পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বসিয়া মাস্টারমহাশয় জুতা সেলাই করিতেছেন আর পড়া বলিয়া দিতেছেন, আর চারিদিকে প্রায় চল্লিশটি ছাত্রের কোলাহল শুনা যাইতেছে। কেহ পড়িতেছে, কেহ লিখিতেছে, কেহ অঙ্ক বুঝাইয়া লইতেছে। কেহ সিঁড়ির উপর, কেহ মেঝের উপর, কেহ চৌকিতে, কেহ বাক্সে—আর নিতান্ত ছোটোদের কেহ কেহ হয়তো মাস্টারের কোলে—এই- রকম করিয়া মহা উৎসাহে লেখাপড়া চলিয়াছে। বাহিরের লোকে ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া অবাক হইয়া এই দৃশ্য দেখিত।

 গরিব মাস্টার ছাত্রদের কাছে এক পয়সাও বেতন লইত না-এতগুলি ছাত্রকে সে বই জোগাইবে কোথা হইতে? তাহাকে শহরে ঘুরিয়া পুরানো পুঁথি, ছেঁড়া বিজ্ঞাপন প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে হইত, এবং তাহাতেই ছেলেদের পড়ার কাজ কোনোরকমে চলিয়া যাইত। কয়েকখানা শ্লেট ছিল, তাহাতেই সকলে পালা করিয়া লিখিত। পাঠশালায় সামান্য যোগ বিয়োগ হইতে ত্রৈরাশিক পর্যন্ত অঙ্ক শিখানো হইত। কেবল তাহাই নয়, এই-সমস্ত ছেলেমেয়েরা তাহার কাছে কাপড় সেলাই করিতে এবং জুতা মেরামত করিতেও শিখিত। সকলে মিলিয়া তীর-ধনুক ব্যাট-বল ঘুড়ি-লাটাই খেলনা-পুতুল প্রভৃতি নানারকম জিনিস নিজেরাই তৈয়ারি করিত। তাহাদের খাওয়া-পরার সমস্ত অভাবের কথাও গরিব মাস্টারকেই ভাবিতে হইত। এই-সমস্ত দেখিয়া-শুনিয়া জন পাউসের উপর কোনো- কোনো লোকের শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। তাহারা মাঝে মাঝে গরম কাপড়-চোপড় পাঠাইয়া দিত। সেই-সব কাপড় পরিয়া ছেলেমেয়েরা যখন উৎসাহে খোড়া মাস্টারের সঙ্গে বেড়াইতে বাহির হইত, তখন মাস্টারমহাশয়ের মুখে আনন্দ আর ধরিত না।

 এমন করিয়া কত বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল, জন পাউণ্ডস বুড়া হইয়া পড়িল, কিন্তু তাহার পাঠশালা চলিতে লাগিল। আগে যাহারা ছাত্র ছিল, তাহারা ততদিনে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে। কতজনে নাবিক হইয়া কত দেশ-বিদেশে ঘুরিতেছে, কতজনে সৈনাদলে ঢুকিয়া যুদ্ধে বীরত্ব দেখাইতেছে। নূতন ছাত্রদের পড়াইবার সময়ে এই-সব অতি পুরাতন ছাত্ররা তাদের বৃদ্ধ গুরুকে দেখিবার জন্য পাঠশালায় হাজির হইত। তাহারই ছাত্রেরা যে সৎপথে থাকিয়া উপার্জন করিয়া খাইতেছে, এবং এখনো যে তাহারা তাহাদের খোড়া মাস্টারকে ভোলে নাই, এই ভাবিয়া গৌরবে আনন্দে বৃদ্ধের দুইচক্ষু দিয়া দরূদ করিয়া জল পড়িত।

 ১৮৯৩ খৃস্টাব্দে নববর্ষের দিনে বাহাত্তর বৎসর বয়সে পাঠশালার কাজ করিতে করিতে বৃদ্ধ হঠাৎ শুইয়া পড়িল। বন্ধুবান্ধব উঠাইতে গিয়া দেখিল, তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। হয়তো তখনো লোকে ভালো করিয়া বোঝে নাই যে কত বড়ো মহাপুরুষ চলিয়া গেলেন। তাহার পর প্রায় আশি বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এখন ইংলণ্ডের শহরে- শহরে অসহায় গরিব শিশুদের শিক্ষার জন্য কত ব্যবস্থা, কত আয়োজন। কিন্তু এ- সমন্তের মূলে ঐ খোঁড়া মুচির পাঠশালা। সেই পাঠশালায় যাহারা পড়িতে আসিত, কেবল তাহারাই যে জন পাউণ্ডসের ছাত্র, তাহা নয়—যাহারা নিজেদের অর্থ দিয়া, দেহের শক্তি দিয়া, একাগ্র মন দিয়া, অসহায় গরিব শিশুদের শিক্ষা ও উন্নতির চেষ্টা করিতেছেন তাহারা অনেকেই গৌরবের সঙ্গে এই খোঁড়া মুচিকে স্মরণ করিয়া বলিতেছেন, “আমরাও আচার্য জন পাউণ্ডসের শিষ্য।”

জীবনী
৮১

সু.স.র.— ২-১০