বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড)/৫

উইকিসংকলন থেকে

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ময়মনসিংহ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র …………………১৯৭১

ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য স্থানের প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার এ,কে,এম ফরিদউদ্দিন

১০-১-১৯৭৫

 বিগত ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি আমার ইপিআর-এর ‘সি’ কোম্পানীসহ ২নং উইং হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহে ছিলাম।

 ২৫শে মার্চ তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগ, টিক্কা খানের রেডিও ভাষন ও আদেশ এবং পাক সামরিক বাহিনীর পিলখানা, রাজারবাগ আক্রমনের খবর ময়মনসিংহে পৌছার সাথে সাথে ময়মনসিংহের ইপিআর-এর বাঙ্গালী যুবকরা তাদের ভবিষ্যৎ বুঝিতে পারে। অন্য দিকে তৎকালীন ২নং ইপিআর উইং-এর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের জোয়ানদিগকে আরাম করার আদেশ হইতে পরিস্থিতি আরও পরিস্কার হইয়া উঠে যে বাঙ্গালীদের ভাগ্যকাশে ঘনঘটার ছায়া জুরিয়া বসিয়াছে।

 ২৭-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আমাকে অফিসে ডাকাইয়া আদেশ দেন যে,আপনারা প্রায় এক মাস যাবৎ স্ট্যাণ্ডবাই ডিউটি করিতেছেন, এখন স্ট্যাণ্ডডাউন করিয়া আরাম করেন। তাহাতে আমি তার সাথে একমত না হওয়ায় দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ঐ সময় একটি জীপে করিয়া বেশ কিছু এম্যুনিশন ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় নিয়া যাওয়ার সময় আমার মনের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যে, আমাদের উপর হামলা হইবে। তারপর আমি উইং হেডকোয়ার্টারের কয়েকজন বাঙ্গালী এনসিও, যথা হাবিলদার আরিফ, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার আহাম্মদ মিয়া ও হাবিলদার আঃ হাকিমকে নিয়া একটি গোপন বৈঠক করিয়া সিদ্ধান্ত নিই যে, হাতিয়ার দেব না। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কোত হইতে হাতিয়ার এম্যুনিশন আরও যাহা ছিল বাহির করিয়া জোয়ানদের মধ্যে বিতরন করিয়া দেই এবং যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য হুকুম দিই। সমস্ত বাঙ্গালী জোয়ানরা নতুন করিয়া শপথ নিয়া মরণ পর্যন্ত হাতিয়ার দিবে না বলিয়া আমাকে আশ্বাস দেয়।

 সারা দিন দুই পক্ষের লোকদের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। ইতিমধ্যে অবাঙ্গালী ফোর্স, যাহাদের মধ্যে ইপিআর, এয়ার ফোর্স, জিডি ট্রুপস, আর্মি সিগন্যাল, মুজাহিদ ইন্সট্রাক্টর এবং আর্মি সিকিউরিটি মিলিয়া প্রায় ১৩৮জন ছিল। তাহারা একটা গোপন বৈঠক করে। ইহার খবর পাইয়া বিকাল অনুমান ৪টার দিকে আমি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ‘সি’ কোম্পানী, যাহা খাগড়হর ইপিআর ক্যাম্পে ছিল, তাহার কমাণ্ডার তৎকালীন মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করি। সমস্ত গোপনীয় সংবাদ, যাহা আমার জানা ছিল, তাহাকে অবগত করাই এবং আগে আমাদের এ্যকশনের জন্য পরামর্শ করি এবং তাঁহার সহযোগীতা কামনা করি। তারপর অনুমান সাড়ে ছয়টার সময় ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে সাথে নিয়া আসিয়া আমার বাঙ্গালীদিগকে ফল-ইন করিতে হুকুম দেন, কিন্তু আমি অল্প কিছু লোক যাহারা সামনে ছিল তাহাদেরকে একত্র করিয়া মেজর সাহেবকে আলাপ করিতে দেই। মেজর সাহেব বলেন যে একটি কোম্পানী বা একটি উইং কি করিয়া পাক আর্মির বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিতে পারে বা বাঁচার জন্য তৈরী হইতে পারে? যাহোক, মেজর সাহেব আমাদেরকে অভয় দেন যে কোন বিপদ হবে না, ভুল চিন্তা করিবেন না। কিন্তু ঐ সময় আমি দেখিতে পাই যে, অবাঙ্গালী ২০/২৫ জন মুজাহিদ কোতে ঢুকিয়া ডিউটি শুরু করিয়াছে। অন্য দিকে, তাহাদের কিছু জেসিও মেসে, কিছু অফিসের ভিতর, কিছু ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় এবং অন্যদিকে ২৫/৩০ জনের একটি গ্রুপ পেট্রোল ডিউটি আরম্ভ করিয়াছে। তখন কয়েকজন বাঙ্গালী জোয়ান দৌড়াইয়া আমার নিকট আসিয়া বলে যে, আমরা কি করিব। অবস্থা খুবই খারাপ দেখিয়া আমি ওদেরকে নিজের জায়গায় থাকিতে আদেশ দেই এবং যে কোন মূল্যে কোয়ার্টার গার্ড নিজেদের আয়ত্বে রাখিতে আদেশ দেই।

 অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানী যাহা পুকুর পারে ছিল তাহাদের মধ্যে নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেনকে (দুই জনই বাঙ্গালী) ডাকাইয়া অবস্থা তাহাদেরকে জানাই এবং তাহাদের মনোভাব অতি সতর্কতার সহিত অনুভব করি,যেহুতু তাহারাও আর্মি। এই ভাবে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় আমি পরিষ্কার বুঝিতে পারি যে আমাদের উপর হামলা হইবে। তাই আমি পরিস্থিতি সম্বন্ধে মেজর নূরুল ইসলামকে ডাক বাংলোয় খবর পাঠাই। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়ার আগেই রাত্রি প্রায়সাড়ে এগারটার সময় অবাঙ্গালীদের তরফ হইতে প্রথম ফায়ার আসে যাহাতে বাঙ্গালী একজন জোয়ান আহত হয়। অমনি দুই দিক হইতে তুমুলভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুরু হয়। এই যুদ্ধে ২৭ তারিখ রাত্রি সাড়ে এগারটা হইতে পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত ছিল। ইপিআর হেডকোয়ার্টারের দুই দিকের আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে সারা ময়মনসিংহ কাপিয়া উঠে। এই দীর্ঘ আঠার ঘণ্টার যুদ্ধে বাঙ্গালীরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২২০ জন আর অবাঙ্গালীরা ছিল ১৩৮ জন। সারারাত যুদ্ধ চলে। সকালের দিকে শহর ও গ্রাম হইতে প্রায় ১০/১৫ হাজার বাঙ্গালী সিভিল লোক বাঙ্গালীদেরকে খাবার, পানীয় ও অন্যান্য যথাসম্ভব সাহায্য করে। অবাঙ্গালীদের মধ্য হইতে ১২১ জন মারা যায় এবং বাকী সতের জন আমার নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। যাহারা আত্মসমর্পণ করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে সুবেদার মেজর জিন্নত খাঁ, নায়েক সুবেদার বোস্তান খাঁ, নায়েক সুবেদার খান বাহাদুর, হাবিলদার গোলাম হায়দার, হাবিলদার নাজির বাদশাহ প্রমুখ ছিল। যাহারা মারা যায় তাহাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস, একজন এয়ারফোর্সের অফিসারও ছিল।

 প্রকাশ থাকে যে, আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে উক্ত উইং- এর অধীনে বর্ডারে থাকা কোম্পানীগুলিকে একটি অয়ারলেস মেসেজ দ্বারা হেডকোয়ার্টারের পরিস্থিতি জানাই। (১) কোম্পানীগুলি ছিল সুবেদার হাকিম সাহেবের সাথে নকশী, (২) সুবেদার জিয়াউল হক সাহেবের সাথে করইতলী এবং (৩) সুবেদার আজিজুল হকের সাথে লেংগুরায়। আমি মেসেজে তাহাদেরকেও জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানাই, যাহা তাহারা করেন।

 এই যুদ্ধের পর আমি মোজাহিদ অস্ত্রাগার দখল করি এবং কোতে থাকা ১৪৭২টা রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বেশ কিছু স্টেনগান, এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, প্রায় ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি এবং আরও যুদ্ধসরঞ্জাম দখল করি, যাহা পরে তৎকালীন মেজর বর্তমানে মেজর জেনারেল কে,এম,শফিউল্লাহ সাহেবকে দেই।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সি-কোম্পানীর সাহায্য আমি চাহিলে সিনিয়র জেসিও বড়ুয়া বলেন যে মেজর সাহেবের বিনা হুকুমে সে আমাকে সাহায্য করিতে পারিবেনা। তারপর নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেন সকাল প্রায় নয়টার দিকে কিছু লোক নিয়া আমার সাথে যোগ দেয়, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর আবার বিরত হইয়া যায়। অন্যদিকে মেজর নূরুল ইসলাম, তার সঙ্গী লেফটেন্যাণ্ট মান্নান সাহেবের কোন খোজ পাওয়া যায় নাই। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টার দিকে যখন আমি উইং-এর লোকেশন বদলী করার জন্য পুলিশ লাইনের ভিতর দিয়া যাইতে ছিলাম তখন আমার ৪/৫ জন লোক মেজর সাহেবকে আমার সঙ্গে ঐ জায়গায় দেখা করাইলে জানিতে পারি যে মেজর সাহেব ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে চলিয়া গিয়াছিলেন। আমি মেজর সাহেবকে ঘটনা পুরাপুরি বলিলে তিনি আমাকে বলেন যে, তাহার ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে 'অয়ারলেসে আলাপ করার পর আবার আমার সঙ্গে দেখা করিবেন।

 রাত্রিতেই আমি পুলিশ, সিভিল ও আওয়ামী লীগের লোকজনের সাহায্যে আমার উইং-এর লোকেশন বদলী করিয়া রাবেয়া হাই স্কুলে নিয়া যাই, কারন আমি অনুমান করি যে পরের দিন পাক বাহিনী খবর পাইলে হয়তো কোন এয়ার এ্যাকশন নিতে পারে। সিভিল লোকদের মধ্যে যাহারা অগ্রভাগে কাজ করিয়া আমাকে সাহায্য করেন তাহাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন এম-এন-এ (বর্তমান আওয়ামীলীগের ভাইস প্রেসিডেণ্ট) জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়া, বর্তমানে লণ্ডনে এ্যাম্বাসেডর জনাব সৈয়দ সুলতান সাহেব, বর্তমান এমপি হাতেম আলী তালুকদার সাহেব প্রমুখ।

 পরের দিন ২৯-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা আমি রাবেয়া হাইস্কুলে ইপিআর-এর লোক সহ বাংলাদেশ পতাকাকে গার্ড অব অনারের সাথে সালাম দিয়া পতাকা ছুঁইয়া নতুন করিয়া শপথ নিই যে আমরণ যুদ্ধ করিব। উল্লেখযোগ্য যে, পতাকা তুলিয়াছিল হাবিলদার নিয়াজ। কারণ এখন আর গত্যন্তর নাই। অনুমান বেলা ১১টার দিকে যখন আমি খাগডহর-এর দিকে যাচ্ছিলাম নতুন বাজারের মোড়ে একজন লোক সাদা পোশাকে আমাকে পরিচয় দেয় যে তিনি বেলুচ রেজিমেণ্টের একজন বাঙ্গালী ক্যাপ্টেন এবং আমার সঙ্গে যোগ দিতে চান। কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করিতে না পারায় পরে দেখা করিতে বলি, কারন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। একটু পরেই মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন যে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহের ইপিআর-এর যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি। তাহারা বৈকালের দিকে ময়মনসিংহে পৌঁছাইতেছে যাহাতে কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার রহিয়াছেন।

 সন্ধ্যার পর ২য় বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে একত্রিত হয়। এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ লিডারসহ একটি গোপন বৈঠক করিয়া ময়মনসিংহের প্রতিরক্ষা এবং ঢাকা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি নকশী কোম্পানীকে জামালপুরের দায়িত্বে, করইতলা কোম্পানীকে সদর পশ্চিম দিকের দায়িত্বে এবং লেংগুরা কোম্পানীকে সদর দক্ষিণ দিকের দায়িত্বে দিয়া আমার হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ও উইং হেডকোয়ার্টারসহ নরসিংদী হইয়া ঢাকার পূর্বদিক দিয়া আক্রমণ চালাইবার সিদ্ধান্ত নিই।

 ৩০-৩-৭১ তারিখে মেজর শফিউল্লাহ সকাল ৮ ঘটিকার সময় আমার ইপিআর ফোর্সের সাথে রাবেয়া হাইস্কুলে আলাপ করেন এবং তাহাদেরকে ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার জন্য বলেন। ঐ দিন ঐ সময়ই আমি আমার নিকট ক্যাপচার করা ১৪৭০টি রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বহু স্টেনগান, এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি ইত্যাদি তাহার নিকট হস্তান্তর করি। অন্যদিকে, বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন (বর্তমান লেঃ কর্ণেল) নাসিম সাহেবের নেতৃত্বে ট্রেনে ভৈরব হইয়া ঢাকার পথে রওনা দিই। বেলা সাড়ে বারটার সময় এই স্পেশাল ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশন ত্যাগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমাদের দলে যোগ দেন। রাত্রি প্রায় ১১টার দিকে ভৈরব পৌঁছালে ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তাহার কোম্পানী সহ ভৈরব স্টেশনে নামিয়া যাইতে থাকিলে আমি তাকে বলি যে, ঢাকা যাইবেন না? তিনি উত্তরে বলেন যে, সকালবেলা একটা কোম্পানী আপনি নরসিংদীতে পাবেন। আপনি গিয়া আগের দিকে ব্যবস্থা করেন।

 আমরা সকালের দিকে নরসিংদীতে পৌঁছাইয়া সড়ক পথে ঢাকার দিকে রওনা হই। কিন্তু ডেমরা ঘাট পাক ফোর্সের দখলে জানিতে পারিয়া পাঁচ দোনা বাজার হইতে আমরা ঢাকা শহরের প্রায় ১২ মাইল দূরে ভাঙ্গা নামক স্থানে জঙ্গলে শীতালক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সন্ধ্যার পর অবস্থান নিই। এই ঘটনা ৩১-৩-৭১ তারিখের। এখানে আলীজান জুট মিলের ম্যানেজার জনাব মিজানুর রহমান সাহেবের নিকট হইতে আমরা খুব সাহায্য পাই।

 এদিকে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন সাইগলের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে নরসিংদীতে ৩১-৩-৭১ তারিখে বেলা প্রায় দুইটার দিকে যোগ দেয়। ডেমরায় পাক ফোর্স যাহতে আমাদের ক্ষতি না করিতে পারে তার দায়িত্ব বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানীকে দেওয়া হয়। এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাহার ঢাকা-নরসিংদী পাকা রাস্তায় ফোর্সের যে কোন অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করিবে। আমরা ঢাকার পূর্ব দিকে আক্রমন করিব। সেই ভাবে ১-৪-৭১ তারিখ রাত্রিতে আমি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সহ ৩” মর্টার দ্বারা ঢাকায় ক্যাণ্টনমেণ্ট এরিয়াতে ইপিআর-এর ৬০ জন লোক মিলিয়া আক্রমণ করি যাহাতে পাক ফোর্সের গাড়ী ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করি। এই যুদ্ধ চালাইতে আমাদের সাহায্য করেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব লাল মিয়া সাহেব। তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে পাক ফোর্স তাহাদের ক্ষতিপূরণ করিবার জন্য ৩-৪-৭১ তারিখে রেডিওতে হুকুম জারি করে ঢাকার সমস্ত বাস ও ট্রাক রমনা মাঠে ড্রাইভার সহ রিপোর্ট করিতে। এর আগে আকাশবাণী কলিকাতা হইতে এই খবর প্রচার হইয়াছিল যে, একটি বিরাট মুক্তিবাহিনী দল নরসিংদী হইয়া ঢাকার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমরা ভাঙ্গা হইতে পরপর দুইদিন ও রাত্রিতে আক্রমণাত্মক এ্যাকশন চালাইলে পাক ফোর্স তাহার ডেমরা ঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি করিতে থাকে বলিয়া সংবাদ পাই। আরও জানিতে পারি যে, আমাদের বেইসের উপর আক্রমণ করিবে। কিন্তু আমাদের ২২ জন লোকের একটি দল গেরিলা পদ্ধতিতে ঢাকার তৎকালীন পাক মোটর বর্তমান বাংলা মোটরে ৪-৪-৭১ তারিখের রাত্রিতে এবং ঢাকা-ডেমরা রোডে ৫-৪-৭১ এ রাত্রিতে দুই জায়গায় সরকারী গাড়ী সহ বেশ কিছু পাক ফোর্সকে মারে। এই দুইটা সফল অপারেশনে অংশ গ্রহন করিয়াছিল হাবিলদার হাকিম, সিপাই নান্নু মিয়া সিপাই আফতার, সিপাই ক্লার্ক মান্নান।

 ৩-৪-৭১ তারিখে বেলা অনুমান ১১/১২ টার সময় আমি একজন সিপাই-এর মারফত সংবাদ পাই যে, ঢাকায় বহু ইপিআর মারা পড়িয়াছে। এবং প্রায় ১০০ লোক ঢাকার জিঞ্জিরায় সুবেদার গণি সাহেবের সাথে আছে। আমি একজন লোক মারফত চিঠি দিয়া গনি সাহেবকে আমার সহিত যোগদানের অনুরোধ জানাই। ৬- ৪-৭১তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সুলতান- এর মারফত জানিতে পারি যে, সুবেদার গনি সাহেব নরসিংদীতে লোক নিয়া পৌঁছিলে ঐ জায়গায় বিমান আক্রমণ হয়। এবং তাহারা আবার ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। এবং অন্য দিকে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কোম্পানী নয়া ক্যাপ্টেন সাইগল ঢাকা-নরসিংদী রাস্তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়িয়া দিয়া নরসিংদী পার হইয়া পূর্ব দিকে চলিয়া গিয়াছেন। এই সংবাদ শুনিয়া আমার লোক জনের মনোবল কমিয়া যায়। আমার ২০/২২ জন লোক তখনও ভাঙ্গা বেইস হইতে ঢাকায় আপারেশনে ছিল। অন্যদিকে ২-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সিরাজ-এর নেতৃত্বে ৪০ জন লোকের একটি প্লাটুন ঘোড়াশাল রেল স্টেশন এরিয়া প্রতিরক্ষার জন্য পাঠাই। ৬-৪-৭১ তারিখে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট চলিয়া যাওয়ার সংবাদ পাইয়া আমি তাহাদেরকে আমার সঙ্গে পাঁচদোনায় ফেরত ডাকিয়া পাঠাইয়া নিজে ভাঙ্গার লোকজন সহ পাঁচদোনার শীলমন্দির নামক গ্রামে প্রতিরোধ ব্যবস্থা করি, অর্থাৎ ডিফেন্স লাগাই। অন্য দিকে খবর পাই যে, পাক ফোর্স ডেমরায় জমা হইয়া আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতেছে।

 ৭-৪-৭১ তারিখে রাত্রে জানিতে পারি যে, পাক ফোর্স সকাল বেলা আমাদের উপর হামলা করিবে। তাই পাঁচদোনার আগে ১২-১৪ জন লোক দিয়া একটি এ্যামবুশ পার্টি লাগাই যাহাতে সিপাই স্নানু, মান্নান, হাকিম ছিল। ঠিক ৮-৪-৭১ তারিখ সকাল আনুমানিক সাড়ে সাড়ে ছয়টায় পাক ফোর্স অগ্রসর হইতে থাকিলে এ্যামবুশ পার্টি একযোগে ৪ টি এলএমজি দ্বারা আক্রমণ চালায় যাহাতে পাক ফোর্সের প্রায় ১৫৫ জনের মতলোক হতাহত হয় এবং কয়েকটি গাড়ীও নষ্ট হয়। পাক ফোর্স ঐ দিন আর অগ্রসর হয় নাই।

 ৯-৪-৭১ তারিখ অনুমান নয়টার সময় পাক ফোর্স এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া আমাদের ওপর হামলা চালায়। অনুমান এক হইতে সোয়া ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাক ফোর্স-যাহাতে ৩১ বেলুচ রেজিমেণ্ট ছিল-আক্রমণ ছাড়িয়া দিয়া পাঁচ হইতে পিছে চলিয়া যায়। যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হইয়া পড়ে কিন্তু আর্টিলারী ফায়ার চলিতে থাকে। আমাদের তরফ হইতে চলিতে থাকে তিন ইঞ্চি মর্টার। বেলা অনুমান ৫ ঘটিকার সময় পাক ফোর্স আবার আমাদের উপরে এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থন পুষ্ট হইয়া দ্বিতীয়বার হামলা চালায়। এই যুদ্ধে পাক ফোর্সের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। আমাদের দুটি মেশিনগান খারাপ হইয়া যায়। পাক ফোর্স এইবারও যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করিয়া আক্রমণ ছাড়িয়া দিয়া সন্ধ্যার সময় গোপালদী বাজারে চলিয়া যায়। এদিকে দুইবারের আক্রমণে আমাদের কিছু হাতিয়ার খারাপ হইয়া যায়। যাহা হউক, সন্ধ্যার পর আমরা সিন্ধান্ত নিই যে আমরা এই আবস্থায় ছাড়িয়া ভৈরবের দিকে যাইয়া বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সাথে মিলিব। আশুগঞ্জে গিয়া বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে পাওযা যায়। এবং সেখানে হইতে কিছু বেঙ্গল রেজিমেণ্টসহ ১৩-৪-৭১ তারিখে রামনগর পুলের নিকট আর একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা হয়। কিন্তু ১৪-৪-৭১ তারিখে সূর্যাস্তের আগে হইতেই এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া পাক ফোর্স হামলা চালায় এবংর দুপুর ১২ টার আগেই ঐ ডিফেন্স নষ্ট হইয়া যায় এবং এখানকার লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়। কিছু লোক মেঘনা পার হইয়া সিলেট জেলার ভিতর চলিয়া যায়।

 আমি কিছু সংখ্যক লোকসহ কিশোরগঞ্জ হইয়া ময়মনসিংহে যাই, কারণ আমার ছেলেপেলে ঐখানে ছিল। তারপর ১৫-৪-৭১ তারিখ বিকালবেলা আমি মুক্তাগাছা হইয়া ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরে জিয়াউল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিলে জানিতে পারি যে, টাঙ্গাইলের আগে জামুর্কী এলাকায় নায়েক সুবেদার হারিসের নেতৃত্বে ইপিআর দলের সঙ্গে পাক ফোর্সের তুমুল যুদ্ধ হয় এবং দুই দিকের ভীষণ ক্ষতি হয়। তাহাতে ২০/৩০ জন ইপিআর মারা যায়।

 পরদিন ১৭-৪-৭১ তারিখে খুব সকাল হইতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ৪টি জঙ্গী বিমান ভীষণভাবে ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য এলাকায় আক্রমণ চালায় যাহাতে কিছু সিভিল লোক শম্ভুগঞ্জ ঘাটে মারা যায় এবং কয়েকটি বাস ও দোকানঘর পুড়িয়া যায়। অন্যদিকে গফরগাঁওয়ে বেশ কিছু সিভিল লোক মারা যায় এবং অনেক জায়গা পুড়িয়া যায়। তাহা ছাড়া মধুপুর ও জামালপুরেও বিমান আক্রমণ হইয়াছে বলিয়া সংবাদ পাই।

 তারপর আমরা আমাদের অবস্থানে যে কয়েকজন লোক ছিল তাহাদের নিয়া বর্ডারে করইতলী হেডকোয়ার্টারে ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের মাঝামাঝি সায়চা পুরঘাটে ডিফেন্স তৈয়ার করি। কিন্তু ২২-২৩ তারিখে পাক ফোর্স আবার এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইয়া আক্রমণ চালায় সকালের দিকে। সেখানে আমরা অতি অল্প সময় টিকিতে পারি। ২৩-৭-৭১ তারিখে আমি আমার সঙ্গী লোকসহ করইতলী ক্যাম্পে থাকাকালীন সুবেদার হাকিম সাহেব আসিলে তাঁহাকে উইং-এর ভার দিয়া আমি আমর ফ্যামেলিসহ হিন্দুস্থানের ভিতর দিয়া গাছুয়াপাড়া হইতে ডালু হইয়া আমার বাংলাশে ঢুকিয়া বহু কষ্টে আমার ফ্যামেলি বাড়ী পৌঁছাইয়া দিয়া আগরতলা কোনাবন বর্ডার দিয়া ঢুকিয়া পুরানো ফোর্সের সাথে ৩ সেকটরের অধীনে বেলচরা সাবসেকটরে যাইয়া যোগদান করি। সেখানে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন। তারপর ঐ সব সেক্টরের ১৬-৫-৭১ হইতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি।

সশস্ত্র প্রতিরোধে ময়মনসিংহ

সাক্ষাৎকার: সুবেদার মেজর জিয়াউল হক

৮-৬-৭১

 ২৬শে মার্চ বেলা একটার সময় ঢাকা ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে কমর আব্বাসকে অয়ারলেস সেটে এ কথা বলার জন্য ডাকা হয়। তখন ডিউটি অপারেটর ছিল নায়েক ফরহাদ হোসেন (বাঙ্গালী)। ঢাকা থেকে বলা হল, অয়ারলেস সেট অন করার পর সেখানে যেন কেউ না থাকে। তাই নায়েক ফরহাদ হোসেন ঝুঁকি নিয়ে পাশের ঘরে একটা জায়গা চুপি চুপি দাঁড়িয়ে থাকে। সৌভাগ্যবশত সে পাঞ্জাবী ভাষা বুঝত। ঢাকা থেকে উইং কমাণ্ডারকে বলা হচ্ছিল সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে নিরস্ত্র করার জন্য এবং কোতে, ম্যাগজিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাবি নিয়ে নিতে এবং বাঙ্গালীদের কোন ডিউটি না দেয়ার জন্য। ঢাকা থেকে ইপিআর-এর স্টাফ কর্নেল সিকান্দার খান তাকে আরো বলে যে, আজ রাতের মধ্যে মসস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে খতম করতে হবে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ইপিআরদের সমন্ধে তোমাকে পরে নির্দেশ দেয়া হবে।  নায়েক ফরহাদ হোসেন অয়ারলেস সেট-এর পেছনে চুপি চুপি এই কথাগুলো শোনে এবং সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে তা জানিয়ে দেয়। নায়েক ফরহাদ অয়ারলেস সেটে ২৭শে মার্চ আমাকে ভোর ছয়টার সময় উক্ত মেসেজ জানায় এবং বলে যে, আপনি আপনার বন্দোবস্ত করেন যদি বাঙ্গালী জোয়ানদেরকে বাঁচাতে চান।

 সেই নির্দেশ অনুযায়ী সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়। একমাত্র সি-কোম্পানীর এক প্লাটুন ইপিআর অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করে। নিরস্ত্রকরণের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় ইপিআর'রা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ঐ প্লাটুন- এর নেতা ছিল সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ।

 এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আমাদেরকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার আবদুল্লা আল- মাহমুদ ও তার সহকর্মীবৃন্দ, আর ছিলেন এডভোকেট সৈয়দ আহমদ এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ, অধ্যক্ষ মতিয়ুর রহমান (আলমগীর মিণ্টু কলেজ) সৈয়দ আবদুস সুলতান (বর্তমানে ইংল্যাণ্ডে হাই কমিশনার), জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়া, এডভোকেট মোশাররফ আকন্দ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অন্যান্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক আবদুল হান্নান ও অধ্যাপক দেওয়ান এবং ভাসানী সমর্থক ছাত্রনেতা আবদুল হামিদও ছিলেন।

 ২৭শে মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ঢাকায় নির্দেশ অনুসারে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিও - এনসিওদেরকে বাঙ্গালী ইপিআরদের খতম করার নির্দেশ দেন রাত এগারটার সময়। ট্রুপস ব্যারাক, উইং কমাণ্ডারের বাংলো এবং কোয়াটার গার্ড কোতে এবং ম্যাগজিনের সমস্ত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ মোতায়েন করা হয়। উইং কমাণ্ডার-এর বাংলোতে সি-কোম্পানী এক প্লাটুনকে ডিউটির জন্য মোতায়েন করা হয়। গার্ড কমাণ্ডার শফি এবং অন্য দুই জনের কাছে করে ৩০৩ রাইফেল ছিল। বাকিদের কাছে কোন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।

 রাত এগারটার সময় হেডকোয়ার্টারের তিনতলা থেকে হাবিলদার মেজর হাসিব উল্লাহ এক রাউণ্ড গুলি ফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জায়গা থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। হেডকোয়ার্টারে তখন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একটা কোম্পানী আবস্থান করছিল। গোলাগুলি শুরু হবার পর বাঙ্গালী ইপিআররা ওদের সাথে মিশে যায়। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং সুলতান আমাদের জোয়ানদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র বাঙ্গালী ইপিআরদের দিয়ে দেয়। গোলাগুলি চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ইপিআর-এর কিছু সাহসী বাঙ্গালী জোয়ান স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় কোতে এবং ম্যাগ্যাজিন-এর ভেণ্টিলেশন ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র বের করতে সমর্থ হয়। ২৮শে মার্চ ভোরবেলায় জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া, শামসুল হক এমপিএ, ছাত্রনেতা আবুল হাশেম ও হামিদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেল এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এনে বাঙ্গালী ইপিআরদের দেয়া হয়।

 ২৮শে মার্চ বেলা ৮টা পর্যন্ত দুই পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩/৯৪ জন। ১১ জন জেসিও-এসসিও জেসিও মেসে সারারাত ফায়ার করার পর ১৭ থেকে ১৯ বাক্স গুলিসহ আত্মসমর্পণ করে সুবেদার ফরিদের কাছে। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস সকালবেলা সিপাই নান্নু মিয়া এবং আফতাব হোসেনের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, সিপাই নান্নু এবং আফতাব স্বাধীনতা সংগ্রামে কর্ণেল নুরুজ্জামানের অধীনে এবং ডালু সেক্টরে অত্যন্ত সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে।

 ১১জন জেসিও এনসিওকে সুবেদার ফরিদউদ্দিন ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় ময়মনসিংহ জেলে বন্দী করা হয়। অতঃপর ময়মনসিংহের সকল বাঙ্গালী জোয়ান এনসিও মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে ৪/৬ কোম্পানী গঠন করে জয়দেবপুর ও টুঙ্গী অভিমুখে যাত্রা করে।  এদিকে রংপুর সীমান্ত এলাকার মাদারচর বিওপি থেকে সিলেট সীমন্তের মহেশখোলা বিওপি পর্যন্ত ২৪টা বিওপি'র সমস্ত বাঙ্গালী ইপিআরকে (প্রত্যেক বিওপিতে তিনজন করে রেখে) দুই কোম্পানীতে সংগঠিত করে সুবেদার মেজর আবদুল হাকিম এবং আমার নেতৃত্বে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, ঘাটাইল এলাকা পর্যন্ত মোতায়েন করা হয়। তখন আমাদের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের শামসুল হক এমপি, মুক্তাগাছার শহীদুল্লাহ এম-পি, রফিকউদ্দিন ভুইয়া, নাগরপুর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন খালিদ, লতিফ সিদ্দিকী এম-পি এবং কাদের সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেন। এই সময় ময়মনসিংহ সদরের এসডিও, মেজর শফিউল্লাহর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান এবং জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়া ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং ত্যাগী ও কর্নেল রাংগাজান (৮৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমণ্ডার)- এর সাথে যোগাযোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে কোন সাহায্য না দিলেও ভবিষ্যতে কর্নেল রাংগাজান আমাদেরকে সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি আমাদের সামনে দিল্লীতে এ ব্যাপারে মেসেজ পাঠান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিকউদ্দিন ভুইয়া, আবদুল মান্নান (বর্তমানে পরিবার পরিকল্পানা মন্ত্রী) ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ আমার কোম্পানী হেডকোয়ার্টার করইতলীতে (হালুয়াঘাটে) অবস্থান করছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে তাঁর বাড়ি থেকে জনাব আবুল হাশেম গাইড করে নিয়ে আসেন এবং আমাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁকে নেতা বানানো হয়। তাদেরকে কর্নেল রাংগাজানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ভারতের গাচুয়াপাড়া রেস্ট হাউস ইন্সপেকশন বাংলাতে।

 সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল প্রতিনিধি কলকাতাতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চলে যান। সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতার ভার রফিকউদ্দিন ভুইয়ার উপর অর্পণ করা হয়। অন্য কোন অস্ত্রশস্ত্র না পেলেও আমরা যথেষ্ট পরিমাণ হ্যাণ্ড গ্রেনেড এবং ২৭টি এলএমজি বিএসএফ ক্যাপ্টেন ত্যাগীর নিকট থেকে পাই। তিনি ছদ্মবেশে রসুলপুর এলাকাতে আমার সাথে কাজ করতে থাকেন। এছাড়াও প্রত্যেক রাত ভারত থেকে (ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে) ইণ্ডিয়ান আর্মি ইঞ্জিনিয়ার টিম পুল এবং রাস্তা ধ্বংস করার জন্য আসতেন এবং কাজ সমাধা করে রাত্রেই চলে যেতেন। ২৭শে মার্চ ময়মনসিহের উইং হেডকোয়ার্টারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের খতম করার পর সীমান্তের সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরদেরও খতম করা হয়।

 এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের উপর কালিহাতী, রসুলপুর, মধুপুর, জামালপুর, মুক্তাগাছা, শম্ভুগঞ্জ, গৌরিপুর ইত্যদি স্থানে পাকিস্তনী বিমান বাহিনী পর্যায়ক্রমে বিমান হামলা চালায়। তাদের সৈন্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে এবং ক্রমশ আমাদের বাঙ্গালীদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে থাকে বলে আমরা অনুমান করি। বিমান হামলার ফলে মেজর শফিউল্লার তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে চলে যান।

মধুপুরগড়ের যুদ্ধ[]


 বিক্রমপুরের সুদুর গ্রামাঞ্চলে বসে ভারতীয় বেতারের প্রচারিত সংবাদ শুনছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে আকাশবাণী ঘোষণা করছে, ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরগড়ে পাক সৈন্যদলের আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

 শতাধিক বছর আগে এই মধুপুর গড় আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবর্তনের ইতিহাসের পাতায় একটু স্থান করে নিয়েছিল। আজকের দিনে আমাদের কাছে সেই ঐতিহ্য হয়তো তুচ্ছ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সেদিন এই মধুপুর গড়ে একদল বিদ্রোহীর অভ্যুত্থান সারা বাংলার মানুষের মনে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। সেই বিদ্রোহ আকারে ছোট হলেও তখনকার দিনের বৃটিশ রাজপুরুষরা তাই নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।  ময়মনসিংহ শহর তথা ময়মনসিংহ জেলা তখনও মুক্ত অঞ্চল। কিন্তু তার উপর রাহুগ্রাসের ভয়াল ছায়া নেমে আসছে। দুর্দিন আসন্ন। হামলাকরী পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল শহর হস্তগত করে ময়মনসিংহ শহর দখল করবার জন্য দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। তাদের এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হলে পথের মাঝখানেই তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই প্রতিরোধের ঘাঁটি গড়ে তোলার পক্ষে মধুপুর গড়ই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। মুক্তিবাহিনী স্থির করেছিল এইখানেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়তে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করবে কারা? প্রতিরোধের মূল শক্তি ইপিআর-এর যোদ্ধারা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য সেক্টরে চলে গেছে। তারা আসতে আসতে এই দুশমনরা মধুপুর গড় ছাড়িয়ে চলে যাবে। অতএব অবিলম্বে তাদের বাধা দেওয়া দরকার। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যেটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে তাদের প্রতিরোধ দিতে হবে।

 মুক্তিবাহিনীর সংগঠকরা বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের কাছে জরুরী ডাক পাঠালেন। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে নান জায়গা থেকে ২২ জন ছাত্র মধুপুর গড়ে এসে পৌঁছল। এরা যুদ্ধ করবার জন্য তৈরী হয়ে এল বটে, কিন্তু এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত ছিল না। মাত্র দিনসাতেক আগে থেকে তারা ইপিআর-এর লোক বা প্রাক্তন সৈন্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালনা শিখছিল। এইটুকু শিক্ষাই ছিল তাদের সম্ভল। আর সম্ভল ছিল অনির্বাণ দেশপ্রেম ও দুর্জয় সাহস। একথা শুনলে কি কেউ বিশ্বাস করতে পারবে যে মাত্র ২২ জন অস্ত্র চালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র সেদিন সেই দুর্ধর্ষ পাক-বাহিনীকে মোকাবিলা করতে দাঁড়িয়েছিল? একথা সত্য সত্যই বিশ্বাস করা কঠিন। তাহলেও এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা।

 ১৩ই এপ্রিল তারিখে প্রথম সংঘর্ষ ঘটল। দ'পক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ চলল। ২২টি রাইফেল শত্রুপক্ষের মেশিনগানের জবাব চলেছে। ছাত্ররা বনের আড়ালে আত্মগোপন করে যুদ্ধ করছিল। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্বেও তাদের মধ্যে একজনও নিহত বা আহত হয়নি। পরে জানা গিয়েছিল, এই দিনের যুদ্ধে ছাত্রদের গুলিতে প্রতিপক্ষের একজন ট্রাক-ড্রাইভার ও একজন জীপ ড্রাইভার মারা গিয়েছিল। বেশ কিছুটা দূর থেকে গুলি বিনিময় চলছিল। এইভাবে বাধা পেয়ে পাক-সৈন্যরা অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের অগ্রগতি সেদিনের মত স্থগিত হয়ে গেল। প্রতিরোধকারীদের পক্ষে এটা একটা বিরাট সাফল্য। মাত্র ২২ জন ছাত্রের এই বাহিনী শক্তিশালী শত্রুদের হাত থেকে এই সাফল্যকে ছিনিয়ে নিয়ে এল। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা অত্যন্ত মূল্যবান। পরদিন ১৪ই এপ্রিল তারিখে এখান থেকে জরুরী ডাক দুই ট্রাকবোঝাই ৫০/৬০ জন মুক্তিদ্ধো ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে গেল। এদের মধ্যে অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত যোদ্ধারা ছিল। তাদের সঙ্গে রাইফেল ও হালকা মেশিনগানও ছিল। এদের পেয়ে এখানকার প্রতিরোধ বাহিনী এবার এক শক্তিশালী বাহিনী হয়ে দাঁড়াল।

 ১৪ই এপ্রিল সারাদিন ধরে দু'পক্ষের পচণ্ড যুদ্ধ চলল। শেষ পর্যন্ত এদের প্রতি-আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে সুশিক্ষিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাক-সৈন্যরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে পেছন দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতে তারা পেছনে ফেলে আসা কালিহাতী, ঘাটাইল অঞ্চলে গিয়ে থামল। প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে পাক-সৈন্যদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে দেখল যে, সেখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মৃতদেহগুলি ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত্রুরা প্রাণভয়ে পালাবার সময় কতকগুলি শস্ত্রশস্ত্র ফেলেই চলে গেছে। ফলে তাদের পরিত্যক্ত একটি ট্রাক, একটি জীব, ৪০টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ১৫০ বাক্স মেশিনগানের, গুলি, কতকগুলি মর্টার শেল এবং কয়েক গ্যালন তেল মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

 মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এভাবে তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসে পাক-সৈন্যদলের পরিচালকরা নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগল। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ তাদের চোখের আড়ালে। আক্রমণের প্রবলতা দেখে তারা মনে করেছিল এক বিরাট সৈন্যদল তাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট সংখ্যা ১০০ জনও হবে না।  বেতার সংবাদ গিয়ে পৌঁছল ঢাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটি বামারু বিমান এসে বনের মধ্যে আত্মগোপনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বোমা ফেলতে লাগল। বোমারু আক্রমণের গর্জনে আর বিস্ফোরণের শব্দে রণক্ষেত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। কিন্তু তাতেও ভয় পেল না মুক্তিযোদ্ধারা। ভয় পেল না সেই সমস্ত সহায়তাকারী সাধারণ মানুষেরা যারা পিছনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ যুগিয়ে চলেছিল। শত্রুপক্ষও অনেক চেষ্টা করেও প্রতিরোধ ব্যূহে ভাঙন ধরাতে পারল না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন পণ করে সঙ্কল্প নিয়েছিল যে তারা কিছুতেই ওদের পথ ছেড়ে দেবে না। তাদের এই সঙ্কল্প শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। তারা পথ ছেড়ে দেয়নি। পাক-সৈন্যরা বেগতিক দেখে এ পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিল।

 এই মধুপুর গড়ের যুদ্ধের শেষ পরিণতি ঘটল।


  1. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।