পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/সোণারায়ের জন্ম

উইকিসংকলন থেকে

চাঁদরায়-সোণারায়

 এই পালা-সংগ্রাহক শ্রীযুক্ত চন্দ্রকুমার দে এই পালা সম্বন্ধে যে বিবরণ পাঠাইয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল। “চান্‌রায়ের পিতা কৃষ্ণ চৌধুরী নবাব মুরসিদ কুলি খাঁর একজন প্রিয় কর্ম্মচারী ছিলেন। তাঁহার পূর্ব্ব উপাধি তলাপাত্র ছিল। নবাব সরকারের অনেক দুরূহ কার্য্য অসামান্য কৃতিত্বের সহিত সম্পন্ন করিয়া কৃষ্ণ চৌধুরী এককালে কানুনগোর পদ প্রাপ্ত হন। তৎপরে ময়মনসিংহের তদানীন্তন কোনও ভূম্যধিকারী নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিলে কৃষ্ণ চৌধুরী বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরিত হন এবং ছলেবলে বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হন। এই সময়ে ময়মনসিংহের দত্ত ও নন্দীবংশীয়েরা জমিদারী শাসন করিতেছিলেন। অকস্মাৎ দৈবদুর্ব্বিপাকে তাঁহাদের দেয় রাজস্ব পথিমধ্যে দস্যুকর্ত্তৃক লুষ্ঠিত হওয়ায় তাঁহাদের সৌভাগ্যের দিন অন্তর্হিত হয়। নবাব লুটের কথা অবিশ্বাস করেন এবং কৃষ্ণ তলাপাত্রকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করিয়া ময়মনসিংহের জমিদারী ফরমান প্রদান করেন।

 শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র চাঁদরায় আলিবর্দ্দি খাঁ নবাবের আমলে রাজস্ব-বিভাগের প্রধান কর্ম্মচারীর কাজ করিতেন। প্রবাদ ঘোড়াঘাট চাকলার কোনও দুর্দ্দান্ত মুসলমান জমিদার বিদ্রোহী হইলে তাহাকে শাসন করার জন্য নবাব আলিবর্দ্দি খাঁ চাঁদরায়কে তথায় প্রেরণ করেন। চাঁদরায় প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা না করিয়া গোপনে বিনা রক্তপাতে যাহাতে কার্য্যসিদ্ধ হয় তাহারই উপায় চিন্তা করিতে থাকেন এবং কতকগুলি সুবৃহৎ সুদৃশ্য অশ্ব সঙ্গে করিয়া অশ্বব্যবসায়ী সদাগর সাজিয়া তথায় অবস্থিতি করেন। তাঁহার চেহারা অতি সুন্দর ছিল, তাঁহার অপূর্ব্ব সুন্দর রূপ দেখিয়া অনেকে তাঁহাকে ছদ্মবেশী রাজপুত্র মনে করিতে লাগিল। ক্রমে জমিদার-পত্নী তাঁহার অপরূপ রূপের কথা শুনিয়া ও পরে দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন এবং তিনি ক্রমশঃ চাঁদরায়ের এমন বশীভুতা হইয়া পড়েন যে চাঁদরায় একমাত্র তাঁহারই সাহায্যে সেই জমিদারকে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করিয়া তদীয় ছিন্নমুণ্ড নবাব-সম্মুখে প্রেরণ করেন। তখন চাঁদরায়ের পুত্র সোণারায়ের জন্ম হয়। অনেককাল পর্য্যন্ত উক্ত বেগম চাঁদরায়ের তত্ত্বাবধানেই বাস করিতেছিলেন। ক্রমে মনােমালিন্যের সূত্রপাত হইলে চাঁদরায় তাঁহার রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করেন। এই বেগমের গর্ভজাতা এক কন্যা আবার সোণারায়ের রূপ দেখিয়া তাহাকে ভালবাসে। সোণারায় অনেক সময়ে এই বেগমের কাছেই থাকিতেন। বেগম ক্রুদ্ধা হইয়া একদা সোণারায়কে বন্দী করেন এবং বন্দিশালায় তাহাকে শৃঙ্খলিত করিয়া বুকে পাষাণ চাপাইয়া রাখেন। প্রবাদ আছে সোণারায় শেষে প্রহরীকে বহুমূল্য রত্নাঙ্গুরী উপহার দিয়া মুক্তিলাভ করেন। আবার লৌকিক প্রবাদের আর এক শাখা আরও করুণ। বেগম-দুহিতা মাতার এই ব্যবহারে অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বারবার মাতাকে বাঞ্ছিতের মুক্তিদান করিতে অনুরোধ করেন।

 কিন্তু বেগম তাহাতে স্বীকৃত হন নাই। তখন বেগম-দুহিতা একরূপ পাগলের মত হইয়া যান ও একদা গভীর নিশিথে বহুমূল্য বস্ত্রালঙ্কারে শোভিতা হইয়া একাকিনী সেই বন্দিীশালায় উপস্থিত হইয়া গায়ের গহনা এক এক করিয়া খুলিয়া দিয়া প্রহরীকে বিস্ময়াভিভূত করিয়া বন্দিীশালার অভ্যন্তরে উপস্থিত হন। অতঃপর এই প্রতিশ্রুতিতে সোণারায় মুক্তিলাভ করেন যে তিনি মুক্ত হইয়া বেগম-দুহিতার পাণিগ্রহণ করিবেন। মুক্তি পাইয়া সোণারায় প্রতিশ্রুতি-ভঙ্গ করেন। বেগম-দুহিতার কোমল হৃদয় এই নিদারুণ মর্ম্মপীড়ায় একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়ে। প্রবাদ আছে শেষে তিনি সেই নিদারুণ আঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া পাগল হইয়া যান। কোনো কোনো শাখায় বর্ণিত আছে তিনি আত্মহত্যা করেন। কিন্তু ছড়াগুলিতে উল্লিখিত বৃত্তান্ত স্পষ্ট ধরা পড়ে নাই, মাঝে মাঝে সত্য ঘটনার ছায়া পড়িয়াছে মাত্র।

 (১) মাসিক আরতি পত্রিকার পুরাতন এক সংখ্যা, (২) ময়মনসিংহের সৌরভ পত্রিকার জন্য প্রেরিত শ্রীযোগেন্দ্র ভট্টাচার্যের একটি অপ্রকাশিত প্রবন্ধ এবং (৩) দশকাহনিয়া, সেরপুর, সরিসাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি স্থান নিবাসী ইনাতুল্লা ফকির, নিমাই মুদী, গোলাম হুসেন প্রভৃতি কতিপয় কৃষকের নিকট হইতে ছড়াগুলি ও প্রবাদ কথাটির অনেকাংশ সংগ্রহ করিয়াছি। রামগোপালপুরের জমিদার শ্রীযুক্ত সৌরেন্দ্রকিশোর রায়-চৌধুরী প্রণীত ময়মনসিংহের বারীন্দ্র জমিদার নামক গ্রন্থেও এই প্রবাদ-কথার কোনও অংশের উল্লেখ আছে। এই শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীই নাকি এই জমিদার বংশের আদিপুরুষ। ছড়াগুলির তেমন বিশেষত্ব নাই। প্রবাদ-ঘটনাটির ঐতিহাসিক মূল্য কতখানি তাহাও জানিবার উপায় নাই। তবে প্রবাদগুলি কদাচ উপেক্ষনীয় নহে। যাহা লোকমুখে চলিয়া আসিতেছে তাহা আংশিক সত্য হইলেও ইতিহাসের উপেক্ষনীয় নহে। অনেক সময় প্রকৃত ইতিহাস বলিয়া আমরা যাহা গ্রহণ করিয়া থাকি, দেখা যায়, তাহাও মূল-শুন্য প্রবাদের ভিত্তির উপর লিখিত। তাহা যদি সত্য হয় তবে বর্ত্তমানে সংগৃহীত এই প্রবাদ ও ছড়ার হয়ত-বা একটা কিছু ঐতিহাসিক মূল্য থাকিতেও পারে। তবে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ও সোণারায় যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি তাহা বলাই বাহুল্য।”

 এই গানটিতে বাঙ্গালা প্রাচীন ছড়ার যে বৈশিষ্ট্য তাহা খুব বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়। কোন কোন ছত্রের বারবার পুনরুক্তি—এইটাই আমাদের পাড়াগাঁয়ের ছড়া-পাঁচালীর একটি চিরপরিচিত ধারা। ইহা চণ্ডীদাসের কবিতায়ও প্রচুর দেখা যায়, যথা:—

(১) কহিবে বঁধুরে সখি কহিবে বঁধুরে। 
গমন বিরোধী হ’ল পাপ শশধরে॥
(২) একথা কহিবে সখি একথা কহিবে। 
অবলা এতেক তপ করিয়াছে কবে॥
(৩) কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান। 
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন॥
(8) তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই। 
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন জন নাই॥ ইত্যাদি।

ইহাকে ইংরাজীতে refrain কহে। এই ছড়াটিতে বহুস্থানে এইরূপ পুনরুক্তি আছে, যথা ‘সোণারায় সোণারায় কি কর বসিয়া।’ বলা বাহুল্য পাড়াগাঁয়ের এই সুরটি বাঙ্গালীর নিকট বড়ই মর্ম্মস্পর্শী ও মধুর। লৌকিক সংস্কারে ঐতিহাসিক ঘটনা যে কিরূপ চালডালমেশানো খিচুড়ীর মত একটা জিনিশ হইয়া দাঁড়ায়, এই ছড়াটিতে তাহা প্রণিধান করিবার যোগ্য। এ কথা যদি সত্য হয় যে, কোন প্রতিহত-প্রেমিকার ষড়যন্ত্রে সোণারায় বন্দী হইয়াছিলেন, তবে অকস্মাৎ পীরের আবির্ভাব-জনিত নায়কের কারাবাসের কথা কিরূপে আসিল তাহা বোধগম্য নহে। ইতিহাসের উপকরণগুলি যাদৃচ্ছাক্রমে ব্যবহার করিয়া লৌকিক কল্পনা এই ছড়াটি প্রস্তুত করিয়াছিল। বঙ্গের পল্লীতে পল্লীতে বঙ্গাপল্লী-নায়কের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিবরণ এইরূপ ছড়াগানে প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইটপাথর কুড়াইয়া যেরূপ মন্দির নির্ম্মিত হয়, এইরূপ উপাদান কুড়াইয়া আমাদিগকে সেইরূপ দেশের ইতিহাস সঙ্কলন করিতে হইবে। সুতরাং কিছুই উপেক্ষনীয় নহে।

  এই ছড়াটির সম্বন্ধে চন্দ্রকুমারবাবু আরো যে দুএকটি কথা লিখিয়াছেন তাহা এখানে উদ্ধৃত করিয়া আমরা ভূমিকার উপসংহার করিতেছি।

 “এগুলি অন্যান্য পালাগানের মত সুরে গান হয় না। যাহা শুনিলাম তাহা এক রকম সুর ধরিয়া আবৃত্তি করা মাত্র। সে রকম সুরকে গানের সুর বলা চলে না, ছড়ার আবৃত্তি মাত্র।”

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

সোণারায়ের জন্ম

সোণারায়ের জন্ম

(১)

এক্কলে সাফল্লি আন ফকিরার মন্তর। (?)
চান রাওয়ের ছাল্ল্যা অইল বচ্ছর অন্তর॥
সোণারায় নাম থুইল মায় সোণার মতন।
হাসিতে মাণিক্য পরে কাঁদিলে ঝরে রতন॥
জোড় মাণিকে গড়ছে তার দুই নয়নের তারা।
রাম ধনুকে গড়ছে ভাই তার দুই ভুরা[১] রে॥
এই না সোণারায়কে কে করিবেক হেলা।
গলায় গবপুল নামব, চক্ষে নামব ঢেলা[২]
ঢেলা নয় কেবলত গায় আয়ব জ্বর।
এই জ্বরে কাপুনি মায়ের দহিব অন্তর॥(১—১০)
* * * *


(২)

গোয়াল গোয়াল গোয়াল মাসী দধি দেও মোরে।
গোষ্ঠের গাভী বাথান গেছে দুগ্ধ নাই মোর ঘরে॥
গোয়াল গোয়াল মাসী দুগ্ধ দাও আমারে।
চান রায়ের হুকুম হইছে পুকুর ভরিবারে॥

এক পুকুর ভরিয়া দিছি দধি দুগ্ধ দিয়া।
সোমবার রাত্তির শেষে তান জন্মিছে এক ছাওলিয়া
আজ যাইও কাল সে যাইও দেইখ্যা আইও তারে।
বিস্তরে পাইবা ক্ষীর সোণারায়ের পুরে॥

কি কহিলি গোয়াল মাসী কি কহিলা মোরে।
তোর ঘরের কবলী গাই বাথানে যেন মরে॥
ছিক্কার উপর দধি লইয়া পীরকে ভাড়াও।
ঘরে মরব পোষা বলদ বাথানে মরব গাই॥
আগে যদি জান্তাম রে এমন তেমন পীর।
আগে দিতাম দুগ্ধ কলা বাটি ভরা ক্ষীর॥

শুন শুন চান রায় কহি যে তোমারে।
দাউন ভরা গরু বাছুর তোমার দোষে মরে॥
তোমায় দিয়া দধি দুগ্ধ পীরে করলাম খেলা।
হেই ত দোষে ত মোরে পীর গোস্বা হইলা॥
পীরের মানত করে রাজা পুত্র পাইব কোলে।
দশ মাস দশ দিন উৎপন্নি যে হইল।
দাই মা দাই মা বল্যা ডাকিতে লাগিল॥

পীরের বরে জন্ম লৈল পুন্নমাসীর চান।
বাপে মায় রাখল তার সোণারায় নাম॥
সোণারায় নাম রাখল সোণার বরণ।
জোড়া মাণিক্য দিয়া গড়িয়াছে নয়ন॥
ব্যাড়ার বান কাট্যা দাই ঘরেত পশিল[৩]
হেন কালে সোণারায় ভুমন্তে পড়িল॥

ছাওয়াল তুলিয়া দাই কোলে তুল্যা নিল।
নাওয়াইয়া ধোয়াইয়া তারে আসুত[৪] করিল॥
সোণার চিচ্‌রা[৫] দিয়া নাড়ী ছেদ করিল।
তোমার ছাওয়াল তুমি লও মা আমারে কিবা দিবা।
গুণ্যা বাদ্যা[৬] পাঁচ টঙ্কা দাইয়ের হাতে দিলা॥

তোমার ছাওয়াল তুমি লও মা আমায় দিবা কি?
অন্ন খাওয়ার সুবর্ণ থালা তোমায় দিয়াছি।
তোমার ছাওয়াল তুমি নিলা আমায় দিলা কি?
পান খাওয়ার সোণার বাটা তোমায় দিয়াছি।
রাজার ঘরত ছাওয়াল হ’ল তুমি রাজার ঝি॥
নেহাতি গরীবি আমায় দিবা কি?
বাউন্ন আড়া জমি পাবা বসত করবার লাগি।
খুসি হইয়া দাই ছাওয়াল কোলে দিল।
সোণারায় জন্ম দেখ আদি শেষ হইল॥(১—৪১)

(৩)

সোণারায়ের শিকার-যাত্রা

একা বাঘের বেকা ঘাড় বাদ্য লোয়াপুরী।
ঘোড়ামুখা নলডুঙ্গা লাম্বা লাম্বা ডুরি॥
আর বাঘ পার বাঘ বাঘ উদয় তারা।
চার কানি জুড়িয়া পড়ে বড়ু বাঘের পারা॥
জঙ্গলেতে আছে বাঘা বনের ঠাকুর।
মানুষ খাইয়া গরু খাইয়া হেক্কুর কেক্কুর॥

তবে ত সোণারায় কোন্ কাম করে।
তীর ধনু লইয়া চলে বাঘা শীকারে॥
বাঘ মাইল বাঘুনি মাইল আর বা মাইল কত।
মহিষা গণ্ডার মাইল শত শত॥
বন কাট্যা সোণারায় নগর বসাল।
সোণাপুরী নাম তার রাইখল।
সোণাপুরীর বিবারণ শোন মন দিয়া।
বড়া বড়া ঘর বান্ধে সোণার থাম্বা দিয়া॥
চালেত সোণার পাতে দিয়া থুইছে ছানি।
চার দিকে কাট্যা দিছে গড়খাই পুষ্করিণী॥
গড়খাই পুষ্কুনিরে ভাই গয়িন কত খানি।
কোন তাতে দধি দুগ্ধ কোন তাতে পানি॥(১—১৮)

(8)

বাজর বাজর

সোণা রূপায় পুরীখানি ঘন গাঠে রুয়া।
বিশকরমে বানাইয়া পুরি পাইল পান গুয়া॥
ঘন গাটের রুয়ারে ভাই বাটাবাটা পান।
পুরী বানাইয়া পান করম ঠাকুরে খান॥
দুই পীর শুশুত করে হ্যারা নিশি যায়।
বাঘ ভাল্লুক হাতী ঘোড়া দেখ্যা সে পলায়॥
না পলায়ো বাঘার ভালুক না পলায়ো তোরা।
নিশানা গড়িয়া দেরে দরমা ঘেলি মোরা॥

এক বাঘের ঠেংটু আর বাঘের কাঁদে।
সোণারায়ের বিয়ার কথা নানাবিধ ছাদে॥
নিশান খেলিতে পীরের মন হইল টিয়া।
তোমরা কে দেখিবা আইস সকাল সোণারায়ের বিয়া॥

আসমানেতে ছিল ফুল রে পড়িল ঝরিয়া।
সেও ফুলে হলো নারে সোণারায়ের বিয়া॥
আরবার যায় মালি ফুলের লাগিয়া।
আনয়ে বাগের ফুল মাল্‌তি ভরিয়া॥
এত ফুলে না হইল রে সোণারায়ের বিয়া।
আনল পদ্মর ফুল পদরী ভরিয়া॥
সেও ফুলে হইল না রে সোণারায়ের বিয়া।
আর বার যাও মালি ফুলের লাগিয়া॥
লালসেহয়া মাথে পাটের পরন সাখে।
ওগো বেগম সাহেব কি কর বসিয়া।
তোমার বেটীর দামান্দ[৭] আইল দোলায় সাজিয়া॥
মালি ভাই চাম্পা ফুল দিল সে আনিয়া।
এও ফুলে হ’ল নারে সোণারায়ের বিয়া॥
মালি ভাই চাম্পা ফুল দিল রে আনিয়া।
এও ফুলে হ’ল নারে সোণারায়ের বিয়া॥
দুই ডালা ভরি ফুল আনিল সোণার।
আন্‌ল সোণার ফুল তরালে কাটিয়া।
এই ফুলে হইব সোণারায়ের বিয়া॥

নীল ঘোড়া বান্ধরে দামান্দ চাম্পা ফুলের ডালে।
লাল ঘোড়া বান্ধরে দামান্দ কেয়া ফুলের পাড়ে॥
সেই ফুল ঝরিয়া পড়িল সোণারায়ের মাথে।
ফুলের সাজি কাঁখে যেমন ফিরে গলি গলি।
তোমার ফুলের দাম বেগম কত টাকা॥
আমার ফুলের দাম সে সোণারায় জানে।
জাত্তি দিয়া বিয়া আমি করিব কেমনে॥
কাজে কাজে হইল নারে সোণারায় বিয়া।

চাঁদ রায় চাঁদ রায় কি কর বসিয়া।
তোমার পুত্র সোণারায় রইল বন্দী হইয়া॥
পাড়াপর্শী ডাক্যা কয় ওলো পাড়ার ঝি।
সোণারায় বিয়া করে ব্যাপার পা’লা কি॥
এক পাইছি গাই বাচ্ছুরী আর পাবাম কি।
সোণারায় বিয়া করে ব্যাভার পাইলা কি॥
লোটা ভরা দই চিনি খাইয়াছি।
সোণারায় বিয়া করে ব্যাভার পাইলা কি॥
ষণ্ড দিলা হাতি ঘোড়া আর পাইব কি।
পরীর মত এক কন্যা দানে পাইয়াছে॥(১—৪৮)

(৫)

বিয়া কইর‍্যা সোণারায় বাড়ীতে চল্যা যায়।
মাঝি মাল্লা গুণ ধরিয়া সোণার ডিঙ্গা বায়॥
সোণার ডিঙ্গার পালরে ভাই রূপার মাস্তুল।
সেই ডিঙ্গা বাইয়া গেল ভাই ব্রহ্মপুত্রের কূল॥
গুণ টান গুণের ভাইরে তালে রাইখ্‌খ পা।
এইখানে থাকিয়া তোমরা কূলে ভিড়াইও না॥
কর্ত্তুলার মজীদে আমি পীরের ছিন্নি দিব।
কিসের দিব পীরের ছিন্নি উজান বাহ নাও।
সোণাপুরে যাইব শীঘ্রি মোরে না ভাড়াও॥
সুবুদ্ধি সোণারায়ের কুবুদ্ধি হইল।
পীরকে ভাড়াইয়া দেখ গমনা করিল॥
যাহ যাহ সোণারায় ডিঙ্গা ভাটাইয়া।
এমন শাস্তি দিবাম তোমায় নমাজ করিয়া॥
ডাক দিয়া কয় পীর মেঘা বার জন।
তোমরা কর সক্কাল রণের সাজন॥

বার মেঘা সাজ্যা আইল রণের সাজন করি।
তার সনে সাজা আইল রণের যত পরী॥
কি কাজে ডাক্যাছ পীর সেই কাজ করিব।
শুন শুন বার মেঘা আমার বাক্য লও॥
সোণারায়ের জাঁক বহুতা তারে বিনাশ দেও॥
কেউ না করে ঝড় অন্ধকার কেউ না করে ভার।
দইরা[৮] হইল টলমল ভাঙ্গিল কাড়ার॥
দাড়্যা কান্দে দাড় ধরিয়া গল্যা কান্দে ছাঁদে।
মাস্তুল ভাঙ্গিয়া পড়ে লোক লস্করা কাঁধে॥
পাল ছিড়িয়া গেল ঝঞ্ঝার বাতাসে।
এরে দেখ্যা মজিদ ঘরে পেগাম্বর হাসে॥
আগা ডুবিল পাছা না ডুবিল ডুবিল নায়ের গুড়া।
একে একে ডুব্যা গেল মাস্তুলের চূড়া॥
অগাধ জলে পইড়া সোণারায় ভাসে।
পীর কহে এই দুঃখ নয়রে আরো দুঃখ আছে॥
পাছে লাগিল পীর সোণারায় ভাসে।
ভাস্যা ভাস্যা লাগল গিয়া বেগম সাবের ঘাটে॥
পরাণে না মইর রে পরাণে মইর।
আমার কথা স্মরণ কইর॥(১—৩৪)


(৬)

সুবে খানি ঘর রে হিচল পিচল।
তারা উপরে ছয় জোড়া পিত্তল॥

ছয় জোড়া পিত্তলে গড়লাম নাও।
সেই নায়ে চড়িয়া কান্দে সোণারায়ের মাও॥
কই যাও সোণারায়ের মা দরিয়া বেতামা।
আমার পুত্র দইরায় ডুবছে দেখছে কোন্ জনা॥
ষোল দাড় বাইয়া যায় সোণারায় আনিতে।

* * * *
মজিত ঘরে বইস্যা পীর ভাবে মন।

ডাক দিয়া আনে সাকারেদ পাঁচজন॥
শুন শুন সাকরীদগণ কহি যে তোমরারে।
জলদি চলিয়া যাও ঘোড়াঘাট গরে॥
ঘোড়াঘাট সহরখানা হিরণ পিরাণ।
সোণার ঘাটে নাইতে যায় ফুল বেগম॥
এক লক্ষ আছেরে হাওয়ারি নাওয়ারি।
বার বাড়ী আছেরে সোবন কাছারি॥
সুবর্ণ কাছারী আছে জলটুঙ্গি ঘর।
তার উপরি আছে অষ্ট অলঙ্কার॥
তার মধ্যে বিরাজ করে ফুল বেগম।
ফুল বেগম নারে কোন বা বাগের ফুল।
পায়ের পাতা ছুঁইয়া রইছে মাথার না চুল॥
দুই নয়ানে দুই মণি যেন কালা তারা।
ফুলের উপর মধু খায়া ঘুমায় ভোমরা॥
চিক্কণ কাকালি তার রায়ে ভাইঙ্গা পড়ে।
রূপার রোশনাই তার জ্বলন্তি নগরে॥(১—২৪)


(৭)

ডিঙ্গা ডুবু ডিঙ্গা ডুবু ভাসে সোণারায়।
হাজার দিন ভাস্যা গেল সোণা ঘাটের সর॥

পীর কহে সকরেদগণ না ভাবিহ ধন্দ।
বন্দিশালা ঘরে গিয়া সোণারায়ে বান্ধ॥
হাতেতে লোহার ছিক্কল, কোমরে বাঁধল দড়ি।
বাইশমণি পাথর দিল বুকের উপর তুলি॥
বাপ না দেখে মাও না দেখে পরাণ বুঝি যায়।
বার দইরা ঘুইরা কান্দে সোণারায়ের মায়॥

* * * *
সোণারায়ের টোপর মাথেরে ফুল বেগম সাজেরে

হারে বন্ধে বাজুবন্ধ তার।
সোণার মুটুক মাথে ফুল বেগম সাজে রে
গলায় পরে হীরামণ হার॥
সোণার টোপর মাথারে ফুল বেগম সাজেরে
বাছ্যা পিন্ধে আসমান তারা শাড়ী।
সোণার মুটুক মাথে ফুল বেগম সাজেরে
সাজ্যা গুজ্যা চলে সুন্দর নারী॥

চান্দের কোলে শালম গাছটি বায় হাল হাল করে।
সেই না গাছের তলায় বসি বুড়ী সুতা কাটে॥
ওলো বুড়ী তোর সুতার কিবা কাপড় বুনে।
আমার সুতা উড়িয়া পড়িব জমিনে॥
চান্দের চারদিকে ফুটল সোণার ফুল।
নিশি রাইতে ফুল বেগম ঝাইড়্যা বান্ধে চুল॥
চুল বান্ধিয়া নারী কোন্ কাম করিল।
বন্দীশালা ঘরে গিয়া দাখিলা হইল॥

আইন্ধার আইন্ধার জলক্কার আসমান ভরা ভরা।
সেই অসমানে ফুইট্যা রইছে মাণিক্য হীরা॥

হীরা নয়রে জীরা নয়রে লক্ষ টাকার মূল।
বন্দীশালা ঘরে গিয়া খসায় মাথার চুল॥
শুন শুন বন্দীয়ান কহি যে তোমারে।
সোণার টোপর সোণার মুটুক দিয়া যাই তোমারে॥
আস্তে ব্যস্তে খোলে কন্যা গায়ের অলঙ্কার।
একে একে খোলে কন্যা সর্ব্ব অলঙ্কার॥
মঞ্চের যতেক ফুল সোণার বাইন্ধা দিব।
ওরে বইন্দাল ওরে বইন্দাল আমার কথা রাখ॥(১—৩৪)


(৮)

সোণারায়ের মাওরে সে বড় চতুর।
চালেতে শুকায়ে রাখে চাম্পার ফুল
পীরের ছিন্নি মানত কইরা পুত্র পাইল কোলে।
চৌদ্দখান ডিঙ্গা আইস্যা লাগল নদীর ঘাটে॥
জয় ডঙ্কা বাজেরে
হাজার লস্কর সাজেরে
আর্ঘ্যা পুছ্যা তুলে দিঙ্গা ধন।
পরথমে উঠিল ডিঙ্গা আল্লার করমান।
সেই ডিঙ্গায় উঠিল কিতাব আর কোরান॥
তার পরে উঠিল ডিঙ্গা গোলুই চলুই।
চৌদ্দ রাজার দেশ থাক্যা দেখা যায় গোলুই॥
তারপরে উঠিল ডিঙ্গা সোবন মাস্তুল।
নব রঙ্গের পাল খানি মাঝে হীরা ফুল॥
তারপরে উঠিল ডিঙ্গা নামে ত কুশিয়া।
এক এক করি চৌদ্দ নাও উঠিল ভাসিয়া॥
বাজর বাজর টিয়া।
পীরের কেরামত বুঝবুন্ধা সিন্নি মানত দিয়া॥

অপুত্রার পুত্র হয়রে নির্ধনিয়ার ধন।
অন্ধ ফিরিরা পায় দুনয়ন॥
আমার এই গাভান পীর যে করিব হেলা।
দুই চক্ষির মণি দিয়া বাড়ব তার ঢেলা॥
ঘরে মরব হালের বলদ বাথানে মরব গাই।
গাভার পীরের লাগ্যা আমরা ছিন্নি কিছু খাই॥
নয়া ধানের নয়া চাল দুগ্ধ দুটি দিবা।
ক্ষিরসা লইতে তোমরা পীরের ঘাটে যাবা॥
পীরের ঘাটে গেলে পর চরণ দর্শন পাবা।
পীরের ক্ষিরসা খাইয়ারে চল আপন দেশ।
সোণারায়ের কথা খানা এই খানে শেষ॥ (১—২৮)

উত্তর থাকি আল এক বামন পণ্ডিত।
বামনের নাম তলাপাত্র বামনীর নামটি খাজা॥
সেই না ঘরে জন্মাইল সোণারায় নামে রাজা।(১—২৮)

* * * *

(৯)

বাসুদেবে ডাক দিয়া কয় ভগমানের ঝি।
খেতের বাইগন যে ফুরাইল খাজানার উপায় কি?
ঝারে আছে বরাক বাঁশ গুড়ি খানা দড়।
এক টঙ্কার বাঁশ বেচিয়া খাজনার জোগাড় কর।
দারুণ বৈশাখের ঝড়ে ঝাড় পইরাছে মারা।
আইল ময়না ফকির গলায় বানল ডুরা॥
গলায় বান্ধিয়া ডুর টাঙ্গায় গাছের ডালে।
মচ্চির না ধুয়া দিয়া সামাল সামাল বলে॥

বাসুদেব কয় ওগো ভগবানের ঝি।
খাজানা দেবার উপায় নাই ভাব বস্যা কি?
এদেশ ছাড়িয়া চল অন্য দেশে যাই।
জিক্কাইর মারিয়া[৯] ওই কাইকরার লস্কর আসে।
ত্বরা কইরা সামালরে ভাই ঘরের যুব্বা নারী।
বেটা পুত্র কোলের ছাওয়াল সামাল সকাল করি॥
ঘরে দিব বেড়া আগুন কে নিবাইতে পারে।
হাত পা বান্ধিয়া ফেলায় সিঙ্গের পাগারে॥
মুণ্ডু কাটিয়া ভাসায় সাগরে।
মায়াত ছাওয়াল লইয়া জঙ্গলায় পালায়।
খাজানার কড়ি নাই কি হবে উপায়॥
লাঙ্গলে বেচে গরু বেচে কি হবে উপায়।
কোলের ছাওয়াল বিক্রী করব কেউ না কিনতে চায়।
সোণা শস্যি আগুন দিয়া ময়নার লস্করে।
সক্কল পোড়াইয়া শেষে ভাসাইল সাগরে॥
তলুই পাত্যা শুকায় ধান ভগমানের মা।
ডাক দিয়া কয় বাসুদেব চিন্তা কইর না॥
খৈয়া ধান সরু শস্যি মাঠে গেল মারা।
এইবার থাঙ্গি সোণারা’ এইদেশের রাজা॥
আলিবুর্দ্দি দিল জান বাঁচল দেশের প্রজা।
বাসুদেবে ডাক্যা কয় ভগবানের মা।
এইবার হইল দেশের রাজা নাম সোণারা॥
সোণারা’র নাম লইয়া গির কর্ম্ম কর।
মঙ্গলচণ্ডী মায়ের কাছে মাগ তিন বর॥
এক বরে পতি পুত্র রাখুন বাঁচায়া।
আর বরে সরু শস্য দোনা পরমান।

বাঁচ্যা থাক সোণারা’ হইয়া ভাগ্যবান্॥
ওরে ওরে কামার ভাই আমি কইয়া যাই।
একখানা ধারের কাঁচি গড়ায়া দিও চাই।
সোণারা’র নাম লইয়া পাকনা মাঠে যাই॥
পাকনা মাঠেরে ভাই পাকনা পাকনা ধান।
বাঁচ্যা থাক সোণারা’ বড় ভাগ্যবান্[১০](১—৪০)

(অসমাপ্ত)

  1. ভুরা=ভ্রু।
  2. গলায়....ঢেলা=তাহার গলায় গলগণ্ড হইবে এবং চক্ষের তারা বাহির হইয়া পড়িবে। এইরূপ কথা গ্রাম্য ছড়ায় আরও পাওয়া যায়—যথা, “আমার ঠাকুর তিন্নাথেরে যে করিবে হেলা। হাত পা কইতরের নলী, চোখ দিয়া বেরুবে ঢেলা॥”
  3. ব্যাড়ার......পশিল=বেড়ার বাঁধ কাটিয়া দাই গৃহে প্রবেশ করিল।
  4. আসুত (আশ্বস্ত)=সুস্থ।
  5. চিচ্‌রা=ধারালো কাটি।
  6. গুণ্যা বাদ্যা=গুণিয়া ও বাজাইয়া।
  7. দামন্দ=জামাই
  8. দইরা=দরিয়া, নদী।
  9. জিক্কাইর মারিয়া = চীৎকার করিয়া।
  10. এই পালাটি আলিবর্দ্দি খাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়।