পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/সোণাবিবির পালা

উইকিসংকলন থেকে

সোণাবিবির পালা

 গত ১৯শে পৌষ তারিখে শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে আমাদের একটি পালা পাঠাইয়াছেন, তাহার নাম সোণাবিবির পালা। চন্দ্রকুমারবাবু এই পালাটি তিন জন বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন। তাহাদের দুইজন—রহমন সেখ ও যদুনাথ বাউল; ইহারা শ্রীহট্ট অঞ্চলের কাটিহালি গ্রামের অধিবাসী। তৃতীয় ব্যক্তি রজনী মাল নামক গায়ক আজমিরি বাজার অঞ্চলের একজন মাঝি।

 পালাটি সম্পূর্ণভাবে এখনও চন্দ্রকুমারবাবু সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। আপাততঃ ইহার ৫৫০টি ছত্র পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু আমাদের গ্রন্থের ছাপা প্রায় শেষ হইয়া আসায় স্থানাভাবে এই ৫৫০ ছত্রও আমরা সমস্ত প্রকাশ করিতে পারিলাম না। পালাটির দুই জায়গা হইতে ৮২ ছত্র উদ্ধৃত করিয়া দিলাম মাত্র। নায়কের প্রেমের গভীরতা এই দুইটি স্থানে কবি অপরূপভাবে ভাষায় ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। উদ্ধৃত নমুনা হইতেই কবির শক্তির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যাইবে।

 যতদূর পাওয়া গিয়াছে, পালাটির গল্পাংশ এইরূপ। পালার নায়ক মামুদের পিতার নাম চান্দ সদাগর। তাঁহার সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির বর্ণনা দিয়াই পালা আরম্ভ করা হইয়াছে। পুত্ত্রের জন্মের পর চান্দ সদাগর বাণিজ্যে গিয়া আঠার বৎসর কাল আর প্রত্যাবর্ত্তন করেন না। তখন মামুদ মাতার অনুমতি লইয়া বাণিজ্যে যাত্রা করে ও পথে সুন্দরী সোণাবিবিকে দেখিয়া মুগ্ধ হয়। তাহার পর বন্ধু মমিনের সাহায্যে মামুদ সোণাবিবিকে বিবাহ করে, কিন্তু বিবাহের পর পত্নীর প্রেমে আত্মহারা হইয়া মামুদ বিষয়কর্ম্ম সমস্ত একেবারে অবহেলা করিতে আরম্ভ করে। ফলে তাহাদের অত্যন্ত সুরবস্থা হয়। অবশেষে বন্ধু মমিনের উপদেশে স্ত্রীর দুর্দ্দশা দূর করিতে মামুদ নৌকা লইয়া আবার বাণিজ্যে বাহির হয় কিন্তু ভাগ্য এখনও তাহার প্রতি প্রসন্ন নয়। ঝড়ে তাহার নৌকা ডুবিয়া যায় এবং কোন রকমে জল হইতে রক্ষা পাইলেও জঙ্গলে অসহায় অবস্থায় ঘুরিতে ঘুরিতে মামুদ সর্পদষ্ট হয়। পালাটির এই পর্য্যন্তই পাওয়া গিয়াছে।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

সোণাবিবির পালা

* * * *
দেখিয়া সোণার রূপ মামুদে সংশয়।

খালি ঘরে রাখলে সোণা কি জানি কি হয়॥
মাথায় রাখিলে সোণা উকুনেতে খায়।
কি জানি জমিনে থুইলে পিপড়ায় লইয়া যায়।
কি জানি জলেতে গেলে দেহাটি মিলায়॥

* * * *
সকল ছাড়িয়া মামুদ গিরেতে বসিল।

সোণার লাগিয়া মামুদ পাগল হইল॥
বাপ আমলের খাট পালং সাজুয়া বিছানা।
শয়ন করে মামুদ সঙ্গে লইয়া সোণা॥
কি জানি সোণার যদি ঘুম নাহি আইসে।
আবের পাঙ্খা লইয়া মামুদ জুরায় বাতাসে॥
ঝিলমিল মশারি টাঙ্গা তবু মনে ভয়।
কি জানি মশার কামুড়ে কন্যার পরাণ সংশয়॥
পিপড়ার কামুড়ে কন্যার গায়ে লাগে চাকা।
আপন আইঞ্চল দিয়া মামুদ অঙ্গ দেয়রে ঢাকা॥
মধুর আলাপনে নিশি গত হইয়া যায়।
মামুদ ভাবে আইজের নিশি কেন বা পোহায়॥
না পোহাও না পোহাও রে নিশি একটুখানি থাক।
উজাগরে গেছে নিশি আমার কথা রাখ॥

* * * *

ডাক্যনারে সোণার কুইল বাচ্চায় দেওরে উম।
তোমার ডাকে ভাইঙ্গা যাইব (আমার) সোণার কাঁচা ঘুম॥
শোন শোন বনের দইয়াল না দিওরে শিষ।
কাঁচা ঘুমে জাগলে সোণার মাথায় হইব বিষ॥
বিয়ান বেলার ভোমরারে কইয়া বুঝাই তোরে।
ফুলের ঘুম না ভাঙ্গাও তুমি গুনুর গুনুর সুরে॥
ফুলের মধু খাইয়া না ভোমর অঙ্গ তোমার তাজা।
কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়া মনে নাইসে দিও দাগা॥

* * * *

বাড়ীর পাছে বাঁশের ঝাড়ে নাচিছে খঞ্জনা।
বিভোলে শয্যায় পইরা ঘুমায় প্রাণের সোণা॥
তুই আঁখি মুদিয়া কন্যা বিভোলে ঘুমায়।
দুই আঁখি মেলিয়া মামুদ আলসে তাকায়॥
বসনে না ঘিরে অঙ্গ মামুদ ভাবে মনে মনে।
কি জানি ছুঁইতে গেলে ভাঙ্গে কাঁচা ঘুম।
মাথার কেশ আউলা ঝাউলা শয্যার তলে লুটে।
বিয়ানের বাতাসে কন্যার মধুনিদ্রা টুটে॥
বাহুটি শিথানে কন্যা শুইয়া নিদ্রা যায়।
ভাঙ্গাইতে না পারে মামুদ কি হইবে উপায়॥

* * * *

ধীরে ধীরে পুষ্পের কলি ফুট্যা যেমন উঠে।
দুই নয়ান জড়াইয়া ঘুম আস্তে ব্যস্তে টুটে॥
দুই বাহুর আলিঙ্গনে সোণা নয়ন মেল্যা চায়।
লাজে রাঙ্গা হইল কন্যা সিন্দুরের প্রায়॥

মুখে চুম্ব দিয়া মামুদ ঘরের বাহির হৈল॥
দুয়ারেতে মাও জননী দেখ্যা লজ্জা পাইল।

* * * *

নৌকাডুবির পরে

বেবানে পড়িয়া মামুদ কতির হইল।
হেন কালে সোণার মুখ মনেতে পড়িল॥
হায় হায় সোণার সঙ্গে আর কি হবে দেখা।
মানুষ করিয়া বিধি কেন না দিল পাখা॥
পাখা থাকতরে বিধি যাইতাম উড়ি।
পরের ঘরে কেমন আছে আমার সোণা বিবি॥
পরের ঘরের কালা মুখ কেমনে থাকে সইয়া।
ছয়মাস কেমনে আছে আমারে ছাড়িয়া॥
এক দণ্ড আমারে না দেখলে প্রাণে মরে।
আছে কি না আছে সোণা ছয়মাস পরে॥
আমার সোণার মরজি মেজাজ পরে কি জোগায়।
কালামুখে কটু বাক্য তাহারে শোনায়॥

খিদা লাগিলে সোণার মুখে নাইসে রা।
মুখ দেখ্যা কে বুঝিবে তাহার অন্তরা॥
নিদ্রা যুদি পায়রে সোণার কে দেয় বিছানি।
তিরাস লাগিলে তার কেবা জুগায় পানি॥
হায় নদীর পারে আইলে সোণা কলসী কাঁকে লইয়া।
শুধা কলসী রাখ্যা ভূঁয়ে থাকে পন্থ চাইয়া॥
আজি যদি দেখতরে সোণা আমার ডিঙ্গার পাল।
বাতাসে সরিয়া যাইত অন্তরার জঞ্জাল॥[১]

সাঞ্জ্যা বেলা শূন্য কলসী কাঁকালে করিয়া।
বিরহে বিভোলা সোণা যায় কি চলিয়া॥
শুকনা মুখে পন্থ চাইয়া বাড়ী ফিরিয়া যায়।
পরের ঘরেতে সোণা পরের গালি খায়॥
ভেল্[২] নিদ্রা ভাঙ্গি সোণা যখন নাকি চায়।
স্বপনের ধন তার স্বপনে মিলায়॥
সকালে উঠিতে সোণার পাও ভাইঙ্গা পড়ে।
কত যে গঞ্জনা সোণা পায় পরের ঘরে॥
নদীর পারে কেয়াফুল ফুলের সুবাসে।
অভাগিনী বিরহী নারীর নিদ কিসে আসে॥
আষাইরা দেওয়ায় ডাকে ঘন বয়রে ধারা।
কাঁপ্যা উঠে বিরহিণী নারীর অন্তরা॥
আপন বন্ধু কোলে নাইরে কে তারে সুমুজে।
পরের অন্তরার দুঃখ পরে কত বুঝে॥
দুরন্ত কার্ত্তিকের উষে ভিজ্যা যায়রে দিশ।
এই উষ লাগিয়া সোণার মাথায় দারুণ বিষ॥
এই বিষে বিষেরে সোনা আমার প্রাণে যাইব মারা।
আর না দেখবাম চান্দমুখ বুকে বিন্‌লো খাড়া॥[৩]


  1. বাতাসে.........জঞ্জাল—আজ যদি আমার নৌকার পাল সোণা দেখিতে পাইত, তবে সেই পালের স্পর্শ-মধুর হাওয়ার তাহার অন্তরের দুঃখ দুর হইয়া যাইত।
  2. ভেল্=মিথ্যা নিদ্রার ভান করিয়া সোণা রাত্রি কাটাইয়া দেয়। সেই মিথ্যা নিদ্রা-ভঙ্গের পর।
  3. বিন্‌লো খাড়া=খাড়া বুকে বিদ্ধ হইল। বিন্‌লো=বিন্ধিল।