পাতা:স্মৃতির রেখা - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কলািবলিয়াতে স্নান করতে এলাম। ঠাণ্ডা জলে নাইতে নাইতে ভাবছিলামঐ আমাদের গ্রামের ইছামতী নদী। আমি একটা ছবি বেশ মনে করতে পারি।-এই রকম ধুধু বলিয়াড়ী, পাহাড় নয় শান্ত, ছোট, স্নিগ্ধ ইছামতীর দু’পাড় ভরে ঝোপে ঝোপে কত বনকুসুম, কত ফুলে ভরা ঘেটুবন, গাছপালা, গাঙশালিকের বাসা, সবুজ তৃণাচ্ছাদিত মাঠ । গায়ে গায়ে গ্রামের ঘাট, আকন্দ ফল। গত পাঁচশত বৎসর ধ’রে কত ফুল ঝ'রে প’ড়ছে-কত পাখী কত বনঝোপ আসছে যাচ্ছে । স্নিগ্ধ পাটা শেওলার গন্ধ বার হয়, জেলেরা জাল ফেলে, ধারে ধারে কত গৃহস্থের বাড়ী ।। কত হাসিকান্নার মেলা । আজ পাচশত বছর ধ’রে কত গৃহস্থ এল, কত হাসিমুখ শিশু প্রথমে মায়ের সঙ্গে নাইতে এল-কত বৎসর পরে বুদ্ধাবস্থায় তার শ্মশানশয্যা হ’ল ঐ ঠাণ্ডা জলের কিনারাতেই, ঐ বঁাশবনের ঘাটের নীচেই। কত কত মা, কত ছেলে, কত তরুণ তরুণী সময়ের পাষাণবত্মা বেয়ে এসেছে গিয়েছে মহাকালের বীথি পািখ বেয়ে। ঐ শান্ত নদীর ধারে ঐ আকন্দ ফল, ঐ পাটা শেওলা, বনঝোপ, ছাতিমন্বন । এদের গল্প লিখবো, নাম হবে ইছামতী । সন্ধ্যার পর কমলাকুণ্ডু থেকে বেরুলাম। দিব্যি জ্যোৎস্না উঠেছে। বালুর উপর চকচকে জ্যোৎস্না ! জয়পালের নৌকাতে পার হ’তে হ’তে বড় ভাল লাগছিল। আর ভাবছিলাম-আজি বৃহস্পতিবার, এই জ্যোৎস্নায় আমাদের দেশে দারিঘাটের পুলের কাছ দিয়ে এসময় হাট ক’রে কেউ হয়তো ফিরছে। রাত্তিরে কারা মাছ ধ’রছে।-রাজ সিং জালসমেত ধ’রে নিয়ে এল, ছেড়ে দিলাম। তারপর ফিনকিফোটা জ্যোৎস্না রাত্ৰে কাশীবনের মধ্য দিয়ে আমি ও নায়েব পাশাপাশি ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সীমানার কাছে যেখানে ওবেলা মহিষ দেখেছিলাম। ওখানে এলাম। মনে হ’ল দূরে আমার বাড়ী। এই জ্যোৎস্না-উঠা সন্ধ্যায় মারি সঞ্চিত হাড়িকলসীগুলো প’ড়ে আছে জঙ্গলভরা ভিটেতে । মার হাতের সজনে গাছটা এই ফাগুন দিনে জঙ্গলের মধ্যে ফুলে ভৰ্ত্তি হয়ে উঠছে। কেউ দেখছে না, কেউ ভোগ করছে না । হরি রায়ের জমিটুকু নেবার কথা মা যখন সইমাকে অনুরোধ ক’রেছিলেন, তখন তিনি জানতেন না যে ছেলে তার ঘর-কুনো গোরস্ত গোছের ছাপোষা গেয়ে মানুষ হবে না। সে দেশে দেশে বহু দূরে বহু সমাজে পাহাড়ে পৰ্ব্বতে ঘোড়ায় ষ্টীমারে ট্রেনে-সারা জগতের অধিবাসী হয়ে বেড়াবে। জীবনের মাত্রাপথের সে হবে উৎসাহী উন্মত্ত পথিক-পথের নেশাতেই ভোর । OY