পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/আন্ধা বন্ধু

উইকিসংকলন থেকে

আঁধাবন্ধু

 ১৯৩০ সালের ২০শে মার্চ্চ চন্দ্রকুমার দে বুদ্ধু নামক হাজাং শ্রেণীর এক ব্যক্তি ও মঙ্গলনাথ নামক খালিয়াজুড়ির এক ভিক্ষাজীবীর নিকট হইতে এই পালা সংগ্রহ করেন। এই গানের ঠিক অনুরূপ একটি গান পার্ব্বত্য হাজাংদের মধ্যে প্রচলিত আছে। সেই গানটি হয় ত মূল গান; নিম্ন সমতল ভূমির হাজাং ও বাঙ্গালীরা উক্ত গানটি কতকটা নিজেদের ভাষায় রূপান্তরিত করিয়া ইহাকে বর্ত্তমান আকারে পরিণত করিয়াছে। এই গানে চণ্ডীদাসের ও রামীর প্রেম-সম্বন্ধে ইঙ্গিত আছে—চণ্ডীদাসের গানের ভাষা ও আঁধাবন্ধুর ভাষা প্রায় একরূপ,—ভাবেও অনেকটা ঐক্য আছে। সেই বাঁশের বাঁশীর মোহিনী শক্তি যাহাতে অচল জড় জগৎ সচল হয়, যাহা স্বৰ্গ ও পৃথিবীকে এক স্বর্ণসূত্রে বাঁধিয়া ফেলে এবং চন্দ্রোদয়ে বারিধিবক্ষের মত যাহার সুরলহরী রমণীহৃদয়কে আন্দোলিত করিয়া তাহার ললাটে কলঙ্কের টীকা দিয়া তাহাকে কুলত্যাগিনী করায়—সেই বাঁশের বাঁশীর অলৌকিক আকর্ষণের কথা এই পালাটির ছত্রে ছত্রে আছে। ভালবাসার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করাই কবির উদ্দেশ্য এবং এই বিষয়েও চণ্ডীদাসের সঙ্গে কবির মিল দেখা যায়। আমার মনে হয় যদিও পালাটি চণ্ডীদাসের পরে লিখিত, তথাপি তাঁহার বহু পরের নহে; চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে এই পালাটি বিরচিত হইয়াছিল বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।

 এই গানটিকে গীতি-কবিতার একটি মধুচক্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ইহা রসের মুক্ত পরিবেশন। ভালবাসার অমৃতনিষেকে একটা কলঙ্কের ব্যাপার নিষ্কলঙ্ক,—একটা নীতি-বিগৰ্হিত জিনিষ স্বৰ্গীয় সুষমামণ্ডিত হইয়াছে। বিবাহিত রমণী তাঁহার স্বামীকে বলিয়া কহিয়া পরামুগামিনী হইতেছেন, এরূপ দুর্নীতি কাব্য-সাহিত্যে আর কোথায় আছে? হিন্দুসমাজে সতীত্বের ডঙ্কা এরূপ জোরে বাজিয়া উঠিয়াছে যে এরূপ একটা প্রেমকাহিনীর অস্তিত্ব অসম্ভব বলিয়া মনে হইতে পারিত যদি না ইহা আমরা চাক্ষুষ দেখিতাম। এই কুল-কলঙ্কিনী লোকলোচনে অতীব বিসদৃশ,―ইহার প্রতি কাহার সহানুভূতি থাকিতে পারে! কিন্তু হিন্দু সমাজের বৃদ্ধ অভিভাবকগণ নীতির তুলাদণ্ড ধরিয়া একদিকে সূক্ষ্ম বিচার করিতেছেন, অপর দিকে সেই রসস্বরূপ আনন্দময়ের প্রেমের সঙ্গীত অবলীলাক্রমে নীতিশাস্ত্রটাকে উলট পালট করিয়া দিতেছে এবং ঠিক একটা খেলনার মত তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া আবদার করিতেছে। শিশু যদি একটা মহামূল্য জিনিষ ভাঙ্গে তবে মাতা কি করেন? দুই মিনিট পরে তাহার চক্ষের জল মুছাইয়া তাহার গণ্ডে চুম্বন করেন। এই কবি সেইরূপ আবদারে। তাঁহার অকাণ্ডটাতেও আমরা অপূর্ব্বত্ব আবিষ্কার করিয়া তাহার উচ্চমূল্য দিতে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছি। রাজকুমারী কুল ছাড়িলেন কি স্বামী ছাড়িলেন, ঐশ্বর্য্য ছাড়িলেন কি কাঙ্গালিনী হইলেন, এ সকল কথা আমরা ভুলিয়া যাই; আমরা তাঁহার একখানি মাত্র চিত্র দেখি, তাহা ইন্দ্রিয়াতীত, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, অমৃতময় ও লোকাতীত―এই প্রেম স্বর্গের, ইহা পৃথিবীর নীতির মানদণ্ডে তুলিত হইবার নয়। স্বামি-কলঙ্কিনীর এই ব্যভিচার সম্পূর্ণরূপে অনাবিল। কবি এত বড়, যে প্রচলিত লৌকিক নৈতিক আদর্শ তিনি অনায়াসে ডিঙ্গাইয়া চলিয়া গিয়াছেন―তিনি যে রাজ্য হইতে তাহার সুর শুনাইতেছেন, মর্ত্ত্যের মানুষ সেই রাজ্যের বিচারক নহে। তাঁহার গান শুনিবার যোগ্য ক্ষ্যাপা ভোলা,―সম্পূর্ণরূপে তন্ময় অপার্থিব ব্যক্তি। তাঁহার গানের বোদ্ধা সেই ব্যক্তি যিনি কাঞ্চন ও কাচকে তুল্য মনে করেন, যিনি পথের ধূলি কুড়াইয়া মাথায় রাখেন ও মণিমাণিক্য তৃণবৎ জ্ঞান করিয়া আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেন। যেমন রাজকুমারী তেমনি তাহার আন্ধাবন্ধু―দুইই দেহের প্রতি উদাসীন, দুইই দেহাতীত কিছু পাইয়াছে―ও তাহাই জগৎকে দিতেছে,―যাহা পাইয়া রমণী সতীত্বকুম্ভ জলে ভাসাইয়া দিয়া কুলত্যাগিনী হইতেছে, তাহার অসমসাহসিক গতির দ্রুত ছন্দের পশ্চাতে সংসারের শত শত কর্ত্তব্যের বাঁধ মাকড়শার জলের মত ছিন্নভিন্ন হইয়া অসার হইয়া পড়িতেছে।

 বাঙ্গালী চাষা প্রেমের যে তত্ত্বের সন্ধান পাইয়াছিল, জগতে তাহা অতুলনীয়। গুটিকয়েক পত্রে কবি যে অমর লিপি অঙ্কন করিয়াছেন তাহা জগতের সুসমাচার―সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রের উপরকার কথা―উহা অপূর্ব্ব, অতুল্য; উহা আনন্দের ভাণ্ডার এবং ত্যাগের মহিমায় চিরোজ্জ্বল।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন।

আন্ধা বন্ধু

আন্ধা বন্ধু

(১)


ভিক্ষা দাওগো নগরবাসী তোমরা সকলে।
খাড়া হইল আন্ধা বন্ধু রাজার তুন[১] দুয়ারে॥
ভোর গগনে খইরা[২] মেঘরে সিন্দুর তার গায়।
রাজপন্থে কোন্ বা জনে বাঁশীটি বাজায় রে বাঁশীটি বাজায়॥
দূর গাঙ্গের কূলে খাড়াইয়া আছিল ভালা লিলুয়া বয়ার[৩]
শুন্যা সে বাঁশীর গান লাগিল চমৎকার॥
কোন্ বা দেশের ভাইট্যাল নদী বহিল উজানী।
পাড় ভাঙ্গান্যা নদীর কূলে ঢেউএর কানাকানি॥
ভোর বিয়ানে[৪] ডালুম[৫] কলি ফুটলো ডাল ভরা।
কেমন জানি আস্‌মান জমিন কেমুন চাঁদ তারা॥
দুনাইর মোর কেউ নাই একলা একলা ফিরি।
বাড়ী নাইরে ঘর নাই গাছ তলায় বসত করি।
যেই বিরখের তলায় যাইরে ছায়া পাইবার দায়।
সেই বিরখ না আগুনি বর্ষে অন্তর পুইরা যায়।
গাঙ্গের ঘাটে গেলে গাঙ্গে পানি যে শুকায়॥

বিধারতা সৃজিল কইরা এমন কপাল পোড়া।
ভিক্ষা দাওরে নাগরিয়া লোক আন্ধা দুয়ারে খাড়া॥

কেমুন জানি সোণার দেশ সোণার মানুষ আছে।
কাঞ্চন পুরুষ কেন ভিক্ষা লইতে আইছে।
কাঞ্চন পুরুষ কেন দুয়ার খাড়া হইছে॥
কাঞ্চনা সোণার অঙ্গ গো আর গোরুচনা।
না দেখ্যাছি গো এমন রূপ কি দিব তুলনা॥
দেখিতে সুন্দর রূপরে শ্যাম শুকপাথী।
কোন্ পামর বিধারতা করলো অন্ধ দুটি আঁখি
তার অন্ধ দুটি আঁখি॥

* * * *

শুন শুন রাজার কন্যা কহি যে তোমারে।
কাঞ্চন পুরুষ এক তোমার দুয়ারে॥
কান্ধেতে ভিক্ষার ঝুলি সোণার বরণ।
আখ্‌খি দুইটি অন্ধ তার বিধাতা দুষ্মন॥
দেখ্‌বে যদি সুন্দর কন্যা চল শীঘ্র করি।
কিবা ভিক্ষা দিবে তারে সঙ্গে লহ করি
দিশা-ওরে ও মন পবনের নাও।
কন্যা সঙ্গে ত লও করি॥
কাঞ্চাসোণা গোরুচনা রূপ না যায় পাশুরা।
এক নয়ানে ঝরে হাসি তার আর নয়ানে ধারা লো
কন্যা, দেখবে চল ত্বরা॥

(১-৩৮)

(২)

দিশা— ওরে ও মন পবনের নাও।

কোন্ দেশ হইতে আইছ তুমি
কোন্ দেশে যাও, ওরে মন পবনের নাও॥

উজান সুরে বাজেরে বাঁশী ভাইটায় যায়রে বইয়া।
উদাস হাওয়া কানের কাছে কিবান যায় কইয়া
ওরে মন পবনার নাও......॥
সেইত না নদীর গো পারে কোন বা সোনার দেশে।
রসইয়া[৬] সোণার মানুষ সেই না দেশে বইসে॥
বাজাও বাজাও বাঁশী বাজাও রে আর বাই শুনিয়া।
(বাঁশী শুন্যা) ঘুমের মানুষ জাগিয়া ঘুমায় এই বাঁশী
শুনিয়া, ওরে মন......॥
না জানি অন্ধের বাঁশী কিবান যাদু জানে।
ঘরে বান্ধ্যা বেড়ার মন বাইরে টাইন্যা আনে॥
কিবা দিব দান ধাই কহত আমারে।
মধুভরা বাঁশের বাঁশী পাগল করলো মোরে লো ধাই
কইয়া দাও আমারে......॥
সোণার কপাট রূপার খিল গো বাপের ভাণ্ডার।
বাপের আগে কয়লো ধাই খুল্যা দেও দুয়ার
লো ধাই কইয়া......॥
ধূলা মাণিক একই কথা দূতীলো তাতে কিবান আছে।
আগে জান কিবান দিলে অন্ধের দুঃখ ঘোচে
লো ধাই......॥
রাজার পুত্র যেমন লো ধাই মন কয় যে আমারে।
বড় দুঃখে আন্ধা হইয়া দুয়ার দুয়ার ঘুরে
লো ধাই......
দেহে যত সয়লো দূতী অন্তরে না সয়।
কিবান ধন দিলে বল অন্ধ খালাস হয়
লো ধাই......॥

শুন শুন রাজার কন্যা আমার কথা ধর।
কি করিলে অন্ধের দুঃখ ঘুচাইতে পার
লো রাজ কন্যা......॥
দিবা রাত্রি অন্ধের কাছে সকল সমান।
ওরে দুঃখু ঘুচে যদি নয়ন কর দান
লো রাজ কন্যা....॥
এমন ধন নাই লো কন্যা রাজার ভাণ্ডারে।
সেই ধন মিলিব কোথা ধাই কইয়া দেও গো মোরে
লো......॥
চাম্পাবরণ আন্ধার হইল ভূমে পড়ে মালা।
ঝরঝরি নয়ানের জল কান্দে রাজার বালা॥
শুন শুন ওলো ধাই কহি যে তোমারে।
আমার দুইটি নয়ান তুল্যা দিয়া আইও তারে
লো ধাই দিয়া......॥
রসিক জনে কয় দিলে কি হবে নয়ন।
অন্ধের দুঃখু ঘুচে যদি কন্যা দিতে পার মন লো
কন্যা দিতে পার মন......॥(১—৬)

(৩)

দিশা—কে বাজায় বাঁশী। 
দেখ্যা আইও নগর-পন্থে এ কোন উদাসী
কে বাজায় বাঁশী॥
ঘুম তনে উঠিলা রাজা বাঁশীর গান শুনি।
মধুভরা এমন বাঁশী জন্নমে না শুনি॥
ভোরের বাতাস পাগল হইল ঘরে থাকা দায়।
এমুন কৈরা কেমুন জনে বাঁশরী বাজায়॥

খবরিয়া[৭] জানিয়া আইও আগে।
কোন্ বা জনে বাজায় বাঁশী নবীন অনুরাগে
খবইর৷ জান্যা আইও আগে॥
খবইরা আসিয়া “কয় রাজা শুন দিয়া মন।
সোণার মানুষ বাজায় বাঁশী পাগল করে মন॥”
রাজা কয় লইয়া আইস তারে॥
বাঁশী হাতে আইলরে পান্থ দাঁড়া হইল থলে
উদাসী পান্থের গায় কাঞ্চা সোণা জ্বলে
রাজা একি চমৎকার।
দেহার রূপে পন্থ আলো চোখ দুইটি আঁধার
রাজা একি চমৎকার॥
“সুন্দর পন্থের মানুষ কহি যে তোমারে।
কোন্ বা দুঃখে বেড়াও তুমি পন্থে পন্থে ঘুরে॥
কোন্ বা দেশে বাড়ীরে তোমার কোন দেশে বসতি।
কেবা তোমার মাতা পিতা কেবা পথের সাথী রে
সত্য কও আমারে।”
“বাপ নাই মাও নাইরে মায়ের পেটের ভাই।
তীর্থের না কাউয়া[৮] যেমুন উইড়া না বেড়াই
গো রাজা কহি যে তোমারে॥
পাষাণ বিধাতা মোরে গো দিলে গো এতেক দুঃখ।
জন্মিয়া না দেখলাম রাজা মাও বাপের মুখ
দরদী ভবে আপন বলতে কেউ নাই॥

জন্মিয়া না দেখলাম কভু চান্দ সূর্য্যের মুখ
গো রাজা......॥
বিধারতা না দোষী আমি কপাল দোষ আমার
দিন রজনী আমার কাছে সমান অন্ধকার
গো রাজা......॥
পন্থে পন্থে ঘুইরা ফিরি দুঃখের বেসাতি।
বনে কাইন্দা বনে ঘুমাই গাছ তলায় বসতী
গো রাজা......॥
কোকিলায় দিয়াছে জনম কাকেত পুষিল।
অভাগা বলিয়া মোরে সবে খেদাই[৯] দিল গো
দরদী ভবে আপন বলতে......॥”
“শুন শুন নবীন পান্থ আরে কহি যে তোমারে।
আইজ হইতে কর বসত এই না রাজ্যপুরে॥
ভিক্ষার ঝুলি ছাড় তুমি ঘরে বস্যা খাও।
আজি হইতে হইলাম আমি তোমার বাপ মাও॥
ভরা ভাণ্ডারের ধন দুয়ার থাকবো খোলা।
গলায় পরিবা তুমি মাণিক্যের মালা;
তুমি থাক আমার ঘরে।
অঙ্গেত পরিবা তুমি রাজার ভূষণ।
সর্ব্বাঙ্গে গাঁথিয়া দিব রত্নাদি কাঞ্চন॥
তুমি থাক আমার ঘরে।
মন্দিরে থাকিবা তুমি উত্তম বিছানে।
ঘুমতনে জাগিব আমি তোমার বাঁশীর সনে॥
এক কন্যা আছে মোর পরাণের পরাণ।
তাহারে শিখাইবা তুমি তোমার ঐনা বাঁশীর গান॥

এই দুই কার্য্য তোমার আর কিছু না জান।
সক্কল সুখ পাইবা কেবল নাই সে দুই নয়ান॥
তুমি থাক আমার ঘরে।”

(১—৫৭)

(8)

দিশা— ধরলো কন্যা শিক্ষা ধর।
“কিবা শিক্ষা দিবাম আমার দুনিয়া অন্ধকার॥
না দেখিলাম আলোর মুখ জন্ম আখি খুলি।
দিষ্টির নয়ানে বিধি মেল্যা মাইল[১০] ধূলি॥
কোন্ দেশের নদী লো কন্যা অন্ধকারে বয়।
আস্‌মানেতে চান্দ সুরুজ কেমনে জানি রয়॥
আলো জানি কেমন লো কন্যা কোন গগনে ফুটে।
নিরল[১১] বায়ে ফুলের কলি কন্যা কেমুন জানি ফুটে
শব্দে শুনি তরুলতা না দেখি নয়ানে।
বিধাতা করিল অন্ধ এহি দুঃখীজনে॥
মানুষ জানি কেমন লো কন্যা হাসি মুখের কথা।
শব্দে শুনি নাই সে দেখি মনে রইল ব্যথা॥
যে মুখে চান্দের হাসি না দেখি নয়ানে।
হিয়ার পরশ নাহি বুঝি সে ধেয়ানে
তরুলতা পুষ্প আমার সামনে আছে খারা[১২]
মাথার উপুর ফুইট্যা রইছে কন্যা চান্দ সুরুজ তারা॥

সবার উপুর আছ তুমি অন্তরে সে পাই।
ধিয়ানেতে আছ কন্যা অন্তরেতে পাই॥”

* * * *

দিশা— “বিদেশে বান্ধা তোমার মনে কত দুঃখ।
মনে কত দুঃখ রে তোমার মনে কত দুঃখ॥

শুনরে বৈদেশী বন্ধু কহি যে তোমারে।
পরিচয় কথা একবার কও যে আমারে॥
কোন্ দেশে জনম হইল কেবা বাপ মাও।
কোন্ জনে পালিল ঐ মন কোকিলার ছাও॥
যে দেশে জনম তোমার সে দেশের লোকে।
কি নাম রাখিল তোমার কি বলিয়া ডাকে॥”

“নাম নাই কন্যা গো আমার থান নাই সংসারে।
পাগল বলিয়া লোকে উপখুসী[১৩] করে॥
কেহ দেয় অঙ্গে ধূলা কেহ বা সম্ভাষে।
পাতের অন্ন দিয়া কেউ পাগলেরে বাসে॥
কেহ বলে দূর দূর কেহ বলে আইস মোর ঘরে।
ছাড়িয়া নয়নের জল দাঁড়াই দুয়ারে॥
কেউ হয় বাপ মাও কন্যা কেউ হয় দুষ্মন।
কেউরে না দোষী লো কন্যা পাগল আমার মন॥
পাগল আমার ডাক নাম পাগল আমার বাঁশী।
আউলা[১৪] পন্থে গাই গান হইয়া উদাসী।”

“তোমার বাঁশী শুন্যা বুঝি মানুষ পাগল হয়।
নাগরিয়া লোকে তোমায় তেই সে করে ভয়॥

মুখের বাঁশী বুকে তোমার চিকন[১৫] দাগ কাটে।
সে বাঁশী ভুলিতে বন্ধু হিয়া খানি ফাটে॥
বাঁশী বাজাও বন্ধু শিখাও মোরে গান।
আজি হতে পিয়া বন্ধু আমার পরাণ॥
আজি হতে তোমায় বন্ধু ছাইড়া নাই সে দিব।
নয়ানের কাজল কইরা নয়ানেতে থুইব॥
সে কাজল দেখিয়া যুদি লোকে করে দোষী।
হিয়ায় লুকাইয়া বন্ধু শুনবাম তোমার বাঁশী॥
হিয়ায় লুকান বন্ধু যুদি লোকে জানে।
পরাণ কটরায়[১৬] ভইরা রাখিব যতনে॥
বসন কইরা অঙ্গে পরব মালা কইরা গলে।
সিন্দুরে মিশাইয়া তোমায় মাখিব কপালে॥
চন্দনে মিশাইয়া তোমায় করব দেহ শীতল।
সুখে দুঃখে করব তোমায় দুই নয়ানের কাজল॥
বলুক বলুক লোকে মন্দ তাহা না শুনিব।
দুই অঙ্গ ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হইব॥
আমার নয়ানে বন্ধু দেখিবা সংসার।
এমন হইলে ঘুচবো তোমার দুই আখির আঁধার॥
তোমার বুক লইয়া আমি শুনব তোমার বাঁশী।
মরণে জনমে বন্ধু হইলাম তোমার দাসী[১৭]॥”

* * * *

“বিধুরা রাজকন্যা বুঝ্যা কথা কও।
দুঃখ ভরা ডালা কন্যা মাথায় কেন লও॥
চির সুখে আছ কন্যা দুঃখ নাই সে জান।
সরল পন্থ ছাইড়া কেন যাও সে কাঁটা-বন॥

অমিত[১৮] ছাড়িয়া কেন বিষ হইল ভালা।
বুঝিতে না পার কন্যা গরল বিষের জ্বালা॥
হিয়ায় না কাট কন্যা আপনার নুখে[১৯]
দুর্জ্জনিয়া[২০] চিন্তারে থান নাই সে দেহ বুকে॥
বিদায় দেও রাজকন্যা আপন দেশে যাই।
রাজত্বির সুখে আমার কোন কার্য্য নাই॥”

দিশা— 
তোমায় ছাইড়া নাই সে দিব।
নয়ানের কাজলী কইরা বন্ধু নয়ানে পইরাব॥

“বন্ধুরে আরে বন্ধু যেদিন শুন্যাছি তোমার বাঁশী।
কুল গেল মান গেল বন্ধু হইলাম তোমার দাসীরে॥
অন্তরারে কইয়া বুঝাই বন্ধু বুঝ নাই সে মানে।
মন যমুনা উজান বইল বন্ধু তোমার বাঁশীর গানেরে॥
তিল দণ্ড না হেরিলে হইরে দেওয়ানা[২১]
বাঁশী বাজাইতেরে বন্ধু মায় কইরাছে মানারে॥
মানায় ত না মানে মন দ্বিগুণা উথলে।
তোষির[২২] আগুনে যেমুন ঘুষ্যা ঘুষ্যা[২৩] জ্বলেরে॥
কিসের রাজ্যতি সুখ তাহাতে কি হবে।
মনের ফরমাইস[২৪] বল কেবা যোগাইবেরে॥
কাঞ্চনা বাঁশেতে বন্ধু ধরিয়াছে ঘুণ।
(আমার) অন্তরাতে লাগল আগুন বন্ধু চক্ষে নাই সে ঘুমরে॥

আগুনের শয্যা পাতি আঞ্চল বিছাইমু।
অমিয়াতে মিশাইয়া বিষ তাহারে ভখিমুরে॥
তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু সুখ নাই সে চাই।
যোগিনী সাজিয়া চল কাননেতে যাইরে॥
চন্দন মাখিয়া কেশে বানাইব জটা।
সংসারের সুখের পথে বন্ধু দিয়া যাইবাম কাঁটারে॥
বাপ রইল মাও রইল সকল ছাইড়া যাই।
বনে ত বসত করি বনের ফল খাইরে॥
বনের না পুষ্প তুল্যা গাথিবাম মালা।
ফুলের মধু আন্যা তোমায় খাওয়াবাম তিন বেলারে॥
পাতার শয্যায় বন্ধু পাত্যা দিতাম বুক।
না জানি এতেকে বন্ধু পাইবা কিনা সুখরে॥
পরাণ থাকিতে রে বন্ধু তোমায় ছাইড়া নাই সে দিব।
মাথার কেশে যোগল[২৫] চরণ বান্ধিয়া রাখিবরে॥
এতেক না ছাইড়া বন্ধু যুদি চইল্যা যাওরে তুমি।
আগেত বধিয়া যাও অবুলা পরাণীরে॥
আমি যে মরিব বন্ধু তোমার কিবান দায়।
অবুলার বধ বন্ধু না লাগিব তোমার পায়রে।”

* * * *

“শান্ত কর শান্ত কর রাজকন্যা শান্ত কর মন।
বাঁশীর গান শিক্ষা তোমার অইল সমাপন॥
অন্তরের দাগ কন্যা মুছিয়া ফেলাও।
বৈদেশী অন্ধার[২৬] জন্য কেন দুঃখ পাও।
আপনে সম্বরি কন্যা গৃহে চইল্যা যাও॥

সোণার পিঞ্জরে তুমি হীরামন সারী।
রাজুয়ার[২৭] ঘরে তুমি হইবা পাটেশ্বরী॥
শতেক দাসীরা তোমায় করিব সেবন।
অঙ্গেত পরিবা কন্যা রত্নাদি কাঞ্চন॥
সাধ কইরা কেন লো কন্যা পর দুঃখের মালা।
না বুইয়াছ[২৮] কন্যা তুমি পিরীতের জ্বালা॥
পায় পায় দুঃখ তার জীবন যাইব দুঃখে।
চরণে বিন্ধিলে গো কাঁটা বাহিরাবে বুকে॥
শব্দে শুনি চণ্ডীদাসে পিরীতি করিল।
ঘসির[২৯] আগুণে তারা দহিয়া মরিল॥
নীলমণি পিরীতি কইরা রাজা হইল খুসী।
যারা যারা পিরীতি করে কেবল দুঃখের ভাগী॥
ফুলের সহিত দেখ ভ্রমর পিরীত করে।
মধুহীন শুকাইয়া অকালেতে ঝরে॥
পিরীতি মধু পিরীতি ফল শুনতে চমৎকার।
মাকাল যেমুন বাইরে লালিম[৩০] ভিতরে আঙ্গার[৩১]

(৫)

ফাগুনের ফুলের কলি চৈতে উঠে ফুটি।
দিনে দিনে শুকনা গাঙ্গে ধরিলেক ভাটি॥
মধুমাস চল্যা যায় সেও গ্রীষ্ম আইসে।
বিরক্ষ হতে শুকনো পাতা আস্তে আস্তে খসে॥

কুইলে[৩২] না গায় গান নাহি বাজে বাঁশী।
গরম হাওয়ায় দাহ পরাণ মন হৈল বাসি॥
নতুন বচ্ছর আইল নয়া যৌবন ফুটে।
সায়র মন্থন বিষ কন্যার বুক ভইরা উঠে॥
পুষ্পকাননে ভ্রমর করে আনাগোনা।
উদ্যানে আসিতে রাজা কন্যায় করে মানা॥
বৈশাখ মাসেতে দেখ গাছে নয়া পাতা।
ঘটক আইল রাজার দেশে লইয়া নতুন কথা॥

খেলার ঘর ভাঙ্গিয়া লইল মালা হইল বাসি।
দিনে দিনে ফুরাইল চাম্পামুখের হাসি॥
দিনে দিনে চাঁচর কেশ চাকুলির[৩৩] আঁশ।
দুরন্ত নিদয় ঘুণ বুকে করলো বাস॥
ঢোল বাজে ডগর বাজে নাচে ডগরিয়া।
কোন দেশের রাজার পুত্র কন্যা যায় নিয়া॥

আজ হইতে রাজার রাজ্য হইল অন্ধকার।
আজ হইতে পাগল বাঁশী না বাজিব আর॥
“বিদায় দাও রাজ্যের রাজা বিদায় দেহ মোরে।
এ রাজ্য ছাড়িয়া আমি যাই অন্য তরে[৩৪]
রাজা বিদায় দেও মোরে॥”

“শুন শুন পাগল পান্থৈ বলি যে তোমারে।
এইখানে বসতি কর আমার রাজপুরে॥
ভাণ্ডারের ধন আছে সুখের নাইরে সীমা।
বাইরে আছে বাপ সুহৃদ্ ঘরে আছে মা॥

সুন্দর রাজার কন্যা বিয়া করাইব।
জলটুঙ্গী ঘর এক বানাইয়া দিব॥
শতেক দাসী দিব তোমার সঙ্গতি করিয়া।
সুখেতে রাজত্বি কর এইখানে থাকিয়া॥
এক দুঃখ অন্ধ নয়ান দিতে না পারিব।
রাজত্তি সুখ যত জুখ্যা মাপ্যা দিব॥”

“শুন শুন আগো রাজা আরে কহি যে তোমারে।
তোমার মত সুহৃদ্ নাই মোর এ ভব সংসারে॥
তোমার কাছে থাক্যা রাজাগো পাইলাম বড় সুখ।
কেবল না দেখিলাম রাজা তোমার হাসি মুখ॥
আর জন্মের বাপ ছিলা গো মাও ছিলা রাণী।
গুণের যতেক কথা কি কব বাখানি॥
কারে বা করিব দোষী কপাল মোর দোষী।
কপালের দোষে আমি হইলাম বনবাসী॥
কি করিব রাজ রাজত্বে হইলাম উদাসী।
ঘরে থাকতে না দেয় মন আমার পাগল করা বাঁশী॥
আমার হাতের বাঁশী রাজা আমার হইল বৈরী।
কি করিব মনের বাঁশী ছাইড়া গেলে মরি॥
বাঁশী আমার জীবন মরণ বাঁশী আমার প্রাণ।
মরণ জিওন ধরম করম ঐনা বাঁশীর গান॥
আমি কি করিব ভালা তুমি কি করিবা।
সুখ না থাকিলে রাজা কিবা মতে দিবা॥
চন্দন নহেত রাজা বাটিয়া দিবে ভালে।
অঙ্গের বসন নয়ত রাজা জইড়া[৩৫] দিবে শালে[৩৬]

যার কপালে সুখ নাই রাজা কোথায় সুখ পায়।
মূল ঘরে[৩৭] যার পালা নাই রাজা কি করে ঠিকায়[৩৮]
রাজা বিদায় দেও আমায়॥”
ঘর ছাড়িল বান্ধৈ ছাড়িল যায় সকল ছাড়িয়া।
বেবান[৩৯] পথে অন্ধের বাঁশী উঠিল বাজিয়া।
বনে কান্দে পশুরে পঙ্খী সেই বাঁশী শুনিয়া॥
কোন্ অভাগীর ভাবের পাগল দিয়াছে ছাড়িয়া।
পরাণ ডোরে পাগল কেন না রাখছে বান্ধিয়া॥
কেউ দেয় অঙ্গেতে ধূলা কেউ সাধে খা।
কেউ বলে বাঁশীরে আমার সঙ্গে লইয়া যা॥
বাজিতে বাজিতে বাঁশী রাজ্য ছাড়াইল।
দূরের রাজার দেশে কান্দিয়া উঠিল॥ (১——৬৩)

(৬)

দিশা— কুঞ্জ সাজিলারে
আজি কুঞ্জে রাধা কানুর মিলনরে।

আরেক রাজার মুল্লুক কথা শুন দিয়া মন।
রাজ্যবাসী যতেক লোক ঘুমে অচেতন॥
পাতে ঘুমায় ফুলের কলি পুষ্পেত ভমরা।
রাজার বুকে শুয়ে রাণী এক গাছি ফুলের ছড়া॥
পাড় ঘুমায় পর্ব্বত ঘুমায় কেবল জাগে নদী।
আর জাগে বিরহিণী ঘরে চক্ষে নাহি নিদি॥

হায় এ হেন কালে অন্ধের বাঁশী উঠিল বাজিয়া।
ডালে ঘুমায় কোইল পঙ্খী উঠিল জাগিয়া॥
আখি মেল্যা চায় পুষ্পের না কলি ভমর জাগে বুকে।
বিদেশী পান্থৈয়ার বাঁশী কোন্ বা সুরে বাজে॥
কালো মেঘে কামসিন্দুরা[৪০] কেরে দিল মাখি।
কোন জনে মেলিল দিব্ব রতনের আখি॥
আইজ কুঞ্জে।
ঘরের নারী জাগ্যা উঠে পাগল বাঁশী শুনি।
মন্দিরে পশিল রাজার ঐ-না বাঁশীর ধ্বনি॥
আইজ কুঞ্জে।

জাগ চন্দ্রমুখী কন্যা কত নিদ্রা যাও।
ভোরের কলি ফুটল কন্যা আঁখি মেল্যা চাও রে।
গলার বাসি ফুলের মালা ছিঁড়িয়া ফালাও রে॥
আইজ কুঞ্জে।
শুন শুন কিবা বাঁশী কোন্ জনে বাজায়।
জান্যা আইস কেমন জনে এমন গান গায়॥
দূতী জান্যা আইস॥
শুন শুন আগো রাজা কহিযে তোমারে।
মনের মধ্যে বাজে বাঁশী চিত্ত আকুল করে॥
দূতী জান্যা আইস॥

বাঁশী শুন্যা রাজার কন্যার হইল সম্ভ্রম।
বাঁশী আমার জীবন মরণ বাঁশী প্রাণধন॥

নীরব রইল্যা সুন্দর কন্যা দুই আঁখি ঝরে।
অনেক দিনের ভোলা বাঁশী আজ ডাকিছে আমারে॥
ছোড কালের বাঁশীরে বড় কালে বাজিল।
পুষ্পবনে বস্যা বন্ধু বাঁশী শুনাইল॥
বনের বাঁশী নয়ত ইহা মনের বাঁশী হয়।
ছোট কালের যতেক কথা জাগাইয়া তোলয়রে॥
বাঁশী মন-গহনে বাজে....।
এই বাঁশী শুনিয়া ফুটত কুসুমের কলি।
বন্ধু মোরে শিখাইত মিঠা মিঠা বুলিরে॥
বাঁশী......।
বাঁশী আমার জীবন যৈবন বাঁশী ছিল প্রাণ।
বাঁশী রবে মন-যমুনা বহিত উজানরে॥
বাঁশী......।
এক জন্নম গেছে মোর আর জন্নম হয়।
জন্মে জন্মে তোমার দাসী হইয়াছি নিশ্চয়॥
বাঁশী......।

ভুলিতে না পারি বন্ধু কেবলি অভাগা।
তোমার বাঁশী দিল বন্ধু বুকে বড় দাগা॥
কি করিব রাজ্য ধনে কুল আর মানে।
সরম ভরম ছাড়লাম বন্ধু তোমার বাঁশী গানে॥
ভুলি নাই ভুলি নাই বন্ধু তোমার চান্দ মুখ।
বনে গিয়া দেখাইব ছিঁড়িয়া সে বুক॥
ভুলি নাই ভুলি নাই বন্ধু তোমার বাঁশীর ধ্বনি।
পরতে পরতে বুকে আক্যা আছ তুমি॥
কি করিব রাজ-ভোগে সুখ সবিস্তরে।
বনের পাখী ভইরা রাখছে সোণার পিঞ্জরে॥
উড়ি উড়ি করি বন্ধু ছিলাম এতকালে।
বিষ নাই যে খাই বন্ধু তোমায় ফিইর‍্যা পাইব বইলে॥

শুন শুন সুন্দর কন্যা না দেও উত্তর।
উঠিতে না পার যদি অঙ্গে করলো ভর॥

দূতী আইস্যা কয় রাজা কর অবধান।
রাজ-পন্থে অন্ধের বাঁশী শুনায় এই গান॥
এমনবাঁশীর গান জন্নমে না শুনি।
বাঁশী শুন্যা নাগরিয়া হইল উন্মাদিনী॥
পঙ্খী যত ছিল উড়ে পশু ছুডে[৪১] বনে।
নদী নালা উজান বয় ঐনা বাঁশীর গানে॥
ঐ বাঁশী থামিলে বুঝি চন্দ্র সুরুজ খসে...।

শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
ভিক্ষুরে কি দিব দান কইয়া দেওলো মোরে॥
কন্যা কইয়া দেওলো মোরে।
দুই নয়ান অঝুরে ঝরে কন্যার ধীরে কথা কয়।
দাসীরে জিজ্ঞাসা তোমার উচিত না হয়॥
তুমি ত রাজ্যের রাজাগো রাজ্য দিতে পার।
যাহা ইচ্ছা দিবা তুমি আমায় কেন ধর॥
শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
যাহা বল দিবাম তাহা না হইব আর[৪২]
কন্যা কইয়া......।
কন্যা বলে দাসী আমি কথায় কিবান হয়।
তোমার ইচ্ছায় হবু দান অন্য নাই সে হয়॥
কন্যা......।

কন্যা কয় যদি বলি রাজত্তি দিবা তারে।
রাজা কয় দিবাম আমি তিন সত্য করে॥
কন্যা......।
কন্যা কয় যদি বলি দিবে যত ধন।
নগরেতে আছে যত রত্নাদি কাঞ্চন॥
রাজা কয় খুল্যা দিবাম রাজ্যের ভাণ্ডারা।
সত্য করিলাম কন্যা তুমি নয়ানতারা॥
কন্যা......।
সত্য কর ওহে রাজা সত্য কর তুমি।
রাজা কহে তিন সত্য করিলাম আমি॥
কন্যা......।
নয়ন মুছিয়া কন্যা কহে “যদি নহে আন।
ধর্ম্ম সাক্ষী ওগো রাজা তুমি আমায় কর দান
—গো আমায় কর দান॥”

(১—৯৪)

বনের নদী উজান বয় তীরে চম্পা ফুল।
বাজিয়া চলিছে বাঁশী সেই না নদীর কূল॥
বাঁশী ধীরে রৈয়া বাজে।
কুলবধূ না দেয় মন আপন গিরকাজে[৪৩]
বাঁশী...॥
খোপাতে রতনের ভমর উড়াইয়া ফালায়।
বনের না পাখী এক উড়িয়া পালায়।
বেণীভাঙ্গা[৪৪] কেশ তার চরণে লুটায়॥
বাঁশী...।
চরণ নুপূর বাজে রুনু রুনু ধ্বনি।
বহু দিনের দাগা কথা এতদিনে শুনি॥

দাণ্ডাইল আন্ধা বান্ধৈ বাঁশী হাতে লৈয়া।
“এই নেউরের শব্দ মোরে কিবান দিল কইয়া॥
বাঁশী.....
এই নেউরের[৪৫] স্বপন-ধ্বনি কার চরণে বাজে।
অনেক দিনের ভোলা কথা আজ পইরাছে মনে॥
পুষ্পবনে সুন্দর কন্যা শুনত বাঁশীর গানে।
স্বপ্নের মত এই সে নেউর বাজত তার চরণে॥
সেই কন্যা যদি লো তুমি মোরে দেহ কথা।
কেন বা জাগিয়া উঠলো ভোলা দিনের বেথা॥”

“শুন শুন বন্ধু আরে কহি যে তোমারে।
পাগল কইরাছে তোমার ঐনা বাঁশীর সুরে॥
ঘর ছাড়লাম বাড়ী ছাড়লাম জাতি কুলমান।
আর বার বাজাও বন্ধু শুনি তোমার গান॥”

চমকিয়া মুখের বাঁশী হাতেত লইল।
“অল্প বুদ্ধি কন্যা হায় কি কাম করিল॥
কন্যা ঘরে ফিইরা যাও।
রাজত্তি সুখের ঘর কেন বা ভাঙ্গাও।
কন্যা ঘরে......
সোণার থালে খাইবা অন্ন পিন্‌বা[৪৬] পাটের শাড়ী।
আমি হইলাম বনের পঙ্খী তুমি রাজার নারী॥
কন্যা ঘরে......!
রত্নাদি কাঞ্চন অঙ্গে যতনে ধরিবা।
বনের বাকল পিন্ধ্যা[৪৭] কেমনে থাকিবা॥
কন্যা......॥

তুমিত রাজার কন্যা রাজ্য ঠাকুরাণী।
অল্প বুদ্ধি কন্যা তোমার বাপে দিব গালি॥
কন্যা......।

একেত অন্ধ আঁখি তাহাতে পাগল।
সঙ্গেতে না আছে মোর কড়ার সম্বল॥
কন্যা......।”


“যেদিনে শুন্যাছিরে বন্ধু তোমার ঐ না বাঁশী।
রাজ্যধন ছাইড়া বন্ধু হইয়াছি তোমার দাসী॥
বনের শারী নাহি চায় সোণার পিঞ্জরা।
ভোগে কি করিব বন্ধু হইলাম উতদারা[৪৮]
তুমি আছ বাঁশী আছে রাজ্য নাহি চাই।
তোমার সঙ্গে থাকা বন্ধু যত সুখ পাই॥
হাত বান্ধিরে পাও বান্ধিরে নাগরিয়া লোকে।
মন কি বান্ধিবে তারা কাকনার বাকে[৪৯]
বনেতে বনের ফল সুখেত ভুঞ্জিব।
গাছের বাকল অঙ্গে টানিয়া পরিব॥
রজনীতে বিক্ক তলে তোমায় বুকে লইয়া।
ঘুমাইব বন্ধু আমি ঐ না বাঁশী শুনিয়া॥
জাগিয়া শুনিব বন্ধু ঐ না তোমার বাঁশী।
কিসের রাজ্য কিসের সুখ হইয়াছি উদাসী॥
রাজ্য সুখে সুখ দেহার কথা মন নাহি চায়।
দেহ মন ভিন্ন হইলে পরাণ রাখা দায়॥”

“শুন অল্প বুদ্ধি কন্যা নিজেরে ভাড়াও[৫০]
সোণার থালার অন্ন থুইয়া বনের ফল খাও॥
সুবর্ণ পালঙ্ক কন্যা ফুলের বিছানা।
কুশ কণ্টকে দিব দেহে তোমার হানা॥
কটু তিক্ত বনের ফলে সুখ না পাইবা।
দুরন্ত আশার আশে কান্দিয়া মরিবা॥
বান্ধিয়া সোণার ঘর আগুনে না পোড়।
মনেরে সম্বরি কন্যা যাহ নিজ ঘর॥

* * * *

“সত্য কথা প্রাণ বন্ধু কহি যে তোমারে।
তোমার দারুণ বাঁশী আমায় থাকতে না দেয় ঘরে।
বাঁশী হইল গরল জ্বালা বাঁশী হইল কালা।
এই বাঁশী শুনিলে আমার সকল যায় ভোলা॥”


“শুন অল্প বুদ্ধি কন্যা কহিযে তোমারে।
বিসর্জ্জন দিলাম বাঁশী তুমি যাও ঘরে॥
আর না বাজিবে বাঁশী কানে লো দংশিয়া[৫১]
ঐ দেখ যায় বাঁশী ঢেউয়ে ত ভাসিয়া॥”

“বাঁশী নাই তুমি ত আছ আমার হৃদের রতন।
আমারে না লহ সাথে কেবল লইয়া যাও মোর মন
তিল দণ্ড তোমারে ছাড়া না থাকিতে পারি।
তোষের আগুনে বন্ধু রৈয়া রৈয়া পুড়ি॥
বন্ধু যত সে বুঝাও।
আমার মনেরে বুঝান হইল বড় দায়॥

সদয় যদি না হওরে বন্ধু নিদয় যদি হও।
ত্যজিব এ ছার প্রাণী দাণ্ডাইয়া রও[৫২]
রে বন্ধু দাণ্ডাইয়া রও।”

“অল্প বুদ্ধি কন্যা তুমি ফিরি যাহ ঘরে।
আজি হতে আমি নাহি সে থাকিব সংসারে॥
এইখানে দাণ্ডাইয়া দেখ নদীতে কত পানি।
নিজ চক্ষে দেইখ্যা নিবাও জ্বলন্ত আগুনি॥”
এতেক বলিয়া অন্ধ ঝাপ্যা জলে পড়ে।
কন্যা বলে “পরাণ বন্ধু লৈয়া যাও আমারে॥”

আসমান হইতে জলে তারা যেন খসে।
জোয়ারিয়া গাঙ্গের ডেউয়ে[৫৩] সাপল[৫৪] ফুল ভাসে॥
ভাসিতে ভাসিতে দুয়ে গেল সমুদ্দার[৫৫]
কাল গরল বাঁশী না বাজিব আর
বাঁশী না বাজিব আর।

(১—৯৩)

  1. তুন=স্থান।
  2. খইরা=খয়ের রঙ্গের।
  3. লিলুয়া বয়ার=মৃদু বাতাস।
  4. ভোর বিয়ানে=সকালে।
  5. ডালুম=ডালিম।
  6. রসইয়া=রসিক।
  7. খবরিয়া=যে খবর আনিয়া দেয়।
  8. কাউয়া=কাক।
  9. খেদাই=তাড়াইয়া।
  10. মাইল=মারিল, নিক্ষেপ করিল।
  11. নিরল=নিরালা।
  12. খারা=উপস্থিত।
  13. উপখুসী=উপহাস।
  14. আউলা=অজানা
  15. চিকন=সরু, তীক্ষ্ণ।
  16. কটরায়=কৌটায়।
  17. C.f. *জীবনে মরণে মরণে জীবনে, নিচয় হইলাম দাসী।” —চণ্ডীদাস।
  18. অমিত=অমৃত।
  19. নুখে=নখে।
  20. দুর্জ্জনিয়া=অন্যায়, কু
  21. দেওয়ানা=পাগল।
  22. তোষির=তুষের।
  23. ঘুষ্যা ঘুষ্যা=ধীরে ধীরে, ভিতরে ভিতরে
  24. ফরমাইস=আকাঙ্ক্ষা।
  25. যোগল=যুগল।
  26. অন্ধার=অন্ধ ব্যক্তির।
  27. রাজুয়ার=রাজার।
  28. বুইয়াছ=বুঝিয়াছ।
  29. ঘসির=ঘুঁটের।
  30. লালিম=লালবর্ণ।
  31. আঙ্গার=অঙ্গার।
  32. কুইল=কোকিল।
  33. চাকুলি=(?)
  34. অন্য তরে=অন্য স্থানে।
  35. জইড়া=জড়াইয়া।
  36. C.f. মণি নও মাণিক নও হার করি গলায় পরি, ফুল নও যে কেশের করি বেশ।”—লোচন দাস।
  37. মূল ঘরে=আদত গৃহে, আসল ঘরে।
  38. ঠিকায়=ঠেকা দ্বারা; ঘরের বাহির হইতে ঝড়ের বেগ সামলাইবার জন্য যে বাঁশের খুঁটি দেওয়া যায় তাহাকে ‘ঠেক।’ বা ‘ঠিকা’ বলে।
  39. বেবান=দূরের।
  40. কামসিন্দুরা='কামসিন্দুর’ একপ্রকার উৎকৃষ্ট হিন্দুর।
  41. ছুডে=ছুটে।
  42. না হইব আর=অন্যথা হইবে না।
  43. গিরকাজে=গৃহ কাজে।
  44. বেণীভাঙ্গা=খোঁপা খোলা।
  45. নেউর=নুপূর।
  46. পিন্‌বা=পরিধান করিবে
  47. পিন্ধ্যা=পরিয়া।
  48. উতদারা=জ্ঞানহারা।
  49. কাকনার বাকে=(?)
  50. ভাড়াও=মিথ্যা আশ্বাসে ভোলাও।
  51. দংশিয়া=পীড় দিয়া
  52. C.ʄ. বঁধু যদি মোরে নিদারুণ হও।
    মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও। —চণ্ডীদাস।
  53. ডেউয়ে=ঢেউয়ে
  54. সাপল=সাপশা, কুমুদ
  55. সমুদ্দার=সমুদ্র।