পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কানটা মাথার পাশে লাগিয়া থাকিবে কি বাদুড়ের মতো আলগা হইয়া থাকিবে এ বিষয়েও মতভেদ দেখা যায়। সুতরাং দেশ বিশেষে ও জাতি বিশেষে কানের উপরেও নানারকম চাপাচাপি ঠেলাঠেলির কৌশল খাটানো হয়। শরীরটিকে এইরকমে যতটা সম্ভব গড়িয়া পিটিয়া কোনোরকমে পছন্দসই করিতে পারিলে তার পরেও তাহাকে সাজাইবার দরকার হয়। সাজাইবার সবচাইতে সহজ উপায় তাহাতে রঙ মাখানো। এই রঙ লেপিবার শখটি অনেক জাতির মধ্যেই দেখা যায় এবং তাহার রকমারিও অনেক প্রকারের। লাল হলদে সাদা এবং কালো, সাধারণত এই কয়রকম রঙেই সব কাজ চলিয়া থাকে। এই-সকল রঙে সমস্ত দেহখানি চিত্র-বিচিত্র করিয়া আঁকিয়ে দেখিতে কেমন সুন্দর হয় বল দেখি? কেবল যে সৌন্দর্যের জন্যই রঙ লাগানো হয় তাহা নয়, অনেক দেশে লড়াইয়ের সময় বড়োবড় যোদ্ধারা নানারকম রঙ লাগাইয়া অদ্ভুত বিকট চেহারা করিয়া বাহির হয়। রঙ লাগাইবার কায়দা কানুন আবার এমন হিসাবমতো যে তাহাতে জাতি, ব্যবসায়, বংশ প্রভৃতি সমস্ত পরিচয়ই দেওয়া হয়।

 কিন্তু রঙের একটা মস্ত অসুবিধা এই যে জীবন্ত চামড়ার উপর তাহাকে পাকা করিয়া মাখানো চলে না। স্নান করিতে গেলেই বা বৃষ্টিতে ভিজিলেই সমস্ত ধুইয়া যায়-সুতরাং যাহাদের শখ বেশি তাহারা কাঁচা রঙ ছাড়িয়া উল্কি আঁকিতে শুরু করিল। উল্কি আঁকা এক বিষম ব্যাপার। শরীরের মধ্যে ক্রমাগত ছুঁচ বিঁধাইয়া বিঁধাইয়া চামড়ার ভিতরে ভিতরে রঙ ভরিয়া তবে উল্কি আঁকিতে হয়। শৌখিন লোকেরা অল্পে-অল্প দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমন-কি, বৎসরের পর বৎসর এইরূপে শরীরকে রীতিমতো যন্ত্রণা দিয়া উল্কি রচনা করে। উল্কি আঁকার ওস্তাদ যাহারা, লোকে মোটা মোটা মাহিনা দিয়া তাহাদের কাছে উল্কি আঁকাইতে যায়। উল্কির কাজ অনেক দেশেই প্রচলিত, আছে, কিন্তু এ বিষয়ে জাপানীদের মতো কারিকর আর বোধ হয় কোথাও দেখা যায় না।

 উল্কির অসুবিধা এই যে, গায়ের রঙটা নিতান্ত ময়লা হইলে তাহার উপর উকি ভালো খোলে না। সুতরাং আফ্রিকার নিগ্রো জাতিদের মধ্যে, বিশেষত কঙ্গো অঞ্চলের নিগ্রোদের মধ্যে এবং আরো অনেক দেশের কৃষ্ণবর্ণ লোকেদের মধ্যে উল্কির প্রচলন নাই। তাহাদের মধ্যে উল্কির বদলে একরকম ঘা-মরা দাগের ব্যবহার দেখা যায়, সে জিনিসটা উল্কির চাইতেও সাংঘাতিক! প্রথমত শরীরে অস্ত্র খোঁচাইয়া বড়ো-বড়ো ঘা বানাইতে হয়, তার পর নানারকম উপায়ে সেই তাজা ঘাগুলিকে অনেকদিন পর্যন্ত জিয়াইয়া রাখিতে হয়। এতরকম কাণ্ড-কৌশলের পর শেষে ঘা যখন শুকাইয়া উঠে তখন উঁচু উঁচু দাগের মতো তাহার চিহ্ন থাকিয়া যায়। কেবল সৌন্দর্যের খাতিরেই স্ত্রী-পুরুষ সকলে শখ করিয়া এত যন্ত্রণা সহ্য করে। শুনিয়াছি, ইউরোপ ও আমেরিকার কোনো কোনো শৌখিন মেমসাহেব দাঁতের মধ্যে ফুটা করিয়া তাহাতে হীরা মুক্তা বসাইয়া অলংকারের চূড়ান্ত করিয়া থাকেন।

 বাস্তবিক ভাবিয়া দেখিলে, অলংকারের শখটা মানুষের এক অদ্ভুত খেয়াল বলিয়া মনে হয়। রসায়নশাস্ত্রে বলে হীরা আর কয়লা, এই দুইটা আসলে একই জিনিস। যে

২০০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২