বাখতিন/বাখতিন, এসময়ে
বাখতিন, এসময়ে
বহু শতাব্দী ধরে যিনি মানুষের চিন্তাবিশ্বকে আলোকিত করবেন, তাঁর চূড়ান্ত-বিন্দুহীন যাত্রায় এক শতাব্দী মাত্র পূর্ণ হলো চোদ্দ বছর আগে। প্রতীচ্যের তত্ত্বভাবনা, বিশেষত উপন্যাস-চিন্তা, গত তিন দশকে নিরবচ্ছিন্ন উন্মোচনের সূত্রে কেবলই ভাবনার নতুন নতুন অণুবিশ্ব নির্মাণ করে চলেছে। আমাদের পাঠাভ্যাস ও চিন্তাপদ্ধতির সংস্কার এত দৃঢ়প্রোথিত যে একে ধারণ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে হলে চাই আত্মবিনির্মাণের স্পৃহা। কিন্তু হায়, আমাদের বৌদ্ধিকতার অহংকার এবং নিজস্ব অবস্থানের অনমনীয়তা বাস্তিল দুর্গের চেয়েও বেশি দুর্ভেদ্য। তার ওপর সাম্প্রতিক কালে বিশ্বাসহীনতার চোরাবালি এত সর্বগ্রাসী যে ইতিহাস-ভাবাদর্শ-তাৎপর্য প্রভৃতিও প্রয়োগ-শূন্য তত্ত্ববীজ হিসেবে ধিক্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত। ইদানীং বিকেন্দ্রায়নের নামে চরম নৈরাজ্য আমাদের এত বেশি অধিকার করে রেখেছে যে কোনো প্রতিবেদনের স্বত-উৎসারিত যুক্তি-শৃঙ্খলায় আমরা কিছুতেই আস্থা রাখতে পারি না। নিজেদের অবিশ্বাস-দীর্ণ অস্তিত্ব থেকে সংক্রামিত নিরলম্বতার পাণ্ডুরোগ মহামারীর মতো ছড়িয়ে দিচ্ছি চিন্তাবিশ্বের নানা অভিব্যক্তিতে। বিশেষত আধুনিকোত্তরবাদের জটিল সন্দর্ভগুলির আংশিক ও অযথার্থ গ্রহণ কেবলই বিড়ম্বিত করছে আমাদের। তাই বাখতিনের অনন্যতাকে ঈপ্সিত মাত্রায় উপলব্ধি করতে পারছি না সম্ভবত। চিন্তার ইতিহাসের ওপর যেহেতু নিজেদের পূর্বনির্ধারিত কেন্দ্রচ্যুত অবস্থানের ছায়া চাপিয়ে দিচ্ছি, বাখতিনের ভাববিশ্ব থেকে অর্জিত সম্বোধ্যমানতার প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্তও করতে পারছি না।
বিশ শতকের শেষে আধুনিকোত্তরবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের উদ্ধত যুগলবন্দি জীবন থেকে ক্রমাগত মানবিক নির্যাস শুষে নিয়েছে। পরিসর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গভীরতা আর সময় থেকে ব্যাপ্তির বোধ। তাহলে প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা বা সম্বোধ্যমানতাকে কীভাবে জাগিয়ে রাখব আজ? কীভাবেই বা বাখতিনের চিন্তাবীজ পুষ্পিত হবে আমাদের অনিকেত এবং পারম্পর্যহীন অবস্থানে? পরিবর্তনের স্রোতে আমরা এখন দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ভেসে যাচ্ছি। বাখতিনের জীবনেও মুহুর্মুহু পরিবর্তন ঘটেছিল, ইতিহাসের কত বিচিত্র পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল—ইতিমধ্যে তা জেনেছি আমরা। তাঁর জীবন ও মননের নিরবচ্ছিন্ন দ্বিরালাপের গ্রন্থনায় ইতিহাসের বহুস্বরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাখতিন নিজে যাকে মহাসময় (Great time) বলেছেন, তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল তারই মধ্যে। কিন্তু আমরা যারা আধুনিকোত্তর ভাবনার নিরিখে ইতিহাসকে মহাসন্দর্ভ বলে প্রত্যাখ্যান করতে শিখেছি, বাখতিনের জীবন-নিষ্পন্ন প্রত্যয় কি আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে! বাখতিন চিন্তা-প্রস্থানের আলোচনায় অতিউদ্ভাসিত প্রথম বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ যেহেতু সবচেয়ে বেশি, তাদের আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির অভিপ্রায় ও রণকৌশল কি আদৌ ভুলে থাকা সম্ভব? তৃতীয় বিশ্বের জিজ্ঞাসুরা কীভাবে বিশ্বাস করবেন যে প্রথম বিশ্বের বাখতিন-ভাষ্য—‘প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা’ কিংবা ‘সত্তা মানে সমান্তরালতার বোধ’ বা অংশীদার হওয়ার প্রত্যয়’—এইসব মহাবাক্য আন্তরিকভাবে স্বীকৃত হবে? কার্নিভাল তত্ত্বে অন্তর্বৃত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নির্যাসকে কিংবা বাখতিনীয় তাৎপর্যতত্ত্বে সংগ্রামের অপরিহার্যতাকে কীভাবে গ্রহণ করতে পারে একবাচনিক আভিজাত্যে অভ্যস্ত জনেরা?
কোনো তত্ত্বপ্রস্থান বা সেই তত্ত্বপ্রস্থানের পাঠ ও বিশ্লেষণ ইতিহাসের বাইরে যেতে পারে না। ইতিহাসকে অস্বীকার করলে গোলকধাঁধা তৈরি হয়ে মাত্র। অন্যত্র লিখেছি, দ্বিবাচনিকতা নিছক নান্দনিক কৃৎকৌশল নয়; তা জীবনদর্শনের সারাৎসার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে তাকে উপেক্ষা কিংবা কুঠারাঘাত করলে নিছক বৌদ্ধিক চর্চায় তা আলোচনার অধিকার থাকে না। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পর্যায়ে যাবতীয় অপর পরিসরের স্বাতন্ত্র্য, সার্বভৌমত্ব ও সমান্তরাল অবস্থানের অধিকার যারা ক্রমাগত কেড়ে নিচ্ছে এবং নিজেদের প্রয়োজন-মাফিক সত্য উৎপাদন করছে—তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা দ্বিবাচনিক বিশ্ববীক্ষাকে কেনই বা সমর্থন করবেন? তাদের ‘নিরপেক্ষ’ সত্য সন্ধান আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়। অন্তত যে-পৃথিবীতে ইরাক-বসনিয়া-কসভো-সোমালিয়া-আফগানিস্থানের ঘটনাবলি সম্ভব, সেই পৃথিবীর উন্নততম তথ্য-প্রযুক্তির সমর্থনধন্য বৌদ্ধিকবর্গ বাখতিনের ভ্রান্ত পাঠই করতে পারেন শুধু।
বিখ্যাত বাখতিন-আলোচক ক্যারিল এমার্সন The first hundred years of Mikhail Bakhtin বইয়ের প্রাক্কথনে লিখেছেন: ‘The Bakhtin industry has known its share of gossip, turfwars, unsubstantiated rumour, dialogue in bad faith, nostalgic fantasy and willful misreadings.’ (১৯৯৭: দশ)। এই যে ইচ্ছাকৃত ভ্রান্ত পাঠের কথা বলা হলো, তাতে তৃতীয় বিশ্বের যেসব ভাষ্যকারেরা জড়িয়ে পড়েন, এর মূলে রয়েছে প্রথম বিশ্বের বৌদ্ধিক বর্গের প্রতি নির্বিচার আনুগত্য ও অবিশ্লেষণাত্মক পাঠের আভাস। স্বয়ং এমার্সনের বক্তব্য সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য। আমরা যারা তুলনামূলক ভাবে ছোট সময়ের অধিবাসী, জীবনবৃত্তের সীমাবদ্ধতা বা অভিজ্ঞতার অতিসংলগ্নতা সত্ত্বেও খোলা মনে চিন্তাবিশ্বের মুখোমুখি হতে আমাদের কোনো বাধা হওয়ার কথা নয়। এমার্সন-কথিত মিথ্যা বিশ্বাসের চাপ অবশ্যই অনস্বীকার্য বাস্তব। তবু তাৎপর্য অর্জনের সংগ্রামী প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেই হয়। নব্বই-এর দশকে প্রতিবিপ্লব-পরবর্তী খণ্ডীকৃত রাশিয়ার তথাকথিত উত্তর-সমাজতন্ত্রী পর্যায়ে বাখতিন কীভাবে পুনঃপঠিত হচ্ছেন, এ সম্পর্কে এমার্সন তথ্য-সমৃদ্ধ মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে যে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ তো নয়ই, কোনো রাজনীতিও তাঁর চিন্তাজীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে পারেনি। নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসকের পীড়ন সত্ত্বেও তিনি কীভাবে রয়ে গেলেন চিরমুক্ত, গৃহহীন ও অসম্পৃক্ত—তা অনুসন্ধান করে আলোচকেরা বাখতিন সম্পর্কে কার্যত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। অথচ তাঁরই বিখ্যাত তত্ত্ববীজ অনুযায়ী (‘জীবন ও সাহিত্যের প্রতিবেদন কখনও চূড়ান্ত করা যায় না’) আলোচকদের ঐ প্রবণতা সমর্থন করা যায় না।
তাঁর মধ্যে কেউ কেউ দেখতে পেয়েছেন সাম্যবাদ-উত্তর আধুনিকোত্তর চিন্তাধারার পূর্বাভাস। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবস্থান খোঁজা হচ্ছে ‘Somewhere between a classic and cliche’ (তদেব: ৩)। বিশেষত আধুনিকোত্তর ভাবনার প্রেক্ষিতে বাখতিনের চিন্তাবিশ্বের বিবর্তন ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। তবু রুশ ভাষ্যকার ভি. এল. মাখলিন-এর মতে বাখতিনকে বুঝতে হবে নেতি নেতি করে। তাঁকে বলা যায় ‘non-Marxist, nonformalist, Non Freudian, non-structuralist, nonexistentialist, noncollectivist, nonutopian, nontheologian, in a word a non-modernist’ (তদেব: ৪) তাত্ত্বিক। আসলে এত দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করার পরেও বাখতিন রয়ে গেছেন রহস্যময়, এমনকী কিছুটা প্রহেলিকাও। তাঁর তত্ত্ববিশ্ব কতটা স্ববিরোধী কিংবা অসম্পূর্ণ—এই আলোচনাও কম হয়নি। বিশেষত সাম্প্রতিক বঙ্গীয় আলোচকদের একটা অংশ এ-বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী। প্রতিবেদনের মধ্যে অন্ধবিন্দু থাকাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। স্বয়ং বাখতিন সার্থক বয়ানকে মুক্ত পরিসরের দ্যোতক বলে ভাবতেন। নিরন্তর প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে তাঁর কাছে শেষ কথা বলে কিছু ছিল না।
দুই
সুতরাং বাখতিন কী করতে পারেননি, সেই অপূর্ণতার ওপর বেশি মনোযোগ না দিয়ে আমরা তাঁর দ্রষ্টাচক্ষুর ব্যাপ্তি ও গভীরতার পরিমাপ করতে পারি। লক্ষ করতে পারি, কীভাবে যথাপ্রাপ্ত বাস্তবের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন স্বর ও স্বরান্তরের অজস্র সম্ভাবনা, খুঁজে পেয়েছিলেন বস্তু ও ক্রিয়ার বিনির্মাণের তাগিদ। চিন্তার ঔচিত্য নয়, চিন্তার স্বভাবই অন্বিষ্ট ছিল তাঁর। কীভাবে ভাবনার সীমান্তগুলি অনবরত মুছে যাচ্ছে এবং তার ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের কূটাভাস—বাখতিন আমাদের সেদিকে মনোযোগী হতে প্রাণিত করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালির আস্তিত্বিক পরিসরে কীভাবে গৃহীত হচ্ছেন বাখতিন—তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সহজ নয়। তবে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে প্রতীচ্যের ভাষ্যকারদের চোখ দিয়ে বাখতিনকে দেখার ফলে কিছু কিছু নেতিবাচক মনোভঙ্গি নিঃসন্দেহে তৈরি হয়েছে। এর সমাধান যদি করতে চাই, কর্তৃত্ববাদের কৃৎকৌশল থেকে তাৎপর্য সন্ধানের প্রক্রিয়াকে আগে মুক্ত করতে হবে। সারা জীবন ধরে যিনি বাচনবিশ্বের যোগ্যতা পরীক্ষা করে গেছেন, তাঁকে টুকরো করে দেখা চলে না কখনো। ভরসার কথা, কোনো কোনো বাঙালি তত্ত্বজিজ্ঞাসু ও আলোচক এবিষয়ে ক্রমশ অবহিত হয়ে উঠেছেন। এই উপলব্ধি উত্তরোত্তর গাঢ়তর হয়ে উঠছে যে এই জগৎ যতটা বাস্তব ততটাই রূপক। চিহ্নায়িত জগতে সত্যে পৌঁছানোর পথে সবচেয়ে বড়ো বিঘ্ন হলো প্রাতিষ্ঠানিকতা বা সরকারি বয়ানের রক্ষণশীলতা। বহুস্তরান্বিত পাঠকৃতিতে সমস্ত অন্তর্বয়ন প্রকাশ্য নয়, রয়েছে বহু গোপন বা অনতিগোপন গৌণ পাঠও। গত দশ বছরে বেশ কয়েকজন সমালোচক বাখতিন চর্চায় অংশগ্রহণ করেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা বলা যাচ্ছে না যে তৃতীয় বিশ্বের অপর পরিসরের উপযোগী যথাপ্রাপ্ত স্থিতির গভীর তাৎপর্য বাঙালি ভাবুকেরা ঈপ্সিত মাত্রায় নিঙ্ড়ে নিতে পেরেছেন। বাখতিনের যে-সমস্ত ভাববীজ বাঙালির নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির জমিতে বহুধা-অঙ্কুরিত হতে পারত, তা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে দেবেশ রায় প্রবর্তিত উপন্যাসতত্ত্বমূলক আলোচনার প্রভাব নবীন প্রজন্মের কয়েকজন প্রাবন্ধিকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে ব্যাপৃত হয়েছেন কয়েকজন উজ্জ্বল কথাকার। কিন্তু আবারও লিখছি, বাখতিনীয় দ্বিরালাপ থেকে যে নবায়মান প্রত্যুত্তরযোগ্যতার বহুমুখী কর্ষণ হতে পারত, তা এখনও অপেক্ষিত। তেমনই কার্নিভালের সাংস্কৃতিক রাজনীতির তাৎপর্য এবং সেই তাৎপর্যের বিস্ফোরক তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সম্ভাবনা আমাদের অভিনিবেশ পায়নি। জীবন-জগৎ-সাহিত্যের প্রতিবেদন কীভাবে অনবরত পুনঃপাঠ করে যেতে হয়, সেই ভাবনার উদ্ভাসন আমাদের মানববিশ্বের প্রতীতিকেই সমৃদ্ধতর করতে পারত। বিশেষত ভারতীয় চিত্তাকাশের শরিক হয়েও আমরা বাখতিনীয় ভাবকল্পকে আমাদের মানবিক মহাকাশে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রায় কোনো অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারি কি না, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। গত কয়েক বছরের সাহিত্যপ্রেক্ষিত পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবনবীক্ষার মধ্যবর্তী জলবিভাজনরেখা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। পক্ষ-প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্ব যেন প্রাসঙ্গিক নয় আর, বিচিত্র সমগ্রায়নের প্রবণতায় কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিগ বয়ানের পার্থক্য অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকোত্তর পরিস্থিতির নামে আরোপিত প্রতিনন্দনের কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হচ্ছে বাঙালির লিখন-প্রণালী। বাখতিনের কার্নিভাল সংক্রান্ত ভাবনার নির্যাস থেকে এক্ষেত্রে হয়তো আমরা প্রতিরোধের ভিন্ন প্রকরণ খুঁজে নিতে পারতাম।
না, এসব কোনো আক্ষেপের কথা নয়। বিশ্বব্যাপ্ত নির্মাণবায়ন প্রবণতার মধ্যে আমাদের অজস্র স্ববিরোধিতা-লাঞ্ছিত সাংস্কৃতিক সমাজ কীভাবে আত্মরক্ষা করতে পারে—এটাই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। এ ব্যাপারে কতটা সাহায্য করতে পারেন বাখতিন, সেটাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে এখন। ইতিহাসই বাঙালির পরিসরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ফলে অসংখ্য উচ্চাবচতা, কৌনিকতা ও অনিশ্চয়তা সম্বল করে বাস্তুহীন মানুষের প্রব্রজন আজও অব্যাহত। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মাত্রা যেহেতু আলাদা, জীবনবীক্ষায় ভিন্নতার অভিব্যক্তিও অনিবার্য। বস্তুত প্রাক্-আধুনিক, আধুনিক ও আধুনিকোত্তর চিন্তাপ্রণালীর সহাবস্থান তাই বাঙালির ভাববিশ্বকে গ্রন্থিল করে তুলেছে। সাহিত্যকর্মে আধার ও আধেয়ের দ্বিরালাপ নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। স্বভাবত প্রত্যুত্তরযোগ্যতা অর্জনের প্রশ্নটি সমস্ত বাঙালির দ্বারা একই ভাবে মীমাংসিত হতে পারে না। বিভিন্ন অবস্থানের সীমান্তগুলিকে কীভাবে গ্রহণ করতে পারি আমরা, এ-বিষয়ে বাখতিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নেওয়া সম্ভব। বিশেষত বাস্তব ও অধিবাস্তব, বস্তুবিশ্ব ও চিহ্নবিশ্ব ইদানীং যেভাবে সাহিত্যিক প্রতিবেদনে একাকার হয়ে যাচ্ছে, নতুনভাবে দ্বিরালাপের যৌক্তিকতা নির্ণয় করা অবশ্যকৃত্য হয়ে পড়েছে। বাংলা সাহিত্যে আখ্যানের স্বরান্তর সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে যে অভিনব সচেতনতার সূচনা হয়েছে, তাকে বাখতিনীয় ভাবকল্প দিয়েই যথার্থ বিনির্মাণ করা সম্ভব। একটু আগে বাঙালির বাধ্যতামূলক প্রব্রজনজনিত চিন্তা ও অভিব্যক্তির যে অনেকান্তিকতার প্রতি ইঙ্গিত করেছি, সেই সূত্রে বলা যায়, বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সৃজনশীলতার কৃত্যে রূপান্তরিত করার পথ-নির্দেশ বাখতিনই দিতে পারেন। তাৎপর্যের রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে নৈঃশব্দ্য ও অনুপস্থিতির যত ভূমিকাই থাক, কৃত্যের নির্মিতিপ্রকরণ শুধুমাত্র তাদের ওপর নির্ভর করে না। এখানেই বাখতিন-কথিত সক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা আমাদের মনে পড়ে।
বাখতিনীয় ভাবকল্পকে সম্প্রসারিত করে ক্যারিল এমার্সন ‘co-existent options in space’ (প্রাগুক্ত: ১৬)-এর কথা বলেছেন। এই কথাটি বহুধাবিচ্ছিন্ন বাঙালির সাম্প্রতিক অবস্থানে খুব জরুরি চিন্তাসূত্র হয়ে উঠতে পারে। আরেকজন বাখতিন-বিশেষজ্ঞ, মিখায়েল এপস্টাইন, ১৯৯৩ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ‘Post-humanism, post-communism, post-modernism—the river of time has entered an ocean and lost its fluency altogether.’ (তদেব)। এ হয়তো বাঙালির পৃথিবী সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়; কিন্তু তবু আজকের অধিপরিসর শাসিত নব্য-বহুত্বের পর্যায়ে এই ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেই হয়। লিখন-বিশ্ব ও তার বিচিত্রগামী ভাষ্যকে যদি সংহত ও গভীরতা-সন্ধানী করতে চাই, তাহলে বাখতিনের দ্বিবাচনিক ভাষাদর্শনের ওপর আস্থা রাখতে হবে। রচনাকর্ম, সমালোচনা ও তত্ত্বসন্ধানে আমরা আজ কেবল বর্তমানকেই গুরুত্ব দেব না, অতীত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পুনঃপাঠও করব। অর্থাৎ বাখতিন আমাদের সময় ও পরিসরের আবহমান পর্যায়ক্রমগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করেন। এই সূত্রটির প্রণালীবদ্ধ অধ্যয়ন থেকে আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে পুনর্বিবেচনা করার রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারি। গ্রেগরি ক্লার্ক তাঁর Dialogue, Dialectic and Conversation বইতে লিখেছেন: ‘for people studying rhetoric and compostion as well as for those studying literature, Bakhtin’s work provides perhaps our most comprehensive explanation of the process through which social knowledge is constructed in a co-operative exchange of texts. However diverse its particular applications. Bakhtin’s explanation persistently and explicitly affirms the two complementary assumptions about language that support a social constructionist point of view: that our language creates rather than conveys our reality. …and that it does so in a process that is collaborative rather than individual.’ (পৃ. ৮-৯)।
এই মন্তব্যের প্রতিটি অংশ বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠে দিক্দর্শক বলে বিবেচিত হতে পারে। সামাজিক নির্মিতিবাদী দৃষ্টিকোন ছাড়া নান্দনিক সত্য ও সেই সত্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়। বাখতিনের কাছে পাওয়া নির্মিতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা কিংবা ‘speech genre’-গুলির অন্তর্নিহিত সামাজিক মাত্রা নির্ণয়ের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে আমরা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরিত প্রতিবেদনের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারব। এটা ঠিক যে বাংলা বিদ্যাচর্চা, বিশেষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, অত্যন্ত মন্থর গতিতে বিবর্তিত হলেও বহুকাল ধরে প্রচলিত রক্ষণশীলতা একটু একটু করে বিচলিত হতে শুরু করেছে। বাখতিন বিশ্বাস করতেন, আমাদের লিখিত বা মৌখিক অভিব্যক্তির কৃত্য বা উদ্যম দুরূহ অন্তর্বৃত সংগ্রামের পরিণতি। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামূহিক অতীত ও বর্তমানের অজস্র উচ্চারণ অন্যোন্য-সম্পৃক্ত হয়ে ভাষার সামাজিক ঊর্ণাতন্তু গড়ে তোলে এবং গড়ার ঐ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রাগুক্ত সংগ্রামে যুক্ত হয়ে যায়। এইসব উচ্চারণে যাবতীয় অপর পরিসরের উপস্থিতি স্বতঃসিদ্ধ ও অন্তরীকৃত। স্বর ও স্বরান্তরের বিন্যাস-প্রতিন্যাসের গ্রন্থনা স্বভাবে দ্বিবাচনিক। সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তহীন দ্বিরালাপের উপস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অনুভূত হয়ে থাকে।
তিন
বাচন সম্পর্কে বাখতিনের দ্যোতনাময় সমৃদ্ধ ভাবনা কি কম্পিউটার প্রযুক্তির সাম্প্রতিক পর্যায়ে অলংকৃত ভার হিসেবে গণ্য হবে? মুদ্রিত শব্দের জগতে অতি দ্রুত যেসব অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে, তাতে বাচন ও পরাবাচন সংক্রান্ত সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সেই চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা সন্দর্ভ-পরাপাঠ-অন্তর্বয়ন বিষয়ক ধারণা কি ইতিহাসের মহাফেজখানায় ঠাঁই পাবে? সাহিত্য-সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্ব যেমন নিরালম্ব হয়ে পড়বে, তেমনি মানবতাবাদী মূল্যমানও ছিন্নমূল হতে বাধ্য। কম্পিউটারের পর্দায় অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে ফুটে উঠতে থাকে অক্ষরের সারি; এদের ইচ্ছামতো কমিয়ে-বাড়িয়ে দুমড়ে-মুচড়ে তৈরি হতে থাকে চরম নমনীয় নব্যপাঠকৃতি। অক্ষরের বিন্যাস-পদ্ধতি তো নয় কেবল, চরিত্রও আমূল পালটে যাচ্ছে। স্বভাবত বাচনও আগের মতো থাকতে পারে না। উপস্থাপনায় এমন উন্মুক্ততা দেখা দিচ্ছে, সংরূপে ও অন্বিষ্ট লক্ষ্যে ই-মেল নেটওয়ার্কিং হাইপারটেক্সট নিয়ে আনছে আমূল পরিবর্তন। বাখতিনের কাছে পাওয়া সংযোগের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তত্ত্ববীজ কি সর্বব্যাপ্ত বিয়োগপর্বের বিভ্রম ও অবভাসে হারিয়ে যাবে? প্রত্যুত্তরযোগ্যতার দার্শনিক নিষ্কর্ষ ও প্রাসঙ্গিকতা কি বজায় থাকবে এখন! লিখনভ্রম লিখনকে আর অধিপরিসরের উচ্চারণ-বিভ্রম উচ্চারণকে মুছে ফেলবে ক্রমাগত? বাখতিন মৌখিক সংযোগ-প্রকরণকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তারই আদলে হয়তো বা এইসব অধিপাঠগুলিকে বিশ্লেষণ করার মতো তাত্ত্বিক বয়ান তৈরি করে নেওয়া যায়—এমন ভেবেছেন সাম্প্রতিক এক আলোচক। বাঙালির ভাববিশ্বে এই পর্যায়ের সূচনামাত্র হয়েছে। অন্তত প্রতীচ্যের বৌদ্ধিক সমাজের সঙ্কট এখনও আমাদের কাছে তত প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেনি। তবু, বদ্রিয়ারের পরিভাষায় এই ভবিষ্যৎ অতীতের ছবি আমাদের পক্ষে হতে পারে আগাম সতর্কীকরণ। আর, সেই সঙ্গে সংকট-জনিত পরিবর্তিত পরিস্থতিতে বাখতিনের সময়োপযোগী পুনঃপাঠও শুরু করা যেতে পারে।
সাহিত্য-সমালোচনা ও সাহিত্যকৃতি সম্পর্কিত যত দার্শনিক ভাবনা সাম্প্রতিক কালে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের মধ্যে বাখতিনের দ্বিবাচনিকতা তত্ত্ব অতিসাম্প্রতিক কম্পিউটার প্রযুক্তির ফলে সৃজ্যমান বয়ানের বৈপ্লবিক রূপান্তরকে সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা করতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই যে বিশ শতকের অন্তিম প্রহরে আমরা একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছি; মুদ্রণযুগের স্থিতিশীল পাঠকৃতিগত অভিব্যক্তির স্থান দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ইলেকট্রনিক সাক্ষরতার অভিনব প্রবণতা ও যুগোপযোগী গতিশীল বয়ান। বাখতিনের ভাষা-ভাবনা শব্দের মৌখিক উৎসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল; কিন্তু তা আশ্চর্যজনক ভাবে আজকের ইলেকট্রনিক সাক্ষরতা ও পাঠকৃতির গতিশীল অভিব্যক্তিকে বোঝার মতো চিন্তাসূত্র আমাদের যোগান দিতে পারে। কোনো কোনো আলোচক ইদানীং ‘Digital dialogics’-এর কথাও বলতে শুরু করেছেন। এটা ঠিক যে বস্তুবিশ্ব সাহিত্যিক বাচনের উৎকর্ষ-সূত্রে চিহ্নবিশ্বে রূপান্তরিত হচ্ছিল। বিশ শতকের শেষে তাত্ত্বিক আলোচনায় বিষয়টি তাই ক্রমশ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিশ্বায়নের সাম্প্রতিক পর্যায়ে চিহ্নায়কের আগ্রাসন তীব্রতর হয়ে চিহ্নায়িতকে কীভাবে গ্রাস করতে বসেছে—তাও আমরা লক্ষ করেছি। বস্তুবিশ্ব কার্যত বিভ্রমবিশ্বে পরিণত হওয়ার ফলে সাহিত্যিক বাচনেও তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে।
আধুনিকোত্তর কবিতায় প্রতি-উপন্যাসে প্রতি-গল্পে বয়ানের সংরূপ অন্তর্ঘাতের তোড়ে বিদীর্ণ হয়ে যেতে দেখেছি। বাস্তব যখন অধিবাস্তবে কিংবা পরিসর অধিপরিসরে লীন হয়ে যায়, বাচনের বোধ ও দ্বিবাচনিকতার আশ্রয় আমূল রূপান্তরিত না হয়ে পারে না। নির্মাণবায়িত সমাজে প্রযুক্তির বিস্ফোরণে অজস্র চিহ্ন যে উৎপাদিত হয়ে চলেছে—কার্যত তা তো অবভাস। আসলে যা ঘটছে, তা হলো নিশ্চিহ্নায়নের সন্ত্রাস। বাস্তব এখন প্রতীত (virtual) মাত্র। বাখতিনীয় ভাবকল্পগুলিকে প্রয়োগ করতে হলেও অত্যন্ত সতর্কতা ও বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আসলে শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, মানুষের পার্থিবতা ও সেই পার্থিবতায় সম্পৃক্ত সাহিত্যবোধই প্রতীত বাস্তবের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি। দাতা ও গ্রহীতার অত্যন্ত মৌলিক ও আবশ্যিক দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা আর পারস্পরিক প্রত্যুত্তরযোগ্যতা আজ কেবল তাত্ত্বিক ভাববীজ মাত্র নয়; সর্বগ্রাসী উদ্ধত প্রতাপের বিরুদ্ধে সাহসী সাংস্কৃতিক যুদ্ধেরও হাতিয়ার। অর্থাৎ একুশ শতক যদি বা আধুনিকোত্তর অবভাসবাদের কল্যাণে ভবিষ্যবাদী মায়া ছড়িয়ে দিয়ে নব্য রোমাণ্টিক প্রতিজগতের বার্তা বয়েও আনে, সর্বপ্লাবী মূল্যহীনতা থেকে সম্ভাব্য মূল্য-চেতনায় পৌঁছানোর দ্বিবাচনিক সংঘর্ষের পথ মানুষকেই নির্মাণ করে নিতে হবে। একুশ শতকের সাহিত্যে বাচনের আপাত-নির্বাসনের আশঙ্কা সত্ত্বেও সত্যোপলব্ধির এই নব্যপ্রযুক্তি মানুষকেই আবিষ্কার করতে হবে। সুতরাং বাখতিন-কথিত নির্মিতিবিজ্ঞানের তাৎপর্য পুনর্নির্ণয়ের প্রক্রিয়া রুদ্ধ হতে পারে না। পুনর্নির্মাণের এই প্রকরণে হয়তো অঞ্চলভিত্তিক, ঐতিহ্যভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক অপরতার বর্গগুলিও পুনর্নির্মিত হবে। কিন্তু যা-ই ঘটুক, দ্বিবাচনিকতা থেমে থাকবে না।
প্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা যত চোখ ধাঁধিয়ে দিক বা বিভ্রান্ত করুক, ইতিহাসের ধুলোয় নিশ্চয় মানুষের এতদিনকার সাহিত্যকৃতির পরম্পরা মিশে যাবে না। যেভাবে বাচনের, উপন্যাসের প্রাক্-ইতিহাস খুঁজে পেয়েছেন বাখতিন, আমরাও একদিন প্রাক্-বিশ্বায়িত ও বিশ্বায়নোত্তর প্রযুক্তির নতুন অর্থ আবিষ্কার করে নেব। খুঁজে নেব প্রাক্-নির্মাণবায়ন ও নির্মাণবায়নোত্তর স্তরের নতুন চিহ্নতত্ত্ব। ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্যে নয়, সম্ভাব্য আগামী কালের সঙ্গে ঐসব তাৎপর্যের দ্বিরালাপের সূত্র খুঁজে নেওয়ার জন্যে। সংকট থেকেই যেহেতু সমালোচনার জন্ম হয় এবং অবশ্যই জন্ম হয় নব্যপাঠকৃতিরও—আমাদের আসন্ন সাহিত্যচর্চায় বাখতিনীয় ভাববিশ্বের সঙ্গে নতুন পরিচয় ঘটবে আমাদের। প্রতাপের বিচ্ছুরণে অভিভূত আমাদের মন; প্রচারিত হচ্ছে বহুত্ববাদের জয় অথচ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার আঙরাখা। সমস্ত অপর পরিসরের সমান্তরাল অবস্থানের অধিকার যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, দৃষ্টির বহুত্ব কিংবা উদ্বৃত্ত তো কাগুজে কথা হয়েই থাকবে। যেহেতু বাখতিনের বয়ান ‘canonical texts of the academy’-র দৃষ্টান্ত নয়—আজকের দিনের প্রয়োজনীয় পুনস্তত্ত্বায়নের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে তাঁর উন্মুক্ত চিন্তাপরিসর থেকে। পৌর সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজের পাশাপাশি ইদানীং যে নতুন তথ্য-বিস্ফোরিত তথ্য-উন্মুখ তথ্যগ্রাহী সমাজের সূত্রপাত হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে হলে বাংলা বিদ্যাচর্চাকে নিরাসক্ত ও ছদ্ম-নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান পরিহার করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, বাচনিক বনাম দৃশ্যগত আখ্যানের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া ক্ষতিকর এখন। গ্রহীতাসত্তা যেহেতু নিছক গ্রহীতা নয় আর, ভোত্তাসত্তাও—আমাদের বহু দৃঢ়ভোথিত ভাবনা হঠাৎ নিরালম্ব হয়ে পড়ছে। অভিনব সমস্যার সমাধান পুরোনো পথে হওয়া শক্ত। যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ‘গন্তব্য’ পথকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেই পর্যায় থেকে সরে এসেছি আমরা। তাহলে, সন্দর্ভ থেকে প্রতিসন্দর্ভে পৌঁছানো যথেষ্ট নয়; ‘উপস্থাপনা’র প্রায়োগিক তাৎপর্যকে বহুদূর প্রসারিত করতে হবে। সেই সূত্রে প্রত্যুত্তরযোগ্যতার ধারণাকেও সব গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে অনন্ত স্থিতি-স্থাপকতার সম্ভাবনায়। যাঁরা বলছেন লেখকের বয়ানকে এখন রূপান্তরিত করতে হবে—‘to digital, on-line forms of expression...from linear page to digital hypertext and multimedia visuals to more holistic electronic forums’—তাঁরা স্পষ্টত সময়ের অতি-সপ্রতিভ নব্য কার্নিভালের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু আমাদের মনে সেই পুরোনো অবোধ প্রশ্নই জেগে ওঠে আবার: অতঃ কিম্? যে-কোনো মূল্যে টিকে থাকতে হবে—এই কি অস্তিত্বের সংজ্ঞা? বিশ্বব্যাপ্ত তথ্য রাজপথ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে লক্ষ করতে পারব কি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, ভোগ-প্রযুক্তির ক্যাসিনো, বস্তু ও চিহ্নের স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞান কীভাবে পলক ফেলতে-না-ফেলতে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে ততোধিক দুর্বার বেগে ধাবমান নেতি ও নৈরাজ্যের কৃষ্ণবিবরে?
আসলে সময়ের পর্বে-পর্বান্তরে যুদ্ধের সংজ্ঞা, যুদ্ধক্ষেত্র, যুদ্ধের সরঞ্জাম, যুদ্ধকৌশল পালটে যায়। একুশ শতকের প্রারম্ভিক দশকে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছি যে আগামী দিনগুলিতে মানবিক অন্তঃসার সংরক্ষিত করে রাখার মতো আপাত-প্রাথমিক কাজই হবে বড়ো ধরনের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বাখতিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন; তাঁর তত্ত্ববীজগুলি হবে যুগপৎ আত্মরক্ষার প্রকরণ ও প্রত্যাঘাতের আয়ুধ। বাখতিন জানতেন, দ্বিবাচনিকতা অন্তহীন; তা সর্বত্র ও সর্বকালে রয়েছে। বস্তুত এই প্রক্রিয়ার শক্তিতেই মানুষ অপরাজেয়, মানবিক নিষ্কর্ষ কালাতিযায়ী। নইলে ভাষা হারিয়ে যেত, মুছে যেত সাহিত্যিক প্রতিবেদন। সুনির্দিষ্ট সময়পর্বের সীমা ও বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে গিয়ে ভাষাই শুধু সঞ্চরমান থাকে, গ্রাহক-সত্তায় সঞ্চারিত করে তার ঐশ্বর্য ও গভীরতা; আত্মদীপ ও অনন্যশরণ হয়ে ওঠে মানুষ। আজকের গোলকধাঁধা তাই এমন বন্দীশালা হতে পারে না যা-থেকে মুক্তি নেই। ভাষায় দীপ্যমান মানুষ কখনও তাৎপর্যরিক্ত হতে পারে না। যা-ই ঘটুক অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে, বাচনের যুদ্ধ অক্ষুণ্ণ থাকবে। এ-সময়ে বাখতিনচর্চা তাই এই যুদ্ধে সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদানেরই অঙ্গীকার। Speech Genres and Other Late Essays থেকে আরও একবার তুলে আনি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চারণমালা: ‘There is neither a first nor a last word and there are no limits to the dialogic context (it extends into the boundless past and the boundless future). Even past meanings that is, those born in the dialogue of the past centuries, can never be stable (finalized, ended once and for all). They will always change (be renewed) in the process of subsequent, future developments of the dialogue. At any moment in the development of the dialogue there are immense, boundless masses of forgotten contextual meanings, but at certain moments of the dialogue’s subsequent development along the way they are recalled and invigorated in renewed form (in a next context). Nothing is absolutely dead; every meaning will have its homecoming festival.’ (১৯৮৬: ১৭০)
এসময় অর্থবোধে পৌঁছানোর সমস্ত পথ যখন আধিপত্যবাদী শক্তি-সমবায়ের দ্বারা আক্রান্ত, বাখতিন-ই হতে পারেন নবায়মান দ্বিরালাপের বহুস্বরিক উৎস। রুদ্ধতা থেকে নতুন উন্মোচনে উত্তীর্ণ হওয়ার দিশা পেতে পারি তাঁর ইঙ্গিতময় চিন্তাবিশ্বে। এভাবেই সময়ের বিভ্রান্তি ও বিদূষণকে কার্যকরী ভাবে মোকাবিলা করতে পারি আমরা, তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও।