পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/বগুলার বারমাসী

উইকিসংকলন থেকে

বগুলার বারমাসী

 এই পালাটিও শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দের সংগৃহীত। ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে এই পালাটি ময়মনসিংহ জেলার খালিয়াজুরি পরগণার মধ্যবাটী নামক গ্রামনিবাসী নকুল বৈরাগী ও কৃষ্ণরাম মাল নামক দুই ব্যক্তির নিকট হইতে সংগৃহীত হয়। পালাটি ৪২৭ পংক্তিতে সম্পূর্ণ। সুতরাং আকারে ছোট।

 বগুলার বারমাসীতে সামাজিক যে সকল চিত্র দেওয়া আছে, তাহা চণ্ডীদাসের যুগের; স্ত্রীলোকের এতটা স্বাধীনতা পরবর্ত্তী ব্রাহ্মণ্য যুগের রুচিসঙ্গত ছিল না; কবি তাঁহার রচনা ফেনাইয়া দীর্ঘ করেন নাই, বরং তাঁহার লেখা কিছু অতিরিক্ত পরিমাণে সংক্ষিপ্ত। অনেক ঘটনা কবি ছাড়িয়া দিয়া গিয়াছেন, গল্প-ভাগের জন্য যেটুকু দরকার সেইটুকু রাখিয়া তিনি অপরাংশ ছাঁটিয়া ফেলিয়াছেন―চণ্ডীদাসের যুগে কাব্যের এইরূপ ইঙ্গিত অনেক সময় দেওয়া হইত। তাঁহার “এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা, কেমনে আইলা বাটে” ছত্রের পরেই “আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে দেখে যে পরাণ ফাটে,” প্রথম পংক্তি নায়ককে সম্বোধন করিয়া বলা হইয়াছে, কিন্তু দ্বিতীয় পংক্তি সখীদের সম্বোধনে উক্ত;―কবি একই গানে এইরূপ দুই তিন ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়াছেন―অথচ তাহা স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই, শুধু কথার ইঙ্গিত দিয়া গিয়াছেন মাত্র। হয়ত তাঁহার গান অভিনীত হইত, গান করিবার সময় রাধা একবার কৃষ্ণকে ও একবার সখীকে এবং আরবার হয়ত জনান্তিকে কথা বলিয়াছেন; অভিনয়-কালে তাহা স্পষ্ট হইয়া উঠিত, এখন কবিতা পড়িবার সময় সেই ইঙ্গিতের সাহায্যে একটু একটু করিয়া অবস্থাগুলি হৃদয়ঙ্গম করিতে হয়। শ্যামরায়, মহিষাল বন্ধু, ধোপার পাট―প্রভৃতি পালাগুলিতেও এই ভাবের ইঙ্গিত দৃষ্ট হয়—সকল কথা কবি খুলিয়া লেখেন নাই―অনেক ঘটনা ও অবস্থা পাঠককে বুদ্ধি-বলে আবিষ্কার করিয়া―সমস্ত পালাটির অর্থ উপলব্ধি করিতে হইবে। বগুলার বারমাসীতে বণিক্-কন্যার সঙ্গে তাহার তরুণ বন্ধুর কথাবার্ত্তার পরে অনেক ঘটনা কবি বাদ দিয়া গিয়াছেন। কুমারী বলিতেছেন, রাজপুত্র তাঁহাকে বিবাহ করিতে জেদ করিতেছেন,―তাঁহার পিতা কন্যাকে রাজমহিষী করিবার প্রলোভনে লুব্ধ হইয়াছেন―কিন্তু তিনি কখনই রাজকুমারকে বিবাহ করিবেন না, ইহা তাহার পণ। তিনি রাজপুত্রকে ঘৃণা করেন, এ কথা তাঁহার পিতাকে তিনি খুলিয়া বলিবেন। তাহার পরের অধ্যায় পড়িলে স্পষ্টই দেখা যাইবে যে রাজপুত্রের বিবাহের প্রস্তাবটি কন্যার একান্ত অনিচ্ছার দরুন বণিক ভাঙ্গিয়া দিলেন, তাঁহার তরুণ বন্ধুর সঙ্গে কুমারীর বিবাহ হইল;―দাম্পত্যের প্রথম অধ্যায়ে মিলন-মধুর কত দিনরাত্র চলিয়া গেল―এ সমস্ত কথাই কবি বাদ দিয়া গিয়াছেন। বণিক্‌-কুমারীর সঙ্গে বণিক্‌-কুমারের প্রথম দিনকার কথাবার্তার পর কবি পটক্ষেপ করিয়া যখন যবনিকা পুনরায় উত্তোলন করিলেন,―তখন একটা বিদায়দৃশ্য উদ্ঘাটিত হইল। তরুণবণিক্‌ সমুদ্রপথে যাত্রা করিতেছেন, সাশ্রুনেত্রে বণিক্-কন্যা―মেঘ উঠিলে ডিঙ্গা তীরে লাগাইতে, ঝড়ের সময় সাবধান হইতে এবং আরো কত কি পরামর্শ দিয়া তাঁহার উৎকণ্ঠা জ্ঞাপন করিতেছেন। প্রথম অধ্যায় এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের মধ্যবর্ত্তী ঘটনাগুলির ইঙ্গিত আছে কিন্তু বিবৃতি নাই, পাঠক কল্পনার দ্বারা তাহা পূরণ করিবেন।

 এই গানটিতে যে ভাষা পাওয়া যায় তাহাও আমাদের চণ্ডীদাসের যুগই স্মরণ করাইয়া দেয়। সুকোমল মনোভাব, স্নিগ্ধ ও করুণ রসে সিক্ত হইয়া বাঙ্গালার প্রণয়ী-প্রণয়িনীর শত শত আবদার ও আদরের মধুবর্ষী কথার সৃষ্টি করিয়াছিল। জয়দেবের পূর্ব্ব হইতে বাঙ্গালীর কবিতার এই লক্ষণ পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু তথাপি দেবভাষার অনুস্বার-বিসর্গের বাহুল্যে ওই সকল ভাব সংস্কৃতে ততটা কোমল হইতে পারে নাই―যতটা বাঙ্গালায় হইয়াছে। এই পেলব ভাষার পরিণতি বৈষ্ণব গীতিকায়―কিন্তু কতকগুলি পালাগানের ভিতরেও ভাষার এই কোমলতার এবং সূক্ষ্ম মনোভাববিশ্লেষণের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা এই সকল কারণে বগুলার বারমাসীটি খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিরচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে করি।

 বারমাসীটি একটু মামুলি রকমের, কিন্তু উহা যেরূপই হোক, বাঙ্গালী পাঠকের নিকট এই বারমাসীর আদর কখনই ফুরাইবে না; কারণ ষড়-ঋতুভেদে বঙ্গমাতার রূপ ও বেশপরিবর্ত্তন আমাদের চক্ষে লাগিয়া রহিয়াছে। এই সকল বারমাসীর প্রত্যেকটিতেই আমাদের চক্ষে যে পল্লীচিত্র প্রকাশিত হয় তাহা চিরপুরাতন হইয়াও নিত্যনূতন।

 আমরা আন্ধাবন্ধু-পালায় স্ত্রীলোকের যে অসম সাহসের পরিচয় পাইয়াছি, অন্য এক ভাবে বগুলার পালায়ও স্ত্রী-স্বাধীনতার মৃদুতর একটা নিদর্শন দেখিতে পাই। স্বামী প্রবাসী, তাঁহার ধর্মপত্নী অপর এক প্রণয়ীর সহিত চিঠিপত্রে ভালবাসা জ্ঞাপন করিতেছেন। অবশ্য বণিক্‌-কুমারী বগুলা একান্ত শুদ্ধ-চরিত্রা এবং যাহার সহিত তাঁহার পত্রব্যবহার চলিতেছে তাহাকে তিনি জানিয়া শুনিয়া প্রতারণা করিতেছেন। এমন কি যখন রাজপুত্র তাঁহাকে লিখিয়া পাঠাইলেন যে তাঁহার স্বামী নৌকাডুবি হইয়া মারা গিয়াছেন, তখন বগুলা নিঃসঙ্কোচে লিখিলেন―“আমার স্বামী যদি মরিয়া গিয়া থাকেন তাহাতে আমার লাভ ভিন্ন লোকসান নাই, কারণ তোমার মত রাজকুমারকে আমি স্বামি-স্বরূপ পাইব।” বগুলা জানিতেন যে এইরূপ প্রতারণা করিয়া রাজপুত্রকে নিবৃত্ত না করিলে দুষ্টপ্রকৃতি, ঐশ্বর্য্য-মদমত্ত যুবক তাঁহার স্বামীর প্রাণ হরণ করিবে। স্বামীকে নিরাপদ্‌ রাখিবার জন্যই বগুলা এই সকল ধূর্ত্ততা অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? একটি কুলবধূর পক্ষে ক্রমাগত―কখনো দাসীর হাতে কখনো বা কপোতের মুখে এইরূপ প্রতারণামূলক পত্রব্যবহার আধুনিক সমাজ-নিয়মের একান্ত বিরোধী। প্রাচীন-পালা-গায়কগণ আশ্চর্য্য অন্তর্দৃষ্টিবলে কেবলই নরনারীর হৃদয়ের সাধুত্বের সন্ধান করিতেন এবং তাহারই ছবি আঁকিয়া যাইতেন। সমাজের যে একটা প্রকাণ্ড লৌহযন্ত্র মানবচিত্তকে নিষ্পেষণ করিবার জন্য অগ্নিচক্ষে স্ফুলিঙ্গ বিকীর্ণ করিত, সে দিকে পালারচক একবারও ভ্রূক্ষেপ করিতেন না। এই বীর্য্য এবং তেজ অনন্যসাধারণ। তবে এমনও হইতে পারে যে বাঙ্গালার প্রান্তসীমায় তখনও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের এত কড়াকড়ি অনুশাসন হয় নাই। আমরা পূর্ব্বে অনেকবার লিখিয়াছি পুর্ব্ব-মৈমনসিং প্রভৃতি অঞ্চলে বহুকাল পর্য্যন্ত কনৌজিয়া ব্রাহ্মণদের প্রভাব ঢুকিতে পারে নাই। এই সকল স্ত্রী-স্বাধীনতার চিত্র দেখিয়া মনে হয় যে উত্তরে গারো পাহাড় ও পূর্ব্বের ব্রহ্মদেশ এই দুই সীমান্তের স্ত্রীলোকদের অবাধ গতিবিধি এবং স্বাধীনতা নিকটবর্ত্তী বঙ্গের সমতল ভূমির উপর কতকটা প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

যদিও পালাগানটিতে নানারূপ কষ্টের ও দুঃখের চিত্র অবতারিত হইয়াছে, তথাপি ইহার পরিণাম শুভ। পল্লীকবিরা সংস্কৃত কাব্যের নিয়মগুলি একেবারেই আমলে আনিতেন না। এইজন্য প্রাচীন পালাগানের অনেকগুলি বিয়োগান্ত। এই গানটি পল্লীনিয়মের ব্যতিক্রম বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

লেখনী ভূপাতিত করিয়া কোন তরুণ বন্ধুকে তাহা তুলিয়া দিবার অনুরোধ এবং সেই উপলক্ষে বিবাহ-প্রস্তাবের অবতারণা শুধু এই পালাটিতে নহে আরও কতকগুলি পালাতে আমরা পাইয়াছি। সম্প্রতি পুরন্দরের পালা নামক যে গানটি আমাদের হস্তগত হইয়াছে তাহারও পুর্ব্বভাগে এইরূপ এক দৃশ্য অবতারিত হইয়াছে। ষোড়শ শতাব্দীতে সুপ্রসিদ্ধ কবি ফকিররাম কবিভূষণ বৰ্দ্ধমান জেলার একটা প্রাচীন পল্লীগাথা ভাঙ্গিয়া যে সুন্দর কাব্য রচনা করেন তাহাতেও এই লেখনী লইয়া প্রেমের কথাবার্ত্তার প্রসঙ্গ আছে। ফকিররামের সেই কাব্যটির নাম ‘সখী সোণা’। আমাদের ‘বঙ্গ-সাহিত্য-পরিচয়’ নামক সংগ্রহ-পুস্তকে সখী সোণার অনেক অংশ সঙ্কলিত করা হইয়াছে।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন।

বগুলার বারমাসী

বগুলার বারমাসী

(১)

“কিবা লিখি কিবান[১] পড়ি আমার নাই থাকে সে মনে।
কলম তুল্যা দেওরে বন্ধু লিখন কারণে॥
মন হইল ছনরে ভন[২] বন্ধুরে হাতে নাইরে বল।
খিন্ন[৩] সাগরে আইল কাল জোয়ারের জল রে
বন্ধু কাল জোয়ারের জল
ঘর আন্ধাইর বন্ধু, ঝিমিঝিমি[৪] রাতি।
কলম তুল্যা দেওরে বন্ধু রাখরে মিন্নতি।”

“একবার দুই না বার তিন বারের বেলা।
এনয় এনয় কন্যা তোমার কলম ফেলা॥
আসমানেতে চান্দরে তারা ঝিলিমিলি জ্বলে।
দূরের বাতাস আইসে ভাইস্যা উদাম[৫] নদীর কূলে॥
গয়িন[৬] বনের পঙ্খীরে কন্যা পাখালী[৭] তার ভিজা।
দূরে বাজায় বাঁশের বাঁশী রাখালিয়া রাজা[৮]

সত্য যদি করলো কন্যা সত্য কর তুমি।
তবেত লিখনীর কলম[৯] তুল্যা দিবাম আমি॥

সত্য যদি করলো কন্যা চান্দ তারা চাইয়া।
তবেত লিখনীর কলম দিব গো তুলিয়া॥”
“কি সত্য করিব কুমার কিছুই না জানি।
আমার বিয়ার কথা লোকে কানাকানি॥
বাপে বিয়া দিতরে চায় দুষ্মন কুমারে[১০]
রাজার ঘরে যাইতে বন্ধু আমার মন নাই সে সরে॥
বনে থাকি বনের পাখী আসমানেতে উড়ি।
কোন্ পন্থে যাইব বন্ধু বুঝিতে না পারি॥
দুষ্মন রাজার পুত্র যৈবন মাগিল।
এত দিনে জীবন যৈবন আমার কাল যে হইল॥
শুন শুন সাধুর পুত্র আমার মিন্নতি।
কলম যে তুলিয়া দেওরে তুমি পরাণ-পতি॥
আইজের নিশির চন্দ্ররে তারা সাক্ষী করি আমি।
জীবনে মরণে বন্ধু তুমি মোর স্বামী[১১]
না চাই না চাইরে বন্ধু রাজ রাজ্য পাটে।
বিরক্ষ[১২] তলায় শুইব তোমায় লইয়া বুকে॥
না চাই না চাইরে বন্ধু রত্ন অলঙ্কারে।
বনে আছে বনের ফুল তুল্যা দিও মোরে॥
খাট পালঙ্গেরে বন্ধু কোন্ বা আমার কাম।
যোগল[১৩] চরণে তোমার যদি পাইরে স্থান॥
আজি রাইতে সত্যরে বাণী হেলা নয়রে ফেলা[১৪]
বাপেরে কইব আজ সত্যের যত কথা॥

কলাবনের পাখীরে বিয়ার গান গাও।
রজনী পোয়াইলে পাখী কোন বা দেশে যাও॥
নদীর কূলে থাকরে পবন নদীর কূলে বাসা।
সাক্ষী হইও তোমরা সবে আমার মনের আশা॥
আমার মনের আশারে বন্ধু এই না পুষ্পের মালা।
তোমার গলায় বন্ধু দিলাম এহি মালা॥
বাপে নাই সে জানে বন্ধু নাই সে জানে মায়।
এক জানে চান্দ তারা আর সে জানে বায়॥”(১—৪৬)

(২)

ঢোল ডুম্বুর বাজে সানাই রইয়া রইয়া।
সাধুর পুত্রর সঙ্গে অইল সুন্দর কন্যার বিয়া॥

* * * *

(বণিক্-কুমারের সমুদ্র যাত্রার প্রাক্কালে)


“শুন শুন পরাণ-পতিগো আমার কথা লইও।
ঝড় তুফানেতে ডিঙ্গা কিনারায় লাগাইও॥
শুন শুন প্রাণের প্রতি আমার মাথা খাও।
দক্ষিণা সায়র বানে[১৫] নাই সে ধর নাও॥
উত্তর ময়ালেরে[১৬] বন্ধু বেশী দূর না যাইও।
পাহাড়িয়া নদীর বাঁকে নৌকা না বাহিও॥
পূর্ব্ব সায়রের বন্ধু নাই সে কূল কিনারা।
দূরেত রাক্ষসের বাসা প্রাণে যাইবা মারা॥

বিপদে পড়িলে বন্ধু দুর্গার নামটি লইও।
বচ্ছরের মধ্যে বন্ধু গিরেত ফিরিও॥
তুফানে পড়িলেরে ডিঙ্গা মনসা স্মরণ।
অগতির গতি প্রভু দেব নারায়ণ॥
দেবতা সকলে বন্ধু রাখুন তোমারে।
কহিতে কান্দয়ে কন্যার দুই আঁখি ঝরে॥”

মাথায় তুল্যা লইল কন্যা যাত্রা কালের বাতি।
বিদায় করিতে কন্যা যায় প্রাণপতি॥
দুই আখ্‌খি[১৭] ঝরে কন্যার শাওনের ধারা।
সপ্প যেমুন নিজ মণি করিল পাশুরা[১৮]
ধান্য দুর্ব্বা রাখে কন্যা গলুইয়ের উপরে।
জুড়িয়া দুখানি হাত পূজে মনসারে॥
দীপ ধূপ দিয়া করে ডিঙ্গার সাজন।
জোকার করিল কন্যা মঙ্গল কারণ॥
ধুয়াইয়া[১৯] পতির পাও কেশেতে মুছায়।
এক বচ্ছরের লাগ্যা পতি করিল বিদায়॥
ভাটি গাঙ্গের উজান বাতাস উড়াইল পাল।
বিদায় হইল সাধুর ডিঙ্গা হৃদয়ে দিয়া শাল॥ (৪৬—৭৪)

(৩)

শয়ন মন্দিরে কন্যা থাকে একেশ্বরী।
উঠা পড়া করে মন চিন্তা হইল ভারি॥

খাট আছে পালং আছে পুষ্পের বিছানী।
বাছিয়া লইল কন্যা ভূমি শয্যাখানি॥
অঙ্গের যত সোণারে দানা খুলিয়া ফালায়।
খালি মন্দিরে নিশি কেমনে পোহায়॥
পুষ্পে না আদুরে কন্যা সোহাগেতে মানা।
বেগরে ছাড়িল কন্যা আরাম খানাপিনা॥
কোইল[২০] ডাকে বনের ঘরে কাঁপে গাছের পাতা।
পুষ্প ভারেতে আল্যা[২১] পড়ে মালতীর লতা॥
চাম্পা গাছেত দেখ পুষ্প সারি সারি।
যৈবন হইল বাসি কান্দে সাধুর নারী॥

“রতন মন্দির ঘর শূন্য যে করিয়া।
এন[২২] কালে বন্ধু মোর গেল যে ছাড়িয়া॥
আর কতদিন ধইরা রাখি নারীর যৈবন।
আর কতদিন বাইন্ধা রাখি অবুলার[২৩] মন॥
পাখী যদি হইতাম বন্ধুরে যাইতাম উড়িয়া।
কোন সায়রের বুকে বন্ধু ডিঙ্গা যায় রে বাইয়া॥
কালবরণ ভমরারে রূপার বরণ আঁখি।
কও কও বন্ধুর কথা কন্ন ভইরা শুনি॥
উড়িয়া যাওরে বনের পঙ্খী নজর বহুত দূরে।
আমার বন্ধুর দেখা পাইলা কোন গয়িন[২৪] সায়রে॥
শুনরে পবনা তুমি আমার মাথা খাও।
সংসার ঘুরিয়া তুমি ভরমিয়া বেড়াও॥

আসমানের চন্দ্র সুরুজ দুই আখ্‌খি জলে।
কোন দেশে গিয়াছে বন্ধু এই নিশির কালে॥”(৭৪—১00)

(8)

ভোর হইল কালনিশা কুঞ্জে ফুল ফুটে।
হেনকালে আইল দূতী লিখন লইয়া হাতে॥
কার লিখন কে পাঠাইল ত্বরিত অইয়া।
সারা নিশির অঙ্গের ধূলা কন্যা লইল ঝাড়িয়া॥
বন্ধু বুঝি এতদিনে পাঠাইল লিখন।
লিখন পড়িল কন্যা করিয়া যতন॥

রাজার পুত্র লিখছে লিখন গায়ে দিল কাঁটা।
যৈবন মাগিছে কন্যার দুষ্মন রাজার বেটা॥
আস্তেবেস্তে[২৫] কয় দূতী “কন্যালো, মোর কথা ধর।
আজি নিশি যাইবেনি কন্যা জোর মন্দির ঘর॥
সোণার যৈবনে কন্যা অঙ্গে ধূলা মাটি।
পালঙ্গে বিছাইয়া দিব ঐ না শীতলপাটি॥
সোণার যৈবন কন্যালো নাই সে আভরণ।
সোণায় বান্ধাইয়া দিব চিক্কনী[২৬] যৈবন।
বাগে আছে চাম্পার কলি গন্ধে আমোদিয়া।
দাসীগণে তুলে ফুল মালাটি গাথিয়া॥
সোণার বাটা ভইরা দিব পান আর চূণে।
রাজরাণী অইয়া কন্যা থাকিবা যতনে॥

গন্ধের তৈল সারি সারি লো কন্যা তোমার লাগিয়া।
সেহিত তৈল দাসীগণ দিব অঙ্গেত মাখিয়া॥
চাচর চিক্কণ কেশে বাইন্ধা দিব বেণী।
যতনে থাকিবা সুখে অইয়া রাজরাণী॥
আজু যে ফুটে সোণার ফুল কাইল অইব[২৭] বাসি।
সুবন্ন অধরে কন্যা না থাকির হাসি॥
নারীর যৈবন লো কন্যা জোয়ারের পানি।
একবার লাগিলে ভাটি বেরথা[২৮] টানাটানি॥”

“শুন শুন আলো দূতী কইয়া বুঝাই তোরে।
মোর পরাণ পতি নাই সে দেখ ঘরে॥
বরত[২৯] কইরাছি আমি শুন দিয়া মন।
রাজপুত্রে দিও আমার এই সে লিখন॥
বুঝাইয়া শুনাইয়া কইও আমার যত কথা।
বুঝাইয়া শুনাইয়া কইও দুখের বারতা॥
বড় দুঃখু দেয় মোরে শাশুড়ী ননদী।
তাদের দুঃখের দায়ে নিরালায় কাঁদি॥
ধরিতে না পারি যৈবন হইল বিষম কাল।
শাশুড়ী ননদী ঘরে হইল জঞ্জাল॥
চিত্তে ক্ষেমা দিয়ায়ে দূতী বচ্ছর গুয়ায়।
এই কথা বুঝাইয়া বইল রাজার ছাল্যায়॥
এক বচ্ছর ব্রত মোর ভূমিত শয়ন।
পর পুরুষের মুখ না করি দর্শন॥
খাট পালঙ্ক ছাড়ছি জমিনে বিছানা।
সম্ভোগবিভোগ দব্ব[৩০] কইরাছি বজ্জনা॥

* * * *
ধূলায় পাত্যাছি শয্যা ব্রতের কারণ॥

পুষ্প তুলিতে মানা এক বছর কাল।
রাজপুত্রে কইও দূতী আমার এই হাল[৩১]
সিনান করিতে নাই অঙ্গে ধূলাবালি।
এক বচ্ছর পরে ফুটব আমার যৈবন কলি॥
পরেত যাইব দূতী তাহার মন্দিরে।
লিখন লইয়া দূতী যাও তুমি ঘরে।”(১০০—১৫০)

(৫)

লিখন লইয়া দূতী হইল বিদায়।
খালি ঘরে শুইয়া কন্যা করে হায় হায়॥
“দুষ্মন রাজার পুত্র কি জানি কি করে।
একেলা কেমনে আমি থাকি শূন্য ঘরে॥
নিরাশা দিলে না জানি করে কোন কাম
পতির উপরে বুঝি বিধি হইল বাম॥
দুরন্ত বনের বাঘা শীকারেতে আশা।
কি জানি ভাঙ্গিয়া দেয় আমার সুখের বাসা॥
বার বচ্ছরের লাগ্যা পতি পাঠাইল বিদেশে।
আলুফা আচানকা দব্ব[৩২] মিলব কোনবা দেশে॥
বিধি যদি সদয় হওয়ে আসে ছয় মাসে।
বিধি যদি নিরদয় আর না হইব দেখা।
গলায় তুলিয়া দিব কাটারির লেখা[৩৩]॥”(১৫০—১৬৪)

(৬)


এই মত কান্দিয়া কন্যার একমাস যায়।
সুমুখে আগুন[৩৪] মাস আইল নয়া বায়॥
মন্দিরে আসিতে দেখ দূতীর হইল মানা।
কবুতরা আনে লিখন শূন্যে আনাগোনা॥

এইতনা আগুন মাসরে শীতে হিস্‌ফিস[৩৫]
বায়েতে আলিয়া[৩৬] পড়ে নয়া ধানের শীষ॥
ঘরে আইল নয়ারে ধান্নি জয়াদি জোকারে।
অর্ঘ্য দেয় কুলের নারী ঘরের লক্ষ্মীরে॥
আমি অভাগী নারীর চিত্তে হাহাকার।
কণ্ঠে নাই সে ফুটে আমার জয়ের জোকার॥
দয়া কর লক্ষ্মীমাতা দয়া কর তুমি।
কাল বিয়ানে উইঠ্যা দেখি ঘরে আইছে সুয়ামী॥”

“শুন শুন সাধুর কন্যালো শুন কই তোমারে।
প্রাণের কথা বল্যা দিও এইনা কইতরারে[৩৭]॥”

“শুন শুন রাজপুত্র শুন মন দিয়া।
এই মাস থাক তুমি চিত্তে ক্ষেমা দিয়া॥”(১৬৪—১৮০)

(৭)

আইল দারুণা পৌষ্যরে পৌষে অন্ধকার।
উত্তইরা বাতাসে আমার গায়ে আইল জ্বর॥

ঘরে নাই সে প্রাণের প্রতি ঘর অন্ধকার।
শূন্য বুক ফাট্যা উঠে দুঃখের হাহাকার॥
কুয়ায়[৩৮] ছাইল দেশ অন্ধ হইল আঁখি।
কাইল বিয়ানে উঠ্যা যদি সুয়ামীরে দেখি॥

“শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
আর কতদিন আর কতকাল ভাড়াইবা মোরে॥”

“শূন্যে আইয়ে শূন্যেত যাইরে তোমার কৈতরা।
এই মাস থাক কুমার চিত্তে ক্ষেমা দিয়া॥
মন হইল ভারা সারা প্রাণ হইল খালি।
শাশুড়ী ননদী হইল দুই চক্ষের বালি।
শাশুড়ী ননদী দেয় দুরাক্ষর গালি॥” (১৮০—১৯৩)

(৮)

“এহিতনা মাঘ মাস শীতে কাঁপে হাড়।
ভূমিত পাতিয়া শয্যা কান্দি জারে জার[৩৯]
ছিঁড়িয়া মৈলান[৪০] হইল অগ্নি পাটের শাড়ী।
বৈদেশী হইয়াছে বন্ধু অভাগীরে ছাড়ি॥
খাট আছে পালং আছে লেপ তূলা ভরা।
একতিলা[৪১] বন্ধু মুখানি না যায় পাশুরা॥

বন্ধু যদি থাকত গিরে[৪২] পালঙ্কে শুইয়া।
পোহাইতাম দিঘল নিশি তারে বুকে লইয়া॥
মাটি হওরে মাটির দেহা তোমার কিবা কাম।
সোয়ামীর সোয়াগ্যা ছিলাম সোয়ামীর পরাণ॥
এন সুয়ামী যদি ছাইড়া গেল মোরে।
মুছাইয়া দুই আখ্‌খি কেবান লইব উরে॥”

“শুন শুন সাধুর কথা শুন দিয়া মন।
তিন মাস গত হইল চিত্ত উচাটন॥”

“শুন শুন রাজার পুত্র কহিযে তোমারে।
একদিন যাইবাম তোমার শয়ন মন্দিরে॥
যৈবন হইল বাসি চিত্ত উচাটন।
এহি দুখ্‌খু সহি কেবল ব্রতের কারণ॥ (১৯৩—২১৬)

(৯)

এহিতনা ফাগুন সকল মাসের রাজা।
রূপে ভইরা গন্ধে ভইরা পুষ্পকলি তাজা॥
নয়া বসন নয়ারে ভূষণ পরে বিরক্ষলতা।
তারা কি বুঝিবে হায় অভাগীর কথা॥
মদন বসন্ত কালে যেহি দিকে চাই।
পরাণ বন্ধুরে আমার দেখিতে যে পাই॥
ফুলে বন্ধু কুলেরে বন্ধু ভমরার বোলে।
ধরিতে ছুইতে নারি কেবল ভাসি আঁখি জলে॥
নাসিকায় পাই গন্ধ কানে শুনি কথা।
এহি দুঃখ দিল মোরে দারুণ বিধাতা॥”

“শুন শুন সাধুর কন্যা শুন দিয়া মন
চারিমাস হইল গত চিত্ত উচাটন॥”

“শুন শুন রাজার পুত্র শুন মন দিয়া।
এহি মাস থাক তুমি চিত্তে ক্ষেমা দিয়া॥” (২১১-২২৫)

(১০)

“আইল চৈতের হাওয়া মন হইল পাগলা।
অঙ্গ জ্বলিয়া যায় মদনের জ্বালা।
ক্ষণে উঠি ক্ষণে বসি ক্ষণে নিদ পারি।
ক্ষণে ক্ষণে স্বপ্ন দেখি বন্ধু আইল বাড়ি॥
পালঙ্কে বসিয়া বন্ধু কোলে নিল মোরে।
মুখেত রাখিয়া মুখ চুম্বিল আমারে॥
দ্বিতীয় পওর[৪৩] নিশি বন্ধু দিল আলিঙ্গন।
তিতিয় পওরে হইলাম নিদ্রায় মগন॥
অলস অবশ অঙ্গ দেহায় বল নাই।
চতুত্থ পওরে বন্ধু জাগিয়া না পাই॥
দারুণ কোইলার ডাকে নিদ্রা যে ভাঙ্গিল[৪৪]
স্বপ্নেত আসিয়া বন্ধু কোথায় লুকাইল॥
সাড়ীর আইঞ্চলে খুঁজি খুঁজি মাথার কেশে।
বুকে আছে পরাণ বন্ধু সুমুখে নাই সে আসে॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
পঞ্চ মাস গতেক যদি কত ভাড়াও মোরে॥”

“বছরের অধেক গত কুমার মন কর থির
নয়া বচ্ছরে যাইম তোমার মন্দির॥” (২২৫—২৪৩)

(১১)

“পরথম বৈশাখ মাসরে নয়া বছর পরে।
অদিষ্টে বিধাতা জানি কি লিখ্যাছে মোরে॥
লীলারী বাতাসে অঙ্গ না হয় শীতল।
ঘুসির আগুন যেমুন রইয়া রইয়া জ্বলে॥
কাল যৈবন কাল রাখিতে না পারি।
ভূমিত পাতিয়া শুই অগ্নি-পাটের সাড়ী॥
বন্ধু যদি আইত দেশে কিসের বরত পালি[৪৫]
যতনে গাথিতাম মালা নয়া পুষ্প তুলি॥
পুষ্পবনে আনিতাম ভ্রমরে বান্ধিয়া।
আইজ নিশি যায় মোর কান্দিয়া কান্দিয়া॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা লিখন লিখি তোরে।
ছয়মাস গত হইল কত ভাড়াও মোরে॥
রূপের যমুনা নদী আজিকে উজানী।
দিনে দিনে ভাটি ধরবে নাই সে থাকবে পানি॥”

“এওমাস যায় কুমার—কুমার আরে শান্ত কর মন।
আর কিছু কাল গেলে হবে অবশ্যি মিলন॥” (২৪৩—২৫৯)

(১২)

“এহিতনা জৈষ্ঠ মাসারে গাছে নানা ফল।
জীবন যৌবন মোর সকলই বিফল॥

জলটুঙ্গি ঘর[৪৬] মোর পইড়া আছে খালি।
কেমুন দুষ্মনে মোরে দিল এমুন গালি॥
যদি ঘরে থাক্‌ত বন্ধু কোলেতে লইয়া।
জলটুঙ্গি ঘরে নিদ্র। যাইতাম শুইয়া॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
এওমাস গত হইল কত ভাড়াও মোরে॥”

“কালপূর্ণ হইতেরে কুমার পঞ্চমাস বাকী।
সবুরে ফলিবে মেওয়া আশার আশে থাকি॥” (২৫৯—২৬৯)

(১৩)

“আষাঢ় মাসেত গাঙ্গরে বহিছে উজানী।
শুকনা নদীতে আইল জোয়ারের পানি॥
দেয়ায় ডাকে ঘন ঘন মেঘে শীতল পানি।
পিয়াসে তাতিয়া মরি অবুলা[৪৭] দুষ্কিণী[৪৮]
এই মেঘে নাইরে পানি আমার লাগিয়া।
অখ্‌খির পাতা চইল্যা পড়ে আসমান চাহিয়া॥
বিধি নিদারুণ অইল তাই যত দুঃখু যায়।
আষাঢ়ের ভরা নদী এমুন শুকায়॥
শুন শুন বিঘুর[৪৯] দেওয়ারে[৫০] ডাকে কাঁপে মাটি।
দিনে দিনে যৈবন গঙ্গা ধরিলেক ভাঁটি॥

কইও কইও মনের কথা প্রাণবন্ধুর কাণে।
মরিল দুষ্কিনী কন্যা মরিল পরাণে॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা আর নাই সে ভাড়াও।
ত্বরিত উত্তর দিও আমার মাথা খাও॥
গোপনে পাঠাইলাম কন্যা সোণার চৌদোলা।
যতনে রাখ্যাছি কন্যা মাণিক্যির মালা॥”

(স্বগত)


“হায়রে দুষ্মন কুমার কি কহিলি কথা।
তোমার দেওয়া মণিমুক্তা বন্ধুর পায়ের ধূলা॥”

(প্রকাশ্যে)


“শান্ত কর কুমার আরে শান্ত কর মন।
অল্প কালে হবে কুমার অবশ্যি মিলন॥” (২৬৯—২৮৯)

(১৪)

শাওন[৫১] বাওনা[৫২] মাস আথাল পাথাল[৫৩] পানি।
মনসা পূজিতে কন্যা হইল উৎযোগিনী॥
কান্দিয়া বসাইল ঘট আপনার গিরে।
প্রাণপতি ঘরে আইসে মনসার বরে।
চাচর চিক্কণ কেশে গিরটি[৫৪] মাঞ্জিল।
নূতন পিটালি দিয়া আলিপনা দিল॥

পঞ্চনাগ আঁকে কন্যা শিরের উপরে।
মনসা দেবীরে আঁকে অতি ভক্তিভরে॥
শির নোয়াইয়া করে শতেক পন্নতি।
“বর দাও মনসাগো ঘরে আইওক[৫৫] পতি॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা কহি যে তোমারে।
সিপাই লস্কর যাইবে আনিতে তোমারে॥”

“শুন শুন রাজার কুমার শান্ত কর মন।
ব্রতকাল শেষ প্রায় অবশ্য মিলন॥” (২৮৯—৩০৩)

(১৫)

“ভাদ্র মাসের চান্নি দেখ গাঙ্গের তলা দেখে।
ঠেকিয়া রহিল ডিঙ্গা কোন বা নদীর পাকে॥
আমারে দেখিতে বন্ধুর নাই কি লহে মন।
এমন নিদয়া বন্ধু হইল ক্যামন॥
পাল উড়ে পাল পড়ে দূর গাঙ্গের বুকে।
এই বুঝি আইল বন্ধু স্মরিয়া আমাকে॥”

অগ্নি পাটের শাড়ী কন্যা খুলিয়া লইল।
ভরা ডিঙ্গা লইয়া বন্ধু বুঝি দেশেতে ফিরিল॥
ধান্য দুব্বা লইল বাছি[৫৬] অর্ঘিতে[৫৭] যায় ঘাটে।
এন কালে আইল কৈতর কন্যার নিকটে॥

“শুন শুন সুন্দর কন্যা শুন দিয়া মন।
বিফল আইল তোমার অঙ্গের সাজন।

সাধুর নন্দন কন্যা আর না যাইব দেশে।
ডুব্যাছে ডিঙ্গার লোক আবঙ্গের দেশে॥”

“শুন শুন রাজার পুত্র শুন দিয়া মন।
অকূলে ডুবুক ডিঙ্গা লইয়া যতেক ধন॥
সুয়ামী ডুবিয়া মরুক কোন দুঃখু নাই।
তোমার মতন রাজা সুয়ামী যদি পাই॥” (৩০৩—৩২১)

(১৬)

“আশ্বিন মাসেত হায়রে দুর্গা পূজা দেশে।
অবশ্যি আইর পতি দুগ্‌গারে পুজিতে॥
তুল্যা রাখি পদ্মর ফুল তুল্যা রাখি পাতা।
কি দিয়া পূজিব বন্ধু জগতের মাতা॥
ফুটিল সিঙ্গারা ফুল গন্ধে ভায় ভরা।
এও ফুল অইল বাসি শুকায় নদীর ধারা।
এও মাসে বন্ধু মোর না আইল গিরে।
কার্তিক অইলে গত কে রাখিবে মোরে॥”

“শুন শুন সুন্দর কন্যা নাইসে দেওগো ফাঁকি।
বচ্ছর গোয়াইতে দেখ এক মাস বাকি॥
ফিইর‍্যা আইলে নাগর তোমার বান্ধিয়া মারিব।
আগুন মাসেত কন্যা তোমায় বিয়া যে করিব॥
মণিমুক্তা দিয়া লো কন্যা করিবাম সাজন।
হীরায় গড়িয়া দিবাম যত আভরণ॥”

“শুন শুন রাজার পুত্র কহি যে তোমারে।
পতিষ্টার[৫৮] কাল পুন্ন[৫৯] হইল নিকটে॥

স্বামীরে মারিবা কুমার দুঃখু নাই তায়।
রাজা সুয়ামী যদি ভাগ্যেতে মিলায়॥”

বগুলা সুন্দরী কান্দে হইয়া হারা-দিশ্[৬০]
কেশেত ছাপাই বান্ধে কাল জহর বিষ॥
বরতের যত আয়োজন করে রাজার বেটা।
লাগিবেক একশত কালা ধলা পাটা॥

* * * *

মেষ মহিষ আর জোড়া কবুতর॥

* * * *

কত যে লাগিব তার লেখা জোখা নাই॥
“কার্ত্তিক মাসেত কুমার চিত্ত উচাটন।
বৈদেশে সাধুর পুত্রের হইয়াছে মরণ॥
চৌদল পাঠাইও কুমার নিশি দুপহরে।
কালুকা[৬১] যাইব কুমার তোমার মন্দিরে॥” (৩২১—৩৪৯)

(১৭)

লিখন লইয়া কৈতরারে শূন্যে দিয় উড়া।
জালেত হইল বন্দী ননদিনী খাড়া॥
“নিলাজ অসতী নারী কি কহিবাম তোরে।
গলায় কলসী বাইন্ধা যাহ জলের ঘাটে॥
তুষের আগুন জ্বালি নিজেরে পুড়াও।
এমনি কলঙ্কী মুখ জগতে দেখাও॥”

ঘরের ছিকল বন্ধ বন্দী হইল নারী।
পিঞ্জরায় বন্দী হইল উড়ন্ত কৈতরী॥

এন কালেতে সাধুর ডিঙ্গা লাগিলেক ঘাটে।
দেশেত পড়িল সাড়া বাদ্দিভাণ্ড বাজে॥
ভরা ডিঙ্গা ছাইড়া উঠে সাধুর নন্দন।
শীতল মন্দিরে যায় ত্বরিত গমন॥

“শুনলো প্রাণের কন্যা বগুলা সুন্দরী।
এক বচ্ছর গত হইল তোমারে না দেখি॥
কেমনে পরাণ ধরি বৈদেশেতে বাসা।
দারুণ রাজার পুত্র করিল নিরাশা॥
ভাড়াইয়া ভাড়াইয়া মোরে পাঠায় বৈদেশে।
আর না থাকিম এমুন রাজার দেশে॥

* * * *

দুয়ার খোললো কন্যা আইলাম ঘরে॥”

* * * *

ননদী আসিয়া কয় সাধুর নন্দনে॥
“কলঙ্কে ছাইল দেশ দাদা নাহিক উপায়।
তোমার ঘরের নারী তোমারে ভাড়ায়॥”
পিঞ্জরা খুলিয়া পত্র ভাইয়েরে দেখাইল।
দেখিয়া সাধুর পুত্র আগুন জ্বলিল॥
ভরা ডিঙ্গায় উঠাইয়া কন্যারে দিল বনবাস।
কান্দে বগুলা কন্যা না পূরিল আশ॥ (৩৪৯—৩৭৫)

(১৮)

“বনে থাক বনের বাঘরে খাও মোর মাথা।
না কইও না কইও বন্ধে আমার যত কথা॥

শুনিলে পরাণ বন্ধু দুঃখ পাইব ভারি।
বিনা দোষে ছাড়ে পতি আপনার নারী॥
পতির কোন দোষ নাইরে যত দোষী আমি।
বান্ধিয়া রাখিলাম বিষ না খাইলাম আমি॥
দুষ্মন রাজার পুত্র মারিব পতিরে।
তেহি সত্য করিলাম তাহার গোচরে॥
মরিতাম খাইয়া বিষ কি করিত মোরে।
দেশ ছাইড়া পরাণ পতি যাইত বহুদুরে॥
আমি যে মরিতাম হায়রে কোন দুঃখ নাই।
পরাণে বাঁচিত বন্ধু দুষ্মনের ঠাঁই॥
সাক্ষী হইও তরুলতা তোমরা সকলে।
আমার যতেক কথা বন্ধু নাহি জানে॥
সাক্ষী হইও চান্দ সুরুজ সাক্ষী হইও তোমরা।
বগুলা কন্যার গান যত দুঃখুভরা।”
কান্দিয়া কাটিয়া কন্যার দুঃখের দিন যায়।
আর এক রাজার পুত্র পথে পাইল তায়॥ (৩৭৫—৩৯৪)

(১৯)

জোরেত ধরিয়া তারে লৈল নিজ দেশে।
কন্যা বলে আমার যে এক ব্রত আছে॥
ব্রতের যতেক বেশ অঙ্গে বিদ্যমান।
কন্যায় কয় “রাজার পুত্র রাখ আমার মান॥
বার মাস গেছে ব্রত প্রতিষ্ঠার কাল।
নাইসে ভাইঙ্গ ব্রত মোর না ঘটাও জঞ্জাল॥”

“তোমার বরত করতে কন্যা কোন কোন দব্ব লাগে।”
“মেষ লাগে মইষ লাগে আর কৈতর লাগে॥

কালাধলা পাঠা লাগে আর শবরী কলা।
এক লক্ষ সোণার চাম্পায় গাইথ্যা দিবা মালা॥
সব্ব-সুলক্ষণ এক সাউধের নন্দন।
তাহারে আনিয়া দিবা ব্রতের কারণ॥”
কত কত সাধুর পুত্র ডিঙ্গা বইয়া যায়।
যারে দেখে ধইরা আনে রাজার কুটালায়॥
দেখিয়া কন্যার রূপ রাজা উদামা পাগেলা।
যাহা কয় কন্যা রাজা নাহি করে হেলা॥

“এই সাধুতে আমার কাম নাহি হয়।”
লইক্ষ লইক্ষ সাউধের পুত্র বন্দী হইয়া রয়॥

একদিন কন্যার তবে আশা যে পূরিল।
আপন সোয়ামীরে কন্যা বন্দিত[৬২] করিল॥
উজান পানি বাইয়া সাধু ঘুরে নানা দেশে।
জানিয়া শুনিয়া সাধু কন্যারে উরদিশে[৬৩]
বনিজ্জি বিফল সাধুর মন হইল পাগেলা।
নানা দেশে ঘুইরা মরে জোয়াইরা চিলা॥
কন্যা কয় “অন্য জনে আর নাই সে কাম।”
যত যত সাধুর পুত্রে দিল মুক্তি দান॥

আইল ব্রতের দিনরে কার্ত্তিক মাস যায়।
লিখনে লিখিয়া কন্যা স্বামীরে জানায়॥
নিশি দুপর কালে কন্যা কোন কাম করে।
স্বামীরে লইয়া কন্যা ডিঙ্গার কাছি ছাড়ে॥

পূবাল বাতাসে কন্যা উড়াইল পাল।
পতি লইয়া ছাড়ে ডিঙ্গা উত্তর ময়াল॥
ঘুমতনে[৬৪] উঠ্যা দেখে রাজার রাজ্যবাসী লোকে।
পলাইয়া গেছে কন্যা আপনার দেশে॥(৩৯৪—৪২৭)


  1. কিবান=কিবা, কি।
  2. ছনরে ভন=ছন্ন ভন্ন, ছিন্ন ভিন্ন।
  3. খিন্ন=ক্ষীণ।
  4. ঝিমিঝিমি=নিশুতি, গভীর।
  5. উদাম=উদ্দাম, বেগশালী, পাগল।
  6. গহিন=গভীর।
  7. পাখালী=পক্ষ।
  8. রাখালিয়া রাজা=রাখালদের রাজা, এখানে ওস্তাদ বংশীবাদক।
  9. লেখনীর কলম=এখানে লেখনীর অর্থ লিখিবার।
  10. কুমারে=রাজপুত্রকে।
  11. C.ƒ. “জীবনে মরণে, মরণে জীবনে প্রাণবন্ধু হইও তুমি।” —চণ্ডীদাস
  12. বিরক্ষ=বৃক্ষ।
  13. যোগল=যুগল।
  14. হেলা ফেলা=বাজে কথা
  15. সায়র বানে=সাগরের পানে।
  16. ময়ালেরে=মহালে, দিকে
  17. আখ্‌খি=আঁখি।
  18. পাশুরা=ভুলিয়া গেল,—এখানে হারাইয়া ফেলিল।
  19. ধুয়াইয়া=ধোয়াইয়া।
  20. কোইল=কোকিল।
  21. আল্যা=এলাইয়া।
  22. এন=হেন।
  23. অবুলার=অবলার।
  24. গয়িন=গভীর।
  25. আস্তেবেস্তে=তাড়াতাড়ি, অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে।
  26. চিক্কনী=মনোহর।
  27. অইব=হইবে।
  28. বেরথা=বৃথা।
  29. বরত=ব্রত।
  30. সম্ভোগবিভোগ দব্ব=ভোগবিলাসের দ্রব্যসামগ্রী।
  31. হাল=অবস্থা।
  32. আলুফা আচানকা দব্ব=হঠাৎ কোন আশ্চর্য দ্রব্য
  33. লেখা=রেখা, তীক্ষ্ণ অংশ।
  34. আগুন=অগ্রহায়ণ।
  35. হিস্‌ফিস=হিমসিম।
  36. আলিয়া=এলাইয়া।
  37. কইতরারে=পায়রাকে
  38. কুয়ায়=কুয়াশা।
  39. জারে জার=শীতে জড়সড় হইয়া।
  40. মৈলান=মলিন।
  41. একতিলা=একতিল পরিমিত সময়ও।
  42. গিরে=গৃহে।
  43. পওর=প্রহর।
  44. “দ্বিতীয় পওর......নিদ্রা যে ভাঙ্গিল।”—এই পদটি ঠিক চণ্ডীদাসের একটি পদের অনুরূপ।
  45. বরত পালি=ব্রত এবং নিয়ম পালন।
  46. জলটুঙ্গি ঘর=গ্রীষ্মকালে আরাম উপভোগ করিবার জন্য ধনী ব্যক্তিরা জলাশয়ের মধ্যে গৃহ নির্ম্মাণ করিতেন, ঐ গৃহকে জলটুঙ্গি বলে।
  47. অবুলা=অবলা।
  48. দুষ্কিণী=দুঃখিনী।
  49. বিঘুর=বেঘোর, ভয়ানক।
  50. দেওয়ারে=হে মেঘ।
  51. শাওন=শ্রাবণ।
  52. বাওনা=বাউড়িয়া, পাগল।
  53. আথাল পাথাল=এদিকে ওদিকে, বিশৃঙ্খল ভাবে।
  54. গিরটি=গৃহটি।
  55. আইওক=আসুন।
  56. বাছি=বাছিয়া।
  57. অর্ঘিতে=অর্ঘ্য দিতে।
  58. পতিষ্টা=প্রতিষ্ঠা, ব্রত-প্রতিষ্ঠা।
  59. পূন্ন=পূর্ণ।
  60. হারা-দিশ্=দিশেহারা, নিরুপায় হইয়া।
  61. কালুকা=কাল
  62. বন্দিত=বন্দী।
  63. উরদিশে=উদ্দেশে
  64. ঘুমতনে=ঘুম হইতে।