বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/ফিঙ্গে
এই পাখী বাংলার প্রাকৃতিক শোভার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। ইহার ঘনকৃষ্ণবর্ণ, ছিপছিপে ঋজু দেহ, কল্কার মত সুদীর্ঘ পুচ্ছ—এবং ক্ষিপ্র, চঞ্চল উৎপতন-ভঙ্গি ইহার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিবেই। অথচ বাঙ্গালী কবিদের প্রকৃতিবর্ণনার মধ্যে এই পাখীর উল্লেখ পাই না। শুধু সতেন্দ্রনাথ দত্ত একটি কবিতায় এর উল্লেখ পাই, তাঁহার “কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল—” কবিতাটিতে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন কোথায় এমন “ফিঙ্গে গাছে গাছে নাচে”। তাঁহার প্রকৃতই সৌন্দর্য্যবোধ ছিল, পর্য্যবেক্ষণ শক্তি ছিল, তাই আমাদের গ্রাম্য প্রকৃতির মধ্যে এই কুচকুচে কালো পাখীটির বেপরোয়া গতিভঙ্গির সুষমা তাঁহার চোখে ধরা পড়িয়াছিল। যাঁহারা রেলপথে যাতায়াত করেন, এই পাখী তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইতে পারে না। কেন না, লাইনের ধারে ধারে, টেলিগ্রাফের তারের উপর বা রেল কোম্পানীর জমির সীমা-নির্দ্দেশক তারের বেড়ার উপর দুই তিনটা খুঁটির ব্যবধানে এক একটি বা এক জোড়া ফিঙ্গে অবশ্য দেখা যাইবে। ইহার দেহায়তন বুলবুল অপেক্ষা অধিক নহে। কিন্তু এর দীর্ঘ পুচ্ছখানির জন্য ইহাকে বড় দেখায়। ইহার পুচ্ছের সব পতত্র সমান নহে, বাহিরের পতত্রগুলি দীর্ঘতম এবং তারপর ভিতর দিকে ক্রমশঃ দুই দিকেই হ্রস্ব হইয়া মাঝখানে আসিয়া হ্রস্বতম হইয়াছে, ফলে পুচ্ছের দুইদিকে কলকার আকার প্রাপ্ত হইয়াছে। এই আর একটি পাখী যাহার স্ত্রী পুরুষ একই রকম দেখিতে।
ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ এই পাখীটির মেজাজ কিন্তু একেবারে আহেল বিলাতী শ্বেতাঙ্গের মত। অপর জাতীয় কোনও পাখী ফিঙ্গে সম্বন্ধে অকারণ কৌতুহল প্রকাশ করিলে অবিলম্বে ফিঙ্গে তাহকে ভদ্রতা শিখাইয়া দেয়। চৌর্য্যকুশল বায়সকে ফিঙ্গে মহাশয় মোটেই সহ্য করিতে পারে না। তাহার বাসার পাশ দিয়া কাককে উড়িয়া যাইতে দেখিলে ফিঙ্গের মেজাজ তিরিক্ষি হইয়া উঠে। ফিঙ্গে দম্পতি তখন মিলিত আক্রমণে সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু ও নখরাঘাতে কাকের পৃষ্ঠদেশ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দেয়। কাক এমনই কাপুরুষ যে সে তাহার অতবড় শরীর সত্ত্বেও ফিঙ্গেকে দেখিতে পাইলে পলাইতে পথ পায় না। ইংরেজ ফিঙ্গেকে “কিং ক্রো” এবং “ব্ল্যাঙ্ক ড্রোঙ্গো” এই উভয় নামে অভিহিত করে। সংস্কৃত বৃহৎ-সংহিতায় কাকবিরোধী “চাষ” পাখীর উল্লেখ আছে। এই “চাষ” সম্ভবতঃ ফিঙ্গে।
জ্যৈষ্ঠমাসের প্রারম্ভ হইতে ফিঙ্গে নীড় নির্ম্মান আরম্ভ করে। খুব উচ্চ গাছের মাঝামাঝি বা উপরদিকের দুইটি শাখার সন্ধিস্থলে ডালের উপর ইহারা নীড় স্থাপন করে। ইহাদের বাসা শূন্যে দোদুল্যমান হয় না। কিছু শুষ্ক ঘাস, খুব সূক্ষ্ণ লতাতন্তু শিকড় একত্র করিয়া ডালের উপর গদির মত সাজায়। তারপর মাকড়সার জালের মিহিতন্তু জোগাড় করিয়া এই গদিটিকে তদ্বারা জড়াইয়া ডালের সঙ্গে আঁটিয়া বাঁধে। অবশেষে উক্ত গদির উপর ফিঙ্গে ও ফিঙ্গেজায়া উভয়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া শরীরের চাপে উহাকে ঠাসিয়া মাটির প্রদীপের মত একটি ছোট আধার প্রস্তুত করে। এই আধারটি ফিঙ্গেজায়ার আঁতুড় ঘর হয়। তিনি ইহার মধ্যে তিন চারিটি শুভ্র বা ঈষৎ লাল আভাযুক্ত ডিম পাড়েন। ডিমের গায়ে অতি ক্ষুদ্র রক্ত বা বাদামী বর্ণের ছিটে থাকে।
সন্তানজননের সময় ফিঙ্গের স্বভাবতঃ রুক্ষ্ম মেজাজ আরও রুক্ষ্ম হইয়া উঠে। এই সময়ে সে এমন দুর্দ্ধর্ষ হয় যে চিলের মত বড় ও হিংস্র পাখীকেও বাসার কাছে দেখিলে ধাওয়া করে। বাংলার ব-দ্বীপে জলাস্থানে মাছধরা বাজ (ফিসিং ঈগল) আছে। এগুলি প্রকাণ্ড পাখী। সন্ধ্যাসকালে ও গভীর রাত্রে ইহাদের উচ্চ চিৎকারধ্বনি আকাশ প্রকম্পিত করিয়া তোলে এবং বালক ও শিশুদের অন্তরে আতঙ্কের সঞ্চার করে। যশোর ফরিদপুর অঞ্চলে ইহাকে বজরইলা বলে। সংস্কৃত সাহিত্যে ইহার নাম কুরর। ফিঙ্গে অনেক সময় এই অতিকায় পাখীকেও আক্রমণ করিয়া থাকে। ছোট ছোট পাখীর তে কথাই নাই। হয় তো কোন একটি ছোট পাখী একটি কীট আহরণ করিয়া খাইবার উপক্রম করিয়াছে; ফিঙ্গে তাহা দেখিতে পাওয়া মাত্র সশব্দে পাখীটিকে আক্রমণ করে। বেচারী পাখীটি প্রাণভয়ে মুখের গ্রাস ফেলিয়া পলায়ন করে এবং ফিঙ্গে অতিশয় অম্লানবদনে পরিত্যক্ত কীট উদরসাৎ করে। ইহাতে মোটেই সে বিবেকের দংশন বোধ করে না। পুলিশপুঙ্গবের মতই নিরীহ মানুষের উপর তন্বী করিতে ইহারা পটু। এবং এই সাদৃশ্যের জন্য অনেক স্থানে বিশেষতঃ দক্ষিণাত্যে ইহার নাম “কোতোয়াল” পাখী।
যদিও অনেক সময় ছোট ছোট পাখীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া আত্মসাৎ করা অভ্যাস, তবু অনেক দুবৃত্ত পাখীকে জব্দ করিয়া রাখে বলিয়া ছোট পাখীরা ইহার প্রতি কৃতজ্ঞ। সেইজন্য প্রজননকালে অনেক দুর্ব্বল পাখী ফিঙ্গে যে গাছে বাসা বাঁধে, সেই গাছেই কিংবা তাহার সন্নিকটস্থ বৃক্ষে নিজেদের নীড় বাঁধিয়া গৃহস্থালী পাতিয়া নিশ্চিন্ত বোধ করে। দু’একটা কীট পতঙ্গ কাড়িয়া খাইলেও, অন্য কোনওরূপ অত্যাচার ফিঙ্গে করে না। সুতরাং ফিঙ্গের প্রতিবেশীরূপে তাহারা নির্ব্বিঘ্নে ঘরকন্না করে। বিশেষ করিয়া দেখিবেন—হল্দে পাখী ফিঙ্গে যে গাছে বাসা বাঁধে সে গাছ ছাড়া অন্য গাছে নিজ নীড় স্থাপন করে না।
ফিঙ্গে নানারকম স্বর কণ্ঠ হইতে বাহির করিতে পারে। তন্মধ্যে কতকগুলি স্বর বেশ সুমিষ্ট। বিশেষতঃ বর্ষাকালে ফিঙ্গের গলা বেশ মনোহর হয়। প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মত ফিঙ্গে অল্প নিদ্রাতেই সন্তুষ্ট। অনেক রাত্রে সে শয়ন করে (কথাটা ঠিক হইল না—পাখীরা শয়ন করে না, তবে নিদ্রা যায়) এবং অতি প্রত্যুষেই নিবাসবৃক্ষ পরিত্যাগ করিয়া শিকার সন্ধানে বাহির হয়।
ফিঙ্গে পাখীও স্নান করিতে খুব ভালবাসে। ঠিক মাছরাঙার মত ইহাও উড়িতে উড়িতে সহসা বেগে জলমধ্যে নিপতিত হইয়া ক্ষণপরেই উত্থিত হয়। ছোট ছোট মাছও সে এইরূপে ধরিয়া সে আহার করে। তবে কীটপতঙ্গই ইহার আহার্য্য। নানারূপ উড়ন্ত পতঙ্গের পশ্চাতে ধাবিত হইয়া ঘুরিয়া ডিগবাজী খাইয়া যে ভাবে ইহা শিকার ধরে তাহা দেখিবার বিষয়। ফিঙ্গে কদাচিৎ জমির উপর শিকার ধরিতে আসে, তবে একেবারে যে আসে না তাহা নহে। গবাদি পশুর পৃষ্ঠদেশে বসিয়া ফিঙ্গে শিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে ভালবাসে। গরু মহিষ যখন মাঠে ঘাস খায় তাদের বৃহৎ শরীরের পদতাড়নায় অনেক কীটপতঙ্গ ভূমি হইতে উত্থিত হয়, সেগুলি সহজলভ্য হয় বলিয়া সে এরূপ করে। শালিক, বক প্রভৃতি পাখী গরুর আশেপাশে পিছনে পিছনে হাঁটিয়া এই সব পতঙ্গাদি শিকার করে। ফিঙ্গে গোমহিষের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া সে কার্য্য করে। সুদীর্ঘ পুচ্ছটির জন্য ভূমিতে স্বচ্ছন্দবিচরণ ইহার পক্ষে সম্ভব হয় না।
ইহারা শস্য হানিকর কীটাদি ভোজন করে, শস্যের উপকারী পোকা আদৌ স্পর্শ করে না। শস্যের ক্ষতিকর পোকা এরা এত অধিক ধ্বংস করে যে ইহারা সত্যই মানুষের বন্ধু হিসাবে গণ্য হইবার উপযুক্ত। ইহাকে খাঁচায় ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা বা হত্যা করা মানুষের স্বার্থের পক্ষে কল্যাণকর নহে।
“কেশরাজ” ও “ভীমরাজ” নামে ফিঙ্গের দুটি জ্ঞাতি আছে। প্রথমটি বোধহয় আংশিক যাযাবর এবং মাথায় ঝুঁটি তাহার বিশেষত্ব। ভীমরাজকে খাঁচার পাখীরূপে দেখা যায়। ইহারা হরবোলা পাখী, তাই তাহাদের আদর। ইহা পরিচিত পাখী নহে, কেননা সুন্দরবনের অরণ্যমধ্যে বা পার্শ্বে এবং নিম্ন পর্ব্বতমালার বনানীমধ্যেই ইহাকে দেখিতে পাওয়া যায়।
ফিঙ্গে এত পরিচিত পাখী এবং এত অধিক সংখ্যায় পাওয়া যায় যে ইহার ছবি আমরা এ পুস্তকে সন্নিবিষ্ট করিলাম না।