বিষয়বস্তুতে চলুন

বাঙ্গলার পরিচিত পাখী/হুপো

উইকিসংকলন থেকে


৮২ পৃঃ
হুপো
হুপো

 ঘন পল্লববীথির মধ্যে আত্মগোপন করিয়া বেড়ায় না, অথচ হল্‌দে পাখীর মতই বর্ণসুষমাসম্পন্ন আর একটি পাখী আমাদের দেশে আছে। ইহার ইংরাজী নাম হুপো এবং হিন্দী নাম “হুদ্‌ হুদ্‌”। শব্দটি আরবী ভাষা হইতে আসিয়াছে কেন না প্রাচীন আরবে এ পাখীর অত্যন্ত কদর ছিল। রাণী শেবা যখন রাজা সলোমলের মনোহরণ করিতে গিয়াছিলেন, তখন তাঁর উপঢৌকনের মধ্যে একটি “হুদ হুদ” পাখীই শ্রেষ্ঠ উপঢৌকন হিসাবে সলোমন কর্ত্তৃক বিবেচিত হইয়াছিল। ইহার বাংলা নাম কি আমি জানিনা। উত্তর, পূর্ব্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গে সর্ব্বত্রই ইহাকে দেখিয়াছি। সর্ব্বত্রই ইহার নাম স্থানীয় লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করিয়াছি। বেশীর ভাগ লোকই ইহাকে কাঠঠোকরা বলিয়া চালাইতে চেষ্টা করিয়াছে। কেহ কেহ কাদাখোঁচা বলিয়াছে; তাহার কারণ এই যে ইহার চঞ্চুটি দীর্ঘ। কিন্তু এই চঞ্চু ঈষৎ বক্র এবং সূচাল; কাঠ ঠুকরাইবার মত মোটেই সুদৃঢ় নহে। ইহাকে কাঠে ঠোকরাইতে দেখাও যায় না। মাটি খুঁচিয়া বেড়ানই ইহার অভ্যাস। আমাদের পর্য্যবেক্ষণ শক্তি যে কিরূপ ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে তাহা আমি অনেক স্থানে পাখীর নাম জানিবার চেষ্টার সময় উপলব্ধি করি। যাই হোক, হিন্দী নামটি একটু শ্রুতিকটু বলিয়া মনে হয়। তাই ইংরেজী নামটিই চালাইবার চেষ্টা করিলাম।

 বাংলার সর্ব্বত্রই ইহাকে পাওয়া যায় সুতরাং ইহাকে চিনিয়া লইতে কাহাকেও বেগ পাইতে হইবে না। জনবিরল পল্লীপ্রান্তেও ইহাকে পাওয়া যায়, আবার জনবহুল নগর মধ্যেও ইহাদের অবাধ গতিবিধি আছে। ইহার মস্তক, কণ্ঠ, স্কন্ধ, বক্ষ ও নিম্নদেশ ফিকে বাদামী বর্ণের। সমস্ত পৃষ্ঠদেশ জুড়িয়া ডানাদুটির উপর বেশ চওড়া কতকগুলি সাদা ও কালো রেখা। ইহার বিশিষ্টতা ইহার মস্তকের শিরোশোভায়। জমির উপর যখন সে বেশ নিশ্চিন্ত মনে বিচরণ করে তখন ইহার সুদীর্ঘ ঝুঁটিটি সঙ্কুচিত হইয়া পৃষ্ঠের সহিত সমান্তরাল ভাবে মাথা হইতে খানিকটা পিঠের উপর বাহির হইয়া থাকে। একটু ত্রস্ত বা সচকিত হইবার কারণ ঘটিলেই এই ঝুঁটি খাড়া হইয়া পাখার মত বিস্তৃত হইয়া পড়ে। তখন আর উহাকে ঝুঁটি বলা চলে না, মুকুট বলিতে হয়। এই ঝুঁটির অগ্রভাগ ঘন কৃষ্ণবর্ণের হওয়ায় দেখিতে মনোহর।

 কতকগুলি পাখী আছে যাহারা শুধু দেখিতে সুন্দর নহে, তাহাদের চালচলন, ভাবভঙ্গীও খুব কৌতুহলোদ্দীপক। “হুপো” সেইরূপ পাখী।

 ইহার আহারসংগ্রহ প্রণালী অতিশয় অভিনব। মাঠের উপর ক্ষিপ্র চঞ্চল পদক্ষেপে চলিতে চলিতে কোনও স্থানে ইহার সুচাগ্র চঞ্চুদ্বারা মাটি খোঁচাইতে আরম্ভ করে। এইভাবে খোঁচাইয়া দীর্ঘ চঞ্চুটি মাটির ভিতর অনেকখানি প্রবেশ করাইয়া পোকা টানিয়া বাহির করিয়া আহার করে। ইহারা সম্পূর্ণ আমিষাশী পাখী, মিক্‌সড ডায়েটে ইহারা বিশ্বাস করে না। চাষের ক্ষতিকর কীটাদি ইহা বেশীর ভাগ খায় বলিয়া এদেশের অস্ত্র আইনে ইহাকে হত্যা বা বন্দী করিলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কৃষিপ্রধান প্রাচীন মিশরে এই পাখী অবধ্য ছিল এবং পূজিত হইত। মিশরবাসীদের দেবতা হোরামের মূর্তির সঙ্গে এই পাখীর চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়।

 ইহাদের স্নান করার অভ্যাস খুব বেশী, তবে জলে নহে, ধূলায়। কতকগুলি পাখী আছে যাহারা ধূলায় শরীর ঘর্ষণ করিয়া ও খানিকট বালু বা ধূলা অঙ্গে ছিটাইয়া পরে চঞ্চু দ্বারা অঙ্গ পরিমার্জ্জিত ও পরিষ্কৃত করে। হুপো এইরূপ করে। চড়ুই পাখীরাও ধূলিস্নানে অভ্যন্ত।

 ইহাদের উৎপতনভঙ্গীও অভিনব। সোজা সরল রেখা ধরিয়া ইহার উড়ে না। ঢেউয়ের মত উঠিয়া পড়িয়া অগ্রসর হয়। যদিও খুব বেগে ইহারা উড়ে না, তবু উড়িতে উড়িতে সহসা ডানদিকে বা বাম দিকে বোঁ করিয়া ঘুরিয়া যাইতে পারে—যেন কাহারও হুকুম শুনিয়া “রাইট হুইল” বা “লেফ্‌ট হুইল” করিতেছে।

 “হুপো” বা “হুদ্-হুদ্” এই উভয় আখ্যাই বোধহয় ইহার কণ্ঠধ্বনি হইতে আসিয়াছে। ইহা সর্ব্বদাই ‘উপ-উপ’ এইরূপ একটা শব্দ বাহির করে। এতদ্ব্যতীত ইহাদের কণ্ঠে অন্য কোন ধ্বনি নাই। ইহাদের বর্ণসুষমাই আছে, কণ্ঠসুষমা একেবারেই নাই। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাদের কণ্ঠস্বর কর্কশ নহে।

 ইহারা কোটরে নীড় রচনা করে। যে কোনও একটি গর্ত্ত পাইলেই হয়, তাহা গাছেই হউক কিংবা বাড়ীর দেয়ালেই হউক। তবে দেয়ালের গর্ত্ত পাইলে—গাছ ইহারা পছন্দ করে না। রংপুরে আমার বাসার অন্দর মহলে, উঠানের অপরপারে রন্ধনশালার বহির্ভাগের দেয়ালে ছাদের অব্যবহিত নিম্নে একটি গর্ত্তে এক জোড়া হুপো আসিয়া প্রতি বছর শাবোকৎপাদন করিত। ইহারা খুব ক্ষুদ্র প্রবেশমুখসম্পন্ন গর্ত্ত পছন্দ করে, যাহাতে পক্ষী সমাজের গুণ্ডারা প্রবেশ করিয়া ডিম্ব বা শাবকের অনিষ্ট না করিতে পারে। নিদাঘকালেই ইহারা ডিম পাড়ে। ডিমগুলি ফেনশুভ্র হয় এবং সংখ্যায় ৪।৫টি করিয়া হইয়া থাকে। ডিম পাড়িবার পর স্ত্রী পাখীটি বাসায় প্রবেশ করিয়া ডিম্বোপরি উপবিষ্টা হয় এবং শাবক নির্গত না হইলে সে আর নীড় হইতে বাহির হয় না। এই সময়ে পুরুষপাখীটি অতি যত্ন সহকারে আহার সংগ্রহ করিয়া স্ত্রীকে খাওয়ায়। ইহারা সামাজিক নহে, জোড়ায় জোড়ায় বাস করে। তবে শাবকগুলি বড় হইবার পরও কিছু দিন পিতামাতার সঙ্গে থাকে বলিয়া বৎসরে একটা সময়ে কয়েকটি পাখীকে একত্র দেখিতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে যে হুপোকে দেখা যায় সেটি এখানকার বাসিন্দা— যাযাবর নহে, তবে শীতকালে ভারতবর্ষে ইউরোপীয় যাযাবর হুপোকে দেখিতে পাওয়া যায়। সেই আগন্তুক পাখীটির বাদামী রংটা একটু গাঢ়তর।

 ইহারা মানুষ্যাবাসের কাছাকাছি এমন কি লোকালয়ের মধ্যেও বাস করে। শালিক, চড়ুই বা কাকের মত মানুষের গা ঘ্যাঁসা ইহার নহে। সুতরাং উৎপাত বলিয়া গণ্য হয় না। আমার বাসার মধ্যে যে হুপোজোড়াটি আসিত তাহারা বাড়ীর ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্য বাঁচাইয়া বেশ নিশ্চিন্ত মনে আসা যাওয়া করিত এমন কি উঠানের মৃত্তিকামধ্য হইতে খাদ্য সংগ্রহ করিয়া লইত। আমার মনে হয় দোয়েলের মতই হুপোদম্পতির একজনের মৃত্যু না হইলে পরস্পরকে ইহারা ত্যাগ করে না এবং প্রতি বৎসর একই স্থানে আসিয়া শাবক উৎপাদনের কার্য্য করিয়া থাকে। এই পুস্তকে যে চিত্র দেওয়া হইল আশাকরি তাহা হইতেই পাঠকের ইহাকে চিনিয়া লইতে অসুবিধা হইবেনা।