পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একদল লোকে পাহাড়ে জমি ভাঙিয়া পিরামিডের ভিত্তি সমান করিতেছিল। সেই ভিত্তির উপর আশ্চর্য কৌশলে ঘর বসাইয়া তাহারই চারিদিকে রাজার সমাধি-মন্দির তৈরি হইয়াছে।

 হেরোডোটস বলেন পিরামিড শেষ করিতে আরো বিশ বৎসর লাগিয়াছিল। কত অসংখ্য ক্রীতদাস কত হাজার হাজার প্রজা মিলিয়া এই কাজে লাগিয়াছিল তাহার আর হিসাব পাওয়া যায় না। কিন্তু একটি যে হিসাব পাওয়া গিয়াছে সে অতি চমৎকার। এক সময়ে পিরামিডের গায়ে আয়-ব্যয়ের একটা ফর্দ লেখা ছিল—তাহারই একটুখানি হেরোডোটসের সময় পর্যন্ত টিকিয়াছিল। তাহাতে দেখা যায় যে মজুরদের খোরাকির জন্য পেঁয়াজ রসুন অর মুলা এই তিন জিনিসেরই খরচ লাগিয়াছিল প্রায় ত্রিশলক্ষ টাকা। এখন ভাবিয়া দেখ সমস্ত পিরামিডটাতে না জানি কত কোটি কোটি টাকা খরচ হইয়াছিল। শোনা যায় রাজা ইহার জন্য তাঁহার যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিয়া একেবারে সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার নিজের ধনরত্ন যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহার প্রায় সমস্তই তাহার সঙ্গে কবরের মধ্যে সমাধিস্থ করা হইয়াছিল। কিন্তু আজ তাহার কিছুই বাকি নাই, আছে কেবল শূন্য কবরের কতগুলা ভাঙা পাথর মাত্র। ভিতরে মূল্যবান যাহা কিছু ছিল মানুষে লুঠ করিয়া তাহার আর কিছু রাখে নাই। পিরামিডের ভিতরটা কিরকম, অনেকদিন পর্যন্ত তাহা জানিবার কোনো উপায় ছিল না, এমন-কি, উহা বাস্তবিকই সমাধিস্তম্ভ কিনা, সে-বিষয়ে নানারকম তর্ক শোনা যাইত। কিন্তু এখন মানুষে আবর্জনা সরাইয়া তাহার ভিতরে ঢুকিবার সুড়ঙ্গ পথ বাহির করিয়াছে। ভিতরের ব্যবস্থাও অতি আশ্চর্য।

 পিরামিডের গোড়ার কাছেই একটা নীচমুখী সুড়ঙ্গ—সেটা খানিক দূরে গিয়া দুমুখো হইয়া গিয়াছে। একটা মুখ মাটির নীচে একটা খালি ঘর পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে—আরএক মুখ উপরের দিকে উঠিয়াছে। সেদিকে রানীর কবরঘর-তার উপর প্রকাণ্ড সিঁড়ি, তার পরে রাজার সমাধি। সমাধির উপরে আবার পাঁচতলা ঘর। তা ছাড়া আরো ছোটোখাটো ঘর আছে, ঘরের মধ্যে বাতাস আনিবার জন্য বড়ো-বড়ো লম্বা নলের মতো-সুড়ঙ্গ আছে—আর আছে কতগুলো বড়ো-বড়ো পাথর যাহার কোনো অর্থ বোঝা যায় না।

 কেবল প্রকাণ্ড জিনিস বলিয়াই যে পিরামিডের সম্মান করি তাহা নয়-যাহারা পিরামিড গড়িয়াছে, ওস্তাদ কারিকর হিসাবেও তাহারা নমস্কারযোগ্য। বড়ো-বড়ো পাথরকে অদ্ভুত কৌশলে তাহারা এমন নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়াছে যে, আজও সেই জোড়ের মুখে একটি ছুঁচ চুকাইবার মতোও ফাঁক হয় নাই। যে চতুষ্কোণ জমির উপরে পিরামিড বানানো হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি কোণ সূক্ষম হিসাবে মাপিয়া সমান করা হইয়াছে, চতুষ্কোণের চারটি দিক এমন নিখুঁতভাবে সমান, যে নিপুণ জরীপের হিসাবে তাহাতে দু আঙুল পরিমাণও তফাত পাওয়া যায় না। ঘড়ির কলের মতো এমন সূক্ষম হিসাব ধরিয়া যে জিনিস খাড়া করা হইল, তাহার ওজন ১৯০,০০০,০০০, উনিশকোটি মণ! এই ভারতবষের অর্ধেক লোককে যদি দাঁড়িপাল্লায় চাপাও তবে এইরকম একটা ওজন পাইতে পার।

২১২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২