বিষয়বস্তুতে চলুন

বাঙ্গালীর প্রতিভা ও সুভাষচন্দ্র/ধর্ম্মালোচনা

উইকিসংকলন থেকে

ধর্ম্মালোচনা

 সুভাষচন্দ্র ১৪ বৎসর বয়ঃক্রমকালে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধর্ম্মপ্রাণতা তিনি তাঁহার মাতার নিকট হইতেই প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। স্কুল পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই সুভাষচন্দ্রের এইরূপ একদল বন্ধু ছিলেন, যাঁহারা রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ অনুসারে ধর্ম্মজীবন যাপন করিতে ইচ্ছুক ছিলেন। সুভাষচন্দ্র যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন তখন তিনি তাঁহার অধিকাংশ সময় দরিদ্র নারায়ণের সেবায়, পীড়িতের শুশ্রুষায় এবং দুঃখীর দুঃখমোচনে ব্যয় করিতেন। তিনি রামকৃষ্ণ কথামৃত, স্বামী বিবেকানন্দের গ্রন্থাবলী এবং অন্যান্য ধর্ম্মগ্রন্থ পাঠ করিতেন এবং মাতার সহিত ধর্ম্মালোচনা করিতেন। এই সময়ে তিনি শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ শিক্ষক বেণীমাধব দাসের সংস্পর্শে আসেন। তিনি সুভাষচন্দ্রের জীবনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন।

 ইংরাজিতে একটী প্রবাদ বাক্য আছে—“Child is the father of man” (বাল্যজীবন ভবিষ্যৎ-জীবনের আলেখ্য)। বড় হইয়া সুভাষচন্দ্র যে একজন মহামানব হইবেন, তাহার বাল্যকালে অনেকেই তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। মহৎব্যক্তির জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করিলে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব হয়। মহারাষ্ট্রবীর শিবাজী বাল্যকালে মহাভারতের রাজাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনী শুনিতে ভালবাসিতেন। পরিণত বয়সে তিনি একজন দিগ্বিজয়ী বীর হইয়াছিলেন। বিখ্যাত ফরাসীবীর নেপোলিয়ন বাল্যকালে বরফের গোলাগুলি লইয়া কৃত্রিম যুদ্ধের অভিনয় করিতেন। পরিশেষে তাঁহার বীরত্বের কাহিনী দিগদিগন্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। বাঙ্গালার বাঘ আশুতোষের অধ্যয়ন স্পৃহা বাল্যকালে অত্যন্ত বলবতী ছিল। তাঁহার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা, দমন করিবার জন্য তাঁহার পিতা ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ তাহাকে একদিন গৃহমধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে গৃহদ্বার উন্মুক্ত করিলে দেখা গেল, বালক আশুতোষ একখানি কয়লার সাহায্যে দেওয়ালে ছবি আঁকিয়া জ্যামিতির কয়েকটী দুরূহ প্রতিজ্ঞার সমাধান করিয়াছেন। বড় হইয়া তিনি গণিতশাস্ত্রের একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হইয়াছিলেন।

 সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীবাবু প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেন। সমস্ত পরিবারবর্গের চালচলনে পূর্ণ মাত্রায় সাহেবিয়ানা বিদ্যমান ছিল। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে, ২৪-পরগণার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রাম জানকীবাবুর পৈত্রিক নিবাস। পূজার সময়ে জানকীবাবু সপরিবারে দেশের বাড়ীতে আসিতেন। রেলপথে আসিবার সময়ে মহিলাদের জন্য প্রথম শ্রেণীর টিকিট লওয়া হইত। জানকীবাবু নিজে পুত্রগণকে লইয়া দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাতায়াত করিতেন। কিন্তু বালক সুভাষচন্দ্রের প্রকৃতি অন্য উপাদানে গঠিত ছিল। তিনি তৃতীয় শ্রেণী ভিন্ন অন্য কোনও শ্রেণীতে ভ্রমণ করিতে চাহিতেন না। সুতরাং তাঁহার। জন্য একখানি তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট ক্রয় করিতে হইত।

 বালক সুভাষের প্রথম শিক্ষা হয় প্রটেষ্ট্যাণ্ট স্কুলে। বাড়ীর ছেলেরা সকলেই সাহেবী পোষাক পরিয়া স্কুলে যাইত। সুভাষচন্দ্রও সাহেবী পোষাকে সজ্জিত হইয়া স্কুলে যাইতেন। কিন্তু এই স্কুলে বেশী দিন তাঁহার মন টিকিল না। তিনি পিতাকে অনুরোধ করিয়া কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে আসিলেন। সেখানে বাঙ্গালী, উড়িয়া, মাদ্রাজী সকলেই তাহার দেশের ছেলে। তাঁহাদের পোষাক পরিচ্ছদ সাদাসিধা। শিক্ষকগণের শিক্ষার ধারাও জাতীয় প্রকৃতির অনুকূল। এই সব দেখিয়া শুনিয়া তাহার মনে জাতীয় ভাব জাগিয়া উঠিল। তিনি বিজাতীয় পোষাক পরিচ্ছদ ত্যাগ করিবার সংকল্প করিলেন।

 এই সংকল্প করিবার পরদিন তিনি দেশীয় পরিচ্ছদ ধুতি জামা পরিয়াই স্কুলে গেলেন। ‘জানকী সাহেবের’ ছেলেকে এইভাবে দেশীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত দেখিয়া শিক্ষক ও ছাত্র সকলেই বিস্মিত হইল। জানকীবাবু পরে এই ব্যাপার অবগত হইয়া সুভাষচন্দ্রকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সুভাষচন্দ্র নির্ভীক কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “বাবা, এই ত আমাদের জাতীয় পোষাক। প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রগণ সকলেই ত এই পোষাক প’রে স্কুলে আসেন। আমার কি উচিত সেখানে সাহেব সেজে যাওয়া?” উত্তর শুনিয়া জানকীবাবু স্তম্ভিত হইলেন। তিনি আর কোন প্রতিবাদ করিতে পারিলেন না। সুভাষচন্দ্রের বাল্যকাল এই ভাবেই গঠিত হইয়াছিল।