প্রাচীন ভারতে নারী/স্ত্রীধন

উইকিসংকলন থেকে

স্ত্রীধন

 সম্পত্তির অধিকার-প্রকরণে এই বিষয়ে কিছু বলা হইয়া থাকিলেও পুনরায় প্রয়োজনবশতঃ স্ত্রীধনের কথা আর-একটু বিশদভাবে বলিতে হইতেছে।

 স্ত্রীধনের কথা বলিতে গিয়াও শাস্ত্রকারেরা বেশ স্পষ্টভাবেই সব বিষয় আলোচনা করিয়াছেন। নারদীয়-মনুতে দেখা যায়—

অধ্যগ্নধ্যাবাহনিকং ভর্ত্তৃদায়স্তথৈব চ।
ভ্রাত্রা দত্তং পিতৃভ্যাং চ ষড়্‌বিধং স্ত্রীধনম্ স্মৃতম্॥ ১৩.৮

এই শ্লোকটি পারিভাষিক শব্দে পূর্ণ হওয়ায় ভাষ্যকার গোবিন্দস্বামীর ভাষ্যানুবাদ দেওয়া যাইতেছে—

 ‘বিবাহকালে দত্ত, কাহারও মতে স্বামী প্রভৃতির দ্বারা জ্ঞাতিকুলে পুনরায় আসিবার সময়ে দত্ত, অন্যদের মতে স্বগৃহে আনয়নকালে দত্ত, স্বামী খুশি হইয়া পরে যাহা দেন, ভাই-পিতা-মাতা যাহা দেন এই ছয় প্রকার যে স্ত্রীধনের কথা লোকে বলে এইখানে তাহাতে সম্মতি দেওয়া যাইতেছে। ইহা স্মৃতিশাস্ত্রসম্মত।’

 মনুসংহিতায়ও (৯. ১৯৪) এই বিধানই স্বীকৃত।

 বহু স্মৃতিতে স্ত্রীধন বিষয়ে আলোচনা আছে। বাহুল্য ভয়ে সবগুলি না দেখিয়া কৌটলীয় অর্থশাস্ত্রে স্ত্রীধনের ব্যবস্থা দেখা যাউক, কারণ অর্থশাস্ত্র হইল চলিত আইন।

 অর্থশাস্ত্রের মতে, বৃত্তি অর্থাৎ ভরণপোষণের জন্য যে ধন, এবং ‘আবন্‌ধ্য’ অর্থাৎ অলংকারাদি হইল স্ত্রীধন—

বৃত্তিরাবন্‌ধ্যং বা স্ত্রীধনম্। অর্থশাস্ত্র, গণপতি শাস্ত্রী, II, ৫৯, পৃ ১৪

সাধারণতঃ বৃত্তির জন্য দত্ত ধন হাজার পর্যন্ত হয়।

 দ্বিসহস্রের উপর বৃত্তি থাকিলে তাহা (জ্ঞাতিগণের কাছে) স্থাপ্য—

পরদ্বিসাহস্রা স্থাপ্যা বৃত্তিঃ। ঐ

 অলংকারের বিষয়ে এইরূপ কোনো নিয়ম নাই—

আবন্‌ধ্যানিয়মঃ। ঐ

 স্বামী যদি ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা না করিয়া বিদেশে যান তবে নিজের, পুত্রের ও পুত্রবধূর ভরণ-পোষণে এই স্ত্রীধন হইতে ভার্যা ব্যয় করিলে দোষ হয় না—

তদাত্মপুত্রস্নুযাভর্মণি প্রবাসাপ্রতিবিধানে চ ভার্যায়া ভোক্তুমদোষঃ। ঐ

 দস্যু প্রভৃতির আক্রমণে ব্যাধি-দুর্ভিক্ষ-ভয় প্রতিকারে এবং ধর্মকার্যে পতি যদি ইহা হইতে ব্যয় করেন তবে দোষ হয় না—

প্রতিরোধকব্যাধিদুর্ভিক্ষভয়প্রতিকারে ধর্মকার্যে চ পত্যুঃ। ঐ

 সন্তান হইবার পরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া যদি তিন বৎসর এই স্ত্রীধন হইতে ভোগ করে, তবে ব্রাহ্ম দৈব আর্য ও প্রাজাপত্য এই চতুর্বিধ ধর্মিষ্ঠ বিবাহবিধিতে পরিণীত হইয়া থাকিলে পতি বা পত্নী কাহারও অপরাধ হইবে না—

সম্ভূয় বা দম্পত্যোর্মিথুনং প্রজাতয়োস্ত্রিবর্ষোভুক্তং চ ধর্মিষ্ঠেষু বিবাহেষু নানুষুঞ্জীত। ঐ

 যদি গান্ধর্ব ও আসুর বিবাহ হইয়া থাকে এবং এমন স্থলে সুদসহ এই স্ত্রীধন পূরাইয়া দিতে হইবে—

গন্ধর্বাসুরোপভুক্তং সবৃদ্ধিকমুভয়ং দাপ্যেত। ঐ

 যদি রাক্ষস ও পৈশাচ বিধিতে বিবাহ হইয়া থাকে এবং স্ত্রীধন যদি কোনো কারণে লওয়া হয় তবে তাহাকে চুরির দায়ে দেওয়া হইবে—

রাক্ষসপৈশাচোপভুক্তং স্তেয়ং দদ্যাৎ। ঐ
ইতি বিবাহধর্মঃ। ঐ

 দেখা যাইতেছে, অর্থশাস্ত্র স্ত্রীধন সম্বন্ধে রীতিমত খুঁটিনাটি ধরিয়া অধিকার ও তাহার ব্যতিক্রমে আইনের ব্যবস্থা দেখাইয়াছেন।

 পতিবিয়োগের পরের কথা আলোচনা করিয়া অর্থশাস্ত্র বলিতেছেন, স্বামী মারা গেলে ধর্মকামা (অর্থাৎ যে নারী পত্যন্তর গ্রহণ করিতে চাহেন না) পত্নী তখনই তাহার স্থাপ্য (দ্বিসহস্র হইতে অধিক হইলে যে বৃত্তি জ্ঞাতিদের কাছে স্থাপ্য ছিল) এবং আভরণ ও বিবাহশুল্কের যদি কিছু অংশ প্রাপ্য থাকে তবে তাহা পাইবেন—

মৃতে ভর্তরি ধর্মকামা তদানীমেবাস্থাপ্যাভরণং শুল্কশেষং চ লভেত। ঐ

আইনত পাইয়াও যদি এই স্ত্রীধন তাহার তখনই হস্তগত না হয় তবে সুদ সমেত তাহাকে দিতে হইবে—

লব্ধা বাবিন্দমানা সবৃন্ধিকমুভয়ং দাপ্যেত। ঐ, পৃ ১৫

 আর যদি সেই নারী বৈধব্যব্রত পালন না করিয়া পত্যন্তর গ্রহণ করিয়া আবার ঘর করিতে চাহেন (কুটুম্বকামা), তবে বিবাহকালে শ্বশুর ও পতির দত্তধন পাইবেন—

কুটুম্বকামী তু শ্বশুরপতিদত্তং নিবেশকালে লভেত। ঐ

পুনরায় বিবাহকালের এই কথা দীর্ঘ প্রবাস-প্রকরণে ব্যাখ্যাত হইবে—

নিবেশকালং হি দীর্ঘপ্রবাসে ব্যাখ্যাস্যামঃ। ঐ

 এই দীর্ঘ প্রবাসের হেতুতে পত্যন্তর গ্রহণের কথা আমরা প্রোষিত পতির কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছি।

 শ্বশুর যাহার সহিত সেই নারীকে বিবাহিতা হইতে বলেন তাহার সহিত বিবাহ না করিয়া যদি সে অন্যত্র বিবাহ করে তবে শ্বশুরের ও পতিদত্ত ধনও তাহাকে হারাইতে হয়—

শ্বশুর প্রাতিলোম্যেন বা নিবিষ্টা শ্বশুরপতিদত্তং জীয়েত। ঐ

তবে জ্ঞাতিহস্তে অভিসৃষ্ট হইয়া থাকিলে জ্ঞাতিরা সেই নারীর কাছে যাহা পাইয়াছেন তাহা তাহাকে তখন ফিরাইয়া দিবেন—

জ্ঞাতিহস্তাদভিমৃষ্টায়া জ্ঞাতয়ো যথাগৃহীতং দদ্যুঃ। ঐ

 অর্থশাস্ত্রের স্ত্রীধন-প্রকরণেও পত্যন্তর গ্রহণ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য জানা গেল।