পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



ভূমিকা

বাঙলা সাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও সুকুমার রায়-এর পরিচিতি ও খ্যাতি মুলত, শিশুসাহিত্যিক রূপে। কিন্তু বাঙলা সাহিত্যের সামগ্রিক পটভূমিতে এদের সমগ্র সাহিত্যসৃষ্টির বৈচিত্র্য ও বিশিষ্টতার যদি সত্যিই কোনোদিন সার্থক মূল্যায়ন হয়—তবে আমরা সহজেই উপলব্ধি করব—সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের বিচারের এই পিতা-পুত্র বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। অবশ্য এ কথা উল্লেখ করা বাহুল্য যে, বাঙলা শিশু সাহিত্য বাঙলা সাহিত্যের কোনো বিচ্ছিন্ন অংশমাত্র নয়, তারই অঙ্গীভুত একটি বিশিষ্ট ধারা। এই বিশিষ্ট ধরার দুই ভিন্ন যুগের দুজন উজ্জ্বল স্বতন্ত্র পুরুষ হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার—এবং এটাই এদের প্রধানতম পরিচয়।

 বাঙলা শিশুসাহিত্যের উৎস সন্ধান করতে গেলে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা, রূপকথা, ছেলে ভুলানো ছড়া ইত্যাদির কথা স্বভাবতই মনে পড়বে। তথাপি আধুনিক অর্থে বাঙলা শিশুসাহিত্যের সুত্রপাত উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় প্রভাবেরই ফল—এ কথা অস্বীকার করা যায় না। এই অর্থে বাঙলা শিশুসাহিত্যের উদ্যোগ পর্বে বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্ত-রাজেন্দ্রলাল প্রমুখের পাঠ্য-রচনার কিংবা এই সময় প্রকাশিত ‘পত্রাবলী'ইত্যাদি পত্রিকায় শিশু বা বালকদের জন্য রচনাকে চিত্তহারী করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও পাঠাপুস্তকের শিক্ষা বা নীতি-উপদেশের অতিরিক্ত কিছু করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। যদিও বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত প্রমুখ প্রতিভাবানদের স্পর্শে এর কোনো কোনো অংশ তুলনামূলকভাবে শিশু-উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু শিশুর বিষয় নিয়ে শিশুর জন্য রচনার সূত্রপাত হয় এর পরবর্তী পর্বে।

  যোগীন্দ্রনাথ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখ শিশুসাহিত্যিকদের উজ্জ্বল সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে শিশুসাহিত্যের এই স্বর্ণযুগের শুরু হয়। শিশুতোষ রচনার জাদুকর যোগীন্দ্রনাথ সরকার ‘মাতৃভাষার আনন্দরূপের পরিচয় নিয়ে তিনি বাংলাদেশের শিশুর প্রথম অশ্রুহীন বর্ণপরিচয় ঘটালেন তার ছড়া ও ছবির মধ্যে দিয়ে। কিন্তু খেলাচ্ছলে হলেও তার মাথা থেকে স্কুলের চিন্তা নির্বাসিত হয় নি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারই প্রথম এলেন শিশুকে গল্প শোনাতে। রূপকথার রাজ্যের নতুন দরজা খুলে গেল বাংলাদেশের শিশুর কাছে। কিন্তু তিনিও পূর্ব ধারার সম্পূর্ণ রেশমুক্ত হতে পারলেন না। তাঁর 'চার ও হারু’ উপন্যাসের সর্বাঙ্গে নীতি-উপদেশের গন্ধ প্রকট। এই যুগে ‘শিশুর বিষয় নিয়ে শিশুর জন্য যিনি প্রথম গল্প শোনালেন, তাঁর নাম—উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যার জগতে কৈশোর সমস্ত কিছুরই মাপকাঠি। এতদিনের চলতি ধারায় এ যেন এক বিদ্রোহের আভাস। প্রথার আনুগত্য বা “অতি মৌল শিক্ষাব্রতীর অভিমান” এই দুটিই বিসর্জন দিয়ে, শিশুকে তিনিই প্রথম ইস্কুলের বাইরে গল্প শুনতে ডাকলেন।

 শিশুসাহিত্যের এই স্বর্ণযুগ রবীন্দ্রপ্রতিভার আংশিক দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে এটা ঠিকই। কিন্তু 'সহজ পাঠ’ ইত্যাদি পাঠ্যপুস্তকের সাফল্য বাদ দিলে, রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুসাহিত্য' হিসেবে চিহ্নিত রচনা প্রায় সম্পূর্ণই শিশুবিষয়ক কিন্তু শিশুর জন্য নয়। তাঁর বিচিত্র সাহিত্য জীবনের একটি ভগ্নাংশে তার শৈশব-সাধনা। উপরন্তু তাঁর কবি মেজাজটি সম্পূর্ণ শিশুসর্বস্ব হওয়া সম্ভব ছিল কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। তবুও মহাকবির কলমের গুণে বহু জায়গায় তা শিশুর পক্ষেও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর প্রমুখের সাহিত্য-সাধনার ধারায় শিশুর জন্য রচনা শুধু সর্বপ্রধানই নয়, প্রায় সর্বস্ব।

 এর পরবর্তী পর্বকে বাঙলা শিশুসাহিত্যের প্রতিষ্ঠা ও জয়যাত্রার যুগ বলা যায়। এই যুগের শিশুসাহিত্য উপকরণে বিচিত্র, উদ্ভাবনে নিপুণ। আর এই দুই যুগের সেতুবন্ধী 'সওদাগর’ হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।