পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিন্তু সকলের চাইতে চমৎকার তাহার খুরের ইতিহাস। আদিকালের সেই পাঁচটি আঙুল কেমন করিয়া এই যুগে একটা ভোঁতা খুর হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহার ইতিহাস অতি সুন্দরভাবে ও স্পষ্টভাবে এই-সকল কংকালের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়। “আদি অশ্বে'র সময়েই পাঁচ আঙুলের একটি প্রায় লোপ পাইয়া আসিয়াছিল। তার পর ক্রমে আর-একটি আঙুলও লোপ পাইল বাকি রহিল মাত্র তিনটি। সংখ্যায় কমিল বটে, কিন্তু মাঝের আঙুলটি ক্রমে মোটা হইয়া লুপ্ত অঙুিলগুলির অভাব দূর করিয়াছে। পাশের আঙুল দুটা ক্রমেই ছোটো হইয়া অনেকদিন পর্যন্ত হাড়ের টুকরার মতো পায়ের দু পাশে লাগিয়া ছিল। তার পর এখনকার ঘোড়ার পায়ে ঐ একটা আঙুলই সবটুকু স্থান দখল করিয়াছে - তাহাকে আর এখন আঙুল বলা চলে না।

 কোন সময় হইতে মানুষ ঘোড়াকে বশ মানিতে শিখাইয়াছিল, তাহা ঠিক বলা যায় না। অতি প্রাচীন যুগের আদিম মানুষ যাহারা বনে-জঙ্গলে গুহা-গহ্বরে বাস করিত, তাহাদের শেষ চিহ্নের আশেপাশে লোমশগণ্ডার, অতিকায় হস্তী, খদন্ত ব্যাঘ্র ও গুহা ভল্লুক প্রভৃতি জানোয়ারের কংকালচিহ্ন আজও পাওয়া যায়। ঘোড়ার ঐ তিন আঙুলওয়ালা পূর্বপুরুষদের কেহ যে মানুষের কাজে লাগে নাই, তাহাই-বা কে বলিতে পারে?

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২৪
প্রাচীন কালের শিকার

 মানুষকে যদি কেবল জন্তু হিসাবে শরীরের গঠন দেখিয়ে বিচার করা যায়, তবে তাহাকে নিতান্তই অনাড়ি জানোয়ার বলিতে হয়। সে না পারে ঘোড়ার মতো দৌড়াইতে, না জানে ক্যাঙারুর মতো লাফাইতে। দেহের শক্তি বলে অথবা নখ দাত প্রভৃতি যে-কোনো অস্ত্রের কথা বলো, সব বিষয়েই সে অন্যান্য অনেক জাননায়ারের কাছে হার মানিতে বাধ্য। অথচ এই মানুষই এখন আর-সব জানোয়ারের উপর টেক্কা দিয়া এই পৃথিবীতে রাজত্ব করিতেছে। এখনকার যুগের মানুষ তো অত্মরক্ষার জন্য সহস্ররকম উপায় করিয়া রাখিয়াছে—শহর বাড়ি লোকালয় বানাইয়া সে বনের জন্তুর কাছ হইতে আশ্রয় পাইবার নানাপ্রকার ব্যবস্থাও করিয়াছে। কিন্তু সেই আদিমকালের মানুষ, যার ঘরও ছিল না বাড়িও ছিল না—সে বন্দুক চালাইতে শিখে নাই, এমন-কি, তলোয়ার বল্লম পর্যন্ত বানাইতে পারিত না—সে কেমন করিয়া এতরকম হিংস্র জন্তুর সঙ্গে রেষারেষি করিয়া টিকিয়া রহিল, ভাবিতে আশ্চর্য লাগে।

 সে যুগের মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইত। কেহ গুহা-গুহ্বরে, কেহ গাছের ডালে বাসা লইয়া বনের পশুর হাত হইতে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিত। চলিতে ফিরিতে কতরকম হিংস্র জন্তু আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইত—তাহাদের কোনো-কোনোটা এ যুগের জানোয়ারগুলির চাইতেও ভয়ানক। যেখানেই সেই প্রাচীন মানুষের কংকাল পাও—তাহারই অশেপাশে সেই-সব পাথরের স্তরের মধ্যেই দেখিবে আরো কতরকম জানোয়ারের কংকালচিহ্ন

জীবজন্তুর কথা
৩১৭