পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কোনোই কারণ থাকত না। কিন্তু তারা কিনা হঠাৎ কেমন করে খবর না দিয়ে আসে যায়, মানুষের কাছে তাই তাদের এত খাতির। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের লোকেই ধুমকেতুকে একটা অলক্ষণ কিংবা উৎপাত বলে মনে করে। ধুমকেতু যখন আসে তখন যার যা কিছু বিপদ-আপদ সবের জন্যেই ঐ ধুমকেতুকেই লোকে দোষী করে। সে সময়ে রোগ মৃত্যু যুদ্ধ বিদ্রোহ সবই ঐ ধূমকেতুর জন্য। সুতরাং ধুমকেতু এসে পৃথিবী ধ্বংস করবে, এই ভয়টা মানুষের মধ্যে থাকা কিছু আশ্চর্য নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কত বড়োবড়ো দুর্ঘটনাকে যে মানুষ ধুমকেতুর ঘাড়ে চাপিয়েছে তা আর বলে শেষ করা যায় না। নানা দেশের ইতিহাসে নানা সময়কার ধমকেতুর যেরকম অদ্ভুত ভয়ংকর সব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতেই বোঝা যায় যে লোকে তাদের কিরকম ভয়ের চোখে দেখেছে। আমরা ছেলেবেলায় একবার খবরের কাগজে গুজব শুনেছিলাম যে কোথাকার এক ‘পাগলা ধূমকেতু’ নাকি পৃথিবীর দিকে আসছে—আর কোনো জ্যোতিষী নাকি গুণে বলেছেন যে সে অমুক তারিখে এই পৃথিবীকে এমন টুঁ লাগাবে যে তখন কেউ বাঁচে কিনা সন্দেহ। এই খবরটা নিয়ে তখন চারিদিকে খুব একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। কয়েক বৎসর আগে যখন ‘হ্যালির ধুমকেতু’ এসে দেখা দেয় তখন কেউ কেউ গুণে দেখিয়েছিলেন যে ঐ ধূমকেতুর ঝাঁটার মতো লেজটা পৃথিবীর উপর এসে পড়বে। ঐ লেজের বাড়ি থেলে পৃথিবীর অবস্থাটা কি হবে তাই নিয়ে কাগজেপত্রে খানিকটা তর্কাতর্কিও হয়েছিল, কিন্তু সময় হলে দেখা গেল যে তাতে পৃথিবীর তো কিছু হলই না, বরং লেজটাই ছিড়ে দু টুকরো হয়ে গেল। সুতরাং ধুমকেতুর ধাক্কা লেগে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কল্পনাটা কোনো কাজের কল্পনা নয়, কারণ ধূমকেতুর লেজটা এমনই অসম্ভবরকম হালকা যে পৃথিবীর সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে গেলে তারই বিপদ হবার কথা। তবে পণ্ডিতেরা বলেন যে পৃথিবীকে যদি কোনোদিন কোনো ধুমকেতুর মাথাটার ভিতর দিয়ে যেতে হয় তা হলে অবস্থাটা কেমন হয়, ঠিক বলা যায় না। সম্ভবত তখন খুব একটা জমকাল গোছের উল্কাবৃষ্টি হবে।

 উল্কাবৃষ্টি জিনিসটা আমি কখনো চোখে দেখি নি, কিন্তু তার যে বর্ণনা শুনেছি সে ভারি চমৎকার। আকাশে মাঝে মাঝে তারার মতো এক-একটা কি যেন হঠাৎ ছুট দিয়ে কোথায় মিলিয়ে যায়-দেখে লোকে বলে 'তারা খস্‌ল’। কিন্তু আসলে সে তারা নয়—উল্কা। ঐরকম উল্কা যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না খসে একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারে হাজারে আকাশের উপর দিয়ে ছুটে যায় তখন তাকে বলে 'উল্কাবৃষ্টি'। এর মতো জমকাল ব্যাপার অতি অল্পই আছে। আমরা আকাশে যে-সব গ্রহ-নক্ষত্র দেখি তারা সবাই ভালো মানুষের মতো স্থির হয়ে থাকে, তারা ওরকম পাগলের মতো ছুটাছুটি করে না। সুতরাং হাজার হাজার উকাকে অমনভাবে ছুটাছুটি করতে দেখলে হঠাৎ মনে কেমন ভয় হয়—যদি দু-চারটা ঘাড়ে এসে পড়ে, তা হলে অবস্থাটা কিরকম হবে। কিন্তু আসলে তেমন ভয় পাবার কিছুই নেই। উল্কাগুলির প্রায় সমস্তই পৃথিবীতে পড়বার ঢের আগেই বাতাসের ঘষায় আপনা হতেই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদি না জ্বলত তবে আমরা তাদের দেখতেই পেতাম না। কারণ, একে তারা অধিকাংশই নিতান্ত ছোটো, তার উপর তাদের নিজেদের কোনো আলো নেই; কেবল মরবার সময় যখন তারা আপন “বুকের পাঁজর

১৯২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২