বরেন্দ্র রন্ধন/অষ্টম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাদশ অধ্যায়

জিরা পর্ব্ব

(১) সূপ

 কলাই ভাঙ্গিয়া প্রস্তুত শস্য যাহাকে আমরা ডাইল বলি এবং মৎস্য মাংসাদি শুধু, উভয় একত্রে অথবা চাউলাদি বা আনাজাদি সহ একত্রে জলে সুসিদ্ধ করতঃ যে “যুষ বা ক্বাথ’ প্রস্তুত হইল তাহা নুণ, হলুদ সহ ঘৃতে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া সম্বারা দিয়া লইলে ‘সূপ’ প্রস্তুত হইল।

 এই হিসাবে নিরামিষ সূপ বলিতে আমরা ডাইলের ঝোল অথবা সংক্ষেপে ‘ডাইল’ বুঝি। ডাইলে জলের ভাগ সাধারণতঃ কিছু অধিক পরিমাণে দেওয়া হয় সুতরাং ডাইল তরল বা অপেক্ষাকৃত কিছু ঘন থকথকে গোছ হইয়া থাকে। ডাইলের সহিত চাউলাদি একত্র সিদ্ধ করিয়া লইয়া সূপ রাধিলে তাহাকে আমরা ‘খিঁচুড়ী’ বলি। ডাইলের সহিত মৎস্য মাংসাদি একত্রে সিদ্ধ করতঃ সূপ রাঁধিলে তাহাকে আমরা অনেক সময় ‘মুড়ীঘণ্ট’ বলিয়া থাকি। কেননা ঐ সকল ক্ষেত্রে প্রায়শঃ ডাইলের সহিত মাছের বা ছাগাদির মুড়া ব্যবহৃত হইয়া থাকে এবং তাহাতে বাটা ঝাল দেওয়া হইয়া থাকে। শুধু মৎস্য মাংসাদির সূপও রাঁধা হয়। আবার মৎস্য মাংসাদির সহিত কিঞ্চিৎ চাউল, আলু বা যবাদি (এবং সাগু প্রভৃতি) কিম্বা আনাজাদি মিশাইয়াও সূপ রাঁধা হইয়া থাকে।

 সূপ হইতে ‘জিরা পর্ব্ব’ আরম্ভ ধরা যাইতে পারে। কেননা সূপে জিরা ফোড়ন পড়িলেও সাধারণতও তাহাতে বাটা ঝাল না দিয়াই রাঁধা হইয়া থাকে। ডাইল গুরুপক্ব করিয়া রাঁধিতে ইচ্ছা হইলে তাহাতে এবং মুড়ীঘণ্ট প্রভৃতিতে বাটা ঝাল (জিরা-মরিচ বাটা, এবং লঙ্কা বাটা, পিপুল বাটাদি) দেওয়া হয়। এবং আরও গুরুপক্ব করিয়া রাখিলে তাহাতে গরমশল্লা সংযোগও করিতে হয়। গুরুপক্ব ডাইলে গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিতে হয়। এবং রুচী অনুসারে মুগ, মশুর, অড়হর, প্রভৃতি ডাইলে পেঁয়াজ ও রশুন ফোড়ন দেওয়া যায়। আদা ফোড়নরূপে ব্যবহৃত হয় না, উহা ছেঁচিয়া মুগ, মাষ প্রভৃতি ডাইলে পশ্চাৎ সংযোগ করা হয়। জিরা ফোড়ন ছাড়া মাষকলাই ডাইলে অতিরিক্ত দুটো মউরী ফোড়ন দিতে হয় এবং মাষ, অড়হর ও মশুরী প্রভৃতির ডাইলে হিঙ ফোড়ন দিলে অনেকের নিকট অধিক মুখরোচক হইয়া থাকে। খেঁসারীর ডাইলে জিরার পরিবর্ত্তে মেথি ফোড়ন দিলে তবে তাহার স্বাদ উত্তম হয়। খেঁসারীর ডাইলের আর এক বিশেষত্ব—ঘৃতের পরিবর্তে তৈলে সম্বারা দেওয়া এবং কঁচা লঙ্কা সংযোগ করা। ডাইল অম্ল বা তিক্ত স্বাদ বিশিষ্ট করিয়া রাখিতে হইলে তাহাতে অতিরিক্ত দুটো সরিষা (গোটা বা গুড়া) ফোড়ন দেওয়া প্রশস্ত।

 সাধারণতঃ কলাই মাত্রই ‘জাঁতায়’ ফেলিয়া ভাঙ্গিয়া ডাইল বাহির করা হয় এবং তৎপর তাহা জলে সিদ্ধ করিয়া সূপ রাঁধা হয়, কিন্তু কতকগুলি ডাইল আছে যাহা রাঁধিবার পূর্ব্বে খোলায় উত্তপ্ত বালুতে বা ঘৃতে ভাজিয়া লইলে তবে তাহার আস্বাদন সমধিক পরিস্ফুট হয়।—মুগ ও মাষ কাঁচা অবস্থায় রন্ধন অপেক্ষা পূর্বে উত্তপ্ত বালুতে ভাজিয়া লইয়া রাঁধিলে তবে তাহার স্বাদ উৎকৃষ্ট হয়। শিম, বরবটী, বোরা প্রভৃতির বীচি বালুতে ভাজিয়া না লইলে তাহার সূপ অখাদ্য হয়। অড়হরের ডাইল কাঁচা রাঁধিলে একরূপ স্বাদ হয়, বালুতে ভাজিয়া রাঁধিলে অন্যরূপ স্বাদ হয় এবং পূর্ব্বে ঘৃতে ভাজিয়া রাঁধিলে উৎকৃষ্ট স্বাদ হইয়া থাকে।

 কোন কোন ডাইল যথা মুগ, মটর, অড়হর প্রভৃতি অনেক সময় অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিয়া রাঁধা হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত তেঁতুল, কাঁচা আম, আমের চুণা, আমড়া, চাল্‌তে, জলপাই, আলু বোখারা প্রভৃতি মিশাইয়া ডাল সিদ্ধ করা হইয়া থাকে। মটরের ডাইলে অম্ল সহ কিঞ্চিৎ আমাদা বা আম্র মুকুল মিশাইলে উত্তম ঘ্রাণ বিশিষ্ট হয়। মুগ ডাইলেও আম্রমুকুল মিশান যায়।

 মটর ও খেঁসারীর ডাইলের সহিত করিলা বা অন্য কোনও তিক্ত আনাজ বা শাক মিশাইয়া সিদ্ধ করতঃ তেলে লঙ্কা, মেথি ফোড়ন দিয়া সম্বারা দিয়া লইলে ‘তিত ডাইল’ পাক হইবে।

 অনেক ডাইল আনাজ যোগে রাঁধা হয়, আবার পক্ষান্তরে অনেক তরকারীতে ডাইল বা ডাইলের ‘বড়ী’, ‘বড়া’, ‘চাপড়ী’, ‘দলা’ ফেলিয়া রাঁধা হইয়া থাকে। এই সমস্ত প্রয়োগ যথাস্থানে লিখিত হইয়াছে।

 ডাইল সুসিদ্ধ না হইলে কদাপি তাহার স্বাদ ভাল হয় না। অর্দ্ধ-সিদ্ধ ডাইলে কাঁটা ঘুরাইয়া ভাঙ্গিয়া দিয়া তাহাকে সুসিদ্ধ হইয়াছে মনে করা নির্বুদ্ধিতা সুতরাং তাহা অকর্ত্তব্য। বলা বাহুল্য পুরাতন ডাইল অপেক্ষা নূতন ও টাটকা ভাঙ্গা ডাইলই সুসিদ্ধ হয় এবং সুস্বাদুও বটে।

 নিরামিষাশীদের পক্ষে ডাইল একটি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য। সূপ ব্যতীত ইহা দ্বারা, বড়ী, বড়া, চাপড়ী, পাণি-দলা বা ধোকা প্রভৃতি প্রস্তুত হয়। এবং তাহা বহু তরকারীতে এবং অম্লে অনুষঙ্গরূপে ব্যবহৃত হয়। ডাইলের মুখরোচক পাট ভাজাদি এবং পাঁপড় ভাজাদি প্রস্তুত হইয়া থাকে। ডাইলের বা তাহার ছাতুর পুর করিয়া বহুবিধ ‘পূরী’ প্রস্তুত হয়। দহিযোগে ডাইলের বড়ার সুন্দর চাটনী হয় এবং চিনি-রস যোগে বহুবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত হইয়া থাকে।

১৪৩। মুগের ডাইল

 মুগ-কলাই খোলায় উত্তপ্ত বালুতে ভাজিয়া ‘ঝাঁঝরে’ ঝারিয়া লইয়া জাঁতায় ভাঙ্গিয়া ডাইল প্রস্তুত কর। খোসাদি কুলায় ঝাড়িয়া বাছিয়া লও (মুগের ডাইলে সাধারণতঃ বিস্তর আঁখির থাকে)। কদাপি ভাজা ডাইল জল দিয়া ধুইবে না তাহা হইলে তাহার স্বাদ নষ্ট হইয়া যাইবে। হাঁড়ি করিয়া জলে ডাল সিদ্ধ কর। সুসিদ্ধ হইলে নুণ, হলুদ ও কিঞ্চিৎ চিনি মিশাও। ঘৃতে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও।

 মুগের ডাইলে পেঁয়াজ, রশুন অথবা হিঙ ফোড়ন দেওয়া যাইতে পারে। এবং নামাইয়া তাহাতে আদা ছেঁচা মিশান যাইতে পারে। স্থল বিশেষে মুগের ডাইলে দুটো চৈ বা কালজিরা ফোড়ন দেওয়া হইয়া থাকে।

 অধিক গুরু করিয়া রাঁধিতে ইচ্ছা করিলে সিদ্ধ ডাইলে বাটা ঝাল (লঙ্কা, জিরা-মরিচ, পিপুল ও তেজপাত বাটা) মিশাইয়া লইবে এবং ফোড়নের সহিত দুটো গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিয়া তাহাতে ঐ বাটাঝাল মিশ্রিত সিদ্ধ ডাইল সম্বারা দিবে। মুগের ডাইলে নারিকেল কুড়া মিশাইতে পার। মুগের ডাইলের সহিত কাঁটালবীচি মিশাইতে পার। এবং অম্নস্বাদ যুক্ত করিয়া রাঁধিতে হইলে আলু বোখারা, আমের চুণা, কাঁচা আম, তেঁতুল প্রভৃতি মিশাইয়া ভাল সিদ্ধ করিবে। আমের মুকুলের সময় অম্লস্বাদ বিশিষ্ট ডাইলের সহিত আমের মুকুল দিতে পার। কিন্তু তৎক্ষেত্রে লোহার কড়াইয়ে রাঁধিলে ডাইল কালো হইয়া যাইবে, সুতরাং পিত্তলী পাত্রে রাঁধিবে।

১৪৪। রুই মাছের মুড়া দিয়া মুগের ডাইল।

 ডাইল সিদ্ধের সময় তৎসহ পাকা রুই প্রভৃতি মাছের এবং চিংড়ী মাছের মুড়া মিশাইবে। তৎপর নুণ, হলুদ, লঙ্কা বাটা, জিরা-গোলমরিচ বাটা, তেজপাত বাটা মিশাও। ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ও গরম-মশল্লা এবং রুচী হইলে পেঁয়াজ ও রশুন ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও। ইচ্ছা করিলে শেষে একটু আদা ছেঁচা এবং গরমমশল্লা বাটা মিশাইতে পার।

 বুট ও মশুরীর ডাইলেরও এইরূপ ‘মুড়িঘণ্ট’ রাঁধিতে পার।

১৪৫। মাংসের সহিত মুগের সূপ

 (ক) হাঁড়ি করিয়া জলে মাংস সিদ্ধ কর। অর্দ্ধ সিদ্ধ হইলে তাহাতে ভাজা মুগের ডাইল ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে তৎসহ নুণ, হলুদ, একটু চিনি ও বাটা ঝাল মিশাও। ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা, গরমমশল্লা এবং রুচী হইলে পেঁয়াজ ও রশুন ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও। নামাইয়া আদা ছেঁচা ও ইচ্ছা করিলে কিছু গরম মশল্লা বাটা মিশাইতে পার।

 বুট ও মশুরীর ডাইলও এইরূপে পাক করিতে পার।

 (খ) হাঁড়ি করিয়া জলে খণ্ড খণ্ড মাংস সিদ্ধ কর। অর্দ্ধ সিদ্ধ হইলে মুগ ডাইল ছাড়। সুসিদ্ধ হইলে তৎসহ নুণ, হলুদ, একটু চিনি ও বাটাঝাল মিশাও। পরে সমস্ত উত্তমরূপে, নাড়িয়া ন্যাকড়ায় ছাঁকিয়া যুষ বাহির করিয়া লও। ঘৃতে তেজপাত, গরমমশল্লা এবং প্যাঁজ ও রশুন ফোড়ন দিয়া ঐ যুষ সম্বারা দাও। নামাইয়া একটু আদা ছেঁচা মিশাও।

 বুট ও মশুরীর ডাইলও এই প্রকারে পাক করিতে পার।

১৪৬। ডিমের সহিত মুগের সূপ

 ডাইল সিদ্ধ কর। সিদ্ধ হইলে নুণ হলুদ একটু চিনি ও বাটা ঝাল মিশাও। এই সময় পুরা-সিদ্ধ পক্ষীর ডিম্ব অর্দ্ধ খণ্ড করিয়া কাটিয়া ডাইলে ছাড়িয়া রাখ। পরে ঘৃতে তেজপাত, গরমমশল্লা এবং প্যাঁজ ও রশুন ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও। নামাইয়া একটু আদা ছেঁচা মিশাও।

 বুট ও মরীর ডাইল এইরূপে পাক করিতে পার।

১৪৭। মশুরীর ডাইল

 মশুরীর ডাইল দুই প্রকারে প্রস্তুত হয়;—খাঁড়ী বা গোটা মশুরী ও ভাঙ্গা মশুরী। তন্মধ্যে খাঁড়ীই উত্তম। মুগের ডাইলের ন্যায় মশুরীয় ডাইল পাক করিবে, তবে মুগের ন্যায় মশুরীর ডাইল বালুতে ভাজিয়া লইতে হয় না। মশুরীর ডাইলে প্যাঁজ, রশুন বা হিং ফোড়ন দিলে তবে উহার স্বাদ সমধিক পরিস্ফুট হয়। মুগের ন্যায় ইহাও গুরুপক্ব করিয়া রাঁধা চলে। মশুরীর ডাইলের সহিত সচরাচর কোনও আনাজ ব্যবহৃত হয় না।

১৪৮। মাষকলাইর ডাইল

 মুগের ন্যায় মাষকলাই বালুতে ভাজিয়া লইয়া পাক করিলে তবে তাহার স্বাদ উৎকৃষ্ট হয়। ডাইল সিদ্ধ করিয়া নুণ হলুদ মিশাও। কেহ কেহ এই ডাইলে হলুদ দেওয়া পছন্দ করেন না। ঘৃতে জিরা, মৌরী, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও। নামাইয়া আদা ছেঁচা মিশাও।

 অপরাপর ফোড়নের সহিত হিঙ ফোড়ন দিলে এই ডাইলের স্বাদ অতি উপাদেয় হয়। মৌরী ফোড়ন এবং পশ্চাৎ আদা সংযোগ এই ডাইলের বিশেষত্ব।

 ইহাও গুরুপক্ব করিয়া রাঁধা চলে। তৎক্ষেত্রে সিদ্ধ ডাইলে বাটা ঝাল মিশাইতে হইবে এবং ইচ্ছা করিলে ফোড়নের সহিত অতিরিক্ত গরমমশল্লা ফোড়ন দিবে।

 সাধারণতঃ কোনও আনাজ এই ডাইলে দেওয়া যায় না এবং অম্ল সংযোগে পাকও সাধারণতঃ করা হয় না।

 আশকে (শুকান) পিঠা এই ডাইলের সহিত খাইতে ভাল।

১৪৯। বুটের ডাইল

 মুগের ডাইলের ন্যায় বুটের ডাইল পাক করিবে। কিন্তু ইহা মুগকলাইর ন্যায় বালুতে ভাজিয়া লইয়া পাক করিতে হইবে না। একটু চিনি না দিলে ইহার স্বাদ তেমন ভাল হয় না। ইহা প্রায়ই গুরুপক্ব করিয়া পাক করা হয় এবং ইহার মুড়ী-ঘণ্টাদিও চমৎকার হয়। তখন সিদ্ধ ডাইলে বাটা ঝাল এবং ফোড়নে অতিরিক্ত গরমমশল্লা ব্যবহৃত হয়। তবে সাধারণতঃ ইহাতে প্যাঁজাদি ফোড়ন দেয় না। এই ডাইলে মাখিয়া লুচী খাইতে ভাল।

১৫০। মটরের ডাইল

 মটর ডাইল দুই প্রকার। দেশী—ছোট দানা এবং পাটনাই বড় দানা। দেশী অপেক্ষা পাটনাইর স্বাদই উৎকৃষ্টতর, কিন্তু দেশীরই সচরাচর ‘পাট’, ‘বড়া’, ‘চাপড়ী’ প্রভৃতি ভাজা হয় এবং ‘বড়ীও’ তদ্দ্বারাই দেওয়া হইয়া থাকে।

 মটর ডাইল বালুতে বা ঘৃতে ভাজিতে হয় না। কাঁচা ডাইল জলে সিদ্ধ করিয়া নুণ মিশাও। ইহাতে হলুদ মিশান অনেকে পছন্দ করেন না। এই ডাইলে ‘কাঁটা’ ঘুরানও কর্ত্তব্য নহে। ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া সম্বারা দাও। এই ডাইলে প্যাঁজ প্রভৃতি সচরাচর ব্যবহৃত হয় না।

 কাঁচা আম, আমের চুনা, তেঁতুল, আমড়া, করঞ্জা, চালিতা প্রভৃতি যোগে এই ডাইল অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিয়া পাক করা খুব প্রচলন। অম্ল-ডাইল আম-আদা, আম্র-মুকুলাদি দ্বারা সুগন্ধি করিলে অতি উপাদেয় হয়। আমদা বাটিয়া পশ্চাৎ মিশাইবে। আম-আদা দিলে একটু চিনি মিশাইবে। অম্ল ডাইলে দুটো সরিষা ফোড়ন দিবে। সরিষা ফোড়ন দিলে জিরা তেজপাত ফোড়ন দিবে না। অম্ল দিয়া পাক করা ডাল আগুনের তাপে শুকাইয়া ঝুরঝুরে গোছ করিয়া লইলেই ‘ডাইল-চড়চড়ী’ প্রস্তুত হইল। তাহা পান্তা ভাতের সহিত মাখিয়া খাইতে ভাল।

 বড় বা পাটনাই মটরের ডাইলও এই প্রকারে পাক করিবে। তবে সুসিদ্ধ করিয়া তাহাতে কাঁটা ঘুরাইতে পার।

 ছোট মটর ডাইলে লাউ, মূলা, করিলা, গাবথোড়, কুমড়া, ডাঁটা প্রভৃতি আনাজ মিশাইয়া রাধা যাইতে পারে।

১৫১। খেঁসারীর ডাইল

 ছোট মটরের ডাইলের ন্যায় খেঁসারীর ডাইল পাক করা চলে। কিন্তু ঘৃতের পরিবর্ত্তে তৈলে তেজপাতা, এবং শুক্না লঙ্কার পরিবর্ত্তে কাঁচা লঙ্কা এবং জিরার পরিবর্ত্তে মেথি ফোড়ন দিয়া এই ডাইল সম্বারা দিলে তবে ইহার স্বাদ উত্তম হয়। এতদুপরি দুটো সরিষার গুঁড়া ফোড়ন দিয়া সম্বারা দিলে ইহা ‘তিত-ডাইল’ হইবে। খেঁসারীর ন্যায় ছোট মটরও তিত স্বাদ বিশিষ্ট করিয়া পাক করা হইয়া থাকে। তৎক্ষেত্রে এতদুভয় ডাইলের সহিত তিক্ত স্বাদ বিশিষ্ট কোন এক প্রকার সবজী মিশাইতে হইবে।

 খেঁসারীর ডাইল সিদ্ধ করিতে প্রথমে আবশ্যকীয় সমস্ত জল সহ ডাইল জ্বালে উঠাইয়া দিবে। পরে জল ফুটিলে অল্পমাত্র জল হাঁড়িতে রাখিয়া অবশিষ্ট উঠাইয়া লইবে এবং ক্রমে ক্রমে এই তোলা জল পুনঃ ডাইলে খাওয়াইবে।

 ছোট মটরের ন্যায় খেঁসারীরও বড়ী, বড়া, পাট, চাপড়ী, দলা প্রভৃতি প্রস্তুত হইতে পারে। মটরের ডাইলের ন্যায় আমাদা ও আম্র-মুকুলাদি সংযোগে খেঁসারীর ডাইলও পাক করা যাইতে পারে।

 মূল, গাবথোড়, করিলা প্রভৃতি আনাজ এই ডাইলের সহিত রাঁধা হয়।

১৫২। অরহরের ডাইল

 অরহরের ডাইলও দুই প্রকার, দেশী-ছোট দানা ও পাটনাই বড় দানা। তন্মধ্যে পাটনাই অরহরই খাইতে উত্তম। উভয়বিধ ডাইলই একই প্রকারে পাক করিতে হয়। কাঁচা, বালুতে ভাজা এবং ঘৃতে ভাজা—এই ত্রিবিধ বিধানে অরহরের ডাইল রাঁধা হইয়া থাকে।

 (ক) সাধারণতঃ যে প্রকারে অপরাপর ডাইল পাক করে কাঁচা ডাইল সেই প্রকারে পাক করিতে হয়। অর্থাৎ, কাঁচা ডাইল জলে সিদ্ধ করিয়া লইয়া তৎসহ নুণ, হলুদ ও একটু চিনি মিশাইয়া অথবা একটু গুরুপক্ব করিতে হইলে বাটাঝাল মিশাইয়া পরে ঘৃতে জিরা, তেজপাতা ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া এবং অধিক গুরুপক্ব করিতে হইলে তৎসহ আরও গরম মশল্লা ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দিবে। কাঁচা ডাইলে পেঁয়াজ, রশুন, অথবা হিং ফোড়ন দিয়া সম্বারা দিলে অতি উত্তম স্বাদ হয়। এই ডাইলে ঘৃত কিছু বেশী পরিমাণে দিতে হয় এবং লঙ্কাও কিছু অধিক পরিমাণে ফোড়ন দিলে তবে স্বাদ ভাল হয়। কাঁচা আম, আমের চূণা বা করঞ্জাদি সহযোগে এই ডাইল অম্লস্বাদ বিশিষ্ট করিয়া পাক করা যায়। তৎক্ষেত্রে জিরা তেজপাতের পরিবর্ত্তে লঙ্কার সহিত শুধু দুটো সরিষা গুঁড়া ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দিবে।

 কেহ কেহ এই ডাইলে আদৌ হলুদ দেওয়া পসন্দ করেন না। কাঁচা ডাইলে সচরাচর কোনও আনাজও মিশান হয় না।

 (খ) অরহরের ডাইল ঘৃতে অথবা বালুতে ভাজিয়া লইয়া জলে সিদ্ধ কর। এই সময় কাঁটালবীচি, কষাণ ফলা বেগুণ অথবা কষাণ গোটা পটোল মিশাইতে পার। নুণ, হলুদ ও একটু চিনি মিশাও। ঘৃতে জিরা, তেজপাতা ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া ডাইল সম্বারা দাও।

 ভাজা অরহরের ডাইলে ভাত মাখিয়া বেগুণ প্রভৃতির ‘পাট-ভাজার’ সহিত খাইতে ভাল লাগে।

১৫৩। বোরা, বরবটি এবং শিম-বীচির ডাইল

 বোরা, বরবটি এবং শিমের সুপক্ব বীজ লইয়া বালুতে ভাজ। পশ্চাৎ জাঁতায় ভাঙ্গিয়া তাহার খোঁসা ঝাড়িয়া ফেলিয়া অপরাপর ডাইলের ন্যায় ডাইল রাঁধ। কাঁচা অবস্থায় ইহার ডাইল রাঁধিলে স্বাদ বিশ্রী হইবে। এই সব ডাইল ঘৃতে ভাজিয়াও রাঁধিতে পার।

 ভাজা ডাইল জলে সিদ্ধ কর। নুণ, হলুদ ও একটু চিনি মিশাও। ঘৃতে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া সম্বারা দাও। সিদ্ধ ডাইলে ইচ্ছা করিলে একটু লঙ্কা এবং জিরা-মরিচ বাটা মিশাইতে পার।

১৫৪। মাছের সূপ, সুরুয়া বা আখ্‌নি

 শিঙ্গী, মাগুর, শোল এবং চিঙড়ী প্রভৃতি মাছেরই সূপ ভাল হয়। মাছ খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া হাঁড়িতে শীতল জলে ছাড়িয়া জ্বালে উঠাইয়া দাও। নুণ, হলুদ, গোটা গোলমরিচ, আদা (থেঁতা) এবং রুচী হইলে পেঁয়াজ (থেঁতা) মিশাও। ধীরে ধীরে সিদ্ধ কর। সুসিদ্ধ হইয়া মাছ আউলাইয়া (এলিয়া) গেলে নামাও। মোটা নেক্‌ড়ায় ছাঁকিয়া লও। অতঃপর ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত ও লঙ্কা ফোড়ন দিয়া এই ‘যুষ’ সম্বারা দিয়া লও।

 এই হইল সাদাসিদা পাৎলা সুপ। ইচ্ছা হইলে মাছের সহিত পটোল, ঝিঙ্গা প্রভৃতি বা হালি ফুলকোবি, সালগম, গাজর, সেলেরী প্রভৃতি আনাজ মিশাইয়া একত্রে সিদ্ধ করিয়া লইতে পার। এবং গরম মশল্লা, পেঁয়াজ (কুচি), রশুন প্রভৃতি ফোড়ন দিয়া সূপ গুরুপক্ব করিয়া লইতে পার।

 ঘন বা ‘মোটা’ সূপ প্রস্তুত করিতে হইলে মাছের সহিত একত্রে আলু, যব (barley), সাগু (sago) প্রভৃতি সিদ্ধ করিতে পার, অথবা সূপ নামাইবার পূর্বে কিছু পিঠালী মিশাইয়াও ঘন করিয়া লইতে পার।

 সূপ সুন্দর পরিষ্কার পাৎলা জলের মত তরল অথচ উজ্জ্বল করিতে হইলে ধীরে ধীরে ফুটাইবে এবং মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ শীতল জলের প্রক্ষেপ দিয়া ফুট বন্ধ করিবে; তাহা হইলে যুষের গাদ বা ক্লেদ উপরে ভাসিয়া উঠিবে এবং ঝাঁঝরা হাতার সাহায্যে তাহা ছাঁকিয়া উঠাইয়া ফেলিতে পারিবে। এই প্রকারে ক্রমে বার তিন চারি ছাঁকিয়া ফেলিলেই যুষ ক্রমে অনেকটা পরিষ্কার হইয়া আসিবে। তখন যুষে ফেলান আনাজ গুলি সব উঠাইয়া ফেলিবে এবং মৎস্য সুসিদ্ধ হইয়া এলিয়া গেলে জল হইতে হাঁড়ি নামাইয়া ঠাণ্ডা করিবে। এই সময় চিনির রসের গাদ কাটার ন্যায় পুনঃ গাদ কাটিয়া একখানা পুরু ন্যাকড়ার সাহায্যে ছাঁকিয়া ‘যুষ’ বা ক্কাথটুকু লইবে। অতঃপর ঘৃতে বা তৈলে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা এবং গুরুপক্ব করিলে তৎসহ গরম মশল্লা ও পেঁয়াজ, রশুনাদি ফোড়ন দিয়া তাহাতে এই যুষ সম্বারা দিবে। ইচ্ছা করিলে পুনরায় সূপ ছাঁকিয়া পোড়া ফোড়নাদি হইতে পৃথক করিয়া লইবে।

 ইউরোপীয়গণ পক্ষীর ডিমের শ্বেতাংশের (হরিদ্রাংশ নহে) দ্বারা যুষ সাফ (clarify) করিয়া লইয়া থাকেন। মৎস্য মাংসাদি সুসিদ্ধ হইয়া এলাইয়া গেলে যখন জ্বাল হইতে নামান হয় তখন তাঁহারা উহা ঠাণ্ডা করিয়া তাহাতে পক্ষীর ডিমের শ্বেতাংশ মায় ডিমের খোলা উত্তমরূপে ফেটাইয়া লইয়া মিশান এবং সমস্ত উত্তমরূপে নাড়িয়া পুনঃ জ্বালে উঠাইয়া গরম করিয়া লয়েন। ইহাতে ডিমের শ্বেতাংশ তাপে দৃঢ়াইয়া গেলে যুষ জাল হইতে নামাইয়া স্থির ভাবে রাখিয়া পুনঃ ঠাণ্ডা হইতে দেন। ইহাতে যুবে মিশ্রিত দৃঢ়ান ডিমের শ্বেতাংশ যুষের সমস্ত অবশিষ্ট গাদ ক্লেদাদি শোধনপূর্ব্বক লইয়া ক্রমে উপরিভাগে ভাসিয়া উঠিবে, অধিকন্তু যুষ ঠাণ্ডা হওয়া প্রযুক্ত ঐ সঙ্গে মৎস্য মাংসাদির মেদ বসাদিও দৃঢ়াইয়া উপরিভাগে ভাসিয়া উঠিবে। এক্ষণে পাৎলা ‘নামদায়’ বা পুরু ফ্লানেলে প্রস্তুত ছাঁকনায় এই যুষ ছাঁকিয়া লইলে উহা সুন্দর পরিষ্কার উজ্জ্বল টলটলে হইবে। অতঃপর পোড়া চিনির রঙ্গ (caramel) বা অপর কোনও প্রকার রঙ্গ মিশাইয়া আবশ্যক মত বাদামী (brown) বা অন্যবিধ রঙ্গ করিয়া লইবে। কিন্তু এখানে একটু বক্তব্য আছে;—ইউরোপীয়গণ অতঃপর আর এই ক্কাথ বা যুষ সম্বারা দিয়া সূপে পরিণত করিয়া লয়েন না, আমরা তাহা করিয়া থাকি। তাঁহারা বিভিন্ন প্রকারের সবজীর ও বাগানের মশল্লাদির সাহায্যে বিভিন্ন বাসের (flavour) যুষ রাঁধিয়া থাকেন এবং তৎপর তাহাতে পুনঃ বিভিন্ন প্রকারের অনুষঙ্গ (garnish) যোগ করিয়া বিবিধ পদবীর soup প্রস্তুত করিয়া লয়েন।

১৫৫। মাংসের সূপ, সুরুয়া বা আখ্‌নি

 মাংস খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিয়া লইয়া এবং মজ্জাগর্ভ হাড়গুলি ফাটাইয়া লইয়া হাঁড়িতে শীতল জলে ছাড়িয়া পশ্চাৎ জ্বালে উঠাইয়া দাও। মাছের সূপের ন্যায় সূপ রাঁধ। বলা বাহুল্য মৎস্য অপেক্ষা মাংসের সূপেরই সমধিক প্রচলন।

 মৎস্য মাংসাদি শীতল জলে ছাড়িয়া ঐরূপ ক্রমে গরম করিয়া সিদ্ধ করিবার তাৎপর্য্য এই যে, তাহা হইলে মাংসের সমুদয় ক্কাথ বাহির হইয়া আসিবে। কিন্তু মাংসাদি প্রথমেই উষ্ণ জলে ছাড়িলে উত্তাপে মাংসের উপরিভাগ কঠিন হইয়া গিয়া ভিতর হইতে ক্কাথ বাহির হইবার প্রতিবন্ধক ঘটাইবে। ‘ভাজি’ অধ্যায়ে কাঁচা ও উত্তপ্ত তৈলাদিতে মৎস্য মাংস ছাডিবার প্রভেদের যে বিচার করা হইয়াছে তাহা দ্রষ্টব্য। কাঁচা জলে বা তৈলাদিতে মাছ মাংস ছাড়িলে এলিয়া যায় বলিয়া সিদ্ধ ও ভাজিবার মৎস্য মাংসাদি উপযুক্ত রূপে উত্তপ্ত জলে বা তৈলাদিতে ছাড়িতে হয় তবে তাহা গোটা থাকে এবং তাহার স্বাদও ঠিক থাকে, সুতরাং যে উদ্দেশ্যে মৎস্য মাংসাদি সিদ্ধ বা ভাজা হয় তাহা তাহাতেই সফল হয়। কিন্তু সূপের উদ্দেশ্য ঠিক তার বিপরীত, অর্থাৎ সূপে মৎস্য মাংসাদির ক্কাথটুকুরই প্রয়োজন—মাংসের প্রয়োজন নাই, সুতরাং যাহাতে এই প্রয়োজনটুকু সিদ্ধ হয় তাহাই অনুষ্ঠেয়। ক্কাথ বাহির করিয়া লইবার পর সূপে যে মৎস্য মাংসাদি অবশিষ্ট রহিবে চাকিয়া দেখিলেই দেখা যাইবে যে তাহা বিস্বাদ ও ছোবা ছোবা সুতরাং কুভক্ষ্য। এই নিমিত্তই বঙ্গদেশীয় রন্ধনে যাবতীয় ব্যঞ্জন প্রথমে উত্তপ্ত ঘৃতে বা তৈলে কষাইয়া বা আংসাইয়া (সাঁৎলাইয়া) লইয়া তবে তাহা প্রয়োজন মত অধিক জলে সিদ্ধ করা হয়। এই নিমিত্ত তখন কাঁচা জল দিলেও পূর্ব্বে কষান থাকা প্রযুক্ত আনাজ মৎস্যাদির স্বাদের ব্যত্যয় বা বিকৃতি ঘটে না। তত্রাচ মাংসের ‘কালিয়া’ রন্ধনে পুনঃ উত্তপ্ত জল দিবার ব্যবস্থা আছে। ইলিশাদি তৈলাক্ত কোমল মৎস্য রন্ধনে যদিও তৈলাদিতে মৎস্য না কষাইয়া কাঁচা মাছই একছের জলে ছাড়িবার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ঐ জল সম্যক না ফুটিলে তাহাতে মৎস্য ছাড়া নিষিদ্ধ।

 অস্মদ্দেশে এক রোগীর পথ্য ব্যতীত সচরাচর মৎস্য মাংসাদির সূপ রাঁধা হয় না সম্ভবতঃ তন্নিমিত্ত কেবল ডাইলের সূপই ‘সূপ’ আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে।

খেচরান্ন বা খিঁচুড়ি।

 চাউলে ও ডাইলে এক সঙ্গে নুণ ও হলুদ যোগে সিদ্ধ করিয়া পরে ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন দিয়া সম্বারা দিয়া লইলেই খিঁচুড়ি পাক হইল।

 খিঁচুড়ি মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। ঢালা খিঁচুড়ি ও ভুনি (ভাজা) খিঁচুড়ি। উপরে যাহা লিখা হইল, তাহা ঢালা খিঁচুড়ি সম্বন্ধে। ভুনি খিঁচুড়িতে ঘৃতে তেজপাত, (জিরা, লঙ্কা) ও গরম মশল্লাদি ফোড়ন দিয়া ডাইল ছাড়িয়া পূর্বে আংসাইয়া অর্থাৎ ভাজিয়া লইতে হয়। তৎপর চাউল ছাড়িয়া এবং পশ্চাৎ জল ঢালিয়া দিয়া নুণ (হলুদ) সহ সিদ্ধ করতঃ জল শুকাইয়া লইলেই ভূনি খিঁচুড়ি পাক হইল।

 সাধারণতঃ বালুতে ভাজা মুগ বা মাষকলাইর ডালের খিঁচুড়িই উত্তম বিবেচিত হইয়া থাকে। মশুরি এবং অরহর ডালেরও খিঁচুড়ি হইয়া থাকে। জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ফোড়ন ব্যতিরেকে পেঁয়াজ, রশুন অথবা হিঙ এবং তৎসহ আরও অতিরিক্ত গরম মশল্লা ফোড়ন দিয়া খিঁচুড়ি রাঁধিলে আরও গুরুপক্ব হইবে। মাষকলাইর ডালের খিচুড়িতে দুটো মৌরি ফোড়ন দেওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য এবং পেঁয়াজের পরিবর্তে তাহাতে হিঙ ফোড়ন দিতে হইবে। খিঁচুড়ি মাত্রেই পশ্চাৎ কিছু আদা ছেঁচা মিশান প্রয়োজন, বিশেষতঃ মাষকলাইর ডালের খিঁচুড়িতে আদা ছেঁচা অবশ্যই মিশাইতে হইবে।

 ইচ্ছা করিলে খিঁচুড়ির সহিত সিদ্ধের সময় গোটা আলু, গোটা পেঁয়াজ এবং কিসমিসাদি এবং সিদ্ধ পর বাটা ঝালও মিশান যাইতে পারে। অনেক দেশে খিঁচুড়িতে আরও বহু জিনিষ যথা—শশা কঁকুড়ের বীচি, নারিকেল কুরা প্রভৃতি মিশাইয়া থাকে; কিন্তু আমাদের দেশে খিঁচুড়ি বিশেষ জটিল করিয়া রাঁধা প্রচলিত নাই।


১৫৬। মুগের ডালের খিঁচুড়ি

 বালুতে ভাজা উৎকৃষ্ট সোণামুগের ডাইল দুই ভাগের সহিত এক ভাগ উত্তম মিহি চাউল (উষ্ণ বা আতপ) লও। হাঁড়িতে প্রথমে চাউল সিদ্ধ উঠাইয়া দাও। ফুটিলে তবে ডাইল ছাড়। নুণ হলুদ দাও। একটু চিনি দাও। ইচ্ছা করিলে গোটা কয়েক গোল আলু ছুলিয়া চাউল ডাইলের মধ্যে ছাড়িয়া সিদ্ধ করিতে পার এবং গোটা পেঁয়াজ ও দুটো কিসমিসাদিও ঐ সঙ্গে হাঁড়িতে ফেলিতে পার। জল এমন পরিমাণে দিবে যাহাতে অতিরিক্ত না হয় অথচ কমও না পড়ে, অর্থাৎ যাহাতে চাউল ডাইল সুসিদ্ধ হইবে অথচ খিঁচুড়ি ঝপ্‌ঝপে কিম্বা শুক্‌না শুক্‌না না হইয়া থকথকে গোছ হইবে। সুসিদ্ধ হইলে নামাইয়া অপর হাঁড়িতে ঘৃতে জিরা, তেজপাত, লঙ্কা এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ পেঁয়াজ, রশুন ও গরম মশল্লা‌ ফোড়ন দিয়া সিদ্ধ চাউল-ডাইল সম্বারা দাও। সম্বারা দিয়াই হাঁড়ির মুখ ঢাকিয়া দিবে। একটু পরে নাড়িয়া চাড়িয়া নামাও। একটু আদা ছেঁচা ও গাওয়া ঘি মিশাও।

 বাটা ঝাল মিশাইতে ইচ্ছা করিলে চাউল ডাইল সিদ্ধ পর তৎসহ জিরামরিচ বাটা মিশাইয়া লইবে।

 ঈষদম্ল দহি দিয়া মাখিয়া ভাজা মাছ, শাক ও বেগুণাদির সহিত এই খিঁচুড়ি খাইতে ভাল। বেগুণ ডুমাকারে ঘৃতে ভাজা হইলেই ভাল হয়।

 খিঁচুড়িতে চাউল অপেক্ষা ডাইলের ভাগ অধিক (দ্বিগুণ) হইলে তবে আস্বাদন ভাল হয়।

১৫৭। মাষকলাই ডাইলের খিঁচুড়ি

 মুগ অপেক্ষা অনেকে মাষকলাইর ডাইলের খিঁচুড়িই অধিক সুস্বাদু বিবেচনা করেন। অবশ্য ইহা ব্যক্তিগত রুচির উপর নির্ভর করে। ইহাতেও বালুতে ভাজা দুই ভাগ উৎকৃষ্ট মাষকলায়ের ডালের সহিত এক ভাগ চাউল লইবে। ডাইল আগে সিদ্ধ উঠাইয়া দাও। ফুটিলে চাউল ছাড়। নুণ হলুদ দাও, একটু চিনি দাও। সুসিদ্ধ হইলে নামাইয়া রাখ। মাষকলায়ের ডালের খিঁচুড়ি একটু ঢল্‌ঢলে গোছ থাকিবে। অপর হাঁড়িতে ঘৃতে জিরা, তেজপাতা, লঙ্কা, মৌরি এবং ইচ্ছা করিলে তৎসহ কিছু হিঙ ফোড়ন দিয়া সিদ্ধ চাউল-ডাইল সম্বারা দাও। ফুটিলে নামাইয়া আদা ছেঁচা ও গাওয়া ঘি মিশাও। এই খিঁচুড়ির সহিতও আলু এবং জিরা-মরিচ বাটা মিশাইতে পার।

 এই খিঁচুড়িও ঈষদম্ল দধি ও ঘৃত দিয়া মাখিয়া মটর শাক ভাজা ও ঘৃতে ডুমা-কুটা বেগুণ ভাজা দিয়া খাইতে ভাল।

১৫৮। মশুর ডাইলের খিঁচুড়ি

 মুগের ডাইলের খিঁচুড়ির ন্যায়ই ইহা রাঁধিবে। ইহাতে পেঁয়াজ, রশুন ফোড়ন দিলে তবে ইহার স্বাদ উত্তম হইবে। ইহাতেও জিরা-মরিচ বাটা মিশাইতে পার।

১৫৯। অরহর ডাইলের খিঁচুড়ি

 মুগের ডাইলের খিঁচুড়ির ন্যায় ইহাও রাঁধিবে। ইহাতেও পেঁয়াজ বা হিঙ এবং অধিক পরিমাণে লঙ্কা ফোড়ন দিলে তবে ইহার স্বাদ উত্তম হইবে। ইহাতে ঘৃত কিছু অধিক পরিমাণে দেওয়া প্রয়োজন।

 অরহর ডাইলের খিঁচুড়ি প্রায় বাটা ঝাল দিয়া রাঁধা হইয়া থাকে। লঙ্কা ও জিরা-মরিচ বাটা চাউল ডাইল সিদ্ধ করিবার পরে মিশাইবে। এই খিঁচুড়িও ঈষদম্ল দধি মাখিয়া খাইতে ভাল।

১৬০। ভুনি খিঁচুড়ি

 মুগের ডালেরই ভুনি খিঁচুড়ি উওম হইয়া থাকে। ঘৃতে পেঁয়াজ কষাইয়া লাল করিয়া উঠাইয়া রাখ। জিরা, তেজপাত, লঙ্কা ও গোটা গরম মশল্লা ফোড়ন দিয়া ডাল ছাড়। আংসাও অর্থাৎ ভাজ। ভাজা ঠিক হইলে চাউল ছাড়। নাড়িয়া চাড়িয়া জল দাও। ফুটিলে কষান আলু বা ফুলকোবি মিশাইতে পার। নুণ হলুদ দাও। একটু চিনি দাও। সিদ্ধ হইলে উনানের উপর হইতে হাঁড়ি উঠাইয়া অল্প আঁচে দমে রাখিয়া দাও। জল মরিয়া গেলে নামাও। এক্ষণে পেঁয়াজ ভাজা, বাদাম পেস্তাকুচা ভাজা ও কিসমিস ভাজা এবং ইচ্ছা করিলে পুরা-সিদ্ধ পক্ষীডিম্ব কাটিয়া উপরে ছড়াইয়া দিয়া পরিবেশন কর।

 ইহার সহিত কোন প্রকারের (বৈদেশিক) শুষ্ককারি যথা ‘কাণ্ট্রি-কাপ্তান কারি’ এবং কাবাবদি খাইতে ভাল।

১৬১। চিড়ার খিঁচুড়ী (বারাণসী)

 উত্তম মিহি চিড়া লও। দহি, গরম মশল্লার গুঁড়া, আমের চূণা ও নুণ দিয়া মাখিয়া ঢাকিয়া রাখ। এক্ষণে মটরশুটী, আলু, বেগুণ ও ফুলকোবি লইয়া, মটরশুটী বাদে অপর আনাজগুলি কুচি কুচি করিয়া কুট। কড়াতে ঘৃতে সা-জিরা (অথবা জিরা) লঙ্কা, হিং ও রাই-সরিষা ফোড়ন দিয়া আনাজ ছাড়। আংসাও। হলুদ দাও। মাখা চিড়া ছাড়। সমস্ত নাড়িয়া মিশাইয়া দিয়া ঢাকিয়া দাও। মধ্যে মধ্যে ঢাকন উঠাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দিয়া পুনঃ ঢাকিয়া রাখিবে। বেশ মোলায়েম হইলে নামাইয়া গরম মশল্লা ও ঘৃত মিশাও। ইহাতে আদৌ জল দিতে হইবে না, বেগুণ ও ফুলকোবি কুচা হইতে আংসান কালে যে জল বাহির হইবে ঢাকিয়া আংসাইবার নিমিত্ত ঐ জলেই চিড়া যথেষ্ট সিদ্ধ হইয়া যাইবে।