বিষয়বস্তুতে চলুন

বিবিধ কথা/বাঙালীর অদৃষ্ট

উইকিসংকলন থেকে

বাঙালীর অদৃষ্ট

 বাঙালী জাতির পূর্ব্ব-ইতিহাস যতটুকু চোখে পড়ে, তাহা হইতে ইহাই মনে হয় যে, ব্যবহারিক জীবনের কোনও বৃহৎ সমস্যা এই জাতিকে কখনও কর্ম্মমন্ত্রে দীক্ষিত করে নাই; উর্ব্বর পলি-মৃত্তিকা ও বালুচরের উপর সে কখনও সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠাভূমি নির্ম্মাণের প্রয়াস করে নাই। জীবনের দিকটা কোনও রূপে নির্ব্বিঘ্ন হইলেই হইল; সংসার, সমাজ ও ধর্ম্মায়তনে যেখানে যেমন প্রয়োজন—দৃঢ়তা ও শৈথিল্য, নিয়মনিষ্ঠা ও ভাবাবেগ, তাহার জীবনে সমান মাত্রায় প্রশ্রয় পাইয়াছে। কল্পনা ও কূটতর্ক তাহার প্রাণের আরাম-স্থল, সেইখানে কোনও বাধা না ঘটিলেই হইল; সমাজে বা রাষ্ট্রজীবনে নব্যন্যায় ও নব্যস্মৃতির উদ্ভাবনা তাহাকে শান্ত ও সন্তুষ্ট রাখিয়াছে, তাহার মনোবৃত্তির উল্লাস ওইখানেই সমাপ্ত হইয়াছে—বাস্তবজীবনে ইহার অধিক কিছু করিতে হইলে মনোজীবনের শান্তি নষ্ট হয়! কিন্তু বিধাতা তাহার ধাতু-প্রকৃতির মধ্যে একটা নিদারুণ উৎপাতের বীজ নিহিত রাখিয়াছেন—বস্তুচেতনার দিকে সে যেমন অলস, ভাব-চেতনার দিকে সে তেমনই চঞ্চল ও স্পর্শকাতর। মার্জ্জিত ও সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তি তাহাকে যেমন কর্ম্মবিমুখ, উদাসীন—জীবনযাত্রার যাবতীয় ব্যাপারে হৃদয়হীন করিয়া রাখিয়াছে, সে যেমন পল্লীসমাজের গণ্ডির মধ্যে পর্ণকুটীর আশ্রয় করিয়া অর্দ্ধনগ্ন দেহে যুগের পর যুগ কাটাইয়া দিতে পারে, অতিশয় ক্ষুদ্র বস্তুকেও বৃহৎ সমস্যার বিষয় করিয়া তাহারই সমাধানে পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারে, বসন-ভূষণ-বিলাসকে তুচ্ছ করিয়া একান্নবর্ত্তী পরিবারের শত মশকদংশন উপেক্ষা করিতে পারে, সংসারকে নিরাপদ করিবার জন্য নারীর নারীত্ব লুপ্ত করিয়া তাহার মাতৃত্বের আশ্বাসে আপনার পৌরুষ-বীর্য্য স্তম্ভিত করিয়া তামসিক তৃপ্তি উপভোগ করে,—তেমনিই, আর এক দিকে প্রবল ভাবাতিরেকের উত্তাপে সে শুষ্ক ইন্ধনের মত জ্বলিয়া উঠে; তখন তাহার নিশ্চিন্ত নিদ্রার ব্যাঘাত হয়, অপূর্ব্ব স্বপ্নাবেশে সে স্বপ্নসঞ্চরণ করিতে থাকে। এই স্বপ্নের আবেশে সে কুটীর হইতে নিষ্ক্রান্ত হয়,এবং দিগন্তবিসর্পী পল্লীপ্রাঙ্গণে—কখনও বজ্রবিদ্যুৎ, কখনও অবারিত জ্যোৎস্নার উদ্দীপনমন্ত্রে—সে জাগর-স্বপ্নে বিভোর হয়; আবার স্বপ্ন হইতে সুষুপ্তিতে ফিরিয়া আসে। বাঙালীর যাহা কিছু ঐতিহাসিক পরিচয় তাহা এই ভাববিপ্লবের কাহিনী। এক একটা ভাবের ধাক্কায় সে যাহা কিছু করিয়াছে তাহাই তাহার এক মাত্র কীর্ত্তি। সে রাজনীতি অর্থনীতির সেবা করে নাই, নগর পত্তন করে নাই, ব্যবসায় বাণিজ্যের দ্বারা শস্যশ্যামলা দেশলক্ষ্মীকে মণিমাণিক্যভূষণা করিয়াছে বলিয়াও শোনা যায় না—অন্তত কবিকাহিনীর বাহিরে। কিন্তু এমন কথা ঐতিহাসিকের মুখেও শোনা যায় যে, কোনও নূতন ভাব বা আইডিয়ার আবেগে সে ঘর ছাড়িয়াছে, হিমালয় লঙ্ঘন করিয়া তিব্বতে চীনে সে মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়াছে; সমুদ্র পার হইয়া ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে—তালীবন ও লবঙ্গলতার দেশে—সে তাহার প্রাণের সৌরভ ছড়াইয়াছে। ভারতের ইতিহাসে রাজবংশ বা রাজসিংহাসনের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালীজাতির অভ্যুদয়কাহিনী কতটা জড়িত আছে, রাষ্ট্র-বিপ্লবের তরঙ্গচূড়ায় বাঙালীর নগ্নশির কোথায় কতগুলি দেখা দিয়াছে, এবং দিলেও তাহার ফলে বাঙালীর সৃষ্টিশক্তি বা সংগঠনী প্রতিভা কতখানি বিকাশ লাভ করিয়াছে—বলা দুরূহ; কিন্তু ভাবরাজ্যের ভাঙন-প্লাবনের ফলে তাহার অলস কর্ম্মকুণ্ঠ মন ও বৈভব-বিমুখ, স্বাচ্ছন্দ্যলোলুপ প্রাণ যে প্রয়াস-প্রযত্নের পরিচয় দিয়াছে, তাহাতে বাঙালীর সঙ্গন্ধে এমন কথা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে যে, ভাবজীবনই এই জাতির সত্যকার জীবন; সমাজে বা রাষ্ট্রে সে কোনও রূপে টিঁকিয়া থাকিতে চায়, সেখানে তাহার কোনরূপ আত্মপ্রসারের চেষ্টা নাই, সেখানে তাহার প্রকৃতি অতিশয় স্থিতিস্থাপক—ভাবের ধাক্কা ভিন্ন আর কোনও প্রয়োজনে সে সাড়া দেয় না। এজন্য—অলস, আত্মতৃপ্ত, নিরুৎসাহ, তর্কপ্রিয়, বচন-বিলাসী—প্রভৃতি বিশেষণের সে যথার্থই উপযুক্ত।

 মুসলমান আমলের পূর্ব্বে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের কোনও নিদর্শন নাই। দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে যখন বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব হইল, তখন হইতেই এই জাতির একটা স্বতন্ত্র সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার পূর্ব্বে এই জাতির, রক্ত, ভাষা, এমন কি, তাহার বাস্তুসীমান্তের পরিচয় পর্য্যন্ত অনুমানসাপেক্ষ। বৌদ্ধ-প্রভাব ও নবহিন্দুত্বের অভ্যুত্থান প্রভৃতির মধ্য দিয়া এই জাতির প্রকৃতি কেমন ভাবে গড়িয়া উঠিতেছিল; জল, বায়ু, রক্ত ও ভাষার নানা উপাদানে একটা নূতন race-type কেমন করিয়া ক্রমশ গড়িয়া উঠিল; এবং অবশেষে মুসলমান প্রভাবের পীড়নে সেই মিশ্রতরল উপাদানরাশি—যাহা এতকাল কেবল ভাববাষ্পের চাপে নানা আকারে উদ্বেলিত হইয়া উঠিতেছিল—তাহাই কেমন করিয়া শেষে দানা বাঁধিয়া কতকটা জমাট হইয়া উঠিল, সে ইতিহাস এখনও উদ্ধার হয় নাই। যতদিন সে ইতিহাস উদ্ধার না হইতেছে ততদিন অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া কোনরূপে একটা করকোষ্ঠী নির্ণয় করা ভিন্ন গত্যন্তর নাই। আর্য্যের ইতিহাস বাঙালীর ইতিহাস নয়; অন্য প্রাদেশিক জাতি হইতে সর্ব্ববিষয়ে তাহার স্বাতন্ত্র্য অতিশয় পরিস্ফুট। বেদ-বেদান্ত-ষড়দর্শনের মনীষা, ভাস-কালিদাস-ভবভূতির প্রতিভা, অজন্তা-কোণারক-খণ্ডগিরির শিল্পচাতুর্য্য বাঙালীর পরিচয়-পত্র নয়। গত আট শত বৎসরের বাংলা ও বাঙালীর সংস্কৃত-চর্চ্চার ইতিহাসে তাহার যে পরিচয় আছে, এবং তাহার সম্বন্ধে যে সকল প্রাচীনতর কীর্ত্তির প্রবাদ বা প্রমাণ আছে, সেই সকলের সহিত—আজও পর্য্যন্ত তাহার ধর্ম্ম ও সমাজ-জীবন, পূজা-পার্ব্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠান, গান ও গাথায় তাহার জাতীয় সাধনার যে ধারাটি লুপ্ত হইয়াও হয় নাই, তাহা মিলাইয়া বাঙালীর যে অন্তরঙ্গ পরিচয়টি ফুটিয়া উঠে, তাহাই বুঝিয়া লইতে হইবে। তথাপি মনে হয়, বহুজাতির রক্ত-মিশ্রণের ফলে বাঙালীর চরিত্রে একটা অস্থিরতা আছে; অতিশয় বিভিন্ন ও বিচিত্র প্রকৃতির বহুবিরোধী সংস্কার একত্র হওয়ায় তাহার স্বভাব—চারিত্র্যের একনিষ্ঠা অপেক্ষা, আত্মহারা ভাববিলাসের অনুকূল। এই ভাবজীবনের স্ফূর্ত্তিতে সে প্রথম প্রচণ্ড বাধা পাইয়াছে মুসলমান-অধিকার কালে। মুসলমান ধর্ম্মের মধ্য দিয়া যে রুক্ষ কঠিন সেমিটিক কাচারের সঙ্গে তাহার প্রাণমনের সংঘর্ষ ঘটিল, তাহাতে তাহার প্রথম স্বপ্নভঙ্গ হইল। সমাজে ধর্ম্মজীবনে, বা ভাব-সাধনায় সে এই নূতনের সঙ্গে কোনও দিক দিয়া আত্মীয়তা স্থাপন করিতে পারে নাই—তাহা এতই পৃথক, এতই অনাত্মীয়। মুসলমান সমাজের সংঘবদ্ধতা, সে ধর্ম্মের অতিশয় বাস্তব ব্যবহারিক আদর্শ—ভাব ও কল্পনার পরিবর্ত্তে বিশ্বাসের শাসন—এই সকলের সম্মুখে তাহার জাতীয় জীবনের বিকাশপথ কতকটা রুদ্ধ হইয়া আসিল। প্রায় ছয় শত বৎসর ধরিয়া বাঙালী আপনার সমাজ, ধর্ম্ম ও ভাষাকে এই একাস্ত অনাত্মীয় পরধর্ম্মের সংঘাত হইতে বাঁচাইবার চেষ্টায় ব্যাপৃত হইয়া রহিল। এই কালে সে আপনার ধারা ত্যাগ করিয়া প্রাচীন ভারতীয় ভাব, ভাষা ও চিন্তাকে অবলম্বন করিয়া অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হইয়া উঠিল; তাহার নিজস্ব স্বপ্ন-কল্পনার ভাবাবেগ—ভারতীয় সাহিত্য, দর্শন ও সমাজনীতির আদর্শে—একটা নূতন আকার ধারণ করিল। ইতিমধ্যে তাহার নিজ ভাষা গড়িয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে ভাষায় প্রবল প্রাণের স্ফূর্ত্তি নাই; পাঁচ শত বৎসরেও এমন একজন কবি জন্মিল না যাহার বাণীতে হিমালয়ের বিরাট গাম্ভীর্য্য অথবা বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গোচ্ছ্বাস প্রতিফলিত হইতে দেখা যায়। এককালে পৃথিবী যাহার গৃহপ্রাঙ্গণ ছিল, গিরিলঙ্ঘন ও সমুদ্রপারাপার যাহার নিত্যকর্ম্ম ছিল, সে এক্ষণে আম্রবনচ্ছায়ে সুপ্ত, গুপ্ত, অথবা লুপ্ত হইয়াই রহিল! তাহার গানে ছন্দের পক্ষবিস্তার নাই, তাহার কাব্যে কল্পনার নিরুদ্দেশ-যাত্রা নাই। কতকগুলি গ্রাম্য-গীতি ও গাথা, এবং গৃহদেবতার মহিমাবর্ণনই তাহার প্রতিভার শেষ নিদর্শন। মনে হয়, এ কোন্ জাতি? মুসলমান-পূর্ব্ব ইতিহাসে, বৌদ্ধ-হিন্দুর নবসমন্বয়ের যুগে, যে জাতির নানা কীর্ত্তির স্পষ্ট ও অস্পষ্ট সংবাদ ঐতিহাসিকের বিস্ময় উৎপাদন করে—সেই জাতি, অবশেষে, এক দিকে তাহার স্বাধীন ভাব-সাধনা গুহ্য তান্ত্রিক অনুষ্ঠানে চরিতার্থ করিতেছে; অপর দিকে আত্ম-বিশ্বাস হারাইয়া, জাতি-ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিয়া, সমাজে, ধর্ম্মে ও চিন্তাপদ্ধতিতে ব্রাহ্মণ্য আদর্শের প্রতিষ্ঠায় উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে! সংস্কৃত ভাষায় তাহার নিজ ভাষার ভিত-পত্তন হইল বটে, কিন্তু সে ভিত্তির উপরে সাহিত্যের সৌধ-নির্ম্মাণ হইল না। স্বাভাবিক প্রাণ-স্পন্দনের অভাবে নবসৃষ্টির শক্তি নাই, তাই ভাষা-সাহিত্য অতিশয় গ্রাম্য আশা-আকাঙ্ক্ষার উর্দ্ধে উঠিতে পারিল না। কবিত্ব অপেক্ষা পাণ্ডিত্যের গৌরব হইল; প্রাণের উপরে মনের, এবং কল্পনার উপরের বুদ্ধিবৃত্তির জয়লাভ হইল। তাই এ যুগের কীর্ত্তি হইল—নব্যন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সমাজ-দেহের অষ্টপৃষ্ঠে স্মৃতিশাস্ত্রের রক্ষাকবচ বন্ধন, এবং সংস্কৃত কাব্য ও অলঙ্কারের অসাধারণ চব্বিত-চর্ব্বণ। ইহাই বাংলাভাষাভাষী অধুনাতন বাঙালী-জাতির মধ্যযুগের ইতিহাস।

 পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য প্রভৃতির আবির্ভাবে, সর্ব্ববিভাগে বাঙালীর যে প্রতিভার উন্মেষ হইয়াছিল, তাহাকে বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ দেশপ্রেমিক মনীষী বাঙালীরা নবজন্ম বা রেনেসাঁস বলিয়া গর্ব্ব করিয়াছেন। রেনেসাঁস এক হিসাবে বটে, কিন্তু সেই ব্যাপারের মধ্যে দুইটা বিভিন্ন লক্ষণই আছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মুসলমান প্রভাবের তাড়নায় বাঙালী তাহার সমস্ত শক্তি উদ্বুদ্ধ করিয়া আত্মরক্ষার জন্য আর্য্যসংস্কৃতির শরণাপন্ন হইয়াছিল—বোল্‌তা যেমন কাঁচপোকার দৃষ্টিপ্রভাবে বর্ণপরিবর্ত্তন করে, বাঙালীর তখন সেই রূপান্তর উপস্থিত। আবার সেই মুসলমান প্রভাবের ফলেই তাহার অন্তর-চেতনা আর এক দিকে সাড়া দিয়াছিল। ব্রাহ্মণ্য আদর্শমূলক সমাজ-ব্যবস্থা তখন সুপ্রতিষ্ঠিত হইলেও, সেই কঠিন ও কৃত্রিম বর্ণ-বিভাগের অন্তরালে তখনও বৌদ্ধসংস্কার একেবারে লুপ্ত হয় নাই; তাই, মুসলমানধর্ম্মের একটি মাত্র উদার নীতি—তাহার অপূর্ব্ব সাম্যবাদ, মানুষমাত্রের প্রতিই শ্রদ্ধা—তাহাকে ভিতরে ভিতরে অভিভূত করিতেছিল। এই ভাব হিন্দুভাবুকতায় মণ্ডিত ও তান্ত্রিক সহজিয়া তত্ত্বে রঞ্জিত হইয়া একটি বিশিষ্ট ভাবধারার প্রতিষ্ঠা করিল। ইহাই মধ্যযুগের বাঙালীজাতির বাঙালিয়ানার নিদর্শন, ভারতীয় কাল্‌চারে তাহার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দান। শ্রীচৈতন্যেরও এক শত বৎসর পূর্ব্বে মানুষের সুগভীর মনুষ্যত্বই বাঙালী কবির ধ্যানের বস্তু হইয়া উঠিয়াছিল; মানুষের দেহ-মন-প্রাণের রহস্যনিকেতনেই সুন্দর-দেবতার যে অপরূপ লীলা বাঙালী-কবিকে পুলক বিস্ময়ে অভিভূত করিয়াছিল, এবং তাহারই আবেগে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে’র কৃষ্ণতত্ত্ব যে নরত্ব-মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল— ভারতীয় কাব্যে তাহার তুলনা নাই। কিন্তু এই ‘রসতত্ত্ব’ হইতে যে প্রেমধর্ম্মের উদ্ভব হইয়াছিল, তাহার ধারা প্রতিকূল ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবে ভিন্নমুখে প্রবাহিত হইয়া পূর্ণ পরিণতি লাভ করিতে পারে নাই— সে সাধনা জীর্ণ পরিত্যক্ত খোলসের মত আজিও সমাজের অঙ্গে জড়াইয়া আছে। সেই একবার বাঙালী আপনাকে চিনিয়াছিল, তাহার আত্মস্ফূর্ত্তি হইয়াছিল; কিন্তু তাহার সে স্বপ্ন টি কে নাই। তখন শাক্তধর্ম্ম ও ব্রাহ্মণ্য-সংস্কারের প্রয়োজনই ছিল অধিক। মুসলমান ধর্ম্মের প্রবল সংঘাতে তাহার ক্রমাগত কুলক্ষয় হইতেছিল, তাই আত্মরক্ষার জন্য সে যে নীতি ও আদর্শের আশ্রয় লইল, তাহাতে কোনরূপে টিকিয়া থাকিবার উপায় হইল বটে, কিন্তু সত্যকার প্রাণশক্তি বা জাতির প্রতিভার উদ্বোধন আর হইল না। আর্য্যসংস্কৃতির পূর্ণ প্রভাব সত্ত্বেও ধর্ম্মানুষ্ঠান ও সমাজ-ব্যবস্থায় তাহার প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য কতখানি ফুটিয়া উঠিয়াছিল, স্বর্গীয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকটি মৌলিক প্রবন্ধে তাহার আলোচনা করিয়াছিলেন। তথাপি মনে হয়, ব্রাহ্মণ্য আদর্শের শাসন যেন পরধর্ম্মের মতই তাহার স্বাভাবিক স্ফূর্ত্তি রোধ করিয়াছিল। বৈষ্ণবের সেই নর-প্রীতি, সেই পুরাতন অধ্যাত্মবাদ ও তত্ত্বজিজ্ঞাসায় জটিল হইয়া উঠিল। জাতিনির্ব্বিশেষে বৈষ্ণবমাত্রেই পূজনীয় হইলেও, ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজে এই বৈষ্ণবপূজাও ব্রাহ্মণপূজার রূপান্তর হইয়া উঠিয়াছে; এবং এই প্রেমধর্ম্মের ফলে একটা দাস-মনোভাব সমস্ত জাতিকে আচ্ছন্ন করিয়াছে। তাই, এই রেনেসাঁসের মধ্যে বাঙালীর বাঙালীত্বের কতখানি উন্মেষ হইয়াছিল, এই নব-জাগরণ তাহার জীবনকে কতখানি জয়যুক্ত করিয়াছিল তাহা ভাবিয়া দেখিলে, ইহার অন্তরালেও একটা বিপুল ব্যর্থতার প্রমাণ মিলিবে। মনে হয়, এই জাতি যেন আত্মপ্রকাশ করিয়াও করিতে পারে নাই, নানা বিরুদ্ধ শক্তির তাড়নায় সে পরিশেষে বীর্য্যহীন হইয়া পড়িয়াছে—নানা জঞ্জাল ও আবর্জ্জনায় তাহার জীবনস্রোত রুদ্ধ হইয়া সমাজে, সাহিত্যে ও ধর্ম্মে কতকগুলি পল্বলের সৃষ্টি করিয়াছে।

 কিন্তু এ কথাও সত্য যে, ঐতিহাসিক কালের মধ্যে বাঙালী সেই একবার জাগিয়াছিল, এবং সেই একযুগের অর্জ্জিত ভাব-সম্পদ ও সাধনার বলে সে আরও তিন চার শত বৎসর পার হইয়া আসিয়াছে। ইতিমধ্যে এক দিকে মুসলমান শাসনের ফলে সমাজে যে নূতন ধরনের aristocracy-র অভ্যুদয় হইয়াছে, এবং অপর দিকে গুরু-ব্রাহ্মণের যে পূজা ক্রমশ সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে—এক দিকে রাজপূজা ও অপর দিকে ভূদেবতার সম্মান, এই উভয়বিধ সংস্কারের চাপে বাঙালীর ভাবস্বাধীনতা লোপ পাইয়াছে, পূর্ণ আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছে। জাতিহিসাবে সে তখন কান্যকুব্জাগত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বংশধর,—সমুদ্রে বিন্দুবৎ যাহারা মিশিয়া গিয়াছিল, তাহাদের সেই আর্য্য-রক্তের গৌরব গুরু-ব্রাহ্মণ ও aristocracy-র দলকে মোহগ্রস্ত করিয়াছে; জাতির বাকি অংশ যে কি, সে পরিচয়ের প্রয়োজনও নাই—তাহারা কৃতাঞ্জলিপুটে সমাজের এই শীর্ষস্থানীয়দের মুখপানে চাহিয়াই কৃতার্থ। এক দিকে দাস-মনোভাব অস্থিমজ্জাগত, অপর দিকে কৌলীন্য-লালায়িত ভূস্বামী ও শাস্ত্রমর্য্যাদালোলুপ বর্ণ-ব্রাহ্মণ জাতির যে কুলজী প্রস্তুত করিল, তাহাতে বাঙালীর ইতিহাস মুখ্যত উপনিবিষ্ট আর্য্যের ইতিহাস বলিয়াই একটা সংস্কার দাঁড়াইয়া গেল। এই সংস্কার তাহার আত্মরক্ষার সহায়তা করিলেও, তাহার বিশিষ্ট প্রতিভা ও প্রাণ-ধর্ম্মের সঙ্কোচ সাধন করিয়াছে। ব্রাহ্মণ্যসংস্কার, সংস্কৃত সাহিত্য, ও আর্য্যের ইতিহাস বাঙালীকে যেমন এক দিকে রক্ষা করিয়াছে, তেমনই অন্য দিকে তাহাকে হতচেতন করিয়াছে। তথাপি তাহার রক্তের ধর্ম্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, সে স্বাতন্ত্র্য আজিও একেবারে লুপ্ত হয় নাই; তাই প্রায় দুই শত বৎসর পূর্ব্বে বাহির হইতে আবার যে প্রচণ্ড প্রভাবের সূত্রপাত হইল—তাহাতে তাহার মনের দুয়ার-জানালা আবার যখন খুলিয়া গেল, তখন তাহার সেই বহুকাল-মুক্ত অসাড় প্রাণ-ধর্ম্ম আবার এক নবজাগরণে জাগিয়া উঠিল।

 বাঙালী ভাবপ্রবণ, স্বচ্ছন্দ-সুখাভিলাষী, কল্পনাবিলাসী। তর্কশাস্ত্রে তাহার অধিকার যতই অসামান্য হউক, জীবনে সে কোনও উৎকৃষ্ট যুক্তি বা কঠিন নীতির পক্ষপাতী নয়। অতিশয় বিরোধী ভাব ও ভাবনাকে একই কালে প্রশ্রয় দিতে সে কুণ্ঠিত নয়—এ বিষয়ে এমন চরিত্রহীন জাতি বোধ হয় আর কুত্রাপি নাই। সমাজ ও ধর্ম্মে ব্রাহ্মণ্য শাসন স্বীকার করিয়াও সে গোপনে ভাব-তান্ত্রিক, স্বৈরাচার বা নানা অশাস্ত্রীয় গুহ্যসাধনা হইতে কখনও নিবৃত্ত হয় নাই। তাহার স্বভাবে জ্ঞানের সহিত বিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নাই—ভাবই তাহার নিকট একমাত্র সত্য। জ্ঞানের চর্চ্চাতেও সে ভাবের অধীন। এজন্য জ্ঞানমাত্রই তাহার ব্যবহারিক জীবনে ফলপ্রসূ হয় না। জ্ঞানচর্চ্চায়, তর্কবিচারের মস্তিষ্কচালনায়, সে যে আনন্দ পায় তাহা একটা বিলাস মাত্র—সে বস্তু তাহার প্রাণ বা কামনা-বাসনার নিয়ামক নয়, সেখানে সে যুক্তি অপেক্ষা কুযুক্তি, ন্যায়নিষ্ঠা অপেক্ষা মমত্ববোধ, নিয়ম অপেক্ষা অনিয়মের পক্ষপাতী। এই প্রবৃত্তিকে সে এতদিন গোপনে তৃপ্ত করিয়া আসিতেছিল, প্রবল ব্রাহ্মণ্য-শাসনের মধ্যেও সে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কূপ খনন করিয়া তাহার হৃদয়ের পিপাসা মিটাইতেছিল। ইংরেজ শাসন ও ইংরেজী শিক্ষা এই প্রবৃত্তিকে দুই দিক দিয়া আঘাত করিল। ইংরেজের শাসন-ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজের বন্ধন ভিতরে ভিতরে শিথিল হইয়া আসিল, তাহাতে বাঙালীর প্রকৃতগত ভাব-স্বাধীনতা প্রশ্রয় পাইল। অপর দিকে ইংরেজী শিক্ষার মধ্য দিয়া যে যুক্তিবাদ, এবং খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্ম ও নীতির প্রভাবে—যে চারিত্র্যের আদর্শ—তাহার মনকে গভীরভাবে নাড়া দিল, তাহার ফলে তাহার এতদিনের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার আবার নূতন করিয়া জাগ্রত ও উদ্যত হইয়া উঠিল—এই নূতনকে পুরাতনের অধীন করিতে চাহিল। গত এক শত বৎসর ধরিয়া বাঙালীর ভাব-জীবনের ইতিহাসে —ধর্ম্ম ও সমাজ সংস্কারে এবং নব সাহিত্য-সৃষ্টির প্রেরণায়—তাহার যে অন্তর-বিপ্লবের পরিচয় পাওয়া যায়, সেই নবজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাণপণ প্রয়াসের মধ্যে এই দুই বিপরীত প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব ফুটিয়া উঠিয়াছে, এবং মনে হয়, পরিশেষে এই দ্বন্দ্বে অবসন্ন হইয়া সে হাল ছাড়িয়া দিয়াছে।

 পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত বড় প্রভাবে বাঙালী ধরা না দিয়া পারে নাই; ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির সহিত তুলনায় ইহাই তাহার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, ইহাই তাহার শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্ব্বনাশের কারণ। কোনও কিছুকে কঠিন ভাবে ধরিয়া থাকিয়া নূতনের গতিরোধ করা তাহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এ যুগের প্রথম বাঙালী মনীষী রাজা রামমোহন রায়। পৌরুষ ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির গুণে তাঁহার প্রতিভা ছিল অসাধারণ। তাঁহার সেই অসাধারণ মনীষায়, এই নবযুগের সমস্যা একটি অতি বাস্তব ব্যবহারিক রূপে যুক্তিসম্মত সমাধানের বিষয় হইয়া দেখা দিল। বাঙালী জাতির যে বিশিষ্ট প্রকৃতির কথা বলিয়াছি রামমোহনে তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়। রামমোহনের মধ্যে বাঙালীর ব্রাহ্মণ্য সংস্কার তাহার সমস্ত বাঙালিয়ানা হইতে মুক্ত হইয়া, খাঁটি আর্য্যসংস্কৃতির অভিমুখে ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। যুগের পর যুগ ধরিয়া নানা মন্ত্র ও নানা তন্ত্রের সাধনায়, ভারতীয় জাতিসমূহের, তথা বাঙালীর ধাতু-প্রকৃতি যে ছাঁচে গড়িয়া। উঠিয়াছে, রামমোহনের ব্যক্তিত্ব যেন তাহা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি যেন এই ঐতিহ্যের প্রভাব সম্পূর্ণ কাটাইয়া অতি প্রাচীন আর্য্য-মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়াছিলেন। যে sensuous mysticism ঐতিহাসিক হিন্দুসাধনার একটি বিশিষ্ট লক্ষণ, রামমোহনে তাহার আভাস মাত্র নাই— তিনি ঘোরতর যুক্তিবাদী, Pragmatist। তাই, যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার বাঙালীর বহির্জীবনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে, সেই সংস্কারের সংস্কৃতি করিয়া জ্ঞান ও যুক্তিবাদের সাহায্যে তিনি এই জাতির আত্মরক্ষার একটা পথ নির্দ্দেশ করিলেন। কিন্তু এই পথ বাঙালীর জাতি-ধর্ম্মের বিরোধী— একটা সুবিচারিত সত্যের কঠিন বন্ধনে তাহার মন কখনও ধরা দিতে পারে না। রামমোহন বাঙালীর ধর্ম্মবিশ্বাস ও সমাজব্যবস্থার অবনতির দিকটাই দেখিয়াছিলেন, এবং মনে করিয়াছিলেন, বেদ-উপনিষদের সত্যধর্ম্ম হইতে ভ্রষ্ট হইয়াই তাহার এই দশা ঘটিয়াছে। কিন্তু বাঙালী জাতির রক্তের ধর্ম্ম যাইবে কোথায়? বাঙালীর ব্রাহ্মণ্য সংস্কার একটা সংস্কার মাত্র; তাহার জাতিধর্ম্মই তাহার নিয়তি, তাহাকে সে লঙ্ঘন করিবে কেমন করিয়া? এজন্য রামমোহনের ঈপ্সিত বা ইঙ্গিতকৃত যে আদর্শ, বাঙালীর চিন্তাধারায় তাহা কতক পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করিলেও—তাহার প্রাণমূলে শক্তিসঞ্চার করিল না। ষড়দর্শন যেমন তাহার কীর্ত্তি নহে, বেদান্ত ও উপনিষদও তেমনই তাহার মনোধর্ম্ম নহে। নব হিন্দুধর্ম্মের পুরাণ-উপপুরাণের মধ্যে সে কতকটা আত্মতৃপ্তির উপায় করিয়াছিল, তথাপি কোনও একটা তত্ত্বকে সে প্রাণ সমর্পণ করে না; সে ভাবপন্থী, জ্ঞানপন্থী নয়। রামমোহন এই পুরাণ-উপপুরাণের মূলোচ্ছেদ করিয়া হাজার বৎসরের সংস্কারকে উৎপাটন করিয়া যে প্রাচীন আর্য্যধর্ম্মকে, আধুনিক যুক্তিবাদ ও সেমিটিক ধর্ম্মবিশ্বাসের সুকঠিন একেশ্বরবাদের দ্বারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহাতে ভারতের সহিত বহির্জগতের এবং পুরাকালের সহিত আধুনিক কালের একটা রফা-মীমাংসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু ধর্ম্ম তো একটা চিন্তাপ্রণালীর সিদ্ধান্ত নয়—উৎকৃষ্ট উপদেশ বা চরিত্র-সংগঠনী শিক্ষাই ধর্ম্মের সার মর্ম্ম নয়, যুগ প্রয়োজনই তাহার সর্ব্বস্ব নয়। ধর্ম্ম জাতির স্বভাবের অনুকূল হইয়াই তাহার প্রাণের শ্রেষ্ঠ প্রয়াসের প্রতিরূপ-হিসাবে সত্য ও সার্থক হইয়া উঠে। তাই বৌদ্ধধর্ম্ম ভারত হইতে নির্ব্বাসিত হইয়াছে; খ্রীষ্টের ধর্ম্ম আজিও য়ুরোপের ধর্ম্ম হইয়া উঠিতে পারে নাই; ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে ইস্‌লামও বিশেষ ফলপ্রদ হয় নাই, মুসলমান-আগমন হইতে আজ পর্য্যন্ত ভারতীয় জাতিসমূহের মধ্যে ইসলাম কোনও সঞ্জীবনী শক্তির পরিচয় দেয় নাই। বাঙালীর জাতি-ধর্ম্ম এক, আবার সেই ধর্ম্মের সঙ্গে, বহুকাল ধরিয়া ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের দ্বন্দ্ব ও মিলনের ফলে তাহার যে প্রকৃতি দাঁড়াইয়াছে তাহা তেমনই জটিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এই জটিল গ্রন্থিপাশে টান পড়িয়াছে; রামমোহন তাঁহার ক্ষুরধার যুক্তি-তত্ত্বের আঘাতে এই গ্রন্থিপাশ ছিন্ন করিতে চাহিয়াছিলেন, অথবা সকল গ্রন্থি খুলিয়া একটি গ্রন্থি বাঁধিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন। ইহা একপ্রকার অসাধ্য-সাধন বলিয়াই রামমোহনের প্রতিভা প্রতিভাই রহিয়া গিয়াছে, তাহা জাতির একটা মুক্তিপথ—নির্দ্দেশ করিলেও—নির্ম্মাণ করিতে পারে নাই।

 মুক্তিপথ আজিও মেলে নাই, তখনও মিলিবে কি না কে জানে! কিন্তু এ যুগে বাঙালীর সেই জাতি-ধর্ম্ম প্রবল পাশ্চাত্য প্রভাবে আবার সাড়া দিয়াছে—সে আবার ভাবের ঘোরে স্বপ্ন-সঞ্চরণ করিয়াছে। রামমোহনের মধ্যে বাঙালীত্বের পরিবর্ত্তে যে আর্য্য-সংস্কার সজাগ হইয়া উঠিয়াছিল, আর এক দিক দিয়া সেই আর্য্য-সংস্কারের নামে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ যে নব্য-হিন্দুয়ানির স্বপ্ন দেখিলেন, যে ভাবসাধনা ও সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা করিলেন, তাহা কিন্তু আদৌ আর্য্য-সংস্কৃতি নহে, তাহা বাঙালীর নিজস্ব মনীষা ও কল্পনার ফল। বাঙালীর এ যুগের রেনেসাঁসের পুরোহিত এই দুই যুগন্ধর ব্যক্তি। পাশ্চাত্য প্রভাব বিশেষ করিয়া ইহাদেরই মধ্য দিয়াই বাঙালীর ভাব-জীবন উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। নূতনকে গ্রহণ করিয়া আত্মসাৎ করিবার যে প্রতিভা, এবং তদ্দ্বারা— জাতি-ধর্ম্মের অনুযায়ী, অথচ নূতনেরই পূর্ণপ্রভাববিশিষ্ট—একটা আদর্শের প্রতিষ্ঠা তাঁহাদের বাঙালিয়ানার নিদর্শন। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালীর ইতিহাস জানিতেন না, জানিবার জন্য অধীর হইয়াছিলেন, এবং কত মনোহর স্বপ্নই রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রাণ জাগিয়াছিল ইংরেজী আদর্শের প্রভাবে; সে আদর্শের যাহা কিছু উৎকৃষ্ট ও উপাদেয়, বাঙালীসুলভ ভাবগ্রাহিতার বলে তিনি তাহা অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করিয়াছিলেন। যে প্রতিভা পাঁচ শত বৎসর পূর্ব্বে সেই একবার বাঙালীকে এক নূতন স্বপ্নে বিভোর করিয়াছিল, সেই প্রতিভাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালীর ভাবজীবনে আর এক রূপের সন্ধান পাইল। সত্যকে সুন্দরের রূপেই বাঙালী চিরদিন আরাধনা করিয়াছে, সুন্দরের জন্য কূলত্যাগ করিতে তাহার কখনও বাধে নাই। বঙ্কিমের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার তাঁহার বাঙালীত্বকে খর্ব্ব করে নাই—একটি অপূর্ব্ব সেণ্টিমেণ্ট রূপে তাহাকে উজ্জ্বল করিয়াছে মাত্র। ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে এই জাত্যভিমান একটা ইতিহাসকে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিয়াছিল—হিন্দুর ইতিহাসকেই তিনি বাঙালীর ইতিহাস বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। য়ুরোপীয় Renaissanceএর যুগেও নব্য ইটালীয়গণ যে কৌলীন্য-অভিমানের মোহে একটা Latinistic Revival-এর চেষ্টা করিয়াছিল—প্রাচীন রোমানদের ইতিহাস তাহাদেরই ইতিহাস, রোমক কাল্‌চার ও লাটিন ভাষায় তাহাদেরই ন্যায্য অধিকার—এইরূপ “legitimist illusion”-এর বশে নবজীবন লাভ করিতে চাহিয়াছিল, এবং অবশেষে ‘Latin Eloquence’-কেই সেকালের সকল ভাষা ও সাহিত্যের দীক্ষামন্ত্র করিয়া তুলিয়াছিল—অনেকটা সেই ধরনের মোহে বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃতহিন্দু-কাল্‌চারকেই তাঁহার স্বজাতির জন্য দাবি করিয়াছিলেন, এবং Sanskrit Eloquence-এর আদর্শে বাংলা ভাষার অপূর্ব্ব শ্রী ও শক্তি সম্পাদন করিয়াছিলেন; বাংলা সাহিত্যে নব-জীবন সঞ্চারের পক্ষে তাঁহার এই মোহই মুক্তিরূপে জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু তথাপি তাঁহার এই প্রতিভার মূলে ছিল তাঁহার খাঁটি বাঙালী প্রাণ। ভাল করিয়া বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে বুঝা যাইবে যে, বঙ্কিমের এই সাহিত্য-বিগ্রহ এক নব-সৃষ্টি; ইহার উপাদান যাহাই হউক, ইহার সৃষ্টিমূলে বাঙালীর প্রাণই স্পন্দিত হইতেছে। কারণ, এই বিগ্রহের আদর্শ ছিল ইংরেজী, কিন্তু প্রাণ-ধর্ম্মের আশ্চর্য্য মহিমায় এই বিগ্রহের মধ্যেই বাঙালীর ইষ্টমন্ত্র মূর্ত্তিধারণ করিয়াছে। নূতনকে বরণ করিয়া, আত্মসাৎ করিয়া—তাহাকে কেবল তত্ত্বের মধ্যে নয়, একটি ভাব-মূর্ত্তিতে পরিণত করিয়া—সেই নূতনকে আপনার মন্ত্রে আরতি করাই বাঙালীর বাঙালীত্বের নিদান। বঙ্কিমচন্দ্রের সমগ্র সাহিত্য-সাধনায় এই নূতনের আরতি, এই পাশ্চাত্য রস-রসিকতার আবেগ যে কাব্যসৃষ্টি করিয়াছে, এবং হিন্দুদর্শন ও হিন্দুশাস্ত্রের নূতনতর ব্যাখ্যার মূলে তাঁহার যে ভাবদৃষ্টির ইঙ্গিত রহিয়াছে, তাহাতেই নব্য বাঙালিয়ানার প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। অথচ বঙ্কিম এ সকলই ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম্মের নামে উৎসর্গ করিয়াছিলেন—নিজে কখনও একদিনের জন্যও ব্রাহ্মণ্য-গৌরব ত্যাগ করেন নাই। রামমোহনের প্রতিভায় বাঙালীত্ব অপেক্ষা আর্য্যসংস্কার প্রবল; বঙ্কিমের আর্য্য-সংস্কার একটা মোহ মাত্র—তাঁহার কবিত্ব ও দেশাত্মবোধের অবলম্বন; মনে প্রাণে তিনি খাঁটি বাঙালী। রামমোহন জ্ঞানপন্থী, বঙ্কিমচন্দ্র ভাবতান্ত্রিক; তাই বঙ্কিমই তাঁহার স্বজাতির অন্তরে একটা নূতন চেতনা সঞ্চার করিতে পারিয়াছিলেন।

 বাঙালীর এই Renaissance-এর দ্বিতীয় পুরোহিত স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ, রামমোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যপন্থী। বিবেকানন্দের যে তত্ত্বজিজ্ঞাসা ছিল, সে ধর্ম্মমতের জন্য নয়—বাঙালীর ভাবজীবনে শক্তি-সঞ্চারের জন্য; বিবেকানন্দও ভাবুক, তাঁহার চক্ষেও কবিস্বপ্ন। ইংরেজী দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস তাঁহাকে সংশয়বাদী করিয়াছিল; বঙ্কিমের মত ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের মোহ তাঁহার ছিল না; তিনি প্রথম হইতেই একটা আধ্যাত্মিক সঙ্কটে বিপন্ন হইয়াছিলেন—তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা ও সত্য-সন্ধান তাঁহাকে উদ্ভ্রান্ত করিয়াছিল। তিনি প্রথমে সম্ভবত রামমোহনের আদর্শে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার ভাবপ্রবণ চিত্ত তাহাতে তৃপ্ত হয় নাই। সকল বিরোধ-বৈচিত্র্যকে একটা কঠিন ঐক্যতত্ত্বের দ্বারা নিরাকৃত করার যে বিশুদ্ধ জ্ঞানবৃত্তি তাহাকে তিনি বিশ্বাস করিতে পারেন নাই; জীবনকে জীবনের দ্বারাই বুঝিবার—বিচিত্র প্রাণধর্ম্মকে বহুরূপা শক্তির লীলারূপে উপলব্ধি করার যে আশ্বাস, তাহাই তাঁহাকে প্রলুব্ধ করিয়াছিল। এই মন্ত্র-দীক্ষা তিনি পাইয়াছিলেন তাঁহার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে। সহস্রাধিক বৎসরের হিন্দুসাধনার সর্ব্ব বিরোধ ও বৈচিত্র্য যে বাঙালী মহাপুরুষের অলৌকিক ভাবসাধনায় এক অপরূপ সত্যরূপে উদ্ভাসিত হইয়াছিল, বিবেকানন্দের প্রাণ তাঁহার নিকটেই আত্মসমর্পণ করিল। বেদান্তের মায়াবাদ তাঁহাকে বিচলিত করিল না, যাহা শূন্য তাহাই রূপে-রসে পূর্ণ হইয়া দেখা দিল। অদ্বৈতবাদ একটা তত্ত্বমাত্র না হইয়া, মানুষেরই মনুষ্যত্ব-মহিমার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করিল—একটা জীবন্ত ধর্ম্ম-বিশ্বাসের উদ্দীপন-মন্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। এই যে তত্ত্বের সঙ্গে ভাবের, সত্যের সঙ্গে জীবনের অপূর্ব্ব সমন্বয়—ভাবকে রূপময় করিয়া দেখা, ইহার মূলে ছিল সর্ব্বসংশয়ভঞ্জন তাঁহার গুরুর সেই প্রত্যক্ষ বাস্তব সাধন-মূর্ত্তি। তিনি কেবল বুঝিয়াই তৃপ্ত হন নাই, দেখিতে চাহিয়াছিলেন—সেই অপরোক্ষ দর্শনের সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল, তাই তিনি প্রাণের মধ্যে প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহার এক নূতন মন্ত্রদৃষ্টি লাভ হইয়াছিল; তাহা না হইলে নরেন্দ্রদত্ত বিবেকানন্দ হইতে পারিতেন না। সেই প্রত্যয়-বিশ্বাসের আনন্দে তিনি যে বাণী প্রচার করিলেন তাহাতে ভারতের ব্রহ্মবাদ বা বেদান্তদর্শনের কতখানি বিশুদ্ধি রক্ষা হইয়াছে, তাহার বিচার ভারতীয় দার্শনিক অথবা যোগী-সাধকেরা করিবেন। কিন্তু সে বাণী সম্পূর্ণ আধুনিক, তাহার মূলে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ধর্ম্মতত্ত্বে’র সাদৃশ্য আছে, মানুষের মোক্ষসাধনার সঙ্গে তাহার জীবন-ধর্ম্মের সামঞ্জস্য আছে; তাহার মতে, অনাসক্ত কর্ম্ম-যোগীর পক্ষেও মানব-মমতা স্বদেশ-প্রেমের ঐকান্তিক সাধনার আবশ্যকতা আছে। বিবেকানন্দের মনে মহাপুরুষের যে আদর্শ ছিল তাহাতে একাধারে শঙ্করের মত মনীষা ও বুদ্ধের মত হৃদয় থাকা চাই। ভারতের এই দুই যুগাবতারের প্রতি তাঁহার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু এই দুইজনের একটিকেও তিনি পূর্ণ আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শের যে পরিচয় তাঁহার ‘কৃষ্ণচরিত্রে’ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহাতেও অনেকটা এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা আছে। মানবত্বের এই যে নূতন আদর্শ একই কালে দুই যুগন্ধর বাঙালীর চিত্তে স্থান পাইয়াছিল, ইহা হইতে আমরা বাঙালী জাতির গভীরতম প্রবৃত্তির পরিচয় পাই। উভয়ের মধ্যেই এই আদর্শ জাগিয়াছিল পাশ্চাত্য প্রভাবের ফলে, উভয়েই ইংরেজী জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রসূত নবভাবের সাধক—উভয়ের মধ্যেই যুগধর্ম্মের পূর্ণ প্রেরণায় সনাতন বাঙালিয়ানা এক নূতন রূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনা ও মনীষা ছিল বড়—তিনি ছিলেন নিছক ভাবুক ও কবি; বিবেকানন্দের প্রাণশক্তি বা প্রেম ছিল বড়— তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করিবার প্রয়াসী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চাহিয়াছিলেন হিন্দুর শিক্ষাদীক্ষা ও সাধনার ক্রমবিকাশকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুযায়ী একটি সুসঙ্গত ব্যাখ্যার দ্বারা উজ্জ্বল করিয়া তুলিতে; বিবেকানন্দ চাহিয়াছিলেন—হিন্দুসাধনার ইতিহাস যেমনই হউক, তাহার বীজ যে কালেই অঙ্কুরিত হউক এবং ইতিহাসিক জোয়ারভাঁটায় তাহা যত রূপেই বিবর্ত্তিত হউক—তাহার মূল মন্ত্রটিকে জাতির জীবনে ফলবান করিয়া তুলিতে। কোনও তত্ত্ব-জিজ্ঞাসায় নয়, ইতিহাস উদ্ধার করাও নয়, একটা বিশুদ্ধ ধর্ম্মমতের প্রতিষ্ঠাও নয়; তাঁহার প্রধান লক্ষ্য ছিল—জাতিকে, ধর্ম্মবিশ্বাসী নয়, আত্ম-বিশ্বাসী করিয়া তোলা। তিনি জানিতেন, তাহা হইলেই যথেষ্ট, কারণ ‘The soul may be trusted to the end’। এইজন্য রামমোহনের মত সংস্কার-প্রবৃত্তি থাকিলেও, পাছে জাতি নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়, এজন্য তাহার সকল অনুষ্ঠানের মধ্যে তাহার প্রাণের আকৃতির দিকটিকে তিনি শ্রদ্ধা করিয়াছিলেন—পূজা-পার্ব্বণ, ব্রত-উপবাস তীর্থযাত্রাদির মধ্যে যেখানে যেটুকু প্রাণের সত্য রহিয়াছে, সেখানে বুদ্ধিভেদ ঘটিতে দেন নাই। তত্ত্বের দ্বারা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত না করিয়া, জীবনেরই মধ্য দিয়া সত্যকে উপলব্ধি করাইতে হইলে, জাতির বিশিষ্ট ভাবনা-সাধনা, মনোবৃত্তি ও হৃদয়-বৃত্তির উচ্ছেদ-সাধন চলিবে না; যাহা আছে তাহাকেই উপাদান ও উপায়স্বরূপে গ্রহণ করিয়া, তাহার মধ্য হইতে প্রাণের আলস্য ও জড়তা দূর করিয়া, এক নূতন ভাব-জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি করাই, তাঁহার মতে এ জাতিকে উদ্ধার করার একমাত্র পন্থা। তাই এই নব-বেদান্তবাদী বাঙালী সন্ন্যাসী, ভারতীয় অদ্বৈতবাদকে মস্তিষ্ক হইতে হৃদয়ের মধ্যে নামাইয়া, জাতির সমস্ত কামনা-বাসনা ও কর্ম্মপ্রবৃত্তির মুলে নবশক্তি সঞ্চার করিতে চাহিয়াছিলেন। সে শক্তিমন্ত্র এইরূপ। আমি নিত্যমুক্ত, অপাপবিদ্ধ, আমি স্বাধীন, আমি অজেয়; অগ্নি যেমন পাবক—যাহা কিছু স্পর্শ করে তাহাকেই পবিত্র করিয়া তোলে—আমিও তেমনই; কোনও কর্ম্মে, কোনও অনুষ্ঠানে, কোনও নীতি-নিয়মের অনুবর্ত্তনে আমার অকল্যাণ হইতে পারে না; সত্য-মিথ্যা, সংস্কার-কুসংস্কার, একেশ্বরবাদ-বহুদেববাদ কিছুই আমাকে ধর্ম্মভ্রষ্ট করিতে পারিবে না, যদি আমার মধ্যে বীর্য্য, আত্ম-বিশ্বাস, স্বাধীনকর্ত্তৃত্ববোধ, ও ত্যাগের শক্তি থাকে—এক কথায় আত্মার দৈন্য না থাকে। এই বাণীর বীজমন্ত্র তিনি লাভ করিয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে, তাহাকে প্রসারিত ও প্রচারিত করিবার ভার লইয়াছিলেন নিজে। একজন নিরক্ষর বাঙালীর অসামান্য প্রতিভায় যাহা ধরা পড়িয়াছিল—আর একজন ইংরেজীশিক্ষিত, পাশ্চাত্য প্রভাবে পূর্ণ-প্রভাবান্বিত বাঙালী হইল সেই মন্ত্রের আধার! যেন বাঙালী-জাতির মগ্ন চৈতন্যের মধ্যে যুগযুগান্তর ধরিয়া তাহার ভাবসাধনার যে মন্ত্রবীজটি সুপ্ত ছিল, পাশ্চাত্য প্রভাবের জল বায়ু তাহাকে অঙ্কুরিত করিয়া তুলিল।

 শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই কি স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার সেই আদর্শের সন্ধান পাইয়াছিলেন? শঙ্করের জ্ঞান ও বুদ্ধের প্রেম, এই দুই বিরোধী তত্ত্বের সমন্বয় তিনি কি এই বাঙালী মহাপুরুষের মধ্যে লক্ষ্য করিয়াছিলেন? এইরূপ সমন্বয় কি সম্ভব? কিন্তু বিবেকানন্দের নিজের মধ্যে যাহা ফুটিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মানবধর্ম্ম-সমস্যার একটা সমাধানের ইঙ্গিত রহিয়াছে। এ সমস্যা এ যুগেরই; পাশ্চাত্য জাতির অদম্য ভোগপিপাসা, সেই পিপাসার পৌরুষ, এবং সেই সঙ্গে তাহার পরিণাম-জিজ্ঞাসা হইতেই এ সমস্যার উদ্ভব হইয়াছে। বাঙালীর প্রাণে ইহার সাড়া জাগিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় দিয়া সে ইহাকে অনুভব করিয়াছিল—পাশ্চাত্য ভাবনায় ভাবিত হইয়াই সে আপনাকেও ফিরিয়া পাইয়াছে। কারণ, এই ভোগবাদ—মনের এই স্বাধীনতা ও সংশয়ব্যাকুলতা—তাঁহার নিজের চরিত্রেও বিশেষরূপে বর্ত্তমান। তাই বিবেকানন্দ বেদান্তের যে ব্যাখ্যা করিলেন তাহাতে মায়াবাদ কর্ম্মবাদকে পুষ্ট করিল, জীবব্রহ্মের অভেদ-তত্ত্ব জীবেরই এক নূতন মহিমার প্রমাণ হইয়া দাঁড়াইল। বিবেকানন্দের চেয়ে শঙ্কর বড়—মনীষায়, বুদ্ধও বড়—তাঁহার ত্যাগে ও তপস্যায়। কিন্তু বিবেকানন্দ এই উভয় হইতেই স্বতন্ত্র, কারণ বিবেকানন্দ বাঙালী,—ভোগবাদ তাঁহার অস্থিমজ্জাগত। তিনি জীবনকে ও জগৎকে অস্বীকার করিতে পারেন নাই, সৃষ্টির এই রসমাধুর্য্য অপেয় অগ্রাহ্য মনে করা তাঁহার পক্ষে কঠিন। বরং, তাঁহার মতে, প্রকৃতিকে পুরুষের মতই ভোগ করিতে হইবে; সেই ভোগ সম্রাটের ইচ্ছার মত আত্ম-ইচ্ছার অধীন হইবে, এবং ভোগে ও ত্যাগে কোনও পার্থক্য থাকিবে না। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের সন্ন্যাস জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের সন্ন্যাস নয়; অতিশয় বলিষ্ঠ জীবন-ধর্ম্মের জন্য যে, বিবেক, আত্মপ্রত্যয় ও শক্তি-সঞ্চয়ের প্রয়োজন—সেই শিক্ষা ও সাধনার আদর্শস্থাপনের জন্যই এই সন্ন্যাস।

* * *

 বাঙালীর এই নব-জাগরণের প্রমাণ-প্রসঙ্গে আমি যে দুই মহাত্মার নাম করিয়াছি, তাঁহাদের মধ্যে আমরা উৎকৃষ্ট বাঙালী প্রতিভার বিকাশ দেখিয়াছি। বঙ্কিমের সাধনায় বাঙালীর আত্ম-পরিচয় ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ফুটিয়া উঠিয়াছে; বিবেকানন্দের প্রতিভায় বাঙালীর আত্মোন্নতি ও আত্মপ্রসারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হইয়াছে। দুই জনেই উচ্চ ভাবের ভাবুক, সমাজের অগ্রগামী। উভয়ের সাধনাতেই একটা স্বতন্ত্র আদর্শের কল্পনা থাকিলেও, সে কল্পনায় কেবলমাত্র সংস্কার-প্রবৃত্তি বা missionary spirit-ই ছিল না; জাতির হৃদ্‌গত আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাহার প্রাণের ভুল ও অভ্যাসের মোহ—এ সকলের প্রতি তাঁহাদের একটি শ্রদ্ধা ও মমত্ব-বোধ ছিল; এক কথায় তাঁহারা জাতিরই একজন হইয়া তাহারই ভাবনার ভার লইয়াছিলেন। এইজন্যই আমরা এই দুই মহাত্মাকেই বাঙালীর এই দ্বিতীয় Renaissance-এর প্রধান প্রতিনিধিরূপে বরণ করি। ইহার আরও প্রমাণ এই যে, আধুনিক বাঙালীর প্রাণমূলে যেখানে যেটুকু সত্যকার স্পন্দন জাগিয়াছে, বাঙালীর জীবনে যেখানে সেটুকু সত্যকার রঙ ধরিয়াছে, যে সকল Idea—মস্তিষ্ক-বিলাস নয়—তাহার অন্তরের অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে, যেখানে যেটুকু খাঁটি জাতীয় চেতনার সঞ্চার হইয়াছে, তাহার মূল অনুসন্ধান করিলে বঙ্কিম ও বিবেকানন্দের বাণীই মিলিবে। সত্য বটে, গত ২০।২৫ বৎসরের মধ্যে বঙ্কিম ও বিবেকানন্দের এই সাধনার সূত্র যেন কতকটা ছিন্ন হইয়াছে, আধুনিকতম বাঙালীর চিত্তক্ষেত্রে তাঁহাদের সেই ভাব-প্রতিমা যেন ম্লান হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু তাহার কারণ এই নয় যে, বাঙালীর সেই নবজাগরণ প্রভাতের পর প্রভাতে নূতনতর হইয়া উঠিতেছে; বরং তাহার কারণ ইহাই বলিয়া প্রতীতি হয় যে, ইতিমধ্যে রাষ্ট্রে ও সমাজে এমন বিরুদ্ধ শক্তি ক্রিয়াশীল হইয়া উঠিয়াছে, এবং দেশের জলবায়ুতে মারী-বিষ এমনই ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে যে, বাঙালী ক্রমেই শক্তিহীন ও স্বধর্ম্মভ্রষ্ট হইতেছে, তাহার প্রাণশক্তি দ্রুত ক্ষয় হইতে আরম্ভ করিয়াছে। একালেই সেই পাশ্চাত্যপ্রভাব আর এক দিক দিয়া তাহার ভগ্নদেহ আক্রমণ করিয়াছে—পশ্চিমের সহিত সেই সম্বন্ধ যতই ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিতেছে, ততই তাহার বিষকে হজম করিবার শক্তি কমিয়া আসিতেছে। তাই যে Renaissance-এর কথা বলিয়াছি তাহার পরিণতির পথ আজ রুদ্ধ হইয়াছে, বাঙালীর বাঙালীত্ব আজ মুমূর্ষু। ইহার উপর, কিছুকাল যাবৎ রবীন্দ্রনাথ বাঙালীকে যাহা শুনাইয়া আসিতেছেন, তাহাও বাঙালীর এই শেষ দশারই উপযুক্ত। বিশ্বকবির অতি উচ্চ, ব্যক্তিগত, সুক্ষ্ম ভাববিলাস তাহাকে ভূমি হইতে তুলিয়া ভূমায় বিলীন করিবার পক্ষে বড়ই ফলপ্রদ হইয়াছে। যে জাতির মেরুদণ্ড বক্র ও শীর্ণ হইয়া উঠিতেছে, যাহার উদরে অন্ন নাই, চক্ষে দীপ্তি নাই—যে জাতিহারা, বাস্তুহারা হইতে বসিয়াছে—সে এখন কবির মুখে বিশ্বভারতী ও বিশ্বমৈত্রীর বাণী শুনিয়া কেমন করিয়া সঞ্জীবিত হইতে পারে, তাহা সহজেই অনুমেয়। কবি তাহাকে বঙ্গভারতীর পরিবর্ত্তে বিশ্বভারতীর আদর্শে দীক্ষিত করিতেছেন; দেশ ও জাতি ভুলাইয়া মহামানবের বন্দনা-গান শুনাইতেছেন; তাহার রসবোধ উন্নত ও মার্জ্জিত করিবার জন্য সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রকলার নব-নব ধারায় বেগসঞ্চারে সাহায্য করিতেছেন; সত্যকার রক্ত-মাংসের চেতনা স্তিমিত করিয়া, অরূপ-রূপকের মিষ্টিক-রসে তাহার মরণাহত প্রাণে সান্ত্বনা সিঞ্চন করিতেছেন। তাই মনে হয়, বাঙালীকে লইয়া বিধাতার কি পরিহাস! এত বড় প্রতিভাও জাতির পক্ষে নিস্ফল হইল! রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর Renaissance-এর শেষ ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নায়ক না হইয়া তাহার মৃত্যুযজ্ঞের অন্যতম পুরোহিতরূপে আত্মপ্রকাশ করিলেন!

চৈত্র, ১৩৩৫