পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 যে কলের সাহায্যে গলার আওয়াজকে, অথবা অন্য যে কোনোরকম শব্দকে অনেক দূর পর্যন্ত পাঠিয়ে দেওয়া যায় তার নাম 'টেলিফোন’। আজকাল অনেক বড়ো-বড়ো শহরে টেলিফোনের কল দেখতে পাওয়া যায়। লোকে একটা হাতলের মতন জিনিস কানে লাগিয়ে তার চোঙার ভিতর কথা বলে, আর অনেক দূরের লোক সেইরকম আর-একটা কল কানে দিয়ে সে কথা শুনতে পায়। দুজনের মধ্যে খালি সরু তারের যোগ। সেই তারের ভিতর দিয়ে সারাক্ষণ বিদ্যুৎ চলে, আর সেই বিদ্যুতের স্রোত শব্দের ঢেউগুলোকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় পৌঁছে দেয়, এই উপায়ে অনেক মাইল পর্যন্ত শব্দ পাঠানো সম্ভব হয়।

 কিন্তু গোড়ায় যে টেলিফোনের কথা বলা হয়েছে, যাতে তিনলক্ষ লোক একসঙ্গে টেলি-ফোনের আওয়াজ শুনতে পায়, তাতে তার-টার কিছুরই দরকার হয় না। তা যদি দরকার হত, তা হলে ভেবে দেখ কত লক্ষ মাইল তার বসাতে হত আর তার জন্য কত হাজার লক্ষ টাকা খরচ করতে হত। তার বদলে এখন কেবল ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা খরচ করলেই তুমি তোমার ঘরে বসে বহু দূরের কথা ও গান-বাজনা অনায়াসে শুনতে পার।

 আমেরিকায় এই-সমস্ত টেলিফোনের কল তৈরি করা আজকাল একটা মস্ত ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা কল তৈরি করে তারা শহরের একটা কোনো জায়গায় গান বাজনা ও বক্তৃতার স্টেশন বসায়। সেখানে বড়ো-বড়ো কল থাকে, সেই কলে চোঙার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তারা বক্তৃতা করে, গায়কেরা গান গায়। বাতাসে যেমন সর্বদাই শব্দের ঢেউ খেলছে; আকাশেও তেমনি আলোর তরঙ্গ, বিদ্যুতের তরঙ্গ সর্বদাই খেলে বেড়াচ্ছে। স্টেশনের কলগুলির কাজ হচ্ছে সমস্ত কথা ও সুরগুলিকে ধরে তা থেকে বিদ্যুতের তরঙ্গ সৃষ্টি করে তাকে আকাশময় ছড়িয়ে দেওয়া। বিদ্যুতের ঢেউগুলি শব্দের বাহন হয়ে চারিদিকে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ে। সে শব্দ কানে শোনা যায় না, কারণ সে আর বাতাসের ঢেউ নয়, সে এখন বিদ্যুতের তরঙ্গ। সেই বিদ্যুতের তরঙ্গ যখন তোমার বাড়িতে তোমার টেলিফোনের যন্ত্রে এসে আঘাত করে তখন সে আবার শব্দের ঢেউ হয়ে তোমার কানের ভিতরে কথা ও সুরের সৃষ্টি করে। স্টেশনের যন্ত্রের সামনে যে কথা ও যেমন সুর শোনানো হয় ঠিক সেই কথা তেমনি সুরে অতি পরিষ্কারভাবে তুমি ঘরে বসেই শুনতে পারবে।

 প্রতিদিন কোন সময়ে কি হবে তা সব আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া থাকে। যেমন মনে কর বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে, সকাল বেলা আটটা থেকে নটা পর্যন্ত খবর শোনানো হবে। সেই সময়ে যদি টেলিফোনে কান দিয়ে থাকি তা হলে শুনতে পাবে যে একজন লোক পরিষ্কার গলায় সেদিনকার সব খবর শোনাচ্ছে। তার আগের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যত দেশ থেকে যতরকমের খবর এসেছে, একে একে সব বলে যাচ্ছে। কোথায় যুদ্ধবিগ্রহ হল, কোথায় বড়ো-বড়ো মন্ত্রিসভায় কি কি পরামর্শ স্থির হল, কোথায় কতরকমের কি দুর্ঘটনা ঘটল, এইসমস্ত খবর বলছে। তার পর ক্রিকেট, ফুটবল, ঘোড়দৌড় আর নানারকম খেলা ও আমোদের কথা বলছে। তার পর হয়তো নানারকম জিনিসের বাজার দর আর নানারকম ব্যবসাবাণিজ্যের কথা বলছে। সকলের শেষে সেদিন কখন কি হবে জানিয়ে দিচ্ছে—যেমন “আজ তিনটের সময় ঘোড়দৌড়ের ফল বলা হবে,” “পাঁচটার সময় অমুক বিষয়ে অমুক বক্তৃতা করবেন,” “সাতটা থেকে আটটা অমুক অমুক গাইয়ের গান শোনানো হবে, তার পর

২৮৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২