পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছাতা কাঁধে, জুতা হাতে, নোংরা ঘোলা কালো
    হাঁটু, জল ঠেলি চলে যত লোকে রাস্তাতে!
অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, বিচ্ছিরি রাস্তা,
    ধরণী, মহা দুর্দম কর্দমগ্রস্তা,
    যাওয়া দুষ্কর, মুস্কিল রে, ইস্কুলে,
সর্দিজ্বরে, বৃদ্ধি বড়, নিত্যি লোকে বদ্যি ডেকে তিক্ত বড়ি খায়!”

 আগেই আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন, ক্রমে অভিনয়ের পালা শুরু হল। প্রথম প্রথম অন্যদের লেখা নাটক, তারপর তাঁর নিজের নাটক ‘রামধনবধ’, একদিকে যেমন তাঁর নাট্যকৃতির প্রথম প্রয়াস, অন্যদিকে তেমনি তাঁর দেশপ্রেমের পরিচায়ক। দুঃখের বিষয় এর কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না, কিন্তু পুণ্যলতা লিখেছেন—“র‍্যাম্স্ডেন (রামধন) সাহেব মস্ত সাহেব, আসল সাহেবরা তার কাছে কোথায় লাগে! ‘নেটিভ নিগার’ দেখলেই সে নাক সিঁটকোয়, পাড়ার ছেলেরাও তাকে দেখলেই চেঁচায় ‘বন্দে মাতরম!’ আর সে রেগে তেড়ে মারতে আসে, বিদঘুটে গালাগালি দেয়, পুলিশ ডাকে। এহেন সাহেব কি করে ছেলেদের হাতে জব্দ হলো, তারই গল্প।”

 রামধনবধের একটা গান—

         “আমরা দিশি পাগলার দল,
         দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি
(তাহোক) এতে দেশেরই মঙ্গল।”

লেখা হয়েছিল মেজভাই মণির প্রতি পরিহাসছলে। সেই সময়ে বঙ্গভঙ্গের ফলে দেশে জাতীয় চেতনার একটি বিরাট উচ্ছ্বাস উঠেছিল। মেজভাই সবিনয় স্বদেশীর নেশায় মেতেছিলেন। তখন দিশি শিল্পজাত জিনিস পাওয়া দুষ্কর ছিল এবং যাও বা পাওয়া যেতো তাও ছিল অতি নিম্নমানের, কিন্তু সুবিনয় দিশি সততার মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারাব্যাঁকা পেয়ালপিরিচ খুঁজেপেতে নিয়ে এসে বাড়ির সবাইকে দিয়ে ব্যবহার করাতেন। এই জন্যেই ঠাট্টা। এই সুকুমারই আবার গম্ভীরভাবের স্বদেশপ্রেমের গান লিখেছিলেন—‘টুটিল কি আজ ঘুমের ঘোর।’

 বন্দেমাতরমের যুগের আগেই যে সুকুমার দেশের কথা ভাবতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গের আগে ১৮৯৪ থেকে ১৯০৩ পর্যন্ত বুঅর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই বটিশ শক্তির সমর্থন করতেন। একদিন কাগজে একটা যুদ্ধে ইংরেজের জয়ের খবর পড়ে পুণ্যলতা আনন্দ প্রকাশ করাতে সকুমার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “নিজেরা মার খেয়ে মাটিতে পড়ে আছিস আবার অন্যের মার খাওয়া দেখে হাসছিস!”

 এই সময়ে সুকুমারের ফোটোগ্রাফির “সখ”টা পরিণত হচ্ছিল। তিনি বিলিতি কাগজে ছবি পাঠিয়ে পুরস্কার পেতে আরম্ভ করেছিলেন এবং আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি অনেকের ছবি তুলে দিতেন।

 কিশোর সুকুমার হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছিলেন, চরিত্রেও পরিণত হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু তাঁর ছেলেমানুষী যায় নি। বস্তুত এই আজীবন-ছেলেমানুষী তাঁর রসের বিশেষ লক্ষণ ছিল।

সুকুমার সমগ্র রচনাবলী