বনবাণী/বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ-উৎসব

উইকিসংকলন থেকে

বর্ষামঙ্গল

বৃক্ষরোপণ-উৎসব

বর্ষামঙ্গল

গান

নীল অঞ্জনঘন-পুঞ্জছায়ায় সম্‌বৃত অম্বর,
হে গম্ভীর।
বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর-
ঝংকৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর।
বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,
কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে-
নন্দিত তব উৎসবমন্দির,
হে গম্ভীর।

দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলােকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ,
দিকে দিকে হল দীর্ণ,
নব-অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ-
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর,
হে গম্ভীর।

বৃক্ষরােপণ

গান

মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে,
হে প্রবল প্রাণ।
ধূলিরে ধন্য করাে করুণার পুণ্যে,
হে কোমল প্রাণ।
মৌনী মাটির মর্মের গান কবে
উঠিবে ধ্বনিয়া মর্মর তব রবে,
মাধুরী ভরিবে ফুলে ফলে পল্লবে,
হে মােহন প্রাণ।

পথিকবন্ধু, ছায়ার আসন পাতি
এসাে, শ্যামসুন্দর-
এসো বাতাসের অধীর খেলার সাথি,
মাতাও নীলাম্বর।
উষায় জাগাও শাখায় গানের আশা,
সন্ধ্যায় আনাে বিরামগভীর ভাষা,
রচি দাও রাতে সুপ্তগীতের বাসা,
হে উদার প্রাণ।

গান

আয় আমাদের অঙ্গনে,
অতিথি বালক তরুদল,
মানবের স্নেহ-সঙ্গ নে—
চল্, আমাদের ঘরে চল্।
শ্যামবঙ্কিম ভঙ্গীতে
চঞ্চল কলসংগীতে
দ্বারে নিয়ে আয় শাখায় শাখায়
প্রাণ-আনন্দ-কোলাহল।


তোদের নবীন পল্লবে
নাচুক আলোক সবিতার,
দে পবনে বনবল্লভে
মর্মরগীত-উপহার।
আজি শ্রাবণের বর্ষণে
আশীর্বাদের স্পর্শ নে,
পড়ুক মাথায় পাতায় পাতায়
অমরাবতীর ধারাজল।

ক্ষিতি

বক্ষের ধন হে ধরণী, ধরো
ফিরে নিয়ে তব বক্ষে।
শুভদিনে এরে দীক্ষিত করে
আমাদের চিরসখ্যে।
অন্তরে পাক্ কঠিন শক্তি,
কোমলতা ফুলে পত্রে,
পক্ষীসমাজে পাঠাক্ পত্রী
তোমার অন্নসত্রে।

অপ্‌

হে মেঘ, ইন্দ্রের ভেরী বাজাও গম্ভীর মন্দ্রস্বনে
মেদুর অম্বরতলে। আনন্দিত প্রাণের স্পন্দনে
জাগুক এ শিশুবৃক্ষ। মহোৎসবে লহো এরে ডেকে
বনের সৌভাগ্যদিনে ধরণীর বর্ষা-অভিষেকে।

তেজ

সৃষ্টির প্রথম বাণী তুমি, হে আলোক—
এ নব তরুতে তব শুভদৃষ্টি হোক।
একদা প্রচুর পুষ্পে হবে সার্থকতা,
উহার প্রচ্ছন্ন প্রাণে রাখো সেই কথা।
স্নিগ্ধ পল্লবের তলে তব তেজ ভরি
হোক তব জয়ধ্বনি শতবর্ষ ধরি।

মরুৎ

হে পবন, কর নাই গৌণ,
আষাঢ়ে বেজেছে তব বংশী।
তাপিত নিকুঞ্জের মৌন
নিশ্বাসে দিলে তুমি ধ্বংসি।
এ তরু খেলিবে তব সঙ্গে,
সংগীত দিয়ো এরে ভিক্ষা।
দিয়ো তব ছন্দের রঙ্গে
পল্লবহিল্লোল শিক্ষা।


ব্যোম

আকাশ, তোমার সহাস উদার দৃষ্টি
মাটির গভীরে জাগায় রূপের সৃষ্টি।
তব আহ্বানে এই তো শ্যামল মূর্তি
আলোক-অমৃতে খুঁজিছে প্রাণের পূর্তি।
দিয়েছ সাহস, তাই তব নীল বর্ণে
বর্ণ মিলায় আপন হরিৎপর্ণে।
তরু-তরুণেরে করুণায় করো ধন্য,
দেবতার স্নেহ পায় যেন এই বন্য॥

বৃক্ষরােপণ

মাঙ্গলিক

প্রাণের পাথেয় তব পূর্ণ হােক, হে শিশু-চিরায়ু,
বিশ্বের প্রসাদস্পর্শে শক্তি দিক্ সুধাসিক্ত বায়ু।
হে বালকবৃক্ষ, তব উজ্জ্বল কোমল কিশলয়।
আলােক করিয়া পান ভাণ্ডারেতে করুক সঞ্চয়
প্রচ্ছন্ন প্রশান্ত তেজ। লয়ে তব কল্যাণকামনা
শ্রাবণবর্ষণযজ্ঞে তােমারে করিনু অভ্যর্থনা।-

থাকো প্রতিবেশী হয়ে, আমাদের বন্ধু হয়ে থাকো।
মমাদের প্রাঙ্গণে ফেলো ছায়া, পথের কঙ্কর ঢাকো
কুসুমবর্ষণে; আমাদের বৈতালিক বিহঙ্গমে
শাখায় আশ্রয় দিয়াে; বর্ষে বর্ষে পুষ্পিত উদ্যমে
অভিনন্দনের গন্ধ মিলাইয়াে বর্ষাগীতিকায়,
সন্ধ্যাবন্দনার গানে। মােদের নিকুঞ্জবীথিকায়
মঞ্জুল মর্মরে তব ধরিত্রীর অন্তঃপুর হতে
প্রাণমাতৃকার মন্ত্র উচ্ছ্বসিবে সূর্যের আলােতে।

শত বর্ষ হবে গত, রেখে যাব আমাদের প্রীতি
শ্যামল লাবণ্যে তব। সে যুগের নূতন অতিথি
বসিবে তােমার ছায়ে। সেদিন বর্ষণমহােৎসবে
আমাদের নিমন্ত্রণ পাঠাইয়ে তােমার সৌরভে
দিকে দিকে বিশ্বজনে। আজি এই আনন্দের দিন
তােমার পল্লবপুঞ্জে পুষ্পে তব হােক্‌ মৃত্যুহীন।
রবীন্দ্রের কণ্ঠ হতে এ সংগীত তােমার মঙ্গলে
মিলিল মেঘের মন্দ্রে, মিলিল কদম্বপরিমলে॥

বর্ষামঙ্গল

গান

আহ্বান আসিল মহােৎসবে
অম্বরে গম্ভীর ভেরীরবে।
পূর্ববায়ু চলে ডেকে
শ্যামলের অভিষেকে,
অরণ্যে অরণ্যে নৃত্য হবে।

নির্ঝরকল্লোলকলকলে
ধরণীর আনন্দ উচ্ছলে।
শ্রাবণের বীণাপাণি
মিলালাে বর্ষণবাণী
কদম্বের পল্লবে পল্লবে।

গান

কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন মাটির পানে।
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে,
ভাব্‌না ভাসে পুব বাতাসে,
মল্লারগান প্লাবন জাগায়
মনের মধ্যে শ্রাবণগানে।

লাগল যে-দোল বনের মাঝে
অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা-যে।
যে বাণী ঐ ধানের খেতে
আকুল হল অঙ্কুরেতে,
আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
সেই বাণী মোর সুরে আনে।

গান

আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে।
ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে
নাচের তালে ওঠেন মেতে,
চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে।

প্রথম যুগের বচন শুনি মনে
নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।
পুব হাওয়া ধায় আকাশতলে,
তার সাথে মোর ভাব্‌না চলে
কালহারা কোন্ কালের পানে ছুটে।

গান

ঝড় নেবে আয়, আয় রে আমার
শুকনো পাতার ডালে
এই বরষায় নবশ্যামের
আগমনের কালে।
যা উদাসীন, যা প্রাণহীন,
যা আনন্দহারা
চরম রাতের অশ্রুধারায়
আজ হয়ে যাক সারা—
যাবার যাহা যাক সে চলে
রুদ্রনাচের তালে।
আসন আমায় পাততে হবে
রিক্ত প্রাণের ঘরে,
নবীন বসন পরতে হবে
সিক্ত বুকের ’পরে।
নদীর জলে বান ডেকেছে,
কুল গেল তার ভেসে,
যূথী বনের গন্ধবাণী,
ছুটল নিরুদ্দেশে—
পরান আমার জাগল বুঝি
মরণ-অন্তরালে।