বত্রিশ সিংহাসন/উপক্রমণিকা

উইকিসংকলন থেকে

বত্রিশ সিংহাসন।

উপক্রমণিকা।

উজ্জয়িনী নগরে ভোজ নামে অতুল ঐশ্বর্য্য শালী অত্যন্ত পরাক্রান্ত এক রাজা ছিলেন। পরমেশ্বর তাহাকে এমত রূপ লাবণ্য সম্পন্ন ও কান্তিপুঞ্জ পরিপূর্ণ করিয়া ছিলেন যে তাহাকে দেখিয়া পূর্ণ চন্দ্রও আপনাকে হীন-কান্তি বিবেচনা করিয়া লজ্জিত হইতেন। ভোজরাজ অতি- শয় বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন এবং এমত প্রতাপান্বিত ছিলেন যে তাহার রাজ্যে ব্যাঘ্র ও ছাগ এক ঘাটে জল পান করিত। তাহার অধিকারে যথার্থ সদ্বিচার ও ন্যায়াচার ছিল, তাহাতে কেহ কাহার প্রতি অত্যাচার করিতে পারিত না। এই নিমিত্তই রাজধানী এমত জনাকীর্ণ ছিল যে তিলা মাত্র স্থান শূন্য ছিল না, তাবৎ নগর অতি অপূর্ব্ব অট্টালিকাতে সুশোভিত ছিল। পথ ঘাট সকল এমত সুন্দর ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল যে ঐ নগরকে পাশার ছক বলিয়া ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। এবং সমস্ত রাজ- পথের প্রান্তে জলপ্রণালী থাকাতে প্রজাগণের জলকষ্ট মাত্র ছিল না। প্রজারা সকলে ঐ রাজধানীতে, নানা প্রকার বাণিজ্য ব্যবসায় করিত, তাহাদের পণ্যবীথিকা সকল সকল সময়েই নানা জাতীয় দ্রব্যে সুশোভিত থাকিত এবং সকল প্রজারই গৃহ ধন ধান্যে পরিপূর্ণ ছিল, কাহার কিছুমাত্র দুঃখ ও দুরবস্থা ছিল না, অতএব নগরের কোন স্থানে নৃত্য, কোন স্থানে সংগীত, কোনস্থানে ধর্মশাস্ত্রের আলোচনা কোন স্থানে দেবার্চনা দিবারাত্রই হইত। ভোজরাজের সভাতে বহুসঙ্খক মহা মহা পণ্ডিত উপস্থিত থাকিতেন। রাজা তাহাদের বিধানানুসারে রাজ্য কার্য পর্যালোচনা করিতেন।

 এই রাজার ক্রীড়া-কাননের সান্নিধ্যে এক কৃষকের ক্ষেত্র ছিল। ক্ষেত্রপতি উহাতে সশা বপন করিয়াছিল, কিয়কাল পরে তাবৎ ক্ষেত্র সশার লতা পল্লব ও ফল ফুলে অতিসুশোভিত হইল। কেবল কতকটা ভূমিতে বীজ অঙ্কুরিত হয় নাই, ঐ স্থানে ক্ষেত্রপাল এক মঞ্চ নিৰ্মাণ করিয়া উহাতে উপবেশন পূর্ব্বক ক্ষেত্র রক্ষা করিত। কিন্তু সে যখন যখন ঐ মঞ্চে আরোহণ করিত তখনি তাহার শরীর অহঙ্কারে পরিপূর্ণ হইত। এক দিবস ক্ষেত্রপতি মঞ্চের উপর দণ্ডায়মান হইয়া চতুর্দিক দৃষ্টি করিতে করিতে কহিল অরে কে আছিস, তোর এখনি রাজা ভোজকে দুর্গ হইতে আনিয়া দণ্ড দে। দৈবায়ত্ত তৎকালে ভোজরাজের এক কিঙ্কর ঐ পথ দিয়া গমন করিতে ছিল, কৃষকের এই সাহঙ্কার বাক্য শুনিতে পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে মঞ্চ হইতে অবরোহণ করাইয়া। প্রথমতঃ তাহার মুখে চপেটাঘাত করিল, পরে কর্ণাকৰ্ষণ করিয়া একবার উঠা একবার বসা এই প্রকার শাস্তি প্রদান করিতে লাগিল। ইহাতে গর্বের মত্ততা খর্ব্ব হইলে ক্ষেত্রপাল রাজকিঙ্করের পদানত হইয়া কহিল আমি অপরাধ করিয়াছি আমাকে আর প্রহার করিও না। যে সকল পথিক এই ব্যাপার দেখিয়া তথায় দণ্ডায়মান হইয়াছিল তাহারা ক্ষেত্রপালকে কহিল তুমি যে কথা উচ্চারণ করিয়াছ রাজা তাহ। স্বকর্ণে শুনিলে তোমাকে শূল দান করিতেন। ইহা শুনিয়া ক্ষেত্রপতি লোদন করিতে লাগিল, এবং প্রাণের ভয়ে জ্ঞানশূনা ও মৃতপ্রায় হইল। পরিশেষে অনেক কাতরোক্তি ও বিনতি করাতে রাজকিঙ্কর তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিল।

 তদনন্তর ক্ষেত্রপাল যখন যখন ঐ মঞ্চে আরোহণ করিত তখনই ঐ প্রকার অহঙ্কার প্রকাশ করিত। এক দিবস রাজা চারি জন পদাতিককে কোন প্রয়াজনানুরোধে স্থানান্তরে প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহারা রাত্রিকালে ঐ পথ দিয়া প্রত্যাগমন করিতেছিল এমত সময়ে ক্ষেত্রপতি মঞ্চ হইতে বলিতে লাগিল, মন্ত্রী ও কর্ম্মকারী দিগকে ডাক, তাহারা এই স্থানে এক দুর্গ নিৰ্মাণ করিয়া যুদ্ধসজ্জা করে, আমি ভোজরাজের সহিত সংগ্রাম করিয়া তাহাকে সংহার করিব, কেননা সে আমার সপ্তম পুরুষের রাজ্য অপহরণ করিয়াছে।

 পদাতিক গণ এই কথা শুনিয়া অত্যন্ত চমৎকৃত এবং কুপিত হইল। এক জন কহিল অরে এ বেটাকে মারিয়াফেল। আর এক জন কহিল, না, ইহাকে বন্ধন করিয়া প্রহার করিতে করিতে রাজার নিকটে লইয়া চল, তিনি উচিত দণ্ড দিবেন। তৃতীয় ব্যক্তি কহিল এ ব্যক্তি মদ্যপ, মদ্যপানে মত্ত হইয়া যাহা মুখে আসিতেছে তাহা কহিতেছে। চতুর্থ ব্যক্তি কহিল যাহ। হউক পরে বুঝা যাইবে, এখন এখানে অনর্থক বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই।

 পদাতিক গণ এই প্রকার কথোপকথনের পর রাজার নিকট গিয়া অভিবাদন করিল এবং যে প্রয়োজনে প্রেবিত হইয়াছিল তাহার সমাচার কহিল। অনন্তর রাজা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন আমার রাজ্যে সকলে আনন্দে আছে কি না, এবং আমার কথা কে কি বলিয়া থাকে। তাহাতে পদাতিক গণ অন্যান্য লোকের কথা কহিয়া, ক্ষেত্রপের মুখে যাহা যাহা শুনিয়াছিল সমুদয় অবিকল বর্ণন করিয়া কহিল মহারাজ ঐ মঞ্চের কি চমৎকার গুণ, ক্ষেত্রপ যখন তাহাতে আরোহণ করে তখনি তাহার মত্ততা জন্মে, তাহা হইতে অবরোহণ করিলে আর সে মত্ততা থাকে না স্বাভাবিক বুদ্ধি উপস্থিত হয়। রাজা মনে মনে আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া বলিলেন। তোমরা আমাকে ঐ স্থানে লইয়া চল, আমি ঐ ব্যক্তিকে দেখিব। ইহা বলিয়া পদাতিক গণ সমভিব্যাহারে ঐ স্থানে গিয়া প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকিলেন। কিয়ৎ কাল পরে ক্ষেত্রপ মঞ্চারোহণ করিতে করিতে বলিতে লাগিল,এখনি তোমরা যাইয়া ভোজরাজকে বন্ধন করিয়া আন এবং তাহাকে সংহার করিয়া আমার রাজ্য উদ্ধার করিয়া দাও, তাহাতে তোমাদিগের যশঃ ও ধর্ম্ম হইবেক।

 এই কথা শুনিয়া রাজার মনে ত্রাস জন্মিল, কিন্তু কোন উত্তর না করিয়া পদাতিক গণ সমভিব্যাহারে বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন। সমস্ত রাত্রি চিন্তাতে নিদ্রা হইল না। রজনী প্রভাতা হইলে স্নান আত্নিক করণানন্তর সভারূঢ় হইয়া পণ্ডিত ও জ্যোতির্ব্বিদ গণকে ডাকাইয়া রাত্রির সমুদায় বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপন করিলেন। দৈবজ্ঞেরা গণনা করিয়া কহিলেন মহারাজ ঐ স্থানে লক্ষ্মী বিরাজমান আছেন। পণ্ডিতেরা বলিলেন ঐ স্থানে অনেক অর্থ থাকা সম্ভব। ইহা শুনিয়া রাজা নগরের তাবৎ খনক আনয়ন করাইলেন, এবং তাহাদিগকে ঐ স্থান খনন করিতে আজ্ঞা দিলেন। খনকেরা গমন করিলে পর রাজা আপন অমাত্য গণকে তথায় প্রেরণ করিলেন, এবং আপনিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। খনকেরা কতক মৃত্তিকা খনন করিলে এক খান সিংহাসনের কিয়দংশ দৃষ্ট হইল। তদবলোকনে রাজা সাবধানে মৃত্তিকা খনন করিতে বলিলেন। খনকেরা সতর্কতা পূর্ব্বক খনন করিতে লাগিল। ক্রমে সিংহাসনের চারি পায়া দৃষ্ট হইল। তখন রাজা তাহা উত্তোলন করিতে আজ্ঞা দিলেন। ন্যূনাধিক লক্ষ-সঙ্খ্যক লোক বলপূর্ব্বক সিংহাসন তুলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কোন রূপেই তাহা চালিত করিতে পারিল না। ইহাতে এক বিচক্ষণ পণ্ডিত রাজাকে কহিলেন মহারাজ এই সিংহাসন দেবনির্ম্মিত, ইহার নিকট পূজা ও বলিদান না করিলে কখন উঠিবেক না। এই কথায় রাজা কোটি কোটি মহিষ ও ছাগবলি প্রদান করিলেন, এবং চতুর্দিকে বাদ্যোদ্যম ও জয়ধ্বনি হইতে লাগিল। বলিদানাদির পর সিংহাসন অনায়াসে উঠিল।

 সিংহাসন উত্তোলিত হইলে রাজা তাহা এক উত্তম স্থানে স্থাপন করাইলেন, এবং দেখিয়া অত্যন্ত হৃষ্ট হইলেন। পরে তাহা ধৌত ও পরিস্কৃত হইলে তাহার এমত চাচক্য জন্মিল যে তাহাতে চক্ষুঃ স্থির রাখা কঠিন। যাহারা ঐ সিংহাসনের শিল্পকার্য্য দৃষ্টি করিল তাহারা পরমেশ্বরের অপার মহিমার নানা প্রশংসা করিতে লাগিল। ফলতঃ ঐ সিংহাসনে এমত শিল্পকর্ম ছিল যে তদ্রপ কেহ কখন দেখে নাই, বিশেষতঃ তাহার এক এক দিকে আট আট পুত্তলিকা এবং প্রত্যেক পুত্তলিকার হস্তে এক এক পদ্ম পুষ্প প্রস্ফুটিত ছিল। ঐ সকল পুত্তলির এমত অলৌকিক রূপলাবণ্য যে তদ্দর্শনে দেবতারাও মোহিত হয়েন। কেবল সিংহাসনের স্থানে স্থানে কোন কোন রত্ন অপসারিত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে রাজা শিল্প ব্যবসায়ী গণকে আজ্ঞা করিলেন যত অর্থের প্রয়োজন হয় তাহা লইয়া রত্নাদি ক্রয় করিয়া সিংহাসনের পুনঃসৌষ্ঠব কর। এই আজ্ঞা দিয়া রাজা গৃহে গমন করিলেন। সিংহাসনের বৈলক্ষণ শোধন হইতে লাগিল।

 পরে পাঁচ মাস অতীত হইলে সিংহাসনের পুনঃ সৌষ্ঠব হইল। তখন পুত্তলী সকল এমত রূপ ধারণ করিল যে তাহাদিগকে দেখিলে বোধ হয় না যে তাহারা। জীবনবিশিষ্ট নহে, তাহাদিগের আপাদ মস্তক সমস্ত অঙ্গই সৰ্বাঙ্গ সুন্দর, চক্ষুঃ হরিণাক্ষির ন্যায়, কটিদেশ সিংহের মধ্যদেশের ন্যায়, এবং চরণের গঠন দর্শনে এমত বোধ হইল যে তাহারা মরালগামিনী। ফলত। যাহারা তাহাদিগকে দৃষ্টি করিল ঐ সকল পুত্তলী একবারে তাহাদের চক্ষুর পুত্তলী হইল।

 ভোজরাজ মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন বুঝি পরমেশ্বর স্বহস্তে এই সমস্ত পুত্তলী নিৰ্মাণ করিয়াছেন, অথবা ইহারা ইন্দ্রের অসরাই হইবেক। এক জন পণ্ডিত সিংহাসনের এই প্রকার সৌন্দর্য্য সন্দর্শন করিয়া বলিলেন মহারাজ জীবন ও মৃত্যু পরমেশ্বরের ইচ্ছাধীন, কিন্তু মনুষ্যের কর্তব্য, জীবনাবস্থায় জীবনের তাবৎ সুখ ভোগ করে। অতএব মহারাজ অবিলম্বেই এই সিংহাসনে আরোহণ সুখ অনুভব করিয়া যথার্থ সুবিচার প্রচার পূর্বক প্রজাবর্গ প্রতিপালন করুন। ভোজরাজ কহিলেন আমি তাহাই মানস করিয়াছি, অতএব তোমরা একটা শুভ সময় ও লগ্ন স্থির কর, আমি সেই সময়ে সিংহাসনে উপবেশন করিব। ইহা শুনিয়া পণ্ডিতেরা কার্তিক মাসের এক দিবস অবধারিত করিলেন। ভোজরাজ সিংহাসনোপবেশনের উদ্যোগ করিয়া রাজ্যস্থ তাবৎ নৃপতি ও নিকটস্থ দুরস্থ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত গণকে নিমন্ত্রণ করিলেন। এবং নির্ধারিত দিবসে রাজা প্রাতঃ স্নানাদি করিয়া উত্তম পরিচ্ছদ পরিধান করিলেন, পণ্ডিতগণ বেদ পাঠ করিতে লাগিলেন, নর্তকী ও গায়ক গণ নৃত্য গীত করিতে লাগিল, স্তুতিপাঠক গণ তাহার গুণকীর্ত্তন করিতে লাগিল, নানাপ্রকার বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল, এবং রাজৰাটীর মঙ্গলাচরণ ও রাগ রঙ্গ হইতে লাগিল। রাজা নিমন্ত্রিত লোক সকলকে নানাবিধ খাদ্য সামগ্রী ভোজন করাইয়া বৃত্তি ও গ্রাম দান করিলেন, ক্ষুধার্তাদিগকে অন্ন ও অর্থ দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র ও অর্থ দান, প্রজাদিগকে বস্ত্রালস্কার নানাপ্রকার দান করিলেন। ইহা ভিন্ন সৈন্য দিগের পুরস্কার ও বেতন বৃদ্ধি ও অমাত্য গণের সম্মান-লুচক কর্ম্ম প্রদান করিলেন। পরে সিংহাসনের চতুর্দিকে তাবৎ লোক দণ্ডায়মান হইয়া জয়ধ্বনি ও রাম নাম করিতে লাগিল। রাজা মনে মনে তুষ্ট হইয়া সিদ্ধিদাতা গণেশ স্মরণ করিয়া সিংহাসনের সম্মুখে গিয়া সিংহা- সনারোহণার্থে দক্ষিণ চরণ উত্তোলন করিলেন।

 রাজা চরণেত্তোলন করিলে পুত্তলিকা সকল হাস্য করিয়া উঠিল। তাহাতে রাজা চমৎকৃত হইয়া মনে মনে কহিলেন এই নির্জীব পুত্তলিকা গণ কি রূপে জীবন বিশিষ্ট হইল। অনন্তর তাহাদের হাস্যে লজ্জা বোধ করিয়া পদ প্রসারণ নিবৃত্তি করিয়া তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন তোমরা কি জন্য হাস্য করিলে, তোমরা কি এমত ভাবিয়াছ যে আমি পরাক্রান্ত ও রাজকুলোদম্ভ নহি, কিম্বা ক্ষত্রিয় কুলে দুৰ্বল ও কাপুরুষ জন্মিআছি, অথবা আমার করস্থ কোন রাজা নাই, আমি পণ্ডিত নহি, আমার গৃহে পদ্মিনী রাণী নাই, কিম্বা আমি রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, এবং রাজ্য শাসনে অক্ষম ইহার কোন বিষয়ে তোমরা আমাকে হীন বিবেচনা করিয়াছ। অতএব আমাকে হাস্যের হেতু প্রকাশ করিয়া বল। ভোজরাজের এই কথা শুনিয়া