বিষয়বস্তুতে চলুন

প্রজাপতির নির্বন্ধ/৩

উইকিসংকলন থেকে

(৩)

 মুকুজ্জেমশায়!

 অক্ষয় বলিলেন—আজ্ঞা কর!

 শৈল কহিল—কুলীনের ছেলে দুটোকে কোন ফিকিরে তাড়াতে হবে!

 অক্ষয় উৎসাহপূর্ব্বক কহিলেন—তা ত হবেই। বলিয়া রামপ্রসাদী সুরে গান জুড়িয়া দিলেন—

দেখব কে তাের কাছে আসে!

তুই রবি একেশ্বরী, একলা আমি রৈব পাশে!

 শৈল হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল...একেশ্বরী?

 অক্ষয় বলিলেন, না হয় তোমরা চার ঈশ্বরীই হলে, শাস্ত্রে আছে অধিকন্তু ন দোষায়।

 শৈল কহিল—আর, তুমিই একলা থাকবে? ওখানে বুঝি অধিকন্তু খাটে না?

 অক্ষয় কহিলেন, ওখানে শাস্ত্রের আর একটা পবিত্র বচন আছে—সর্ব্বমত্যন্তগর্হিতং।

 শৈল। কিন্তু মুখুজ্জেমশায়, ও পবিত্র বচনটা ত বরাবর খাটবে না। আরও সঙ্গী জুটবে।

 অক্ষয় বলিলেন—তােমাদের এই একটি শালার জায়গায় দশশালা বন্দোবস্ত হবে? তখন আবার নূতন কার্যবিধি দেখা যাবে। ততদিন কুলীনের ছেলেটেলেগুলােকে ঘেঁষ্তে দিচ্চিনে!

 এমন সময় চাকর আসিয়া খবর দিল দুটি বাবু আসিয়াছে। শৈল কহিল, ঐ বুঝি তারা এল। দিদি আর মা ভাঁড়ারে ব্যস্ত আছেন, তাঁদের অবকাশ হবার পূর্ব্বেই ওদের কোন মতে বিদায় করে দিয়ো।

 অক্ষয় জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বক্শিষ মিলবে?

 শৈল কহিল—আমরা তােমার সব শালীরা মিলে তােমাকে শালীবাহন রাজা খেতাব দেব।

 অক্ষয়। শালীবাহন দি সেকেণ্ড?

 শৈল। সেকেণ্ড হতে যাবে কেন? সে শালীবাহনের নাম ইতিহাস থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তুমি হবে শালীবাহন দি গ্রেট্!

 অক্ষয়। বল কি? আমার রাজ্যকাল থেকে জগতে নূতন শাল প্রচলিত হবে? এই বলিয়া অত্যন্ত সাড়ম্বর তানসহকারে ভৈরবীতে গান ধরিলেন—

তুমি আমায় করবে মস্ত লোক!
দেবে লিখে রাজার টকে প্রসন্ন ঐ চোখ!

 শৈলবালার প্রস্থান। ভৃত্য আদিষ্ট হইয়া দুটি ভদ্রলোককে উপস্থিত করিল। একটি বিসদৃশ লম্বা, রোগা, বুট জুতাপরা, ধুতি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠিয়াছে, চোখের নীচে কালি পড়া, ম্যালেরিয়া রোগীর চেহারা; বয়স বাইশ হইতে বত্রিশ পর্য্যন্ত যেটা খুসি হইতে পারে। আর একটি বেঁটেখাটো, অত্যন্ত দাড়ি গোঁফসঙ্কুল, নাকটি বটিকাকার, কপালটি ঢিবি, কালোকোলো, গোলগাল।

 অক্ষয় অত্যন্ত সৌহার্দ্য সহকারে উঠিয়া অগ্রসর হইয়া প্রবলবেগে শেক্হ্যাণ্ড করিয়া দুটি ভদ্রলোকের হাত প্রায় ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। বলিলেন, আসুন মিষ্টার ন্যাথানিয়াল, আসুন মিষ্টার জেরেমায়া, বসুন বসুন! ওরে বরফ জল নিয়ে আয়রে, তামাক দে!

 রোগ লোকটি সহসা বিজাতীয় সম্ভাষণে সঙ্কুচিত হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, আজ্ঞে আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় গাঙ্গুলি।

 বেঁটে লোকটি বলিল—আমার নাম শ্রীদারুকেশ্বর মুখোপাধ্যায়!

 অক্ষয়। ছি মশায়! ও নামগুলো এখনো ব্যবহার করেন বুঝি? আপনাদের ক্রিশ্চান নাম?

 আগন্তুকদিগকে হতবুদ্ধি নিরুত্তর দেখিয়া কহিলেন—এখনো বুঝি নামকরণ হয়নি? তা তাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না, ঢের সময় আছে!

 বলিয়া নিজের গুড়গুড়ির নল মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে অগ্রসর করিয়া দিলেন। সে লোকটা ইতস্ততঃ করিতেছে দেখিয়া বলিলেন বিলক্ষণ। আমার সামনে আবার লজ্জা! সাত বছর বয়স থেকে লুকিয়ে তামাক খেয়ে পেকে উঠেছি। ধোঁয়া লেগে লেগে বুদ্ধিতে ঝুল পড়ে গেল! লজ্জা যদি করতে হয় তাহলে আমার ত আর ভদ্র সমাজে মুখ দেখাবার জো থাকে না!

 তখন সাহস পাইয়া দারুকেশ্বর মৃত্যুঞ্জয়ের হাত হইতে ফস্ করিয়া নল কাড়িয়া লইয়া ফড়্ ফড়্ শব্দে টানিতে আরম্ভ করিল! অক্ষয় পকেট হইতে কড়া বর্ম্মা চুরোট বাহির করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে দিলেন। যদিচ তাহার চুরোট অভ্যাস ছিল না, তবু সে সদ্যস্থাপিত ইয়ার্কির খাতিরে প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিয়া মৃদুমন্দ টান দিতে লাগিল এবং কোন গতিকে কাশি চাপিয়া রাখিল।

 অক্ষয় কহিলেন—এখন কাজের কথাটা সুরু করা যাক্! কি বলেন?

 মৃত্যুঞ্জয় চুপ করিয়া রহিল, দারুকেশ্বর বলিল—তা’নয়ত কি? শুভস্য শীঘ্রং!—বলিয়া হাসিতে লাগিল, ভাবিল ইয়ার্কি জমিতেছে।

 তখন অক্ষয় গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মুর্গি না মাট্ন?

 মৃত্যুঞ্জয় অবাক্ হইয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল। দারুকেশ্বর কিছু না বুঝিয়া, অপরিমিত হাসিতে আরম্ভ করিল। মৃত্যুঞ্জয় ক্ষুব্ধ লজ্জিত হইয়া ভাবিতে লাগিল, এরা দুজন ত বেশ জমাইয়াছে, আমিই নিরেট বোকা!

 অক্ষয় কহিলেন,—আরে মশায়, নাম শুনেই হাসি! তা হলেত গন্ধে অজ্ঞান এবং পাতে পড়্লে মারাই যাবেন! তা যেটা হয় মনস্থির করে বলু—মুর্গি হবে না মাট্ন হবে?

 তখন দুজনে বুঝিল আহারের কথা হইতেছে। ভীরু মৃত্যুঞ্জয় নিরুত্তর হইয়া ভাবিতে লাগিল। দারুকেশ্বর লালায়িত রসনায় একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল!

 অক্ষয় কহিলেন—ভয় কিসের মশায়? নাচ্তে বসে ঘোম্টা? শুনিয়া দারুকেশ্বর দুই হাতে দুই পা চাপড়াইয়া হাসিতে লাগিল। কহিল, তা মুর্গিই ভাল, কট্‌লেট্, কি বলেন?

 লুদ্ধ মৃত্যুঞ্জয় সাহস পাইয়া বলিল, মাটানটাই বা মন্দ কি ভাই! চপ্‌!—বলিয়া আর কথাটা শেষ করিতে পারিল না।

 অক্ষয়। ভয় কি দাদা, দুই হবে। দোমনা করে খেয়ে সুখ হয় না।—চাকরকে ডাকিয়া বলিলেন—ওরে, মোড়ের মাথায় যে হোটেল আছে সেখান থেকে কলিমদি খানসামাকে ডেকে আন্ দেখি!

 তাহার পর অক্ষয় বুড়ো আঙুল দিয়া মৃত্যুঞ্জয়ের গা টিপিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন—বিয়ার, না শেরি?

 মৃত্যুঞ্জয় লজ্জিত হইয়া মুখ বাঁকাইল। দারুকেশ্বর সঙ্গীটিকে বদরসিক বলিয়া মনে মনে গালি দিয়া কহিল—হুইস্কির বন্দোবস্ত নেই বুঝি?

 অক্ষয় তাহার পিঠ চাপড়াইয়া কহিলেন—নেইত কি? বেঁচে আছি কি করে? বলিয়া যাত্রার সুরে গাহিয়া উঠিলেন —

অভয় দাও ত বলি আমার wish কি,
একটি ছটাক্ সোডার জলে পাকি তিন পোয়া হুইস্কি!

 ক্ষীণ প্রকৃতি মৃত্যুঞ্জয়ও প্রাণপণে হাস্য করা কর্ত্তব্য বোধ করিল এবং দারুকেশ্বর ফস্ করিয়া একটা বই টানিয়া লইয়া টপাটপ্ বাজাইতে আরম্ভ করিল

 অক্ষয় দুলাইন গাহিয়া থামিবামাত্র দারুকেশ্বর বলিল দাদা, ওটা শেষ করে ফেল! বলিয়া নিজেই ধরিল, “অভয় দাও ত বলি আমার wish কি;”—মৃত্যুঞ্জয় মনে মনে তাহাকে বাহাদুরী দিতে লাগিল।

 অক্ষয় মৃত্যুঞ্জয়কে ঠেলা দিয়া কহিলেন, ধরনা হে, তুমি ও ধর!—

 সলজ্জ মৃত্যুঞ্জয় নিজের প্রতিপত্তি রক্ষার জন্ত মৃদুস্বরে যোগ দিল— অক্ষয় ডেস্ক্ চাপড়াইয়া বাজাইতে লাগিলেন। এক জায়গায় হঠাৎ থামিয়া গম্ভীর হইয়া কহিলেন—হাঁ, হাঁ, আসল কথাটা জিজ্ঞাসা করা হয় নি। এদিক ত সব ঠিক—এখন আপনারা কি হলে রাজি হন?

 দারুকেশ্বর কহিল,—আমাদের বিলেতে পাঠাতে হবে।

 অক্ষয় কহিলেন—সে ত হবেই। তার না কাট্লে কি শ্যাম্পেনের ছিপি খোলে? দেশে আপনার মত লোকের বিদ্যে বুদ্ধি চাপ থাকে, বাঁধন কাট্লেই একেবারে নাকে মুখে চোখে উছ্লে উঠবে।

 দারুকেশ্বর অত্যন্ত খুসি হইয়া অক্ষয়ের হাত চাপিয়া ধরিল, কহিল, দাদা, এইটে তোমাকে করে দিতেই হচ্চে! বুঝলে?

 অক্ষয় কহিলেন, সে কিছুই শক্ত নয়। কিন্তু ব্যাপটাইজ্ আজই ত হবেন?

 দারুকেশ্বর ভবিল ঠাট্টাটা বোঝা যাইতেছেন। হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, সেটা কি রকম?

 অক্ষয় কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের ভ’বে কহিলেন—কেন, কথাইত আছে, রেভারেণ্ড্ বিশ্বাস আজ রাত্রেই আসচেন। ব্যাপটিজম্ না হলে ত ক্রিশ্চান্ মতে বিবাহ হতে পারে না!

 মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীত হইয়া কহিল—ক্রিশ্চান মতে কি মশায়?

 অক্ষয় কহিলেন—আপনি যে আকাশ থেকে পড়লেন। সে হচ্চে না—ব্যাপটাইজ্ যেমন করে হোক্, আজ রাত্রেই সারতে হচ্চে। কিছুতেই ছাড়ব না।

 মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল—আপনারা ক্রিশান না কি?

 অক্ষয়। মশায়, ন্যাকামি রাখুন! যেন কিছুই জানেন না।

 মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীত ভাবে কহিল—মশায়, আমরা হিঁদু, ব্রাহ্মণের ছেলে, জাত খোয়াতে পারব না!

 অক্ষয় হঠাৎ অত্যন্ত উদ্ধতস্বরে কহিলেন—জাত কিসের মশায়! এ দিকে কলিমদ্দির হাতে মুর্গি খাবেন বিলেত যাবেন, আবার জাত!

 মৃত্যুঞ্জয় ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া কহিল—চুপ, চুপ, চুপ করুন! কে কোথা থেকে শুনতে পাবে।

 তখন দারুকেশ্বর কহিল,—ব্যস্ত হবেন না মশায়, একটু পরামর্শ করে দেখি!—বলিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে একটু অন্তরালে ডাকিয়া লইয়া বলিল, বিলেত থেকে ফিরে সেই ত একবার প্রায়শ্চিত্ত কর্ত্তেই হবে—তখন ডবল্ প্রায়শ্চিত্ত করে একেবারে ধর্ম্মে ওঠা যাবে। এ সুযোগটা ছাড়লে আর বিলেত যাওয়াট ঘটে উঠবে না! দেখলি ত কোন শ্বশুরই রাজি হল না। আর ভাই, ক্রিশ্চানের হুঁকোয় তামাকই যখন খেলুম তখন ক্রিশ্চান হতে আর বাকি কি রৈল?—এই বলিয়া অক্ষয়ের কাছে আসিয়া কহিল—বিলেত যাওয়াটা ত নিশ্চয় পাকা? তা হলে ক্রিশচান হ’তে রাজি আছি।

 মৃত্যুঞ্জয় কহিল, কিন্তু আজ রাতটা থাক্।

 দারুকেশ্বর কহিল—হতে হয় ত চট্পট্ সেরে ফেলে পাড়ি দেওয়াই ভাল—গোড়াতেই বলেছি শুভস্য শীঘ্রং।

 ইতিমধ্যে অন্তরালে রমণীগণের সমাগম। দুই থালা ফল মিষ্টান্ন লুচি ও বরফ জল লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ। ক্ষুণ্ণ দারুকেশ্বর কহিল—কই মশায়, অভাগার অদৃষ্টে মুর্গি বেটা উড়েই গেল না কি? কট্‌লেট্ কোথায়?

 অক্ষয় মৃদুস্বরে বলিলেন—আজকের মত এইটেই চলুক!

 দারুকেশ্বর কহিল—সে কি হয় মশায়! আশা দিয়ে নৈরাশ! শ্বশুর বাড়ি এসে মটন চাপ খেতে পাব না? আর এ যে বরফ জল মশায়, আমার আবার সর্দ্দির ধাত, সাদা জল সহ্য হয় না! বলিয়া গান জুড়িয়া দিল—“অভয় দাওত বলি আমার wish কি” ইত্যাদি। অক্ষর মৃত্যু ঞ্জয়কে কেবলি টিপিতে লাগিলেন এবং অস্পষ্ট স্বরে কহিতে লাগিলেন, ধরনা হে, তুমিও ধর না—চুপচাপ কেন;—সে ব্যক্তি কতক ভয়ে কর্তক লজ্জায় মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল! গানের উচ্ছাস থামিলে অক্ষয় আহার পাত্র দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—নিতান্তই কি এটা চলবে না?

 দারুকেশ্বর ব্যস্ত হইয়া কহিল, না মশায়, ও সব রোগীর পথ্যি চলবে না! মুর্গি না খেয়েই ত ভারতবর্ষ গেল! বলিয়া ফড়ফড়করিয়া গুড় গুড়ি টানিতে লাগিল। অক্ষয় কানের কাছে আসিয়া লক্ষ্মৌ ঠুংরিতে ধরাইয়া দিলেন—

কত কাল রবে বল ভারতরে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য করে!

 শুনিয়া দারুকেশ্বর উৎসাহসহকারে গানটা ধরিল এবং মৃত্যুঞ্জয়ও অক্ষয়ের গোপন ঠেলা খাইয়া সলজ্জভাবে মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল।

 অক্ষয় আবার কানে কানে ধরাইয়া দিলেন—

দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন
ধর হুইস্কি সোডা আর মুর্গিমটন!

 অমনি দারুকেশ্বর মাতিয়া উঠিয়া উৰ্দ্ধস্বরে ঐ পদটা ধরিল এবং অক্ষয়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের প্রবল উৎসাহে মৃত্যুঞ্জয় ও কোন মতে সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিয়া গেল।

অক্ষয় পুনশ্চ ধরাইয়া দিলেন—

যাও ঠাকুর চৈতন চুটুকি নিয়া!
এস দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা!

 যতই উৎসাহসহকারে গান চলিল, দ্বারের পার্শ্ব হইতে উসখুস শব্দ শুনা যাইতে লাগিল এবং অক্ষয় নিরীহ ভালমানুষটির মত মাঝে মাঝে সেই দিকে কটাক্ষপাত করিতে লাগিলেন।

 এমন সময় ময়লা ঝাড়ন হাতে কলিমদ্দি আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারুকেশ্বর উৎসাহিত হইয়া কহিল,—এই যে চাচা। আজ রান্নাটা কি হয়েছে বল দেখি!

 সে অনেক গুলা ফর্দ দিয়া গেল। দারুকেশ্বর কহিল কোনটাই ত মন্দ শোনাচে না হে! (অক্ষয়ের প্রতি) মশায়, কি বিবেচনা করেন? ওর মধ্যে বাদ দেবার কি কিছু আছে?

 অক্ষয় অন্তরালের দিকে কটাক্ষ করিয়া কহিলেন—সে আপনারা যা ভাল বোঝেন!

 দারুকেশ্বর কহিল, আমার ত মত, ব্রাহ্মণেত্যো নমঃ বলে সব কটাকেই আদর করে নিই!

 অক্ষয়। তা ত বটেই, ওঁরা সকলেই পূজ্য!
 কলিমদ্দি সেলাম করিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় কিঞ্চিৎ গলা চড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মশায়রা কি তাহলে আজ রাত্রেই ক্রিশ্চান হতে চান?

 খানার আশ্বাসে প্রফুল্লচিত্ত দারুকেশ্বর কহিল—আমার ত কথাই আছে, শুভস্য শীঘ্রং। আজই ক্রিশ্চান হব, এখনি ক্রিশ্চান হব, ক্রিশ্চান হয়ে তবে অন্য কথা! মশায়, আর ঐ পুঁই শাক কলাইয়ের ডাল খেয়ে প্রাণ বাঁচে না! আনুন আপনার পাদ্রি ডেকে! বলিয়া পুনশ্চ উচ্চস্বরে গান ধরিল—

যাও ঠাকুর চৈতন-চুটুকি নিম্ন,
এস দাড়ি নাড়ি কলিমন্দি মিঞা!

 চাকর আসিয়া অক্ষয়ের কানে কানে কহিল—মাঠাকুরুণ একবার ডাক্‌চেন।

 অক্ষয় উঠিয়া দ্বারের অন্তরালে গেলে জগত্তারিণী কহিলেন—এ কি! কাণ্ডটা কি?

অক্ষয় গম্ভীরমুখে কহিলেন—মা সে সব পরে হবে এখন ওরা হুইস্কি চাচ্চে, কি করি? তোমার পায়ে মালিশ করবার জন্যে সেই যে ব্রাণ্ডি এসেছিল, তার কি কিছু বাকি আছে?

 জগত্তারিণী হতবুদ্ধি হইয়া কহিলেন, বল কি বাছা? ব্রাণ্ডি খেতে দেবে?

 অক্ষয় কহিলেন, কি করব মা, শুনেইছ ত, ওর মধ্যে একটা ছেলে আছে যার জল খেলেই সর্দ্দি হয়, মদ না খেলে আর একটীর মুখে কথাই বের হয় না!

 জগত্তারিণী কহিলেন—ক্রিশ্চান্ হবার কথা কি বল্‌চে ওরা?

 অক্ষয় কহিলেন—ওরা বলচে হিঁদু হয়ে খাওয়া দাওয়ার বড় অসুবিধে, পুঁইশাক কড়াইয়ের ডাল খেয়ে ওদের অসুখ করে!

 জগত্তারিণী অবাক হইয়া কহিলেন; তাই বলে কি ওদের আজ রাতেই মুর্গি খাইয়ে ক্রিশ্চান্ করবে নাকি?

 অক্ষয় কহিলেন, তা মা ওরা যদি রাগ করে চলে যায় তা হলে দুটি পাত্র এখনি হাতছাড়া হবে। তাই ওরা যা বলচে তাই শুন্‌তে হচ্চে, আমাকে শুদ্ধ মদ ধরাবে দেখচি।

 পুরবালা কহিলেন—বিদায় কর, বিদায় কর, এখনি বিদায় কর!

 জগত্তারিণী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন—বাবা, এখানে মুর্গি খাওয়া টাওয়া হবে না, তুমি ওদের বিদায় করে দাও। আমার ঘাট হয়েছিল আমি রসিক কাকাকে পাত্র সন্ধান কর্‌তে দিয়েছিলুম! তাঁর দ্বারা যদি কোন কাজ পাওয়া যায়!

 রমণীগণের প্রস্থান। অক্ষয় ঘরে আসিয়া দেখেন, মৃত্যুঞ্জয় পলায়নের উপক্রম করিতেছে এবং দারুকেশ্বর হাত ধরিয়া তাহাকে টানাটানি করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছে। অক্ষয়ের অবর্ত্তমানে মৃত্যুঞ্জয় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছে। অক্ষয় ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র মৃত্যুঞ্জয় রাগের স্বরে বলিয়া উঠিল, না মশায় আমি ক্রিশ্চান্ হতে পারব না, আমার বিয়ে করে কাজ নেই।

 অক্ষয় কহিলেন, তা মশায়, আপনাকে কে পায়ে ধরাধরি কর্‌চে!

 দারুকেশ্বর কহিল, আমি রাজি আছি মশায়!

 অক্ষয় কহিলেন, রাজি থাকেন ত গির্জ্জেয় যান মশায়! আমার সাত পুরুষে ক্রিশ্চান্ করা ব্যব্‌সা নয়!

 দারুকেশ্বর কহিল—ঐ যে কোন্ বিশ্বাসের কথা বল্লেন—

 অক্ষয়। তিনি টেরেটির বাজারে থাকেন, তাঁর ঠিকানা লিখে দিচ্চি।

 দারুকেশ্বর। আর বিবাহটা?

 অক্ষয়। সেটা এ বংশে নয়।

 দারুকেশ্বর। তাহলে এতক্ষণ পরিহাস করছিলেন মশায়? খাওয়াটাও কি—

 অক্ষয়। সেটাও এ ঘরে নয়।

 দারুকেশ্বর। অন্ততঃ হোটেলে?

 অক্ষয়। সে কথা ভাল।— বলিয়া টাকার ব্যাগ হইতে গুটিকয়েক টাকা বাহির করিয়া দুটিকে বিদায় করিয়া দিলেন।

 তখন নৃপর হাত ধরিয়া টানিয়া নীরবালা বসন্তকালের দম্‌কা হাওয়ার মত ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। কহিল, মুখুজ্জে মশায়, দিদি ত দুটির কোনটিকেই বাদ দিতে চান্ না!

 নৃপ তাহার কপোলে গুটি দুই তিন অঙ্গুলির আঘাত করিয়া কহিল, ফের মিথ্যে কথা বলচিস্?

 অক্ষয়। ব্যস্ত হস্‌নে ভাই, সত্য মিথ্যের প্রভেদ আমি একটু একটু বুঝ্‌তে পারি।

 নীরু। আচ্ছা মুখুজ্জে মশায়, এ দুটি কি রসিক দাদার রসিকতা, না আমাদের সেজ দিদিরই ফাঁড়া?

 অক্ষয়। বন্দুকের সকল গুলিই কি লক্ষ্যে গিয়ে লাগে? প্রজাপতি টার্গেট প্র্যাক্‌টিস্ করছিলেন, এ দুটো ফসকে গেল। প্রথম প্রথম এমন গোটাকতক হয়েই থাকে। এই হতভাগ্য ধরা পড়বার পূর্ব্বে তোমার দিদির ছিপে অনেক জলচর ঠোকর দিয়ে গিয়েছিল, বঁড়শি বিঁধল কেবল আমারি কপালে!—বলিয়া কপালে চপেটাঘাত করিলেন!

 নৃপ। এখন থেকে রোজই প্রজাপতির প্র্যাক্‌টিস চল্‌বে না কি মুখুজ্জে মশায়? তা হলে ত আর বাঁচা যায় না!

 নীরু।কেন ভাই দুঃখ করিস্? রোজই কি ফস্কাবে? একটা না একটা এসে ঠিক মতন পৌঁছবে।

রসিকের প্রবেশ।

 নীরু। রসিক দাদা, এবার থেকে আমরাও তোমার জন্যে পাত্রী জোটাচ্চি।

 রসিক। সে ত সুখের বিষয়!

 নীরু। হাঁ! সুখ দেখিয়ে দেব! তুমি নিজে থাক হোগ্‌লার ঘরে, আর পরের দালানে আগুন লাগাতে চাও! আমাদের হাতে টীকে নেই? আমাদের সঙ্গে যদি লাগ, তা হলে তোমার দু-দুটো বিয়ে দিয়ে দেব— মাথায় যে ক’টি চুল আছে সাম্‌লাতে পারবে না!

 রসিক। দেখ্ দিদি, দুটো আস্ত জন্তু এনেছিলুম বলেই ত রক্ষে পেলি, যদি মধ্যম রকমের হত, তা হলেই ত বিপদ ঘট্‌ত। যাকে জন্তু বলে চেনা যায় না, সেই জন্তুই ভয়ানক।

 অক্ষয়। সে কথা ঠিক। মনে মনে আমার ভয় ছিল, কিন্তু একটু পিঠে হাত বুলাবামাত্রই চট্‌পট্ শব্দে ল্যাজ নড়ে উঠ্‌ল। কিন্তু মা বল্‌চেন কি?

 রসিক। সে যা বল্‌চেন সে আর পাঁচজনকে ডেকে ডেকে শোনাবার মত নয়। সে আমি অন্তরের মধ্যেই রেখে দিলুম! যা হোক্ শেষে এই স্থির হয়েছে, তিনি কাশীতে তাঁর বোনপোর কাছে যাবেন, সেখানে পাত্রের ও সন্ধান পেয়েছেন, তীর্থদর্শনও হবে।

 নীরু। বল কি, রসিক দাদা! তা হলে এখানে আমাদের রোজ রোজ নতুন নতুন নমুনে দেখা বন্ধ?

 নৃপ। তোর এখনো সখ্ আছে নাকি?

 নীরু। এ কি সখের কথা হচ্চে? এ হচ্চে শিক্ষা। রোজ রোজ অনেক গুলি দৃষ্টান্ত দেখ্‌তে দেখ্‌তে জিনিষটা সহজ হয়ে আস্‌বে; যেটিকে বিয়ে করবি সেই প্রাণীটিকে বুঝ্‌তে কষ্ট হবে না।

 নৃপ। তোমার প্রাণীকে তুমি বুঝে নিয়ো, আমার জন্যে তোমার ভাবতে হবে না!

 নীরু। সেই কথাই ভাল—তুইও নিজের জন্যে ভাবিস্ আমিও নিজের জন্যে ভাব্‌ব—কিন্তু রসিক দাদাকে আমাদের জন্যে ভাব্‌তে দেওয়া হবে না।

 নৃপ নীরুকে বলপূর্ব্বক টানিয়া লইয়া গেল। শৈলবালা ঘরে প্রবেশ করিয়াই বলিল -রসিকদা তোমার ত মার সঙ্গে কাশী গেলে চল্‌বে না —আমরা যে চিরকুমার সভার সভ্য হব—আবেদন পত্রের সঙ্গে প্রবেশিকার দশটা টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বসে আছি।

 অক্ষয় কহিলেন, মার সঙ্গে কাশী যাবার জন্যে আমি লোক ঠিক করে দেব এখন, সে জন্যে ভাবনা নেই।

 শৈল। এই যে মুখুজ্জে মশায়! তুমি তাদের কি বানর বানিয়েই ছেড়ে দিলে—শেষকালে বেচারীদের জন্যে আমার মায়া করছিল!

 অক্ষয়। বানর কেউ বানাতে পারে না শৈল, ওটা পরম প্রকৃতি নিজেই বানিয়ে রাখেন। ভগবানের বিশেষ অনুগ্রহ থাকা চাই! যেমন কবি হওয়া আর কি। ল্যাজই বল কবিত্বই বল ভিতরে না থাক্‌লে জোর করে টেনে বের করবার জো নেই!

 পুরবালা প্রবেশ করিয়া কেরোসিন্ ল্যাম্পটা লইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া কহিল—বেহারা কি রকম আলো দিয়ে গেছে, মিট্‌মিট্ করচে! ওকে বলে বলে পারা গেল না!

 অক্ষয়। সে বেটা জানে কিনা অন্ধকারেই আমাকে বেশি মানায়।

 পুরবালা। আলোতে মানায় না? বিনয় হচ্ছে না কি? এট। ত নতুন দেখ্‌চি।

 অক্ষয়। আমি বল্‌ছিলুম, বেহারা বেটা চাঁদ বলে আমাকে সন্দেহ করেচে!

 পুর। ওঃ তাই ভাল! তা ওর মাইনে বাড়িয়ে দাও! কিন্তু রসিক দাদা, আজ কি কাণ্ডটাই করলে!

 রসিক। ভাই, বর ঢের পাওয়া যায় কিন্তু সবাই বিবাহযোগ্য হয় না, সেইটের একটা সামান্য উদাহরণ দিয়ে গেলুম।

 পুর। সে উদাহরণ না দেখিয়ে দুটো একটা বিবাহযোগ্য বরের উদাহরণ দেখলেই ত ভাল হত!

 শৈল। সে ভার আমি নিয়েছি দিদি।

 পুর। তা আমি বুঝেছি! তুমি আর তোমার মুখুজ্জে মশায়ে মিলে ক’দিন ধরে যে রকম পরামর্শ চল্‌চে একটা কি কাণ্ড হবেই।

 অক্ষয়। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড ত আজ হয়ে গেল।

 রসিক। লঙ্কাকাণ্ডের আয়োজনও হচ্চে, চিরকুমার সভার স্বর্ণলঙ্কায় আগুন লাগাতে চলেছি।

 পুর। শৈল তার মধ্যে কে?

 রসিক। হনুমান ত নয়ই।

 অক্ষয়। উনিই হচ্চেন স্বয়ং আগুন।

 রসিক। এক ব্যক্তি ওঁকে ল্যাজে করে নিয়ে যাবেন।

 পুর। আমি কিছু বুঝ্‌তে পারচিনি! শৈল, তুই চিরকুমার সভায় যাবি না কি!

 শৈল। আমি যে সভ্য হব!

 পুর। কি বলিস্ তার ঠিক নেই! মেয়ে মানুষ আবার সভ্য হবে কি!

 শৈল। আজকাল মেয়েরাও যে সভ্য হয়ে উঠেছে। তাই আমি শাড়ি ছেড়ে চাপকান ধরব ঠিক করেছি।

 পুর। বুঝেছি, ছদ্মবেশে সভ্য হ’তে যাচ্চিস্ বুঝি! চুলটাত কেটেইচিস্, ঐটেই বাকি ছিল। তোমাদের যা খুসি কর, আমি এর মধ্যে নেই।

 অক্ষয়। না, না, তুমি এ দলে ভিড়ো না! আর যার খুসি পুরুষ, হোক, আমার অদৃষ্টে তুমি চিরদিন মেয়েই থেকো—নইলে ব্রীচ্ অফ্ কণ্ট্রাক্ট—সে বড় ভয়ানক মকদ্দমা!—বলিয়া সিন্ধুতে গান ধরিলেন—

চির-পুরাণো চাঁদ!
চির দিবস এমনি থেকো আমার এই সাধ!
পুরাণো হাসি পুরাণো সুধা, মিটায় মম পুরাণো ক্ষুধা,
নূতন কোন চকোর যেন পায় না পরসাদ!

 পুরবালা রাগ করিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয়-শৈলবালাকে আশ্বাস দিয়া কহিলেন—ভয় নেই! রাগটা হয়ে গেলেই মনটা পরিষ্কার হবে—একটু অনুতাপও হবে—সেইটেই সুযোগের সময়।

 রসিক।

কোপো যত্র ভ্রুকুটি রচনা, নিগ্রহো যত্র মৌনং,
যত্রান্যোন্যস্মিতমনুনয়ং, যত্র দৃষ্টিঃ প্রসাদঃ,

 শৈল। রসিক দাদা তুমি ত দিব্যি শ্লোক আউড়ে চলেচ—কোপ জিনিষটা কি, তা মুখুজ্জে মশায় টের পাবেন।

 রসিক। আরে ভাই, বদল করতে রাজি আছি! মুখুজ্জে মশায় যদি শ্লোক আওড়াতেন আর আমার উপরেই যদি কোপ পড়ত তা হলে এই পোড়া কপালকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখ্‌তুম। কি দিদি, ঐ জলখাবারের থালা দুটি ত মান করে নি, বসে গেলে বোধ হয় আপত্তি নেই?

 অক্ষয়। ঠিক ঐ কথাটাই ভাব্‌ছিলুম।

 উভয়ে আহারে উপবেশন করিলেন, শৈলবালা পাখা লইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন।