প্রাকৃতিকী/নূতন বিশ্লেষণ-প্রথা

উইকিসংকলন থেকে

নূতন বিশ্লেষণ-প্রথা

সূর্যালোক বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা যে বর্ণচ্ছত্র প্রাপ্ত হই, তাহাতে লোহিতাদি বর্ণ অবিচ্ছিন্নভাবে সজ্জিত থাকে, কেবল ইহার মধ্যে সৌরবর্ণচ্ছত্রের প্রধান লক্ষণ কতকগুলি কৃষ্ণরেখা স্থানে স্থানে দৃষ্ট হয় মাত্র। কিন্তু এই কৃষ্ণরেখাগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলিয়া, স্থুল দৃষ্টিতে সাধারণ বর্ণচ্চত্র

পর্য্যবেক্ষণ করিলে, এগুলি সহসা লক্ষিত হয় না; এজন্য সৌরবর্ণচ্ছত্র প্রায় অবিচ্ছিন্ন বলিয়া বোধ হয়। এই ত গেল সূর্য্যালোকের কথা। অপর আলোকও বিশ্লিষ্ট হইলে, বর্ণচ্ছত্র উৎপন্ন হইয়া থাকে। কিন্তু যে সকল মৌলিক বর্ণরশ্মি সংযোগে সূর্য্যালোক উৎপন্ন হয়, তাহার সকলগুলি অপর আলোকে এককালে উপস্থিত থাকে না। এ বিবিধ বর্ণচ্ছত্রে বর্ণবিন্যাসের অনেক প্রভেদ দেখা যায় এবং কোন কোন স্থলে এই কারণে বর্ণচ্ছত্রের প্রকৃতিগত বিভিন্নতাও দেখা গিয়া থাকে।

 আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ প্রকৃতিভেদে পদার্থ সকলের বর্ণচ্ছত্রগুলিকে প্রধান তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া থাকেন। যে সকল বর্ণচ্ছত্রে বর্ণসকল অবিচ্ছিন্নভাবে পর পর সজ্জিত থাকে, তাহাদিগকে এক শ্রেণীর অর্ন্তভুত করা হয়। পরীক্ষা দ্বারা দেখা গিয়াছে, কঠিন ও তরল পদার্থ প্রজ্জ্বালিত করিলে, তজ্জাত আলোক দ্বারা সাধারণতঃ এই অবিচ্ছিন্ন বর্ণচ্ছত্রের বিকাশ হয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণচ্ছত্রে বিশ্লিষ্ট-বর্ণগুলির উজ্জ্বলতা সমান থাকে না, এজন্য ইহাতে বর্ণসকল বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত দেখা যায়;—সৌরবর্ণচ্ছত্র এই শ্রেণীর অন্তর্ভুত, ইহার সর্ব্বাংশ কৃষ্ণরেখা পরিব্যাপ্ত থাকে বলিয়া, পূর্ব্বাপর বর্ণগুলির মধ্যে ব্যবধান থাকিয়া যায়, কাজেই ইহা প্রথম শ্রেণীর বর্ণচ্ছত্রের ন্যায় অবিচ্ছিন্ন হইতে পারে না। বৈজ্ঞানিকগণ বলেন,—এই শ্রেণীর বর্ণচ্ছত্রোৎপাদক আলোক হইতে কোন প্রকারে কতকগুলি মৌলিক বর্ণরশ্মি লয়প্রাপ্ত হইলে বর্ণচ্ছত্রে লুপ্তবর্ণ সকল প্রকাশিত হয় না, কাজেই ইহাদের স্থান শূন্য পড়িয়া থাকে। এই শূন্যস্থানই সৌরবর্ণচ্ছত্রে কৃষ্ণরেখাকারে প্রকাশিত থাকে। তৃতীয় শ্রেণীর বর্ণচ্ছত্রেও অবিচ্ছিন্ন বর্ণের সমাবেশ দেখা যায় না, ইহাতে কেবল মধ্যে মধ্যে কয়েকটি স্থূল ও উজ্জ্বল বর্ণরেখা দৃষ্ট হয় মাত্র; যে-সকল রশ্মি কেবল দুই বা ততোধিক মৌলিকবর্ণ সংমিশ্রণে উৎপন্ন হয়, তাহাদের বিশ্লেষণে, এই শেষোক্ত বর্ণচ্ছত্র রচিত হইয়া থাকে,—প্রজ্বলিত বাষ্পজাত আলোকের এই বর্ণচ্ছত্রই প্রধান লক্ষণ।

 নিউটনের বর্ণবিশ্লেষণ প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পর বর্ণচ্ছত্র লইয়া বৈজ্ঞানিক মহলে কিছুদিন বেশ আন্দোলন চলিয়াছিল, কিন্তু ইহা দ্বারা কোন নূতন তথ্য প্রকাশ পায় নাই। নিউটনের আবিষ্কারের অনেক পরে ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে, টমাস মেল্‌ভিল্ নামক জনৈক কৃতবিদ্য যুবক নিউটন-প্রদর্শিত পথে বর্ণচ্ছত্রের নূতন গবেষণায় নিযুক্ত হন; সৌভাগ্যের বিষয়, সমসাময়িক অপর বৈজ্ঞানিকদিগের ন্যায় মেল্‌ভিলের অনুসন্ধান ও যত্ন বিফল হয় নাই,—দাহ্য পদার্থভেদে যে দীপালোকের নানা বর্ণচ্ছত্র হইতে পারে তাহা যুবক মেল্‌ভিলই সর্ব্বপ্রথম প্রচার করেন এবং স্থূল কাগজস্থ ক্ষুদ্র ছিদ্র দ্বারা ত্রিকোণ কাচ-মধ্যাগত আলোক পরীক্ষা করিয়া প্রজ্বলিত বাষ্পের স্থূলোজ্জ্বল রেখাময় বর্ণচ্চত্রের বিষয় ইনিই আবিষ্কার করেন। সামান্য যন্ত্র দ্বারা নানা জাতীয় বর্ণচ্চত্রের অস্তিত্ব আবিষ্কার করায় তাৎকালিক বৈজ্ঞানিক সমাজে মেলভিলের বিশেষ সমাদর হইয়াছিল; এই প্রকারে সম্মানিত হইয়া যুবক দ্বিগুণ উৎসাহে আলোকবিজ্ঞানের নানা গবেষণায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যপ্রযুক্ত পুর্ব্বোক্ত আবিষ্ক্রিয়ার দুই বৎসর পরেই মেলভিলের মৃত্যু হওয়ায় বিজ্ঞানজগৎ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইল।

 মেল্‌ভিলের পর, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ওলাষ্টন্ বর্ণচ্ছত্রের গবেষণায় নিযুক্ত হন; ১৮০২ খৃষ্টাব্দে রয়াল্ সোসাইটির অধিবেশনে তাঁহার পরীক্ষালব্ধ কয়েকটি নূতন কথা প্রকাশিত হইয়াছিল। কিন্তু ইহা দ্বারা আলোকবিজ্ঞানের বিশেষ কোন উৎকর্ষতা সাধিত হয় নাই। আলোকবিজ্ঞানের উন্নতির ইতিহাস ঠিক কোন্ সময় হইতে আরম্ভ হয়, তাহার স্থিরতা নাই। এ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদিগের মধ্যে মতভেদ দৃষ্ট হয়, অনেকে বলেন, স্বনামপ্রসিদ্ধ যোজেফ ফ্রান্‌হোফারের সময় হইতেই আলোকবিজ্ঞানের উন্নতি আরম্ভ হয়। যাহা হউক ফ্রান্‌হোফারের বিখ্যাত আবিষ্কার এবং তাঁহার নানা পরীক্ষা, আলোকবিজ্ঞান ও বর্ণচ্ছত্রের ক্রমোন্নতির ইতিহাসে যে একটি মহৎ ঘটনা তাহাতে সন্দেহ নাই। ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্‌হোফার কর্ত্তৃক সৌর বর্ণচ্ছত্রে পূর্ব্ববর্ণিত কৃষ্ণরেখার আবিষ্কার হওয়ায় অনেকের দৃষ্টি এই দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিল। দুইখানি ভিন্ন প্রকৃতি কাচ লইয়া, বিবিধ রশ্মির আলোকপথ পরিবর্ত্তনের পরিমাণ স্থির করিতে গিয়া এই জর্ম্মান্ পণ্ডিত, সৌর বর্ণচ্ছত্রে হঠাৎ কৃষ্ণরেখা আবিষ্কার করেন। অপর পণ্ডিতগণ ইঁহার এই অদ্ভুত আবিষ্কারে সন্দিহান হওয়ায়, থিওডোলাইট্ যন্ত্রের দূরবীক্ষণ দ্বারা, ঐ রেখাগুলির সংখ্যা ও স্থান প্রত্যক্ষ নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইলে পর, সকল সন্দেহই অপনীত হইয়াছিল। ফ্রান্‌হোফার এই ক্ষুদ্র যন্ত্র দ্বারা প্রায় ছয়শত কৃষ্ণরেখা আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই বিখ্যাত পণ্ডিত কেবল কৃষ্ণরেখা আবিষ্কার করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, প্রায় তিন বৎসর অবিরাম পরিশ্রম দ্বারা সেগুলির পরস্পর ব্যবধান স্থির করিয়া, সৌর বর্ণচ্ছত্রের কয়েকটি প্রতিকৃতিও অঙ্কিত করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত ইনি বর্ণচ্ছত্র সম্বন্ধে আরও অনেক নূতন সত্য আবিষ্কার করিয়াছিলেন। কৃষ্ণরেখাগুলির সংখ্যা যে নির্দ্দিষ্ট, এবং সাধারণ সূর্য্যালোকে ও চন্দ্রাদি গ্রহ-উপগ্রহাগত প্রতিফলিত আলোকে, ঐ কৃষ্ণরেখাগুলির স্থানও যে নির্দ্দিষ্ট এবং অপরিবর্ত্তনীয়, তাহাও ফ্রান্‌হোফার সর্ব্ব প্রথম প্রচার করেন। এই প্রকারে নানা বিষয়ে কৃতকার্য্য হইলেও, নানা পরীক্ষা ও চেষ্টাতে, ফ্রান্‌হোফার কৃষ্ণরেখা উৎপাদনের মূল কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারেন নাই।

 ফ্রান্‌হোফারের কথা ছাড়িয়া দিয়া, বর্ত্তমান শতাব্দীর গবেষণাপরায়ণ পণ্ডিতদের কথা স্মরণ করিলে, বর্ত্তমান প্রসঙ্গে সার্ জন হার্সেল ও ফক্স ট্যালবটের কথা স্বতঃই মনে হয়। এই বৈজ্ঞানিকদ্বয়ের মৌলিক গবেষণা দ্বারা, বর্ণচ্ছত্রের প্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক অপরিজ্ঞাত বিষয় প্রকাশিত হইয়াছিল, এবং বর্ণচ্ছত্র দ্বারা পদার্থের প্রকৃতি নির্ণয়ের কথা, এই পণ্ডিতযুগলই সর্ব্বপ্রথম জগতে প্রচার করিয়াছিলেন। ১৮২২ খৃষ্টাব্দে হার্সেল সাহেব, বিবিধ জ্বলন্ত পদার্থের বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষায় নিযুক্ত হন এবং প্রত্যেক পদার্থের বর্ণচ্ছত্রের নির্দ্দিষ্টাংশে এক একটি স্থূল বর্ণরেখা দেখিয়া, এই নির্দ্দিষ্ট বর্ণরেখাগুলিকেই, দাহ্য পদার্থের প্রকৃতিজ্ঞাপক বলিয়া স্থির করেন। হার্সেলের পরীক্ষাকালে, তাৎকালিক অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানবিৎ সার্ ডেভিড ব্রুষ্টার ইহাতে যোগ দিয়াছিলেন, এবং নানা প্রকার উদ্ভিজ্জরসে বর্ণচ্ছত্র পাতিত করিলে ইহার বর্ণ পরিবর্ত্তন হইতে প্রত্যক্ষ করিয়া, বর্ণচ্ছত্র দ্বারা বিশ্লেষণ কার্য্য সম্ভবপর বলিয়া, এই বৈজ্ঞানিকদ্বয়ই সর্ব্বপ্রথম অনুমান করেন। এতদ্ব্যতীত প্রত্যেক বাষ্পের নির্দ্দিষ্ট রশ্মিহরণক্ষমতা প্রত্যক্ষ করিয়া, সৌর বর্ণচ্ছত্রস্থ কৃষ্ণরেখা উৎপাদনের প্রকৃত কারণের আভাষ, ইঁহারাই সর্ব্বপ্রথমে জগতে প্রচারিত করেন।

 হার্সেল এবং ব্রুষ্টারের পরীক্ষার ফল প্রচারিত হইলে, ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে, সুপ্রসিদ্ধ রসায়নবিৎ ফক্স ট্যাল্‌বট্ উক্ত বৈজ্ঞানিকদ্বয়ের আবিষ্কারের সমালোচনা করিয়া একখানি পুস্তিকা রচনা করেন। বৈজ্ঞানিকদিগের মতে, ট্যাল্‌বটের এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানি, প্রাচীন বিজ্ঞান ভাণ্ডারের একটি অমূল্য রত্ন,— এই ক্ষুদ্র পুস্তিকা দ্বারাই আধুনিক বর্ণচ্ছত্রীয় বিশ্লেষণপ্রথার মূলভিত্তি স্থাপিত হয়। গ্রন্থকার একস্থানে স্পষ্টই লিখিয়াছেন,—জটিল রাসায়নিক পদার্থ প্রজ্বালিত করিয়া, কেবল বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা দ্বারা ইহার গঠনোপাদান অতি সূক্ষ্মভাবে স্থির করিতে পারা যায়। এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ কার্য্য অপর রাসায়নিক প্রক্রিয়া দ্বারা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সকল বর্ণচ্ছত্রে সোডিয়ম্ জাত উজ্জ্বল পীতরেখা দেখিয়া পীতরেখা-উৎপাদক পদার্থটির আবিষ্কারার্থে ট্যাল্‌বট্ নানা পরীক্ষায় নিযুক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ইহাতে কৃতকার্য্য হন নাই। প্রায় সকল পদার্থেই অল্পাধিক পরিমাণে জল আছে দেখিয়া জলই পীতবর্ণোৎপাদক পদার্থ বলিয়া স্থির করেন এবং অপর এক সময়ে লোহিতালোকজাত বর্ণচ্ছত্রে অত্যুজ্জ্বল পীতরেখা দেখিয়া, গন্ধকই ইহার কারণ বিবেচনা করেন।

 এখন পূর্ব্ববর্ণিত প্রাচীন ও আধুনিক পণ্ডিতগণের নানা পরীক্ষাদি দ্বারা দেখা যাইতেছে পদার্থমাত্রই তাপসংযোগে বাষ্পীভূত ও প্রজ্বলিত হইলে, ইহাদের বর্ণচ্ছত্রে এক একটি নির্দ্দিষ্ট বর্ণের রেখা দৃষ্ট হয় এবং পদার্থটির অস্তিত্ব থাকিলে সকল্‌ সময়েই বর্ণচ্ছত্রের এক একটি নির্দ্দিষ্ট স্থানে উক্ত রেখাসকল প্রকাশিত দেখা যায়; কাজেই বর্ণচ্ছত্রস্থ এই স্থির বর্ণরেখাগুলি পরিদর্শন করিয়া, অনায়াসেই অতি জটিল পদার্থের গঠনোপাদানও নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। সোডিয়ম্ পোটাসিয়ম্ প্রভৃতি কয়েকটি ধাতু সাধারণ দীপশিখায় সহজেই বাষ্পীভূত ও প্রজ্বলিত হয়, এজন্য ইহাদের বর্ণচ্ছত্র অতি সহজেই প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু অপর পদার্থ অল্পতাপে বাষ্পীভূত ও প্রজ্বলিত করা অতি কষ্টসাধ্য এবং অনেক সময়ে অসাধ্য বলিয়া বিবেচিত হওয়ায় এ পর্য্যন্ত সাধারণ বিশ্লেষণকার্য্যে বর্ণচ্ছত্র ব্যবহৃত হইত না। কিন্তু আজ কাল বৈদ্যুতিক প্রবাহ ও অগ্নি-হাইড্রোজেন দীপশিখার সাহায্যে এই সকল কার্য্য সম্পন্ন হইতেছে, এজন্য এই অভিনব বিশ্লেষণপ্রথা সর্ব্বাপেক্ষা সরল বলিয়া আদৃত হইতেছে। কেবল বিদ্যুৎপ্রবাহ দ্বারা, আজকাল সকল ধাতুই বাষ্পীভূত হইতেছে।

 বর্ণচ্ছত্র দ্বারা কেবল যে, পদার্থ বিশ্লেষণের সুযোগ হইয়াছে তাহা নয়, গত পঞ্চাশৎ বৎসরের মধ্যে, ইহা দ্বারা কয়েকটি নূতন ধাতুও আবিষ্কৃত হইয়াছে। পোটাসিয়ম ইত্যাদি কয়েকটি ধাতুর বর্ণচ্ছত্রে ইহাদের বর্ণরেখা নিরূপণকালে জগদ্বিখ্যাত জর্ম্মানপণ্ডিত বুন্‌সেন্‌ দুইটি নূতন ধাতু আবিষ্কার করেন। পোটাসিয়মের বর্ণচ্ছত্রের বর্ণরেখার পার্শ্বে অপর একটি অদৃষ্টপূর্ব্ব বর্ণরেখা দেখিয়া নিশ্চয়ই ইহা কোন বিজাতীয় পদার্থ যোগে উৎপন্ন হইয়াছে স্থির করিয়া বুন্‌সেন্‌ এই বর্ণোৎপাদক পদার্থটিকে পৃথক করিবার চেষ্টা করেন, এবং ইঁহার এই চেষ্টার ফলে রুবিডিয়ম্ ও সিজিয়ম্ নামক দুইটি নূতন ধাতুর আবিষ্কার হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ক্রুক্‌স্ কোন একটি যৌগিক পদার্থের বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষাকালে বর্ণচ্ছত্রে একটি অত্যুজ্জ্বল নীলরেখা দেখিয়াছিলেন এবং ইহা পরিজ্ঞাত কোন মৌলিক পদার্থজাত হইতে পারে না বুঝিয়া সম্ভবতঃ ইহা একটি নূতন পদার্থের অস্তিত্বজ্ঞাপক বলিয়া স্থির করেন, এবং অল্পায়াসেই থ্যালিয়ম নামক একটি নূতন ধাতু আবিষ্কৃত হইয়া পড়ে। বর্ণচ্ছত্র দ্বারা ধাতুআবিষ্কারে বুন্‌সেন্ ও ক্রুক্‌স্ প্রমুখ পণ্ডিতগণের কৃতকার্য্যতা দেখিয়া তাৎকালিক অনেক পণ্ডিত সকল পদার্থেরই বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। ইহার ফলে রয়স্‌বাদ্রোঁ ও ফ্রেনবর্গ নামক বৈজ্ঞানিকদ্বয় অল্পকাল মধ্যেই ইণ্ডিয়ম্ ও গ্যালিয়ম্ নামে অপর দুইটি নূতন ধাতু আবিষ্কার করেন।

 প্রত্যেক পদার্থের বর্ণচ্ছত্রস্থ নির্দ্দিষ্ট বর্ণের স্থির রেখাগুলিই, এই নূতন বিশ্লেষণ প্রথার প্রধান অবলম্বন। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে— পদার্থ পরিবর্ত্তন না করিলে, বর্ণচ্ছত্রে নির্দ্দিষ্ট বর্ণরেখাগুলির স্থান সকল সময়েই এক থাকে। এখন ইহা হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, কোন এক জটিল যৌগিকের উপাদান স্থির করিতে হইলে, বর্ণচ্ছত্র রচনা করিয়া ইহার কোন্ কোন্ বর্ণরেখা মৌলিক বর্ণচ্ছত্রস্থ রেখার অনুরূপ, সর্ব্ব প্রথমে তাহা নির্ণয় করা আবশ্যক। কারণ, তাহা স্থির করিতে পারিলে, তত্তৎ বর্ণরেখা উৎপাদক মৌলিক পদার্থ যে, উক্ত যৌগিকে বর্ত্তমান আছে, তাহা অনায়াসেই স্থির করা যায়। কোন্ মৌলিক পদার্থ কোন্ বর্ণরেখা প্রকাশ করে তাহা নানা পদার্থের রঞ্জিত প্রতিকৃতি দেখিয়া অনায়াসে জানিতে পারা যায়। আজকাল সাধারণ বিশ্লেষণকার্য্য এই প্রকারে সম্পন্ন হইয়া থাকে।

 বর্ণচ্ছত্রস্থ বর্ণরেখাগুলির স্থান যে, সকল সময়েই নির্দ্দিষ্ট থাকে তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু আলোকজনক পদার্থের অবস্থাভেদে, অনেক সময় রেখাগুলি কখন ক্ষীণতর কখন বা প্রশস্ততর হইতে দেখা যায়। পরীক্ষা দ্বারা দেখা গিয়াছে, আলোকোৎপাদক পদার্থের চাপ ও তাপ বৃদ্ধি করিলে ইহার পরিচায়ক বর্ণরেখাগুলি ক্রমেই উজ্জ্বল ও প্রশস্ততর হইতে দেখা যায় এবং তাপ পরিমাণ অত্যন্ত বৃদ্ধি করিলে, বর্ণচ্ছত্রে কখন কখন একই বর্ণের অপর দুই একটি রেখা দৃষ্ট হয়। চাপ ও তাপ দ্বারা বর্ণচ্ছত্রের এই পরিবর্ত্তনে, পরীক্ষায় নানা গোলযোগ উপস্থিত করে; কারণ, অবিচ্ছিন্ন উজ্জ্বল বর্ণচ্ছত্র, জ্বলন্ত কঠিন পদার্থজাত বলিয়া সাধারণতঃ স্থিরীকৃত হয় বটে, কিন্তু বাষ্পজাত বিচ্ছিন্ন বর্ণচ্ছত্রস্থ বর্ণরেখাগুলিকেও প্রচুর উত্তাপ ও চাপ সাহায্যে বিস্তৃত করিয়া, কঠিন পদার্থের বর্ণচ্ছত্রের অনুরূপ অবিচ্ছিন্ন করিতে পারা যায়। এজন বর্ণচ্ছত্রের বিশ্লেষণ কালে বর্ণরেখাগুলির পরস্পর ব্যবধান অতি সতর্কতার সহিত পরীক্ষা করিতে হয় এবং পরীক্ষাধীন পদার্থটিকে উপযুক্ত তাপ সংযোগে অতি সাবধানে প্রজ্বালিত করিতে হয়!

 এই ত গেল বিচ্ছিন্ন বাষ্পীয় বর্ণচ্ছত্রের কথা। কৃষ্ণরেখাময় সৌর বর্ণচ্ছত্র দ্বারাও, রাসায়নিক বিশ্লেষণ অতি সূক্ষ্মরূপে সুসম্পাদিত হইয়া থাকে। পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, শুভ্রালোকস্থ সমবেত বিবিধ বর্ণরশ্মি সূর্য্যমণ্ডল হইতে পৃথিবীতে আগমনকালে কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তিত হয়, এবং কতকগুলি রশ্মি কোন প্রকারে এককালে লোপ পাইয়া থাকে;—এই জন্যই সৌরবর্ণচ্ছত্রে লুপ্তবর্ণের স্থানে কৃষ্ণরেখা প্রকাশিত হয়। এই লুপ্তরশ্মি-আলোকের বর্ণচ্ছত্র দ্বারা, অনেক সময়ে সহজে তরলপদার্থের নির্ম্মাণোপাদান নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। বিজ্ঞানানুরাগী পাঠকপাঠিকাগণ বোধ হয় অবগত আছেন,— আমরা সচরাচর যে-সকল পদার্থ প্রত্যক্ষ করি, তাহারা তাহাদের বর্ণ সূর্য্যালোক হইতেই পাইয়া থাকে। শুভ্রালোক ঐ সকল পদার্থে পতিত হইলে, প্রাকৃতিক ধর্ম্মানুসারে ইহার। আলোকস্থ কতকগুলি বর্ণরশ্মি হরণ করে ও হৃতাবশিষ্ট রশ্মিগুলি প্রতিফলিত করে,—এই প্রতিফলিত রশ্মি দ্বারা আমরা পদার্থগণকে তত্তৎবর্ণবিশিষ্ট দেখিতে পাই। এই ত গেল সাধারণ পদার্থের বর্ণের কথা। স্বচ্ছ পদার্থসকলও পূর্ব্বোক্ত প্রকারে বর্ণবিশিষ্ট হইয়া থাকে,—ইহাতে কেবল লুপ্তাবশিষ্ট রশ্মিগুলি প্রতিফলিত না হইয়া, পদার্থের মধ্য দিয়া নির্ব্বিঘ্নে বহির্গত হইয়া, ইহাদিগকে রঞ্জিত করে। বর্ণচ্ছত্র সাহায্যে কোন তরল পদার্থের প্রকৃতি নির্ণয় করিতে হইলে, ইহার মধ্য দিয়া অবিশ্লিষ্ট রশ্মিগুচ্ছ আনয়ন করিয়া, পরে পূর্ব্ববর্ণিত সাধারণ উপায়ে বর্ণচ্ছত্র উৎপন্ন করিতে হয়, পরে এই বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা দ্বারা পদার্থটির উপাদান স্থির করিতে হয়। এই প্রকার বর্ণচ্ছত্রের একটি প্রধান লক্ষণ এই যে, তরল পদার্থের মধ্য দিয়া আগমনকালে সাধারণ সৌর বর্ণরশ্মিগুচ্ছের কতকগুলি, পদার্থটির প্রকৃতি অনুসারে লোপ প্রাপ্ত হয়; কাজেই এই লুপ্তরশ্মির আলোক দ্বারা যে বর্ণচ্ছত্র রচিত হয়, তাহাতে সৌর বর্ণচ্ছত্রস্থ স্থিররেখাগুলি ব্যতীত আরো কয়েকটি নূতন কৃষ্ণরেখা প্রকাশিত হয়। এই নূতন রেখাগুলির স্থান বর্ণচ্ছত্রের কোন্ কোন্ অংশে অবস্থিত, এবং কোন্ কোন্ মৌলিক পদার্থ দ্বারা উক্ত বর্ণলুপ্ত রেখা সকল উৎপন্ন হয় তাহা স্থির করিলে, তরল পদার্থটির উপাদান অনায়াসেই স্থির করিতে পারা যায়।

 আজকাল পূর্ব্ববর্ণিত উপায়ে, সকল জৈব ও ধাতব পদার্থের বিশ্লেষণকার্য্য সম্পন্ন হইতেছে। যে-সকল জৈব পদার্থ জটিলতার জন্য এ পর্য্যন্ত অবিশ্লিষ্ট অবস্থায় ছিল, বর্ণচ্ছত্র সাহায্যে এখন তাহার অতি ক্ষুদ্র উপাদানও, অতি সহজে আবিষ্কৃত হইতেছে। এতদ্ব্যতীত সন্দেহজনক মৃত্যুতে মৃতব্যক্তির পাকাশয়স্থ পদার্থের বিশ্লেষণ অসম্ভব হইলে, কেবল বর্ণচ্ছত্র পরীক্ষা দ্বারা অনেক সময়ে বিষাক্ত পদার্থের চিহ্ন আবিষ্কৃত হইতে দেখা গিয়াছে। অল্পদিন হইল, হপ্‌সেলার নামক জনৈক বিজ্ঞানবিৎ, নরশোণিতের বর্ণচ্ছত্র উৎপাদন করিয়াছেন এবং শোণিত বিষসংযুক্ত হইলে, বর্ণচ্ছত্রের কি প্রকার পরিবর্ত্তন হয় তাহাও দেখাইয়াছেন। হপ্‌সেলারের এই আবিষ্কার দ্বারা, বিকৃতশোণিত ব্যক্তির রক্ত কি বিষে দূষিত হইয়াছে, তাহা অল্পায়াসেই স্থিরীকৃত হইতেছে। আজকাল আবার অধ্যাপক সর্লিপ্রমুখ কয়েকটি পণ্ডিত বর্ণচ্ছত্র সাহায্যে ব্যবসায়িগণের দ্রব্যাদির বিশুদ্ধতাও পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন; য়ুরোপীয় অনেক বণিক্‌-সভা, বিশুদ্ধতা নিরূপণের ইহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও সূক্ষ্মতম উপায় বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।