বত্রিশ সিংহাসন/১২
কীর্তিমতী দ্বাদশ পুত্তলিকা
কহিল মহারাজ অবধান কর।
একদিন রাজা বিক্রমাদিত্য সভারূঢ় হইয়া সভাসদ গণকে জিজ্ঞাসা করিলেন আর কোথাও দাত লােক আছে কি না। সভাসদগণ এই কথায় কোন উত্তর করিলেন না, পরে এক ব্রাহ্মণ কহিলেন হে নরােত্তম তােমার তুল্য সাহসী ও দাতা আর নাই, কিন্তু আমার এক নিবেদন আছে তাহা বলিতে সাহস হয় না। রাজা বলিলেন সত্য কথা বলিতে ভয় কি, তুমি স্পষ্ট কহ আমি রুষ্ট হইব না। ব্রাহ্মণ বলিলেন সমুদ্রতীরে এক রাজা আছেন, তিনি ধর্মানুষ্ঠানে অতিশয় রত, এবং প্রতিদিন প্রাতঃস্নান করিয়া লক্ষ মুদ্রা দান করেন, তাহার পর জল গ্রহণ হয়। ইহা ভিন্ন অন্য প্রকার অনেক। দান বিতরণ ও ধর্ম্ম কর্ম্ম আছে। তাদৃশ ধর্মাত্মা পুরুষ আর দেখা যায় না।
এই কথা শুনিয়া রাজা বিক্রমাদিত্য মনে মনে ভাবিলেন ঐ রাজাকে স্বচক্ষে দর্শন করিতে হইবে। পরে তাল বেতালকে স্মরণ পূর্ব্বক তাহাদের স্কন্ধারূঢ় হইয়া সমুদ্রতীরস্থ রাজার রাজধানীতে যাত্রা করিলেন। তথায় উপনীত হইয়া তাল বেতালকে বিদায় দিয়া বলিলেন আমি এই রাজার সেবাতে নিযুক্ত হইব তােমরা প্রস্থান কর, কিন্তু আমার তত্ত্ব করিও। তাহার জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ এই রাজার সেবায় নিযুক্ত হইবেন ইহার কারণ কি। রাজা কহিলেন সে কথায় তােমাদের প্রয়ােজন কি, আমি যাহা আজ্ঞা করিলাম তাহা কর। এই বাক্যে তাল বেতাল প্রস্থান করিল।
রাজা পদব্রজে নগর প্রবেশ করিয়া রাজদ্বারে উপনীত হইয়া দ্বারপালকে বলিলেন তােমার রাজাকে গিয়া বল, কোন বিদেশীয় ব্যক্তি কর্ম্ম প্রাপ্তির আশয়ে আসিয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন। দ্বারপাল রাজার নিকটে সম্বাদ করিলে রাজা স্বয়ং দ্বারে আসিলেন। বিক্রমাদিত্য তাহাকে দেখিয়া নমস্কার করিলেন। সমুদ্রাধিপতিও তাঁহাকে দেখিয়া নমস্কার পূর্ব্বক কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। বিক্রমাদিত্য কহিলেন মহারাজের অনুগ্রহে সকল মঙ্গল। তদনন্তর রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন তােমার নাম কি, তুমি কি নিমিত্ত কোথা হইতে আসিয়াছ। বিক্রমাদিত্য কহিলেন আমার নাম বিক্রম, আমি রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ্যে বাস করি। অন্তঃকরণের বিরাগ জন্য আমি দেশত্যাগী হইয়া এখানে আসিয়াছি। এক্ষণে মহারাজকে দর্শন করিয়া আমার মনটদুঃখ দূর হইল। আমি মহারাজের সেবায় নিযুক্ত হইব। রাজা জিজ্ঞাসিলেন কি বেতন হইলে আমার কর্মে নিযুক্ত হইতে পার। বিক্রমাদিত্য কহিলেন প্রতিদিন চারি। সহস্র মুদ্রাতে আমার দিনপাত হইতে পারে। রাজা বলিলেন তুমি এমত কি কর্ম্ম করিবে যে প্রতিদিন চারি সহস্র মুদ্রা দেওয়া যাইবে। বিক্রমাদিত্য কহিলেন আমি যাহার সেবা করি, অত্যন্ত সঙ্কট উপস্থিত হইলেও তাহাকে উদ্ধার করিতে পারি। ইহা শুনিয়া রাজা। নিত্য নিত্য চারি সহস্র মুদ্রা বেতন অবধারিত করিয়া তাহাকে কর্মে নিযুক্ত করিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য কয়েক দিবস তথায় থাকিয়া দেখিলেন ঐ রাজা প্রতাই লক্ষ মুদ্রা দান করেন। তিনি মনে মনে ভাবিলেন এই দানের অভিপ্রায় কি, এবং কোন, দেবতা তাহাকে ধন দান করেন, তাহা জানিতে পরে এক দিবস দেখিলেন রাত্রি গাঢ়তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হইলে রাজা বনে গমন করিতেছেন। ইহা দেখিয়া তিনি তাহার পশ্চাদগামী হইলেন। রাজা নগর পরিত্যাগ করিয়া অরণ্য প্রবেশ করিলেন। ঐ অরণ্য মধ্যে এক সরােবর ও এক দেবালয় ছিল, তাহার সম্মুখে এক কটাহে ঘূত উত্তপ্ত হইতেছিল। রাজা সরােবরে অবগাহন পূর্ব্বক দেবীকে প্রণাম করিয়া উত্তপ্ত ঘূত কটাহে পড়িলেন। পড়িবামাত্র তাবদঙ্গ দগ্ধ হইল। পরে চতুঃষষ্টি যােগিনী আসিয়া তাহার মাংস আহার করিল। অনন্তর এক কঙ্কালিনী আসিয়া রাজার অস্থিতে অমৃত প্রেক্ষণ করিল, তাহাতে রাজা সজীব হইয়া রামনাম উচ্চারণ পূর্ব্বক গাত্রোথান করিয়া দেবীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। দেবী মন্দির হইতে তাহাকে এক লক্ষ মুদ্রা দিলেন। রাজা তাহা লইয়া গৃহে আসিলেন। যােগিনী গণও স্বস্থানে প্রস্থান করিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া রাজা বিক্রমাদিত্যও ঐ উত্তপ্ত ঘূত কটাহে ঝাপ দিলেন, তাহাতে তৎক্ষণাৎ তদ্রুপ দগ্ধ হইলেন, এবং যােগিনীগণ তাহার মাংস ভক্ষণ করিল। তদনন্তর কঙ্কালিনী অমৃত দ্বারা তাহাকে . জীবন দান করিল। পরে তিনি দেবীর সম্মুখে যাইবা মাত্র দেবী তাঁহাকে লক্ষ মুদ্রা প্রদান করিলেন। রাজা বিক্রমাদিত্য ঐ ধন প্রাপ্ত হইয়া পুনর্ব্বার কটাহে পড়িলেন, এবং সেই প্রকার দগ্ধ ও পুনর্জীবিত হইয়া দেবীর সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলে, দেবী তাহাকে দুই লক্ষ মুদ্রা দিলেন। এই প্রকার রাজা সাত বার ঐ কটাহে পড়িলেন, এবং প্রতিবার এক এক লক্ষ মুদ্রা অধিক পাইলেন। অনন্তর যখন তিনি পুনর্ব্বার কটাহে ঝাপ দিতে উদ্যত হইলেন তখন দেবী তাহার কর ধারণ পূর্ব্বক বলিলেন বৎস আমি তােমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি, তুমি বর প্রার্থনা কর। রাজা কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন জননি আমি যে বর চাহিব যদি তাহা দেন তবে প্রার্থনা করিতে পারি। দেবী বলিলেন, তােমার যে বর ইচ্ছা চাহ আমি দিব। রাজা বলিলেন হে করুণাময়ি তুমি যে থলিয়া হইতে এই মুদ্রা বাহির করিয়া দিলে আমার প্রতি করুণ। করিয়া সেই থলিয়াটী দাও। দেবী এই বাক্য শুনিয়া তৎক্ষণাৎ রাজাকে সেই ঝুলিটী দিয়া অন্তর্হিত হইলেন। রাজা তাহা প্রাপ্তে মহানন্দিত হইয়া রাজধানীতে আসিলেন।
পরদিন রজনীযােগে সমুদ্রতীরস্থ ভূপতি বনে গিয়া দেখিলেন, না সেই দেবীর মন্দির আছে, না সেই কটাহই আছে, কিছুই নাই। ইহাতে রাজা অতিশয় চিন্তিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে রােদন করিতে লাগিলেন। পরে গৃহে আসিয়া অত্যন্ত বিমর্ষভাবে থাকিলেন। প্রত্যুষে সভাসদগণ দেখিল রাজা অতিশয় মান ভাবে আছেন, হাস্য বা কথা কিছুই নাই, কেহ রাজ্য কার্য্যের আলাপ করিলে বিরক্ত হয়েন। এই অবস্থা দেখিয়া মন্ত্রী বিনয়পূর্ব্বক নিবেদন করিলেন, মহারাজ, আপনাকে এই ভাবাক্রান্ত দেখিয়া তাবৎ সভ্য অসুখী হইয়াছে। রাজা বলিলেন অদ্য আমার শরীর অসুস্থ হইয়াছে, তুমি রাজ্য কার্য্য সম্পাদন কর। এই আজ্ঞায় মন্ত্রী রাজ্য কার্য্য করিতে লাগিলেন। অপর ব্যক্তিরা অনুমান করিল রাজা পীড়িত হইয়াছেন, কেহ কেহ ভাবিল রাজা মুগ্ধ হইয়াছেন, কেহ কেহ বলিল রাজা নাই। কিন্তু রাজার প্রকৃতাবস্থা কেহই জানিতে পারিল না।
রাজা বিক্রমাদিত্য নিয়মিত সময়ে রাজসদনে উপস্থিত হইলেন, এবং রাজার বিষন্নভাব অবলােকনে বলিলেন প্রভা আমি আপনকার বিপদকালে উদ্ধার করিব এই প্রতিজ্ঞা করিয়া আপনার বেতনভােগী হইয়াছি, অতএব আপনার কি মনটদুঃখ তাহা আমাকে অকপটে বলুন। রাজা উত্তর করিলেন আমি সে কথা তােমাকে কি কহিব, আমি মানস করিয়াছি এ প্রাণ আর রাখিব না। বিক্রমাদিত্য বলিলেন হে পৃথীনাথ একবার আপনার মনের দুঃখ আমাকে বলুন, তাহার পর যাহা বাঞ্ছা করিবেন। নৃপতি বলিলেন এক দেবী আমার প্রতি সদয় ছিলেন, বত্রিশ সিংহাসন। এবং প্রতিদিন আমাকে লক্ষ মুদ্রা দান করিতেন, ঐ মুদ্রা আমি নিত্য বিতরণ করিতাম। কিন্তু কল্যাবধি দেবী অদৃশ্যমান হইয়াছেন, আমি ধন পাই নাই, তাহাতে আমার নিত্যকর্ম নির্বাহের ব্যাঘাত জন্মিয়াছে। আমার এত অধিক সম্পত্তি নাই যে তাহাদ্বারা নিত্য নৈমিত্তিক ধর্ম্ম কর্ম্ম সকল নির্বাহ অতএব যদি ধর্ম্ম কর্ম্ম করিতে না পারিলাম তবে প্রাণ ধারণে কি ফল। এই সকল বিবেচনা করিয়া আমি প্রাণত্যাগ করা অবধারণ করিয়াছি।
রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁহার এই সকল আক্ষেপপাক্তি শ্রবণ করিয়া তখনি দেবীদত্ত ঝলিটী তাহার হস্তে অর্পণ পর্ব্বক কহিলেন আপনার যখন যে অর্থের প্রয়ােজন হইবে তাহা এই তােড় হইতে পাইবেন। রাজা ঐ কথা শুনিয়া মহাদে গাত্রোখান করিলেন, এবং তােড় হইতে এক লক্ষ মুদ্রা বাহির করিয়া দিয়া মন্ত্রীকে বলিলেন নিত্য নিত্য যে সকল ব্রাহ্মণেরা যাহা পাইয়া থাকেন তাহা তাহাদিগকে দাও। মন্ত্রী আজ্ঞানুরূপ তাহা দিলেন।
তদনন্তর রাজা বিক্রমাদিত্য তাহাকে কহিলেন আমি অনেক দিবস হইল এস্থানে আসিয়াছি, যদি অনুমতি হয় স্বদেশে গমন করি। রাজা, উত্তর করিলেন আমি তােমার গুণ কি বর্ণন করিব, তুমি আমার প্রাণদান করিয়াছ। তােমাকে অনুমতি দিলাম। স্বদেশে গমন কর, কিন্তু তথায় গিয়া আমাকে সম্বাদ। লিখিও। তোমার বাসস্থান কোথায় বলিয়া যাও, আমি তােমাকে সর্বদা পত্রাদি লিখিব। বলিলেন আমি অম্বাবতী নগরের রাজা, আমার নাম বিক্রমাদিত্য, আপনার যশঃশ্রবণে আপনাকে দর্শন করিতে আসিয়াছিলাম, আপনার সাহস ধর্ম্ম ও বল দেখিয়া তুষ্ট হইয়াছি, এইক্ষণে বিদায় হই।
রাজা, মহারাজ বিক্রমাদিত্যের পরিচয় পাইয়া তাহার পদানত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বলিলেন হে রাজেন্দ্র আমি অতি কুকর্ম্ম করিয়াছি, আপনার পরিচয় না জানিয়া আপনাকে বেতনভােগী করিয়া রাখিয়াছিলাম, এজন্য আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন। হে নৃপশ্রেষ্ঠ আপনার যেমত ধর্ম্মের কথা শুনিয়াছিলাম সেই মত দেখিলাম। আপনাকে, আপনার সাহসকে, পরাক্রমকে ও ধর্মকে ধন্য। ইহা বলিয়া রাজাকে সাতিশয় সম্মানপূর্বক বিদায় করিলেন। রাজা তাল বেতালের স্কন্ধারূঢ় হইয়া রাজধানীতে আসিলেন।
কীর্তিমতী পুত্তলিকা এই আখ্যায়িকা সমাপন করিয়া ভােজরাজকে বলিল, মহারাজ, রাজা বিক্রমাদিত্যের এইরূপ সদগণ ও সাহস ছিল, দেখ তিনি এমত অমূল্য ঝুলি পাইয়াও অনায়াসেই দান করিলেন, এবং দান করিয়াও অন্তঃকরণে কিছুমাত্র অনুতাপ করিলেন না। সুর বা নরের মধ্যে তর্ভুল সমুণ কাহারও ছিলনা, তুমি কোন পদার্থ। এই কথা শুনিয়া ভােজ নৃপতি মোনাবলম্বী হইলেন, সিংহাসনারােহণ করিলেন না। পর দিন পুনর্ব্বার তদুপবেশনের বাসনায় তথায় আসিয়া দাঁড়াইলে,