ঘোড়া ধরল। তখন বসন্তের প্রথম কিরণে পুবের মেঘে রঙ ধরেছে, দক্ষিণ বাতাস জেগে উঠছে।
অসুর বুঝল এ-সমস্তই দেবতার ফাঁকি। কোথায়-বা চন্দ্র সূর্য, কোথায় -বা দেবকন্যা ফ্রেয়া! এতদিনের পরিশ্রম সব একেবারেই পণ্ড। ভাবতে ভাবতে অসুরের মাথা গরম হল, ভীষণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে দেবতাদের সে মারতে চলল। দূর থেকে তার মূর্তি দেখেই দেবরাজ থর্ বুঝলেন, অসুর আসছে স্বর্গপুরী ধ্বংস করতে। তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে তাঁর বিরাট হাতুড়ি ছুঁড়ে মারলেন। অসুরের বিশাল দেহ চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ল।
কিন্তু, দেবতাদের মনে আর শান্তি রইল না। এই অন্যায় কাজের জন্য তাঁরা লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। দেবতাদের মুখ মলিন দেখে সাগরের দেবতা ইগিন বললেন, “আমার প্রবালপুরীতে রাজভোজ হবে, তোমরা এস—ভাবনাচিন্তা দূর কর।” দেবতাদের সবাই এলেন, কেবল লোকিকে কেউ খবর দিল না। সবাই যখন ভোজে বসেছেন, লোকি তখন জানতে পেরে ভোজের সভায় হাজির হয়ে সকলকে গাল দিতে দিতে বিনা দোষে ইগিনের প্রিয় দাস ফন্ফেন্কে মেরে ফেলল। দেবতারা অনেক দিন অনেক সয়েছেন, আজকে তাঁরা সহ্য করতে পারলেন না। লোকির সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের কথা তাঁদের মনে পড়ল। তাঁরা বললেন, “এই লোকির জন্য স্বর্গের সর্বনাশ হচ্ছে। এই হিংসুকে লোকি থরের স্ত্রীর সোনার চুল চুরি করেছিল; এই কাপুরুষ লোকিই বাজি রেখে নিজের মুণ্ড পণ ক’রে বাজি হেরে পালিয়েছিল; এই বিশ্বাসঘাতক লোকিই স্বর্গের অমৃতফল অসুরের হাতে দিয়েছিল; এই হতভাগা লোকিই ফ্রেয়াকে রাক্ষসের কাছে পাঠাতে চেয়েছিল; এই চোর লোকিই ফ্রেয়ার গলার সোনার মালা সরাতে গিয়ে হিমদলের হাতে সাজা পেয়েছিল; এই পাষণ্ড লোকিই নিষ্পাপ বলোদরের মৃত্যুর কারণ! এই লোকি পৃথিবীতে গিয়ে অত্যাচার করে, পাতালে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে মন্ত্রণা করে! মারো এই অপদার্থকে।”
লোকি প্রাণভয়ে পালাতে গেল কিন্তু স্বয়ং দেবরাজ থর্ আর আদি দেবতা অদিন যখন তাঁর পিছনে ছুটলেন, তখন সে আর পালাবে কোথায়? বিষের ঝরনার নিচে হাত-পা বেঁধে লোকিকে ফেলে রাখা হল। লোকির স্ত্রী সিগিন যতক্ষণ ঝরনাতলায় পাত্রে ক’রে বিষ ধরেন আর ফেলে দেন, ততক্ষণ লোকি একটু আরাম পায়; আর সিগিন যদি মুহূর্তের জন্য খেতে যান কি ঘুমিয়ে পড়েন, তবে বিষের যন্ত্রণায় লোকির আর সোয়াস্তি থাকে না। দেবতারা ভাবলেন, স্বর্গের পাপ দূর হল, স্বর্গে এবার শান্তি এল। কিন্তু হায়! তার অনেক আগেই পাপের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে। লোকির জন্য স্বর্গের পাপ মর্ত্যে নেমেছে, পাতালে ঢুকে অসুর পিশাচ দৈত্য দানব সবগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে। যে বনের লোহার গাছে লোহার পাতা, সেই বনের ছায়ায় বসে লোকির রাক্ষসী স্ত্রী অঙ্গুর্বদা নেকড়ে-মুখো পিশাচ-রাহুদের যত্ন করে পাপীর হাড় আর পাপীর মজ্জা খাইয়ে খাইয়ে বাড়িয়ে তুলছে। তারা চন্দ্র সূর্যের পিছন পিছন যুগের পর যুগ ছুটে বেড়ায়। এতদিনে খেয়ে খেয়ে তাদের মূর্তি এমন ভীষণ হল যে চন্দ্র সূর্য ম্লান হয়ে কাঁপতে লাগল, পৃথিবী চৌচির হয়ে ফেটে উঠল, আকাশের নক্ষত্রেরা খসে খসে পড়তে লাগল। পাতালের রক্তকুকুর আর রাহুর বাপ ফেনরিস বিকট শব্দে ছুটে বেরোল। লোকি তার বাঁধন ছিঁড়ে লাফিয়ে