প্রজাপতির নির্বন্ধ/২

উইকিসংকলন থেকে
( ২ ) শ্রীশ ও বিপিন।

 শ্রীশ। তা যাই বল অক্ষয়বাবু যখন আমাদের সভাপতি ছিলেন তখন আমাদের চিরকুমার সভা জমেছিল ভাল। হাল সভাপতি চন্দ্রবাবু কিছু কড়া।

 বিপিন। তিনি থাক্তে রস কিছু বেশি জমে উঠেছিল—চিরকৌমার্য্যব্রতের পক্ষে রসাধিক্যটা ভাল নয় আমার ত এই মত।

 শ্রীশ। আমার মত ঠিক উলটাে। আমাদের ব্রত কঠিন বলেই রসের দরকার বেশি। রুক্ষ মাটিতে ফসল ফলাতে গেলে কি জল সিঞ্চনের প্রয়োজন হয় না? চিরজীবন বিবাহ করব না এই প্রতিজ্ঞাই যথেষ্ট তাই বলেই কি সব দিক থেকেই শুকিয়ে মরতে হবে?

 বিপিন। যাই বল, হঠাৎ কুমার সভা ছেড়ে দিয়ে বিবাহ করে অক্ষয়বাবু আমাদের সভাটাকে যেন আল্গা করে দিয়ে গেছেন। ভিতরে ভিতরে আমাদের সকলেরি প্রতিজ্ঞার জোর কমে গেছে।

 শ্রীশ। কিছুমাত্র না। আমার নিজের কথা বল্তে পারি, আমার প্রতিজ্ঞার বল আরো বেড়েছে। যে ব্রত সকলে অনায়াসেই রক্ষা করতে পারে তার উপরে শ্রদ্ধা থাকে না।

 বিপিন। একটা সুখবর দিই শোন।

 শ্রীশ। তোমার বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছে না কি?

 বিপিন। হয়েছে বৈ কি—তোমার দৌহিত্রীর সঙ্গে। —ঠাট্টা রাখ, পূর্ণ কাল কুমার সভার সভ্য হয়েছে।

 শ্রীশ। পুর্ণ! বল কি! তাহলে ত শিলা জলে ভাস্ল!

 বিপিন। শিলা আপনি ভাসে না হে! তাকে আর কিছুতে অকুলে ভাসিয়েচে। আমার যথাবুদ্ধি তার ইতিহাসটুকু সঙ্কলন করেচি।

 শ্রীশ। তোমার বুদ্ধির দৌড়টা কি রকম শুনি।

 বিপিন। জানই ত, পূর্ণ সন্ধ্যাবেলায় চন্দ্রবাবুর কাছে পড়ার নোট নিতে যায়। সেদিন আমি আর পুর্ণ একসঙ্গেই একটু সকাল সকাল চন্দ্র বাবুর বাসায় গিয়েছিলেম। তিনি একটা মীটিং থেকে সবে এসেছেন। বেহারা কেরোসিন্ জেলে দিয়ে গেছে—পূর্ণ বইয়ের পাত ওল্টাচ্চে, এমন সময়—কি আর বলব ভাই, সে বঙ্কিমবাবুর নভেল বিশেষ—একটি কন্যা পিঠে বেণী ফুলিয়ে—

 শ্রীশ। বল কি হে বিপিন?

 বিপিন। শোনই না। এক হাতে থালায় করে চন্দ্রবাবুর জন্য়ে জলখাবার, আর এক হাতে জলের গ্লাস নিয়ে হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত। আমাদের দেখেই ত কুণ্ঠিত, সচকিত, লজ্জায় মুখ রক্তিমবর্ণ। হাত জোড়া, মাথায় কাপড় দেবার জো নেই। তাড়াতাড়ি টেবিলের উপর খাবার রেখেই ছুট্। ব্রাহ্ম বটে কিন্তু তেত্রিশ কোটির সঙ্গে লজ্জাকে বিসর্জ্জন দেয় নি এবং সত্য বলচি শ্রীকেও রক্ষা করেছে।

 শ্রীশ। বল কি বিপিন, দেখতে ভাল বুঝি?

 বিপিন। দিব্যি দেখ্তে। হঠাৎ যেন বিদ্যুতের মত এসে পড়ে পড়াশুনোয় বজ্রাঘাত করে গেল।

 শ্রীশ। আহা, কই, আমি ত একদিনো দেখিনি! মেয়েটি কে হে!

 বিপিন। আমাদের সভাপতির ভাগ্নী, নাম নির্ম্মলা।

 শ্রীশ। কুমারী?

 বিপিন। কুমারী বই কি। তার ঠিক পরেই পূর্ণ হঠাৎ আমাদের কুমার সভায় নাম লিখিয়েছে।

 শ্রীশ। পূজারি সেজে ঠাকুর চুরি করবার মতলব?

একটি প্রৌঢ় ব্যক্তির প্রবেশ।

 বিপিন। কি মশায়, আপনি কে?

 উক্তব্যক্তি। অজ্ঞে আমার নাম শ্রীবনমালী ভট্টাচার্য্য, ঠাকুরের নাম ৺ রামকমল ন্যায়চুঞ্চু, নিবাস—

 শ্রীশ। আর অধিক আমাদের ঔৎসুক্য নেই। এখন কি কাজে এসেচেন সেইটে—

 বন। কাজ কিছুই নয়। আপনার ভদ্রলোক আপনাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়—

 শ্রীশ। কাজ আপনার না থাকে আমাদের আছে। এখন, অন্য কোনো ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি আলাপ পরিচয় করতে যান তাহলে আমাদের একটু—

 বন। তবে কাজের কথাটা সেরে নিই।

 শ্রীশ। সেই ভাল।

 বন। কুমারটুলির নীলমাধব চৌধুরী মশায়ের দুটি পরমাসুন্দরী কন্যা আছে—তাঁদের বিবাহযোগ্য বয়স হয়েচে—

 শ্রীশ। হয়েছে ত হয়েছে, আমাদের সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কি!

 বন। সম্বন্ধ ত আপনারা একটু মনোযোগ করলেই হতে পারে। সে আর শক্ত কি! আমি সমস্তই ঠিক করে দেব।

 বিপিন। আপনার এত দয়া অপাত্রে অপব্যয় করচেন।

 বন। অপাত্র! বিলক্ষণ! আপনাদের মত সৎপাত্র পাত্র কোথায়! আপনাদের বিনয়গুণে আরো মুগ্ধ হলেম।

 শ্রীশ। এই মুগ্ধভাব যদি রাখ্তে চান তা হলে এই বেলা সরে পড়ুন। বিনয়গুণে অধিক টান সয় না।

 বন। কন্যার বাপ যথেষ্ট টাকা দিতে রাজি আছেন।

 শ্রীশ। সহরে ভিক্ষুকের ত অভাব নেই। ওহে বিপিন, একটু পা চালিয়ে এগোও—কাঁহাতক রাস্তায় দাঁড়িয়ে বকাবকি করি? তোমার আমোদ বোধ হচ্চে কিন্তু এরকম সদালাপ আমার ভাল লাগে না।

 বিপিন। পা চালিয়ে পালাই কোথায়? ভগবান এঁকেও যে লম্ব এক জোড়া পা দিয়েচেন।

 শ্রীশ। যদি পিছু ধরেন তাহলে ভগবানের সেই দান মানুষের হাতে পড়ে খোয়াতে হবে।