পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নানারকম কাজের জন্য নানারকম কাঁচ তৈরি হয়। তা থেকে কাজের জিনিস গড়বার উপায়ও নানারকম। সামান্য একটা গেলাস, বোতল, চিমনি বা কাচের নল বানাবার জন্য কত যে কায়দা কৌশলের দরকার হয়, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। একটি কারিকর একটা লোহার নলে করে খানিকটা গলা কাঁচ নিয়ে, তার মধ্যে ফুঁ দিয়ে, তাকে নেড়ে ঝেড়ে দুলিয়ে ঝুলিয়ে চটপট কত যে আশ্চর্য জিনিস গড়তে পারে সে একটা দেখবার মতো ব্যাপার। নলের মুখটা চুল্লিতে-চড়ানো তরল কাচের মধ্যে ডুবিয়ে নলের আগায় খানিকটা গলা কাঁচ উঠে আসে। তখন সেই নলের মধ্যে ফুঁ দিলে কাঁচটা গোল বুদ্বুদের মতো হয়ে ফুলে ওঠে। নরম থাকতে থাকতে সেই বুদ্‌বুদটাকে লোহার টেবিলের উপর ইচ্ছামতন চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা করা যায়; অথবা গড়িয়ে ডিমের মতন বা ইকোর মালার মতন লম্বাটে করে দেওয়া যায়। কোনো জিনিস গড়তে গড়তে, তার খানিকটা জায়গা আগুনে তাতিয়ে আবার যদি ফুৎ দেওয়া যায় তা হলে সেই তাতান জায়গাটুকু গম্বুজের মতো ফুলে উঠতে থাকে। কিংবা যদি সেটাকে নরম অবস্থায় ঝুলিয়ে পরে আস্তে আস্তে ঘোল-মউনির মতন পাক দেওয়া যায়, তা হলে যেখানটা নরম সেটা চিমনির ডাটা বা নলের মতন লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে। গোল জিনিসের গোড়ায় একটু নল বানিয়ে, তার পর আগার দিকটা গরম করে ফুয়ের জোরে ফাটিয়ে দিলে খাসা একটি বোতলের মুখ বা কলকে তৈরি হয়। এই-সমস্ত নানারকম জিনিসের গায়ে আবার খানিক নরম কাঁচ লাগিয়ে ইচ্ছামতো হাতল বা পায়া গড়ে দেওয়া যায়। এসব শিখতে যা সময় লাগছে, গড়তে গেলে ওস্তাদ লোকের তার চাইতেও কম সময় লাগে।

 এইরকম অনেক জিনিসই আজকাল কলে তৈরি হয়। তার কতক গড়ে ঢালাই করে, কতক বানায় কল দিয়ে বাতাস ফুঁকে, আবার কতকগুলো তৈরি হয় নরম কাঁচের উপর অস্ত্র চালিয়ে। সাধারণ সরাসরি কাঁচ সমস্তই আগে অনেক হাঙ্গাম করে হাতে গড়ে তৈরি হত। তার জন্য প্রথমে ঘাড়-কাটা বোতলের মতো মস্ত মস্ত চোঙা বানিয়ে, তার পর সেইগুলোকে কেটে চিরে, নরম করে, চেপ্টিয়ে ছোটোবড়ো শার্শী তৈরি হয়। কিন্তু খুব বড়ো-বড়ো আরশি আর ভারী ভারী অসিবাবী আয়নাগুলি প্রায় সমস্তই হয় ঢালাই করে। চুল্লির তরল কাঁচ গামলার মতো প্রকাণ্ড হাতায় করে তুলে একটা মস্ত টেবিলের উপর ঢেলে দিতে হয়। তার পর প্রকাণ্ড রোলার দিয়ে সেই গরম কাঁচকে ক্রমাগত বেলে এবং দলে, শেষে পালিশ-করে ঘষে সমান করতে হয়।

 সবচাইতে ভালো আর দামী যে কাঁচ সেগুলো দরকার হয় বিজ্ঞানের কাজে। তা দিয়ে দুরবীন হয়, ফোটো তুলবার ‘লেন্স’ হয়, হাজাররকম যন্ত্র তৈরি হয়। এই-সব কাজের জন্য যে কাঁচ লাগে, সে কাঁচ একেবারে নিখুঁত হওয়া দরকার। তার আগাগোড়া সমান স্বচ্ছ হওয়া চাই। জলের মধ্যে নুন ফেললে সে নুন যেমন গলে গিয়ে সমস্তটা জলের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি করে কাঁচর সমস্ত মসলাগুলি সব জায়গায় ঠিক সমানভাবে সমান ওজনে মিশে যাওয়া চাই। তা যদি না হয়, কাচের মধ্যে কোথাও যদি অতি সামান্য একটুখানিও দাগী বা ঘোলা থেকে যায়, তা হলেই আর তা দিয়ে কোনো সূক্ষ কাজ চলতে পারবে না। সুতরাং এই কাঁচ তৈরি করবার সময় খুব সাবধান হতে হয়।

নানা নিবন্ধ
২৫৩