পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সাধ্যি নেই। হাতে তাঁর এক শিঙের বাঁশি, সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল জুড়ে হুঙ্কার বাজবে, ‘সাবধান!’ ‘সাবধান!’—সেই সঙ্গে ত্রিভুবনের সকল প্রাণী কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠবে। এমনি করে প্রস্তুত হয়ে হীমদল সেখানে পাহারা দিতে লাগলেন।

 কিন্তু দেবতাদের মনের ভয় তবুও কিছু কমল না। তাঁরা বললেন, “বিপদ বুঝে সাবধান হয়েও যদি বাইরের শত্রুকে ঠেকাতে না পারি, তখন আমাদের উপায় হবে কি? যদি বাঁচতে হয় তো অক্ষয়দুর্গ গড়তে হবে। আকাশজোড়া স্বর্গটিকে দুর্গ দিয়ে ঘিরতে হবে।” কিন্তু তেমন দুর্গ বানাবে কে? নানাজনে নানারকম মন্ত্রণা দিচ্ছেন, কিন্তু কোন কিছুই মীমাংসা হচ্ছে না। এমন সময় কোথাকার এক অজানা কারিগর এসে খবর দিল হুকুম পেলে আর বকশিশ পেলে সে অক্ষয়দুর্গ বানাতে পারে। হিমের অসুর মামতুরষ যে ছদ্মবেশে কারিগর হয়ে এসেছেন, দেবতারা তা বুঝতে পারলেন না। তাঁরা বললেন, “কিরকম তুমি বকশিশ চাও?” কারিগর বলল, “চন্দ্র চাই, সূর্য চাই, আর স্বর্গের মেয়ে ফ্রেয়াকে চাই।”

 আবদার শুনে দেবতারা সব রেগে উঠলেন। সবাই বললেন, “বেয়াদবকে দূর করে দাও।” কিন্তু দেবতাদের মধ্যে একজন ছিলেন, তাঁর নাম লোকি; তিনি সকলরকম দুর্বুদ্ধির দেবতা। লোকি বললেন, “আচ্ছা, কাজটা আগে করিয়ে নিই না—তারপর দেখা যাবে।” দুষ্টু দেবতার কূট-মন্ত্রণা শুনে দেবতারা সব মামতুরষকে বললেন, “তুমি চন্দ্র পাবে, সূর্য পাবে, দেবকন্যা ফ্রেয়াকে পাবে, যদি একলা তোমার ঘোড়ার সাহায্যে শীতকালের মধ্যে এ কাজটাকে শেষ করতে পার।” ছদ্মবেশী অসুর বলল, “অতি উত্তম! এই কথাই ঠিক রইল।”

 সেদিন থেকে মামতুরষের বিশ্রাম নেই। সারাদিন সে পাথর বয়ে ঘোড়াকে দিয়ে স্বর্গে তোলায়, সারারাত দুর্গ বানায়। দেবতারা ঠিক যেমন-যেমন বলে দিয়েছেন, তেমনি করে পাথরের পর পাথর জুড়ে আকাশ ফুঁড়ে অক্ষয়দুর্গ গড়ে উঠেছে। শীত যখন ফুরোয় ফুরোয়, তখন দেবতারা দেখলেন, সর্বনাশ! দুর্গের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, একটি মাত্র ফটক বাকি—সে ত শুধু একদিনের কাজ! এখন উপায়? এত দিনের চন্দ্র সূর্য স্বর্গ থেকে খসে পড়বে? সুন্দরী ফ্রেয়া শেষটায় কিনা অজানা এক কারিগরকে বিয়ে করবে? ভয়ে ভাবনায় ক্ষেপে গিয়ে সবাই বললে, “হতভাগা লোকির কথায় আমাদের এই বিপদ হল, ও এখন এর উপায় করুক, তা না হলে ওকেই আমরা মেরে ফেলব।”

 লোকি আর করবে কি? সন্ধ্যা হতেই সে স্বর্গ হতে বেরিয়ে দেখল, অনেক দূরে মেঘের নিচে কারিগরের ঘোড়া পাহাড়ের সমান পাথর টেনে ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। লোকি তখন মায়াবলে আকাশ-ঘোটকীর রূপ ধ’রে চিঁহি চিঁহি ক’রে অদ্ভুত সুরে ডাকতে ডাকতে একটা বনের ভিতর থেকে দৌড়ে বেরোল। সেই শব্দে মামতুরষের ঘোড়া চম্‌কে উঠে, লাগাম ছিঁড়ে, সাজ খসিয়ে, উর্ধ্বমুখে মন্ত্রে-চালান পাগলের মত ছুটে চলল। দিক-বিদিকের বিচার নেই, পথ-বিপথের খেয়াল নেই, আকাশের কিনারা দিয়ে, আঁধারের ভিতর দিয়ে, বনের পর বন, পাহাড়ের পর পাহাড়, কেবল ছুট্‌ ছুট্‌ ছুট্‌। লোকিও ছুটেছে, ঘোড়াও ছুটেছে, আর ‘হায় হায়’ চিৎকার ক’রে পিছন পিছন মামতুরষ ছুটে চলেছে। এমনি করে শীতকালের শেষ রাত্রি প্রভাত হল, দুষ্টু দেবতা শূন্যে কোথায় মিলিয়ে গেল, অসুর এসে হাঁপাতে হাঁপাতে

৮০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী