প্রাচীন ভারতে নারী/বরদরাজ-কৃত ব্যবহারনির্ণয় ও নারীদের অধিকার
বরদরাজ-কৃত ব্যবহারনির্ণয় ও নারীদের অধিকার
একই সংস্কৃতির মানুষ নানা কারণে কালে-কালে নানা দেশে বিচ্ছিন্ন হইয়া ছড়াইয়া পড়ে। তখন সকলেই নিজেদের পুরাতন ঐক্যসূত্রটি বাঁচাইয়া রাখিতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। তখনও তাহারা বিচ্ছিন্ন নানা শাখার মধ্যেও আচারব্যবহারের ও ধর্মাচরণের সাম্য রক্ষা করিয়া নিজেদের একত্বটি বজায় রাখিতে চায়। তাহা ছাড়া বিশেষ বিশেষ সঙ্কটস্থলে কর্তব্য-সংশয় উপস্থিত হইলে যদি প্রাচীন সব বিধিবিধানের সহায়তা পাওয়া যায় তবে মীমাংসার অনেক সুবিধা হয়। এইসব কারণেই বৈদিক যুগের উত্তরভাগে আমরা গৃহ্যসূত্র, কল্পসূত্র, শ্রৌতসূত্র প্রভৃতির উদ্ভব দেখিতে পাই। এইসব সূত্রের দ্বারা নানা বিষয়ে প্রাচীন বিধিবিধান নানা শাখার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া তখনকার দিনে নানা-প্রদেশে-বিচ্ছিন্ন ভারতের সর্বত্র আর্যসংস্কৃতির ঐক্যরক্ষার ও সংশয়মীমাংসার চেষ্টা করা হইয়াছে।
তাহার পর আরও বহুকাল চলিয়া গেল। নানা দেশে গিয়া নানা শ্রেণীর মধ্যে নানাবিধ সব নূতন আচার-ব্যবহার প্রবর্তিত হইল। তখন আরও অনেক বিষয়ে নূতন নূতন নির্দেশের প্রয়োজন হইল। তখনই হইল মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর প্রভৃতি নানা স্মৃতির উদ্ভব। এই স্মৃতির মধ্যে কতকগুলি সর্বত্রই অতিশয় সম্মানিত। কতকগুলি স্মৃতি অন্যত্র সম্মানিত হইলেও দেশবিশেষেই বিশেষভাবে অনুসৃত। তাই দেশভেদে সম্প্রদায়ভেদে ও মুখ্যগৌণভেদে স্মৃতির সংখ্যা অনেক। সেইসব স্মৃতির মধ্যে মনুর সমাদর সর্বত্র। এইসব স্মৃতিকারেরাও নানাস্থান হইতে প্রাচীন মতামত সংগ্রহ করিয়া একত্র প্রকাশিত করিয়াছেন, তাই তাঁহাদের গ্রন্থের নাম সংহিতা। শ্রীযুত পি. ভি. কানের গ্রন্থ দেখিলে নানাবিধ স্মৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। বোম্বাই আনন্দাশ্রম মন্বাদি প্রধান প্রধান স্মৃতি ছাড়াও অপেক্ষাকৃত দুর্লভ সাতাশটি স্মৃতি একত্রে ১৯০৫ সালে মুদ্রিত করেন।
এইসব কারণে স্মৃতি অনেক। ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতিতে স্থানগত ও কালগত প্রয়োজন অনুসারে কখনও কখনও আচারব্যবহারের ভিন্ন ভিন্ন দিকে ঝোঁক বা গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে।
স্মৃতির পরবর্তীকালে দেখা গেল যে, সংসারযাত্রার নানা সংশয়স্থলে নানা স্মৃতির তুলনা করিয়া আশ্রয় না নিলে এবং নানা প্রমাণ একত্র করিয়া বিচার না করিলে সব সময় ঠিক চলে না। এইজন্য পরবর্তী যুগে হইল সব ধর্মনিবন্ধের উদয়। বাংলাদেশের যেমন রঘুনন্দন নানাশাস্ত্র সংকলিত করিয়া যুক্তি ও বিচার করিয়া তাঁহার অষ্টবিংশতিতত্ত্বসমন্বিত নিবন্ধ রচনা করিয়াছেন, তেমনি ভারতের নানা স্থানে নানা যুগে সব নিবন্ধকারদের উদয় হইয়াছে। বাংলা দেশে প্রধানত রঘুনন্দনেরই সমাদর। অন্যান্য বহু প্রদেশে চলে বিজ্ঞানেশ্বর-কৃত মিতাক্ষরা। তাহা যাজ্ঞবল্ক্যের ব্যবহারকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। পরাশর-সংহিতায় ব্যবহার-কাণ্ডের উপর রচিত হইল মাধবভাষ্য। মিথিলাতে চণ্ডেশ্বর ঠক্কুরের বিবাদ-রত্নাকর ও উড়িষ্যার প্রতাপরুদ্রের সরস্বতীবিলাস সমাদৃত। দক্ষিণভারতে বরদারাজ-কৃত ব্যবহারনির্ণয়, দেবণ্ণভট্টের স্মৃতিচন্দ্রিকা এবং মাধবাচার্যের ব্যবহার-মাধবীয়ই সমধিক আদৃত।
দায়াদি বিষয়ে নারীদের অধিকারের কথা প্রাচীন নানা নিবন্ধেই আলোচিত হইয়াছে। তবে ব্যবহার নির্ণয় এই বিষয়ে যেমন উদারভাবে দেখিয়াছেন তেমন সকলে দেখেন নাই। পূর্বপূর্ববর্তী শাস্ত্রকারদের এই বিষয়ে কোনো সংকীর্ণতা থাকিলেও তিনি তাঁহার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের বলে সেই সব নিরসন করিয়াছেন। তাঁহার মতামত অতিশয় স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল। কাজেই নারীদের দায়বিচারে এই গ্রন্থখানির ভালোরূপ আলোচনা প্রয়োজন।
দক্ষিণদেশে এই গ্রন্থের প্রভূত সমাদর। সপ্তদশ শতাব্দীতে মালয়ালম্ দেশে ব্যবহার-মালা নামে ইহার একটি সংক্ষিপ্তসার রচিত হইয়াছিল। তাঞ্জোরাধিপতি মহারাজা সরফোজীর (১৭৯৮-১৮৩৩) নামে সংকলিত ব্যবহার-প্রকাশের মূলভিত্তি ও বরদারাজ-কৃত ব্যবহারনির্ণয়। পরব্রহ্মশাস্ত্রীর ব্যবহারদর্পণও এই ব্যবহারনির্ণয়েরই সংক্ষিপ্ত-রূপ। এইসবই বরদরাজ-কৃত গ্রন্থের সমাদরের প্রমাণ।
মীমাংসা ও ন্যায়শাস্ত্রে বরদরাজের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁহার যুক্তি ও বিচারও ছিল খুব গভীর অথচ স্বাধীন। তাঁহার বুঝিবার ও বুঝাইবার রীতি অনন্যসাধারণ। ‘ব্যবহার-মাতৃকা’ ও ব্যবহারের বিষয়ে আইনের মূলনীতি ও আইনের বিধি সম্বন্ধে তিনি খুব বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছেন। ব্যবহার বিষয়ে তাঁহার ব্যবহারনির্ণয় গ্রন্থখানি স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণ। এই গ্রন্থে বিদ্যা ফলাইবার চেষ্টা একটুও দেখা যায় না। সহজ ও অসংদিগ্ধ ভাষায় সোজাসুজি মতামত ও সিদ্ধান্তগুলি দেখাইতে বরদরাজের আগ্রহ। মাধবীয় গ্রন্থে এই গুণটি দুর্লভ। বিজ্ঞানেশ্বরের মিতাক্ষরার উপর বরদরাজের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি মিতাক্ষরাকে অনুসরণ করিলেও মিতাক্ষরা বরদারাজ-চরিত ব্যবহারনির্ণয়ের মত প্রাঞ্জল নহে। অনেক সময় মিতাক্ষরার বিপুল বিচারজালের মধ্যে আসল কথাটিই চাপা পড়িয়া যায়।
মনু ও বৃহস্পতির স্মৃতির উপর বরদরাজ বেশি নির্ভর করিয়াছেন। শাস্ত্রের উপর নির্ভর করিলেও তিনি যুক্তিকে কোথাও উপেক্ষা করেন নাই। তাই গ্রন্থারম্ভশ্লোকেই তিনি বলিয়াছেন, যুক্তি ও স্মৃতির সহায়তায় আমরা নির্ণয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছি—
নির্ণয়ঃ ক্রিয়তেঽস্মাভির্যুক্তিস্মৃত্যনুরোধতঃ।
অথচ স্মৃতিচন্দ্রিকার দেবণ্ণভট্ট বলেন, সবই আমার শাস্ত্রানুসারে লেখা, নিজের মতামত তাহাতে কিছুই ফলাই নাই (সংস্কার কাণ্ড, দ্বিতীয় শ্লোক)। যুক্তি বাদ দিয়া শুধু শাস্ত্র আশ্রয় করিয়া বিচার করিতে গেলে ধর্মহানি হয় ইহাই বৃহস্পতির মত। এই মতের সঙ্গে বরদরাজের মনের মিল থাকায় তিনি বৃহস্পতির এই বাণীটি উদ্ধৃত করিয়াছেন—
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যোঽর্থনির্ণয়ঃ। পূঃ ১৩৯
সবর্ণা ও অসবর্ণা পত্নীতে জাত সন্তানদের উত্তরাধিকারের বিষয়ে অনেক শাস্ত্রকারের ব্যবস্থায় বৈষম্য আছে। বরদরাজ এইসব স্থলেও যাহাতে দায়বৈষম্য না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখিয়াছেন। সুবিচারের দিকে তাঁহার সাবধান দৃষ্টি ছিল—
ন হি ভিন্নজাতীয়স্ত্রীষু জাতানাং ভ্রাতৃণাং সবর্ণাষু জাতানাম্, একজাতীয়ত্বান্ ন তত্র দায়বৈষম্যমিতি। ব্যবহারনির্ণয়, দায়বিভাগকাণ্ড, পৃ ৪২৫
দেখা গেল, বরদরাজের সময়েও অসবর্ণা কন্যাকে বিবাহ করা বন্ধ হইয়া যায় নাই। এবং তখনও অসবর্ণা স্ত্রীর সন্তানেরা সবর্ণা স্ত্রীর সন্তানেরই একজাতি হইতেন।
বিষ্ণু বলেন, সবর্ণা ভার্যার সংখ্যা অনেক হইলে জ্যেষ্ঠার সঙ্গে ধর্মকার্য করিবে। নানাজাতীয়া ভার্যা থাকিলে কনিষ্ঠা হইলেও সমানবর্ণা ভার্যার সহিত ধর্মকার্য করণীয়। সমানবর্ণা ভার্যার অভাবে ‘অনন্তরা’ অর্থাৎ তাহার পর নিম্ন বর্ণের ভার্যাকে লইয়া ধর্মকার্য করিবে। তবে শূদ্রা ভার্যাকে লইয়া দ্বিজ ধর্মকার্য করিবে না—
সবর্ণাষু বহ্বীষু ভার্যাষু বিদ্যমানাসু জ্যেষ্ঠয়ৈব সহ ধর্মকার্যং কুর্যাৎ। মিশ্রাসু চ কনিষ্ঠয়া অপি সমানবর্ণয়া। সমানবর্ণাভাবে ত্বনন্তরয়া। ন ত্বেব দ্বিজঃ শূদ্রয়া। ঐ, সম্ভুয়সমুত্থানাদি দশপদ কাণ্ডম্, পৃ ৩৯৭
বরদরাজ উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন যে, নারদের মতে পিতার দিকে সপ্তম ও মাতার দিকে পঞ্চম ব্যবধান না হইলে সগোত্রা ও সমানপ্রবরা কন্যা বিবাহ করা চলিবে না—
আসপ্তমাৎ পঞ্চমাচ্চ বন্ধুভ্যঃ পিতৃমাতৃতঃ।
অবিবাহ্যাঃ সগোত্রাশ্চ সমানপ্রবরাস্তথা। ঐ পৃ ৩৭৬
যাজ্ঞবল্ক্য হইতে এই মত তিনি উদ্ধৃত করিয়াছেন,—
পঞ্চমাৎ সপ্তমাদূর্দ্ধং মাতৃতঃ পিতৃতস্তথা। ঐ
বসিষ্ঠ হইতেও উদ্ধৃত করিতেছেন,—
পঞ্চমীং মাতৃবন্ধুভ্যঃ সপ্তমীং পিতৃবন্ধুভ্যঃ। ঐ
কণ্ব বলেন, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মাতার দিকে তৃতীয় এবং পিতার দিকে পঞ্চম হইলেই কন্যাকে বিবাহ করা যায়—
তৃতীয়াৎ ক্ষত্রিয়ো মাতুঃ পঞ্চমাৎ পিতৃতঃ পরাম্। ঐ
ব্যবহারনির্ণয় তাই বলেন, কণ্বের এই বচনবলে মাতার দিকে তৃতীয়া ও পিতার দিকে পঞ্চমী বিবাহের কথা যে পৈঠঈনসি বলিয়া গিয়াছেন তাহা ক্ষত্রিয়াদির পক্ষেই প্রযোজ্য—
এতৎ কণ্ববচনবলাৎ মাতৃতস্তৃতীয়াং পিতৃতঃ পঞ্চমীমিতি পৌঠীনসিবচনং ক্ষত্রিয়াদিবিষয়ং দ্রষ্টব্যম্। ঐ
তাহার পর সুমন্তুর মত দিয়াছেন— পাঁচ ও সাত পুরুষ ব্যবধান না থাকিলে কন্যা বিবাহযোগ্যা হয় না—
কন্যা আপঞ্চমাদাসপ্তমাচ্চাবিবাহ্যা ভবন্তি। ঐ
যে কন্যাকে পণ দিয়া সংগ্রহ করা হইয়াছে তাহাকে পত্নী না বলিয়া দাসীই বলা উচিত। যমস্মৃতি বলেন, পণক্রীতা কন্যা দৈব ও পিত্র্যকর্মের অযোগ্য, কারণ সে দারা বলিয়া অভিহিত হইলেও দাসীমাত্র, যে হেতু পণ দিয়া তাহাকে আনা হইয়াছে—
ক্রয়ক্রীতা তু যা কন্যা ন সা পত্নী বিধিয়তে।
তথা দৈবে চ পিত্র্যে চ দাসী বা পারসংজ্ঞিতা। পৃ ৩৯৮
এই হিসাবে পণের দ্বারা সংগৃহীত বরও দাস মাত্র। যদিও তাহাকে লোকে বরই বলে, তবু আসলে সে পণক্রীত দাস বই আর কিছুই তো নহে।
মনুর বিধি উদ্ধৃত করিয়া বরদরাজও বলেন, কন্যা ঋতুমতী হইয়া আমরণ ঘরে থাকিলেও গুণহীন বরকে সম্প্রদান করিবে না—
কামমারণাতিষ্ঠেদ্ গৃহে কন্যর্তুমত্যপি।
ন চৈবৈনাং প্রয়চ্ছেৎতু গুণহীনায় কহির্চিৎ। পৃ ৩৮৯
বয়ঃপ্রাপ্তা কন্যা ঋতুমতী হইয়া তিন বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। ইহার মধ্যে যদি গুরুজনেরা বিবাহের ব্যবস্থা না করেন তবে কন্যা উপযুক্ত পতিকে নিজেই বরণ করিবে। এই বিধিও তাঁহার মনু হইতে উদ্ধৃত—
ত্রীণি বর্ষাণ্যুপাসীত কুমার্যৃতুমতী সতী।
উর্দ্ধ্ং তু কালাদেতস্মাদ্ বিন্দেত সদৃশং পতিম্॥ পৃঃ ৩৮৫
এখানে এমন অনেক কথার প্রসঙ্গ-বশে পুনরুক্তি করিতে হইবে যাহা পূর্বে বলা হইয়াছে।
দীর্ঘরোগা, কুৎসিতরোগা, আর্তা, বিকলাঙ্গা, অঙ্গহীনা, ধৃষ্টা, অন্যের কাছে যদি তাহার মন বা দেহ নিবেদিত হইয়া থাকে তবে সেই কন্যা দোষযুক্তা। এরূপ কন্যাকে বিবাহ করা অনুচিত—
দীর্ঘকুৎসিতরোগার্তা ব্যঙ্গা সংসৃষ্টমৈথুনা।
ধৃষ্টান্যগতভাবাশ্চ কন্যাদোষাঃ প্রকীর্তিতাঃ॥[১]
স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধের পূর্বেই বরকে কন্যার বরণ করা উচিত—
স্ত্রীপুংসয়োশ্চ সম্বন্ধাৎ বরণং প্রাগ্বিধীয়তে॥[২]
বরণের যোগ্য না হইলে আর বর কিসের? তাই বর যেন যুবা ধীমান এবং জনপ্রিয় হয়। তাহা হইলেও তাহার পুরুষত্ব যথাযথ আছে কি না তাহা যত্ন পূর্বক পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত,—
যত্নাৎ পরীক্ষিতঃ পুংস্ত্বে যুবা ধীমান্ জনপ্রিয়ঃ।[৩]
এই বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের মত উদ্ধৃত করিয়াই বরদরাজ ক্ষান্ত হন নাই। তিনি নারদের মতও উদ্ধৃত করিয়া বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাইয়াছেন। নারদ আরও বলেন, স্বীয় দৈহিক লক্ষণের পরীক্ষায় যদি পুরুষের পুংস্থ সিদ্ধ হয়, সকল সন্দেহ নিরসন হইয়া যদি তাহার পুরুষত্ব নিশ্চিত হয় তবেই সে কন্যা লাভ করিতে পারে—
পরীক্ষ্য পুরুষং পুংস্ত্বে নিজেরেবাঙ্গলক্ষণৈঃ।
পুমাংশ্চেদবিকল্পেন স কন্যাং লব্ধুমর্হতি॥[৪]
তাহার পর নারদ পুরুষলক্ষণ ও ক্লীবলক্ষণ সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন।
ক্লীবত্ব বহুবিধ। অনেক ক্ষেত্রে তাহা দুঃসাধ্য। মানসিক বা ভাবনাগত ক্লীবত্বের প্রতীকার সম্ভব। তবে তাহার প্রতিকার একটু সময়সাধ্য। নানাবিধ ক্লীবত্বের আলোচনা বরদরাজ করিয়াছেন (পৃ ৩৭৯-৩৮১)। এই বিষয়ে যাঁহারা অনুসন্ধিৎসু তাঁহারা মূলগ্রন্থ পড়িয়া দেখিতে পারেন।
ক্লীবত্ব নানাবিধ। কোনো ক্লীবত্ব স্থানবিশেষে, কোনোটা বা কালবিশেষে, কোনোটা বা পাত্রবিশেষে ধরা পড়ে। বিবাহের পরে স্ত্রীসঙ্গম হইবার পরেও যদি ক্লীবত্ব ধরা পড়ে, অর্থাৎ পতির পুরুষত্ব ঠিকমত নাই ইহা বুঝা যায়, তবে ভার্যা সঙ্গতা হইলেও পতিত পতির মত ভর্তাকে ত্যাগ করা চলে। নারদের এই মত ব্যবহারনির্ণয় উদ্ধৃত করিয়াছেন—
সংত্যক্তব্যাঃ পতিতবৎ ক্ষতযোন্যা অপি স্ত্রিয়া। পৃ ৩৮১
ক্ষতযোনিরই যদি পুনরায় বিবাহ দিবার ব্যবস্থা নারদ দিয়া থাকেন তবে যে কন্যার মাত্র বরণ ও পাণিগ্রহণ হইয়াছে তাহার বিষয়ে আর কথা কি। তাই বরদরাজ বলেন—
কিমুতাক্ষতযোন্যা বরণপাণিগ্রহণমাত্রায়াঃ। পৃ ৩৮১
ইহার পাদটীকাতে (নারদীয় মনুসংহিতা, ১২৮ পৃষ্ঠা) দেখা যায়— ক্ষতযোন্যা অপি, কিমুতাক্ষতযোন্যা বরণপাণিগ্রহণমাত্রেণ। পৃ ৩৮১ কোনো কোনো ক্লীবত্বে একপক্ষ বা একমাস পরীক্ষা করিলেই চলে, কোথাও কোথাও সংবৎসর দেখিতে হয়। নারদ বলেন, ইহাতেও প্রতিকার না হইলে তাহাকে ত্যাগই করিতে হইবে—
তত্রাদ্যাবপ্রতীকারৌ পক্ষাথ্যো মাসমাচরেৎ।
অনুক্রমাৎ ত্রয়স্যাস্য কালঃ সংবৎসরঃ স্মৃতঃ। পৃ ৩৮০
নারদ আরও বলেন, যদি পতির বীর্য শক্তিহীন হয় এবং তাহার প্রতিকার হইবার উপায় না থাকে তবে এক বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া নারী অন্য পতিকে বিবাহ করিবে—
আক্ষিপ্তে মোঘবীজে চ পত্যাবপ্রতিকর্মণি।
পতিরন্যঃ স্মৃতো নার্যা বৎসরং সংপ্রতীক্ষ্য তু। পৃ ৩৮১
আর-একটি বিধানও এখানে ব্যবহারনির্ণয় উদ্ধৃত করিয়াছেন (নারদীয় মনুসংহিতা, পৃ ১২৮)। পরস্ত্রীর নিকট পুরুষ হইলেও নিজের পত্নীতে যদি কেহ পুরুষত্বহীন হয় তবে তাহার স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করিতে পারে। কারণ প্রজাপতির এই বিধান—
অন্যস্যাং যো মনুষ্যঃ স্যাদমনুষ্যঃ স্বঘোষিত।
লভেত সাঽন্যং ভর্তারমেতৎ কার্যং প্রজাপতেঃ॥ পৃ ৩৮১
নারদীয় মনুসংহিতায় আরও দেখা যায় (১২, ১৯; পৃ ১২৮), নারী হইল ক্ষেত্র, পুরুষ হইল বীজবান্ বা বীজী। বীজ যাহার আছে ক্ষেত্র সেই পাইতে পারে। অবীজী ক্ষেত্র পাইবে কেন? তাই যদি পতি বীজহীন হয়, তবে পিতা স্বয়ং আবার সেই কন্যাকে অন্য বরের কাছে সম্প্রদান করিবেন, পিতার অনুমতিতে মাতাও দান করিতে পারেন। প্রয়োজন হইলে মাতামহ, মাতুল, সকুল্য বা বান্ধব যেকেহ কন্যাকে এইরূপ ক্ষেত্রে দান করিতে পারেন। ইহারা কেহ না থাকিলে মাতাই দিবেন। মাতা যদি অপ্রকৃতিস্থা হন তবে যে-কোনো স্বজাতি এই সম্প্রদান করিতে পারেন—
অপত্যার্থে স্ত্রিয়ঃ সৃষ্টাঃ স্ত্রী ক্ষেত্রং বীজবান্ পুমান্।
ক্ষেত্রং বীজবতে দেয়ং নাবীজী ক্ষেত্রমর্হতি।
পিতা দদ্যাৎ স্বয়ং কন্যাং মাতা বানুমতে পিতুঃ।
মাতামহো মাতুলশ্চ সকুল্যা বান্ধবাস্তথা।
মাতাভাবে তু সর্বেষাং প্রকৃতৌ যদি বর্ততে।
তস্যামপ্রকৃতিস্থায়াং দদ্যুঃ কন্যাঃ সজাতয়ঃ। পৃ ৩৮২
কাত্যায়ন বলেন, ঘটনাক্রমে বর যদি অন্যজাতীয়, পতিত বা ক্লীব হয়, বর যদি পাপাসক্ত, সগোত্র, চিররোগী, দুঃসাধ্যরোগী হয়, ভর্তা যদি পৌরুষলক্ষণহীন ক্লীব হয়, তবে বিবাহিত হইলেও কন্যাকে সর্বাভরণভূষণা করিয়া যোগ্য অন্য বরের কাছে সম্প্রদান করিতে হইবে। এখানে ‘উঢ়া’ পদ ব্যবহারের দ্বারা কাত্যায়ন বুঝাইয়াছেন যে, কন্যার যদি বিবাহ-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইয়া থাকে তবুও সেই বিবাহ অসিদ্ধ হইবে এবং বিবাহিতা হইলেও সর্বাভরণভূষণা করিয়া কন্যাকে যোগ্য বরের কাছে পুনরায় যথাবিধি সম্প্রদান করিতে হইবে—
স চ যদ্ অন্যজাতীয়ঃ পতিতঃ ক্লীব এব বা।
বিকর্মস্থঃ সগোত্রো বা দীর্ঘতীব্রাময়োঽপি বা।
ক্লীবোহন্যো যদি বা ভর্তা বিসৃষ্টঃ পুংস্ত্বকারণৈঃ।
উঢ়াঽপি দেয়া সাহন্যস্মৈ সর্বাভরণভূষণা॥ পৃ ৩৮৭-৩৮৮
যদি কন্যার শুল্ক ও স্ত্রীধন দিয়া কোনো বর দেশান্তরে চলিয়া যায়, তবে এক বৎসর তাহার জন্য প্রতীক্ষা করা যায়। তাহার পর যথাবিধানে সেই কন্যাকে অন্য বরের কাছে দান করা উচিত। যদি বরের সংবাদাদি আসে তবে তিন বৎসর পর্যন্ত প্রতীক্ষা করা চলে। তাহার পর অন্যের কাছে ইচ্ছানুসারে কন্যাকে বিবাহ দিতে হইবে। কাত্যায়নের এই মত ব্যবহারনির্ণয় সমর্থন করিয়া উদ্ধৃত করিয়াছে—
প্রদায় শুল্কং গচ্ছেদ্ যঃ কন্যায়াঃ স্ত্রীধনং তথা।
ধার্য্যা সা বর্ষমেকং তু দেয়াঽন্যস্মৈ বিধানতঃ॥
অথ প্রবৃত্তিরাগচ্ছেৎ প্রতীক্ষেত সমাত্রয়ম্।
অথ উর্দ্ধং প্রদাতব্যা কন্যাঽন্যস্মৈ যথেচ্ছয়া। গৃ ৩৮
নারদ বলেন, কন্যা এইরূপ স্থলে তিন ঋতু প্রতীক্ষা করিয়াই অন্যবরকে বরণ করিতে পারে। নারদের এই বাণীও উদ্ধৃত হইয়াছে—
প্রতিগৃহ্য তু যা কন্যাং বরো দেশান্তরং ব্রজেৎ।
ত্রীনৃতুন সমতিক্রম্য কন্যাঽন্যং বরয়েদ্বরম্। পৃ ৩৮৫
যাজ্ঞবল্ক্যও বলেন যদি কোনো বর বিবাহ করিয়াই দেশান্তরে চলিয়া যায়, তবে সেই প্রণষ্ট পুরুষের জন্য কন্যা তিনটি ঋতুকাল অপেক্ষা করিয়া অন্যবরকে বরণ করিবে—
বরয়িত্বা বরঃ কশ্চিৎ প্রণশ্যেৎ পুরুষো যদা।
রক্তাগমাংস্ত্রীনতীত্য কন্যাঽন্যং বরয়েদ্বরম্। পৃ ৩৮৬
আপন দোষ লুকাইয়া যদি কেহ কন্যালাভ করে তবে বরেরই দত্তধন নষ্ট নয়। সেই কন্যাকে আবার পিতার কাছে ফিরাইয়া আনা চলে। কাত্যায়নের মতে এমন স্থলে কন্যাকে আবার কুমারীর মতই বিবাহ দেওয়া সংগত হয়—
গৃহয়িত্বাঽত্মনো দোষান্ বিন্দতে কন্যকাং যদি।
বরস্য দত্তনাশঃ স্যাৎ কন্যা চাপি নিবর্ত্ততে। পৃ ৩৮৮
কন্যার জন্য শুল্ক পাইবার পরে যদি আরও ভালো বর আসে, তবে নারদের মতে, পরে-আগত ভালো বরের কাছেই কন্যাকে বিবাহ দেওয়া উচিত—
কন্যায়াং প্রাপ্ত শুল্কায়াং শ্রেয়াংশ্চেদ্বর আব্রজেৎ
ধর্মার্থকামসংযুক্তং বাচ্যং তত্রানৃতং ভবেৎ॥
পূর্বদত্তামপি শ্রেয়সে দাতুং হরেদিতি। পৃ ৩৮৬
বরদরাজও বলেন, পূর্বদত্তা হইলেও আরও ভালো বর পাইলে তাহাকেই কন্যা দিবে। যাজ্ঞবল্ক্যও এইমত সমর্থন করেন—
দত্তামপি হরেৎ পূর্বাং শ্রেয়াংশ্চেদ্বর আব্রজেৎ। ঐ
যাজ্ঞবল্ক্য বলেন সেইরূপ কারণছাড়া বাগ্দত্তা কন্যাকে ফিরাইয়া নিলে পিতা বা গুরুজন দণ্ডনীয় হইবেন। বরদরাজও বলেন, বিলক্ষণপুরুষাভাবে কন্যা ফিরাইয়া নিলে দণ্ড্য হইবে—
বিলক্ষণপুরুষাভাবে হরন্ দণ্ডঃ। ঐ
বাগ্দানের পর বা উদকপূর্বদানের পর যদি বর মারা যায়, কন্যা যদি মন্ত্রোপনীতা না হইয়া থাকে তবে তো পুনরায় বিবাহের সম্বন্ধে কোনো সংশয় বা প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কারণ তখনও সে কুমারী এবং পিতারই সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অধিকার। বসিষ্ঠের এই মত ব্যবহারনির্ণয় উদ্ধৃত করিয়াছেন—
অদ্ভির্বাচা চ দত্তায়াঃ ম্রিয়েতোর্দ্ধং বরো যদি।
ন চ মন্ত্রোপনীতা স্যাৎ কুমারী পিতুরেব সা। ঐ
বসিষ্ঠ আরও বলেন, বলপূর্বক কেহ যদি কন্যাকে হরণ করে এবং কন্যা যদি মন্ত্র-সংস্কৃতা না হয় তবে যোগ্য অন্য বরের কাছে তাহাকে বিধি-অনুসারে দিবে, কারণ অন্য অন্য কন্যাও যেমন সেও তেমনি—
বলাচ্চেৎ প্রহৃতা কন্যা মন্ত্রৈর্যদি ন সংস্কৃতা।
অন্যস্মৈ বিধিবদ্দেয়া যথা কন্যা তথৈব সা। পৃ ৩৮৭
বসিষ্ঠের আর-একটি বিধানও ব্যবহার নির্ণয় উদ্ধৃত করিয়াছেন, কন্যার জন্য শুল্ক পাইবার পর যদি শুল্কদাতা বর মরিয়া যায় তবে কন্যার সম্মতি থাকিলে দেবরের নিকট তাহাকে সম্প্রদান করিবে—
কন্যায়াং প্রাপ্তশুল্কায়াং ম্রিয়েত যদি শুল্কদঃ।
দেবরায় প্রদাতব্যা যদি কন্যাঽনুমন্যতে॥ ঐ
পাণিগ্রহণিকা মন্ত্রা নিয়তং দারলক্ষণম্
তেষাং নিষ্ঠা তু বিজ্ঞেয়া বিদ্বদ্ভিঃ সপ্তমে পদে। পৃঃ ৩৮৬
উদ্ধৃত যম বচনেও এই মতেরই সমর্থন মেলে। উদকপূর্ব দানে বা বাগ্দানে কন্যার পতিত্ব লাভ করা যায় না। পাণিগ্রহণ সংস্কারের সপ্তপদীর সপ্তম পদে পতিত্ব সিদ্ধ হয়—
নোদকেন ন বাচা চ কন্যায়াঃ পতিবিয়তে।
পাণিগ্রহণসংস্কারাৎ পতিত্বং সপ্তমে পদে॥ পৃ ৩৮৭
এই বিষয়ে কাত্যায়নে ও মনুতে (৯.৯৭) ইহার চেয়েও একটু উদার বিধি আছে, তাহাও ব্যবহারনির্ণয় উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেই কন্যার সঙ্গে যদি পতির দৈহিক সম্বন্ধ না হইয়া থাকে, কন্যা যদি পতির গৃহে গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া থাকে তবে পৌনর্ভব ভর্তার সঙ্গে পুনরায় তাহার বিবাহসংস্কার হইতে পারে—
সা চেদক্ষতযোনিঃ স্যাদ্ গতপ্রত্যাগতাঽপি বা।
পৌনর্ভবেন ভর্ত্রা সা পুনঃ সংস্কারমর্হতি॥ ঐ
শাতাতপেরও এই মতটি উদ্ধৃত হইয়াছে, কন্যা উদ্বাহিত হইলেও যদি মৈথুন না ঘটিয়া থাকে তবে পুনরায় সে পত্যন্তরে বিবাহিত হইতে পারে। কারণ অন্যান্য কুমারীকন্যার সঙ্গে তাহার তো কোনো ভেদই নাই—
উদ্বাহিতা তু যা কন্যা সংপ্রাপ্তা ন চ মৈথুনম্।
ভর্তারং পুনরভ্যেতি যথা কন্যা তথৈব সা। ঐ
স্বামী যদি বিদেশে চলিয়া যায় বা নিরুদ্দেশ হইয়া যায় তবে নারীর পক্ষে আজীবন তাহার জন্য প্রতীক্ষা করার মধ্যে কোনো যুক্তি নাই। প্রোষিতের প্রতীক্ষাকাল হারীত নির্দেশ করিয়াছেন।[৫]
ধর্মহেতু প্রোষিত হইলে আটবৎসর প্রতীক্ষা করা উচিত। বিদ্যা বা যশোলাভের জন্য গিয়া থাকিলে ছয় বৎসর, এবং কামার্থ হইলে তিন বৎসর—
প্রোষিতো ধর্মহেতোস্তু প্রতীক্ষ্যেঽষ্টৌ নরঃ সমাঃ।
বিদ্যার্থং ষড়্যশোহর্থং বা কামার্থংস্ত্রীংস্তু বৎসরান্॥ পৃ ৩৯৪
কাত্যায়ন বলেন, স্বামী প্রোষিত হইলে পিতা ছয় বৎসর পত্যন্তরের সহিত যুক্ত করিবেন না।
পিত্রা ভর্তা ন যোজ্যাস্ত্রী ষড়্বর্ষং প্রোষিতে প্রভৌ। ঐ
গৌতমও বলেন, স্বামী নিরুদ্দেশ হইলে ছয়বৎসর প্রতীক্ষা, খবর পাওয়া গেলে সেখানে যাওয়া, প্রব্রজিত হইলে প্রসঙ্গবশেই নিবৃত্তি অর্থাৎ পূর্ব বিবাহ নিবৃত্ত হইবে। ব্রাহ্মণ বিদ্যা-হেতু বিদেশে গেলে দ্বাদশ বৎসর পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিবে—
নষ্টে ভর্তরি ষড়্বার্ষিকং ক্ষপণম্। শ্রূয়মাণে অভিগমনম্। প্রব্রজিতে তু নিবৃত্তিঃ প্রসঙ্গাৎ। দ্বাদশবর্ষাণি ব্রাহ্মণ্য বিদ্যাসম্বন্ধে। পৃ ৩৯৪
যমস্মৃতি বলেন, স্বামী যদি স্ত্রীকে লইয়া ঘর না করে তবে ব্রাহ্মণ-স্ত্রী দশ বারো বা আটবৎসর প্রতীক্ষা করিবে, ইহাই মনুর মত। ক্ষত্রিয়া আট বৎসর, বৈশ্য ছয় বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। শূদ্রের পক্ষে কোনো কাল-বাধা নাই। প্রতীক্ষা না করিলে তাহাদের ধর্মব্যতিক্রিয়া হয় না—
ন শূদ্রায়াঃ স্মৃতঃ কালো ন চ ধর্মব্যতিক্রিয়া। পৃ ৩৯৫
নারদ বলেন, বিশেষষতঃ অপ্রসূতার পক্ষে সংবৎসরপরা স্থিতি অর্থাৎ এক বৎসরই প্রতীক্ষা কাল।
বিশেষতোঽপ্রসূতায়াং সংবৎসরপরা স্থিতিঃ। পৃ ৩৯৫
স্বামীও কোনো কোনো স্থলে ভার্যা পরিত্যাগ করিতে পারেন তাহার ব্যবস্থা ইহার পরে বরদরাজ দিয়াছেন।
নানাভাবে সংগ্রহ করিয়া নারীদের নষ্ট করা যে কত বড় অপরাধ তাহা দেখাইবার জন্য ব্যবহারনির্ণয় ‘স্ত্রীসংগ্রহ’ নামে একটি আগাগোড়া প্রকরণ দিয়াছেন। তাহাতে সুন্দর বিচার ও বিধান দেওয়া আছে (পৃ ৩৯৮—৪০৫)। যিনি জানিতে উৎসুক তিনি প্রমাণাদিসহ মূল গ্রন্থে তাহা দেখিতে পারেন। দাসী ক্রীতদাসী বা বেশ্যারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাতে গমন করিলে পুরুষ দণ্ডনীয় (ব্যবহার নির্ণয়, পৃ ৪০৩)। অন্যায়ভাবে নারীসংগ্রহকারীদের প্রতি দণ্ডবিধিও ভাল করিয়া আলোচিত হইয়াছে। তবে কুমারী কন্যা যদি কাহাকেও মনে মনে প্রার্থনা করে তবে সেই কন্যাকে হরণ করিলে চুরি হয় না, ইহা যমস্মৃতির বিধান। কিন্তু সেই কন্যা যেন অলংকৃতা না হয়—
কন্যাহরণমস্তেয়ং যাঽবরা যাহনলংকৃতা। পৃ ৫১৫
এখানে বরদরাজ বলেন, সেই কন্যাকে যদি অন্য কাহারও সঙ্গে বিবাহ দিবার উদ্দেশ্যে অলংকৃতা করা হয় তবে তাহাকে হরণ করিবে না—
অন্যস্মৈ দাতুমলংকৃতাং নাহরেৎ। ঐ
মনু বলেন (৯. ৯২), কন্যা স্বয়ম্বরা হইলে পিতার মাতার বা ভ্রাতার প্রদত্ত অলংকার ধারণ করিবে না। এমন ভাবে অলংকার লইলে তাহা চুরি হইবে—
অলংকারঃ নাদদীত পিত্র্যং কন্যা স্বয়ংবরা।
মাতৃকং ভ্রাতৃদত্তং বা স্তেয়ংস্যাদ্ যদি তং হরেৎ। পৃ ৩৮৫
মনুর মতেও প্রাপ্ত-ঋতু ইচ্ছুক কন্যাকে হরণ করিলে পিতাকে কিছু শুল্ক দিবার প্রয়োজন নাই—
পিত্রে ন দদ্যাচ্ছুল্কং তু কন্যামৃতুমতীং হরন্। ঐ
নারদ বলেন, বিনা অপরাধে ভার্যাকে ত্যাগ করিলে রাজা তাহাকে কঠিন দণ্ড দিবেন—
অনুকুলামবাগ্দুষ্টাং দক্ষাং সাধ্বীং প্রজাবতীম্।
ত্যজন্ ভার্যামবস্থাপ্যো রাজা দণ্ডেন ভূয়সা। পৃ ৩৯৭
এমন অবস্থায় কে তাহাকে আশ্রয় দিবে, কে তাহার ভরণপোষণ করিবে?
নারদ বলেন, অপুত্রা নারী বিধবা হইলে পতিকূলের লোকেরা তাহার আশ্রয়, তদভাবে পিতৃকুলে তাহার আশ্রয়, তাহাও না থাকিলে তাহার ভরণ এবং চালনার ভার রাজার উপর (পৃ ৩৯১)। যাজ্ঞবল্ক্যমতে, বিশেষ হেতু না থাকিলে পতিপুত্রের ঋণে নারী দায়ী থাকিবে না, পুত্রের ঋণেও পিতা দায়ী হইবে না (পৃ ২৬০)। ব্যবহারনির্ণয় এই সব মত ভাল মনে করিয়াছেন তাই উদ্ধৃত করিয়াছেন।