বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৩

উইকিসংকলন থেকে

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ কুমিল্লা-নোয়াখালী-ঢাকা

শিরোনাম উৎস তারিখ
৩। ৪র্থ বেঙ্গল ও অন্যান্য বাহিনীর কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধ সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৪-১৯৭৫[] ১৯৭১

 ১৯শে মার্চ ১৯৭১ আমাকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হেড অফিস কুমিল্লাতে বদলী করা হয়। আমি ২২শে মার্চ আমার পরিবারকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে রেখে কুমিল্লা চলে যাই। এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টে গিয়ে যোগদান করি। ইউনিটে পৌঁছার সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম আমার সৈনিকরা বেশ উদ্বিগ্ন। আরো জানতে পারলাম পাঞ্জাবীদের কমাণ্ডো এবং গোলন্দাজ আর্টিলারি বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেণ্টের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে মেশিনগান লাগিয়ে অবস্থান নিয়েছে। নির্দেশ পেলেই সবাইকে হত্যা করবে। পাঞ্জাবীরা সেনানিবাস রক্ষার অজুহাতে এসব পরিকল্পনা নিয়েছে। পাঞ্জাবীদের কার্যাবলীতে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকদের মনে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছিল। আমি পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা জানতে চায় এখন তাদের কি কর্তব্য? আমি সকলকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে এবং আত্মরক্ষার্থে প্রহরী দ্বিগুন করার নির্দেশ দিয়ে তাদের শান্ত করি। পরের দিনে ২৩শে মার্চ ছুটির দিন ছিল। ২৪শে মার্চ সকাল ৭টায় আমি প্রথম অফিসে রিপোর্ট করি লেফট্যাণ্ট কর্নেল খিজির হায়াত খানের কাছে। তিনি চতুর্থ বেঙ্গল কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন এবং পাঞ্জাবী ছিলেন। লেফট্যাণ্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে আমার পোষ্টিংয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। এবং ইউনিট সম্বন্ধে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলেন। ঐদিনই আমি যখন আমার অফিসে সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড উপ-প্রধানের কাজ বুঝে নিচ্ছিলাম সকাল প্রায় সাড়ে দশটায় তখন খিজির হায়াত খান ডেকে পাঠালেন। আমি অফিসের ভিতর ঢুকে দেখি খিজির হায়াত খান উদ্বিগ্ন। তিনি আমাকে বসার জন্য বললেন এবং জানান যে আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়ীত্ব নিয়ে আজই কুমিল্লা থেকে রওনা হতে হবে। আমি উত্তর দিলাম যে হুকুম যদি হয় আমি নিশ্চয়ই যাব। তবে আমি একদিন হয় এসেছি এবং আমার দায়ীত্ব কেবল বুঝে নিচ্ছি, এমতাবস্থায় ইউনিটি থেকে অন্য যায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়তো আপনার পক্ষে ভুল হবে। তাকে আরো বুঝাতে চেষ্টা করলাম ব্যাটালিয়ানে আরো অফিসার আছে, তাদেরকেও পাঠানো যেতে পারে। তাছাড়া ইউনিটি প্রধানকে সাধারনতঃ এভাবে পাঠানো হয় না। আমার বক্তব্য শুনে তিনি বললেন ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ন সে জন্য তোমাকেই যেতে হবে। আমি যানতে চাইলাম আমাকে কি ধরনের দায়ীত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। কর্নেল খিজির হায়াত খান বললেন যে খবর এসেছে সিলেটের সমসের নগর নামক জায়গায় নক্সালপন্থীরা বিশেষ তৎপর রয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করছে আরো খবর আছে ভারত থেকে বেশ অনুপ্রোবেশও হচ্ছে। এই সব কারনে আমাকে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী নিয়ে সেখানে যেতে হবে। এবং তাদের দমন করতে হবে। আমি জবাব দিলাম একটা কোম্পানী যখন যাবে তখন কোন জুনিয়র মেজরকে সেখানে পাঠানো যেতে পারে। সাধারণত উপ-প্রধান একটা কোম্পানী নিয়ে কখনও যায় না। আমার বক্তব্য খিজির হায়াত খান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। এবং আমাকে বললেন, ঠিক আছে আপনি যান এবং আমি আপনাকে একটু পরে ডেকে পাঠাব। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আবার আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ব্রিগেড কমাণ্ডারের কাছে ইকবাল শফি এখনই আপনাকে ডেকেছেন। আমাকে নিয়ে কর্নেল খিজির হায়াত ব্রিগেড কমাণ্ডারের কাছে গেলেন। ব্রিগেড কমাণ্ডার আমাকে দেখেই বললেন আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যা একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ সম্পন্ন করতে পারবে না এবং সেই জন্য আমি তোমাকেই নির্বাচিত করেছি। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। তিনি আরো বললেন, তোমার মত একজন সিনিয়র আফিসাকে এই জন্য মনোনিত করা হয়েছে। আমি ট্রপস ছাড়া শমসেরনগরে ইপিআর-এর একটি কোম্পানী আছে। এই বড় ফোর্স এর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র বাঙ্গালী অফিসারের দরকার। তুমিই একমাত্র বাঙ্গালী অফিসার কুমিল্লাতে যাকে আমি এ ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারি।

 আমি বুঝতে পারলাম যেতে আমাকে হবেই। উপায় যখন আর নেই তখন যতটুকু তাদের কাছে আদায় করে নেয়া যায় সেটুকুই আমার পক্ষে মঙ্গল। আমি ব্রিগেডিয়ার শফিকে বললাম, যে কাজের ভার আমাকে দিচ্ছেন শুধু একটা কোম্পানী দিয়ে তা হবে না। কোম্পানীর চেয়ে বেশী সৈন্য আমাকে দেয়া হোক। আর হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটা শক্তিশালী ওয়ারলেস দেওয়া হোক। এছাড়া যেহেতু আমি অনেক দুরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছি। সেহেতু আমার ট্রপস এর জন্য স্বয়ংক্রিয় ভারী এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টার ইত্যাদি এবং যথেষ্ট পরিমান গোলাবারুদ দেয়ার অনুমতি দেয়া হোক। ব্রিগেডিয়ার শফি প্রথমে বললেন, তোমাকে যে কাজের জন্য পাঠান হচ্ছে, তাতে এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে না। আমি উত্তরে বললাম যে, আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার কথা চিত্রিত করেছেন তাতে আমার সামরিক জ্ঞান অনুসারে এই সমস্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্রের দরকার হবে বিশেষ করে যেখানে হেড কোয়ার্টার থেকে তাড়াতাড়ি সাহায্য পাবার আশা কম। আমার বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি কনভিনসড হলেন এবং কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দিলেন আমার যা প্রয়োজন তা যেন আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বিগ্রেডিয়ার শফির কাছ থেকে ইউনিটে ফিরে এলাম। এসেই ব্যাটালিয়নের এডজুট্যাণ্ট ক্যাপ্টেন গফফারকে (এখন মেজর) ডেকে নির্দেশ দিয়ে দিলাম সমস্ত ব্যাটালিয়ন থেকে বেছে বেছে ২৫০ জনের মত সৈন্যকে আলফা কোম্পানীতে একত্রিত করার জন্য।

 গফারকে বলে দিলাম যে, ব্যাটালিয়নের ভারী অস্ত্রশস্ত্র যতো আছে সব নিয়ে নাও। গোলাবারুদ এমন ভাবে নেবে যাতে একমাস যুদ্ধ করা যায়। আমাদের ২৬টা গাড়ী ব্রিগেড থেকে দেওয়া হয়েছিল। সব বোঝাই করতে এবং অস্ত্রশস্ত্র ও সৈনিকদের তৈরী করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এই সময় আমি একটা অস্বাভাবিক ঘটনা দেখতে পাই। যতোক্ষণ পর্যন্ত আমি এবং আমাদের লোকজন প্রস্তুত হচ্ছিলাম ততক্ষণ পর্যন্ত খিজির হায়াত এবং অন্যান্য ব্রিগেড স্টাফ এর অফিসাররা বসে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

 আমি ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যাওয়ার জন্য তৈরী হই। ব্যাটালিয়নে যে সমস্ত বাঙ্গালী অফিসার থেকে গেল তারা সবাই আমার যাবার পূর্বে মেসে এসে দেখা করে গেল। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) তাকে আমি এই উপদেশ দিলাম যে আমি চলে যাচ্ছি, এতে ঘাবড়াবার কিছু নাই। এখন তুমিই সিনিয়র। যদি কোনো অঘটন ঘটে তাহলে এই ৪র্থ বেঙ্গল এর বাকী ট্রপস এর নিরাপত্তার পুরা বন্দবস্ত করবে এবং যদি প্রয়োজন হয় যুদ্ধ করে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে শমসেরনগরের পথে রওনা হলাম। রাত প্রায় ২টা আরাইটার সময় বি-বাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলাম। সেখানে রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড। এই প্রতিবন্ধকতার জন্য আমাদের এগোতে অসুবিধা হচ্ছিল। এই ব্যারিকেড ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শহরের দিকে এগোচ্ছিলাম। শহরের কিনারে যে পুল আছে (নিয়াজ পার্কের কাছে) সেখানে বি-বাড়িয়ার ছাত্র জনতা আমাদের বাধা দেয়। হাজার হাজার লোক এবং ছাত্র রাস্তায় শুয়ে পড়ে এবং বলে যেতে দেওয়া হবে না। আমি সেখানকার নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলতে চাইলাম। ওখানেই আওয়ামী লীগের তদানীন্তন এমসিএ সাচ্চু মিয়া এবং অন্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রনেতারা আমাকে জানান যে, পূর্ব বাংলার অনেক যায়গায় পাকসেনারা আবার গুলি চালিয়েছে এবং মিলিটারী চলাচল কেন্দ্রীয় নির্দেশে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। তারা আরও বলেন আপনাদের বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে কুমিল্লা থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে এবং আমরা আপনাদের যেতে দেব না। এই ভাবে কয়েকঘণ্টা কথাবার্তা হয়। ইতিমধ্যে মেজর শাফায়াত জামিল (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), যিনি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের আর একটা কোম্পানীসহ বি-বাড়িয়াতে অবস্থান করছিলেন, তিনিও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তিনিও তাদের বুঝাতে চেষ্টা করলেন যাতে ব্যারিকেড এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু তাতেও তারা আমাদের অনুরোধ রাখতে রাজী হয় না। তারপর তাদের নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিলের ক্যাম্পে যাই। সেখানে আবার কথাবার্তা চলে এবং তাদের আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই যে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বাংলাদেশেরই রেজিমেণ্ট, যখন দরকার পড়বে বাঙ্গালী জাতির জন্য পিছিয়ে থাকবে না। এমতাবস্থায় আমাদের বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। অবশেষে সকাল সাড়ে পাঁচটায় সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদেরকে আর বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা শমসেরগনের পথে আবার ২৫শে মার্চের সকালে রওনা দিলাম। যাওয়ার আগে মেজর শাফায়াত জামিলকে আলাদা ডেকে সতর্ক করে দিলাম এবং আমার সঙ্গে অয়ারলেস মারফত যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দিয়ে গেলাম। আমি সকাল দশটা এগারটার সময় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছি। সেখান থেকে শমসেরনগর যাবার রাস্তা আমার জানা ছিল না। ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, শমসেরনগর যেতে হলে মৌলভীবাজার হয়ে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গলে কনভয় দার করিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করি শমসেরনগরে যাওয়ার রাস্তা সম্ভন্ধে এবং জানতে পারি মৌলভী বাজার হয়ে যাওয়া যায় অথবা আর একটা রাস্তা আছে সোজা শ্রীমঙ্গল হয়ে জঙ্গল এবং পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এই রাস্তা অপেক্ষাকৃত কম দুরত্বের আমি এই সোজা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে শমসেরনগরের পথে রওনা হলাম। যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে রাস্তা পরিত্যাগ করে পাহাড়ের পথ দিয়ে রওনা হলাম এই রাস্তা খুব খারাপ ছিল তাই অতি কষ্টে দুপুর ২টার সময় শমসেরনগরে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে যেয়ে ডাকবাংলোতে আমি আমার ছাউনি স্থাপন করি।

 দুপুরে খেয়ে আমি এবং লে. মাহবুব শমসেরনগরের চারদিকে ঘুরে দেখে আসি দেখি পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কিছু পেট্রোল পার্টি চতুর্দিকে পাঠিয়ে দিই। স্থানীয় ব্যাক্তিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে যানতে পারি কোন অঘটন সেখানে ঘটেনি। ইপিআর এর যে দুটো কোম্পাণীর কথা আমাকে বলা হয়েছিলো। তাদের কোন পাত্তা নেই। ইপিআরএর একজন সুবেদার এবং আরো কয়েকজন সিপাই শমসেরনগর এয়ারপোর্টে অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক কোন উত্তর পাইনি। শমসের নগরের টি গার্ডেন গুলো ঘুরে জানতে পারলাম। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ম্যানেজার এবং অফিসাররা ঢাকায় চলে এসেছে। নক্সালপন্থী বা অনুপ্রবেশকারীদের কোন চিহ্ন আমি খুজে পেলাম না। ২৫শে মার্চের রাতটা এভাবে খবরাখবর নিয়ে এবং পেট্রোলিং করে কেটে গেল। সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোড়ালো মনে হলো। আমার মনে জাগল আমাকে এখানে কৌশল করে পাঠানো হয়েছে। এবং যা কিছু তারা বলেছিল, তা সবই মিথ্যা। আমি সমস্ত সকাল অয়ারলেসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি কিন্তু কোন যোগাযোগ হল না। এই ভাবে দুপুর পর্যন্ত চলে যায়। আমি এবং লে. মাহবুব ডাকবাংলোর বারান্দায় বসেছিলাম। হঠাৎ আমাদের এসে খবর দেয় এক পাঞ্জাবী অফিসার এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য শমসেরনগরের বাজারে এসেছে এবং সেখানে কারফিউ জারি করে স্থানীয় জনসাধারনের উপর অত্যাচার করছে। সেই দলটি আমাদের ক্যাম্পের সম্মুখে দিয়ে মৌলভীবাজার যাচ্ছিল। আমাদের সেণ্ট্রিকে সেই দলটির অফিসারকে ডাকার জন্য পাঠাই। এরা যখন সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন সেণ্ট্রি তাদের আমাদের ক্যাম্পে আসার অনুরোধ জানায়। অফিসারটি ক্যাম্পের ভিতরে আসে এবং আমার সেখানে উপস্থিতি সম্বন্ধে আশ্চর্যবোধ করে। এমন ভাব দেখায় যে আমর এখানে আছি এটা সে জানত না। কথাবার্তায় আমি জানতে পারি যে ৩১ পাঞ্চাব রেজিমেণ্টের বেশ কিছু সৈন্য সিলেট থেকে মৌলভীবাজার এসে দুই দিন আগে ক্যাম্প করেছে। অফিসারের হাবভাব এবং কথাবার্তা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। যতক্ষন সে ডাকবাংলোয় বসেছিলো ততক্ষন সে স্টেনগানটি কোথাও না রেখে নিজের হাতে রাখে। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। এদের আগমন সম্বন্ধেও আমাকে অবহিত করা হয়নি। এটাও অত্যান্ত অস্বাভাবিক কিছুক্ষণ পরে অফিসারটি তার দলবল নিয়ে চলে যায়। এবং যাওয়ার আগে আমাদেরকের পাঞ্জাব রেজিমেণ্টে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমি যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে অফিসারটিকে বিদায় করলাম।

 সেই দিনই বিকেলে স্থানীয় জনসাধারণের মুখে আমি জানতে পাই ঢাকাতে কিছু একটা ভয়ংকর অঘটন ঘটেছে। কিন্তু কেউ সঠিক কিছু বলতে পারে না। আস্তে আস্তে লোকমুখে আরও শুনতে পাই যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনীর হাজার হাজার লোক গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং মারছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গাতেও পাক বাহিনী সেই রূপ নৃশংস অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার লোক ঢাকা ছেড়ে জান বাঁচানোর জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে। পাক সেনাবাহীনী ট্যাংক, কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্দোষ, নিরীহ, নিরস্ত্র জনসাধারনের উপর বর্বরচিতভাবে অত্যাচার করছে। ঢাকা শহর একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আমি অনেক্ষণ বসে থেকে চিন্তা করতে থাকলাম আমার এখন কর্তব্য কি। অয়ারলেস সেট খোলার হুকুম দিয়ে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেক চেষ্টার পরও কোন যোগাযোগ হল না। তবুও আবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বললাম। অনেক্ষণ পর আমাকে লে. মাহবুব এসে খবর দিল যে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে অতি কষ্টে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম অয়ারলেসে কথা বলার জন্য। যখন আমি কথা বলতে চাই, তখনই অপরদিক থেকে কর্নেল খিজির হায়াত কিংবা ক্যাপ্টেন আমজাদ পাঞ্জাবী জবাব দেয়। তাদের কাছে কোন কথাই খুলে বলা সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম কর্নেল খিজির হায়াত এবং চতুর্থ বেঙ্গল এর বাকী অংশ কুমিল্লা থেকে ২৫ তারিখে বি- বাড়িয়া এসেছে। কর্নেল খিজির হায়াত আমাকে জানালেন সব কিছু স্বাভাবিক এবং তিনি আরো জানালেন যে অতি সত্বর তিনি একবার শমসেরনগর পরিদর্শনে আসবেন। আমি তাকে জানালাম এখানে সব শান্ত এবং আমার এখানে থাকার কোন প্রয়োজনই নাই এবং আমাকে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হোক। তিনি জবাবে আমাকে শমসেরনগরেই থাকতে আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পর আমি আবার অয়্যারলেসে কথা বলার চেষ্টা করি। এবার ক্যাপ্টেন গাফফারের (এখন মেজর) সঙ্গে কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের নিকটে কোন পাঞ্জাবী অফিসার আছে। সেজন্য সব কথা খুলে বলতে পারছিল না। আমি শুধু বললাম যখন সুযোগ পাবে তখন মেজর শাফায়াত জামিলকে (বর্তমানে লে. কর্নেল) আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে। আরো কিছুক্ষণ পরে মেজর শাফায়াত জামিল আমার সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলেন এবং জানালেন ঢাকাতে পাক সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখনো ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কথা চলছিল ২৬শে মার্চের সন্ধ্যা বেলায়। শাফায়াত জামিল লোকমুখে শুনেছেন যে সব লোক ঢাকা থেকে পালিয়ে কুমিল্লার দিকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর শাফায়াত জামিল এবং ক্যাপ্টেন গাফফার আরো জানান যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও সান্ধ্য আইন জারি করা হইয়াছে এবং ৪র্থ বেঙ্গলকে এটা কার্যকরী করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসাধারন সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছে। এমতাবস্থায় তাদের করণীয় কি তা আমার কাছে জানতে চাইলেন।

 আমার পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন ছিল। আমি প্রায় ১০০ মাইল দুরে অবস্থান করছি। সমস্ত বাংলাদেশে আর কোথায় কি হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না। ঢাকা শহরে পাক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে এবং আরো অনেক জায়গাতেও করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই মুহুর্তে কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই যে তাদের কাছে কোন উপদেশ নেব। একদিকে সামরিক শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যবোধ অন্যদিকে বিবেকের দংশন আমাকে পীড়িত করছিল। এই উভয় সংকটে পড়ে আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলি। মেজর শাফায়াত জামিলকে বললাম, আমাকে কিছুটা সময় দাও, আমি কিছুক্ষণ পরে বলব এবং সঙ্গে সঙ্গে বললাম কোন মতেই যেন গুলি চালানো না হয়। লোকজনকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা কর। চিন্তায় আমি আমার কামরার চতুর্দিকে পায়চারি করতে শুরু করলাম এবং এমন অবস্থায় চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি বসে পরলাম এবং লে. মাহবুবও (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) সেখানে বসে ছিল। আমার সঙ্গে যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ছিল। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল অবশেষে আমার বিবেক আমাকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। এই অণ্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। যদিও কোন রাজনৈতিক নির্দেশ সেই মুহুর্তে ছিল না তবুও বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের ঘোষনার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন “এবার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আমি লে. মাহবুবকে ডেকে বললাম যে এই মুহুর্তে আমি স্বাধীন বাংলার আনুগত্য স্বীকার করলাম। এখনই সব সৈনিকদের বলে দাও আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত নই। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দাও। এখন থেকে আমরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করবো। সব সৈনিকদের তৈরী হতে বল। এখান থেকে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দেব এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে ব্রাহ্মণবারিয়াতে একত্রিত করতে হবে। লে. মাহবুব যেন এই নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। সে দৌড়ে গিয়ে সবাইকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরেই আমি শুনতে পেলাম বঙ্গশার্দুলদের শ্লোগান “জয় বাংলা”। আমি তাদেরকে প্রথমে শান্ত করলাম এবং বুঝিয়ে দিলাম আমাদের এখন থেকে যে সংগ্রাম শুরু হল সেটা কঠিন এবং বিপদসংকুল। সকলেই নিজেকে স্বার্থের উর্ধ্বে রেখে দেশ ওজাতির এবং বাংলাদেশ সরাকরের জন্য আত্মিয়স্বজন, আর্থিক কষ্ট এবং সব কিছু সুবিধা ত্যাগ করে আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি দেখতে পেলাম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকরা সবাই দৃঢ় সংকল্পে থেকে আত্মত্যাগের মনভাব নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রথমে অয়ারলেসে মেজর শাফায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তাকে নির্দেশ দিই যেন সেও তৈরী থাকে। তাকে আরো বললাম, কুমিল্লার রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে। তাকে আরো বললাম যে আমি অতি শিগগিরই ব্রাহ্মণবারিয়াতে পৌঁছব। ইতিমধ্যে আমার সমস্ত লোক ব্রাহ্মণবারিয়াতে রওনা হবার জন্য তৈরী হয়ে যায়। আমি লে. মাহবুবের সঙ্গে কিছুক্ষসংখ্যক সৈন্য দিয়ে শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়ে দেই এবং সেখানে ডিফেন্স নিতে নির্দেশ দিই যাতে আমাদের যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট এসে বাধা দিতে না পারে। শমসেরনগর থেকে জঙ্গলের পথে রাত বারোটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে রওনা হয়ে যাই। রাস্তায় আমাদের অগ্রসর অনেক ধীর ছিল। কারণ সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড এবং কোন কোন জায়গায় রাস্তা কেটেও দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গলের অনেক জায়গায় বিরাট গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই সব প্রতিবন্ধক আমাদেরকে কেটে কেটে বা মাটি ফেলে পরিস্কার করে অগ্রসর হতে হবে। সব প্রতিবন্ধকের কাছেই অনেক লোক লুকিয়ে দেখছিল আমরা কি করি। যখনই তারা বুঝতে পারত আমরা বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ঢাকার দিকে বা ব্রাহ্মণবারিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তখনই তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলতে এবং রাস্তাঘাট পরিস্কার করতে সাহায্য করত। তাদের সহায়তায় এবং সক্রিয়তায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল কম সময়ের মধ্যে এগিয়ে যাবার। এভাবে অতি মন্থর গতিতে এগোতে এগোতে আমি ভোর পাঁচটায় সাতছড়িতে পৌঁছলাম। এখানে আমার সৈনিকরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এখানে এসে আমি আবার অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাক্ষণবারিয়াতে যোগাযোগ করি। ঐ অবস্তাতে কর্নেল খিজির হায়াতের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমাকে আশ্বাস দেন যে সেখানে সব কিছু ঠিকঠাক। মেজর শাফায়াত জামিলও আমার সঙ্গে কথা বলে। সে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জানতে চায় আমি কোথায় এবং আসতে কেন দেরী হচ্ছে। আমি বললাম ভয়ের কোন কারন নেই কেননা আমি অনেক কাছে এসে গেছি। তাকে আশ্বস দিয়ে আবার রওনা হই। সকাল ৬টায় ব্রাহ্মণবারিয়া থেকে দশ মাইল দুরে মাধবপুরে পৌঁছি। এবং মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে অয়্যারলেসে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান, সকাল দশটার সময় কর্নেল খিজির হায়াত একটা কনফারেন্স ডেকেছেন (আমি পরে জানতে পারি যে কুমিল্লা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট এর একটা কোম্পানী সেই সময়ে আসছিল।) কনফারেন্সের কথা যখন আমি শাফায়াতের কাছে শুনতে পেলাম তখন আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে যাই এবং তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠি। আমি শাফায়াতকে তখনই নির্দেশ দিই আমার জন্য অপেক্ষা কর না। প্রয়োজন হলে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসারকে কর্নেল খিজির হায়াতসহ গ্রেফতার করে ফেল এবং যত পাঞ্জাবী সৈনিক আছে নিরস্ত্র কর। আমি আবার রওনা হয়ে গেলাম। পরে শুনতে পেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কি হয়েছে। দশটা বাজার দশ মিনিট আগে কর্নেল খিজির হায়াত মেজর নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন আমজাদ কনফারেন্সে বসেছিল। এমতাবস্থায় মেজর শাফায়াত জামিল লে. কবির (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) লে. হারুন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) হঠাৎ সেই কামরায় প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাবী অফিসারদের তাদের অস্ত্র সমর্পন করার নির্দেশ দেন। মেজর নেওয়াজ জিনি নিজে একজন কমাণ্ডো ছিলেন তিনি কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু লে. হারুন ত্বরিত প্রচেষ্টায় তার সে চেষ্টা ব্যার্থ হয় এবং সব পাঞ্জাবী অফিসারকে তারা বাংলাদেশের নামে গ্রেফতার করে। ইতিমধ্যে বাকী বঙ্গশার্দুলরা বাইরে যে সব পাঞ্জাবী সৈনিক ছিল, তাদের নিরস্ত্র করে এবং যারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ২৭শে মার্চ। ইতিমধ্যে আমি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার অতি সন্নিকটে এসে গেছি। আমার বাহিনী এবং শাফায়াতের বাহিনী বেলা ১১টার দিকে সম্মিলিত হয়। আমি বুঝলাম আমার প্রথম কর্তব্য হল যে সমস্ত এলাকা মুক্ত হয়েছে তা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। আমি প্রথমেই অফিসারদের নিয়ে একা বৈঠক করি এবং এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে কার্যকরী করতে হবে তার সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা জানাই। আমার এই পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমরা মেঘনা নদীকে উত্তরে রেখে পশ্চিম প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করব এবং দক্ষিনে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করব এবং দক্ষিণে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত করব। উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষার বন্দোবস্ত করব। উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে সিলেটে আর একটি ঘাটি স্থাপন করব।

 এই পরিপ্রেক্ষিতে ভৈরববাজারে প্রথম দুটো কোম্পানী পাঠিয়ে দিই। আর একটা পার্টিকে কুমিল্লার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অগ্রসর হতে বলি। মেঘনার পূর্ব পারে একটা প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরীর ব্যবস্থা করি। এছাড়া ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চতুর্দিকে তিতাস নদীর চতুর্দিকে একটা আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করি। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে একটা কোম্পানী দিয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবার জন্য পাঠিয়ে দেই। শ্রীমঙ্গলে তাদের সাথে স্থানীয় সংগ্রামী আনসার, মুজাহিদ এবং আরো কিছুসংখ্যক সৈন্য কর্নেল রবের নেতৃত্বে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) যোগ দেয়। এই দলটির সাথে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের যে সব সৈন্য মৌলভীবাজারে ছিল তাদের সাথে লড়াই হয় এবং পাঞ্জাবীরা অনেক হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরে মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যায়। সিলেট শহর পর্যন্ত তাদেরকে ধাওয়া করা হয়। ব্রাহ্মণবারিয়াতে আমি বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব রকিব। তিনি অত্যান্ত উৎসাহী, সাহসী এবং সংগ্রামী ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বেসামরিক সাহায্যের যতটুকু প্রয়োজন ছিল যেমন রসদ সরবরাহ, যানবাহন যোগার, সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, আর্থিক সাহায্য তিনি অত্যন্ত উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে করেছেন। তিনি পুলিশ অয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমস্ত জেলা এবং মহকুমা প্রশাসকদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন যে, মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট স্বাধীনতা যুদ্ধ করছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকা শত্রুমুক্ত করেছে। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার সাথে জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, সাচ্চু মিয়া প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এবং তাদেরকে আমি আমার বাংলাদেশ সরকারের সাথে আমার আনুগত্যের কথা বলি। তারা আমাকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করেন। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কিভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করা যায়। আমি তাদের অনুরোধ জানাই, যে কোনো উপায়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে যদি কোনো অস্ত্রশস্ত্র আনার বন্দোবস্ত করতে পারেন তাহলে আমি আমার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো সুন্দর ও শক্তিশালী করতে পারি। আমি তখন জানতাম যে, আমার কাছে যা গোলাবারুদ আছে তা নিয়ে বেশী দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তারা এই বার্তা নিয়ে আগরতলাতে চলে যান।

 এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমান পাঞ্জাবী সৈন্যদের সাথে আমার অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। এতে পাকিস্তানীরা অনেক হাতাহত হয়ে আবার কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ২৯শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে শত্রুসেনা প্রথম বিমান হামলা চালায়। এতে আমার একজন সৈনিক শহীদ হন। সেদিনই সন্ধ্যায় পাকিস্তানীদের একটা রেকি পার্টি (তথ্য অনুসন্ধানী দল) একজন অফিসার এবং ৮ জন সিপাহী সহ ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে আসে। এই দলটি আমাদের অগ্রবর্তী ঘাটির এ্যামবুশে পড়ে যায় এবং অফিসারসহ সব শত্রুসেনা এবং একখানা গাড়ী ধ্বংস করে দিই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর বিমান হামলা আরো চলতে থাকে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা আরো অধিকতর শক্তিশালী হতে থাকে। আমি এই অবস্থাতে ভৈরব বাজার এবং নরসিংদীর ভিতরের রেলওয়ে লাইন অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিই এবং আর একটা দলকে নরসিংদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিই। আমার এই দলটির সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত আর একটি সাবেক ইপিআর এবং দ্বিতীয় বেঙ্গলের কিছু সৈন্যের যোগাযোগ স্থাপন হয়। এই সম্মিলিত দলটি ঢাকা থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান এক বিরাট বাহিনীকে অ্যামবুশ করে পর্যুদস্ত করে এবং ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।  আমাদের তখনো বাইরে আর কোন প্রতিষ্ঠান বা বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর আর কোন দলের সাথে যোগাযোগ হয়নি। অন্যান্য জায়গা সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম।

 আমি জানতে পাই যে মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে এসে তার দ্বিতীয় বেঙ্গলকে একত্রিত করেছে। আমি আরো জানতে পারলাম যে, সে তার মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাবার পরিকল্পনা করেছে। এই সংবাদে আমি অতিশয় উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারণ আমি জানতাম ঢাকাতে পাকিস্তানীদের অন্ততপক্ষে দুটো ব্রিগেড সৈন্য আছে। তাছাড়া সাঁজোয়া বাহিনীর ট্যাংক, গোলান্দাজ বাহিনীর কামান এবং বিমান বাহিনী আছে। এসব অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আধুনিক মরনাস্ত্রে সজ্জিত। বিরাট পাক সেনার বিরুদ্ধে অল্প সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করার মানেই ছিল আমাদের শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা। আমার সঙ্গে মেজর সফিউল্লাহর যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত কোন সরাসরি রাস্তা না থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ তার সঙ্গে যোগাযোগ করা খুবই প্রয়োজন। তা না হলে এ সর্বনাশকে কিছুতেই রোধ করা যাবে না। অনেক চেষ্টার পর আমি একটা খালি রেলওয়ে ইঞ্জিনের ব্যবস্থা করলাম। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সেই ইঞ্জিনে বসিয়ে সোজা কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দিলাম। তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলাম। কোন কিছু করার আগে তিনি যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং সম্ভব হলে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাই।

 এরপর ক্যাপ্টেন মাহবুব ফিরে এসে জানায় মেজর সফিউল্লাহ এবং সমস্ত সেনাদল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর সফিউল্লাহ তার বাহিনীকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন এবং তিনি আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমাদের দুটো দলের যোগাযোগ হওয়াতে আমাদের শক্তি ও মনোবল বেড়ে যায়। এরপর আমরা বসে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনা করি। আমরা জানতে পারি যে, পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আমরা পাকিস্তানীদের আকমণের কৌশল সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করি এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের উপর বিমান, হেলিকপ্টার এবং নদী পথে ঢাকার দিক থেকে আক্রমন করতে পারে। নদী পথে আক্রমণ করার জন্য তারা মেঘনার পথে গানবোটে আসতে পারে এবং মেঘনার দক্ষিণ পাড়ে ল্যাণ্ডিং করতে পারে এবং সাথে সাথে হেলিকপ্টারযোগেও কমাণ্ডো এবং শত্রুবাহিনী নামাতে পারে।

 যে বিস্তীর্ন মুক্ত এলাকা আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল, সে সব এলাকাতে সৈন্য রাখার মতো আমার কাছে সৈন্য ছিল না। সেই জন্য আমি আমার ট্রুপসকে যেখানে পাক বাহিনীর অবতরণের এবং আক্রমণের বেশি সম্ভাবনা, সেই জায়গাগুলোতে ডিফেন্স নেওয়ার বন্দোবস্ত করি। এই সময়ে আমি জানতে পাই ৪র্থ বেঙ্গল এর জনা পঞ্চাশেক সৈন্য যারা কুমিল্লার দক্ষিণে জাঙ্গালিয়া ইলেকট্রিক গ্রীড স্টেশনে প্রহরায় ছিল সেই সব সৈন্যরাও ২৫শে মার্চের পর নিকটবর্তী একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে এবং আমার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। আমি এই অবস্থাতে তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে দেই এবং তাদেরকে আরও দক্ষিণে যেয়ে লাকসাম এবং কুমিল্লার মধ্যখানে লালমাই হিলের মধ্য প্রান্তে টেম্পল পাহাড় নামক এক জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ার নির্দেশ দিই। তাদের উপর এই নির্দেশ দিলাম যে, কুমিল্লা থেকে পাক বাহিনী লাকসাম, নোয়াখালী কিংবা চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হলে তাদের যেন এ্যামবুশ করা এবং বাধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমি খবর পাই আখউড়া, কসবা, বুড়িচংখেলাতে পাকিস্তানী সেনা ইপিআর পোস্টগুলোতে বাঙ্গালী ইপিআরদের বিরুদ্ধে এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে (বর্তমানে মেজর) পাঠাই কিছু লোকজন নিয়ে যাতে বাঙ্গালী ইপিআরদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে এই সব পোস্টগুলো পাঞ্জাবীদের কবল থেকে মুক্ত করা যায়। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইপিআর এবং স্থানীয় জনসাধারণের সম্মিলিত হামলায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের পর পাঞ্জাবীরা এই সব অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সব খণ্ডযুদ্ধের পর ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার গোমতী পর্যন্ত আমি সমস্ত এলাকা মুক্ত করতে সমর্থ্য হই এবং কুমিল্লা শহরের বিবিরবাজার নামক একটা জায়াগায় একটা প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।  ইতিমধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং সাচ্চু মিয়ার প্রচেষ্টায় আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের কিছু সাড়া পাওয়া যায়। সীমান্তে আমার সঙ্গে আগরতলার জেলা প্রশাসক মি. সাইগলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্বন্ধে তখনও তাদের কোন ধারণা ছিল না। আমার কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে তিনি আমাকে জানালেন যে এ সম্বন্ধে তিনি তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তাকে আমি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান। কয়েকদিন পর আবার সীমান্ত এলাকায় ভারতের সেনাবাহিনীর ৫৭তম ডিভিশনের কমাণ্ডার মেজর জেনারেল গানজালভেজ এর সঙ্গে দেখা হয়। তাকেও আমি ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিই। তখন পর্যন্ত আমরা কোনো সাহায্য পাইনি।

 এপ্রিল মাসের ২/৪ তারিখে কুমিল্লার সীমান্তে মতিনগরের নিকট কর্নেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) যখন ভারত সীমান্তে পৌঁছেন তখন আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি প্রথম আমার কাছে সংক্ষেপে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হন এবং তার পরই তিনি আগরতলাতে চলে যান। পরের দিন সন্ধ্যায় আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে কর্নেল ওসমানী আমাকে মেজর সফিউল্লাহ লে. কর্নেল রবকে (বর্তমানে মেজর জেনারেল) নিয়ে একটা বৈঠক করেন। এই বৈঠকে আমরা যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে তাকে জ্ঞাত করি। আমি তাকে আরও জানাই, আমাদের যে শক্তি আছে তা দিয়ে বেশি দিন পাকবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অতিসত্বর বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বা অন্য কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যাবস্থা করতে হবে। এছাড়া তাকে আরো অনুরোধ করা হয় আরো নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতি শিগগির আমাদের বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হউক যাতে আমরা বহির্জগতের স্বীকৃতি পাই এবং যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাই। তিনি আমাদের বক্তব্য বুঝতে পারলেন এবং আগরতলা থেকে কলকাতা চলে গেলেন। কিছুদিন পর ১৭ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে স্বীকার করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।

 এই সময় বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বিএসএফ এর ব্রিগেডয়ার পাণ্ডে আমাদের হেডকোয়ার্টার আসেন এবং আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আপ্রান চেষ্টা করেন আমাদের সহায়তা করার কিন্তু সে সাহায্য ছিল নগণ্য। আমরা চাচ্ছিলাম হালকা এবং ভারী স্বয়ক্রিয় হাতিয়ার মর্টার। কিন্তু সে সময় আমাদেরকে খুবই সামান্য ৩০৩ রাইফেল এবং সামান্য গুলি সাহায্য দেওয়া হয়। তা ছিল আমাদের দরকারের চেয়ে অনেক নগন্য। এই সময়ে ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে আমাদেরকে মেজর জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে বিস্তারিত জানান এবং একদিন মেজর জিয়াউর রহমানকে (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, পাক বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং যুদ্ধ করার জন্য তার কাছে অতি নগন্যসংখ্যক সৈন্য আছে এবং তিনি আমাকে ও মেজর সফিউল্লাহকে মেজর জিয়াউর রহমানকে কিছু সৈন্য দেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি এবং মেজর সফিউল্লাহ নিজ নিজ বাহিনী থেকে দুটো শক্তিশালী কোম্পানী গঠন করে মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট প্রেরণ করি।

 এই সময় পাকবাহিনী আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ওপর প্রবল বিমান আক্রমন চালাতে থাকে। এই আক্রমন এতই ভয়াবহ রুপ ধানর করে যে, মাঝে মধ্যে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা অনবরত স্ট্রাপিং রকেটিং এবং বোম্বিং করতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষে পাকবাহিনী বিমান বাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টার এবং গানবোটের সাহায্যে আমাদের আশুগঞ্জ পজিশনে সৈন্য অবতরণ করায়। আমাদের সৈন্যরা শত্রুদের বিমান বাহিনী এবং ছত্রীদের সম্মিলিত সাড়াশি আক্রমনের মুখে অসহায় হয়ে আশুগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পিছু হটে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত আমরা শত্রুসেনাকে ঠেকিয়ে রাখি এবং শেষ পর্যন্ত শত্রুদের সাজোয়া বাহিনী বিমান বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনে আর টিকতে না পেরে আমরা দুই রাস্তায় পিছু হটে গেলাম। আমার সৈন্যরা ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে আখাউড়াতে এসে তিতাস নদীর উপর পুনরায় প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। মেজর সফিউল্লাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে মাধবপুরের দিকে চলে যায়। পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে আসে এবং আখাউড়া আক্রমণ করে কিন্তু অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহত স্বীকার করে তারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।

 আমি এই সময়ে কুমিল্লার দক্ষিণে যে দলটি ছিল অর্থাৎ ৪ বেঙ্গলের বি কোম্পানী তাদেরকে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুলের (বর্তমানে উভয়েই ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে আরও কিছু সৈন্য পাঠিয়ে জোরদার করি।

 কুমিল্লা থেকে এপ্রিল মাসের ১৫/১৬ তারিখে পাক বাহিনীর বিরাট এক কনভয় প্রায় ৩০টি গাড়ীতে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লাকসামের দিকে যাচ্ছিল। লে. মাহাবুরের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের বি কোম্পানীর সৈন্যরা শত্রুসেনারা এই দলটিকে দুপুর বারোটায় জাঙ্গালিয়ার নিকটে এ্যামবুশ করে। এই ব্যামবুশে শত্রুসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পাকসেনারা গড়ী থেকে নেমে এ্যামবুশ পার্টিকে 'আক্রমণ করার চেষ্ট করে কিন্তু আমাদের সৈন্যদের সাহসিকতা এবং কৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে লে. মাহবুব এবং লে. দিদার যথেস্ট কৌশলের এবং যুদ্ধনিপুণতার পরিচয় দিয়েছিল। লে. মাহবুব তাঁর সৈন্যদের নিয়ে রাস্তার পূর্ব পাশে এ্যামবুশ করে ওঁৎ পেতে বসেছিল। যখন শত্রুদের কনভয় তার এ্যামবুশ-এর মাঝে পড়ে যায়, তখন সে তাদের উপর তার লোকজন দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে কটা গাড়ী রাস্তা থেকে একসিডেণ্ট করে পড়ে যায়। বাকী গাড়ীগুলো থেকে পাকসেনরা লাফালাফি করে নীচে নামার চেষ্ট করে। এতেও তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। যে সব পাকসেনা গাড়ী থেকে ভালভাবে নামতে পারে তারা রাস্তার উপরে (পশ্চিম দিকে) গিয়ে একত্রি হয় এবং লে. মাহবুরের উপর আক্রমণের প্রস্ততি নেয়। এদিকে লে, দিদারুল আলম রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য নিয়ে তৈরী ছিল। সে পাকিস্তানীদের উপর আকস্মাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই ভাবে দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে এবং নিজেদের এত হতাহত দেখে শত্রুসেনাদের মনোবল একবারেই ভেঙ্গে যায়। মৃতদেহ ফেলে রেখে তারা কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে লে. মাহবুব এবং লে. দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি মেশিনগান ৬টি হালকা মেশিনগান এবং অজস্র রাইফেল আহত এবং নিহত শত্রু সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। যে বিধ্বস্ত গাড়ীগুলো শত্রুরা ফেলে গিয়েছিল তা থেকে কয়েক হাজার এ্যামুনিশন উদ্ধার করা হয়। এর তিন দিন পরে স্থানীয় জনসাধারাণ আরও ২টি হালকা মেশিনগান, কয়েকটা রাইফেল এবং বেশ কিছু গোলাবারুদ যা শত্রুসেনা পালিয়ে যাবার সময় ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল আমাদেরকে পৌঁছে দেয়। এই একশনের ফলে আমার এ্যামুনেশনের প্রয়োজনীয়তা সাময়িকভাবে মিটেছিল এবং পাক বাহিনী বেশ কিছুদিন কুমিল্লার দক্ষিণে অগ্রসর হবার সাহস দেখায়নি।

 এই সময় আখাউড়াতে পাক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে আবার আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে তাদের ২৫ জনের মত হতাহত হয় এবং পাক বাহিনী আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পশ্চাদপসরণ করে। এপ্রিল মাসের শেষে পাক বাহিনী কুমিল্লা থেকে উত্তর দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাস্তায় অগ্রসর হয়ে ১২ নং ফ্রাণ্টিয়ার ফোর্স নিয়ে সাইদাবাদ দখল করে নেয়। পরে পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে তারা নিয়ামতবাদ, গঙ্গাসাগর দখল কের নেয়। আমি তখন কুমিল্লার বিবিরবাজার এলাকাতে যেখানে পাকবাহিনী প্রতিদিন আক্রমণ চালাচ্ছিল সেখানে যুদ্ধ পরিচলান করছিলাম। গঙ্গাসাগার, নিয়ামতাবাদ শত্রুকবলিত শুনতে পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দিই ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে কসবার উত্তরে চণ্ডিমুরা উঁচু পাহাড়ে প্রতিরক্ষব্যূহ শক্ত করতে এবং সেই রাতেই কুমিল্লার দক্ষিণ হতে ৪র্থ বেঙ্গলের আলফা কোম্পানীকে উঠিয়ে আমার সঙ্গে নিয়ে গঙ্গাসাগরের নিকটে দুটি কোম্পানীকেই একত্রি করি। সন্ধ্যায় যখন আমি চণ্ডিমুরার নিকটে পৌঁছি তখনই শত্রুদের অবস্থান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা বিবরণ ইপিআরদের কাছ থেকে অবগত হই এবং সেই রাত্রেই গঙ্গাসাগর এবং নিয়ামতাবাদে শত্রুদের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিই। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফ্ফার এবং একজন সুবেদারের নেতৃত্বে আলফা, চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে ভোর পাঁচটায় শত্রুদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেই। এই আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল যে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পূর্ব দিক থেকে শত্রুদের গঙ্গাসাগর পজিশনের পিছন দিক দিয়ে ইনফিলট্রেট করে ভিতরে ঢুকে গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালাবে এবং এই সময়ে সুবেদার তার আলফা কোম্পানী নিয়ে নিয়ামতাবাদের উপর যে জায়গাতে আমরা শত্রুদের হেড কোয়ার্টার ভেবেছিলাম, সেখানে আক্রমণ চালাবে। এ দুই আক্রমণ এক সঙ্গে চারটায় শুরু হবে। আক্রমণের ঠিক দশ মিনিট আগে সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের মর্টার এই দুই পজিশনের উপর গোলা ছুঁড়বে। রাত বারোটায় এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি এই তিন কোম্পানী নিয়ে শত্রুদের ঘাটিতে ঢুকে যাই। সেদিন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। চতুর্দিকে বেশ পানি জমছিল। আমাদেরকে হাটু পানি ভেঙ্গে ত্রাসের রাস্তায় অগ্রসর হতে হচ্ছিল। এক সয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাদের ঠিক পথে যাচ্ছি না এবং এই সময়ে নিকটবর্তী একটা বাড়ির একটা লোকের সঙ্গে দেখা হয়। সেও একজন পুরানা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যাক্তি ছিল। এই ব্যাক্তি আমাদেরকে শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে দিনে দূরে থেকে যা দেখেছে সে সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত খবর দেয়। এই ব্যাক্তির সাহায্যে আমি এবং আমার প্রত্যেকটি দল ভোর পাঁচটায় আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাই। আক্রমণ করার সময় নির্দিষ্ট ছিল রাত চারটা। যেহেতু আমরা দেরীতে পৌঁছি সেহেতু পাচটায় পরিল্পনামত আক্রমণ শুরু করে দিই। শত্রুসেনারা অকস্মাৎ তাদের অবস্থানে এবং পিছনে ভয়ংকর গোলাগুলির শব্দ শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর তারা গঙ্গাসাগর এবং নিয়মাতাবাদ ছেড়ে সাইদাবাদে পশ্চাদপসরণ করে। আমরা পরের দিন সকালে গঙ্গাসাগরে আবার প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি। শত্রুসেনারা গঙ্গা সাগরে পর্যুদস্ত হয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্ট করে। তাদের প্রথম আক্রমণ আমরা ব্যর্থ করে দিই কিন্তু পড়ের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা টি, আলীর বাড়ি পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং ঘাঁটি গড়ে তোলে। আমরা আমাদের কসবা পুরানা বাজারে পজিশন শক্তিশালী করে তুলি এবং শত্রুসেনাকে কসবার দিকে অগ্রসর হতে বাধা দেই। টি, আলীর বাড়িতে শত্রুসেনাদের যে ঘাঁটি ছিল সে ঘাঁটিতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল-এ ডেল্টা কোম্পানী মর্টারের সহায়তায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন অকস্মাৎ আক্রমন করে। এই আক্রমণে শত্রুদের চার পাঁচটা গাড়ীতে আগুন লেগে যায় এবং তাদের ২০/৩০ জন হতাহত হয় তারা টি, আলীর বাড়ী ছেড়ে আরো পেছনে হটে যায়।

 ইতিমধ্যে কুমিল্লা বিবিরবাজার পজিশনের উপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কুমিল্লা শহারের সন্নিকটে দেড় মাইল পূর্বদিকে তারন্যপুর শত্রুরা দখল করতে সমর্থ হয়। আমি ইপিআর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার প্রতিরক্ষাব্যূহ আরও ইপি আর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার অবস্থানটির উপর পাকসেনাদের লক্ষ্য এ জন্য ছিল যে প্রতি রাত্রে এখান থেকে 'আমার ছোট ছোট কমাণ্ডো পার্টি গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানী অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালাতো এবং ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। এখান হতে আমরা অনেক সময় তাদের অবস্থানের উপর মর্টার হামলাও চালাতাম। এতে প্রায়ই পাক সেনাদের অনেক লোক হতাহত হত। অবশেষে পাক বাহিনী একদিন সন্ধার সময় অতর্কিতে এই পজিশনের উপর ৩৯তম বেলুচ রেজিমেণ্টর সাহায্যে গোলন্দাজ বাহিনী এবং ট্যাংকের সহায়তায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রথমে শত্রুসেনা পূর্ব দিকে আক্রমণ চালনা করে। এই আক্রমণ আমার সৈনিকরা নস্যাৎ করে দেয় এবং শত্রুদের অনেক লোক নিহত এবং আহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা দক্ষিণ দিক হতে আমাদের পজিশনের উপর পিছনে বাম পার্শ্বে ট্যাংক ও ৩৯তম বেলুচ রেজিমেণ্টের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ অন্ততপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। আমাদের গুলিতে শত্রুদের অন্ত ১১০ থেকে ১৫০ জন নিহত বা আহত হয়। কিন্তু ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে এবং পিছন দিক হতে ঘিরে ফেলার আশংকা থাকায় আমাকে বাধ্য হয়ে এই অবস্থান ছাড়তে হয়।

 এই যুদ্ধে ইপিআর জওয়ানরা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মনে পড়ে এক নায়েকের কথা, যে শত্রুদের গুলি করতে করতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের নিহতের বিপুল সংখ্যা দেখে এক পর্যায়ে 'জয় বাংলা' হুংকার দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে এবং সেই সময়ে হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত তার মাথায় গুলি লাগে এবং সে মারা যায়। এ যুদ্ধে আমার ৬ জন সৈন্য মারা যায় এবং ৮/১০ জন আহত হয়। এই সব আহতদের আমরা পিছনে নিয়ে আসি কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত তাদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারি না। এ রকম একজন আহত তরুণ ছাত্রের কথা মনে পড়ে যায় পেটে গুলি লেগেছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ অপারেশন করার কোন ব্যাবস্থা না থাকায় সে মারা যায়।

 এদিকে গঙ্গাসাগরে এবং আখাউড়ায় শত্রুসেনারা আবার তৎপর হয়ে ওঠে এবং বারবার আখাউড়া এবং গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালায়। জুন মাসের প্রথমে পাকবাহিনীর ১২ তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স ট্যাংক, কামান এবং বিমান বাহিনীর সহায়তায় আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন এবং গঙ্গাসগারের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী কিছুটা পিছু হটে আজমপুর, আখাউড়া রেলওয়ে স্টেমন থেকে আধা মাইল পূর্বে আবার প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। এই প্রতিরক্ষাব্যূহ সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা রেলওয়ে লাইনকেও শত্রুদের ব্যবহার থেকে বাধা দিতে সমর্থ। এই অবস্থানগুলির উপর পাক বাহিনী বারবার আক্রমণ চালায় এবং প্রতিবারই ৩০/৪০ জন করে সৈন্য হতাহত হওয়ায় তারা আক্রমণ থেকে নিরস্ত থাকে।

 মে মাসে জেনারেল ওসমানী আমাদের হেড কোয়ার্টার-এ আসেন। সে সময় ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিচালনা কিভাবে হবে সে সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। জেনারেল ওসমানী আমাকে নির্দেশ দেন যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলি। এই পরিকল্পনায় আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দুই বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত করার পন্থা নিই। আমরা পরিকল্পনা করি যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হেলে আমাদের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে। দুই রকমের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। নিয়মিত বাহিনী, যা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপিআর এবং অন্যান্য আমস ও সার্ভিসেস-এর একা ডিভিশন গড়ে উঠবে এবং কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈন্য নিয়ে প্রত্যেক সেক্টরেই কোম্পানী গঠন করা হবে এবং সেই সব কোম্পানী শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কমাণ্ডো এ্যাকশন চালিয়ে যাবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর পুরানা এবং নতুন ব্যাটালিয়ান নিয়ে ব্রিগেড গঠন করে সেই সব ব্রিগেড শত্রুদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাবে এবং প্রয়োজন হলে দখলীকৃতাবস্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলবে। যেসব যুবক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে তাদেরকেও ট্রেনিং দিয়ে একটা অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এই অনিয়মিত বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপ এবং কোম্পানীতে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে এসব নিয়মিত বাহিনীর কোম্পানী এবং গ্রুপগুলো যাতে ভালভাবে কাজ করতে পারে সে জন্য তাদের পরিচলানার জন্য নিয়মিত বাহিনী থেকে জেসিও বা এনসিওদেরকে পরিচালনার জন্য পাঠান হবে। এই পরিকল্পনাতে আমরা আরো উল্লেখ করি যে নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের মতই হবে। কিন্তু অনিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র হালকা ধরনের হবে এবং এলএমজির চেয়ে ভারী অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

 জেনারেল ওসমানী আমাদের সাথে একমত হন এবং তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দেন যে এই পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি কার্যকর হয় তিনি তার চেষ্টা করবেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক যুবক আমাদের কাছে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমি আমার হেড কোয়ার্টারে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে দিই। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং-এর প্রবর্তন করি। বিশেষ করে পাক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার জন্য ডেমোলিশন ট্রেনিং-এর ভার ক্যাপ্টেন হায়দর (বর্তমানে মেজর) এবং হাবিলদার মুনিরের উপর ন্যাস্ত করি। অতি সত্বরই আমার বেশ কিছু ডেমোলিশন টিম ট্রেইণ্ড হয়ে যায়। প্রথমেই আমি এসব টিমগুলোকে ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রেল লাইন এবং পাক সড়কে পাঠিয়ে দিই। তাদের এ কাজ দিই যে যতোটুকু সম্ভব পুল এবং রেলওয়ে লাইন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। এসব কাজে আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধার সৃষ্টি হয় ডেমোলিশন-এর সরঞ্জামাদির অভাবে। আমরা হয়তো বারুদ পাই কিন্তু ফোটানোর জন্য ডেটোনেটোর পাই না কিংবা অন্য কোনো সরঞ্জামাদি। এসব অসুবিধার মধ্যেও আমরা প্রত্যেকটি রেল এবং রাস্তাতে বেশ কিছুসংখ্যক পুল ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই যার ফলে পাকিস্তানীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা- ঢাকার সঙ্গে এই সব প্রধান স্থানগুলোর- বিনষ্ট হয়ে যায় এবং পাকিস্তানকে বিমান ও জলপথের সাহায্য নিতে হয়। এই রুপ অবস্থা শেষ পর্যন্ত চলে।

 আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে সরিয়ে কুমিল্লার কাছে মতিনগর নামক স্থানে স্থাপন করি। সেখান থেকে কুমিল্লা এবং ঢাকা কাছে হওয়াতে আমার পক্ষে এসব জয়গাতে গেরিলা তৎপরতা চালানো অনেক সুবিধাজনক হয়। আমার ট্রেনিং ক্যাম্প এ সময়ে অনেক বড় হয়ে যায় এবং হাজার হাজার ছেলেদের আমি ট্রেনিং দিতে শুরু করি। এসব ছেলেদের মধ্যে অনেককেই আমি নিয়মিত বাহিনীর শিক্ষা প্রদান করি। প্রথম অবস্থায় সৈন্যদের এবং অনিয়মিত বাহিনীর লোকদের থাকা খাওয়ার ও চিকিৎসার অত্যন্ত অসুবিধা হয়। আমাদের কাছে না ছিল রসদ, না ছিল টাকা পয়সা, না ছিল বাসস্থান। অনেক সময় এই সব হাজার হজার লোককে খাওয়ানোর জন্য আমাকে বাংলাদেশের ভেতর বিভিন্ন রেশন ডিপো (এলএসডি) থেকে রসদ জোরপূর্বক আনতে হয়েছিল। কোন কোন সময় রসদের ব্যবস্থা হলেও হাজার হজার লোকের খাবার তৈরীর হাড়ি পাতিল বাসনপত্র ছিল না। তেলের ড্রাম কেটে আমরা পাত্র তৈরী করে নিই। অনেক সময় এমন দিন যায় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র একবার ক্যাম্পের লোক খেতে পেয়েছে শুধু আধাসিদ্ধ ভাত, কোন সময় ডাল ছাড়াই। থাকার জন্য কোন আশ্রয় না তাকায় অধিকাংশ লোকজনকে বৃষ্টিতে ভিজতে হতো। কোন বিশুদ্ধ পানি ছিল না নালার পানি ব্যবহার করতে হতো। তবুও এত কষ্টের ভিতরে আমি ক্যাম্পে লোকজনের মুখে সব সময় হাসি এবং উৎফুল্ল ভাব দেখতাম। এরা সবাই নিয়মিত এবং গণবাহিনী মিলেমিশে সব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। আস্তে আস্তে অব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ভারত সরকার ইউথ ক্যাম্প তৈরী করার জন্য সাহায্য দেয়। আমি আগরতলার রিলিফ ডিপার্টমেণ্ট-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটা ইউথ ক্যাম্পের অনুমোদন করিয়ে নিই। তাদের কিছুটা আর্থিক সহায্যের ব্যবস্থা করি এবং আমার লোকদের প্রচেষ্টায় আমরা মেলাঘর নামক স্থানে একটা ক্যাম্প গঠন করি। এ জায়গাটা পাহাড়ের উপর এবং জঙ্গলের ভিতর বেশ একটা সুন্দর জায়গায় অবস্থিত ছিল। পাকিস্তানী হামলার আশংকা থেকেও বিপদমুক্ত ছিল। এখানেই আমি আমার স্থায়ী হেড কোয়ার্টার স্থাপন করি। এ ক্যাম্পটিতে বেশী জায়গা ছিল বলে আমি তিন চার হাজার লোককে একত্রে থাকা-খাওয়া এবং ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত করতে পারি। এ ক্যাম্পে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীর উভয় প্রকারের মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং শুরু করি। এ সময় কুমিল্লার দক্ষিণে আমার যে সব সেনাদল ছিল তাদেরকে নিয়ে একা সাবসেক্টর গঠন করি। এ সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার আমি নর্ভয়পুরে স্থাপন করি। ক্যাপ্টেন আকবর (বর্তমানে মেজর) লে. মাহবুব এবং লে. কবির এই সাবসেক্টর থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকে একটি কোম্পানী সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারীর অধীনে লাকসামের পশ্চিমবর্তী এলাকায় তাদের গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এখান থেকে নোয়াখালী, লাকসাম, কুমিল্লা, চাঁদপুরের রাস্তায় শত্রুসেনাদের উপর অনেক আক্রমণ চালাতে থাকে।

 জুলাই মাসে শত্রুদের একটি শক্তিশালী দল এলাকাকে মুক্তি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত কারার জন্য লঞ্চযোগে চাঁদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদীতে অগ্রসর হয়। সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী আগে থেকে এ সম্বন্ধে খবর পেয়েছিল। সে ছাতুরার নিকট একটি সুপারির বাগানে শত্রুসেনাকে এ্যামবুশ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। নদীর দু'পাশে হালকা মেশিনগান লাগিয়ে শত্রুদলের অপেক্ষায় ছিল। সকাল ১১ টায় শত্রুরা লঞ্চযোগে এ্যামবুশ অবস্থানের মধ্যে পৌঁছায় এবং নদীর দুই তীর থেকে আমাদের কোম্পানীর লোকেরা শত্রুসেনার উপর অতর্কিত গোলাগুলি চালায়। এতে লঞ্চের মধ্যে অনেক শত্রুসেনা হতাহত হয়। উভয় পক্ষের এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা পর্যুদস্ত হয়। উপায়ন্তর না দেখে শত্রুসেনারা পিছু হটে যায় এবং আবার লঞ্চ থেকে নেমে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এবারও তারা পরাস্ত হয়ে চাঁদপুরে ফিরে যায়। এ কোম্পানী পরে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লার বেশ কয়েকটি সেতু ও রেলসেতু ধ্বংস করে দেয় পাক বাহিনী পরবর্তী পর্যায়ে অনেকবার আমাদের এ মুক্ত এলাকাকে দখল কারার চেষ্টা করে কিন্তু তারা অসমর্থ হয় নির্ভয়পুর থেকে আমাদের সৈন্যারা এবং গেরিলা বাহিনী লাকসাম-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইনের লাকসাম ও চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণে রেলওয়ে সেতু এবং রাস্তার সেতু ধ্বংস করে দেয় এতে চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়।

 উত্তারাঞ্চলে কসবা, মন্দভাগ, আখাউড়া শালদানদী প্রভৃতি৷ঞ্চলে যখন আমার সেনাদলের সাথে পাকবাহিনীর প্রত্যহ সংঘর্ষ তীব্রতর হচ্ছিল, সে সময়ে কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চলে মিয়ার বাজার এবং চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলেও আস্তে আস্তে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আমার ৪র্থ বেঙ্গল-এর বি কোম্পানীর একটি প্লাটুন এবং ইপিআর ও মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত দলটি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ার বাজারে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়াকের উপর প্রতিরক্ষা অবস্থান গঠন করে ব্যূহকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। এর ফলে চট্টগ্রাম-ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনীর মধ্যে এ অবস্থার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মিয়ার বাজারের নিকট যে রাস্তায় সেতুটি ছিল, সেটা ভেঙ্গে দেয়া হয়। এছাড়া কুমিল্লার ৬ মাইল দক্ষিণে বাগমারাতে যে রেলওয়ে সেতুটি ছিল, সেটাও উড়িয়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুনরায় খোলার জন্য ৩০শে মে সকাল ছটায় দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হয়। বেলা ১১টার সময় আমাদের একটি এ্যামবুশ দল মিয়ার বাজারের উত্তরে পাকসেনাদের উপরে অতর্কিত হামলা চালায়। শত্রু সেনাদল মিয়ার বাজারের এত আগে এ ধারনের হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে তারা সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে কুমিল্লার দিকে পলায়ন করে। এ যুদ্ধে শত্রুদের প্রায় ৫০ জন হতাহত হয় এবং আমাদের সেনা দল দুটি ৩ টনের গাড়ী গোলাবাবরুদসহ ধ্বংস করে দেয় এবং একটি গাড়ী দখল করে নেয়। আমাদের পক্ষে দুজন সৈন্য নিহত এবং একজন আহত হয় এরপর শত্রুরা কুমিল্লা বিমানবন্দর অবস্থান থেকে আমাদের মিয়ার বাজারের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ভীষণভাবে ভারী কামানের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ করার চেষ্ট চালায়। শত্রুদের একটি শক্তিশালী পেট্রোল পার্টি চেওরা হয়ে মিয়ার বাজারের পূর্বদিক দিয়ে আমাদের অবস্থানের ভিতর প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু লে. কবিরের নেতৃত্বে আমাদের একটা ছোট দল পাক বাহিনীর পেট্রোল পার্টিকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবহিনীর ১০ জন নিহত হয়। লে. কবির পাকবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়।

 মিয়ার বাজারের অবস্থানটির উপর পাকসেনাদের চাপ বাড়তে থাকে। কামানের গোলা দিনে দিনে আমাদের অবস্থানের উপর তীব্র হতে থাকে। অবস্থানটি বেশী দিন আর টিকানো যাবে না ভেবে আমি লে. ইমামুজ্জামানকে একটু পিছু হটে চৌদ্দগ্রাম থানার বাজারের নিকট নতুন করে অবস্থান তৈরীর নির্দেশ দিই। ইমামুজ্জামান তাঁর দলকে নিয়ে চৌদ্দগ্রামে আবার এক নতুন প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। এ প্রতিরক্ষাব্যূহ তিন দিকে মুখ করে গড়ে তোলা হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের প্লাটুনটি মিয়ার বাজারে কুমিল্লার দিকে মুখ করে পজিশন নেয়। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তায় মিয়ার বাজারের যে সেতুটি ছিল, সে সেতুটির দক্ষিণে অবস্থানটি গড়ে তোলে। এদের উপর দায়িত্ব ছিল কুমল্লা থেকে পাক বাহিনীকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসরে বাধা দেওয়া। আরেকটি প্লাটুনকে পশ্চিম দিকে মুখ করে বাগমারা থেকে যে কাঁচা রাস্তা মিয়ার বাজারের দিকে আসে তার উপর প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করার নির্দেশ দিই। মুজাহিদ কোম্পানীর দায়িত্ব ছিল দক্ষিণ দিকে মুখ করে মিয়ার বাজার হতে আধা মাইল দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা মহাসড়কের উপর অবস্থান গড়ে তোলা এবং দক্ষিণ থেকে শত্রুসেনাদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়া। কিছু কিছু মাইন সরু বাঁশ কেটে আমার এ অবস্থানটির চতুর্দিকে পুঁতে দিই। দুই সপ্তাহ পরে শত্রুসেনারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ অবস্থানটির হেড কোয়ার্টার চৌদ্দগ্রাম থানায় স্থাপন করি। দুই সপ্তাহ পরে শত্রুসেনারা কুমিল্লার দিক থেকে এ অবস্থানটির উপর দুটি কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ চালায়। কিন্তু শত্রুদের বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হওয়ার পরে তারা আক্রমণ বন্ধ করে দিয়ে পশ্চাদপসরণ করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর তাদের কামানের গোলা চালিয়ে যায়।

 ১৪ই জুন সকাল ৬টায় সময় পাকসেনারা নয়া বাজার হয়ে হয়ে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু তারা আমাদের একটা এ্যামবুশ পার্টির ফাঁদে নয়া বাজারের নিকট পড়ে যায়। শত্রুদের প্রায় ৩০ জন হতাহত হয় এবং তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং পিছু হটে যায়। ১৯শে জুন সকাল ৬টায় পাকসেনারা অন্ততপক্ষে ২টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে দুই দিক থেকে (লাকসাম এবং ফেনীর দিক থেকে) প্রবল আক্রমণ শুরু করে। তীব্র কামানের গোলার মুখে আমাদের সম্মুখবর্তী সৈনিকরা পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের আক্রমণ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত পাকসেনাদের আক্রমণে আমাদের চৌদ্দগ্রামে অবস্থানটি সংকটময় হয়ে পড়ে। আর বেশিক্ষণ এ অবস্থানটিতে থাকলে রাতের অন্ধকারে শত্রুসেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত হবার আশংকা ছিল। যদিও পাকসেনাদের সমস্ত দিনের যুদ্ধে অন্তত ২০০ জন হতাহত হয়েছিল এবং আমাদের পক্ষে ক্ষতির সংখ্যা ছিল ২ জন নিহত এবং ৪ জন আহত। তবুও চৌদ্দগ্রাম শত্রুদের প্রবল আক্রমণের মুখ থেকে আর রক্ষা করা যাবে না বলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমাদের সেনাদল অবস্থানটি পরিত্যাগ করে।

 মে মাসে যখন আমাদের শত্রুদের সঙ্গে সম্মুখসমর চলছিল, সে সময় আমার মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু বাহিনীর পিছনে তাদের আক্রমণ চলিয়ে যাচ্ছিল। ২১ শে মে দুজন মুক্তিযোদ্ধা জামাল এবং খোকন একটি এ্যাণ্টি-ট্যাংক মাইন পুঁতে শত্রবাহী একটি ট্রাককে কুমিল্লার নিকট উড়িয়ে দেয়। গেরিলাদের আর একটি পার্টি দেবীদ্বার থানা আক্রমণ করে ছয়জন দালাল পুলিশকে নিহত করে। গেরিলাদের হাতে হাজিগঞ্জ থানার একজন পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর ও দুইজন দালাল পুলিশ নিহত হয়। এ পুলিশদের নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়ে পাকবাহিনীর একটি ছোট দল (দশজনের মত) হবিগঞ্জ থানা পাহারায় নিযুক্ত হয়। গেরিলারা একদিন আক্রমণ চালিয়ে তাদের চারজনকে নিহত করে।

 এ সময়ে ঢাকাতে আমাদের কমাণ্ডো ছেলেরা নয়টি সরকারী অফিসে আক্রমণ চালিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেগুলো ছিল সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, হাবিব ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সদরঘাট টার্মিনাল, পাকিস্তান অবজারভার অফিস প্রভৃতি। এসব আক্রমণে চারজন পাক সেনা অফিসার এবং দুজন সৈনিক নিহত হয়।

 কুমিল্লার দক্ষিণে গৌরীপুর নামক স্থানে আমাদের কমাণ্ডোরা পাকসেনাদের উপর আকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণেও পাকসেনাদের ৯ জন সৈন্য নিহত হয়।

 পাকসেনারা ইতিমধ্যে শালদানদী এরিয়াতে বিশেষভাবে তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে থাকে। তাদের ১টা রেলওয়ে ট্রলি যা শত্রুদের জন্য রেশন এবং এমুনিশন নিয়ে যাচ্ছিল ২১ শে মে আমাদের একটা ছোট এ্যামবুশ দলের হাতে ধরা পড়ে। এর ফলে আমাদের হস্তগত হয় এমজিআইএ ৩, ৭৫ এম এম এবং ১০৬ আর আর এর শেল।

২২শে মে তারিখে মুজাহিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হকের নেতৃত্বে একটি গেরিলা দল শালদানদী এলাকায় অবস্থানরত শত্রুদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণটা শত্রুদের পিছন থেকে পরিচালিত করা হয়। শত্রুরা এ রকম আক্রমণের জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন আবদুল হকের প্লাটুন শত্রুদের অবস্থানটি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে। শত্রুরা তাদের অবস্থানের ভিতর এ অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। এ আক্রমণের ফলে পরে আমরা জানতে পারি যে, শত্রুদের প্রায় ১৫ জন হতাহত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৪জন মারা যায়।

 ২৫শে মে রাত আড়াইটার সময় আমাদের এ্যামবুশ পার্টি বাটপাড়া জোড়কাননের নিকট শত্রুদের ১টা ট্রাক এবং ১টা আরআর রাইফেল-এর জীপ এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে শত্রুদের প্রায় ২০ জন সৈনিক ট্রাক এবং জীপসহ ধ্বংস হয়ে যায়। ২৯শে মে সকাল সাড়ে ৬টায় একটা এ্যামবুশ পার্টি সুবেদার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১৫ জন লোক নিয়ে কুমিল্লার উত্তরে রঘুরামপুর নামক স্থানে এ্যামবুশ করে বসে থাকে। শত্রুদের একটা পেট্রোল পার্টি ১ জন অফিসার ও ২৫ জন সৈন্য নিয়ে আমাদের এ্যাবুশের ফাঁদে পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ২৭ শে মে মন্দভাগ থেকে ১টি প্লাটুন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় কুট শাদানদীর সিএণ্ডবি রাস্তার উপর শত্রুদের এ্যামবুশ করে। এ এ্যামবুশের ফলে শত্রুদের ৯ জন লোক নিহত হয় এবং ১১টা জীপ ও ১টা ডজ ধ্বংস হয়ে যায়। শত্রুরা তাদের মৃতদেহগুলো রেখেই পালায়ন করে। পেট্রোল পার্টি ২ জন পাকসেনাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হয়। মে মাসের মাঝামাঝি ফেনী এবং লাকসামের মাঝে রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া হয়। রেলওয়ে ব্রিজের উপর পাক সেনাদের ১০ জন পহারারত ছিল। তাদেরকেও সে সঙ্গে মেরে ফেলা হয়।

 ২৬ শে মে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ১টি শক্তিশালী দল কসবার উত্তরে ইমামবাড়ীর নিকট ১৫০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। এরপর এ দলটি শত্রুদের জন্য এ্যামবুশ করে বসে থাকে। শত্রুরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। শব্দ শুনে আমাদের দল তৈরী হয়। ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছার আগেই পাক সেনারা এ্যামবুশ- এর ভয়ে সেখান থেকে ফেরত চলে যায়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন পরে তার দলটিকে নিয়ে কর্নাল বাজারে শত্রু অবস্থানের উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের সময় ৭৫- এমএম আর আর এর সাহায্যে শত্রুদের কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস করে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যেও গোলাবর্ষণ করে। এতে শত্রুদের ৮জন সেনা নিহত হয় এবং কয়েকটি ব্যাংকার ধ্বংস হয়।

 আখাউড়া থেকে আমাদের অবস্থান পরিত্যাগ করার পর আমি আমার দলকে আখাউড়ার উত্তরে আজমপুর গ্রামে সিঙ্গারবিলে পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিই। লে. হারুনের নেতৃত্বে ১টি ইপিআর কোম্পানী এবং ৪র্থ বেঙ্গল-এর ১টি প্লাটুন আজমপুর রেলওয়ে কলোনী পছনে মাধবপুর সড়ক এবং রেল লাইনের উপর প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করে। এ জায়গাটা ছিল একটু উঁচু এবং এর ডান দিকে তিতাস নদী থাকাতে এ অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকসেনারা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে আমরা এ জায়গাতে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছি। শত্রুদল আখাউড়া দখল করার পর ভেবেছিল যে এবার তারা সিলেট আখাউড়া লাইনে ট্রেন যোগাযোগ পুনরায় চালু করবে। এ জন্য সিলেটের দিক থেকে ১টি লাইন ইঞ্জিন এবং কয়েকটি বগিসহ মাধবপুর থেকে দক্ষিণে পাঠায়। সিঙ্গুরবিল স্টেশনের কিছু উত্তরে পুলের নিকট লে. হারুন কয়েকটি এ্যাণ্টি ট্যাংক মাইন রেল লাইনের নিচে আগেই পুঁতে রেখেছিল। এ ট্রেনটি লাইনের উপর দিয়ে আসার সময় মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে পাকিস্তান বাহিনীর কিছু সৈনিক এবং রেলওয়ে কর্মচারীরা ক্রেন নিয়ে আসে এ ট্রেনটি তোলার জন্য। কিন্তু পাক সেনাদের এ দলটি লে. হারুনের পূর্ব পরিকল্পিত এ্যাবমুশে পড়ে যায়। এর ফলে প্রায় ২০ জন পাক সেনা নিহত এবং তারা রেলওয়ে কমর্চারীসহ সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এর কিছুদিন পর লে. হারুন সিঙ্গারবিল রেলওয়ে ব্রিজ ১৪০ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনী এ সেতুটি মেরামত করার জন্য রেলওয়ে কর্মচারী ও আরো সরঞ্জাম সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশনে জমা করে। এরপর সেসব সরঞ্জাম তারা রেলওয়ে সেতুটির নিকট নিজেদের তত্ত্বাবধানে এবং পাহারাধীনে আনে। লে. হারুনের মার্টার প্লাটুন সুবেদার শামসুল হক (বর্তমানে সুবেদার মেজর) এ সময়েরই অপেক্ষায় ছিল। পাকবাহিনী কয়েকদিন পর সকালে যখন তাদের সেতু মেরামতের কাজ আরম্ভ করেছে, ঠিক সে সময় সুবেদার শামসুল হকের মর্টার তাদের লক্ষ্য করে গোলা ছুঁড়তে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে লে. হারুনও তার সৈন্যদের দিয়ে আক্রমণ চালায়। পাক বাহিনী এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তাদের সমস্ত সরঞ্জাম ফেলে সেখান থেকে পলায়ন করে এবং সে সঙ্গে সিলেট-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর দশজন লোক নিহত হয়।

 কিছুদিন পর পাকবাহিনী আমাদের আজমপুর পজিশনের উপর কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে আজমপুর থেকে আমাদের অবস্থানটিকে দখল করতে না পারলে সিলেট ঢাকা রেলওয়ে লাইন তারা কখনো খুলতে পারবে না।

 ২৯ শে মে কিছু কিছু ফাইটিং পেট্রোল তারা আজমপুর পজিশনের পশ্চিম তিতাস নদী বরাবর পাঠায় আমাদের পজিশন বিস্তারিত জানবার জন্য। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই এসব পাক দল আমাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে। আমরাও পাক সেনা বাহিনীর আখাউড়া অবস্থানে ছোট ছোট দল পাঠিয়ে ব্যতিব্যাস্ত করে তুলি। আমরা জানতে পারি যে, ব্রাহ্মণবড়িয়া থেকে ট্রালি বা লাইট ইঞ্জিনের মাধ্যমে পাকবহিনী তাদের রসদ এবং সরঞ্জাম আখাউড়াতে পাঠায়। এ খবর জানতে পেরে আমাদের ১টি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২ মাইল দক্ষিণে রেল লাইনের নিচে মাইন পুঁতে দেয়। কিন্তু পাকবাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় এসব মাইন সম্মন্ধে জানতে পারে এবং সেগুলি উঠিয়ে নেয়। পাক বাহিনী এ সময়ে রেল লাইনের নিকটবর্তী গ্রামের লোকদেরকে কঠোর সতর্ক করে দেয় যে, কোন গ্রামের নিকটে মুক্তিবাহিনী যদি তাদের কোন ক্ষতিসাধন করে তাবে সে গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হবে। এ সতর্কতার ঘোষণায় প্রতিদিন রাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো হতে লোকজন লাইন এবং সড়ক পাহারা দিত। এর ফলে আমাকে পাকবাহিনীর গতিবিধির উপর বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

 এ রকমের বাধাবিপত্তির সম্মুখীন আরো অনেক জায়গাতে আমি হই। আমাদের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য যে সব জায়গায় আমার লক্ষ্যস্থল ছিল, সেখানে আমার সেনাদলগুললিকে সান্ধ্য আইন (কারফিউ জারি করার নির্দেশ দিই এবং এ নির্দেশ বহুলাংশে সফল হয়। যদিও গ্রামবাসীদের পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার কোন ইচ্ছা ছিল না তারা তাদের ভয়ে এসব বাধাবিপত্তির সৃষ্টি করতো। আমাদের সান্ধ্য আইনের ঘোষণায় অনেক ফল হয় এবং গ্রামবাসীরা আর বাধা সৃষ্টি করে না। এরপর আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আখাউড়ার মাঝে ২টি রেল সেতু উড়িয়ে দিই। এর ফলে আখাউড়ায় পাকসেনাদের অবস্থানটির জন্য রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। এরপর তারা আখাউড়াতে হেলিকপ্টারের সাহায্যে রসদ সরবরাহ করতে বাধ্য হয়।

 পাক বাহিনী আমাদের আজমপুর পজিশনের উপর তাদের চাপ বাড়াতে থকে। তাদের ২টা কোম্পানী একদিন সকালে আজমপুরের আধ মাইল দক্ষিণে দরগার নিকট আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণ সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত চলে। আমাদের সৈন্যরাও আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রায় ৩০ জন শত্রুসেনা হতাহতের পর তারা আক্রমণ বন্ধ করে নিয়ে আবার পশ্চাদপসরণ করে।

 বেশ কিছুদিন পর জুন মাসে পাকিস্তানী সৈন্য আবার মাধবপুরের রাস্তা এবং রেল লাইনের উপর আমার পজিশনের দিকে অগ্রসর হয়। এবার পাক সেনাদের ১২নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের অগ্রবর্তী দরগা পজিশন থেকে এ আক্রমণকে বেশ কয়েকদিন বিফল করে দেয়া হয় কিন্তু জুন মাসের শেষের দিকে আক্রমণ আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাক বাহিনী আখাউড়াতে ১২০ এম এম ভারী মর্টার এবং ১০৫ এমএম তোপ নিয়ে আসে। এসব কামানের গোলার আঘাতে এবং ১২ নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স-এর প্রবল চাপে আমাদের অগ্রবর্তী পজিশন সংকটময় হয়ে ওঠে এবং শত্রুদের অন্তত ৫০ জন হাতাহতের পর আমাদের পজিশন পরিত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়।

 এর পর কিছুদিন পর জুলাই মাসে পাক বাহিনী আবার আজমপুরের দিকে মুল অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আবারও তারা মাধবপুরের সড়ক ও রেল লাইনের উপর ১২ নং ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়াসহ আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পূর্বে প্রচণ্ড গোলাগুলি করতে থাকে। আমরা এ আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে যখন পাক সেনারা সারিবদ্ধ লাইনে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আমাদের মর্টার এবং মেনিগান তাদের অন্ততপক্ষে ১০০/১২০ জনের মত লোককে হতাহত করে। তারা আমাদের অবস্থানের কোন কোন জায়গায় ঢুকে পড়ে কিন্তু আমাদের পাল্টা আক্রমণে আমরা পাক সেনাদের হটিয়ে দিই। এ সংঘর্ষ প্রায় দুই দিন চলে। আমরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, যেকোনো অবস্থাতেই আমরা আমাদের ঘাঁটি ছাড়বো না। শত্রুসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হচ্ছিল প্রতিদিনই, কিন্তু তারাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমাদের এ অবস্থানটি দখল করার জন্য। তাদের কামানের গোলায় আমাদের পজিশনটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা আত্মবিশ্বাস হারায়নি। আমাদের অবস্থানটি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আগরতলা বিমানবন্দরের বেশ নিকটেই ছিল। এর ফলে পাকবাহিনীর কামানের গোলার স্প্লিনটার মাঝে মাঝে বিমানবন্দরে গিয়ে পড়ছিল। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র আমাদের এ অবস্থাটি থেকে যুদ্ধ আরো চালিয়ে যাওয়ার আপত্তি করে। তাদের বিমানবন্দরে ক্ষতি হওয়ার আশংকায় এ আপত্তি করে। আমরা নিরুপায় হয়ে দেড় মাস যুদ্ধ চালানোর পর আজমপুর অবস্থান পরিত্যাগ করে সিঙ্গারবিলে নতুন অবস্থান গড়ে তুলি।

 পাক বাহিনী মাধবপুর থেকে অগ্রসর হয়ে কমলছড়ি চা বাগান দখল করে নেয়। এই চা বাগানে তারা মিলিশিয়ার এক কোম্পানী এবং নিয়মিত বাহিনীর প্লাটুনসহ একটা শাক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। লে. হারুন বুঝতে পারে যে, পাক সেনারা আখাউড়া থেকে (দক্ষিণ থেকে) এবং মাধবপুর থেকে (উত্তর থেকে) কমলছড়ি হয়ে তার সিঙ্গারবিল পজিশনকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। লে. হারুন পাক বাহিনীকে পৃথকভাবে উত্তর এবং দক্ষিণে আঘাত হানার এ পরিকল্পনা নেয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কমলছড়ি চা বাগান প্রথম 'আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জুলাই মাসে কমলছড়ি চা বাগান এবং চা বাগানে পাক বাহিনীর ঘাঁটি সম্মন্ধে সে বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। একদিন রাত তিনটার সময় ৪র্থ বেঙ্গল-এর ১টা প্লাটুন এবং ইপিআর-এর ১টা কোম্পানী নিয়ে গোপন পথে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কমলছড়ি পাকবাহিনীর অবস্থানের ভিতর সাহসের সাথে ঢুকে পড়ে। এ অকস্মাৎ গোপন আক্রমণ পাক সেনাদলকে হতভম্ব করে দেয়। তাদের কিছু বুঝাবার বা বাধা দেয়ার আগেই লে. হারুনের দল পাক বাহিনীর অন্তত ছয়টা ব্যাংকার গ্রেনেডের সাহায্য ধ্বংস করে দেয়। এরপর সমস্ত রাত ধরে পাক বাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই চলতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা আকস্মাৎ আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে হকচকিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। সে জন্য পরবর্তী পর্যায়ে যখন লে. হারুনের ছোট ছোট দলগুলি চাবাগানের সরু এবং গোপন রাস্তায় অগ্রসর হয়ে একটার পর একটা ব্যাংকার ধ্বংস করে যাচ্ছিল তখন উপায়ন্তর না দেখে পাক বাহিনীর সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে এবং এতে তাদের বেশ লোক গুলিতে নিহত হয়। সকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কমলছড়ি চা বাগানটি সম্পূর্ন লে. হারুনের দখলে এসে যায়। এ যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানিদের ৫০ জন নিহত এবং আমাদের হাতে ৪টি মেশিনগান ও ৬টি হালকা মেশিনগান, বেশ কিছু রাইফেল এবং অজস্র গোলাগুলি ও প্রচুর রসদ এবং কাপড়-চোপড় হস্তগত হয়।

 ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা মন্দভাগ এবং মালদানদীতে শত্রুসেনাদের উপর অনবরত আঘাত চলিয়ে যাচ্ছিল। ২৬শে মে রাত ৯টায় সুবেদার ভূইয়ার নেতৃত্বে দুটি সেকশন রকেট লাঞ্চার নিয়ে শত্রুর শালদানদীর পজিশনের ভিতর ঢুকে যায়। এরপর শত্রুদের ২টা ব্যাংকার তারা রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়। শত্রুরা তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালালে পেট্রোল পার্টি হালকা মেশিন গানের সাহায্যে শত্রুসেনাদের বেশ কিছু লোক নিহত করে এবং তারা পিছু হটে আসে। পরে জানতে পারা যায় যে, এ আকস্মিক হামলায় শত্রুদের ১ জন জেসিও এবং ৯ জন সৈন্য মারা যায়। ২৮ শে মে রাতে মুক্তিবাহিনীর কমাঙ্গেরা কুমিল্লার নিকট কালিকাপুর রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ঐ দিনই সকালে পাকিস্তানী সেনারা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের কাছে রঘুরামপুরে একটি কোম্পানী নিয়ে আসে। এ কোম্পানীকে আমাদের সেনাদল সকাল সাড়ে ছটার সময় অতর্কিতে এ্যামবুশ করে এবং এ্যামবুশে পাকসেনাদের অন্তত একজন অফিসারসহ ৩৫ জন লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা আঘাত খেয়ে মরিয়া হয়ে ভবনগর, শালুকমুডা, খাড়েরা, ফকিরবাজার প্রভৃতি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়াও শত্রুসেনারা তিন ইঞ্চি মর্টার এবং ১০০ এম এম ভারী মর্টারের সাহায্যে যথেষ্টভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির উপর গোলা ছুঁড়তে থাকে।

 ২৮শে মে আর একটি পেট্রোল পার্টি নায়েক গিয়াসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মনোহরপুর নামক গ্রামে শত্রুদের জন্য একটি এ্যামবুশ পেতে থাকে। পাকসেনাদের ১টি কোম্পানী জঙ্গলবাড়ীর দিকে যাচ্ছিল কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা দিয়ে। সকাল সাড়ে ৮টায় পাকসেনাদের কোম্পানীটি নায়েক গিয়াসুদ্দিনের এ্যামবুশ-এর ফাঁদে পড়ে যায় এবং তাদের ২৫ জনের মত লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে এসে পুনরায় কামানের গোলার সাহায্যে আক্রমণের চেষ্টা করে। তখন আমাদের এ্যামবুশ পার্টি তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুরা পার্শ্ববর্তী মাগুর, মনোহরপুর ইত্যাদি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় সাথে সাথে কামানোর সাহায্যে গোলা ছুঁড়তে থাকে।

 শালদানদীর শত্রু অবস্থানটির উপর আমাদের চাপ আরো বাড়াতে থাকি। ২৫ শে মে আমাদের আর একটি ছোট দল অতর্কিত হামলা করে পাকসেনাদের ১ জন জেসিও এবং ৫ জন সৈন্যকে নিহত করে। তাদের ২টি মর্টারও ধ্বংস করে দেয়া হয়। ২৭ শে মে শত্রুসেনাদের কুটি থেকে সিএণ্ডবি রাস্তায় শালদা নদীতে আরো সৈন্য আনার চেষ্টা করে। সকাল ৭টায় মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের এ দলটিকে এ্যামবুশ করে। এ্যামবুশ-এর ফলে ১টা জীপ, ১টা ডজ ধ্বংস ও শত্রুদের ৯ জন লোক নিহত হয়। শত্রুরা সামনে অগ্রসর হতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়।

 ২৮ শে মে সকাল ৬টায় কুমিল্লার দক্ষিণে রাজারমার দীঘির শত্রুদের ১টা বাংকার আমাদের ২জন সৈনিক গোপনে গিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে ৪ জন লোককে নিহত করে এবং তাদের রাইফেলগুলি দখল করে নিয়ে আসে। ঐ দিন সকাল ৯টায় লাকসাম-কুমিল্লা রেল লাইনের উপর আলীশ্বরের নিকট মাইন পুঁতে ১টা রেলওয়ে ইঞ্জিণ ও ২টি বগি লাইনচ্যুত করে। ২৬শে মে জগন্নাথদিঘী শত্রু অবস্থানের উপর লে. ইমামুজ্জামানের প্লাটুন রাত ১১টার সময় অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ১টি প্লাটুন ২টি তিন ইঞ্চি মর্টার ২টি মিডিয়াম মেশিনগান ব্যবহার করে। আক্রমণের ফলে শত্রুদের ১৯ জন লোক হতাহত হয়। আমাদের ১টি পেট্রোল পার্টি ২৬শে মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা রোডের উপর উজানিরশা সেতুর নিকট পাকবাহিনীর পাহারারত সৈনিকদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য পাঠান হয়। আমাদের দলটির সঙ্গে কমাণ্ডো শিক্ষাপ্রাপ্ত কিছু লোকও ছিল। কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ দুই জায়গাতেই পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা তাদের গতিবিধির জন্য বিশেষ জরুরী ছিল। উজানিরশা ব্রিজকে ধ্বংস করে পাকসেনাদের গতিবিধিকে ব্যহত করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। আমার দলটি রাত ১১টায় উজানিরশা ব্রিজটি অকস্মাৎ হামলা করে এবং সফলতার সাথে বিস্ফোরক লাগিয়ে ১টা স্প্যান ধ্বংস করে দেয়। এ অকস্মাৎ হামলায় শত্রুদের ১৩ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়।

 ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানী ২৯ শে মে শালদানদীর পিছনে পশ্চিম শিবপুর, বাজার ও সাগরতলাতে শত্রুদের অবস্থানের পিছনে সকাল ৪টায় মেশিনগান এবং ৭৫ এম এমআর আরসহ ঢুকে পড়ে। শত্রুরা তাদের পিছনে হঠাৎ মুক্তিবাহীর অনুপ্রবেশে বেশ হকচকিয়ে যায়। সকাল ৫টা পর্যন্ত আমাদের দলটি শত্রুঅবস্থানের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে শত্রুদের বেশ কয়েকটা বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায় বেলুচের মেজর দুররানিও নিহত হয়।

 ৩১ শে মে আমাদের ১টা পেট্রোল পার্টি কুটির নিকট শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধানে যায়। কুটির নিকটে তারা দেখতে পায় যে পাকসেনাদের ১টি জীপ ৬জন সৈনিকসহ কুটি গ্রামে প্রবেশ করছে। জীপটি গ্রামের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে থেকে ৬ জন পাকসেনা জীপ থেকে বের হয়ে গ্রামের ভিতরে যায়। আমাদের ছোট দলটি বোমা ছুঁড়ে ড্রাইভারসহ জীপটি ধ্বংস করে।

 ৩১ শে মে-তেই আমাদের ৬ জন সৈন্যের একটি দল সুবেদার আবদুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শালদানদী রেলওয়ে স্টেশনের নিকট অনুপ্রবেশ করে। তারা যখন তথ্যানুসন্ধান করছিল, সে সময় পাক সেনাদের দুইজন ও-পি যারা গাছের উপর বসে দূরবীণ লাগিয়ে আমাদের অবস্থান খুঁজছিল, তাদের দেখে ফেলে এবং গুলি করে মেরে ফেলে।

 ৪র্থ বেঙ্গল-এর আলফা কোম্পানী মেজর সালেকের নেতৃত্বে এবং চার্লি কোম্পানী ক্রাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালাদানদী এবং মন্দভাগে পাকসেনাদের উপর বার বার আঘাত হেনে যাচ্ছিল। শত্রুরা প্রতিদিন কিছু না কিছু হতাহত হচ্ছিল। আমাদের এই দুই কোম্পানীর সেনা দল ৩ইঞ্চি মর্টারের সহায়তায় শিবপুর, বাগরা, গৌরলা প্রভৃতি জায়গা হয়ে শত্রু অবস্থানটি প্রায় তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছিল এবং প্রতিদিন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা এরূপ সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে পাকসেনাদের পক্ষে তাদের বাংকার থেকে মাথা তোলারও সুযোগ ছিল না। গুলি এবং মর্টারের গোলার সাহায্যে আমাদের সৈনিকরা তাদের সে অবস্থানে থাকাকে সম্পূর্ণ বিপদজ্জনক করে তুলেছিল। এছাড়া কুটি এবং শালদানদীর রাস্তায় আমাদের এ্যামবুশ পার্টি ২৪ ঘণ্টা এ্যামবুশ পেতে থাকত। এর ফলে রশদ এবং অস্ত্র সরবরাহ করা তাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা রেলওয়ে লাইন ব্যবহারের বার বার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে। এরপর শালদানদী দিয়ে রসদ সরবরাহ করার চেষ্টা করে। সেখানেও তারা আমাদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় তাদের মনোবল সত্যিই ভেঙ্গে গিয়েছিল।

 জুন মাসের ১ তারিখে আমাদের চাপের মুখে টিকতে না পেরে তারা মন্দভাগ এবং শালদানদীর অবস্থানগুলি পরিত্যাগ করে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট তাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপন করে। সম্মুখসমরে শালদানদী থেকে শত্রুসেনাকে জুন মাসের প্রথম দিকে পর্যদস্ত করে পিছু হটিয়ে দেওয়া আমাদের সৈনিকদের জন্য ছিল একটা বিরাট সাফল্য ও কৃতিত্ব। এতে আমার সেক্টরের সব সৈনিকদের মনোবল পুনরুদ্ধার হয়। মার্চ মাস এবং মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাক বাহিনী অতর্কিতে বিপুল সৈন্য, কামান, বিমান বাহিনীর সহায়তায় আমাদের উপর আক্রমন চালায় তখন আমাদের সৈনিকরা অতি সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাক সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে কিন্তু অবশেষে বেশিরভাগ সময়ে পাক বাহিনীর বিপুল শক্তি ও সরঞ্জামের সামনে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় এবং সর্বক্ষেত্রেই আমরা প্রতিরক্ষা অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করেছি এবং পাক বাহিনী বার বার আমদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। শালদানদী এবং মন্দভাগে প্রথম এক মাস পর আমরা পাকবাহিনীর উপর প্রতি আক্রমন চালিয়ে তাদের শক্তিশালী অবস্থান থেকে বিতাড়িত করি। শত্রু সেনা চলে যাবার পর ক্যাপ্টেন গাফ্ফারকে মন্দভাগে প্রধান অবস্থান গড়ে তোলার এবং শালদানদীতে তাঁর অগ্রবর্তী ঘাঁটি করার নির্দেশ দিই।

 যখন আমি যুদ্ধ চালাচ্ছিলাম এবং যুদ্ধ আস্তে আস্তে যখন তীব্রতর হচ্ছিল, তখন আমার সেনাদলে আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। সে সময়ে আমার সৈনিক এবং গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল না, শুধু আমার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ১ জন ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার ছিলেন। অফিসারের সল্পতায় তাঁকেও আমি একটা কোম্পানীর কমাণ্ডার বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োগ করেছিলাম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আখতার ডাক্তার হয়েও একজন যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার আহতের সংখ্যা যখন বেশ বেড়ে যায় এবং অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসার অভাবে অনেক সৈনিক বা গণবাহিনীর ছেলেরা রক্তক্ষয় হয়ে মারা যেতে থাকে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমার সেক্টরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ডেকে পাঠাই এবং অতি সত্বর আমার হেড কোয়ার্টারের নিকট একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করার নির্দেশ দিই। ঢাকা থেকে কিছু সংখ্যক ছেলে মেয়ে আমার সেক্টরে এসে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে দুই একজন চিকিৎসা শিক্ষানবিসও ছিল। তারাও আমাকে ১ টি হাসপাতাল গড়ার জন্য অনুরোধ জানায়। এসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন আখতার কয়েকটি তাঁবুতে মতিনগরে আমার হেড কোয়ার্টারের নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রথম বাংলাদেশ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটা সুন্দর বাগানের ভিতর উঁচু এবং শান্ত পরিবেশে এ হাসপাতালটি অবস্থিত ছিল। প্রথমে হাসপাতালের ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে ঔষুধপত্র বা অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জাম কিছুই ছিলনা। কিন্তু তবুও আমাদের এই নবীন দলটি ক্যাপ্টেন আকতারের নেতৃত্বে সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্তেও ধীরে ধীরে হাসপাতালটি গড়ে তুলতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে টুলু এবং লুলু মেডিকেল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, সবিতা, শামসুদ্দিন প্রমুখ। এসব ছেলেমেয়েদের দল নিজেদের সুখ ও আরাম ত্যাগ করে দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর ছেলেদের সেবাশুশ্রূষা ও চিকিৎসা করে যাচ্ছিল। এরা রেডক্রস ও বন্ধু রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেক কষ্টে ওষুধপত্র যোগাড় করত। মাঝে মাঝে আমি যতটুকু টাকা-পয়সা সেক্টর ফাণ্ড থেকে দিতে পারতাম তা দিয়ে ওষুধপত্র যোগাড় করত। জুন মাসের দিকে লণ্ডন থেকে ডাঃ মবিন (প্রবাসী বাঙ্গালী) আমাদের এই হাসপাতালের কথা শুনে এখানে এসে যোগ দেন। এর কিছু দিন পর ডাঃ মবিনের আর এক বন্ধু ডাঃ কাফরুল্লাহ সংবাদ পেয়ে লণ্ডন থেকে এসে যোগ দেন। এরা দুজনেই লণ্ডনে এফআরসিএস পড়ছিলেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ শুনে তারাও এসে অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন। তারা তাদের লণ্ডনের সব সুখ ও আরাম ত্যাগ করে আমাদের এ হাসপাতালের নাম শুনে ছুটে এসেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। তাদের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয় এবং আমার এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য একটি পরিকল্পনা নিই। ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহ আমাকে আশ্বাস দেন লণ্ডনে অবস্থিত প্রবাসী বাঙালিরা তাদের মাতৃভূমির জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে এবং আমরা যদি বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের কাছে আহবান জানাই তবে এ হাসপাতালে সরঞ্জামের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহকে বিস্তারিত সরঞ্জামের তালিকা বানানোর নির্দেশ দেই। আর সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর একটু পিছে বিশ্রামগঞ্জে সুন্দর জায়গায় পাহাড়ের উপর অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা নিতে নির্দেশ দিই। আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের প্রধান সেনাপ্রতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তাকে আমি আমার সেনাদল ও ছেলেদের চিকিৎসার শোচনীয় অবস্থার কথা জানাই। তিনি আমাকে আমার হাসপাতাল তৈরীর পরিকল্পনায় উৎসাহ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশ হাজার টাকা মঞ্জুর দেন। এক মাসের মধ্যে বাঁশ, কাঠ ও ছন দিয়ে আমরা বিশ্রামগঞ্জে ২০০ বেডের হাসপাতাল তৈরী করে ফেলি। ডাঃ জাফরুল্লাহ লণ্ডনে চলে যান হাসপাতালের জন্য ওষুধপত্র ও অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে। আমাদের হাসপাতাল যখন তৈরি হচ্ছিল তখন আহতের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব ছিল। এছাড়াও ওষুধের অভাব ছিল আমাদের প্রকট। কিন্তু তবুও এসব অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ছোট হাসপাতালটি আস্তে আস্তে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছিল। যদিও এগুলি বাঁশ এবং ছনের ঘর ছিল তবুও উৎসর্গিত ছেলেমেয়েদের প্রচেষ্টায় সমস্ত এলাকাটা শান্তিদায়ক হয়ে উঠেছিল। সকালে উঠেই সমস্ত হাসপাতালের বিভিন্ন কাঁচা ওয়ার্ডগুলি তারা নিজ হাতে লেপতো এবং পরিস্কার করতো। হাসপাতাল রোগীর কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে তাদের রান্নাবান্না, সেবাশুশ্রূষা সব কিছু এরাই করতো। এদের সঙ্গে আরো ২০ জনের মতো ছেলেমেয়ে এসে যোগ দেয়। কিছুদিন পর ডাঃ জাফরুল্লাহ ও ডাঃ মবিনের প্রচেষ্টায় এবং লণ্ডন প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের সহায়তায় আমরা এ হাসপাতালটির জন্য অস্ত্রোপাচারের সরঞ্জামাদিসহ ওষুধপত্র পেয়ে যাই। ৯ মাসের যুদ্ধে এ হাসপাতালটি কয়েক হাজার আহতকে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপাচার করতে সক্ষম হয়। এ হাসপাতালটির আর একটি অবদান ছিল যে এটি স্থাপনের পর আমার সেনাবাহিনীর ছেলেদের ও গণবাহিনীর মনোবল আরো বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যদি তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় তবে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এটাকে আরো উন্নত করার জন্য উৎসাহ দেন। সেপ্টেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

 ২৯ শে মে রাতে আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি কুমিল্লার বাটপাড়ায় এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। শত্রুদের ২ টা গাড়ী রাত ২ টার সময় এ্যামবুশ এর ফাঁদে পড়ে। এ্যামবুশ পার্টি সাফল্যের সাথে ২ টি গাড়ী ধ্বংস করে দেয় এবং সেই সঙ্গে ৪ জনকে নিহত করে। শত্রুদের পিছনের গাড়ীটি ফাঁদে পড়ার আগেই পালিয়ে যায়। ২৯ শে মে রাত ৯ টায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ২ টি সেকশন কসবার পশ্চিমে টি, আলীর বাড়িতে শত্রুদের অবস্থানের উপর অকস্মাৎ অণুপ্রবেশ করে এবং আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের সাহায্যে আড়াইবাড়ী শত্রুঅবস্থানের উপর গোলা চালায়। এ আক্রমনে শত্রুদের ১ টা বাংকার ধবংস হয়ে যায় এবং তিনজন লোক নিহত ও ২ জন শত্রুসেনা আহত হয়। এরপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ শেষ করে নিজ অবস্থানে চলে আসে।

 ৩১ মে রাত তিনটায় একটা প্লাটুন লে মাহবুবের নেতৃত্বে কুমিল্লার দক্ষিণে জহমোহনপুর নামক স্থানে শত্রু ঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায় এবং শত্রু সেনাদের ১২ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা যখন কসবার দিকে তাদের চাপ বাড়াতে থাকে, আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকে একটা কোম্পানীসহ কসবার উত্তরে লাটুমুরায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিই।

 ৩০ শে মে সন্ধ্যা ৭ টায় আমাদের ১ টি ছোট গেরিলা দল ইকবালের (বাচ্চু) নেতৃত্বে বিবিরবাজারে শত্রুসেনাদের অবস্থানে আঘাত হানার জন্য পাঠান হয়। পাক সেনারা তখন তাদের অবস্থানের উপর বসে তাদের সান্ধ্যভোজনে ব্যস্ত ছিল এবং এ সময়টি সম্বন্ধে আমাদের স্থানীয় লোকের দ্বারা খবর আগে থেকেই সংগ্রহ করা ছিল। পাক সেনারা যখন খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, সে সময় আমাদের গেরিলা দলটি তাদের উপর হঠাৎ গোমতী বাঁধের উপর থেকে গোলাবর্ষণ করে। এতে শত্রুদের ১০ জন হতাহত হয়। ঐ দিন সাড়ে ৬ টার সময় আমাদের মর্টার প্লাটুন সিঙ্গারবিল শত্রুঅবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে। এর ফলে শত্রুদের ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ২৯ শে মে চৌদ্দগ্রাম বাবুর্চি রোডে হরিসর্দার বাজারের নিকট রাস্তার ব্রিজ সম্পূর্নভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়।

 ২৯ শে মে বিকাল ৪ টায় ৪র্থ বেঙ্গল এর পাইওনিয়ার পার্টিকে লাকসাম-চাঁদপুর রেলওয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেল গাড়ী লাইনচ্যুত করার জন্য পাঠানো হয়। এ দলটি মাইন পুঁতে লাকসাম এবং নোয়াখালীর মাঝে তিনটি রেলওয়ে বগী সম্পূর্নভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। ফেরার পথে পাইওনিয়ার পার্টির ছোট দলটি চৌদ্দগ্রাম-চট্টগ্রাম সড়কের উপর একটি সদ্য মেরামত করা ব্রিজের উপর মাইন পুঁতে দেয়। রাত ৮টায় একটি জিপ ৫ জন পাকসেনা সহ ফেনীর দিক থেকে আসে। জিপটি যখন ব্রিজের উপর পৌঁছে তখন মাইন বিস্ফোরিত হওয়াতে ব্রিজটি সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এর ফলে ১ জন অফিসারসহ তিনজন পাকসেনা নিহত এবং অন্য ২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় তিনজন গেরিলাকে হ্যাণ্ড গ্রেনেডসহ চৌদ্দগ্রাম থানায় পাঠান হয়। থানার সন্নিকটে দিঘির নিকট শত্রুদের একটি বাংকার ছিল। গেরিলা দলটি গ্রেনেড ছুড়ে বাংকারটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে ৩ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং কিছু স্থানীয় লোকও আহত হয়। ৩০ শে মে চৌদ্দগ্রামের আধ মাইল উত্তরে চৌদ্দগ্রাম মিয়াবাজার রোডের উপর ৪র্থ বেঙ্গল এর বি কোম্পানীর একটি প্লাটুন হঠাৎ শত্রুদের ২৭ জনের একটি দলকে দূরে থেকে আসতে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এ্যামবুশ পাতে। শত্রুরা যদিও এ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায় কিন্তু তারা ত্বরিত গতিতে রাস্তার পশ্চিম পাশে সরে পড়ে। এ্যামবুশের ফলে শুধু তিনজন শত্রুসেনা নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা লাকসাম বাংগোড়া কাঁচা বাস্তার উপর ফেলনা গ্রামের নিকট মাইন পুতে রাখে। শত্রুদের একটি তিন টনের গাড়ী এ মাইনের সাথে সংঘর্ষে সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ২৯ শে মে ৪র্থ বেঙ্গল এর 'ব্রাভো' কোম্পানীর একটা প্লাটুন ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ সন্ধ্যায় চৌদ্দগ্রাম থানার উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। অতর্কিত মর্টারের গোলার আঘাতে এবং হালকা মেশিনগানের আঘাতে তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়।

 জুন মাসের ৪ তারিখে রাত দুটোর সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর ২টা প্লাটুন মর্টার নিয়ে শত্রুদের অবস্থানে গোপন পথে প্রবেশ করে শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ভোর বেলায় পাকসেনারা যখন তাদের বাংকারের উপর অসতর্কভাবে ঘোরফেরা করছিল ঠিক সে সময় আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর অতর্কিত মর্টার এবং মেশিন গানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। আধ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা জবাব আসে না। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের প্রায় ১৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। আমাদের একজন সৈন্য বুকে গুলি লেগে গুরুতরভাবে আহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘণ্টা পরে শত্রুরা যখন ভেবেছিল আমাদের সৈন্যরা অবস্থান পরিত্যাগ করেছে এবং তাদের আহতদের পিছনে নিয়ে যাবার যখন ব্যবস্থা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের সৈন্যরা আবার তাদের উপর দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুদের আবারও ৫ জন নিহত হয়। এরপর আমাদের পার্টি অবস্থান ত্যাগ করে চলে আসে। ঐ দিনই সকাল ৭ টার সময় আমার আর একটা পার্টি শত্রুদের রাজাপুর অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শত্রুকে নিহত করে এবং তিনজনকে আহত করে। আমাদের আরেকটি দল  রাত ১টার সময় কুমিল্লার দক্ষিণে সুয়াগাজীতে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ১টা সেতু উড়িয়ে দেয় এবং বাগমারার রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে দেয়।

 ৬ই জুন একটি ডেমোলিশন পার্টিকে লাকসামের দক্ষিণে পাঠান হয়। এই দলটি খিলাতে লাকসাম নোয়াখালী মহাসড়কের উপর ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুতে রাখে। সকাল ৫টায় কুমিল্লা থেকে শত্রুর ২টি জীপ ও একটি ট্রাক নোয়াখালী যাবার পথে মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে সঙ্গে ৪জন পাক অফিসার এবং ৭জন সৈন্য নিহত হয়। পাক সেনাদের ২টি কোম্পানী কুমিল্লা থেকে শালদানদীর উত্তরে আসে এবং রেলওয়ে লাইনের সাথে সাথে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। ৪র্থ বেঙ্গল এর এ কোম্পানী শত্রুদের এ অগ্রগতিকে বাধা দেয় সকাল ৬টার সময় শালদানদীর পূর্ব দিক থেকে। শত্রুরা বাধা পাবার ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আমাদের গুলির মুখে পাক সেনাদের ২৫জন লোক হতাহত হয়। সকাল ৬টায় পাক সেনাদের আর একটি দল কুমিল্লা থেকে একটি ট্রেনে করে নয়নপুর এবং শালনদীর দিকে আসছিল। এ ট্রেনটি নয়নপুরের দক্ষিণে আমাদের অবস্থানরত সৈন্যদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের গোলাগুলির সামনে শত্রুৱা টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পর রাজাপুরে পশ্চাদপসরণ করে। এর ৪/৫ ঘণ্টা পরে শত্রুরা কামানের গোলার সহায়তায় আবার নয়নপুর পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু নয়নপুর স্টেশনে যখন তারা ব্যাংকার তৈরীতে ব্যাস্ত সে সময় আমাদের মর্টার তাদের উপর ভীষণ গোলাগুলি চালায় এবং শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষতি করে। শত্রুরা কিছু পিছু হটে নয়নপুর গ্রামে ভিতর অবস্থান নিয়ে তাদের বাংকার তৈরী করতে শুরু করে। ঐদিনই শত্রুদের একটি পেট্রোল পার্টি কসবার দিকে অগ্রসর হয়, আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানীর একটা প্লাটুন তাদেরকে অতর্কিত এ্যামবুশ করে। পাকসেনারা এ এ্যামবুশ- এর ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের অন্ততপক্ষে ২০জন লোক হতাহত হয়। শত্রুদের দলটি আমাদের এ্যামবুশ পার্টির তাড়া খেয়ে তাদের অবস্থান আড়াইবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। আমাদের একটি দল কুমিল্লার দক্ষিণে ধানপুর বিওপির নিকট পাকসেনাদের জন্য এ্যামবুশ পেতে থাকে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা দালালদের মারফতে এ খবর পায়। কুমিল্লা থেকে পাক সেনাদের একজন অফিসারসহ ১টা প্লাটুন গ্রামের ভিতর দিয়ে এসে আমাদের এ্যামবুশ পার্টিকে ঘিরে ফেলায় চেষ্টা করে। এ্যামবুশ পার্টি তৎক্ষণাৎ কিছু পিছু হটে গিয়ে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ ঘণ্টাখানেক স্থায়ী হয়। ইতিমধ্যে আমাদের ধানপুরের কোম্পানী খবর পেয়ে লে. মাহবুব ও লে. কবিরের নেতৃত্বে তৎক্ষনাৎ এ্যামবুশ পার্টিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে এবং তারা পাকসেনাদের দলটিকে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের ভিতর লুকিয়ে পড়ে এবং দালালদের সাহায্যে এ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৫জন সৈন্য নিহত হয়।

 ঐ দিনই বিকাল তিনটায় পচুয়াতে আমাদের আর একটা এ্যামবুশ পার্টির ফাঁদে শত্রুদের একটি দলের ১০ জন হতাহত হয়। ৪ ও ৫ই জুন রাতে লাকসাম চাদপুর রেল লাইনের মাঝে মধু রোডস স্টেশনের নিকটে জমজমা রেলওয়ে সেতুটি সুবেদার পাটওয়ারীর একটি দল উড়িয়ে দেয়। ঐদিনই রাতে আর একটি দল চাদপুর কুমিল্লা সড়কের মহামায়া বাজারের নিকটে একটি পুল ধ্বংস করে দেয়। এর দুই দিন পরে চাদপুরের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর ফলে সমস্ত চাদপুরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কলকারখানাগুলি ও বন্ধ হয়ে যায়। পরে শত্রুরা এসে পাশের গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটতরাজ ও মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে।

 আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল ডি কোম্পানীর একটা প্লাটুন ১১ই জুন সকাল ৬টায় কসবার উত্তরে চার্নল নামক জায়গায় এ্যামবুশ পেতে রাখে। শত্রুদের একটি কোম্পানী দুপুর ১২টার সময় আমাদের এ্যামবুশ এর মধ্যে পড়ে যায়। আমাদের গুলীতে তাদের ১২জন সৈন্য নিহত হয়। এতে আমাদের একজন আহত হয় এবং পরে মারা যায়। পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে ঐ জায়গা থেকে ইয়াকুবপুরের দিকে পলায়ন করে। পলায়নের পর শত্রুদেরকে আমাদের আর একটি এ্যামবুশ পার্টি দেখে ফেলে এবং তারাও ইয়াকুবপুরের নিকট তাড়াতাড়ি শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য এ্যামবুশ পাতে। শত্রুরা এ এ্যামবুশ এর ফাদে পড়ে যায় এবং সম্পূর্নরূপে পরাস্ত হয়। এ এ্যামবুশে শত্রুদের ৮জন লোক নিহত এবং ১৩জন আহত হয়। এ দুটি এ্যামবুশ এর অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয় এবং শত্রুরা এ এলাকা থেকে চলে যায়।

 এই সময়ে শালদানদীর দক্ষিণে রেলওয়ে ব্রিজ কুটির রাস্তায় বাসারা গ্রামের সেতু মন্দভাগ গ্রামের সেতু সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়।

 আমাদের হেড কোয়ার্টারে এ খবর আসে যে পাক সেনারা তলুয়াপাড়া ফেরী ঘাট তাদের যাতায়াতের জন্য সাধারনত ব্যাবহার করে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে আমাদের একটি প্লাটুনকে ৯ই জুন রাত্রে তলুয়াপাড়াতে পাঠান হয়। এ প্লাটুনটি তলুয়াপাড়া ফেরী ঘাটের নিকট শত্রুদের জন্য এ্যামবুশ পাতে। ১০ই জুন রাত ১১টার সময় শত্রুদের একটি দল সেই ফেরীঘাটে আসে এবং নৌকাযোগে পার হতে থাকে। শত্রুরা যখন নদীর মাঝখানে এ্যামবুশ দলটি সে সময় তাদের উপর গুলি চালাতে শূরু করে। এর ফলে নৌকাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের ২০ জন লোক হতাহত হয়।

 আমাদের একটি প্লাটুন লে. মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ই জুন রাত্রে মিয়াবাজারের দক্ষিনে রাজারমার দিঘী ও জগমোহনপুর কাচারীর শত্রুঅবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা এই সাহসী আক্রমনে হকচকিয়ে যায়। আমাদের সৈন্যরা পাক সেনাদের বাংকারে গ্রেনেড ছুড়ে ৮জন পাকসেনাকে নিহত ও ৫জনকে আহত করে। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। এরপর আমাদের সৈন্যরা অবস্থানটি দখল করে বাংকারগুলি ধ্বংস করে দেয় এবং শত্রুদের পরিত্যাক্ত অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে।

 আমাদের ৩টি গেরিলা দল কুমিল্লা ও লাকসামে পাঠানো হয়। ১১ই জুন কুমিল্লাতে গেরিলা দলটি শত্রুদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর দশটি গ্রেনেড ছোড়ে এতে পাক সেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সমস্ত কুমিল্লা শহর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ঐ দিনই চারজন গেরিলার ডেমোলিশন পার্টি জাঙ্গালিয়ার নিকট মাইন পুতে একটি ডিজেল ইঞ্জিন লাইনচ্যুত করে।

 লাকসামে যে গেরিলা দলটি পাঠানো হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল আবদুল মান্নান। পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গ্রেনেড ছোড়ে এবং এতে ৫জন নিহত হয়। এ দলটি লালমাই এর নিকট পাকসেনারা যে ঘরে থাকতো তার ভিতর ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতেও পাক সেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। এর ফলে পাক সেনারা লাকসামে ৭২ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারী করে এবং অনেক নির্দোষ লোকের উপর অত্যাচার চালায়। আর একটি দল লাকসামে পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড ছোড়ে। এর ফলে কিছু লোক আহত হয়। আমাদের দুটি এ্যামবুশ পার্টি ফুলতলি এবং মিয়ার বাজারের নিকট ঐ দিনই এ্যামবুশ পেতে রাখে পাক সেনাদের দুটি গাড়ী রাত সাড়ে চারটার সময় ফুলতলীতে এ্যামবুশ এর মধ্যে পড়ে যায়। এ্যামবুশ পার্টি একটা গাড়ীকে ধ্বংস করে। দেয় এবং একটা গাড়ীর ক্ষতিসাধন করে। শেষের গাড়ীটির ভিতর এ্যামবুশ পার্টি ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে শত্রুদের ৬জন লোক নিহত হয়। মিয়ার বাজারের এ্যামবুশেও পাকসেনাদের ৫জন লোক নিহত হয় এবং আমাদের এ্যামবুশ পার্টি একটি মর্টার দখল করে নেয়।

 আমাদের কাছে সংবাদ আসে যে, ওয়াল্ডং ব্যাংক টিম জুন মাসে ঢাকাতে আসছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সরেজমিনে ঘটনাবলী অবগত হওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের প্রচারযন্ত্র সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমটির অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যদি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেয়, তাহলে সেই আর্থিক সাহায্যে পাকিস্তানের সমরাস্ত্র কেনার ও যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে যথেষ্ট সুবিধা হবে। যে করেই হোক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়। বরং বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানই পাক বাহিনীর আয়ত্তাধীনে নেই।

 এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি গেরিলার একটি দলকে ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানো এবং পাকিস্তানীদের নিহত করার জন্য পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ৪ঠা জুন ঢাকায় গোপন পথে রওনা হয়ে যায় এবং পর দিন সকালে পৌছে যায়। এই দলেরই ২ জন ছেলে ৮ই জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় জিন্নাহ এভিনিউর কলেজ সু স্টোরের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। আর একটি গ্রেনেড ছোড়ে পুরানা পল্টনে সন্ধ্যা আটটায়। ঐ দিনই আর একটি ছোট দল ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টের ভিতর একজন পাকিস্তানী অফিসারের বাড়ীর ভিতরে দুপুর দুটোর সময় গ্রেনেড ছোড়ে। এতে অফিসারের গাড়ীটির ক্ষতিসাধিত হয় এবং একজন লোক আহত হয়। পরের দিন সন্ধ্যায় মর্নিং নিউজ অফিসের ভিতর গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানী দালাল নিহত হয়। ইতিমধ্যে দলটি খবরাখবর নেয় যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে অবস্থান করছে। এ খবর পাবার পর ২ জন গেরিলা ৯ই জুন সন্ধ্যা ৮-১৫ মিনিটে হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে প্রবেশ করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম এ হোটেলে ফেরার প্রতিরক্ষায় থাকে। তারা যখন তাদের গাড়ীতে করে আসেন এবং গাড়ী নিচে রেখে হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করেন সে সময় গেরিলা দলটি গাড়ী লক্ষ করে ৩টি গ্রেনেড ছোড়ে। এর ফলে গাড়িটি সম্পূর্ন রুপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং নিকটবর্তী একজন পাঞ্জাবী সেনাও নিহত হয়।

 এ সমস্ত ঘটনাবলীতে বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তাগণ অতি সহজেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের বিস্ফোরণের তারা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) বর্তমান অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এই ঘটনার পর বিশ্ব ব্যাংক টিম দেশে ফিরে গিয়ে তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক ঘটনাবলী তুলে ধরেন। তারা তাদের রিপোর্টে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য না দেওয়ার সুপারিশ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এক বিরাট পরাজয়।

 রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নিকট পাচড়া গ্রামে শত্রুদের একটি অবস্থান ছিল। এই অবস্থানটি শত্রুদের নয়নপুর এবং রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পিছন থেকে সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হত। মতিনগর থেকে একটি রেইডিং পার্টিকে পাচড়া গ্রামে শত্রুঅবস্থানের উপর অনুপ্রবেশ করে আক্রমন করার নির্দেশ দেয়। ১৩ই জুন রাত নটার সময় এ দলটি গ্রামের গোপন পথে শত্রু অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ অতর্কিত আক্রমণে শত্রুদের মধ্যে সম্পূর্ন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমাদের দলটি বেশ কিছু পাকসেনাকে হতাহত করে শত্রু অবস্থান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু এরপরেও শত্রুদের মধ্যে রাতের অন্ধকারে প্রায় ২ঘণ্টা গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনাদের অয়্যারলেস ম্যাসেজ আমাদের অয়ারলেসে ধরা পড়ে। এতে শোনা যায় পাকসেনারা তাদের ঊর্ধ্বতন হেড কোয়ার্টারকে জানাচ্ছে মুক্তিবাহিনী আমাদের উপর ভয়ংকর আক্রমন চালাচ্ছে। আমাদের নির্দেশ দিন আমরা এখন কি করব। এছাড়াও শত্রু অবস্থান থেকে বার বার শ্লোগান শোনা যায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আজিজ ভাট্টি জিন্দাবাদ, ১৭তম পাঞ্জাব জিন্দাবাদ ইত্যাদি। গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ তখনও চলতে থাকে। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের দলটি সরে আসার পরও পাক বাহিনী নিজেদের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা গোলাগুলি করে বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ১১জন নিহত ও ১২জন আহত হয়। বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের নিজেদের গুলিতেই হতাহত হয়।

 পাকিস্তানীরা সীমান্তের নিকটবর্তী থানাগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং মিলিশিয়া নিয়োগ করতে শুরু করে। এসব থানাগুলিতে তারা বাংকার তৈরী করে অবস্থানকে শক্তিশালী করতে তাকে। কুমিল্লার উত্তরে সবগুলো থানাকেই তারা এভাবে শক্তিশালী করে। আমি এসব থানাগুলোকে আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের শাসনযন্ত্রকে অচল করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা করি। অমার অবস্থানের নিকটবর্তী বুড়িচং থানা আমার জন্য একটা বাধার কারণ হয়ে দাড়িয়ে ছিল। কেননা বুড়িচং এর ভিতর দিয়েই আমার গেরিলারা গোপন পথে ঢাকা কুমিল্লা এবং ফরিদপুরে যাতায়াত করত। এই থানাটির অবস্থানের গোপন পথগুলো মোটেই নিরাপদ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা পাক সেনাদের খবরাখবর পাঠাত। আমি বুড়িচং থানা আক্রমন করার জন্য ১৬জনের একটি দলকে পাঠাই। ১৪ই জুন রাত ১টায় এই দলটি অতর্কিত বুড়িচং থানার উপর আক্রমন চালায়। থানায় প্রহরারত ইপকাফ এবং পুলিশ যথেষ্ট বাধা দেয়। কিন্তু অবশেষে আমাদের রেইডিং পার্টির হাতে তারা পরাস্ত হয়। এই সংঘর্ষে শত্রুদের ৮জন নিহত হয়। আমাদের ১জন লোক গুরুতরভাবে আহত এবং একজন নিখোজ হয়। এর ফলে বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং ঢাকা, কুমিল্লা যাবার গোপন পথ নিরাপদ হয়।

 ঢাকাতে ৪ঠা জুন যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিল সেই দলটি তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে যাতে স্বাভাবিক পরিবেশ পাকিস্তানীরা ফিরিয়ে আনতে না পারে। ঢাকার প্রশাসন ব্যবস্থা যাতে পাকিস্তানীদের সম্পূর্নভাবে নিয়ন্ত্রনে না আসে তার জন্য এই গেরিলা দল তৎপর ছিল। দলটি ১০ই জুন দুপুর ২টার সময় নিউ মার্কেটের প্রধান চত্বরে তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে সমস্ত লোকজন নিউ মার্কেট থেকে পালিয়ে যায় এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এর পরদিন বিকাল ৪টার যখন অফিস শেষ হচ্ছিল ঠিক সে সময় ওয়াপদা বিল্ডিং এর সামনে ২টি গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটায়। এর ফলে ওয়াপদা ভবনের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।

 এদিকে নয়নপুর রেল স্টেশনের নিকট গোডাউনের ভিতর শত্রুদের কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের ঘাটি গড়ে তুলেছিল। এই সংবাদ ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী জানতে পারে। মেজর সালেক একটি প্লাটুনের সঙ্গে আর আর রাইফেল ও মর্টার দিয়ে এ ঘাটিটি আক্রমনের জন্য পাঠায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ দলটি শত্রুদের অবস্থানে দক্ষিণ দিক দিয়ে পিছনে অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিতে ঐ গোডাউনটির উপর আক্রমন চালায়। আর আর এবং মর্টারের গোলা গোডাউনটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং কয়েকটি আর আর এর গোলা গোডাউনের ভিতরে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। ঐ দিন রাতেই হাবিলদার সালামের নেতৃত্বে নয়নপুরের রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিনে আশাবাড়ী থেকে রাত দেড়টার সময় শত্রু অবস্থানের উপর আর আর রাইফেল ও মর্টারের সাহায্যে আবার আক্রমন চালানো হয়। শত্রুরা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারা দ্বিতীয়বার আক্রমণ আশা করেনি। এ আক্রমনের ফলেও শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 এ সময় শত্রুদের অবস্থান যেখানে যেখানে ছিল সে সব অবস্থানের কাছাকাছি এবং পাক সেনাদের চলাচলের রাস্তার উপর মাইন পুতে রাখা হয়েছিল। ১৪ই জুন রাতে ফকিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৭০০/৮০০ গজ উত্তরে শত্রুর একটি দল দুপুরে বখশিমাইল গ্রামে পেট্রোলিং এর জন্য গিয়েছিল। আর একটি দল গাজীপুরের নিকট আমরা যে কাঠের পুল জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম সেটি মেরামত করছিল। বখসিমাইল গ্রাম থেকে সন্ধ্যার সময় পাক সেনাদের দলটি ফকিরহাটে নিজেদের অবস্থানে ফেরার পথে আমাদের পুতে রাখা মাইনের মধ্যে পড়ে যায় এবং মাইনগুলি তাদের পায়ের চাপে ফাটতে থাকে। এতে তাদের অনেক লোক হতাহত হয় এবং তাদের মধ্যে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ মাইনগুলোর ফাটার শব্দ নিকটবর্তী অবস্থান থেকে পাকসেনারা শুনতে পায়। রাতের অন্ধকারে তারা ঠিক বুঝতে পারছিল না এ বিস্ফোরণের সঠিক কারণ কি? মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ভেবে পাক সেনারা প্রচণ্ডভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। এই গোলাগুলি রাত ৮টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে। শত্রুরা নিজেদের লোকের উপর শতে শতে মর্টার এবং কামানের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের দূরে অবস্থিত পেট্রোল ইয়া আলী, ইয়া আলী, বাচাও বাচাও, প্রভৃতি ধ্বনি শুনতে পায়। পরে আমরা পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকমুখে শুনতে পাই যে আমাদের মাইনে এবং পাক সেনাদের নিজেদের গোলাগুলিতে অন্ততপক্ষে ৪০/৫০ জন পাক সেনা হতাহত হয়েছে। পরদিন সকালে পাকসেনারা একজন ব্রিগেডিয়ার ঐ অবস্থানটি পরিদর্শন করতে কুমিল্লা থেকে আসেন।

 পাকসেনারা এই দুর্ঘটনার পর রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের চতুর্দিকে এবং ফকিরহাট পর্যন্ত তাদের পেট্রোলিং আরো জোরদার করে। মতিনগরে অবস্থিত আমাদের কোম্পানী শত্রুদের এই কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ১৬ই জুন সকালে আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের পেট্রোলিং পথের উপর এ্যামবুশ পাতে। সকাল ৯টায় পাক সেনাদের একটি দল রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রওনা হয়। এই দলটি আমাদের এ্যামবুশ এর মধ্যে পড়ে যায়। অতর্কিতে আমাদের লোকেরা পাকসেনাদের উপর হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি চালায়। এই গোলাগুলিতে শত্রুদের ৮জন নিহত ও একজন আহত হয়। এছাড়া আমাদের লোকেরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, ড্রাইসেল ব্যাটারি ও আরও অন্যান্য জিনিস হস্তগত করে।

 জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার কাছে খবর আসে যে, শত্রুদের গোলান্দাজ বাহিনীর একটি ব্যাটারি (দল) কুমিল্লা ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সিএণ্ডবি রোড তাদের কামানের অবস্থান হিসাবে ব্যবহার করছে। পাক বাহিনীর নয়নপুর, শালদা নদী, টি, আলীর বাড়ী (কসবায়) প্রভৃতি শত্রু অবস্থানের জন্য এই কামানগুলি থেকে সাহায্যকারী গোলা নিক্ষেপ হত। এই কামানগুলির জন্য পাক বাহিনীর উপরোক্ত অবস্থানগুলির উপর আক্রমন অনেক সময় কার্যকরী করা যেত না। আমার কাছে আরও খবর আসে যে, প্রায় ১৫০ জন পাক সেনা এই কামানগুলিকে ব্যাবহার ও রক্ষনাবেক্ষন করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র আমি লে. হুমায়ুন কবিরকে এই কামানের অবস্থানটি আক্রমন করে ধ্বংস করার জন্য নির্দেশ দেই। ৪০ জনের একটি দল (৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানী) লে. হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে ১৬ই জুন রাত সাড়ে ১০টায় শত্রুঅবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। সমস্ত রাত চলার পর দলটি কুমিল্লা- ব্রাহ্মনবাড়িয়ার রাস্তার পশ্চিমে সাইদাবাদের চার মাইল উত্তরে ভোরে পৌঁছে এবং তাদের একটি গোপন অবস্থান তৈরী করে। ১৭ই জুন সমস্ত দিন এবং রাত লে. হুমায়ূন কবির তার সঙ্গে শুধু কয়েকজনকে নিয়ে পাকসেনাদের সাইদাবাদ অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে অনুসন্ধান করে। এই অবস্থানটি পাহারার কি কি ব্যবস্থা আছে, কারা পাহারাদার এবং কি কি অস্ত্রের সাহায্য পাহারা দেয়, অবস্থানটিতে পৌঁছার জন্য গোপন পথ কি, কামানগুলি রাতে কোন স্থানে রাখে, কোন সময়ে পাক সেনারা বেশী সজাগ এবং তাদের বাংকারগুলির অবস্থান কোথায় প্রভৃতি খবরাখবর সে সংগ্রহ করে। এরপর লে. হুমায়ুন কবির সকাল হবার আগেই তার গোপন ঘাটিতে ফেরত আসে। ১৮ই জুন সমস্ত দিন তার দলটিকে পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর বলে এবং পাক ঘাটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা এবং কার্যাবলী সম্বন্ধে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দেয়। সমস্ত দিন দলটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

 ১৮ই জুন ভোর চারটায় লে. হুমায়ুনের নেতৃত্বে আমাদের দলটি পাক সেনাদের কামান ঘাঁটির উপর পিছন দিক থেকে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা তাবুর মধ্যে শুয়ে ছিল। তারা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সেদিনই কুমিল্লা থেকে পাক সেনাদের দুটি কোম্পানী যেগুলি সামনে শত্রুদের ঘাটিকে শক্তিশালী করার জন্য যাচ্ছিল তারাও রাতের বিশ্রামের জন্য অসতর্কভাবে এ অবস্থানটিতে শুয়ে ছিল। আমাদের দলের অতর্কিত আক্রমণে পাকসোনাদের ঘাটিতে ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং অনেক শত্রুসেনা আমাদের গুলিতে প্রান হারাতে থাকে। আমাদের লোকেরা কয়েকটি জীপ ও ৩টনের ট্রাকে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকসেনারা এত বেশী ভীত হয়ে পড়ে যে তারা তাদের হেড কোয়ার্টারে জঙ্গী বিমানের সাহায্যের প্রার্থনা জানায়। যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ভয়ংকরভাবে চলে এবং আমাদের সৈন্যরা কামান, গাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সকাল হয়ে যায় এবং শত্রুদের প্রতিরোধ শক্তি বাড়তে থাকে ও তাদের আবেদনে তিনটি জঙ্গী বিমান ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমাদের রেইডিং পার্টির উপর আক্রমন চালায়। লে. হুমায়ূনের দলটি তখন আটকা পড়ে যাবার ভয়ে আক্রমণ শেষ করে গ্রামের গোপন পথে মেঘনার দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এই পশ্চাদপসরনের সময় তারা বার বার পাকিস্তানী জঙ্গী বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবুও সমস্ত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তারা সাফল্যের সাথে শত্রদের আওতার বাইরে চলে আসে। একদিন পর তারা অন্য পথে আবার কুমিল্লা ব্রাহ্মনবাড়িয়া প্রধান সড়কের উপর আসে এবং মতুরা সড়কের সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে নিজ ঘাটিতে নিরাপদে ফিরে আসে।

 এ আক্রমণের ফলে যদিও লে. হুমায়ুনের দলটি পাকসেনাদের কামান দখল করে আনতে পারেনি কিন্তু তবুও এ আক্রমণের ফলাফল পাকসেনাদের জন্য ছিল ভয়াবহ। অন্ততপক্ষে ৫০/৬০ জন পাকসেনা এ আক্রমণে হতাহত হয়। মৃতদেহগুলি পাকসেনারা ২টি বেসামরিক বাসে লাল ঝাণ্ডা তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। এ খবর স্থানীয় লোকেরা জানায়। তাছাড়া গাড়ি, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও এই অবস্থানে রাখা কামানের গোলা যেগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল তা ছিল তাদের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্নক ক্ষতিকর। আসার পথে দলটি যে সেতু উড়িয়ে দিয়ে আসে এতেও তাদের গতিবিধির উপর যথেষ্ট বাধার সৃষ্টি করে। এ হামলার পর শত্রুসেনারা প্রায় ২/৩ সপ্তাহ সমস্ত সেক্টরে তাদের কার্যকলাপ সম্পূর্নরূপে বন্ধ করে দেয়। পাকসেনারা এরপর নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালায় এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

 ১৬ই জুন আমাদের কসবা অবস্থান থেকে একটি ছোট দল বগাবাড়ি নামক জায়গায় এ্যামবুশ পাতে। সকাল ৬টায় পাক সেনাদের একটি পেট্রোল পার্টি সবার দিকে তাদের টহলে আসে। পাকসেনাদের এই দলটি অসতর্কভাবে হঠাৎ আমাদের এ্যামবুশ পার্টির ব্যাংকারের নিকট চলে আসে। আমাদের এ্যামবুশ দলটি এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। অতি নিকট থেকে তাদের সমস্ত অস্ত্র গুলী চালাতে থাকে। অতর্কিত গুলীর আঘাতে প্রায় ১০জন পাকসেনা নিহত ও ৫জন আহত হয়। শুধু ২জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

 পাকসেনারা ১৮ই জুন আমাদের অবস্থান কৈখোলার উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের অবস্থানকারী প্লাটুনটি কৈখোলা ত্যাগ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের একটি দল কৈখোলা দখল করে নেয়। ঐ দিন রাতে মেজর সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে আমাদের এ কোম্পানী ভোর রাতে কৈখোলায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমন চালায়। হাবিলদার সালামের প্লাটুন শিবপুরের দিক থেকে এবং সুবেদার আবদুল হক ভূইয়ার প্লাটুন দক্ষিণ দিক থেকে শত্রুসেনাদের অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে যায়। হাবিলদার সালামের প্লাটুনের আক্রমনে পাকসেনাদের ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পাকসেনারা হাবিলদার সালামের সামনের অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পিছনে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের ভিতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং শত্রুরা সমগ্র কৈখোলা এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। ২ঘণ্টার মধ্যে প্রচণ্ড আক্রমনের সামনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা অবস্থানটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে। এ যুদ্ধের ফলে পাক সেনাদের একজন জেসিওসহ ৩১জন সিপাই হতাহত হয়। এবং অবস্থানটি থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দখল করা হয়।

 ১৯শে জুন লে. হুমায়ুন কবিরের হেড কোয়ার্টারে খবর আসে যে, পাকসেনাদের একটি প্লাটুন সাগরতলার ভিতর পেট্রলিং করার জন্য যেতে দেখা গেছে। লে. হুমায়ুন তৎক্ষনাৎ একটি প্লাটুন নিয়ে মন্দভাগের নিকট দ্রুত এ্যামবুশ পাতে। সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনারা ফেরার পথে তাদের দলটির শেষ অংশটিকে লে. হুমায়ুন এ্যামবুশ করে। এ্যামবুশে পাকসেনাদের ৯জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকি পাক সেনারা মন্দভাগ গ্রামের দিকে পালিয়ে তাদের জীবন বাঁচায়।

 জুন মাসের মাঝামাঝি লে. মাহবুব ৪র্থ বেঙ্গলের বি কোম্পানী থেকে একটি প্লাটুনকে পাকসেনাদের যাতায়াতের রাস্তা ধ্বংস করার জন্য কুমিল্লার দক্ষিণে প্রেরণ করে। এ দলটি ১৮ই জুন সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লা লাকসামের বিজয়পুর রেলওয়ে ব্রিজ, কুমিল্লা বাগমারা রোডের সেতু উড়িয়ে দেয়। এই সেতুগুলোর ধ্বংসের ফলে কুমিল্লার দক্ষিণে সড়ক এবং রেলওয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিনই দলটি বিজয়পুর এবং মিয়াবাজারের নিকট কয়েকটি ইলেকট্রিক পাইলন উড়িয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাকসেনাদের একটি প্লাটুন সন্ধ্যার সময় চৌরা'র নিকট পেট্রোলিং এ আসে। এই পাকসেনার দলটিকে এ্যামবুশ করলে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং অত্যাচার চালায়। আমাদের পেট্রোল পার্টি খবর আনে যে, পাকিস্তানীদের প্রায় এক কোম্পানী সৈন্য মিয়াবাজারের উত্তরে একটি গোডাউনের মধ্যে অবস্থান করছে। পেট্রোলটি এই গোডাউনটিতে পৌছবার গোপন রাস্তা, পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে লেঃ মাহবুব ৩৩ জনের একটি কমাণ্ডো প্লাটুন ব্লাকসাইড ও মর্টারসহ রাত ১২টার সময় শত্রুঅবস্থানের নিকটে পৌঁছে যায়। তারা একটি ছোট দল পাঠিয়ে অবস্থানটির সর্বশেষ খবর নেয় এবং জানতে পারে পাকসেনারা অবস্থানটিতে বেশী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। রাত ১টায় আমাদের কমাণ্ডো প্লাটুনটি অতর্কিতে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের উপর হালকা অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই গুলিতে হতাহত হয়। তারা আমাদের কমাণ্ডো প্লাটুনের উপর পাল্টা আক্রমনের চেষ্টা করে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

 ১৮ই জুন রাত ৯টায় মিয়াবাজারের দক্ষিণে আমাদের আরেকটি প্লাটুন পাকসেনাদের ২টি বাংকারের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমনে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা এরপর সমস্ত রাত অবিরাম মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের এই দলটি খিলা রেলওয়ে স্টেশনের নিকট কয়েকটি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন রাস্তায় পুতে রাখে। পাক সেনাদের একটি জীপ রাতে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথে মাইনের উপর পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং ৫জন পাকসেনাও নিহত হয়।

 জুন মাসেই পাকসেনারা কুমিল্লা শহরে শাসনকার্য পুনরায় স্বাভাবিক করার জন্য সমস্ত রকমের ব্যবস্থা নেয়। সরকারী অফিস ভালভাবে চলার জন্য তারা সরকারী কর্মচারীদের বাধ্য করে। শহরের দোকান ও যানবাহন চালু করার বন্দবস্ত করে। পাকিস্তানীদের এ প্রচেষ্টা ব্যার্থ করার জন্য ৪জন গেরিলার একটি দলকে ৬ই জুন কুমিল্লার উত্তর দিয়ে গোমতী পার করে কুমিল্লা শহরে পাঠান হয়। এ দলটি গ্রেনেড ও স্টেনগান সঙ্গে নিয়ে যায়। তিনদিন পর্যন্ত শহরের ভিতর একটি গুপ্ত অবস্থানে দলটি নিজেদের ঘাটি গড়ে। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাকসেনাদের টহলদার দলগুলি সম্বন্ধে তারা বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। ১০ই জুন সন্ধ্যায় কমার্স ব্যাঙ্ক, ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, জজকোর্ট প্রভৃতি স্থানে পর পর পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে একজন পাকসেনা নিহত ও ৫জন আহত হয়। ঐ দিনই ৭জন রেঞ্জারের একটি দলকে তারা আক্রমণ করে। এতে ২জন মিলিশিয়া নিহত হয় এবং তাদের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কয়েকদিন পর ২১শে জুন সকালে একটি আর আর রাইফেল আমাদের সৈন্যরা কুমিল্লা শহরের নিকটে বয়ে নিয়ে যায় এবং কুমিল্লা বিমান বন্দরের ও শহরের উপকণ্ঠের উপর গোলাগুলি করে এবং পাকিস্তানীরা এতে পাগলের মত ছোটাছুটি করতে থাকে। এসব কার্যকলাপের ফলে কুমিল্লা শহর ও তার নিকটবর্তী এলাকার লোকেরা আবার তাদের সাহস ফিরে পায়। অনেকেই শহর থেকে বাইরে চলে যায়। এসব আক্রমণের ফলে পাকিস্তানীদের শাসন ব্যবস্থা চালু করার প্রচেষ্টা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়।

 শালদা নদীতে পাকসেনারা জুন মাসে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল। পাকসেনাদের কার্যকলাপে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য এবং তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানীর ১টি প্লাটুন মর্টারসহ শালদা নদীর পশ্চিম দিকে পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি রাত ৩টায় পাকসেনাদের অবস্থানটি ঘুরে পিছনে যেতে সক্ষম হয়। সকাল সাড়ে ৫টার সময় পূর্বনির্ধারিত স্থানে তারা নিজেদের ঘাটি স্থাপন করে। এরপর প্রত্যুষের সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে মেশিনগান ও অন্যান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং মর্টারের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের ওপর অতি নিকট থেকে হামলা চালায়। পাকসেনারা দিনের বেলায় তাদের অবস্থানের পিছনে এত নিকট থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং এর ফলে তাদের অন্ততঃপক্ষে ১জন জেসিওসহ ৩২জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল রাতে শালদা নদীর অবস্থান হতে কসবাতে টহলের জন্য গিয়েছিল। এই সংবাদটি আমাদের লোকের জানাছিল না। পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি যখন ভয়ংকর সংঘর্ষ করছিল, সে সময় পাকসেনাদের টহলদার দলটি কসবা থেকে ফেরার পথে আমাদের প্লাটুনটির পিছনে অবস্থান নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অতিকষ্টে পাকসেনাদের ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আসার সময় আমাদের একজন লোক আহত হয়। পাকসেনারা এরপর শালদা নদী অবস্থান আরো শক্তিশালী করে তোলে। আমরা খবর পাই যে, পাকবাহিনী প্রায়ই হোমনা থানার নিকট কাঠালিয়া নদী এবং গোমতী নদীতে লঞ্চের দ্বারা পেট্রোলিং করে। এ খবর শুনে আমি হেডকোয়ার্টার থেকে ১টি প্লাটুন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের নেতৃত্বে হোমনা থানাতে প্রেরণ করি। এই দলটি অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে দাউদকান্দি ৮ মাইল উত্তরে ও ও গৌরীপুর হতে সাত মাইল উত্তর পশ্চিমে চড়কমারী গ্রামের নিকট তাদের গুপ্ত ঘাটি গড়ে তোলে। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন চড়কমারী গ্রামের নিকট পাকসেনাদের লঞ্চকে এ্যামবুশ করার জন্য তার দলটিকে নিয়ে নদীর পাড়ে একটি অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা নিত্যনৈমিত্তিক টহলে সকালে পশ্চিম হতে কাঠালিয়া নদী দিয়ে লঞ্চে অগ্রসর হয়। লঞ্চটি যখন ৫০ গজের ভিতর চলে আসে, তখন হাবিলদার গিয়াসুদ্দিনের পার্টি মেশিনগান, হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র হতে অতর্কিতে গোলাগুলী চালাতে থাকে। পাকসেনারা অনেকেই হতাহত হয়। লঞ্চটির সারেং লঞ্চটিকে একটা চরের দিকে নিয়ে ভিড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। এরপর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে পানিতে ঝাপ দিয়ে পড়ে কিন্তু তাতেও তারা পানিতে গুলির আঘাতে মারা যায়। লঞ্চটিও আমাদের মেশিনগানের গুলিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় এবং বেশীর ভাগ পাকসেনা পানিতে পড়ে যায়। শুধু কয়েকজন সাতরিয়ে অন্য পাড়ে উঠে পালাতে সক্ষম হয়। এই লঞ্চে পাকসেনাদের অন্ততঃ ৭০/৮০ জন লোক ছিল এবং সঙ্গে ৩জন বেসামরিক লোকও ছিল। হাবিলদার গিয়াসুদ্দীনের লোকেরা লঞ্চ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করে। সেদিনই বিকেল ৫টার সময় পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার তাদের এই লঞ্চটি এবং লোকজনের খবরাখবর নেয়ার জন্য ঐ এলাকায় অনেক ঘোরাফিরা করে কিন্তু কোন খোজখবর না পেয়ে হেলিকপ্টারটি ফেরত চলে যায়। এ এ্যাকশন সকালে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে পার্শ্ববর্তী সমস্ত এলাকার স্থানীয় লোকেরা দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করে। পাকবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হতে দেখে স্থানীয় লোকের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। তারা মুক্তিবাহিনীর উপর আরো আস্থাশীল হয়। হাবিলদার গিয়াসুদ্দিন এখনও এই এলাকার লোকের কাছে কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে বিরাজ করছেন।

 সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর অধীনে যে কোম্পানীটি লাকসামের দক্ষিণে নোয়াখালীর উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল, সে কোম্পানীটি ও এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের কার্যকলাপ চালায়। চাঁদপুর থেকে পাকবাহিনী যে রাস্তা নোয়াখালী যাবার জন্য ব্যবহার করত, সে রাস্তায় লক্ষ্মীপুরের নিকট ৯০ ফুটের একটি সড়কসেতু বিধ্বস্ত করে দেয়। এর কিছুদিন পর পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করলে সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রায়পুর থানা আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে দালাল পুলিশের সাহায্যে স্থানীয় লোকদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করত। এ থানা দখল করে নেয়ার ফলে সমস্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 ১৬ই জুন আমাদের ২টি গেরিলা পার্টি হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানো হয়। ৬ জনের একটি কুমিল্লার দক্ষিনে ইলেক্ট্রিক পাইলন উড়ানের জন্য এবং আরও ৬ জনের একটি পার্টিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে তিতাস গ্যাসলাইন কাটার জন্য পাঠানো হয়। ২১শে জুন প্রথম পার্টিটি ২টি ইলেকট্রিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে নোয়াখালী বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দলটি ব্রাহ্মনবাড়িয়ার উত্তরে তালশহরে ২৪শে জুন সন্ধ্যায় তিতাস গ্যাসের ৪ ফুট পাইপ উড়িয়ে দেয়। এর ফলে তিতাস গ্যাস ঢাকা নারায়নগঞ্জ আশুগঞ্জ এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনগুলিতে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে এসব পাওয়ার স্টেশনগুলি হতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে শিল্প এলাকাগুলির যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

 মতিনগর থেকে একটি প্লাটুন রাজাপুর পাক অবস্থানের উপর হামলা করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি ২২শে জুন আমাদের ঘাটি থেকে রাজাপুরের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যায় রাজাপুর শত্রুঅবস্থানটি তারা পুঙ্খানুপঙ্খরূপে রেকি করে। তারা জানতে পারে যে পাকসেনারা বেশ অসতর্কভাবে তাদের অবস্থানে আছ। ২২শে জুন ভোর ৪টায় আমাদের দলটি অতর্কিতে গোপনপথে শত্রু অবস্থানের ভিতর প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পাকসেনারা সম্পূর্ণ হকচকিত হয়ে যায়। এই আঘাতে আমাদের লোকদের হাতে তাদের প্রায় ১৫জন লোক হতাহত হয়। আমাদের একজন আহত হয়। আক্রমণ প্রায় এক ঘণ্টা পর আমাদের লোকেরা পিছু হটে আসে।

 আমাদের রেকি পার্টি খবর আনে যে পাকসেনারা কসবার উত্তরে চন্দ্রপুর এবং লাটুমুড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ সংবাদ পাবার পর লেঃ হুমায়ুন কবির পাকসেনাদের চতুর্দিকে থেকে এ্যামবুশ করার জন্য ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানীর তিনটি প্লাটুন ইয়াকুবপুর, কুয়াপাইনা এবং খৈনলে পাঠিয়ে দেয়। এই তিনটি প্লাটুন নিজ নিজ জায়গায় ২৩শে জুন সকাল ৬টার মধ্যে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা সমস্ত রাত অগ্রসর হওয়ার পর সকালে আমাদের অবস্থানের সামনে উপস্থিত হয়।

 পাকসেনারা আমাদের উপরোল্লিখিত অবস্থানের ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে এসে পড়লে তিনদিক থেকে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ৮জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়। পাকসেনারা একটু পিছু হটে যেয়ে আবার আক্রমণের চেষ্টা চালায় কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর সমস্তদিন উভয়পক্ষে গোলাগুলী চলতে থাকে এবং সন্ধ্যার সময় পাকসেনারা পিছু হটে যায়। পাকসেনাদের পশ্চাদপসরণের সময়ও আমাদের ইয়াকুবপুরের প্লাটুন তাদেরকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করে বেশ ক্ষতিসাধন করে। পিছু হটে গিয়ে লাটুমুড়ার উত্তরে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করতে থাকে। ২৪শে জুন পাকসেনারা যখন লাটুমুড়াতে তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করতে থাকে। ২৪শে জুন পাকসেনারা যখন লাটুমুড়াতে তাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরীতে ব্যস্ত ছিল, সকাল পাচটায় আমাদের কুয়াপাইনা ও খৈনাল এলাকা থেকে শত্রুদের বামে এবং দক্ষিণে আমাদের ৩টি প্লাটুন আবার অতর্কিত আক্রমন চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ৯জন লোক নিহত হয়। আমাদের ১জন আহত হয়।

 নোয়াখালীর উত্তর পাকবাহিনী ফেনী থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত ট্রাকে টহল দিত। এ খবর আমাদের নোয়াখালী গেরিলা হেডকোয়ার্টার এ পৌঁছে। সেখান থেকে আমাদের ২টি এ্যামবুশ পার্টি বোগাদিয়া এবং বজরাতে পাঠানো হয়। ২১শে জুন এই দুই পার্টি সন্ধ্যায় উপরোক্ত দুটি স্থানে এ্যামবুশ পাতে। তারা রাস্তাতে একটি এ্যাণ্ট্রি ট্যাঙ্ক ও এ্যাণ্ট্রি পার্সোনেল মাইন পুতে রাখে। সন্ধ্যায় পাকসেনাদের দুটি ট্রাক ফেনীমুখে যাচ্ছিল। এই ট্রাক দুটি এ্যামবুশ স্থানে পৌছালে প্রথম ট্রাকটি এ্যাণ্টি ট্যাঙ্ক মাইনে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায়। পরের ট্রাকটি পিছু হটে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এ্যামবুশ পার্টি তাদের উপর গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে ট্রাক থেকে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করে। পলায়নপর শত্রুদের কিছুসংখ্যক গুলীতে মারা যায়, আর কিছু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ এ্যামবুশ এ পাকসেনাদের ২টি ট্রাক সম্পূর্নরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১২জন নিহত হয়। আমাদের পার্টি অনেক অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে এবং বজরার এ্যামবুশ পার্টিও শত্রুদের একটি টহলদার দলকে আক্রমন করে ২জনকে নিহত এবং ২জনকে আহত করে। আর একটি পার্টি ২৩শে জুন পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেয়ার জন্য নোয়াখালীর শাহেবজাদা ব্রীজ, চন্দ্রগঞ্জ এবং রামগঞ্জ জেলা কাউন্সি ব্রীজ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।

 পাকসেনারা লাটুমুড়াতে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অব্যহত রাখে কিন্তু ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানী লেঃ হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে তাদেরকে সবসময় ব্যতিব্যস্ত রাখে।

 পাকসেনারা তাদের শালদানদী অবস্থান থেকে সবসময় মন্দভাগ দখল করে নেয়ার চেষ্টা চালাত। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানী মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এবং জেলা বোর্ডের কাচা রাস্তা পর্যন্ত নিজেদের রেখে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়েছিল। এ অবস্থানটির জন্য পাকবাহিনী চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলওয়ে লাইন চালু করতে পারছিল না। সেজন্য সবসময়ই তাদের চেষ্টা ছিল মন্দভাগ থেকে আমাদের বিতাড়িত করা। এছাড়া এ অবস্থানটির জন্য তারা শালদানদী ছিটমহল যেখানে আমাদের মূল ঘাটি ছিল, তা তাদের দখলে আনতে পারছিল না। অনেকবার চেষ্টা করেও তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২৪শে জুন বিকেল ৩টায় তাদের শালদানী অবস্থান থেকে পাকসেনাদের একটা কোম্পানী, কসবায় টি, আলীর বাড়ী থেকে একটা কোম্পানী-এই দুই কোম্পানী দুদিক থেকে এসে কায়েমপুরের নিকট মিলিত হয়। তারপর মর্টার মেশিনগান এবং কামানের সাহায্যে আমাদের মন্দভাগ অবস্থানে আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড গোলার সহায়তায় পাকসেনাদের এই শক্তিশালী দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে ৩০০ গজ পশ্চিমে জেলা বোর্ডে সড়কের নিকট পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়। আমাদের সৈনিকরাও তাদের বাঙ্কার থেকে মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগানের গুলীতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে থাকে। দুঘণ্টা চেষ্টার পর পাকসেনারা যখন অগ্রসর হতে পারছিল না তখন আক্রমন বন্ধ করে দেয় এবং পিছু হটে চলে যায়। এ আক্রমনের সময় পাকসেনাদের ২৪জন হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের কায়েমপুরের অবস্থানও তুলে নিয়ে শালদানদীর মূল ঘাটিতে চলে যায়।

 ঢাকায় আমাদের গেরিলারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ যাতে স্বাভাবিকভাবে না চলে সেজন্য তারা ২৯শে জুন বিকেল পাচটায় সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাও পাওয়ার লাইনের একটি পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এই বিধ্বস্ত পাইলনটি অন্য দুটি পাইলনের তার নিয়ে ছিড়ে পড়ে যায়। এর ফলে কমলাপুর এবং তেঁজগাওয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেকাংশে কমে যায়। বিস্ফোরণের ঠিক পরপরই পাকসেনাদের একটি হেলিকপ্টার তৎক্ষণাৎ উক্ত এলাকায় গেরিলাদের অনেক খোজাখুজি করে। আমাদের গেরিলারা নিরাপদে ফিরে আসে। আর একটি গেরিলা দল সিদ্ধিরগঞ্জের মাটির তলার পাওয়ার লাইন মাতুয়াইলে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা নিকটবর্তী ঘাটি হতে জীপে করে এসে দলটিকে ধরার চেষ্টা করে এবং এদের উপর গোলাগুলী করে, কিন্তু গেরিলা গলটি নিরাপদে ফিরে আসে।

 স্থানীয় লোকমুখে আমরা সংবাদ পাই যে, পাকসেনাদের একটি জীপ ও টহলদার দল প্রায়ই সাইদাবাদ থেকে কর্নালবাজার পর্যন্ত আসে। এ সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন খোলাপাড়ায় এবং তুলাইশমলে একটি করে প্লাটুনের সাহায্যে এ্যামবুশ লাগায়। ২৭শে জুন সন্ধ্যার সময় পাকসেনাদের টহলদার দল খোলাপাড়ায় আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। এতে পাকসেনাদের ৮জন লোক নিহত হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এর পরদিন ২৮শে জুন সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনাদের একটি জীপ তুলাইশমলে আমাদের এ্যামবুশে পড়ে। এ্যামবুশ পার্টির গুলিতে জীপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায়। জীপে পাঁচজন পাকসেনা ছিল, তারাও সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। আমাদের পার্টি অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়।

 পাকসেনারা কুমিল্লা শহরের পূর্বে বিবিরবাজার এলাকায় যে ঘাটি গড়েছিল, আমরা প্রায়ই আক্রমণ করে তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখতাম। লেঃ মাহবুব খবর পায় যে, পাকসেনারা সন্ধ্যার পর আর তাদের বাংকার থেকে বাইরে আসে না। রাতে যেসব পাহারাদার থাকে তারা বাংকারের মধ্যে বসে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে লেঃ মাহবুব দুটি প্লাটুনকে ২৪শে জুন রাতে শত্রুদের বিবিরবাজার ঘাটির কয়েকটি বাংকার ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়ে কুমিল্লার দক্ষিণ থেকে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি অরণ্যপুর হয়ে শত্রুদের বিবিরবাজার অবস্থানের পিছনে পৌছে এবং রাত তিনটায় অবস্থানের ভিতর অনুপ্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রথমেই তারা তাদের সামনের একটি বাংকারে গ্রেনেড ছোড়ে এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এরপর আরও ২/১টি বাংকার ধ্বংস করে তারা সকাল হবার আগেই শত্রু অবস্থান ত্যাগ করে। এই অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনাদের ২১জন নিহত ও ৭জন আহত হয়।

 পাকসেনারা বিজয়পুরের যে রাস্তার সেতুটি আমাদের কমাণ্ডো পার্টি উড়িয়ে দিয়েছিল সেটি সাময়িকভাবে মেরামত করে ফেলে এবং সে রাস্তায় আবার তাদের চলাফেরা শুরু করে। লেঃ মাহবুব আবার একটি কমাণ্ডো প্লাটুন পাঠায় এবং এই প্লাটুনটি ২১শে জুন বিজয়পুর ব্রীজের নিকট এ্যামবুশ পেতে পাকসেনাদের অপেক্ষায় থাকে। রাত ২টার সময় পাকসেনাদের দুটি গাড়ী কুমিল্লা থেকে ঐ রাস্তায় আসে। গাড়ীগুলী যখন ব্রীজের উপর দিয়ে চলা শুরু করে ঠিক তখনই আমাদের পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ীগুলি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রীজ থেকে নদীতে পড়ে যায়। এতে দুটি গাড়িই বিনষ্ট হয়ে যায় এবং ৮জন পাকসেনা নিহত হয়।  জুন মাসে প্রথম সপ্তাহে আমার হেডকোয়ার্টার থেকে গেরিলাদের ৬০জনের একটি দলকে আমি ফরিদপুরে পাঠাই। মাদারীপুর, পালং, রাজৈর, নড়িয়া প্রভুতি থানায় গেরিলাদের বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছিল। এই দলগুলি তাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়েয় ঘাটি গড়ে তোলে। এরপর তারা কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী দালালকে হত্যা করে। এরপর তারা নিজ নিজ এলাকার থানাগুলি যেখান থেকে দালাল পুলিশরা পাকিস্তানীদের খবরাখবর যোগাত, সেই থানাগুলি ভালভাবে রেকি করে। প্রথমে তারা শিবচর অয়ারলেস স্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর গেরিলা কমাণ্ডার খলিলের নেতৃত্বে পালং থানার উপর ২৭শে জুন রাত ১১টার সময় আক্রমণ চালান হয়। এ আক্রমনে একজন দালাল সাব ইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ নিহত হয়। গেরিলারা ৯টা রাইফেল দখল করে নেয়। তারা থানার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। নড়িয়ার গেরিলাদল খবর পায় যে, মাদারীপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টর ও দালাল সি আই পুলিশ একটি স্থানীয় দালালের বাড়িতে গুপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত। এ সংবাদ পেয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমন চালায়। তারপরে নড়িয়ার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। নড়িয়ার গেরিলাদল খবর পায় যে, মাদারীপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টর ও দালাল সি আই পুলিশ একটি স্থানীয় দালালের বাড়িতে গুপ্ত আলোচনায় ব্যাস্ত। এ সংবাদ পেয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারপরে নড়িয়ার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়।

 শত্রুদের একটি ছোট দল রাজৈর থানার টাহেরহাটে এসে অবস্থান নেয়। রাজৈরের গেরিলা দলটি তাদের অবস্থানটি সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খবর নেয়। ২৮শে জুন রাত ১১টার সময় ২০জনের একটি গেরিলাদল টাহেরহাটে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১০জন নিহত হয় এবং পাকসেনারা টাহেরহাট অবস্থান থেকে পালিয়ে যায়।

 পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় যে ২৮শে জুন সন্ধ্যায় জেনারেল মোঃ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন এ সংবাদ জানতে পেরে আমি ইয়াহিয়া খানের ভাষণকে উপস্থিত সম্বর্ধনা জানানোর জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এসম্বন্ধে আমি আমার সাবসেক্টর কমাণ্ডারদের আমার হেডকোয়ার্টার এ ডেকে পাঠাই এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌছি যে ভাষণের সময় পাকিস্তানীরা সর্বক্ষেত্রেই রেডিও শোনার জন্য তাদের নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থানে একত্রিত হবে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কিছুটা শিখিল হবে। এ সময় তাদের এ সতর্কতা আমাদের জন্য আনবে এক সুবর্ন সুযোগ। তাছাড়া আমাদের এ্যাকশনও হবে ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সমুচিত জবাব। এ জন্য আমি সব সাব সেক্টর কমাণ্ডারকে নির্দেশ দিলাম, তারা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে যখন ইয়াহিয়ার ভাষন আরম্ভ হবে, ঠিক সে সময়ে আমার সেক্টরের সব এলাকায় একযোগে পাকসেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাবে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী ন্যানপুরের পাকসেনাদের অবস্থানের দিকে তিন দিক থেকে অগ্রসর হয় এবং ভাষণ আরম্ভ হবার কিছুক্ষণ পরেই পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায়। এর সাথে সাথে আমাদের মর্টারের গোলা তাদের উপর পড়তে থাকে। পাকসেনারা তাদের অবস্থানের চুতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ী এবং চীৎকার করে বাংকারের দিকে যাবার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে তাদের অনেকেই মারা যায়। আধ ঘণ্টা এভাবে গুলী চালানোর পর আমাদের সৈন্যরা শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এ যুদ্ধে ১৮জন নিহত এবং বহু আহত হয়।

 ঐ দিনই আমাদের একটি কোম্পানী মর্টারসহ লেঃ হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে ঠিক ঐ সময় লাটুমুড়াতে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের মধ্যে বেশ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তখন তারা ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনছিল। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ৫জন নিহত ও ১০জন আহত হয়। আমাদের কোম্পানী শত্রুদের উপর আড়াই ঘণ্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে পিছু হটে আসে।

 ঢাকাতে ঐ সময়টিকে উদযাপন করার জন্য আমি ৫০জন গেরিলার একটি দলকে পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ২৭শে জুন ঢাকায় পৌঁছে। তারপর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা শহরের প্রধান স্থানগুলিতে যেমন জিন্নাহ এভিনিউ মতিঝিল, শাহবাগ, পুরানা পল্টন, সদরঘাট, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে একযোগে সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং মোটরগাড়ীতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পাকসেনারা চতুর্দিকে ছোটাছুটি করে এবং সমস্ত ঢাকায় একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এ বিস্ফোরণগুলি ফলে ঢাকায় আমাদের বাঙ্গালীরা তাদের মনোবল আরো ফিরে পায় এবং তারা ইয়াহিয়ার ভাষণের সমুচিত জবাবে আনন্দিত হয়।

 মতিনগর থেকে ২টি মর্টার দিয়ে একটি ছোট দলকে গোমতীর উত্তর পাড় দিয়ে কুমিল্লা শহরের দিকে পাঠানো হয়। এ দলটি কুমিল্লা শহরের নিকট গিয়ে ভাষনের ঠিক সময়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউসের উপর মর্টার দ্বারা গোলাবর্ষণ করে। কুমিল্লা সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের মার্শাল ল'র প্রধান অফিস ছিল। মর্টারের গোলা এসে অফিসে পড়ার পর, সেখানেও পাকসেনারা ছুটাছুটি করতে থাকে। কুমিল্লা শহরেও কয়েক মিনিটের মধ্যে নিরবতা নেমে আসে।

 কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানীদের একটি জীপ ও একটি ৩টনের গাড়ি দক্ষিণে যাচ্ছিল। লেঃ মাহবুবের একটি এ্যামবুশ পার্টি এই দলটিকে সন্ধ্যার ফুলতলীর নিকটে আক্রমন করে। এতে জীপটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এ এ্যামবুশে পাকিস্তানীদের ২৪জন সৈন্য ৩জন অফিসার নিহত হয় এবং ১জন অফিসারসহ ৪জন আহত হয়। অফিসারটি লেঃ কর্নেল ছিলো।

 লেঃ মাহবুবের আর একটি প্লাটুন ঠিক ঐ সময় বিবিরবাজার শত্রু অবস্থানের ভিতর অতর্কিতে অনুপ্রবেশ করে ১টি মেশিনগানসহ কয়েকটি বাংকার করে দেয়। পাকসেনাদের ১১জন এতে নিহত হয়।

 এ ছাড়া, মিয়াবাজার, ফেনী, বিলোনিয়া, লাকসাম, শালদানদী, চাদপুর ইত্যাদি স্থানেও মর্টার ও গ্রেনেডের সাহায্যে পাক অবস্থানের উপর একযোগে একই রুপে আক্রমন চালান হয়।

 ইয়াহিয়া খান মনে করেছিল যে, তার ভাষণ দিয়ে তিনি বাঙ্গালীদের শান্ত করবেন এবং আবার তার মিথ্যা আশ্বাসে বাঙ্গালীরা তাদের অত্যাচারকে ভুলে যাবে, কিন্তু আমাদের সমস্ত এলাকা জুড়ে সবগুলো এ্যাকশনে তিনি নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছিলেন যে, বাঙ্গালীরা তার জবাব কি দিয়েছে।

সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল শাফায়াত জামিল

 ১৯৭১ সনের ১লা মার্চ তারিখে আমি আমার চতুর্থ বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া চলে আসি আমার সাথে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের আর একটা কোম্পানী ছিল যার কমাণ্ডার ছিল একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সিনিয়র মেজর। আমাদের পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য ব্রাহ্মনবাড়িয়াতে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করা। এখানে বলে রাখা দরকার যে, চতুর্থ বেঙ্গলে আমিই বাঙ্গালীদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট ছিলাম। আমরা চলে আসার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের আরো দুই কোম্পানী সৈন্য থেকে যায়।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি সব সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের বাকি দুই কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করতাম। এ ব্যাপারে আমি সুবেদার আবদুল ওহাবকে ব্যবহার করতাম।

 মার্চের ১তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত কুমিল্লা সেনানিবাসের অস্বাভাবিক ঘটনাবলীঃ

 ১। আমাদের ইউনিট লাইনের চারদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এবং জেসিওদের বিশেষ করে আর্টিলারী বাহিনীর লোকদের অস্বাভাবিক গতিবিধি বা চলাফেরা।

[]  ২। রাতের বেলায় মেশিনগান আমাদের ইউনিট লাইন, অফিসারদের বাসস্থান, অস্ত্রাগার এবং কোয়ার্টার গার্ডের দিকে পজিশন করে রাখত। এবং দিনের বেলায় সেনানিবাসের বাহিরেরদিকে পজিশন থাকত। তাছাড়া আমাদের ইউনিট লাইনের চারিদিকে উঁচু পাহাড়ে পরিখা খনন করে। জিজ্ঞেস করলে বলত “আমরা ট্রেনিং করেছি “।

 ৩। ইউনিট লাইনে বিগ্রেড কমাণ্ডার ও বিগ্রেড কমাণ্ডার অন্যান্য অফিসারদের অপ্রত্যাশিত পরিদর্শন।

 ৪। আমাদের খেলার মাঠের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট অফিসার ও জেসিদেরসাথে ব্রিগেডের অফিসার ও জেসিদের দৈনিক খেলাধূলা প্রতিযোগিতা (যেটাস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছয় মাসে একবার, দুইবার হয়)। খেলার মাঠ রক্ষার জন্য অন্য রেজিমেণ্টের প্রটেকশন পার্টিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়োগ করা।

 ৫। যদিও সম্ভব্য ভারতীয় আক্রমণের জন্য আমাদের উপর ছুটির ব্যাপারে কোন বাধা- নিষেধআরোপ করা হয় নাই। বরং চতুর্থ বেঙ্গলের কমাণ্ডিং অফিসার ও বিগ্রেড কমাণ্ডার জোয়ানদেরকে বলেন, যার যার ইচ্ছানুযায়ী ছুটি নিতে পারে।

 ৬। মার্চ মাসের ১৮/১৯ তারিখে ইউনিট লাইনে রাত প্রায় বারোটার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর একজন বাঙ্গালী এসে খবর দেয় যে সেনানিবাসে আজ রাতে চতুর্থ বেঙ্গলের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা হামলা চালাবে। এ খবর পাওয়া মাত্র ক্যাপ্টেন গফফার, লেফটেন্যাণ্ট মাহবুব, লেফটেন্যাণ্ট কবীর, বেঙ্গল রেজিমেণ্টের দুই কোম্পানি (যারা সেনানিবাসের ভিতরে ছিল) নির্দেশ দেয় যে, সব জোয়ান নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে যেন নিজেদের কাছে রাখে। চতুর্থ বেঙ্গলের সৈনদের দেখাদেখি সেনানিবাসের অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিট অস্ত্রশস্ত্র সহকারে তৈরি থাকে। সে রাতে কোন হামলা হয়নি। ২০শে মার্চ ভোরে সবাই অবার অস্ত্র জমা দেয়। রাতে অস্ত্রগার থেকে বাহির করার জন্য কারো কাছে কোন কৈফিয়ত চাওয়া হয়নি। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট কমাণ্ডিং অফিসার নিজে জেনেও উপরোল্লিখিত অফিসারদের কাছে কোন কৈফিয়ত চান নাই।

 ৭। বিগ্রেড কমাণ্ডার, ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার সপ্তাহে একবার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিতেন, যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।

 ৮। ১০মার্চ, (১৯৭১) ১৭টি গাড়ি (রসদপত্র, তেল বোঝাই) কুমিল্লা থেকে সিলেট পাঠানো হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের একজন সুবেদার সামসুল হক এবং দশজন (বাঙ্গালী) লোককে এই কনভয়কে প্রটেকশনে পাঠানো হয়। এই কনভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যও ছিল। দুই দিনে এই কর্ভয় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে। রাস্তায় বেরিকেড ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এই কনভয়কে নিয়ে সিলেটের খাদিমনগরে পৌছাবার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড অতিক্রম করে খাদিমনগরে পৌছাতে তিন দিন লাগে। ১৫মার্চ আমি খাদিমনগর পৌছি ও নির্দেশ মোতাবেক ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু আমাকে বলা হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাকে ৩১ পাঞ্জাবের সাথে থাকতে হবে। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি কুমিল্লায় টেলিফোন করলাম। বাঙ্গালি আফিসাররা বিশেষ করে ক্যাপ্টেন গাফ্ফার, লেফটেন্যাণ্ট মাহবুব, লেফটেন্যাণ্ট কবীর এবং জেসিওরা কমাণ্ডিং অফিসাররা আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেন। ১৭/১৮ তারিখে আমি ও আমার চতুর্থ বেঙ্গলের অন্যান্য সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার কোম্পানিতে ফিরে আসি।

 উপরোল্লিখিত আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমি সুবেদার ওহাবের মাধ্যমে কুমিল্লা সেনানিবাসে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অফিসার ও জেসিদের কাছে খবর পাঠাতাম যে, কোন পরিস্থিতিতেই তারা যেন আত্মসমর্পন না করে। যদি প্রয়োজন হয় অস্ত্র নিয়ে তারা যেন বেরিয়ে আসে।  এই সন্দেহ এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হবার পর আমার কোম্পানী এবং মেজর সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আনা হয়।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা ওয়াপদা কলোনী সংলগ্ন স্থানে তাঁবুতে দুই কোম্পানী থাকি। আমার আশংকা ছিল, এই দুই কোম্পানী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করবে। এই সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আমি আমার কোম্পানীর এবং সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর জেসিওদের নির্দেশ দিই, যেন তারা আত্মরক্ষার জন্য আমাদের ক্যাম্পের চারিদিকে পরিখা খনন করে রাখে। আর যদি প্রয়োজন হয় তবে ঐসব পরিখা থেকে আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে।

 আমার এই সমস্ত কাজ খুব সাবধানে ও হুঁশিয়ারের সাথে করতে হয়। কেননা, মেজর সাদেক নেওয়াজ সব সময় আমাকে চোখে চোখে রাখতো। সে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত, পরিখা খনন করা, পজিশন নেয়া- এগুলোর উদ্দেশ্য কি? আমি বলতাম, ডিগিং প্র্যাকটিস এবং পজিশন নেয়ার প্রশিক্ষণ রিভাইজ করা হচ্ছে।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ, এবং বিভিন্ন জেসিওদের সাথে যোগাযোগ, প্রভাবান্বিত করা, এবং সতর্ক করার কাজে লেফটেন্যাণ্ট হারুন আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। সে এসব কাজে উৎসাহী ছিল এবং অন্যান্য লোকদের প্রেরণা যোগাতো।

 প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে কুমিল্লার সাথে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্যাম্পের যোগাযোগ ছিল একমাত্র টেলিফোনের মাধ্যমে এবং একটি সিগন্যাল সেট যেটা অস্বাভাবিকবাবে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ রাখত। এ সময় আমি খুব অস্বস্তিকর পরিবেশে ছিলাম। আমি সবসময় চিন্তা করতাম যে কুমিল্লাতে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সৈনিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 ২৪শে মার্চ সন্ধায় আমরা দেখতে পেলাম কুমিল্লার দিক থেকে ৮টা গাড়ির আলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ক্যাম্পের প্রটেকশন পার্টি পরিখাতে অবস্থান নেয়। গাড়ি কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারি, মেজর খালেদ মোশাররফ তার কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১২০ মাইল দূরে সমশেরনগরে নকাশালপন্থী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করার জন্য আসছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, মেজর খালেদ মোশাররফ যিনি আমার থেকে বাঙ্গলীদের মধ্যে সিনিয়র সেদিনই ব্যাটালিয়নে ঢাকা থেকে এসে যোগদান করেন এবং একই দিনে তাঁকে কুমিল্লা থেকে ১৭০ মাইল দূরে সমশেরনগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর চতুর্থ বেঙ্গলের একটি রাইফেল কোম্পানী আর হেডকোয়ার্টার কোম্পানী কুমিল্লা থেকে যায়।

 সেই রাতে মেজর খালেদ মোশাররফ লেঃ মাহবুবকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং তার কোম্পানী আমাদের ক্যাম্পে থাকে। মেজর সাদেক নেওয়াজের সর্বক্ষণিক উপস্থিতির জন্য আমরা খোলাখুলি আলাপ - আলোচনা করতে পারি নাই। শুধু আভাষে, ইঙ্গিতে এটুকু বুঝাতে সক্ষম হই, যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন আমি আর লেফটেন্যাণ্ট হারুন খুব খুশী হই এই ভেবে যে, আমাদের পরিচালনার জন্য একজন পুরোনো অভিজ্ঞ অফিসার চতুর্থ বেঙ্গলে যোগ দিয়ে কুমিল্লা থেকে আরো একটি কোম্পানীকে মরণ ফাঁদ থেকে কনফ্রনটেশনের আগেই বের করে নিয়ে এসেছেন।

 মেজর খালেদ মোশাররফের নিকট একটা সিগনাল সেট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার দিয়ে দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমার সেট এবং খালেদ মোশাররফের সেট যেন একই প্রিকুয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। ২৪/২৫ তারিখ সকালে তিনি তার কোম্পানী নিয়ে সমশেরনগরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।  ২৫শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায় কুমিল্লা থেকে নির্দেশ আসল যে, আরো লোক আসছে তাদের থাকার ও খাবার ব্যাবস্থা করতে হবে। আমরা থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু আমরা জানতাম না কারা আসছে। রাত আটটার সময় দেখলাম যে লেঃ কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান কুমিল্লায় অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গলরেজিমেণ্টের বাকি কোম্পানীগুলো নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উপস্থিত হয়েছেন। এসে তিনি বললেন যুদ্ধ আসন্ন। সেজন্য ব্রিগেড কমাণ্ডার তাঁকে কুমিল্লা থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের প্রায় সব লোক নিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

 খিজির হায়াত খানের আসার পর চতুর্থ বেঙ্গলের অবস্থান নিম্নরূপ ছিলঃ

 (ক) এক কোম্পানী সমশেরনগরে- যার কমাণ্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ।

 (খ) তিন কোম্পানী- হেডকোয়ার্টার কোম্পানী আর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার- ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।

 (গ) ৭০/৮০ জন লোক কুমিল্লায় ইউনিট লাইন-এর প্রহরায় নিয়োজিত।

 (ঘ) এক প্লাটুন কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ গ্রীড স্টেশনের প্রহরায়। এর কমাণ্ডার ছিল নায়েব সুবেদার এম, এ, জলিল।

 খিজির হায়াত খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেই ২৫শে মার্চ রাত এগারটায় আমাকে হুকুম দিলেন যে, আমি যেন আমার কোম্পানীর সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১৩ মাইল দূরে শাহবাজপুর পুলের কাছে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করি। রাত দু'টার সময় রওনা হয়ে তিনটায় শাহবাজপুরে পৌঁছি।

 সকাল ছটার সময় (২৬শে মার্চ) আবার খবর আসল, কোম্পানী ব্রাহ্মনবাড়িয়াতে ফেরত যেতে হবে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।

 সকাল সাতটায় রওনা হয়ে দশটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছি। দশ মাইল আসতে তিন ঘণ্টা লাগে, কেননা জনসাধারণ বড় বড় গাছ রাস্তার উপরেফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছে দেখি সেখানে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে খিজির হায়াত খান আমাকে পুলিশ লাইনে গিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে নিরস্ত্র করতে গেলে খামাখা গণ্ডগোল, গোলাগুলী হবে। তার চেয়ে আমি নিজেই গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার অঙ্গীকার করলাম। খিজির হায়াত খান প্রথমতঃ চেয়েছিলেন যে মেজর সাদেক নেওয়াজ গিয়ে প্রয়োজনবোধে শক্তি প্রয়োগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করুক। আমি অনর্থক রক্তপাত এড়ানোর জন্য খিজির হায়াত খানের কাছে এক মিথ্যা অঙ্গীকার করলাম যে আমি নিজে গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসব। তিনি আমার কথায় রাজী হলেন।

 ২৬শে মার্চ বেলা বারটার সময় চতুর্থ বেঙ্গলের সিগনাল জেসিও নায়েব সুবেদার জহীর আমাকে বললেন যে তিনি অয়ারলেস ইণ্টারসেপ্ট করে দুটো স্টেশনের মধ্যে এই কথোপকথন শুনেছেন। তাকে খুব চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।

 ইণ্টারসেপ্টেড মেসেজগুলো ছিলঃ (1) Send tank ammunition (2) Send helicopter to evacuate casualties (3) 50 boys of East Bengal Regimental Centre have deserted...some with weapon and some without weapon.

 এ সমস্ত মেসেজ পেয়ে আমার জুনিয়র অফিসারগণ লেঃ হারুন, লেঃ কবীর, লেঃ আখতার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন আমি সিগনাল সেটে গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ করি এবং অল্প চেষ্টায় তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে যায়। আমি তাঁকে চোস্ত ঢাকাইয়া বাংলায় ঐ মেসেজগুলো শুনাই এবং তাঁর মতামত জানতে চাই। আমি তাঁকে বলি যে, আমরা তৈরি এবং তাঁকে তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোম্পানী নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করি। আমার সাথে যখন খালেদ মোশাররফের কথোপকথন চলে তখন সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং খিজির হায়াত খান আমাকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। সেই জন্য খুব বেশী কথাবার্তা চালানো সম্ভব হয়নি এবং তিনিও সমশেরনগর থেকে বেশী কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন যে, তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন।

 তার পর থেকেই আমার জুনিয়র অফিসাররা তাড়াতাড়ি যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল। আমি ব্যাটালিয়নের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের মতামতের অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা, সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী না হলে সবকিছু পণ্ড হয়ে যাবে এবং নিজেদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় হতাহত হবে। আমি অন্ততঃ একজন অফিসার এবং একজন জেসিওকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সারারাত সময় দিই। সন্ধ্যার সময় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সৈনিকদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখা মাত্রই বেশ কয়েকজন সৈনিক যাদের মধ্যে কয়েকজন এনসিও ছিলেন, আমাকে ঘিরে ধরেন এবং বলেন যে, “স্যার দেশের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল বোঝেন। আমরা অফিসারদের মুখর দিকে তাকিয়ে আছি। আপনাদের যেকোন নির্দেশ আমরা জীবন দিয়ে পালন করতে প্রস্তুত। আপনারা যদি বেশী দেরী করেন তবে হয়ত আমাদের কাউকে পাবেন না। আমরা আগামীকালের পরেই যে যার বাড়ির দিকে রওনা হব। কিন্তু সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাব। সৈন্যদের এই মনোবল ও সাহস দেখে আমি খুব গর্বিত ও আশান্বিত হলাম এবং দু'একজন অফিসার ও জেসিও'র দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাকে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা থেকে বিরত করতে পারে নাই। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, আমার চেষ্টা সত্ত্বেও দুপুরের পরে খালেদ মোমাররফের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি।

 ২৬শে মার্চ সন্ধার পরে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুণে আমার বাঙ্গালী জুনিয়র অফিসাররা আরো উত্তেজিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং আমাকে তক্ষুনি অস্ত্র হাতে তুলে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আমি রাতে আমার তাঁবুতে অবস্থান করলাম। সারারাত সাদেক নেওয়াজ এবং লেঃ আমজাদ আমার তাঁবুর ১০০/১৫০ গজ দূর থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমার অজ্ঞাতেই তিন চারজন এনসিও (শহীদ হাবিলদার বেলায়েত হোসেন, শহীদ হাবিলদার মইনুল, হাবিলদার শহীদ মিয়া এবং হাবিলদার ইউনুস) সারারাত আমাকে পাহারা দেয় যাতে ঐ দুজন পাঞ্জাবী অফিসার আমার উপর কোন হামলা করতে না পারে। পাঞ্জাবী অফিসাররাও সারারাত সজাগ ছিল।

 ২৭শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি লেঃ আখতারকে সাদেক নেওয়াজের কক্ষে পাঠাই এবং তাকে বলা হয় যখন সাদেক নেওয়াজ মেসে আমাদের সাথে নাস্তা করতে আসবে তখন যেন তার স্টেনগান এবং ৮ ম্যাগাজিন গুলী অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল রক্তপাতহীন একটা এ্যাকশন পরিচালনা করা। কিছুক্ষণ পর আমি, লেঃ হারুন আর লেঃ কবীর দুইজন এন- সি- ও সাথে করে অফিসার মেসের দিকে যাই। অফিসার মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের সাথে আমরা ব্রেকফাস্টে মিলিত হই। এন- সি- ওদের নির্দেশ দিই যে, আমাদের রক্তপাতহীন এ্যাকমনের সময় যদি কোন বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে যেন গুলী করে হত্যা করা হয়। আমরা সকাল ৭-২০ মিনিটে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছি। এমন সময় একজন জেসিও খিজির হায়াত খানকে বলল যে, সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে একটু মনোমালিন্য হয়েছে সুতরাং খিজির হায়াতকে সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে এক্ষুনি যেতে হবে। একথা শোনা মাত্র খিজির হায়াত খান তক্ষুনি সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর কাছে যেতে উদ্যত হল। আমি তাকে বাধা দিলাম এবং বললাম যে, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না। সুতরাং প্রথমে আমরা অফিসে যাই। ওখানে আলাপ- আলোচনার পর আমরা সকলেই সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে যাব। খিজির হায়াত এতে রাজি হলেন। সাদেক নেওয়াজ তখন তার স্টেনগান আনার জন্য তার কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। আমি আবার বাধা দিই এবং বলি যে আমার স্টেনগানটা সে যদি চায় তবে সে সঙ্গে নিতে পারে। এতে সে আশ্বত হয় এবং আমরা সকলেই অফিসে যাই। একটা তাঁবুতে অফিস করা হয়েছিল। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার তাঁবুতে ঢোকা মাত্রই লেঃ কবীর আর লেঃ হারুন তাঁবুর দুপাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং আমি আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘোষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে তারা আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘোষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে তারা আমাদের বন্দী। তদানুসারে তাদের জীবনের দায়িত্ব আমাদের এবং তারা যেন কেউ কোন বাঙ্গালী অফিসার, জে- সি-ও, এন- সি-ও সাথে কোন কথা না বলে। বলাবাহুল্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ১২/১৫ জন সৈনিক যারা চতুর্থ বেঙ্গল- এর সাথে ছিল আমার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রায় একই সময়ে তাদেরকে বন্দী করে এক জায়গায় জমা করে রাখা হয়। বিনা রক্তপাতে আমাদের এ্যাকশন সম্পন্ন হয় এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টর প্রায় সব কটা কোম্পানী তার সম্পূর্ন তার সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, যানবাহন, রসদপত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 ২৭শে মার্চ সকাল দশটার দিকে প্রায় ১০/১৫ হাজার উল্লসিত জনতা আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে এবং ‘জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়। অস্ত্র ধারণ করার পর দেখতে পেলাম আমার বেশ কয়েকজন অফিসার, জেসিও এবং এনসিও একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ছিলেন এই অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এই বিরাট পরিবর্তনে। কয়েকজনের ক্ষণিকের মধ্যে ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর পর্যন্ত হয়েছিল। কয়েকজন আবোল- তাবোল বকছিল। দুইজন অফিসারকে বেশ কয়েকদিন আর চোখে পড়েনি। আমি নিজেও একটু অস্থির প্রকৃতির হয়ে পড়েছিলাম।

 সকাল ১১টার দিকে আমি সব কোম্পানীকে নির্দেশ দিলাম তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের চার পাশের গ্রামগুলোতে যেন অবস্থান নেয় যাতে করে পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমাদের ব্যাটালিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারিপার্শ্বের গ্রাম গোপনে অবস্থান নেয়। বেলা আড়াইটার সময় মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। রাস্তায় হাজার হাজার বেরিকেড অতিক্রম করে আসার ফলে তাঁর আসতে দেরী হয়েছিল। তিনি আসা মাত্রই আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকা তাঁর কাছে হস্তান্তর করি এবং তাঁর নির্দেশে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।

 কুমিল্লা সোনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোক ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সুতরাং তাদেরকে ২৭শে মার্চ বলতে পারিনি যে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছি। যা হোক, কর্নেল খালেদ মোশাররফ ২৯শে মার্চ জাঙ্গালীয়াতে আমাদের প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং তদেরকে আমাদের সংগ্রামের কথা জানান এবং নির্দেশ দেন জাঙ্গালীয়া থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাটালিয়নে যোগদান করতে।

 আমরা পরে জানতে পেরেছি যে কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লোকজন ছিল তারা ২৯শে মার্চ আমাদের সংগ্রামের কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে তারা কোন এ্যাকশন নিতে পারেনি। ৩১শে মার্চ বিকাল চারটার সময় সেনানিবাসে অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ৭০/৮০ জন সৈনিকের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা চারিদিক থেকে হামলা করে এবং প্রায় ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইউনিট লাইন দখল করে। এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের ৮/১০ জন জোয়ান শহীদ হন। এই যুদ্ধে নায়েব সুবেদার এম, এ, সালাম অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।

 জাঙ্গালিয়াতে যে প্লাটুন ছিল সেটা ২৯শে মার্চ বের হয়ে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয় এবং কুমিল্লা- লাকসাম রোডে নায়েব সুবেদার এম, এ, জলিলের নেতৃত্বে কয়েকটি সাফল্যজনক এ্যামবুশ করে।

কুমিল্লা- নোয়াখালীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর গাফ্ফার[]

২১-৮-১৯৭৩

 আমি মনে করছিলাম কুমিল্লা ব্রিগেডের ইকবাল মোঃ শফি আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে বিভক্ত এবং দুর্বল করে দিয়ে ধ্বংস করে দেবে। সেহেতু ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তিনটি কোম্পানীকে বাইরে পাঠিয়ে সিলেটে অবস্থানরত ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট, কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে অবস্থানরত ২৪তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স- এর ৩ কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণ ও ঘেরাও করিয়ে ধ্বংস করাই তারা শ্রেয় ভেবেছিল। তারা এ কাজ ভালভাবেই সম্পন্ন করেছিল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে যোগ দেয়া শ্রেয় মনে করি। আমি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম কমাণ্ড লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে বুঝতে থাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে মিলিত হবার জন্য। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন এবং আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হন এবং নির্দেশ নেবার জন্য ব্রিগেড কমাণ্ডারের কাছে যান। ব্রিগেড কমাণ্ডার তাঁকে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত ফোনে আমাকে ২৩শে মার্চ ১টার মধ্যে বাকী কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমি দ্রুততার সঙ্গে ৩০টি ৩টনের গাড়িতে বেশী পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র এবং অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হই। আমি ১টা প্লাটুন জাঙ্গালিয়াতে রেখে যাই এবং আরেকটা প্লাটুনকে ভিতরে রেখে যাই ক্যাণ্টনমেণ্টে অবস্থানরত বাঙ্গালী অফিসারদের পরিবার- পরিজনের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য। আমরা আমাদের পরিবার- পরিজনকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে পারিনি, কেননা এটা করলে আমাদের উপর তাদের সন্দেহ হত এবং আমাদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেত। যাবার আগে ক্যাপ্টেন উদ্দিনের (বর্তমান মেজর) সাথে কথা বলি এবং তাঁকে অনুরোধ করি আমাদের পরিবারগুলির প্রতি খেয়াল রাখার জন্য এবং পারলে নিরাপদ জায়গায় যেন সরিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে সে সময় চট্টগ্রামে নবম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে বদলী করা হয়েছিল। আমরা তাঁকে ক্যাণ্টনমেণ্টে রেখে যাই। ২৭শে মার্চ শত্রুরা কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে আমাদের পরিবারদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ঘিরে ফেলল শত্রুরা তাদের ছেড়ে দেয়। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সাথে এসে যোগ দেন।

 ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার জন্য আমি লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দেবার অনুরোধ করি। তিনি আমার কথামত সবাইকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে আসার নির্দেশ দেন। একমাত্র সমশেরনগরে অবস্থিত মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনী ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে।

 ২৪শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম- সি- এ জনাব লুৎফুল হাই আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চান আমরা কি করব। আমি তাঁকে বলি ‘ঠিক সময়ে আমরা আমাদের কর্তব্য সাধন করব।' তিনি চলে যাবার পর আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবী অফিসাররা এসে জিজ্ঞেস করে লুৎফুল হাই কেন এসেছিল। আমি তাদের বলি, সে আমার আত্মীয় এবং আমার সাথে এমনি দেখা করতে এসেছে। মিথ্যা বলে তাদের সন্দেহ দূর করি। আমি মেজর শাফায়াত জামিলকে সমস্ত পরিকল্পনার কথা বলি। সেভাবেই তিনি সমস্ত বাঙ্গালী অফিসার, জে-সি- ও এবং এন- সি- ওদের নিয়ে একটা সভা ডেকে বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ- সেহেতু সবাইকে সজাগ এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। ২৫শে মার্চ রাতে আমি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে অয়ারলেসে কথা বলি এবং সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানাই। তিনি বলেন, আমরা সমশেরনগর থেকে আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে অগ্রসর হব এবং তোমরা যদি পার পাঞ্জাবী অফিসারদের প্রেফতার কর।

 রাত ২টার সময় লেঃ কর্নেল খিজির খান, মেজর সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং অন্যান্য অবাঙ্গালী সৈনিকদের প্রেফতার করার পরিকল্পনা নিই। সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, কেননা মেজর সাদেক নেওয়াজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএণ্ডবি রেস্ট হাউসে আমার রুমে আমার পাশে ভর্তি করা একটা চাইনিজ স্টেনগান নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল।

 ২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার সময় সভাকক্ষে সমস্ত অফিসারদের ১টা সভা ডাকা হয়। কিন্তু এর আগে ভোর সাড়ে চারটার সময় আমি অয়ারলেস সেটটি ধ্বংস করে দিই, কেননা এ অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের কথাবার্তা হত। সমস্ত টেলিফোন যোগাযোগও নষ্ট করে দেয়া হয়। আমাকে এটা করতে হয়েছিল, কেননা অয়ারলেস অপারেটরদের ৩ জনের মধ্যে ২ জনই পাঞ্জাবী ছিল। অয়ারলেসের মাধ্যমে শেষ যোগাযোগ করি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে। তাঁকে অনুরোধ করি অতি সত্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য।

 আমরা সবাই তাঁবুতে এসে জড়ো হই। সাড়ে ৯টার সময় মেজর শাফায়াত, লেঃ কবীর, লেঃ হারুন, আমিও জে- সি- ও'রা তাঁবু ঘিরে ফেলি। আমরা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করি এবং মেজর শাফায়াত জামিল তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা আর পাকিস্তানী সৈন্য নই, আমরা এখন বাংলাদেশ সরকারের সৈনিক। আপনারা আমাদের বন্দী। পালাবার চেষ্টা করবেন না, করলে মারা যাবেন।” মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ঘটে যায়। ৭২ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ৩ জন পাক অফিসারকে গ্রেফতার করে ২৬শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করি।

 মেজর খালেদ মোশাররফ এবং লেঃ মাহবুব রাত সাড়ে ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছেন। মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নেতৃত্ব দেয়া হয়। এরপর মেজর খালেদ আমাদের সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারপাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ার নির্দেশ দেন, কেননা, শত্রুরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করে দতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের হেডকোয়ার্টার করা হয়।

 আমাকে ১৮ জন সৈন্য নিয়ে গোকনঘাটে পাঠান হয়। ঢাকা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত জনতা পালিয়ে আসতে থাকে। আমি ২ দিনের মধ্যে ২৫০ জন পলায়নপর পুলিশ, ইপি- আর নিয়ে একটা কোম্পানী তৈরী করে ফেলি। তৃতীয় দিনে পাকবিমান বাহিনী ৪টা স্যাবর জেটের সাহায্যে আমার এলাকায় স্ট্রাফি করতে থাকে। এতে আমার বাহিনীর ১ জন আহত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্থলপথে কোন আক্রমণ তখনও শুরু হয়নি।

 এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আমার কোম্পানীকে ৩০৩ রাইফেলের দ্বারা সজ্জিত করে ফেলি। ৫ই এপ্রিলের মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে আমার বাহিনী ক্যাপ্টেন মাহবুবের (পরে শহীদ হন) হাতে দিতে বলেন। তিনি ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। তার হাতে দায়িত্ব দিয়ে আমি ৫ই এপিলে সকাল ৯টার সময় অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মেজর মোশাররফের কাছে যাই।

 মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বলেন, ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট সিলেট থেকে নদীপথে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। সেজন্য ৪র্থ বেঙ্গলের ১টা কোম্পানী নিয়ে আজবপুর ঘাট পজিশন নিয়ে শত্রুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা ঢাকা যাবার পথে বাধা দিতে হবে। সেইমত আমি তাড়াতাড়ি আজবপুর ঘাটে যাই এবং সন্ধার মধ্যেই পজিশন নিয়ে নিই। এখানে এসে আমি ২য় বেঙ্গল-এর ক্যাপ্টেন নাসিমের (বর্তমান লেঃ কর্নেল) সাথে যোগাযোগ করি, যিনি আশুগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট মেজর কাজী মোঃ শফিউল্লাহ'র নেতৃত্বে জয়দেবপুর ক্যাণ্টনমেণ্টে বিদ্রোহ করে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে বেরিয়ে আসে। ময়মনসিংহ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেন। আমরা সে সময় বিরাট এলাকা কোম্পানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের খোয়াই নদী পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন রেখেছিলাম।

 ৭ই এপ্রিলে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম, শত্রুরা বড় নৌকা ও লঞ্চের সাহায্যে পালাবার চেষ্টা করবে। সেহেতু আমি সমস্ত নৌকা তল্লাশি করার নির্দেশ দিই। অতি প্রত্যুষ্য ১টা মটর লঞ্চ আশুগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমি তাদের থামতে বলি। লঞ্চটি না থেমে বরঞ্চ আরও দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। ওর ভিতর পাঞ্জাবী সেন্য আছে ধরে নিয়ে আমরা এম-এম জিও ৭৫ এম-এম-আর-আর-এর সাহায্যে গুলি ছুড়তে থাকি। লঞ্চটি থেমে যায় এবং আশ্চর্যের বেপার লঞ্চটি বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা ভর্তি দেখলাম। একজন এতে আহত হয় ও তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে সারেংকে সাবধান করে ছেড়ে দিই। এই সময় পাক বিমান আমাদের উপর অকস্মাৎ হামলা শুরু করে দেয়।

 ৩/৪ দিন পর ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমান মেজর) ১টি কোম্পানী নিয়ে এসে আমাদের অব্যাহতি দেন। আমি আমার বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়া যাই পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হয়। দুইদিন বিবিরবাজারে অবস্থানের পর তৃতীয় দিনে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানীকে নিয়ে মনতলি যাবার নির্দেশ দেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

 ১৪ই এপ্রিল প্রথম সাফল্যজনক আক্রমণ চালাই শত্রুর বিরুদ্ধে। ঐদিন রাতে গঙ্গাসাগরে ৪টা প্লাটুনও ১টা ৩ ইঞ্চি মর্টার সেকশনের সাহায্যে শত্রু অবস্থানকে ঘিরে আক্রমণ চালাই। মেজর খালেদ মোশাররফ মর্টার সেকশনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অবস্থিতি আমার সৈন্যদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। রাত ২টার সময় শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩১ জন শত্রু সৈন্য ও ১৫/২০ জনকে আহত করি। আমরা সবাই নিরাপদে ফি আসি। ২ জন সামান্য আহত হয়।

 চারদিন সেখানে অবস্থানের পর আমাকে কসবো-শালদানদী এলাকায় যেতে বলা হয়। ১৮ই এপ্রিল আমি কসবার পথে রওনা হই এবং সেখানে ঘাঁটি গড়ে তুলি। গঙ্গাসাগরে শত্রুদের মার দেবার পর কসবা- শালদানদীর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। আমার পৌঁছতে একটু দেরী হয়। এর আগেই শত্রুরা কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। আমি আমার ক্যাম্প ইয়াকুবপুর জামুরা এলাকায় স্থাপন করি। আমি রেকি করে বুঝতে পারি আমার অবস্থান খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। ভারতে আশ্রয় না নিয়ে নিজ অবস্থানে থেকে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকি। পাকসেনারা কসবা এসে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার, লুণ্টন, ধর্ষণ চালাতে থাকে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক পাকসেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাচ্ছিল।

 ১৮ই এপ্রিলের রাতেই আমি কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করার পকিল্পনা করি। ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে হঠাৎ করে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করে দিই। শত্রুরা যেহেতু প্রস্তুত ছিল না, সেহেতু তারা এ আক্রমণে হকচকিত হয়ে পড়ে। এ অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এবং এর সাফল্য অপ্রত্যাশিত ছিল। শত্রুরা তখন পর্যন্ত কোন বাঙ্কার তৈরি করেনি। ফলে তারা গাড়ি বোঝাই অস্ত্র ফেলে রেখে বাজারের কুঁড়েঘর এবং দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

 রাত সাড়ে চারটাকে আবার আক্রমণ করার সময় হিসাবে বেছে নিই। আমি একটা লম্বা গাছের উপরে উঠে শত্রুদের অবস্থান দেকে নিই এবং আমার সৈন্যদের প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলি। একটি মাত্র পথ শত্রুদের জন্য খোলা থাকে। ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার এবং ছোট অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের উপর গোলাগুলী ছুড়তে থাকি। এই গোলাবর্ষণের ফলে শত্রুদের ৭টা গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ৪৫/৫০ জন নিহত এবং ৭০/৮০ জন পাকসেনা আহত হয়। শত্রুরা এ আকস্মিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে কসবা ছেড়ে আড়াইবাড়ি কুটির দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। যাবার সময় তারা বিধ্বস্ত গাড়ি ও অনেক মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়।

 এ যুদ্ধ জয়ের ফলে আমার সৈন্যদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। কসবা নতুন বাজার দখল করার পর আমার হেডকোয়ার্টার কসবাতেই স্থাপন করি। অবশ্য আমি জানতাম, শত্রুরা কসবা দখল করার জন্য আবার বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের উপর আক্রমণ চালাবে।

 জুন মাসে মেজর খালেদের নির্দেশে মুন্সিরহাট, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় যাই। যাবার পূর্ব পর্যন্ত তারা কসবা দখল করতে সক্ষম হয়নি। এই ব্যাপক বিপর্যয়ের পর শত্রুসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগীতা ছাড়া বাংকার থেকে বের হতো না।

কুমিল্লার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আইনউদ্দিন[]

২৬-১০-১৯৭৩

 একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাত ১২ টার দিকে কুমিল্লা পুলিশ ক্যাম্প পাঞ্জাবীরা আক্রমণ করে এবং গণহত্যা করে। ২৫শে মার্চ রাতে তারা এসপিও ডিসিকে গ্রেপ্তার করে ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে আসে। সে সময় আমি কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে ছিলাম। ২৬শে মার্চ সকালে আমি যখন আমার বাসা বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন গাড়িতে করে কিছু সাদা পোশাক পরা লোককে ধরে আনতে দেখি। ঐ দিন আমাকে মেজর জামিল (অবাঙ্গালী) নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমাকে রাতে অয়ারলেসে ডিউটি করতে হবে। আমি রাত ১১টার দিকে যখন ডিউটিতে ছিলাম ঐ সময় সিলেট থেকে পাঞ্জাবী বেলুচ রেজিমেণ্ট-এর সি-ও অয়ারলেসে কথা বলেন। সে সময় আমি বুদ্ধি করে নিজের নাম ও পদ গোপন করে একজন পাঞ্জাবীর নাম করে অয়ারলেসে কথা বলি। বেলুচ রেজিমেণ্টের সি-ও-র কথায় বুঝতে পারলাম যে শ্রীমঙ্গলে যে সমস্ত বাঙালী সৈন্য ছিল (খালেদ মোশাররফ সাহেব তখন শ্রীমঙ্গলে ছিলেন) তাদের আক্রমণ করবে, তার জন্য বেলুচরা রেকি করেছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি কিভাবে এ সংবাদ শ্রীমঙ্গলে পাঠাবো তার চেষ্টা করি, কিন্তু ইতিপূর্বে বাঙ্গালীরা টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়ায় ঐ জরুরী সংবাদটি শ্রীমঙ্গল পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। খালেদ মোশাররফ সাহেব খবর না পেলেও শ্রীমঙ্গল থেকে তার দলসহ সরে পড়েছিলেন।

 ২৭ তারিখে আমি সাধারণ পোশাক পরে আমার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে যাই যে, যদি আমি রাত ১২টার ভিতর ব্রাহ্মবাড়িয়া থেকে ফিরে না আসি তবে যেন তারা হাতিয়ার নিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের বাইরে একটি জায়গায় অপেক্ষা করে। নির্দিষ্ট জায়গাটি আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম।

 আমি সাধারণ পোশাক পরে একখানা সাইকেলে চড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। দুপুর একটার দিকে পথিমধ্যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ট্রেঞ্চ কাটছিল। কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারেনি। তবে পথিমধ্যে কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তায় কংশনগর বাজারে কিছু বাঙ্গালী আমাকে আটক করে। তারপর আমি আমার পরিচয়পত্র দেখিয়ে তাদের বুঝাই যে, আমি বাঙ্গালী একজন ক্যাপ্টেন, বিশেষ কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি। অনেক তথ্য -প্রমাণ দেয়ার পর তারা আমাকে মোটরসাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছিয়ে দেয়। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাত দেড়টার সময় পৌঁছাই। আমি গিয়ে দেখি সকল পাঞ্জাবী সৈন্যকে বাঙালীরা গ্রেফতার করে ফেলেছে এবং ছোটখাটো সৈন্যদের বাঙালী সৈন্যরা মেরে ফেলেছে।  আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছাই তখন করোলা ব্রীজের কাছে দিয়ে জীপ যেতে দেখি। ঐ জীপটিকে আমি থামালাম। ঐ জীপে কয়েকজন বাঙালী সৈন্য এবং একজন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান (পাঞ্জাবী) ছিল। আমি দূর থেকে বাঙালী সৈন্যদের ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করতে বলি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালী সৈন্যরা তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন কৌশলে গাড়ি ব্যাক করে পালিয়ে যায়। কিন্তু ২৮ তারিখে ঐ ক্যাপ্টেন যখন বিকালে পুনরায় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছিল তখন করোলা ব্রীজের নিকট ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্যরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ঐ গাড়িতে তিনজন বাঙালী সৈন্য মারা যায় ও দুজন আহত হয়। ঐ ক্যাপ্টেন মুসলমান ছিল, তাই বাঙালীরা দায়পরবশ হয়ে তার মৃতদেহ মুসলমান কায়দায় রাত আড়াইটায় কবর দেয়। এ ধরনের কবর দেয়া প্রথম ও শেষ। তারপরে আর কোথাও মৃতদেহকে মুসলিম কায়দায় কবর দেয়া হয়নি। (শত্রুদের আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া নাকি জেনেভা কনভেনশনে আছে)।

 ২৮ তারিখে আমি ৪ জন অফিসারসহ অন্যান্য সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিফেন্স নিই। ২৭ তারিখে রওনা হয়ে খালেদ মোশাররফ সাহেব শ্রীমঙ্গল থেকে পুরা কোম্পানী নিয়ে ২৮ তারিখ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছান এবং আমাকে বলে যান, যদি কোন এম-এন-এ বা কোন বুদ্ধিজীবী আসেন তাহলে তাদের আমার (খালেদ মোশাররফ) সাথে যোগাযোগ করার জন্য যেন সিলেট তেলিয়াপাড়া টি এস্টেটে পাঠিয়ে চলে যান। খালেদ মোশাররফ সাহেব ২৮ তারিখেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট তেলিয়াপাড়া টি এস্টেটে চলে যান। তেলিয়াপাড়ায় খালেদ মোশাররফ সাহেব ক্যাম্প খোলেন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে এবং স্থানীয় প্রশাসন ঠিকভাবে চলে। ঐ সময় এস-ডি-ও ছিলেন রকিবউদ্দিন আহমেদ। তিনি তখন স্থানীয় প্রশাসক হন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রক্ষা করার জন্য গোকনঘাটে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার, ক্যাপ্টেন শহীদ ও মাহবুবুর রহমানকে ঐ ঘাট দেখাশোনার জন্য মোতয়েন করা হয়েছিল; কারণ ঐ নদীপথে পাক সৈন্যরা জাহাজে করে সৈন্য আনতে পারত। গোকন্যাট চিল একটি লঞ্চঘাট। সৈন্যরা করোলা নদীর আশেপাশে ডিফেন্স নিয়ে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধান করেন সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট হারুনর রশীদ।

 ২৯ তারিখে বিকাল ৪টার দিকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান থেকে দেড়-দুঘণ্টা ধরে বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে একজন বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্য শহীদ হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কাছে তেমন কোন অস্ত্র না থাকায় শুধু ট্রেঞ্চের ভিতর বসে থাকতে হয়।

 ৩১ তারিখে আখাউড়া থেকে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি আখাউড়াতে ডিফেন্স নিয়েছিলেন। আখাউড়াতে ইপি আর- এর সৈন্যরা পাঞ্জাবীদের ঘেরাও করে রাখে। তারপর ৩১ তারিখে সারাদিন গোলাগুলী হওয়ার পর কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায় ও কিছু ধরা পড়ে। কিন্তু ৭ জন পাঞ্জাবী পালিয়ে যায়। তারপর ঐ ৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে গ্রামের ভিতর বাঙালীরা ধরে মেরে ফেলে।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসার ধরা পড়ে তারা হলোঃ ১) লেঃ কর্নেল খিজির হায়াৎ খান, ২) মেজর সাদেক নেওয়াজ, ৩) লেফটেন্যাণ্ট আমজাদ সাইদ। তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নবীনগর, শাহবাজপুর, সরাইল হয়ে তেলিয়াপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। তাদেরকে বাঙালীরা হত্যা করতে পারত কিন্তু ঐ পাঞ্জাবী অফিসাররা কোনদিন বাঙালীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি বা বেঈমানি করেনি।  ১লা এপ্রিল ৭১ আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া যাই। ইপি- সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা বলেন যে তারা আমার সাথে (মানে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সাথে) একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করবে। তারা আমার কাছে কিছু অস্ত্র চাইলে আমি অস্ত্র সরবরাহ করতে রাজী হই। তারপর ইপি-আর-এর সৈন্যরা আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ও উজানীসাহা ব্রীজের আশেপাশে ডিফেন্স নেয়। আমি আগরতলায় বিএসএফ-এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করি এবং তাদের কাছে কিছু অস্ত্র চাই। এবং তারা তা দিতে চান। লেঃ কর্নেল দাসের সাথে রাতে ফোনে যোগাযোগ করি।

 ১/২ তারিখে আমি আখাউড়ার আওয়ামী লীগের সহসভাপতিকে সংগে করে আগরতলায় বিএসএফ- এর লেঃ কর্নেল দাসের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। মিঃ দাস ১০ হাজার গুলি ও একশত ৩০৩ রাইফেল ও কিছু এক্সপ্লেসিভ দিতে অঙ্গীকার করেন এবং পরে তিনি তা দেন। এ অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে যে কণ্ট্রাক্ট হয় সে কণ্ট্রাক্ট করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম সাহেব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম ও লুৎফুল হাই সাচ্চু সাহেব বেঙ্গল রেজিমেণ্টদের খাওয়া-দাওয়া, গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে প্রচুর সাহায্য করেছেন যুদ্ধ চলা অবস্থায়। সৈন্য জনাব আলী আজম ৩০ তারিখের পূর্বেই আগরতলা গিয়ে অস্ত্রের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলেন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেজর হাবিবুল্লাহ বাহার (যিনি কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে এসেছিলেন- ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার-কমাণ্ডিং অফিসার (তিনি কুমিল্লা থেকে পালিয়ে আসেন) এবং ক্যাপ্টেন সায়গলকে (যে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে) তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

 আমি যখন কুমিল্লা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওনা দিই তখন যে প্রায় একশত সৈন্য রেখে আসি তারা কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে বেপরোয়া হয়ে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এর ফলে প্রায় ৩-৪ শত পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায়। কিছু বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈন্য শহীদ হন।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি ১৫/২০ জন এম-পি-এ কে ভারতে পাঠিয়ে দিই। এপ্রিল মাসে আমি জানতে পারি যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভৈরব এসেছেন। সৈয়দ সাহেবকে অবহিত করাই যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্টের অধীনে আছে। আমি সৈয়দ সাহেবকে আনার জন্য স্পিডবোট পাঠাতে চাইলে তিনি আসতে রাজী হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসননি। এ সময়ের মধ্যে আমি বিভিন্ন জেলায় অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর নিতে লাগলাম যে কোথায় বাঙালীরা রিভোল্ট করল। আমি জানতে পারলাম ময়মনসিংহে মেজর সফিউল্লাহ আছেন ও নরসিংদিতে একটি কোম্পানী আছে মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে। মেজর সফিউল্লাহ একটি পরিকল্পনা করেন যে, মেজর মতিউর রহমানের বাহিনীও তাঁর কোম্পানী মিলে ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমণ করবে ও দখল করবে। এ সংবাদ আমি মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেবকে জানাই। তিনি এ খবর পেয়ে তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন। এখানে একত্র হয়ে তারা সবাই মেলে যুক্তি করে ভালভাবে কাজ করতে পারবে। পরে সফিউল্লাহ সাহেব পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন এবং মেজর মতিউর রহমান সাহেব ভৈরব ব্রীজের কাছে ডিফেন্স নিয়ে থাকেন।

 এদিকে মেজর নাসিম এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আশুগঞ্জ ডিফেন্স দিয়ে থাকেন ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছিলাম আমি, ভৈরবে ছিলেন মেজর মতিউর রহমান এবং আশুগঞ্জে ছিলেন মেজর নাসিম। বাকি সবাই তেলিয়াপাড়া চলে যান।

 মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একত্রিত হলেন তখন তারা সিদ্ধান্তে আসতে চাইলেন যে, তারা কুমিল্লা ক্যাণ্টমেণ্ট আক্রমণ করবেন কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলেন কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে বিপুলসংখ্যক পাকসৈন্য রয়ে গেছে। ঐ পাকসৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাবে না, এর ফলে অনেক সৈন্য মারা যাবে। শেষ পর্যন্ত মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন পাকসেনাদের গেরিলা পদ্ধতিতে ঘায়েল করতে হবে।

 ১৪ তারিখে পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান থেকে গুলি করে; ফলে কিছু পাবলিকসহ কিছু বাঙালী সৈন্য মারা যায়। এ সংবাদ খালেদ মোশাররফ সাহেব পেয়ে জানালেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আখাউড়া চলে আসে। ঐ তারিখে পাকসৈন্য প্যারাট্রুপার ফেলে আশুগঞ্জের পিছনের দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে মেজর নাসিম সাহেবের কিছু সৈন্য শহীদ হয়। ১৪ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান আক্রমণ চলে। এর পরে আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কোন রকম টেলি-যোগাযোগ বা কোনরকম যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

 ১৪ই এপ্রিল আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংক থেকে (ইস্টার্ন মার্কেণ্টাইল ব্যাংঙ্ক) ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে ডাকিয়ে ব্যাংক খুলে ২ কোটি টাকা নিয়ে যাই। ঐ টাকা ঐদিন তেলিয়াপাড়ায় মেজর সফিউল্লাহ সাহেবের কাছে জমা দিই। ১৪ তারিখে সারাদিন বিমান আক্রমণ হচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। এ সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার ভিতরেও আমি বীরত্বের সাথে এ কাজ সমাধান করি। আমি বিকালেই তেলিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে দেখি আমার বাহিনী কিছু কিছু আখাউড়া চলে এসেছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দুখানা মূল্যবান অয়ারলেস সেট নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সড়ক পথে তেলিয়াপাড়া হয়ে আখাউড়া চলে আসি।

 ১৫ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বলেন, আমাকে আখাউড়ায় সৈন্যদের দেখাশোনা করতে হবে। আখাউড়াতে ৩০/৪০ জন সৈন্য ছিল। আমি ১৫ তারিখে আমার বাহিনীকে বিকালে গঙ্গাসাগরের দিকে মুখ করে ডিফেন্স নেবার কলাকৌশল দেখিয়ে দিই। ১৫ তারিখ রাতে কুমিল্লা থেকে রেলে করে পাকসৈন্য গঙ্গাসাগর আসে এবং গঙ্গাসাগরের ব্রীজের দক্ষিণ পারে বাজারের দিকে তারা ডিফেন্স নেয় এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ব্রীজের উত্তর দিকে অর্থাৎ আখাউড়ার দিকে ডিফেন্স নেয়। ১৬ ই এপ্রিল সকালে যেখানে ব্রীজের নিকট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ডিফেন্স নিয়েছিল, সেখানে ঐ সৈন্যদের সাথে দেখা করার জন্য আমি ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। পাকসৈন্যরা আমাকে দেখে আমার দিকে অবিরাম গুলীবর্ষণ করতে থাকে, কিন্তু আমি ঐ ঝুঁকি নিয়ে ট্রেঞ্চে গিয়ে সৈন্যদের বলে আসি পাক বাহিনীকে হত্যা করে যখন তাদের সংখ্যা কমে আসবে এবং বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ট্রেঞ্চের কাছে চলে আসবে ঠিক তার অল্প কিছুক্ষণ আগে যেন তারা বিওপিতে চলে আসে।

 ১৩ এপ্রিল গঙ্গাসাগরের এক পারে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং অপর পারে পাকবাহিনী অবস্থান করছিল। ঐ দিন বিকালে ৪টা থেকে পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী আধ ঘণ্টা বোমাবর্ষণ করে থেমে যায়।

 বিকাল ৬টা থেকে পাকবাহিনী আবার গোলা ছুড়তে থাকে এবং আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেনারা অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে এবং বহু পাকসেনাকে খতম করে শেষে পাকসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে সব বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সৈন্য পিছনের দিকে চলে আসে। বাকি ছিল মাত্র সিপাই মোস্তফা কামাল; সে আর ফিরে আসে নাই। তার হাতে ছিল একখানা এল-এম-জি ও ৮ হাজার গুলী। তার সাথে যে ২ জন সেনা ছিল তারাও চলে গেল। কামাল ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে যুদ্ধ করতে থাকে। তার গোলায় পাক বাহিনীর তিনজন অফিসার মরে ও ২ জন আহত হয়। সবসুদ্ধ প্রায় সাড়ে তিনশ' সৈন্য খতম হয়। কামালের গুলি যখন ফুরিয়ে যায় তখন শত্রুসেনারা মাত্র ৫০ গজ দূরে ছিল, তবু সে পিছনে ফিরে আসে না। দূর থেকে পাকসেনা চীৎকার করে কামালকে আত্মসমর্পণ করতে বলে, কিন্তু কামাল তা করে নাই। পরে যখন পাকসেনারা ক্রলিং করে কামালের ট্রেঞ্চের কাছে আসে, কামাল তার শেষ সম্বল দু'খানা গ্রেনেড দিয়ে কিছু পাকসেনাকে আহত করে। শেষ পর্যন্ত কামাল পাকসেনাদের কাছে ধরা পড়ে। পাকসেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। প্রায় সাড়ে তিনশত পাকসেনা মরা যায়। এ সংবাদ যখন পাসেনারা অয়ারলেসে তাদের হেড অফিসে প্রেরণ করছিল তখন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট তাদের অয়ারলেসের মাধ্যমে সঠিকভাবে জানতে পারল যে, বেঙ্গল পাকবাহিনীর সাড়ে তিনশ' সৈন্যকে হত্যা করেছে। এত সৈন্য মরার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায় যার পরবর্তী ২/৩ মাস তারা আর আক্রমণ করে নাই।

 এপর আমার বাহিনী আখাউড়া বি-ও-পিতে ডিফেন্স নেয়। পরে আমার অধীনে দু'জন লেফটেন্যাণ্ট নিয়োগ করা হয়। একজন ক্যাডেট অফিসার হুমায়ূন কবীর। তার এলাকা ছিল কসবা। তিনি কসবাতে সাবসেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। অপরজন লেন লেফটেন্যাণ্ট হারুনার রশীদ। তিনি নসিঙ্গরে সাবসেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। হারুন ও কবীরের কাছে এক কোম্পানী ও আমার কাছে দুই কোম্পানী সৈন্য ছিল। কোন সময় কসবা রেলস্টেশন ও কসবা নতুন বাজার পাকবাহিনী দখল করতে পারেনি। এবং নসিঙ্গরের কালাছড়া টি এস্টেট প্রায় সব সময় মুক্তিবাহিনীর অধীনে ছিল। আমি প্রত্যেক দিন একবার করে তিনটি ক্যাম্প পরিদর্শন করতাম।

 ১৭ই এপ্রিল রাত ১১/৩০ মিনিটে মেজর শাফায়াত পামিল ও আমিসহ পাঁচজন অফিসার ও ৬০ জন সৈন্য নিয়ে আখাউড়া পাকবাহিনীর সেনাদের দখলে ছিল। ব্রীজ উড়িয়েছিল ৬৫ জন বেঙ্গল রেজিমেণ্ট সৈন্য। তারা অক্ষত অবস্থায় আখাউড়া বি-ও-পি' তে ফিরে আসে।

 কর্নেল বাজার অপারেশনও জুন-১৯৭১: আখাউড়া পতন হওয়ার পর বাংলাদেশ বাহিনী কর্নেল বাজারে জড়ো হয়। বাংলাদেশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাক সৈন্যদের হত্যা করে সংখ্যা কমানো। তাই তারা ওখানে রয়ে গেল। পাকবাহিনীর সৈন্য ছিল এক কোম্পানী আর বাংলাদেশ বাহনীর ৩টি কোম্পানী ছিল। তার ভিতর একটি ছিল অনিয়মিত বাহিনী।

 আগরতলা থেকে যে রাস্তা গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে ঐ রাস্তার উত্তর মুখ হয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ডিফেন্স নেয়। ঐ রাস্তার উত্তর দিকে একটি খাল ছিল। পাকবাহিনী আখাউড়া থেকে কর্নেল বাজারের দিকে অগ্রসর হয় উত্তর দিক থোকে। তারা খাল পার হয়। রাতের বলায় এসে পূর্বদিকে অর্থাৎ বাংলাদেশ বাহিনীর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়ে তারা ছিল অনিয়মিত বাহিনী। যা কিছু সৈন্য ছিল তাদের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। ফলে বেয়নেটের আঘাতে বাংলাদেশ বাহিনীর ৭ জন সৈন্য শহীদ হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বাহিনীর অনিয়মিত সৈন্যদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারা যার যার মত নানা দিকে চলে যায়।

সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা

সাক্ষাৎকারঃ মেজর ইমামুজ্জামান[]

১০-১-১৯৭৪

 মেজর খালেদ মোশাররফ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক কোম্পানী সৈন্য আমার নেতৃত্বে দিয়ে কুমিল্লা- চাঁদপুর সড়কে (লাকসামের কাছাকাছি) এপ্রিল মাসের ১১ তারিখ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৬৫টা কনভয় আমরা এ্যামবুশ করি। এতে ৫টা গাড়ি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়, বাকি গাড়িগুলো কুমিল্লাতে ফিরে যায়।

 এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় (বাগমারায়)। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তখনও প্রচুর ছিল না। ভারতও তখনো আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছিল না। দু'দিন পর্যন্ত আমরা তীব্র প্রতিরোধ করলাম। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হাটতে বাধ্য হলাম। ওদের প্রায় ২৭০ জন মারা গিয়েছিল- মৃত দেহগুলি গাড়ীতে (৭/৮ ট্রাক) উঠবার সময় আমরা দেখতে পেলাম।

 এপ্রিলের ২১ তারিখে আমরা লাকসাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হলাম। চাঁদপুরে তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ শুরু করে। লাকসাম থেকে আমরা মিয়ার বাজারে চলে গেলাম। এপ্রিলের ২৭ তারিখ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিয়ার বাজারে আক্রমণ করে। ঐ যুদ্ধে ওদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছিল। ধানক্ষেতে পানির মধ্যে অনেক সৈন্যের লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

 এপ্রিলের ২৯/৩০ তারিখে ওরা আবার আক্রমণ চালায়। ওদের দুটো আক্রমণই বীরত্বের সাথে প্রতিহত করা হয়। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়।

 আমি কাদের চৌধুরী নামে মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেনকে মিয়ার বাজারের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে চৌদ্দগ্রামে চলে আসি এবং ডাকাতিয়া নদীর পারে পরিকোট নামক জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করি।

 মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নদীর ওপারে বাংগোড়া বাজারে আসে এবং বেশ গোলাগুলী করে। কিন্তু আমাদের শক্তিশালী ঘাঁটির কথা জানতে পেরে ওরা লাকসাম চলে যায়। মে মাসের ১৪ তারিখ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় নদীর ওপার থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই।

 আমরা চৌদ্দগ্রাম চলে আসি। গোলন্দাজ বাহিনীর ভারী গোলাবর্ষণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা ভারতের রাধানগরে চলে আসি। আমাদের কোন সরবরাহ ছিল না। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। গুলির অভাব ছিল।

 চৌদ্দগ্রাম থেকে মিয়ার বাজার পর্যন্ত সড়কে পাকিস্তানীরা যাতায়াতের চেষ্টা করে। ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঐ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারেনি। প্রায় সমস্ত পুল ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। বন্ধুরা দৌলতপুর থেকে ছাগলনাইয়া পর্যন্ত জুন মাসের প্রথম দিকে মেজর জিয়ার সেনাবাহিনী এবং ২নং সেক্টরের সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে একটা মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করেছিল।

কুমিল্লা- নোয়াখালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

১৮-৯-১৯৭৩

 ৩০শে অথবা ৩১শে মার্চ (১৯৭১) সুবেদার সিরাজুল হককে সঙ্গে নিয়ে আমি চৌমুহনী পৌঁছি। এখানে পরিষদ সদস্যদের সাথে দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। নূরুল হক ও অন্যান্য সদস্যগণ ঢাকাসহ প্রদেশের সমস্ত জায়গায় পাক পশুশক্তির বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনি। তারা সবাই আমাকে যে কোন প্রকারে যোদ্ধা সংগ্রহ করে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে বলেন। তারা সর্বপ্রকার সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং আমাকে মাইজদীতে নিয়ে যান। সেখানে তৎকালীন এম-এন-এ এমপিএ' দের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

 ২রা এপ্রিল অতঃপর আমি ফেনীতে গিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার, ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন পরামর্শ করি। মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে কালবিলম্ব না করে নোয়াখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং বাঘমারায় শত্রুকে বাধা দিতে নির্দেশ করেন। তিনি

[] সকল প্রকার অস্ত্র সরবরাহ করারও প্রতিশ্রুতি দেন। ফেনী থেকে ফিরে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপি-আর এবং ৭৬ জন প্রকৃত নিয়মিত সৈন্য সংগ্রহ করি ও নোয়াখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করি।

 ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১-সর্বপ্রথম বাঘমারা পরিদর্শনঃ দয়াময়কে স্মরণ করে সর্বপ্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য লাকসামের উত্তরে বাঘমারা পরিদর্শন করি এবং সুবেদার নজরুল ও সুবেদা জব্বারকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্থান নির্দিষ্ট করে দিই। এমন সময় নোয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার সাহেব এবং পরিষদ সদস্যগণ এসে আমাকে জানালেন যে, দু'খানা পাকসেনা বহনকারী জাহাজ রামগতির দক্ষিণ পাশের নদীতে অবস্থান করছে। এ খবর শোনার পর আমি তৎক্ষণাৎ রুহুল আমীন (শহীদ), পিটি-অফিসার সাহেবসহ চারজন বুদ্ধিমান জোয়ানকে তার সত্যতা প্রামণ করতে উক্ত নদীতে পাঠালাম। তাঁরা নদী থেকে ফিরে এসে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে জনান যে, সেখানে একখানা নৌকা ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। অতঃপর ৫ই এপ্রিল নোয়াখালীর অদূরবর্তী দৌলতগঞ্জের সেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিই। কেননা পাক সৈন্যরা তখন লাকসামের উত্তরে বাঘমারাতে অবস্থান করছিল। কয়েকজন মোজাহিদ ও আনসারকে হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করি। বিকেলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ফেনীতে যাই।

 ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১: ফেনী থানা থেকে অতিকষ্টে ১৮ টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে কোম্পানীতে ফিরে আসি। এক'দিনে রাতদিনের আরাম-আয়েশ হারাম হয়ে পড়ে আমার জন্য। শুধু যোদ্ধা, অস্ত্র আর এ্যামুনিশন সংগ্রহের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। য সমস্ত যোদ্ধা আমার সাথে ছিল তাদের হাইড-আউটের কথাও চিন্তা করি।

 ৭ই এপ্রিল, ১৯৭১: সারারাত যোদ্ধা, হাতিয়ার আর এ্যামুনিশন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে হাঁটাহাঁটি করে ভোর ছ'টায় ক্যাম্পে ফেরামাত্র খবর পেলাম ফেনীতে ইপি-আর এবং অবাঙ্গালীদের মধ্যে সংঘর্ষের। পুরা কোম্পানী নিয়ে ফেনী যাবার সিদ্ধান্ত নিলে সুবেদার সিরাজ ফেনী যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা আমাদের হাতে কয়েকটি রাইফেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর কথামত কোম্পানী রেখে আমি নিজে স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখার জন্য ফেনী রওনা হই। ফেনীর পরিস্থিতি দেখে চৌমুহনীতে ফিরে আসি এবং নোয়াখালীর সমস্ত পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের সঙ্গে জরুরী পরামর্শে বসি।

 ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১: নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার জনাব মঞ্জুর সাহেব সারা দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমাকে ডেকে পাঠান। নোয়াখালীর প্রতিরক্ষার জন্য তাগাদা দেন। বিকেলে ক্যাপ্টেন এনামুল হক সাহেব কোম্পানী পরিদর্শন করে আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।

 ৯ই এপ্রিল, ১৯৭১: শত্রুর তুলনায় সামান্য অস্ত্র এবং যোদ্ধা নিয়ে ফরোয়ার্ড লাইনের প্রায় সবটাই কভার করে নিই। এ-দিন নাথের পেটুয়া স্টেশনের কাছে আরও একটি ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্থাপন করি।

 ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১- লাকসামে প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় মুখোমুখী যুদ্ধ। নোয়াখালীর পরিষদ সদস্যদের দেওয়া চারশত টাকা ফরোয়ার্ড ডিফেন্স বাহিনীতে ভাগ করে দিতে যাই লাকসামে সকাল ১০টায়। বেলা ১২টার সময় খবর পেলাম পাকবাহিনী বাঘমারা থেকে লাকসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্প নিই। লাকসামের সামান্য উত্তরে পশুশক্তিকে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সেই অনুসারে পজিশন নেওয়া হ'ল। মাত্র ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে এই অভিযান চালাই। সঙ্গে দুটো এল-এম-জি ছাড়া বাকী সবই ৩০৩ রাইফেল ছিল। তাই নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে রইলাম সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত। কিছুক্ষণ পর শত্রুপক্ষ যখন আমাদের রেঞ্জের ভিতরে চলে আসে তখনই একসঙ্গে গোলাগুলী শুরু করি। আমার এ অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনীর দুজন লেফটেন্যাণ্টসহ ২৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৬০ জন আহত হয়। পর মুহূর্তে সামলে নিয়ে পাকবাহিনীর সৈন্যরাও মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাগুলী শুরু করে বৃষ্টির মত গুলীবর্ষণ শুরু হলো। প্রায় ৪ ঘণ্টা গোলাগুলী বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের দুটো ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ক্রমেই আমাদের গোলাবারুদ শেষ হতে থাকে। সরবরাহ ও সাহায্যের কোন আশা ছিল না। অপর পক্ষে পাকবাহিনী ময়নামতি থেকে সারবরাহ ও সৈন্য পেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। কাজেই অক্ষত সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হই। ফলে পাকবাহিনী লাকসাম দখল করে নেয়।

 রাতে নূরুল হক সাহেব, নাগাবাবুসহ অপর দুজন পরিষদ সদস্য ২টা এল-এম-জি ও ৪টা এস-এল- আর আমার হাতে অর্পণ করেন। কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে দৌলতগঞ্জ সেতু উড়িয়ে দিই এবং লাকসাম- নোয়াখালী সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হই।

 ২০শে এপ্রিল, ১৯৭১-নাথের পেচুয়ার মুখোমুখি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল সারারাত সেতু ধ্বংস করায় ব্যস্ত থাকায় ভোরে বিপুলাশ্বরে পৌঁছামাত্র মাইজদী থেকে টেলিফোনযোগে খবর পেলাম যে, লাকসামে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ কোম্পানীকে ফল-ইন করিয়ে সুবেদার সিরাজ সাহেবকে কে প্লাটুনের কমাণ্ডার নিযুক্ত করি এবং সুবেদা রজব্বার সাহেবকে দ্বিতীয় প্লাটুনের কমাণ্ডার নিযুক্ত করে দিই। আমি নিজে তৃতীয় প্লাটুনটি কোম্পানী হেডকোয়ার্টারসহ নিয়ে নাথের পেটুয়া অভিমুখে দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকের দায়িত্ব সুবেদার সিরাজ সাহেব ও জব্বার সাহেবের উপর অর্পণ করি এবং আমি পশ্চিম কি রক্ষার দায়িত্ব নিই। তাদেরকে এ কথাও জানাই যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের যখন কোন ব্যবস্থ নেই, সেহেতু শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন কেউই পশ্চাদসরণ না করেন।

 আমি নিজের প্লাটুনকে প্রত্যেক সেকশনের পজিশন স্বহস্তে দেখিয়ে দিই। খনন কার্য শেষ না হতেই হঠাৎ নায়েক সিরাজ সতর্ক সংকেত দ্বারা আমাকে দেখালেন যে শত্রুপক্ষ ক্রলিং করে আমাদের পজিশনের নিকটে এসে গেছে। আমি চেয়ে দেখি সত্য সত্যই শত্রুরা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে প্রায় এক কোম্পানী ক্রলিং করে এমনভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যা ধারণা করা যায় না। আমি তৎক্ষণাৎ এস-এল-আর’এর মাধ্যমে গুলি শুরু করি। নায়েক সিরাজও এল-এম-জি'র মাহায্যে শত্রুর উপর আঘাত করে। বলতে গেলে আমার সমস্ত প্লাটুনের সৈন্যরা একসাথে আগত শত্রুর প্রত্যেককে আহত বা নিহত করতে সক্ষম ছিল। এরপর তাদের ফলো-আপ কোম্পানী দ্বিগুণ বেগে তাদের সাপেটিং বা সাহায্যকারী অস্ত্রের দ্বারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়ে আহত ও নিহত সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে চলে যায় এবং তারপর আমাদের উপর আর্টিলারী এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পূর্ব দিক থেকে যখন আমার দ্বিতীয় প্লাটুনের ল-এম-জি'র ফায়ার শত্রুপক্ষের উপর পড়ছিল তখন শত্রুরা তাদের উপরও (দ্বিতীয় প্লাটুনের উপর) অনবরত শেলিং করতে থাকে। পরিণামে আমার একজন সৈন্য তৎক্ষণাৎ শহীদ হন এবং একজন গুরুতরভাবে আহত হন। আমি বাধ্য হয়ে প্লাটুনকে ২০০ গজ পশ্চাতে একটা ডোবার পাশে দৌড়ে পজিশন নিতে আদেশ দিই। শত্রুর দুই প্লাটুনের মত সৈন্য আমার প্রথম পজিশনটি দখল করে ফেলে। এ সময় আমি আমার প্লাটুনকে আদেশের মাধ্যমে দ্বিতীয় ডিফেনসিভ পজিশনে নিয়ে যাই। এবং পুনরায় শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করেই গুলি আরম্ভ করি। এমন সময় হঠাৎ তিনখানা যুদ্ধ-বিমান সোজা আমাদের উপর ডাইভ করে পর পর তিনবার আক্রমণ চালায়। তারা প্রচুর পরিমাণ গুলি ছোঁড়ে এবং নাপাম বোমা ফেলতে থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে, সমস্ত গুলি এবং বোমাগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ঠ অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুদের আর এক ইঞ্চি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা ছিল না তখন আমি পূর্বদিকে অবস্থানরত দুই প্লাটুনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমার একজন জোয়নকে তাদের খবর আনতে পাঠাই। এ সময় পূর্ব দিকের গ্রামগুলি আগুনে শুধু জ্বলতে দেখি। সংবাদদাতা ফিরে এসে জানালো যে, পূর্বদিকের দুই প্লাটুন তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। এ কথা শোনার পর আমি বাধ্য হয়ে অলরাউণ্ড ডিফেন্স করি। এভাবে সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলাগুলী বিনিময় হয়। সন্ধ্যের পর পাকবাহিনী রেকি পেট্রলিং শুরু করে। তারা আমাদের উপর ফাইটিং পেট্রল পাঠায়। আমার সঙ্গে দু'ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। তারা যাবতীয় অস্ত্র দ্বারা গুলি করতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর তারা চলে যায়।  সারাদিন ধরে যুদ্ধ করার পর অনাহার আর অবিশ্রামে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কথা বের হচিছল না আমাদের। এমতাবস্থায় পুনরায় যুদ্ধ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলি এবং রাত সাড়ে দশটার সময় আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে সোনাইমুড়ি অভিমুখে রওনা হই। এ সময় রাস্তায় কোন জনগণের সাড়াশব্দ ছিল না। প্রত্যেক বাড়ির লোক ধন-সম্পদের আশা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে চলে গেছে। সোনাইমুড়িতে পৌঁছে ড. মফিজ সাহেবের সাক্ষাৎ পাই। আমাদের বিশেষ করে আমাকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন। (ড. মফিজ খবর পেয়েছিলেন যে, আমরা পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মারা গিয়েছি)। তারপর তিনি আমাকে ও আমার সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

 ২১শে এপ্রিল ভোরে শত্রুদের পুনরায় অগ্রসর হবার খবর পেলাম। পূর্বদিন যুদ্ধে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া এ্যামুনিশনও তেমন ছিল না। তবু শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নিই। এবং সে অনুযায়ী সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছাকাছি এ্যামবুশ পার্টি বসাই। কিছুক্ষণ পর শত্রুবাহিনীর জোয়ানরা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে আমরা গুলী চালাই। শত্রুপক্ষ ৩” মর্টার ও মেশিনগান থেকে গুলী চালায়। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। বেলুচ রেজিমেণ্টের কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। ইতিমধ্যে আমাদের এ্যামুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমি আমার বাহিনীকে উইথড্র করে চলে আসি। পাকবাহিনী সোনাইমুড়ি দখল করে চৌমুহনীর দিকে অগ্রসর হয়।

 আমি আবিরপাড়ায় একটি গোপন বৈঠক দিই। এখানে কর্মীদের বিপুল উৎসাহ দেখা যায়। নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ও ইসহাক মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

 ২৪শে এপ্রিলং আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মী জনাব আমীন উল্লা মিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আমাকে সাহস দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা দেন। তিনি প্রথমবারের মত ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনার জন্য এবং রাস্তা ঠিক করার জন্যে ভারতে চলে যান। এইদিনে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে এসে আমার কোম্পানীতে যোগদান করেন।

 ২৬শে এপ্রিলঃ হাবিলদার নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে বিপুলাশ্বর স্টেশনের দক্ষিণে এক আড়ালে এ্যামবুশ করি। সকালে পাকবাহিনরি ৬জন সিগনালম্যানসহ দু'খানা গাড়ী যাবার সময় এম-এমজি দ্বারা ব্রাশ করলে তাদের একখানা গাড়ী নষ্ট হয়ে যায় এবং দু'জন আহত হয়। পাকবাহিনী আহত ব্যক্তিদ্বয়কে নিযে অন্য গাড়ীসহ পালিয়ে যায়। এখানে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। এখানে দুটো রাইফেল উদ্ধার করি।

 ২৮শে এপ্রিলঃ সিপাই শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে সোনাইমুড়িতে রেকী করি। ২৯শে এপ্রিল নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে সোনাইমুড়ি আউটার সিগন্যাল পুনরায় অ্যামবুশ করে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর তিনখানা গাড়ী অগ্রসর হতে থাকলে সফি ফায়ার শুরু করে। ফায়ারে সম্মুখের গাড়ীখানা অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ পজিশন নিয়ে পাল্টা ফায়ার শুরু করে। দু'তিন ঘণ্টা যাবৎ গোলাগুলী বিনিময় হয়। কিন্তু এ্যামুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমাদের জোয়ানরা গা-ঢাকা দেয়। শত্রুপক্ষের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এখানে পাকবাহিনীর গুলীতে একটি ছেলে ও এক বৃদ্ধ মারা যায়।

 ১লা মে-বগদীয়ার যুদ্ধঃ নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে বগাদীয়া সেতুর কাছে এ্যামবুশ করে। এ জায়গা দিয়ে একখানা জীপসহ তিনখানা ৩-টনী লরী কিছু দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হবার সময় নায়েক সিরাজ পাকবাহিনীর উপর চরম আক্রমণ চালায় এবং প্রথম ও শেষ গাড়ীখানার উপর অনবরত গুলী চালালে ৩-টনী একখানা গাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এখানে ১৫/২০ জন খানসেনা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়, কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষণে পাকসেনারা ৩” মর্টার ও মেশিনগান হতে অবিরাম গোলাগুলী বর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর নায়েক সিরাজ প্লার্টুন উইথড্র করে। পাকসেনারা এখানে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে হাবিলদার নুরুল আমীন ও অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয়। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বিরত্বের সাথে এ যুদ্ধ পরিচালনা করে।

 ৬ই মে-ফেনাকাটা পুলে সংঘর্ষঃ চৌমুহনী-চন্দ্রগঞ্জ রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এ্যামবুশ করার সুযোগ পাইনা। অবশেষে ৬ই মে নায়েক সফির সেকশন নিয়ে এ্যামবুশ পার্টি বসাই। বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তিনখানা পাকসৈন্য বোঝাই ট্রাক চন্দ্রগঞ্জ থেকে চৌমুহনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকলে আমরা অতর্কিত আক্রমণ চালাই। আমাদের এই অতর্কিত আক্রমণে পাক জোয়ানরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তাদের প্রস্ততি নেয়ার পূর্বেই বেশ কয়েকজন খানসেনা ধরাশায়ী হয়। মুহূর্তের মধ্যে তারা ভারী মেশিনগান দ্বারা আমাদেরকে পাল্টা আক্রমন করে। পাকসেনাদের মেশিনগানের গুলীতে একই নামে আমাদের দু'জন বীর মুক্তিসেনা (ইসমাইল) শহীদ হন। তাদের একজনের বাড়ি আমিশাপাড়া বাজারের পশ্চিমে সাতঘরিয়া, অপরজনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জে। এরপর আমি আমার সৈন্য তুলে নিয়ে শহীদদ্বয়ের দাফনের ব্যবস্থা করি-আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মী চৌমুহনীর হোটেল জায়েদীর মালিক, পদিপাড়ার নূর মোহাম্মদ সাহেবের তত্ত্বাবধানে পদিপাড়াতে সমাধিস্থ করা হয়।

 ৮ই মে আমি ভারত থেকে মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেবের আদেশক্রমে অস্ত্র আনয়ন করি।

 ৯ই মে-পুনরায় বগাদীয়াতে যুদ্ধঃ ফেনাকাটা যুদ্ধ ও অপারেশনের পর জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন করে সাহসের সঞ্চার হয়। নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে বগাদীয়াতে এ্যামবুশ করার নির্দেশ দিয়ে নায়েক সুবেদার জবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমি শত্রুবাহিনীর কর্মতৎপরতা ও অবস্থান লক্ষ করার উদ্দেশ্য চৌমুহনী রওনা হই। চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করে বগাদিয়ায় ফেরার পূর্বেই নায়েক সুবেদার ওয়ালী উল্লা পাকবাহিনীর একখানা পিকআপ ভ্যানের একজন জেসিওসহ ছয়জন সৈন্যের উপর আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুদের দু'জন সৈন্য (জেসিও) নিহত হয়। গাড়ীখানা রাস্তায় পড়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরাও পৌছে গেলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে শত্রুবাহিনীর আরও দু'খানা গাড়ী এসে পড়ল। আরম্ভ হয় উভয়পক্ষের আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ। প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা গোলাগুলী বিমিনয় হয়। অবশেষে শত্রুরা হতাহত সৈন্যদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে চলে যায়। এখানে শত্রুপক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এ যুদ্ধে নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর কপালে গুলী লাগে এবং তিনি সামান্য আহত হন। তিনি এ যুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বীরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পাকবাহিনীর উক্ত অকেজো গাড়ীখানা স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ কয়েক মাস রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে থাকে।

 তৎকালীন পাকিস্তান বাজারের পূর্ব দিকে যুদ্ধঃ পাকসেনাদের চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর সড়কে আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সেই রাস্তায় এ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করি। অবশেষে ১০ই মে এ্যামবুশ করে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একখানা সিভিল বাসে কিছু ছদ্মবেশে ও কিছু সামরিক পোশাকে খানসেনারা লক্ষ্মীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই বাসের ২/৩ শত গজ পেছনে সামরিক গাড়ীতে আরও বহু পাকসৈন্য অগ্রসহর হচ্ছিল। প্রথম গাড়ীকেই আমরা আঘাত করি। ফলে কয়েকজন সৈন্য প্রাণ হারায়। মুহূর্তে অন্য পাক সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে মর্টার ও আর্টিলারীর সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে আমরা সেখান থেকে পালতে সক্ষম হই।

 ১১ই মে, ১৯৭১-মীরগঞ্জে পাকবাহিনীর পরাজয়ঃ এখানে রেকী করে সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে এ্যামবুশ করার নির্দেশ দেই এবং নায়েক আবুল হোসেনকে রাস্তায় মাইন পুঁততে নির্দেশ দিই। আবুল হোসেন মাইন বসিয়ে আত্মগোপন করে থাকে। লক্ষ্মীপুরের প্লাটুন কমাণ্ডার হালিদার আব্দুল মতিন ও তার সেকশন নিয়ে এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পর শত্রুবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে একখানা গরুর গাড়ী সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকে। গরুর গাড়ীখানা পুঁতে রাখা মাইনের উপর দিয়ে অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড আওয়াজে সেটি কয়েক হাত উপরের দিকে উঠে যায়। প্রচণ্ড আওয়াজে হানাদার খানসেনারা এতই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে যে তারা কয়েকজন অস্ত্র ফেলে প্রাণপণে পালানো চেষ্টা করে। অমনি শুরু হয় আমাদের গোলাগুলী। কয়েকজন হতাহতও হয়। জানা যায়, শত্রুরা পালিয়ে যাবার সময় জনসাধারণের হাতে দু'জন খানসেনা মাছ মারা রাকসা দ্বারা আহত হয়। শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া বেশ অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এখানেও সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন।

 ১২ই মে চৌমুহনীর দেড়মাইল উত্তরে মান্দারহাটে শত্রুদের উপর চরম আঘাত হানার জন্য আমি এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিয়ে এ্যামবুশ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখন চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর বিরাট ঘাঁটি অবস্থান করছিল। এ সময়ে পাকবাহিনী গুপ্তচর দ্বারা খবর নিয়ে অতর্কিত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে আমরা সেখান থেকে কোন প্রকারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকবাহিনী আমাদের ধরতে না পেরে মান্দারহাট বাজারটি পুড়িয়ে দেয়।

 ১৩ই মেঃ এদিন বিকেল দু'টায় খবর পেলাম নোয়াখালীর এস-ডি-ও দুই গাড়ী পাকসৈন্যসহ আজ লক্ষ্মীপুর পরিদর্শনে গেছেন। তাদের প্রত্যাগমনে বাধার দেওয়ার জন্য হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে চন্দ্রগঞ্জের নিকট কোন এক জায়গায় এ্যামবুশ করেন। এ এ্যামবুশে এস-ডি-ও সহ কয়েকজন সৈন্য আহত হয়।

 ১৪ই মেঃ নায়েক আবুল হোসেন বিপুলাশ্বর স্টেশনের কাছে কয়েকটি মাইন পুতে রাখে। কিন্তু পাকসেনাদের গাড়ী অতিক্রম করার পূর্বেই একখানা ইট বোঝাই ট্রাক সে স্থান অতিক্রম করার সময় ট্রাকটি পড়ে যায়। অন্যদিকে একই দিনে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ তাঁর প্লাটুন নিয়ে চন্দ্রগঞ্জে এ্যামবুশ করেন। লক্ষ্মীপুর থেকে অগ্রগামী একখানা লরী বোঝাই খানসেনাদের এ্যামবুশ করে ৫/৬ জনকে খতন করতে সক্ষম হয়। অসমর্থিত খবরে জানা যায়, একজন কর্নেলও নাকি নিহত হয়। পরে তারা দোয়াইরা গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

 ১৫ই মেঃ নায়েক সুবেদার ইসহাক এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ৭ মাইল পায়ে হেঁটে খিলপাড়ার পশ্চিমে মইলকার দীঘিরপারে পাক হানাদার বাহিনীর ছোট একটি ছাউনী আক্রমণ করে সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। নায়েক সুবেদার ইসহাক এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দেয়।

 ১৮ই মে, ১৯৭১-সাহেবজাদার পুল ধ্বংসঃ ওয়ালীউল্লাহ মাইন দ্বারা সাহেবজাদার পুলটি ধ্বংস করে লাকসাম-নোয়াখালীর যোগযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

 ১৯শে মে বগাদিয়ায় পুনরায় সংঘর্ষঃ নয়েক আবুল হোসেনকে মাইন বসানোর নির্দেশ দিয়ে গোপনে এ্যামবুশ করে বসে থাকি। সকাল ৯টার সময় ৩জন পাকসেনা বেবী ট্যাক্সি করে লাকসাম যাবার সময় বগাদিয়ায় পৌঁলে পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে বেবীট্যাক্টিটি কয়েক গজ দূরে উড়ে যায় এবং ৩জন খানসেনই নিহত হয়। এ খবর শত্রবাহিনীর কানে পৌছামাত্র এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে আমরা গা-ঢাকা দিই।

 ২৬শে মেঃ সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমন করে ৩০ জন রাজাকারকে হত্যা করে এবং ৬টি রাইফেল উদ্ধার করে।

 ২৮ শে মেঃ পুনরায় সেক্টর কমাণ্ডারের আদেশক্রমে ভারতে কনফারেন্সে যোগ দিয়ে কিছু এ্যামুনিশন নিয়ে আসি।

 ২৯ শে মেঃ মীরের হাট থেকে ১৫ জনের একটি রাজাকার দল আসতে থাকলে হাবিলদার আব্দুল মতিন তাদেরকে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত ১৫ জন রাজাকারই হাবিলদার মতিনের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত

হয়।

সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া

২০-০৭-১৯৭৬

 ২৬শে মার্চ সকাল বেলা আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে একজন নায়েক অপারেটর সিঙ্গারবিলে আসে এবং বলে যে, ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ কুমিল্লাতেও আমাদের লোকজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর পাবার পর আমি আমার লোকজনকে গোপনে ডাকি। কমাণ্ড আমি আমার হাতে নিই, আর কেউ সিনিয়র না থাকাতে। সিদ্ধান্ত নেয়া হল, ৬টা বিওপিতে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরকে আজ রাতের মধ্যে শেষ করতে হবে। পরদিন সকালে খবর পাঠানো হল, সকল বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আখাউড়া সিমেনা হলের সামনে সমবেত হওয়ার জন্য। ২৮শে মার্চ সবাই আখাউড়াতে গিয়ে একত্রিত হয়।

 ২৯শে মার্চ সমস্ত বাঙালী ইপিআর আখাউড়ার জনসাধারণের সাহায্য ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ডব্লিউপিআররা রাতের অন্ধকারে দুটি লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। আখাউড়া থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে জনসাধারণ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। দুইজন লোককে পশ্চিম পাকিস্তানী রাইফেল দিয়ে গুলী করে হত্যা করেছিল। তারপর আমার এক প্লাটুন ইপিআর সেখানে যাওয়াতে তারা স্থানীয় মসজিদে ঢুকে পড়ে। শত্রুর এক সুবেদার ও এক নায়েব সুবেদারসহ ১৪জনকে সেখানে হত্যা করা হয়।

 কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, অয়ারেলস সেট, রেশন আমরা সরিয়ে সিনেমা হলের সামনে স্কুলে নিয়ে আসি। দুইজন হাবিলদারকে নায়েক সুবেদার দিয়ে ৩টা প্লাটুন খাড়া করি এবং আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনসহ ঐ এলাকায় ডিফেন্স তৈরি করি।

 ২রা এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টেললেফোনে আমার সাথে কথা বলেন, তিনি আমাকে একটা প্লাটুন দিয়ে উজানিসার ও আর একটা প্লাটুন দিয়ে গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনে ডিফেন্স করার নির্দেশ দেন। ৪ঠা এপ্রিল দুটি প্লাটুন উল্লিখিত জায়গায় মোতায়েন করা হয়। ৫ই এপ্রিল আমি নিজেও উজানিসার চলে যাই।

 ১২ই এপ্রিল উজানিসার ও গঙ্গাসাগর ব্রীজ আংশিক নষ্ট করে দেয়া হয়-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যাতে কুমিল্লা থেকে সরাসরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসতে না পারে।

 ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিগ্রেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। উজানিসার ব্রীজের হাজার গজ দূর থেকে একটা কোম্পানী থেকে নেমে রাস্তার দুপাশে নালা দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রীজের নিচে আমাদের বাংকার ছিল। শত্রুরা আমাদের কাছাকাছি আসার পর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করা হয়। আমাদের এই আচমকা আক্রমণে তাদের অনেকেই হতাহত হয়। নৌকাতে তারা সমস্ত লাশ বোঝাই করে নিয়েছিল। ঐ নৌকার মাঝি পরে আমাদেরকে বলেছিল যে, একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য ওদের নিহত হয়েছিল।

 তারপর পাকিস্তানী সৈন্যরা পেছনে গিয়ে আর্টিলারী ও মর্টাররের সাহায্যে আমাদের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের কাছে কোন আর্টিলারী বা মর্টার ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের কাছে খবর পাঠানো হয়েছিল আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য। আমাদের লোক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলের কাউকে পায়নি। জনসাধারণ বলেছে যে তারা নাকি আখাউড়ার দিকে চলে গেছে। পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা (আমাদের দুই প্লাটুন সৈন্য) উইথড্র করে আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও আমাদের কোন ডিফেন্স নাই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা উইথড্র করি।

[] উজানিসারে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য গঙ্গাসাগর হয়ে আখাউড়া আসার চেষ্টা করে। আমাদের এক প্লাটুন ইপিআর হাবিলদার আসদ্দর আলীর নেতৃত্বে গঙ্গাসাগর ব্রীজে ডিফেন্স বানিয়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে পৌঁছলে এক প্লাটুন ইপিআর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করে। এই অতর্কিত আক্রমণে (১৫ই এপ্রিল) পাকিস্তানীদের ৩জন অফিসারসহ আনুমানিক ৭০/৭৫জন সৈন্য নিহত হয়েছিল। তিনজন অফিসারের কবর ও সৈন্যদের কবর সেখানে পাওয়া গিয়েছিল। প্লাটুনটির ডিফেন্স দুদিন সেখানে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরাও তাদের ডিফেন্স মজবুত করে। পাকিস্তানী ব্রিগেড কমাণ্ডার ঐ ব্যাটালিয়নকে উইথড্র করে নতুন আর একটা ব্যাটালিয়ন গঙ্গাসাগরে পাঠায় এবং দুই দিনের মধ্যে গঙ্গাসাগরে মুক্তিফৌজদের ডিফেন্স ধ্বংস করে আখাউড়া পৌঁছার নির্দেশ দেয়। পাকিস্থানী সৈন্যরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমাদের ডিফেন্সে চলে আসে। আর্টিলারী ও ৩" মর্টার দিয়ে তারা ওভারহেড ফায়ার অব্যাহত রেখেছিল। ইপিআর মোহাম্মদ সুফি মিয়া তখনও গুলী ছুঁড়ে চলছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংকারে ঢুকে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ল্যান্স নায়েক মোবাশ্বের আলীকেও বাংকারে ঢুকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। ৭ জনকে গুরুতররূপে আহত অবস্থায় আগরতলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৮ই এপ্রিল প্লাটুন-এর অন্যান্য সৈন্য উইথড্র করে আখাউড়া চলে আসে।

 ১৯শে এপ্রিল পুরো ইপিআর কোম্পানীকে ক্লোজ করে আখাউড়ায় একত্রিত করা হয়। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ১টা কোম্পানীও এসেছিল ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীনের নেতৃত্বে।

 ২১শে এপ্রিল ঘয়েরকোট ও ইটনা গ্রামে আমরা মিলিতভাবে ডিফেন্স করি।

 ২২শে এপ্রিল গঙ্গাসাগরে এক গ্রামবুশে আমরা ৬জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করি ও বাইশ হাজার চীনা এ্যামুনিশন উদ্ধার করি ৫টা রাইফেল ও একটা স্টেনগানসহ।

 ২৮শে এপ্রিল আমাদের দুট প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীন আজমপুরে আসার নির্দেশ দেন।

 ১১ই মে আজমপুরে আমরা এক এ্যামবুশ তৈরি করি। পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কোম্পানী সিলেটের মুকুন্দপুর থেকে আজমপুরের দিকে আসছিল। আমাদের দুটি প্লার্টুন নরসিঙ্গর নামক জায়গায় ওদেরকে এ্যামবুম করে। এই এ্যামুবশে তাদের ৬৩জন নিহত হয়।

 ১৩ই মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

 ১৮ই মে এই এলাকায় এক রেইডে ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। একজন আহত সৈন্যকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল।

 ২৭শে মে রাজাপুর এলাকায় এক রেইডে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 ২৯শে মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩১শে মে সিঙ্গারবিলে আর এক এ্যামবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৪ঠা জুন দুটি এ্যামবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় সিঙ্গারবিল এলাকায়।

কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের আরও বিবরণ[]

॥ বড় কামতার যুদ্ধ॥

 বর্ডার পেরিয়ে আগরতলা এসে পৌঁছেছি। তারপর ক'টা দিন কেটে গেছে। মুক্তিবাহিনীর ভাইদের স্বচক্ষে দেখবার জন্য আর তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনাবার জন্য আকুলি-বিকুলি করে মরছিলাম। কিন্তু আমাদের মত লোকদের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি তাদের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। অতিরিক্ত আগ্রহ দেখালে হয়তোবা সন্দেহভাজন হয়ে পড়ব! শুনলাম শহর থেকে মাইল পাচেক দূরে প,বি, হাসপাতালে মুক্তিবাহিনীর দশ-বারো জন আহত যোদ্ধা রয়েছে। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করলে আমাদের মনের আশা মিটতে পারে।

 কিন্তু কাজটা কি এতই সহজ! আমরা যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের লোক নই তারই বা প্রমাণ কি? এখনকার অবস্থায় এই সন্দেহ তো জাগতেই পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেমে দেখলাম, আমাদের খুব বেশী বেগ পেতে হোল না। আমরা যে পরিচয়সূত্রটুকু নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতেই কাজটা সহজ হয়ে গেল। বেলা এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা তাদের মুখে তাদের নানা কাহিনী শুনলাম। আমার মনে হোল তারা যেন প্রথমত কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছিল, পরে কথা বলাবলির মধ্যে দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল।

 সবসুদ্ধ চার জায়গার চারজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমরা আলাপ করেছি। তিনজের সাথে কথা শেষ করে চতুর্থ জনের সঙ্গে কথা শুরু করতেই চমকে উঠলাম। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কোন জায়গায় লড়াই করে জখম হয়েছেন। তিনি উত্তর দিলেন-সে জায়গার নাম বড়কামতা এই কথা শোনার পর আমার চমকে ওঠার কথাই তো। এই তো মাত্র ক'দিন আগে কড়কামতায় এক রাত্রি যাপন করে এসেছি। সে কথা কি এখনই ভুলে যেতে পারি!

 বড়কামতা?

 হ্যাঁ, বড়কামতা। আমার মানসচক্ষে সেই স্বল্পভাষী যুবকটির মুখ ভেসে উঠছিল। আর স্মৃতিপটে ভেসে আসছিল স্খলিত কণ্ঠে বৃদ্ধের সেই ব্যাকুল প্রার্থনা, দুর্গা, দুর্গা। তাহলে আমার সেই এক রাত্রির স্নেহঘন আশ্রয় বড়কামতা গ্রামটিও যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে?

 ওরা কোন তারিখে হামলা করেছিল আর সেই সময় আপনারাইবা সেখান থেকে কতদূরে ছিলেন?

 ওরা হামলা করেছিল ৩০-এ, অর্থাৎ ৩০-এ এপ্রিল তারিখে।

 আমরা ২৫-এ তারিখে প্রথম সেখানে যাই। তার পর থেকে সেখানেই ছিলাম। কি আশ্চর্য কাণ্ড, আর কি অদ্ভুত যোগাযোগ!

 আমি খুব তাড়াতাড়ি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম আমরা চার বন্ধু সেই ২৫-এ এপ্রিল তারিখেই বড়কামতায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। এঁরাও আমাদের কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু আমরা বাইরের লোক, এঁদের কেমন করে জানব।

 আপনার ক'জন ছিলেন?

 আমরা মুক্তিবাহিনীর দশজন লোক সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ ক'টি দিনের মধ্যে ঐ অঞ্চলে আরও পাঁচজন লোককে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলাম বলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়াল পনের।

 এই ক'দিনে বড়কামতার লোকেরা আমাদের, নিজেদের আপন জনের মত গ্রহণ করে নিয়েছিল। আমরা সবাই মিলেমিলে সংসার করছিলাম। আমরা এখান থেকে ওখান থেকে বড় বড় মাছ ধরে আনতাম। কখনো তাঁরা রান্না করতেন, কখনো বা আমরা। কিন্তু খাবার বেলায় সবাই ভাগাভাগি করে খেতাম। কিসের হিন্দু আর কিসের মুসলমান, আমাদের জাত-পাতের বালাই ছিল না।

 উপর থেকে নির্দেশ পেয়ে আমরা ২৯শে এপ্রিল তারিখে চান্দিনার পূর্বদিকে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের একটা পুল উড়িয়ে দিলাম। ক'দিন থেকেই চান্দিনা অঞ্চলে মিলিটারিরা বেশ তোড়জোর চালাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিলাম।  কয়েকদিনের মধ্যে এরা একটা কিছু ঘটাবে সেটা মনে মনে অনুমান করেছিলাম। আমাদের এই ছোট দলটিও সেজন্য তৈরী ছিল। ওরা একটা কিছু অঘটন ঘটালে আমরাও একেবারে চুপ করে থাকব না। ওরা যাই মনে করে থাকুক না কেন, ব্যাপারটা একদম একতরফা হবে না।

 ২৯ তারিখে পুল উড়িয়ে দেবার পর ওরা কোথাও না কোথাও হামলা করবেই। কিন্তু ওদের সেই হামলাটা কোথায় হবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

 কিন্তু এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হোল না। ওরা পরদিন সকালবেলা চারখানা সৈন্য বোঝাই গাড়ি সাজিয়ে এই বড়কামতায় এসে হানা দিল। ওরা কি তবে সন্দেহ করতে পেরেছে যে, আমরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে আছি? কিন্তু তখন বেশী ভাববার সময় ছিল না। ওরা প্রথমেই কতকগুলি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। ওদের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে ষাট। ইতিমধ্যে আমরা মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ওদের দৃষ্টির আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ পজিশন নিয়ে নিয়েছি। ওরা প্রথমেই কোন বাধা না পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাদের ধ্বংসের কাজে এগিয়ে চলেছিল।

 আমরা প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র একই সঙ্গে চারটা গাড়ির উপর ‘ব্রাশ করে চললাম। আমাদের মিলিটারি ভাষায় ‘ব্রাশ” কথার মানে একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলির পর গুলি চালিয়ে যাওয়া। থামিয়ে না দিলে এইভাবে ক্রমান্বয়ে গুলির পর গুলি চলতে থাকে। এই একটানা গুলিবর্ষণের ফলে সৈন্য-বোঝাই চারটা গাড়িই লণ্ডভণ্ড হোতে চলল। আমাদের এই প্রচণ্ড আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ওরা সহ্য করতে না পেরে প্রাণ নিয়ে পালাল।

 ৩০শে এপ্রিলের যুদ্ধের এটা প্রথম পর্ব। এরপরই যে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে যাবে সেটা বুঝতে বেশী বুদ্ধির দরকার করে না। এখানে ক্যাণ্টনমেণ্ট কতই বা দূর। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বটা যে এত তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যাবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। এর এক ঘণ্টা কি দেঢ় ঘণ্টা বাদেই ওরা সৈন্য বোঝাই গাড়ির মিছিল সাজিয়ে চলে এল। ওদের আঠারটা ট্রাক বিকট আওয়াজে পথঘাট কাঁপিয়ে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল। অনুমানে বুঝলাম প্রতিপক্ষ দুশ জনের কম হবে না। ওদের সঙ্গে মর্টার, মেশিনগান, রাইফেল কোন কিছুর অভাব ছিল না। ওরা এবার রীতিমত শিক্ষা দিয়ে যাবে। ওরা এসেই বেশ বড় একটা এলাকাকে ঘেরাও করে ফেলল।

 আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন সেই ঘেরাও-এর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। আমাদের ঘেরাও-এর সুবিধা হচ্ছে এই যে, ওদের আমরা ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এত সমস্ত লোকের ভিড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কোথা মিশে আছে এবং তারা কোথায় কোথায় পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

 বড়কামতা গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ বারুই বা বারুইজীবী শ্রেণীর লোক। সেজন্য গ্রামের এখানে ওখানে বহু পানের বরোজ আছে। এই বরোজগুলো সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এগুলির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারা শত্রদের বেছে বেছে তাক করে মারছিল।

 একটা কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার পাকসৈন্যদের বিরুদ্ধে শুধু যে আমরাই লড়াই করছিলাম তা নয়, গ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। দুএকশ লোক নয়, আমার মনে হয় তাদের সংখ্যা দু-তিন হাজারের কম হবে না। লোকগুলি ক্ষিপ্তের মত ছুটে আসছিল। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম থেকে শুরু করে বন্দুক পর্যন্ত। এই দুঃসাহসী লোকগুলি এই হাতিয়ার নিয়ে মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ছুটে আসছে। এদের উন্মাদ ছাড়া র কি বলা চলে! কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাদের এই উন্মাদনা আমাদের মধ্যে নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে তুলেছিল। ওরা নানারকম জয়ধ্বনি আর বিকট গর্জন করতে করতে ছুটে আসছিল। সেই গর্জন শত্রদের মনেও ভয়ের কপিন জাগিয়ে তুলেছিল। ওরা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে এটা আমরা কখনও আশা করতে পারিনি। অতি সাধারণ মানুষ যে দেশের ডাকে, স্বাধীনতার ডাকে এমন অসাধারণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের আর কখনও হয়নি। এইভাবে ঘণ্টা দুই ধরে দুই পক্ষে যুদ্ধ চলল। আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে শত্রুসৈন্যদের তাক করে করে মারছিলাম। আর এই ক্ষিপ্ত জনতা তাদের যৎসামান্য হাতিয়ার নিয়ে তাদের পক্ষে যেটুকু সম্ভব তা করে চলেছিল। মর্টার গর্জন করছে, বোমা ফাটছে, মেশিনগান চলছে, গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জুলে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওরা যেন ভয় পাবার কথা ভুলেই গেছে। ভয় পেয়ে পালাবে দূরে থাক, ওদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

 এই দুঘণ্টার যুদ্ধে বহু সাধারণ মানুষ মারা গেছে। আমরা যে চারজন ঘেরাও-এর মধ্যে আটকা পড়ে গেছি তাদের মধ্যে দু’জন জখম হয়েছে। এই দুই ঘণ্টার যুদ্ধ ওদের অনেক হিসেবই ভণ্ডুল করে দিয়েছে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষের এই নির্ভীক ও মারমুখো মূর্তি এবং তাদের মুহুর্মুহু গগনভেদী চীৎকারে ওরা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা ওদের কখনও হয়নি। এমন দৃশ্য আমরা কোনদিন দেখিনি।

 শেষ পর্যন্ত আমরাই সেদিন এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। আমাদের সামান্যসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সেদিন যে বীরত্ব ও রণচাতুর্জ দেখিয়েছিল সে কথা হয়তো কেউ কোনদিন জানবে না। কিন্তু এই অঞ্চলের সাধারণ কৃষক জনতা সেদিন যে শক্তি, সাহস আর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিল, আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমরা তা কোনদিন ভুলতে পারব না।

শেষ দৃশ্য। পাকসৈন্যরা রণক্ষেত্র ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পারছে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। তাদের পেছন পেছন ক্ষিপ্ত, উন্মুক্ত জনতা যার যার হাতিয়ার উচিয়ে তাড়া করে চলেছে।

আমার কাছ থেকে বেশ কিছুটা সামনে তিনজন পাঞ্জাবী সৈন্য ওদের অজানা অচেনা পথে ছুটে চলেছে। একমাত্র আমি ছাড়া ওরা যে আর কারও নজরে পড়েনি, এটা ওদের জানা নেই। কেমন করে জানবে? একবার মুখ ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত নেই। আমি সেই সুযোগটাকে ভালভাবেই কাজে লাগালাম। আমি পরপর গুলি করে একজন একজন করে ওদের তিনজনকেই ভূপাতিত করলাম। সামনে গিয়ে দেখলাম, ওদের তিনজের মধ্যে একজন তখনও মরেনি। আমি এক গুলিতেই আমার সেই অসমাপ্ত কাজটিকে সমাপ্ত করে দিলাম।

 এর পরের কাজ ওদের থেকে অস্ত্র নিয়ে নেয়া। সেই অস্ত্র নিয়ে বীর জনতার হাতে তুলে দিলাম। এতক্ষণ বাদে আমার নজরে পড়ল যে, আমি নিজেও অক্ষত নই। এই যে দেখুন, আমার হাতের এই জায়গায় একটা বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এতক্ষণ এত সমস্ত উত্তেজনাকর ঘটনার মধ্যে আমিও তা টের পাইনি। এরপর চিকিৎসার জন্য চলে এলাম এ হাসপাতালে।

 যিনি এতক্ষণ এ কথা বলছিলেন, তিনি বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন সুবেদার। এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। তার কথা বুঝলাম বড়কামতার যুদ্ধের ঐখানেই পরিসমাপ্তি।

 কিন্তু আমার বোঝাটা যে কত বড় ভুল বোঝা সেটা বুঝলাম আরও কয়েকদিন বাদে। এবারকার এই পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায় চলতে চলতে কি আশ্চর্যভাবে আর কি অপ্রত্যাশিতভাবে কতরকম লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে! একজনের মুখে শোনা অসম্পূর্ণ কাহিনী কি বিচিত্রভাবে আর একজন এসে সম্পূর্ণ করে দিয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন হঠাৎ চান্দিনা কৃষক সমিতির আমার এক পরিচিত সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার মুখে শুনলাম, এই বড়কামতার যুদ্ধে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, তারা নিজেরাও ভালভাবেই জড়িত ছিলেন।   ৩০শে এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন দ্বিতীয়বার বড়কামতা আক্রমণ করল তখন শুধু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারাই তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করেনি, বহু সাধারণ মানুষ সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল, এ কথা আমরা সেই মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধার মুখে আগেই শুনেছিলাম। আমাদের চান্দিনার সেই পরিচিত কৃষক কর্মটির মুখে শুনলাম প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার কৃষক সেদিন এ লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল।

 পরদিন ১লা মে তারিখে গতদিনের পরাজয়ের ঝাল মেটাবার জন্য সকাল দশটায় প্রায় হাজারখানেক পাকসেনা পুনরায় এই অঞ্চলে আসে। গতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর বেশ বড় রকমের ঘাঁটি রয়েছে। তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সঙ্কল্প নিয়ে তারা বেশ বড়রকমের প্রস্ততি নিয়ে এখানে এসে হামলা করল। তারা চান্দিনার দুই মাইল পূর্বে কোরপাই থেকে আরম্ভ করে চান্দিনার এক মাইল পশ্চিমে হাটখোলা পর্যন্ত সমস্ত পাকা রাস্তায় পজিশন নেয়। তাছাড়া কিছু দূরে মেশিনগান ও কামান পেতে রাখে। তিন-চার শ” পাকসেনা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে এবং বাড়িগুলি আগুন দিয়ে জুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা তখন ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে হামলাকারীরা বুঝতে পারল যে, তাদের হাতের শিকার ফসকে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চারদিককার গ্রামবাসীদের উপর মনের ঝাল মিটিয়ে এই রক্তখাদক মানুষশিকারীর দল তাদের ক্যাণ্টনমেণ্টে ফিরে চলে গেল।

॥মুক্তিযুদ্ধে ফেনী॥

 এপ্রিলের প্রথমভাগেই নোয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক ও নায়ক। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও ই-পি-আর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, সাধারণ মানুষ-এরা সবাই এই বাহিনীতে সামিল হয়েছিল। হাতিয়ার বলতে এদের কিছু রাইফেল আর বন্দুক। তাছাড়া বর্শা, বল্লম, লাঠিসোটা ইত্যাদিও ছিল। এই অস্ত্র সম্বল করে, সবকিছু জেনেশুনেও তারা কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তৈরি হয়েছিল। তখন তারা ভাবতেও পারেনি যে, এর চেয়েও মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে ওরা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু যখন সে সময় এর, তখন তাতেও পিছ-পা হয়নি তারা।

 মুক্তিবাহিনী প্রস্ততি নেবার জন্য বেশী সময় পায়নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই আক্রমণকারী পাক-সৈন্যের একটি দল ফেনী শহর দখল করার জন্য মার্চ করে এগিয়ে এল। কিন্তু কাজটাকে যত সহজ বলে মনে করেছিল তা-ঠিক নয়, কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। ওরা ফেনী শহরে এসে পৌছবার আগেই মুক্তিবাহিনী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। যাকে বলে মুখোমুখি লড়াই তা নয়, মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা নিজেদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রপক্ষকে এমনভাবে অস্থির করে তুলল যে, শেষ পর্যন্ত ওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছনে হটে যেতে বাধ্য হোল। এই গেল প্রথম রাউণ্ড। কিন্তু প্রথম রাউণ্ডেই জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হোল না। এরপর দু'পক্ষের মধ্যে পরপর কয়েকবার সংঘর্ষ ঘটল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে আক্রমণকারীদের মুখ চুন হয়ে গেল। এই দুর্গম পথে, এই জীবনপণ করা দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়, তা করতে গেলে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মত স্থলপথে আক্রমণের কাজটা স্থগিত রাখল।

 এইভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ মেজর জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একথা ভালভাবেই জানতেন, যুদ্ধের এইখানে ইতি নয়, সূচনা মাত্র। ওরা শীঘ্রই শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে আসবে। আত্মসন্তষ্টির অবকাশ নেই, এবার প্রবলতর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সেজন্য ভয় করলে চলবে না। শক্রযতই প্রবল হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হবে, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃঢসংকল্প গ্রহণ করেছে। ফেনী শহর ও নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লাঠির ঘায়ে পিছিয়ে গিয়ে জঙ্গীবাহিনীর নেতারা ফেনী শহরকে আক্রমণ করার জন্য এবার এক নতুন পরিকল্পনা তৈরী করল।

 এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ। একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে দুটো বিমান প্রচণ্ড গর্জন তুলে সারা শহরটাকে প্রদক্ষিণ করে চলল। ওরা শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই আসেনি, বোমারু বিমান দুটো ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তর উপর বোমা ফেলে চলেছে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সাধারণ মানুষ এমন একটা আকস্মিক ঘটনার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিল না। তারা উদভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। কিছু কিছু লোক হতাহতও হোল। এইভাবে কিছুক্ষণ বোমা ফেলে বিস্ফোরণ ঘটাবার পর সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবগুলি স্বস্থানে ফিরে গেল।

 পরদিন আবার ওরা এল। এসেই আগেকার দিনের মতই বোমা ফেলে চলল। কিন্তু একটি দিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শহরের সাধারণ মানুষ অনেক বেশী সাহস সঞ্চয় করেছে। বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে কি করে আত্মরক্ষা করতে হয়, সেই কৌশলটাও তারা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারা দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত ছুটোছুটি করছিল না, অথবা বহু লোক এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে ওদের হাতে আক্রমণের সুযোগ তুলে দিচ্ছিল না, তারা ঠাণ্ডা মাথায় আত্মরক্ষা করে চলেছিল। আর মুক্তিযোদ্ধারা? মুক্তিযোদ্ধারা কি করছিল?

 সেই ধ্বংশলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেজর জিয়া নির্ভীক কণ্ঠে হেঁকে উঠলেন, মুক্তিবাহিনীর জওয়ান ভাইরা, আমরা মরবার জন্য তৈরী হয়েই দুস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, তবে আর আমাদের ভয় কি! কুছপরওয়া নেই, আমরা ঐ বিমান দুটোকে পাল্টা আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে ছাড়ব।

 মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মিতকণ্ঠে প্রশ্ন করল, আমাদের হাতে তো এণ্টিএয়ারক্র্যাফট কামান নেই, আমরা কেমন করে এই বিমানগুলিকে ধ্বংশ করব?

 হ্যাঁ, এণ্টিএয়ারক্র্যাফ্ট থাকলে আমরা আগেই ওদের দফা রফা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নাই-বা থাকল তা, আমাদের রাইফেল তো আছে। এই রাইফেল দিয়েই আমরা ওদের এমন শিক্ষা দেব, যা ওরা কোন দিন ভুলতে পারবে না। জওয়ান ভাইসব, শহরে যে-সমস্ত উঁচু দালান আছে, তাদের উপর উঠে ওদের তাক করে গুলি চালাতে থাক। ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা এইভাবে শত শত মার্কিন জঙ্গী বিমান ফেলে দিয়েছে, আমরাই বা কেন পারব না? এক মুহূর্ত দেরী নয়, জওয়ান ভাইরা, ছুটে চল সবাই।

 শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, মেজর জিয়া সবার আগে নিজেই রাইফেল বাগিয়ে ছুটলেন। রাইফেলধারী যোদ্ধারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছুটতে ছুটতে শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলির ছাদে গিয়ে উঠ পড়ল। এই দালানগুলি যেকোন সময় বোমার আগাতে ধসে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেজন্য মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, বিন্দুমাত্র ভয় নেই। সবাই একমনে বিমান দুটোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে চলেছে। তাদের এভাবে আক্রান্ত হতে হবে, বিমান চালকরা একথা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাইফেলের নাগালের ভেতরে এসে গিয়েছিল। তারা জানত যে, সে ক্ষেত্রে তারাই শুধু আক্রমনকারী। কিন্তু তারাও যে আক্রান্ত হতে পারে, এটা তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা দালানের ছাদের উপর থেকে পায় একই সঙ্গে এক ঝাঁক রাইফেলের গুলি ছুটল। আর একই সঙ্গে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। জলন্ত বিমানটার অবস্থা দেখে অপর বিমানটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, দেখতে দেখতে আকাশপথে মিলিয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ বিমানটা উল্কার মত জ্বলতে জ্বলতে পূর্বদিকে ছুটল। ওটা একটু বাদেই জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।, পরে জানা গিয়েছিল, জ্বলন্ত বিমানটার ধ্বংসাবশেষ ত্রিপুরার সীমান্তে গিয়ে পড়েছিল।  জয়, মুক্তিবাহিনীর জয়! জয়, স্বাধীন বাংলা জয়! বিজয়গর্বে উদ্দীপ্ত হাজার হাজার জনতার জয়ধ্বনিতে ফেনী শহর মুখরিত হয়ে উঠল। সবাই মেতে উঠল উৎসবে। মুক্তনগরীর বুকে স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছিল।

॥ চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধ॥

 মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান-বোঝাই একদল পাকসৈন্য ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে চোখ পড়েছে, তখন ওরা সেখানে লুটপাট না করে ছাড়বে না। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লুৎফর রহমান, যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাট জনের মত হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ খবর করে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাদের জড় করা গেল।

 সাতজন মানুষ সাতটি রাইফেল। এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যা নয়, এটা একটা দুঃসাহসের কাজই হবে। অথচ হাতে, সময় নেই, মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে-সময়ের প্রয়োজন, তার মধ্যে এই লুণ্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে, আর তারা বসে বসে তাই দেখবে? না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলের সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষতভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারে না। ওরা আমাদের অনেক রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরকেও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।

 রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন করে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো তোলা হয় নি, ইটগুলি যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। চন্দ্রগঞ্জে ঢুকতে হলে সৈন্যবাহী গাড়ীগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেরন। এখানে থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দুঃসাহসের কাজ। তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলেছেন। কিন্তু এমন এক একটা সময় আসে যখন জেনেশুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থাবিশেষে বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর নায়েক সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা।

 কিন্তু বেশি কথা বলার সময় ছিল না। দূরে থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। ঐ যে, ঐ যে আসছে ওরা! তাঁরা সাতজন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্ফুট থেকে স্ফুটতর হয়ে উঠতে লাগল। তারপর একটু বাদেই দেখা গেল সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেন ইস্পাতের মত দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এল।

 সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে হঠাৎ থেমে গেল। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নেই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী-প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আর শান্তি ফিরে এল।  সৈন্যরা সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। অদৃশ্য শত্রুরা কি তবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? না, ওদের বিশ্বাস নেই, একটু বাদেই হয়তো ওরা আরেক দিক থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তার দু'পাশে অনেক ঝোপঝাড়-জঙ্গল। তাদের মাঝখানে ওরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছে কে জানে! তবে দলে ওরা ভারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে এমন করে হামলা করতে সাহস পেত না।

 চন্দ্রগঞ্জ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে এসে অবাধে লুটপাট করা যাবে, এই আশা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল। এই অঞ্চলে তাদের একজন জামাতে ইসলামপন্থী দালাল ছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা লুটের আশায় এখানে ছুটে এসেছে। তারা শুনেছিল এখানে তাদের 'বাধা দেবার মত কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ কে জানে কোথা থেকে এই শয়তানের দল মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে! কে জানে, হয়তো ওরা ইতিমধ্যে তাদের চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে! প্রতি গাছ আর প্রতিটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যে একজন করে শত্রু লুকিয়ে নেই এমন কথাই বা কে বলতে পারে! ওদের রাইফেলগুলি এইভাবে বহু গলি অপচয় করার পর থামল।

 কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেল। সৈন্যরা ভাবছিল, তাদের অদৃশ্য শত্রুরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে। এমন প্রবল গুলিবৃষ্টির সামনে ওরা কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে! কিন্তু তাহলেও ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করা দরকার। এবার বেশ হুঁশিয়ার হয়ে এগুতে হবে। যারা হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিয়েছে, ওরা তাদের একজন একজন করে ভ্যানের উপর তুলছিল। ঠিক সে সময়ে আবার কতকগুলি রাইফেল একসঙ্গে গর্জে উঠল। গুলির পর গুলি আসছে বিরতি নেই। সৈন্যদের মধ্যে এক অংশ আছে ভ্যানের উপরে, অপর অংশ রাস্তায়। অদৃশ্য হস্তগলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। একটি গুলিও বৃথা যাচ্ছে না সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হট্টগোল পড়ে গেল। তারা একটু সামলে নিয়ে আবার প্রবলভাবে গুলিবর্ষণ করে চলল। কিন্তু তাদের সামনে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। এইভাবে কিছুক্ষণ দুপক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা চলল। ইতিমধ্যে সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অপর পক্ষে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না।

 অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সৈন্যরা। কিন্তু একটু আগেই তাদের দালাল, জামাতে ইসলামীপন্থী সেই লোকটি, তাদের সাহায্যে করবার জন্য এসে গেছে। সে অত্যন্ত চতুর লোক, চারদিকে ভালভাবে নজর করে সে এই রহস্যটা বুঝতে পারল! দূরবর্তী ইটের পাঁজাটার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে সে বলল, আমার সন্দেহ হয়, ওরা ঐ পাঁজাটার পেছনে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কথাই তো, এই সন্দেহটা সকলের মনেই জাগা উচিত ছিল কিন্তু এতক্ষণ এই কথাটা ওদের কারও মাথায় আসেনি।

 এবার ওদের রাইফেলগুলি একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। সৈন্যরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পণে তিন দিক দিয়ে এগিয়ে চলল। ইটের স্তূপটাকে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। খুব সাবধান, ওদের একটাও যেন সরে পড়তে না পারে।

 মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা ইটের পাঁজার আড়াল থেকে সবকিছুই দেখছিল। সৈন্যদের মতলব বুঝতে তাদের বাকী রইল না।

 আর এক মুহূর্তে দেরী করার সময় নেই। এখনই তাদের সরে পড়তে হবে। এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে তারা যতটা আশা করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ হাসিল করতে পেরেছে। এবার তারা স্বচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারে। একজন একজন করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কিছুটা বাদে শিকার-সন্ধানী সৈন্যরা এসে সাফল্যের সঙ্গে সেই ইটের স্তূপটাকে ঘেরাও করে ফেলল। কিন্তু কি দেখল এসে? দেখল, পাখিগুলি তাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে চলে গিয়েছে। ইটের পাঁজার পেছনে একটি জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটর উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

 সেদিনকার যুদ্ধে সবসুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর জওয়ান সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্যে করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকেও খতম করল।

 সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ঘা খেয়ে পাকসৈন্যদের চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। চন্দ্রগঞ্জে লুটপাট করা দূরে থাক, হতাহত বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি বোঝাই করে ওরা মাথা হেট করে ফিরে এসেছিল কিন্তু এই অপমান আর লাঞ্ছনা ওরা ভুলে যেতে পারেনি। দিন কয়েক বাদে ওরা আবার নতুনভাবে তৈরী হয়ে চলল চন্দ্রগঞ্জের দিকে। তাদের মনের জ্বালাটা এবার ভাল করেই মিটিয়ে নেবে।

 পাকসৈন্যরা আবার হামলা করতে আসছে, এই খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল চন্দ্রগঞ্জে। সুবেদার লুৎফর রহমান এখন সেখানে নেই, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ নেই। এবার কে তাদের প্রতিরোধ করবে? ওরা সেদিন আচ্ছামত ঘা খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে, এবার ভাল করেই তার প্রতিশোধ তুলবে। চন্দ্রগঞ্জকে এবার ওরা ধ্বংশস্তুপে পরিণত না করে ছাড়বে না। যাকে পাবে তাকেই মারবে। ওদের হাতে কেউ কি রেহাই পাবে? সারা অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চন্দ্রগঞ্জের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। ওরা ওদের যা করবার বিনা বাধায় করা যাবে।

 কিন্তু চন্দ্রগঞ্জের একটি মানুষ এই কথাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন তিনি, এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। আর যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাব, একাই গিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করব।

 কে এই লোকটি? কি তাঁর নাম? না, তাঁর নাম আমার জানা নেই। কোন খ্যাতনামা লোক নন তিনি। একজন বৃদ্ধ প্রাক্তন সৈনিক। আর দশজন বৃদ্ধের মত তিনিও তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষ। কেউ কোনদিন তাঁর কোন অসাধারণত্বের পরিচয় পায়নি। কিন্তু আজ দেশের এক বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ অনুকূল মুহুর্তে তাঁর ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে জাগিয়ে তুলিছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে অস্থির সেখানে এই একটি মানুষ দৃঢ় নিষ্কম্প কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি একা যেতে হয়, আমি একাই যাব, আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করব। মরবার আগে এই হিংস্র পশুগুলির মধ্যে একটাকেও যদি মেরে যেতে পারি, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।

 যারা তাঁর হিতৈষী, তারা তাঁকে নিবৃত্ত করবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, তুমি একা মানুষ, তার উপরে বুড়ো হয়েছ, তুমি কি করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবে? কিন্তু কারও কোন বাধা তিনি মানলেন না, দৃঢ় মুষ্টিতে রাইফলটা আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। তাঁর এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর তরুণ ছেলে তাঁকে ডেকে বলল, দাঁড়াও আব্বা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তোমার মত আমিও ওদের সঙ্গে লড়াই করব। ছেলের কথা শুনে বাপের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুজনের হাতে দুটি রাইফেল পিতাপুত্র পাশাপাশি প্রতিরোধ সংগ্রামে যাত্রা করল।

 আজও ওরা সেই ইটের পাঁজার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা পিতা-পুত্র পাশাপাশি বসে শত্রুদের আগমনের জন্য অধীর চিত্তে প্রতিক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে দূর থেকে মোটর ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। হ্যাঁ, এইবার ওরা আসছে। দেখতে দেখতে সৈন্যবাহী গাড়ি একেবারে কাছে এসে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে অনেকের কাছেই এই ইটের পাঁজাটি সুপরিচিত। ঐটিকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়, কিন্তু আজও যে কেউ তাদের আক্রমণ করবার জন্য এর আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে থাকতে পারে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাবেত না পারা স্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ওরা এই স্তুপটার বরাবর আসতেই পর পর তিনজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, কে বা কারা তাদের লক্ষ্য করে স্তপটার আড়াল থেকে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যরা এর পাল্টা জবাব দিল। ইটের পাঁজাটাকে লক্ষ করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ চলল। এরপর সেই স্তপের পেছন থেকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা গেল না। সৈন্যরা একটু সময় অপেক্ষা করল, তারপর ছুটে গেল স্তূপটার সামনে। উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে ধরে যখন তারা পায়ে পায়ে সেই স্তূপটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখতে পেল, সেখানে এক বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে। কিন্তু অস্ত্র বলতে কোন কিছু সেখানে নেই, শুধু কয়েকটা কার্তুজের খোল পড়ে আছে। ওরা বুঝল, এই বৃদ্ধের সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছে।

॥ সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন॥

 চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর রহমান নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলেছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তেও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাকসৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারীর মত তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলেছে।

 এপ্রিলের শেষ ভাগ। খবর এল একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছবে। লুৎফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হোল, ওদের বিনা বাধায় এগুতে দেওয়া হবে না, সোনাইমুড়ি স্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেলস্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সেজন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফস্কে যতে দেওয়া চলবে না।

 কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের মত সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবে না। এবার আর আগেকার মত আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ বলবে দিবালোকে প্রকাশ্যে, মুখোমুখি। ওদের সৈন্যসংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাইমুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে, সৈন্যদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেকটা বেশী। তাহোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

 নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্যবাহী ট্রেনটা সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোন একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌঁছবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ির ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। ড্রাইভার ইঞ্জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল। ফলে ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।

 প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাকসৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর ঘটনাটা এমন দ্রুত ঘটে গেল যে একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্ধ হয়ে রইল। প্ল্যাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ দিতে হল।

 এবার দু'পক্ষ শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপরে এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এই লড়াই চলল। এই যুদ্ধে পঁয়ত্রিশজনের মত পাকসৈন্য নিহত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছয়জন শহীদ হলেন।

 ইতিমধ্যে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পেয়ে ঘণ্টা তিনেক বাদে আক্রান্ত পাক-সৈন্যদের সাহায্য করবার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছল। এবার পাক-সৈন্যদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল আড়াইশতের উপর। হতাহতদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশ-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মাত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভুল কখনও করে না। তারা যেমন বিদ্যুৎ গতিতে এসে আক্রমণ করেছিল, তেমনিভাবেই ঘটনাস্থল থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পাকসৈন্যরা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হল।


  1. খালেদ মোশারফ একাত্তরের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টে সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড হিসাবে মেজর পদে ছিলেন।
  2. ১৯৭১ সালের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  3. ১৯৭১ সালে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  4. ১৯৭১ সালের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একডেমীর দলিলপত্র থেকে সংর্কত।
  5. ১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে লেফটেন্যাণ্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বংল একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  6. বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।
  7. বাংলা একডেমীর দক্ষিণত্র থেকে সংকলিত
  8. সত্যের সেন রচিত 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ', কলিকাত, আগস্ট ১৯৭১ থেকে সংকলিত।