পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জলধর কিন্তু অপ্রস্তুত হবার ছেলেই নয়। সে একগাল হেসে বলল, “আমি ইচ্ছে করে তোদের ভুল বুঝিয়েছিলাম। আরে, চোরকে না ধরা পর্যন্ত কি কিছু বলতে আছে—কোনো পাকা ডিটেক্‌টিভ ওরকম করে না। আমি মনে মনে যাকে চোর বলে ধরেছি, সে আমিই জানি।”

 তার পর কদিন আমরা খুব হুঁশিয়ার ছিলাম; আট-দশ দিন আর চুরি হয় নি। তখন জলধর বললে, “তোমরা গোলমাল করেই তো, সব মাটি করলে। চোরটা টের পেয়ে গেল যে আমি তার পেছনে লেগেছি। আর কি সে চুরি করতে সাহস পায়? তবু, ভাগ্যিস তোমাদের কাছে আসল নামটা ফাঁস করি নি।” কিন্তু সেইদিনই আবার শোনা গেল স্বয়ং হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘর থেকে তার টিফিনের খাবার চুরি হয়ে গেছে। আমরা বললাম, “কই, হে? চোর না তোমার ভয়ে চুরি করতে পারছিল না? তার ভয় যে ঘুচে গেল দেখছি।”

 তার পর দুদিন ধরে জলধরের মুখে আর হাসি দেখা গেল না। চোরের ভাবনা ভেবে ভেবে তার পড়াশুনা সব এমনি ঘুলিয়ে গেল যে পণ্ডিতমশায়ের ক্লাশে সে আরেকটু হলেই মার খেত আর কি। দুদিন পরে সে আমাদের সকলকে ডেকে একত্র করল আর বলল তার চোর ধরবার বন্দোবস্ত সব ঠিক হয়েছে। টিফিনের সময়ে সে একটা ঠোঙায় করে সরভাজা, লুচি আর আলুর দম রেখে চলে আসবে। তার পর কেউ যেন সেদিকে না যায়। ইস্কুলের বাইরে যে জিমন্যাস্টিকের ঘর আছে সেখান থেকে লুকিয়ে টিফিনের ঘরটা দেখা যায়। আমরা কয়েকজন বাড়ি যাবার ভান করে সেখানে থাকব। আর কয়েকজন থাকবে উঠোনের পশ্চিম কোণের ছোটো ঘরটাতে। সুতরাং চোর যেদিক থেকেই আসুক, টিফিন ঘরে ঢুকতে গেলেই তাকে দেখা যাবে।

 সেদিন টিফিনের পর পর্যন্ত কারও আর পড়ায় মন বসে না। সবাই ভাবছে কতক্ষণে ছুটি হবে আর চোর কতক্ষণে ধরা পড়বে। চোর ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কি করা যাবে সে বিষয়েও কথাবার্তা হতে লাগল। মাস্টারমহাশয় বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে লাগলেন, পরেশ আর বিশ্বনাথকে বেঞ্চির উপর দাঁড়াতে হল—কিন্তু সময়টা যেন কাটতেই চায় না। টিফিনের ছুটি হতেই জলধর তার খাবারের ঠোঙাটি টিফিন ঘরে রেখে এল। জলধর, আমি অর দশ-বারোজন উঠোনের কোণের ঘরে রইলাম আর একদল ছেলে বাইরে জিমন্যাটিকের ঘরে লুকিয়ে থাকল। জলধর বলল, “দেখ, চোরটা যেরকম সেয়ানা দেখছি। আর তার যেরকম সাহস, তাকে মারধর করা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয়ই খুব ষণ্ডা হবে। আমি বলি সে যদি এদিকে আসে তা হলে সবাই মিলে তার গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব আর চেঁচিয়ে উঠব। তা হলে দরোয়ান-টরোয়ান সব ছুটে আসবে। আর লোকটা পালাতে গেলেও ঐ কালির চিহ্ন দেখে ঠিক ধরা যাবে। আমাদের রামপদ বলে উঠল, “কেন? সে যে খুব ষণ্ডা হবে তার মানে কি? সে তো কিছু রাক্ষসের মতো খায় বলে মনে হয় না। যা র করে নিচ্ছে—সে তো কোনোদিনই খুব বেশি নয়।” জলধর বলল, “তুমিও যেমন পণ্ডিত। রাক্ষসের মতো খুব খানিকটা খেলেই বুঝি খুব ষণ্ডা হয়। তা হলে তো আমাদের শ্যামাদাসকেই সকলের চেয়ে ষণ্ডা বলতে হয়। সেদিন ঘোষেদের নেমন্তন্নে ওর খাওয়া দেখেছিলে তো! বাপু হে, আমি যা বলেছি তার ওপর ফোড়ন দিতে যেয়ো না। আর তোমার যদি নেহাত বেশি সাহস থাকে, তুমি গিয়ে চোরের সঙ্গে লড়াই কোরো। আমরা কেউ তাতে

১২৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২