বিবিধ কথা/মৃত্যু-দর্শন

উইকিসংকলন থেকে

মৃত্যু-দর্শন

 মৃত্যুর কথা কেহ ভাবে না, এ কথা সত্য—ভাবিলে মানুষের পক্ষে বাঁচাই কঠিন হইত।

 কিন্তু না ভাবিয়া থাকে কেমন করিয়া? জীবনের মোহ-রসে আচ্ছন্ন থাকে—মৃত্যু-বিভীষিকা সে মোহ ভেদ করিতে পারে না। বাঁচিয়া থাকিতে হইবে; সে বাঁচা দিন হইতে দিনে, বা বৎসর হইতে বৎসরে নয়—পলে অনুপলে; তাই মৃত্যুকে দেখিলেই সে পাশ কাটায়, বেশিক্ষণ তাহার দিকে তাকাইতেও পারে না। মানুষের জীবধর্ম্ম এতই প্রবল, দেহের অণু পরমাণু এত চঞ্চল যে, থামিবার ভাবিবার অবকাশ তাহার নাই। সে যে মুখে ছুটিতেছে তাহার বিপরীত মুখে মৃত্যু তাহার পাশ দিয়া ছুটিয়া যাইতেছে, উভয়ে চক্রাকারে ছুটিতেছে—যখনই দেখা হয় শিহরিয়া উঠে; কিন্তু গতির বিরাম নাই, ঘুরণের নেশায় মৃত্যুকে আমরা দেখি না। যখনই সংঘর্ষ ঘটিবে তখনই চুরমার হইয়া যাইবে এ কথা সে জানে, কিন্তু ঘূর্ণনের মুখে তাহা মানে না। ইহারই উল্লেখ করিয়া মহাভারতকার যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়া বলাইয়াছিলেন, ‘কিমাশ্চর্য্যমতঃপরং’।

 মৃত্যুকে ভাবিতে পারা যায় না; আর সব-কিছু মানুষের জ্ঞানগম্য—পরোক্ষ অনুভূতির বিষয়, কিন্তু মৃত্যুকে সাক্ষাৎ করিতে না পারিলে তাহার পরিচয় করা হয় না; এবং সাক্ষাৎ করিলে আর কিছু বলিবার থাকে না। অস্তিত্বের বিলয়-মুহূর্ত্তে যে অপরোক্ষ অনুভূতি ঘটে, তাহা বজ্রাঘাতের মত; নিমেষের মধ্যে মহাশূন্য জাগিয়া উঠে—তাহাতে দিক-কাল নাই, অগ্রপশ্চাৎ নাই, স্মৃতি-বিস্মৃতি নাই; সেই মহানির্ব্বাণের পূর্ব্ব মুহূর্ত্তে কি অনুভব হয়, তাহা কেহ কাহাকে জানাইতে পারে না। মৃত্যু কি, তাহা কেহ জানে না, জানিবার কোনও উপায় নাই; যাহা জীবনের বিপরীত, জীব তাহা ধারণা করিতে পারে না। তাই মৃত্যুর ঘটনা মানুষ দেখে, মৃত্যুকে জানে না; বুদ্ধির দ্বারা তাহাকে আয়ত্ত করিতে পারে না বলিয়াই বোধ হয় সত্যকার মৃত্যুচিন্তা কেহ করে না।

 যে দ্বার রুদ্ধ, যে পৈঁঠার পরে আর পদক্ষেপ নাই—যাহাকে ক্রমাগত চলিতেই হইবে সে সেদিকে চাহিবে কেন? যাহাকে জানা পর্য্যন্ত ধর্ম্মবিরুদ্ধ——জানার নামই জীবধর্ম্মের নিবৃত্তি, তাহাকে জানিবার প্রবৃত্তিই যে হয় না!

 তাই মৃত্যুকে একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনারূপেই সে দেখে—ক্ষণিক বিভীষিকা প্রতি রাত্রির দুঃস্বপ্নের মত প্রভাতের আলোকে প্রত্যহ মুছিয়া যায়, জীবনের জাগ্রত যাত্রার অবিরত তাড়নায় মৃত্যুর ফাঁক ভরিয়া উঠে। এ যাত্রায় কিছুই ফিরিয়া দেখিবার অবকাশ নাই, ইহাতে বর্ত্তমান ছাড়া কাল নাই; পরের মৃত্যু অতীত, নিজের মৃত্যু ভবিষ্যৎ—এ দুইটার কোনটাই বাস্তব নয়।

 অতএব মৃত্যু কি তাহা আমরা যেমন জানি না, তেমনই জানিবার কোনও প্রয়োজনও হয় না। কিন্তু তথাপি মৃত্যুর একটা রূপ আমরা দেখি, সেই পরোক্ষ দেখাও অপরোক্ষ হইয়া উঠে—যখন চোখের সম্মুখে প্রাণসম প্রিয়জনের শেষ নিশ্বাস-ত্যাগের সেই চরম মুহূর্ত্ত গণনা করি। জীবনের সেই অবসান-দৃশ্য, প্রাণবায়ু-ত্যাগের সেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ তখন একটা বিস্ময় বা বিভীষিকার মত কেবল একটা বিমূঢ় ভাবের উদ্রেক করে না, কেবল মন বা মস্তিষ্কের উপরেই আঘাত করে না—হৃদয় মথিত করে; জীবনের পুষ্প-পতাকাময় তোরণের অন্তরালে যে কঙ্কাল লুকাইয়া আছে, তাহা যেন নির্লজ্জভাবে উদ্ঘাটিত হইয়া যায়। সেও মৃত্যুর স্বরূপ নয় —তবু একটা রূপ আমরা দেখি; এই দেখিতে পাওয়ার কারণ আর কিছু নয়, আমাদেরই একটা অংশ—প্রাণবৃক্ষের একটি শাখা—তখন শুকাইয়া খসিয়া যায়। সে যেন আমাদেরই আংশিক মৃত্যু, সে মৃত্যু তখন অনুভব করি প্রাণের মধ্যে; এই প্রাণী-দেহ যে স্নায়ুশিরা-বন্ধনের শত গ্রন্থিতে দৃঢ়বদ্ধ হইয়া আছে সেই গ্রন্থিতে চোট লাগে—সে বন্ধন আর তেমন থাকে না, শিথিল হয়; কয়েকটা স্নায়ু হয়তো ছিঁড়িয়া যায়। যাহাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখিয়াছিলাম, যাহাকে হৃদয়ের স্নেহরসে পুষ্ট করিয়াছিলাম, যাহার জীবনে আমার জীবন বেগ সঞ্চার করিয়াছে—মৃত্যু যখন তাহাকে গ্রাস করে, তখন আমারই কতকটা তাহার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়; না মরিয়াও আমি মৃত্যুর স্পর্শ লাভ করি।

 সাধারণে ইহাকে বলে শোক। শোক বাহিরের আক্ষেপমাত্র, সে বেশি দিন থাকে না। জীবন্ত দেহে অস্ত্রোপচার করিলে ক্ষতঅঙ্গে স্নায়ু-পেশীর যে স্পন্দন অবশ্যম্ভাবী, শোক তদতিরিক্ত কিছু নহে। এই শোক বা আক্ষেপ অস্ত্রাঘাতমাত্রেই হয়; কিন্তু সকল অস্ত্রাঘাতে অঙ্গহানি হয় না—দেহের একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয় না। শোক কালে শান্ত হয়; কিন্তু সেই অঙ্গহানি, প্রাণের সেই আংশিক মৃত্যুর কোনও প্রতিকার নাই; বরং বাহিরের আক্ষেপ বা শোক যত প্রবল ততই সান্ত্বনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আত্মীয়-বিয়োগে মৃত্যু যাহার অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে তাহার পক্ষে সকল সান্ত্বনা নিরর্থক বলিয়াই বাহিরে কোনও আক্ষেপের লক্ষণ প্রকাশ পায় না; সে মূঢ় মুক হতচেতন হইয়া যায়, ভিতরে পক্ষাঘাত হয়—যাবজ্জীবন সে অজ্ঞানে ও সজ্ঞানে সেই পক্ষাঘাত বহন করে।

 ইহারই নাম মৃত্যুর সহিত সাক্ষাৎকার—নিজ মৃত্যুর পূর্ব্বে মানুষ মৃত্যুকে আর কোনও রূপে দেখিতে পায় না। সাধারণত মৃত্যুকে আমরা জানি না, জানিতে চাই না—জীবিতের পক্ষে অপরের মৃত্যু একটা অর্থহীন দুর্জ্ঞেয় উপদ্রবমাত্র; যতক্ষণ বাঁচিয়া আছি ততক্ষণ মৃত্যুকে স্বীকার করা অসম্ভব—মৃত্যুকে স্বীকার করাই মরা। স্বীকার এক রকম করি—যখন বুকের পাঁজর কয়খানার কোনটা খসিয়া যায়; তখন নিজের মনের মুকুরে নিজের সেই লাঞ্ছিত হতশ্রী মূর্ত্তি দেখিয়া মুখ লুকাই, সে মুখ কাহাকেও দেখাইতে লজ্জা হয় না; মানুষের সভায় যখন বসি তখন প্রাণপণে নিজের সেই ক্ষতিচিহ্ন লুকাইয়া রাখি। যে শোক করে, সে মানুষের সান্ত্বনা সহানুভূতি চায়, সে জীবনের দুয়ারে ভিক্ষা করিয়া মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ করিয়া লইতে চায়—সে মৃত্যুকে দেখে নাই।

 জীবনে যাহার মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয় নাই—সে ভাগ্যবান, যে তাহাকে দেখিয়াও দেখে নাই—সে হৃদয়হীন। যে মৃত্যুর অন্তরালে পরম আত্মাকে আবিষ্কার করে, মৃত্যুকে যে অমৃতের সোপান বলিয়া উপলব্ধি করে, মৃত্যু কোথাও নাই বলিয়া যে ঘোষণা করে, সে—হয়, জানিয়া শুনিয়া মধুর মিথ্যার প্রশ্রয় দেয়; নয়, সে কখনও বাঁচে নাই—দেহ পরিগ্রহ করিয়াও বিদেহ অবস্থায় আছে, অর্থাৎ সে প্রেত-পিশাচের সামিল। মানুষ যতক্ষণ মানুষ, ততক্ষণ সে তাহার ব্যক্তিপরিচ্ছিন্ন সত্তা বিস্মৃত হইতে পারে না—সেই সত্তার উপরে যে ব্যক্তিত্বহীন অমৃতসত্তার আরোপ করিয়া আশ্বস্ত হইতে চায় তাহার আত্মপ্রবঞ্চনা কৃপার উপযুক্ত বটে। কিন্তু যে সেইরূপ আশ্বাসে আশ্বস্ত হইতে পারে সে মানুষ নয়—যে বস্তু কবি-বিধাতার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি, সেই হৃদয় নামক যন্ত্রটি তাহার মধ্যে বিকল হইয়া আছে। যাহারা লোক-লোকান্তরের স্বপ্ন দেখে, যাহারা মৃত্যুর পরেও অবিচ্ছেদে জীবনযাপন করার কথায় বিশ্বাস করে, তাহারা শিশুর মত রূপকথার ভক্ত। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে তফাৎ এই যে, এক দল তত্ত্বজ্ঞানের অভিমানে হৃদয়বৃত্তি নিরোধ করে; অপর দল হৃদয়াবেগের মোহে নির্ব্বিচারে মিথ্যার শরণাপন্ন হয়।

 মৃত্যুর পরে আর কিছুই নাই—এ কথা যতই সত্য বলিয়া মনে হউক—স্বীকার করিতে সকলেই ভয় পায়। মৃত্যুর সম্বন্ধে ভাবিতে গেলেই মনের মধ্যে একটা অন্ধকার শূন্য মাত্র অনুভব করি—অথচ, শূন্য বা নাস্তিত্বের কল্পনাও আমাদের সংস্কার-বিরোধী; তাই মন সেই শূন্য বা নাস্তি-চেতনাকে নানা কৌশলে আবৃত করিবার চেষ্টা করে— সেই অন্ধকার গহ্বরকে কোন কিছু দিয়া ভরাইয়া রাখিতে চায়। মানুষ মৃত্যুশোকে সান্ত্বনা চায়—তাহার অর্থ, মৃত্যুকে সে মানিতে চায় না; অস্তিত্বের ঐকান্তিক বিলোপ তাহার জীব-সংস্কারের পক্ষে বিষবৎ মারাত্মক, তাই আত্ম-প্রবঞ্চনার দ্বারা সে আত্মরক্ষা করিয়া থাকে। ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিলে, স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে, মানুষ সাধারণ মৃত্যু- ঘটনায় বিশেষ বিচলিত হয় না; যে মরিয়া গেল, জীবন-ব্যাপারে তাহার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকে না বলিয়া তাহাকে সে আর গণনার মধ্যেই আনে না। শোকের আক্ষেপ মনের একটা সাময়িক পীড়া মাত্র; যে বাঁচিয়া আছে সে প্রাণবন্ত—প্রাণহীনের সঙ্গে প্রাণীর যে সম্পর্কহীনতা, তাহা ধর্ম্মের মত দুর্ল্লঙ্ঘ্য—যে মৃত সে আর আমাদের কেহ নয়, এই সংস্কার যেন প্রাণের মর্ম্মমূলে জড়িত হইয়া আছে। অতএব শোক মিথ্যা, সান্ত্বনা সুসাধ্য।

 মৃত্যু জীবনের উপরে রেখাপাত করিতে পারে না। মৃত্যুর সম্বন্ধে শিশুর যে মনোভাব—নিত্যসঙ্গীরও অকস্মাৎ তিরোধানে শিশুর যে আচরণ—বয়স্ক ব্যক্তির আচরণও তাহাই, মূল জীবন-চেতনার বা সত্যকার জীবন-ধর্ম্মের তাগিদে আমরা মৃতজনকে আমাদের জগৎ হইতে একেবারে নির্ব্বাসিত করিয়া দিই; অমৃতের আশ্বাস, ধর্ম্মের সান্ত্বনা, পরলোকের কাহিনী-কল্পনা—এ সকলই তাহার প্রমাণ। মৃতজন আমাদের প্রাণের সন্নিকটে আর বাস করে না; আমাদের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাহাদের কোনও যোগ নাই। যাহার কায়া নাই তাহার সঙ্গে দেহধারীর কোনও সম্পর্ক থাকিতে পারে না—তাই থাকেও না; তথাপি যে সম্পর্কের দাবি করি তাহা ভান মাত্র; তাহা যে সত্য নয় তাহার প্রমাণ সর্ব্বত্র; মানুষের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করিলেই বুঝিতে পারিবে মৃতজনের সম্বন্ধে কোনও চেতনা, কোনও সজ্ঞানতা, তাহার মধ্যে কুত্রাপি নাই। শিশুর আচরণ অবিমিশ্র সত্য, তাহাতে ভান নাই; বয়স্ক ব্যক্তির স্মৃতি নামক একটা মানস-ব্যাধি আছে—হয়তো লজ্জাও আছে, তাই সে মাঝে মাঝে স্মরণ করে, দুঃখ করে, লজ্জা পায়।

 মানুষ আপনার চেয়ে কাহাকেও ভাল বাসে না; যদি কাহাকেও খুব ভাল বাসে, তবে তাহা আপনার চেয়ে নয়—আপনার মত। তাই স্নেহ যত গভীর হউক, প্রেম যত বড় হউক, তার মূলে স্বার্থ থাকে। পরের জন্য আপনাকে হত্যা করা—পরের মৃত্যুতে নিজের জীবন-সংকোচ করা জীবের ধর্ম্ম নহে, মানুষের মত শ্রেষ্ঠ জীবেরও নহে। যে মরিয়া গেল তাহাকে ভাল বাসিতাম, খুব ভাল বাসিতাম—তাহার অর্থ, আমার প্রীত্যর্থে তাহাকে প্রয়োজন ছিল; তাহার মৃত্যুতে আমার আত্মপ্রীতির বিঘ্ন ঘটিয়াছে। আত্মপ্রীতির জন্য এই যে পরকে আশ্রয় করা—ইহারই নাম হৃদয়-ধর্ম্ম। এই ধর্ম্মের চরম বিকাশে মানুষ শেষে আত্মবিস্মৃত হয়, আত্মরক্ষা শেষে আত্মবিসর্জ্জনে পর্য্যবসিত হয়। এই বিসর্জ্জন বা বিসৃষ্টিও আত্মহত্যা নয়—আপনাকেই ভিতর হইতে বাহিরে প্রক্ষেপ করিয়া, বিষয়ান্তরে আপনাকেই সৃষ্টি করা। এতখানি কল্পনা সকলের নাই, কিন্তু মূলে সকলের ধর্ম্মই এক—সকলেই আত্মধর্ম্মী, আত্মব্রতী। যাহাকে ভালবাসি, স্নেহ করি, সে আমার আত্মীয়, আত্ম-সম্পর্কিত, অর্থাৎ আত্মপ্রীতির আশ্রয়। সেই আত্মীয় যখন মরিয়া যায় তখন যে শোক উপস্থিত হয়, তাহা সাধারণত স্বার্থহানির শোক। কিন্তু তাহাকে আর কোনও প্রয়োজনে পাইব না, এই জীবনের প্রত্যক্ষ লীলামঞ্চে কোনও সুত্রে সে আমার সঙ্গে আর বাঁধা নাই; মৃত্যুর পরে যদি সে থাকে-ও, তবে তাহার জাত্যন্তর ঘটিয়াছে—জীবিত আত্মার সঙ্গে মৃত আত্মার কোনও গুণ-সামান্য নাই, অতএব সে আর আত্মীয় নহে; প্রাণের গভীরতম চেতনায় মানুষ ইহাই অনুভব করে, তাই অজ্ঞানে প্রাণ-ধর্ম্ম পালন করে; কেবল মানসধর্ম্মের তাড়নায় তাহা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হয়। মানুষ কাঁদে, কিন্তু প্রকৃতি হাসে—জীবধর্ম্ম পালন করিতে সে বাধ্য, করে-ও। এক দিকে শোক করে, আর এক দিকে নিজ জীবনের প্রয়োজন পুরাপুরি সাধন করে।

 আত্মীয়-বিয়োগে আত্মার বিয়োগ হয় না; আমাকেই কেন্দ্র করিয়া যে জগৎ দাঁড়াইয়া আছে, আমারই প্রয়োজনে যাহার অস্তিত্ব, আমারই প্রীত্যর্থে যাহাকে আমি চাই—যতক্ষণ আমি বাঁচিয়া আছি ততক্ষণ তাহার ক্ষতিবৃদ্ধির হিসাবে কোনও স্থায়ী তারতম্য হইতে পারে না। আমি ছাড়া আর সবটাই এই জগতের অন্তর্গত; এই আত্মপ্রয়োজনাধীন জগতের এক টুকরাও হারাইবে না—যতক্ষণ না আমি আমাকে এতটুক হারাইতেছি। সকলই পর, সকলই পর, সকলই পর। এ পরের যেটুকুকে আপন বলিয়া ভাবি, তাহাও জীবনের লীলা-সুখের জন্য নিজ আত্মার অভিমান পরের উপর আরোপ করা; কাজেই তাহা মিথ্যা। প্রিয়জনের মৃত্যুতে সেই অভিমান ব্যর্থ হয়—সে যেন তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়া আমাকে ফিরাইয়া দেয়, তাই আঘাত পাই, সেই আঘাতের নাম শোক। তারপর, সে ক্ষতি তখনই অন্য দিক দিয়া পূরণ করিয়া লই; কিংবা ব্যয়-সংক্ষেপ করি, অর্থাৎ বৈরাগ্য-সাধনা করি। আত্মীয়ের মৃত্যুতেই প্রমাণ হয়—সে কতদূর অনাত্মীয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কত মিথ্যা; মানুষের ভাগ্য-বিধাতা মানুষকে কতটা আত্মৈকশরণ, আত্মপরায়ণ, নিঃসঙ্গ, একক করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন; তাহার জীবনে স্বকর্ম্মনির্দ্ধারিত পথ বা আত্মস্বার্থসাধন ভিন্ন গত্যন্তর নাই। আত্মীয়-অনাত্মীয় যাহার দশা যেমন হউক, যে যখন যেখানে যেরূপ করিয়াই জীবনলীলা শেষ করুক—আসলে তোমার তাহাতে ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। তোমার পথে তুমি চলিতে থাকিবে, তুমি ফিরিয়াও চাহিতে পার না—চাহ না। ফিরিয়া যদি চাহিতে, তবে তুমিও মরিতে—পাণ্ডবগণের স্বর্গারোহণ-কাহিনী স্মরণ কর। তুমি মরিতে চাও না—তাই ফিরিয়া চাহিতেও নারাজ। তাই বিশ্বাস হয়, অপরের মৃত্যু অপরেরই—সে যতই প্রিয়জন হউক; সে মৃত্যু আমাদের নিকট অবাস্তব—নিজের মৃত্যুই একমাত্র বাস্তব।

 পূর্ব্বে বলিয়াছি, মৃত্যুকে আমরা দেখিয়াও দেখি না; তথাপি সময়ে সময়ে প্রাণসম প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের দৃষ্টিকে অপলক নিশ্চল করিয়া রাখে। পরের মৃত্যু একটা নিত্যদৃষ্ট ঘটনা মাত্র; সে ঘটনাকে ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিবার অবকাশও যেন আমরা পাই না—একটা অপ্রীতিকর অনুভূতি হয় মাত্র; সে অনুভূতিকে বেশিক্ষণ প্রশ্রয় দিই না, মনের দরজা বন্ধ করিয়া দিই। জীবনের বাসগৃহে একটা ভূতের ঘর আছে, সে ঘর খুলিয়া কখনও উঁকি মারি না—সময়ে সময়ে যখন আপনি খুলিয়া যায়, তখন তাহাকে বন্ধ করিয়া দিই। ইহাই আমাদের স্বভাব—ইহা না হইলে আমরা বাঁচিতাম না। কিন্তু যাহাকে এমন করিয়া বুকে করিয়া রাখিয়াছিলাম যে, যাহার নিশ্বাস-বায়ু আমারই নিশ্বাসবায়ুর প্রতিশ্বাস বলিয়া মনে করিতাম; যাহার মৃত্যুশয্যার পার্শ্বে বসিয়া বহু দিন ও বহু রাত্রির দীর্ঘ প্রহর যাপন করিয়াছি; সূর্য্যাস্ত হইতে সূর্য্যোদয়, আবার সূর্য্যোদয় হইতে সূর্য্যাস্ত, অমাবস্যা হইতে পূর্ণিমা—যাহার ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর প্রাণশক্তির গতি নিরীক্ষণ করিয়াছি, নাড়ীর বেগ বা হৃদস্পন্দন গণিবার সময় মৃত্যুর আক্রমণ নিজের নাড়ীতে, নিজের হৃদস্পন্দনে অনুভব করিয়াছি; যাহার মৃত্যুকরনিষ্পেষিত কণ্ঠের আর্ত্তস্বর শুনিয়া, শুধু আমার নয়, জগতের সকল জীবিত জনের জীবন-শ্বাসকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হইয়াছে;—মৃত্যু যখন তাহাকে কবলিত করিল, বিস্ফারিত অক্ষিতারকা স্থির জ্যোতিহীন হইয়া শেষে জালাবৃত হইয়া গেল; পরে ক্ষণকাল দেহের আনাভি-কণ্ঠ আন্দোলন, ও শেষে মুখ-গহ্বর হইতে প্রাণবায়ুর শেষ-শ্বাস-নির্গম প্রত্যক্ষ করিলাম—যে মুহূর্ত্তে সে মরিয়া গেল সেই মুহূর্ত্তকে চাক্ষুষ করিলাম, তখন কি দেখিলাম? কি অনুভব করিলাম? দেখিলাম, একটা জীবনের অবসান হইয়া গেল—বুঝিলাম, যে ছিল সে আর নাই! সে আর নাই, এই পরম সত্য উপলব্ধি করিলাম—উপলব্ধি করিলাম, আমি বাঁচিয়া আছি। শবদেহ বক্ষে চাপিয়া ধরিলাম, মাথায় মুখে হাত বুলাইতে লাগিলাম; কারণ, তখন স্পষ্ট বুঝিলাম, অবশিষ্ট যাহা তাহা এই দেহটা, উহার অতিরিক্ত আর কিছু অস্তিত্বের সীমানায় আর নাই। চিরদিনের শিক্ষা-সংস্কার বিস্মৃত হইলাম—যে গেল সে ওই দেহটা নয়, আর কিছু; সে আর উহার মধ্যে নাই, ত্যক্ত বসনের মত সে উহাকে পরিহার করিয়া গিয়াছে—এ সকল কথা বিশ্বাস হইল না। দেহের দিকে না তাকাইয়া তাহার আত্মার প্রয়াণ-পথ কল্পনা করিতে পারিলাম না; কারণ, মৃত্যু কি, তাহা সেই মুহূর্ত্তে হৃদয়ঙ্গম করিলাম। জীবন ওই দেহেরই ধর্ম্ম—জীবিতের মূর্ত্তি ওই দেহ—ওই মুর্ত্তি মরিয়াছে, সে আর বাঁচিয়া নাই—সে আর নাই। তবু যতক্ষণ ওই দেহটা আছে, প্রাণহীন হইলেও তাহাকেই দেখিতেছি—তাহাকে আর কোনও রূপে কল্পনা করিতে পারি না। যে রহস্যময় প্রাণবায়ু ওই দেহকে ত্যাগ করিয়া গেল, সে মহাশূন্যে মিলাইয়া গিয়াছে, দীপনির্ব্বাণ হইলে শিখা যেমন শূন্যে বিলীন হয়। সে বায়ু ওই দেহকেই সঞ্জীবিত করিয়াছিল—তাই তাহার এত মূল্য; সেই বায়ু এখন নিঃশেষ হইল, মানুষ মরিল। শবমুখে যতই চাহিয়া দেখি, ততই মনে হয় সে মুখ যেন কাঙালের মুখ—প্রাণ হারাইয়া সে যেন সর্ব্বস্ব হারাইয়াছে, তার আর কিছু নাই— কিছু নাই! সে মুখে চাহিয়া স্পষ্ট বুঝিলাম—এই শেষ! এইখানেই সব শেষ—তাহার অস্তিত্বের শেষ নিদর্শন ওই দেহ। মৃত্যু তাহার মুখে ভয় বা বিস্ময়ের চিহ্ন অঙ্কিত করে নাই—অতি দীন দুঃখী ভিখারীর মত সে মুখে একটি বড় করুণ ছায়া বিস্তার করিয়াছে; জীবন ও মৃত্যুর সন্ধি-মুহূর্ত্তে যে সত্য তাহার মুখে মুদ্রিত হইতে দেখিলাম তাহাতে সকল মিথ্যা সংস্কার দূর হইল; যে অবস্থা ধারণা করিতে পারি না, জীবিতের পক্ষে যাহা অপরোক্ষ করা অসম্ভব—সেই চিরনির্ব্বাণ, সেই মহাশূন্য বা চরম পরিণাম যেন প্রত্যক্ষ করিলাম। ওই প্রাণহীন শবদেহও যতক্ষণ ধ্বংস না হয়, ততক্ষণ তাহা সত্য; সৃষ্টির মূল সত্য—যে মূর্ত্তি বা কায়া তাহা তখনও সম্মুখে বিদ্যমান। মনে হইল প্রাণ নাই, তবু সে আছে—প্রাণহীন সে; সে-হীন প্রাণ—যাহাকে আত্মা বলে, তাহা কল্পনা করিতেই পারিলাম না; যাহাকে হারাইলাম তাহার শেষ সত্য ওই দেহটা, তাই সেটাকে বুকে চাপিয়া ধরিলাম।

 ইহাই মৃত্যু—দেহ-বিযুক্ত আত্মার লোকান্তর-প্রাপ্তি নহে। মৃত্যুশোক বিরহ-দুঃখ নয়, কারণ মৃত্যু লোকান্তর-বাস নয়—অতলস্পর্শ শূন্যগহ্বর। যে আর নাই—তাহার সম্বন্ধে বিরহ-ভাব হয় কেমন করিয়া? কাহারও মৃত্যু যদি গভীরভাবে হৃদয়কে স্পর্শ করে, যদি তাহাকে এমন ভালবাসিয়া থাক যে তাহার অভাবে—তোমার কি হইল না ভাবিয়া— তাহার কি হইল ভাবিতে পার, তবেই মৃত্যুর স্বরূপ কতকটা উপলব্ধি করিতে পারিবে। যে মরিল সে যে আর নাই—এ কথা ভাল করিয়া গভীরভাবে উপলব্ধি করা দূরূহ; আমার জীবন-সংস্কার অর্থাৎ ‘আমি আছি’র সংস্কার সে পক্ষে প্রধান বাধা। এই সংস্কার যদি মুহূর্ত্তের জন্য ঘুচিয়া যায় তবে মৃত্যু সম্বন্ধে কোনরূপ কল্পনা-বিলাস আর টিঁকিতে পারে না। প্রাণসম প্রিয়জনের মৃত্যু-ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়া যখন মনে হয়—আমি আছি, আর, সে নাই; আমার বাঁচিয়া থাকার তুলনায় তাহার না-বাঁচার অবস্থা যখন তীব্রভাবে অনুভব করি, তখন এই ভাবিয়া মর্ম্মমূল ছিঁড়িয়া যায় যে, আমি যাহা ভোগ করিতেছি সে তাহা হইতে চিরতরে বঞ্চিত হইল। যে আয়ু অপেক্ষা পরম ধন আর নাই, যে আয়ু আমি এখনও ভোগ করিতেছি—শোকের আবেগে নিজের সেই আয়ুকে যতই ধিক্কার দিই না কেন, অন্তরের অন্তরে যাহার মূল্য সম্বন্ধে আমি সচেতন—সেই আয়ু—অস্তিত্বের সেই একমাত্র স্বাদ-সুখ হইতে যখন তাহাকে বঞ্চিত হইতে দেখি, তখন কপট বৈরাগীর মত, নিজে গোপনে ভোগসুখে আসক্ত থাকিয়া অপরের সম্বন্ধে সুমহান বৈরাগ্যের আদর্শ প্রচার করার মত, নিজে জীবিত থাকিয়া মৃতের জন্য আত্মা বা পরলোকের ব্যবস্থা করিতে প্রবৃত্তি হয় না। তখনই মৃত্যু কি, তাহা বুঝিতে পারি। যখন জীবন-বঞ্চিত হতভাগ্যের সেই দুঃখ অনুভব করি— আমার অভাব নয়, তাহার সেই অভাব—সেই সব-শেষ-হওয়ার মহা দৈন্য যখন উপলব্ধি করি, তখন এক দিকে জীবনকে যেমন পরম আশীর্ব্বাদ বলিয়া বুঝি, তেমনই, আর এক দিকে মৃত্যু যে কত বড় অভিশাপ, তাহাও অন্তরে অন্তরে অনুভব করি।

 পরক্ষণেই মনে হয় যে রহিল না, যে আর নাই, তাহার জন্য দুঃখ কি?—দুঃখ তাহার, না তোমার? জীবন-বঞ্চিত হইয়াছে কে? ‘হইয়াছে’ কথাটা যাহার সম্বন্ধে খাটে তাহার একটা সত্তা মানিতে হয়— কিন্তু সে যে নাই! মৃত্যু যে মহা অবসান—চির সমাপ্তি! তখন বুঝি, দুঃখটা আমার—আমারই সম্পর্কে, আমারই স্বার্থজড়িত। শোক করিতে গিয়া মনের মধ্যে বাধা পাই। চোখ ফাটিয়া যে অশ্রুর উদ্গম হয়, তাহার হেতুরূপে আমা ছাড়া আর কাহাকেও খুঁজিয়া পাই না।

 তখন বুঝিতে পারি, যাহার শব-দেহ বার বার বক্ষে ধারণ করিতেছি—সে আর নাই বটে, তবু আমার জীবনে তাহার জীবনের রেশ রহিয়াছে—আমি যে আছি! এই যে ‘সে নাই’ ভাবিতেছি ইহা তো আমারই ভাবনা, ‘না থাকা’ যে কি, তাহা যে নাই সে তো আর বুঝে না; যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণই মৃত্যু আছে—যাহার মৃত্যু ঘটে তাহার আর কিছু নাই—মৃত্যুও নাই! শবদেহ যেমন চিতার অগ্নিজ্বালা অনুভব করে না, কিন্তু জীবিত দেহের একটা অঙ্গ যখন অগ্নিদগ্ধ হয় তখনই দহন-জ্বালা যে কি তাহার অনুভব হয়—তেমনই, মৃত্যু-রূপ জ্বালার অনুভূতি জীবিতেরই হইয়া থাকে। আবার, অপরের দেহ দগ্ধ হইলে সে জ্বালা যেমন আমি অনুভব করি না, তেমনই পরের মৃত্যু যতই অনুমানসাপেক্ষ হউক, আমার অনুভূতি-গোচর হয় না। কিন্তু আমারই একটা অঙ্গ দগ্ধ হওয়ার মত যখন আমার জীবনের অংশস্বরূপ কোনও পরম প্রিয়জনের মৃত্যু হয়, তখনই আমি মৃত্যুকে অনুভব করি—আমি যখন একেবারে মরিব, তখন আমিও তাহা অনুভব করিব না। মৃত্যুকে অপরোক্ষ করার আর কোনও উপায় নাই—আমারই জীবনের অংশরূপে আর একটা জীবন যখন আমার মধ্যে মরিয়া থাকিবে, তখনই মৃত্যুর সহিত আমার পরিচয় ঘটিবে; যে মরিল, মৃত্যু যেন তাহাকে ত্যাগ করিয়া আমারই জীবনের মধ্যে বাসা বাঁধিল! অতএব মৃত্যুর জন্য যে সত্যকার শোক সম্ভব—তাহা মানুষের নিজেরই মৃত্যু-শোক; মৃত্যুকে আর কোনও অবস্থায় আমরা বুঝি না, অনুভব করি না—আর সকল মৃত্যুই আমাদের নিকটে অবাস্তব; সে সকল মৃত্যুতে যে শোক আমরা করিয়া থাকি তাহা সুখবোধের বিপরীত একটা দুঃখবোধ মাত্র—নানা অন্যবিধ যন্ত্রণার মতই একটা যন্ত্রণা। সে মৃত্যু বাহিরের আঘাত মাত্র, তাহা জীবনের অন্তর্ভুক্ত হয় না, প্রাণের মর্ম্মস্থানে ক্ষতচিহ্নরূপে বিরাজ করে না; করিলে, সে শোক একটা ঝড়ের মত জীবনের শাখাপ্রশাখাগুলিকে কিছুকাল আন্দোলিত করিয়াই নিবৃত্ত হয় না—মূল হইতে রস-সঞ্চারে বাধা দেয়, পত্র পুষ্প বিবর্ণ হইয়া যায়; সম্পূর্ণ অলক্ষিতে তাহার প্রভাব ক্রমশ ভিতর হইতে বাহিরে প্রকট হইয়া পড়ে।

 কিন্তু এমন ভাবে আমরা মৃত্যুকে সচরাচর অপরোক্ষ করি না—পর এমন আত্মীয় হয় কদাচিৎ। অতি বড় শোকও যে কালে আরোগ্য হয়—আমরা যে সান্ত্বনা খুঁজি এবং পাই, তাহার কারণ, মৃত্যুর স্বরূপ উপলব্ধি আমরা করি না, মৃত্যু যে কি তাহা ভাবিতেও ভয় পাই; যে মরিয়াছে তাহাকে বিস্মৃত হইবার প্রাণপণ চেষ্টা করি—বাঁচিতে চাই। স্ত্রী-বিয়োগে, সন্তান-বিয়োগে, বন্ধু-বিয়োগে আমরা যে ব্যথা পাই, তাহা মৃত্যু-চেতনা নয়—জীবনেরই একটা দুঃখবোধ—সুখভোগে একটা বাধার মত। কিন্তু মৃত্যুকে স্বতন্ত্রভাবে দেখিবার অবকাশ যদি কখনও ঘটে, তবে জীবনের যত কিছু সংস্কার মুহূর্ত্তে উড়িয়া যায়—শোক ও সান্ত্বনা দুইই অনর্থক বলিয়া মনে হয়। সে অবস্থায়—যাহাদের হৃদয়বৃত্তি অতি গভীর ও প্রবল, তাহারা প্রিয়জনের মৃত্যুতে তৎক্ষণাৎ নিজেও মরিয়া যায়; এমন যুগপৎ মৃত্যুর দৃষ্টান্ত বিরল নহে—‘মৃতে ম্রিয়তে যা’ বলিয়া যে প্রেমিকার বর্ণনা আমরা পাঠ করি, তাহা মিথ্যা নয়। যাহাদের জ্ঞানবৃত্তি প্রবল, তাহারা—শূন্যবাদী, নাস্তিক বা বৈদান্তিক মনোবৃত্তির অনুশীলন করিয়া, কাঠ-পাথরের মত হইয়া—আত্মপ্রসাদ লাভ করে; মৃত্যুকেই মোক্ষ বলিয়া বুঝে, কেবল তৎপূর্ব্বে অবশিষ্ট জীবনটা কোনও রূপে অতিবাহিত করিবার জন্য কূটতর্কের জালে তাহাকে আবৃত করে। যাহাদের কর্ম্ম-প্রবৃত্তি প্রবল, তাহারা মৃত্যুকে স্বীকার করিয়াও জীবনের সুযোগটা উত্তমরূপে ভোগ করিতে চায়; সত্যকার শক্তিমান নাস্তিক তাহারাই—জীবনের মদিরাপাত্র আকণ্ঠ পান করিয়া কীর্ত্তির নেশায় মশগুল থাকে; মুহূর্ত্তের জন্যও চিন্তা করে না—শেষ কোথায়? ইহারাই পরম বিস্ময়ের পাত্র—কারণ, ইহারা সাধারণ নরনারীর মত ক্ষুদ্রমনা বা স্বার্থমোহগ্রস্ত নয়। তথাপি ইহারা মৃত্যুর মত এত বড় একটা ঘটনার সম্বন্ধে উদাসীন—মনের মধ্যে সে প্রশ্নকেই যেন ঠাঁই দিতে নারাজ।

 মৃত্যুতে শোক করা, আর মৃত্যুকে দেখা—এই দুইটা এক নয়; এই কথাটাই বার বার বলিয়াও শেষ করিতে পারিতেছি না। শোক সকলেই করে; কিন্তু মৃত্যুকে দেখিতে সকলে চায় না, বা পারে না। মৃত্যুকে যথার্থ দেখিতে পাইলে যে জ্ঞানের উদয় হয় তাহা বজ্রালোকের মত—জীবনের সকল তিমির-সংস্কার বিদীর্ণ করিয়া সে আলোকচ্ছটা মানুষের মানস-চক্ষু ধাঁধিয়া দেয়; সে বজ্র যাহার উপর পতিত হয় সে তন্মুহূর্ত্তেই মহা রহস্য-সাগরে বিলীন হইয়া যায়। যে তাহাকে দেখিয়াছে মাত্র, সেই বজ্রের আলোক যাহার দুই চক্ষু ঝলসিয়া দিয়াছে, সে অস্তিত্বের ঐকান্তিক অভাব চকিতে অনুভব করিয়াছে; সে বুঝিয়াছে, সকল জ্ঞানের সীমা কোথায়—মানুষের মানসবৃত্তি মহাশূন্যকে আচ্ছাদন করিয়া জীবন-রঙ্গভূমির জন্য যে মিথ্যা-বিচিত্র যবনিকা রচনা করে তাহার ছিদ্র কোথায়। সে ছিদ্রমুখে দৃষ্টি সংলগ্ন করিলে যে সত্যের উপলব্ধি হয়, তাহাতে এই প্রতীতি জন্মে যে, জীবনের বাহিরে আর কিছুই নাই—মৃত্যুর পরে আর কোনও রহস্য নাই, মৃত্যু অমৃতের দ্বার নহে। এই জীবনই—‘তিক্ত হোক, মিষ্ট হোক—একমাত্র রস’। ইহার হিসাব বা ব্যবস্থা করিবার কালে কোনও অদৃষ্ট ভবিষ্যৎকে গণনার মধ্যে গ্রহণ করা ভুল; সে ভরসা ত্যাগ করিয়া বীরের মত জীবন-যাপনের নীতি স্থির কর; ভগবান বা পরলোক, আত্মার অমরতা বা ব্রহ্মণ—এ সকল মরীচিকা মাত্র; মৃত্যুকে চাক্ষুষ করিবার মত সাহস নাই বলিয়া, জীবনকে যথার্থরূপে ভোগ করিবার মত হৃদয়-বল নাই বলিয়া, এ পথ্য হজম করিবার মত পরিপাক-শক্তি নাই বলিয়া—সাধারণ জীব আমরা দুধে জল মিশাইয়া, নানা পেটেণ্ট ঔষধের সহযোগে জীবন-পিপাসা নিবৃত্তির উপায় করিয়া থাকি।

 মৃত্যুকে যে যথার্থরূপে দেখিয়াছে, সে দ্বিজত্ব লাভ করিয়াছে—মিথ্যা হইতে সত্যে নব-জন্ম লাভ করিয়াছে। তাহার মানস-প্রকৃতির একটা পরিবর্ত্তন এই হয় যে, সে কোনও কিছুর পরিণাম বা ভবিষ্যৎ পূর্ণতায় আর বিশ্বাস করে না। সে আর যাচ্‌ঞা করে না, প্রাথনা করে না—লাভ-ক্ষতি, মঙ্গল-অমঙ্গল তাহার নিকটে সম-মূল্য। জীবন-বিধাতার নিয়তি-রূপ সে মানিয়া লয় বটে, সে শক্তিকে সে প্রত্যক্ষ করে জীবনমৃত্যুর বন্ধন-পাশরূপে—সে শক্তি ঈশ্বর নয়, তাহার স্বাধীন কর্ত্তৃত্ব নাই; এই জগতের অণু-পরমাণু হইতে মানুষের প্রাণ পর্য্যন্ত সৃষ্টির যত কিছু রূপ-বৈচিত্র্য যে অলঙ্ঘ্য নিয়মের অধীন, সেই নিয়ম-বন্ধনের মূলগ্রন্থিরূপেই সে তাহাকে চিনিয়া লয়; সে গ্রন্থি—আপনাকে আপনি উন্মোচন করা দূরে থাক—একটু শিথিল করিতেও পারে না। ইহাও সে বুঝে—তাহার সেই শক্তির সীমা কতদূর। আমার জীবন-সংস্কারের বাহিরে আমার উপরে তাহার অধিকার কোথায়? জীবনে আমি তাহারই স্ব-বন্ধন-রজ্জুতে আবদ্ধ আছি; মৃত্যুতে আমি সকল বন্ধনমুক্ত—অস্তিত্বের বহির্ভূত। অতএব যে মৃত্যুর স্বরূপ-সন্ধান পাইয়াছে—সে আশাহীন, ভয়হীন; তাহার পরিণাম-চিন্তা নাই, তাহার ভগবান নাই। সে হাতযোড় করিয়া কিছুই যাচনা করে না। যে কেহ এইরূপ দ্বিজত্ব লাভ করিয়াছে, সে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও সুযোগ-মুহূর্ত্তে মৃত্যুকে দেখিতে পাইয়াছে—সে দেখা এমন দেখা যে, তাহার পর জীবন-সংস্কারের অনুকূল কোনও রঙিন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে আর প্রবৃত্তি হয় না। জীবনের নিশীথ-প্রহরের যে লগ্নে সকলে ঘুমাইয়া থাকে, সে তখন সহসা জাগরিত হইয়া প্রকৃতির নেপথ্যগৃহে দৃষ্টিপাত করিয়াছে; সেখানে যে দৃশ্য তাহার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইয়াছে তাহাতে দুই চক্ষের মায়া-অঞ্জন মুছিয়া গিয়া সর্ব্বমোহের অবসান হইয়াছে—সে চরম সত্যের দীক্ষালাভ করিয়াছে।

 মানুষ মৃত্যুকে ভয় করে—পশুও করে; পশুর জীব-সংস্কার অস্পষ্ট, তাই তাহার ভয়ও অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট সহজাত মৃত্যু-ভয়ের উপরে মানুষ খুব বড় একটা কাল্পনিক ভয়কে খাড়া করিয়াছে—‘the dread of something after death’। মানুষ বাঁচিতে চায়—কারণ, বাঁচিয়া-থাকার একটা জ্ঞান তাহার আছে—দেহগত জীব-সংস্কার ছাড়া একটা মানস-সংস্কার গড়িয়া উঠিয়াছে; এই সংস্কার বশে সে ইহজীবনকে পরজীবনে প্রসারিত না করিয়া পারে না। এই অন্ধ প্রাণগত বিশ্বাসের বশে সে মৃত্যুকে একটা জীবনান্তর সেতু বলিয়া মনে করে—এই সেতুই বৈতরণী, এক পার হইতে আর এক পারে পঁহুছিবার অগ্নিময় খেয়া-পার। পার হওয়ার পর সে থাকিবে; কিন্তু কি অবস্থায় থাকিবে তাহা জানে না। মৃত্যুর সঙ্গেই যদি জীবন-শেষ না হয়, তবে জীবনের শেষ কোথায়? সেই অনন্ত জীবন এক দিকে যেমন তাহাকে আশ্বস্ত করে, অপর দিকে অবস্থান্তরের অনিশ্চয়তা তাহাকে অধিকতর শঙ্কাকুল করিয়া তোলে। মনুষ্য-সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস অতীত কালে যতদূর আমাদের দৃষ্টিরোধ না করে, তাহাতে—খুব আধুনিক যুগ ছাড়া আর আর সকল যুগে—মানুষের মৃত্যু সম্বন্ধীয় এই ধারণাই তাহার জীবনকে সমধিক নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে বলিয়া মনে হয়। মানুষ তাহার জীবনের অর্দ্ধেক—কি তাহারও বেশি—ভগবান ও দেবতাকুলকে বাঁটিয়া দিয়াছে, জীবনের সূর্য্যালোক মৃত্যুপারের রহস্যময় কুহেলিকায় আচ্ছন্ন করিয়া দেখিয়াছে, জীবনের উপরে মৃত্যুচিন্তাকে নানা ভাবে নানা ভঙ্গিতে প্রশ্রয় দিয়াছে। এই ভয়-সংশয় আশা-বিশ্বাস তাহার সর্ব্ববিধ ভাবনা ধারণা—হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্তুগুলিতে পর্য্যন্ত—জড়াইয়া আছে; সে এই নশ্বর দেহের ক্ষুৎপিপাসাকে অমৃতপিপাসায় শোধন করিবার চেষ্টা করিয়াছে, ভোগের মধ্যে ত্যাগকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া মনুষ্য-চরিত্রকে একটা বিরাট বীর-মহিমার আধার করিয়া তুলিয়াছে। এ সকলের মুলে ওই এক সংস্কার—মৃত্যুই শেষ নয়, আত্মা অমর, তাহার গতি লোকলোকান্তরে অপ্রতিহত, এ জীবন তাহার তুলনায় অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। এইরূপ ভাবনার দ্বারা জীবনকে শোধন করিয়া মানুষ যে আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছে, মৃত্যুকে মহিমান্বিত করিয়া মৃত্যু-ভয় নিবারণের যে প্রয়াস পাইয়াছে, তাহাতে ইহাই প্রমাণ হয় যে, মানুষ জীবিতকালেই মৃত্যুর সাধনা করিয়াছে—জীবনের অনেকখানি মৃত্যুর নামে উৎসর্গ করিয়া একটা আপোষ করিতে চাহিয়াছে; নিরতিশয় শূন্য যাহা তাহাকে কল্পনায় পূর্ণ করিয়া সে বিভীষিকা হইতে যতটা সম্ভব বাঁচিবার প্রয়াস পাইয়াছে। এই যে মিথ্যা, ইহাই আজও পর্য্যন্ত জীবনের মূল ভিত্তি হইয়া রহিয়াছে। জীবন একটা প্রকাণ্ড আত্মপ্রবঞ্চনা—মানুষের যত কিছু ভাবনা সাধনা এই আত্মপ্রবঞ্চনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়াস।

 অতি আধুনিক কালে মানুষের এ বিশ্বাস টলিতে সুরু করিয়াছে, মানুষ ভগবান পরলোক প্রভৃতিতে আর তেমন আস্থাবান হইতে পারিতেছে না, আত্মপ্রবঞ্চনার শক্তি, অর্থাৎ নিছক ভাব-চিন্তা বা কল্পনার শক্তি ক্ষয় হইয়া আসিতেছে। জীবন ও জগৎ এখন বে-আব্‌রু হইয়া পড়িয়াছে, প্রত্যক্ষের তাড়নায় অপ্রত্যক্ষের রহস্য বা ভয়-বিস্ময় এখন ফিকা হইয়া পড়িতেছে। আশ্চর্য্য এই যে, তাহার ফলে মানুষের আত্ম-প্রত্যয় যেন ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে, মানুষ যেন আত্মভ্রষ্ট হইয়া পড়িতেছে। মৃত্যুকে স্থিরদৃষ্টিতে দেখার যে কথা বলিয়াছি, সে বিষয়ে কোনও পরিবর্ত্তন হয় নাই—স্বাভাবিক কারণেই তাহা হইতে পারে না; অথচ মানুষ অপ্রত্যক্ষের ভয় বা আশ্বাস হারাইতেছে। প্রত্যক্ষ জীবনের কোনও মহত্ত্ব সে উপলব্ধি করে না—ক্ষুদ্র আয়ুষ্কালের যত কিছু সুখ, দুঃখ, কেবলমাত্র ভোগ-করিতে-পারা বা না-পারার মূল্যে সে গ্রহণ করিতেছে; জীবনকে সে পণ্যস্ত্রীর মত ভোগ করিতে চায়, মৃত্যু সম্বন্ধে সে উদাসীন।

 মৃত্যু সম্বন্ধে মানুষের মনোভাবের এই দুই দিক তুলনা করিয়া দেখিলে মনে হয়, মৃত্যু সম্বন্ধে সত্য ধারণা জীবনের পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, তেমনই প্রয়োজনীয় নহে। কিন্তু মৃত্যু সম্বন্ধে মিথ্যা কল্পনার প্রয়োজন আছে; সেই মিথ্যাই মানুষের জীবনকে যে রঙে রঙিন করিয়া তোলে, তাহার রক্তে যে অবসাদ বা উন্মাদনা জাগায়, তাহারই ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের হৃদয়বৃত্তির উন্মেষ হয়—কামনার শক্তি বাড়ে। দেহযন্ত্রে রক্তসঞ্চালনই জীবন নহে—সেটা জীবন-ক্রিয়া মাত্র, কামই জীবনীশক্তির মূল। এই কাম যদি কল্পনাহীন হইয়া পড়ে—যদি জীবন-ক্রিয়ার বাহিরে তাহার কোনও স্ফূর্ত্তির অবকাশ না থাকে, তবে মানুষ দুর্ব্বল হইয়া পড়ে, তাহার ভোগ-ক্ষমতাও কমিয়া যায়। এ পর্য্যন্ত মানুষ যেখানে যত শক্তির পরিচয় দিয়াছে, তাহার মূলে আছে প্রবল কামনা। তাহাকে জয় করা, অথবা জয়ী করা—এই উভয়ের শক্তি এক; এ শক্তির মূলে আছে মরণান্তরিত মহাজীবনের স্বপ্ন, অমরতার আশ্বাস। তাহার ভরসায় মানুষ যেমন ইহজীবনের সর্ব্বস্ব হাসিমুখে ত্যাগ করিতে পারে, তেমনই ভ্রূক্ষেপহীন হইয়া জীবনের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া ভোগের পথে নিঃশেষে আপনাকে ছাড়িয়া দিতে পারে; কারণ উভয়ত্র এ বিশ্বাস আছে যে, ইহাই শেষ নয়—আমার মৃত্যু নাই, শেষ পর্য্যন্ত কোন খানে ক্ষয় বা ক্ষতির আশঙ্কা নাই; যে অসীম অনন্ত জীবন সম্মুখে নিত্যকাল প্রসারিত হইয়া থাকিবে, তাহাতে কত অবস্থান্তর, কত জয়-পরাজয়, কত লাভক্ষতির অবকাশ আছে! দুঃখ কিসের? কার্পণ্যের প্রয়োজন কি? ভোগেই হোক আর ত্যাগেই হোক, মানুষের অন্তরের অন্তরে সেই বিশ্বাস থাকে—সেই কল্পনার শক্তিই মানুষকে এত শক্তিশালী করিয়া তোলে।

 অতএব, মানুষের পক্ষে এই কল্পনাই ভাল—সত্য ভাল নয়; সত্য বিষ, সত্য মারাত্মক। মানুষের সমগ্র জীবনাদর্শের মূলে আছে এই প্রকাণ্ড ছলনা, এই মহতী মিথ্যা। যোগী, ঋষি, সন্ন্যাসী, দার্শনিক কেহই এই মিথ্যার সেবা হইতে নিষ্কৃতি পায় নাই; নাস্তিক বা আস্তিক, ভক্ত বা জ্ঞানী, সকলেই—কেহ সূক্ষ্ম কেহ স্থূলভাবে—এই মিথ্যার আরাধনা করিয়া থাকে। মৃত্যুর অন্তর্নিহিত যে সহজ প্রত্যক্ষ সত্য তাহাতে আস্থাবান না হইবার একমাত্র কারণ—মানুষ মরিতে চায় না; এমন কথা স্পষ্টই বলে, যেহেতু আমি মরিতে চাই না, অতএব আমি মরিব না। মৃত্যুর সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেই দার্শনিক যে সকল তত্ত্বের আলোচনায় প্রবৃত্ত হয় তাহাতে সে প্রশ্নের কোনও সরাসরি জবাব মেলে না। সচ্চিদানন্দ-ব্যবসায়ী বৈদান্তিক অস্তি-ভাতি-নামরূপ প্রভৃতি ব্যাখ্যার দ্বারা, ক্ষুদ্র আস্তিক্যবুদ্ধি লোপ করিয়া মহা আস্তিক্যবুদ্ধির প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত হইয়া উঠেন। বেশ বুঝিতে পারিবে, থাকা অর্থে তুমি যাহা অনুভব কর, তোমার যে একমাত্র সহজ ব্যক্তি-চেতনা ব্যতীত আর সকলই তোমার সংস্কার-বিরোধী—যাহাকে ছাড়িয়া আর কিছুর ভাবনা তোমার সত্যকার ভাবনা হইতেই পারে না—তাহা যে মিথ্যা, অর্থাৎ তুমি থাকিবে না, তোমার সে অস্তিত্ব একেবারে লোপ পাইবে—এ কথা দার্শনিক মাত্রেই স্বীকার করিবে; কিন্তু তাহার স্থানে একটি অতি বিশুদ্ধ অস্তিত্ব, একটি নামগোত্রহীন সত্তার আশ্বাসে তোমাকে আশ্বস্ত হইতে হইবে—ইহারই নাম আস্তিকতা। যাহারা নাস্তিক্যবাদী তাহাদের মতের সঙ্গে এই মতের বিশেষ পার্থক্য নাই; যাহা কিছু পার্থক্য—সে কেবল চিন্তাপ্রণালীর সুক্ষ্ম কৌশল-ভেদ। ইহাদের নিকট মৃত্যু সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেই দেখিবে, ইহারা সহজভাবে তাহার উত্তর দিবে না—যেন প্রশ্নটা নিতান্তই স্থূল। তাহার কারণ, তাহারাও মৃত্যুকে দেখিবার সাহস করে না, প্রাণের অনুভূতিকে জ্ঞানের দ্বারা রোধ করিয়া মনস্বিতার নামে অন্যমনস্ক হইতে চায়। আসল কথা, তাহারাও মানুষ—জীবধর্ম্মী; মৃত্যুর স্বরূপচিন্তা তাহাদেরও সংস্কার-বিরোধী।

 মনে কর, কোনও বড় কর্ম্মী বা জ্ঞান-বীরের শেষ মুহূর্ত্ত উপস্থিত। মৃত্যুর আক্রমণে দেহ বিবশ, মুহুর্মুহু আক্ষেপ হইতেছে—মুখ বিবর্ণ ও বিকৃত, চেতনা আচ্ছন্ন, চক্ষুতারকা দৃষ্টিহীন। সে সময়ে, সে ব্যক্তির মহত্ত্ব, তাহার কীর্ত্তি বা তপস্যা-গৌরব স্মরণ করিয়া—তাহার সেই মৃত্যুমলিন দীন কাতর মূর্ত্তির প্রতি করুণা অনুভব না করিয়া পার? ভাল করিয়া তাহার সেই মৃত্যুযাতনাক্লিষ্ট নিশ্বাস, দেহের সেই অন্তিম মিনতিপূর্ণ আবেদন যদি বুঝিয়া থাক, তবে মহান আত্মা বা মহতী কীর্ত্তির এই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম নিরীক্ষণ করিয়া, এই ভাবিয়া আশ্বস্ত হইবে না যে, যে ব্যক্তির জীবন ধন্য হইয়াছে—তাহার মৃত্যু মৃত্যুই নয়; বরং, মনে হইবে, ওই ব্যক্তি সর্ব্বজীবের মতই আজ মৃত্যুর অধীন হইল—এ মুহূর্ত্তে তাহার নিজের পক্ষে সর্ব্ব কীর্তি, সর্ব্ব গৌরব বৃথা; তাহার কীর্ত্তির জন্য জীবিতেরা জয়ধ্বনি করিবে, কারণ সে কীর্ত্তির উত্তরাধিকারী তাহারা; কিন্তু ঐ যে প্রাণ-বুদ্বুদ অসীম শূন্যে বিলীন হইতেছে, উহার রহিল কি? নশ্বরতার হাত হইতে কোন্ কীর্ত্তি তাহাকে রক্ষা করিবে? সকল মিথ্যা অভিমান, মনোগত সংস্কার ত্যাগ করিয়া মুমূর্ষুর পানে চাহিয়া দেখ—তাহার মরজীবনের চরম লাঞ্ছনা, তাহার ক্ষণ-অস্তিত্বের চির-অবসান, নিয়তির নির্ম্মম অট্টহাস চাক্ষুষ করিতে পারিবে। জীবনের চেয়ে বড় কি আছে?—সেই জীবন হইতে বঞ্চিত হওয়ার যে নিদারুণ নিঃস্বতা, তাহা কি ওই ব্যক্তির পক্ষে সত্য নয়? সে কি কাহারও চেয়ে কম হতভাগ্য? মৃত্যুর আঘাতে তাহার মুখ কি কালিমালিপ্ত হয় নাই—তাহার মহাপ্রাণী কি শেষ মূহূর্ত্ত পর্য্যন্ত বাঁচিবার চেষ্টা করিবে না? চাহিয়া দেখ— মহামনীষী মহাপুরুষ বা মহাবীরের মৃত্যুও মৃত্যু; তাহার সেই মৃত্যুকালীন মুখচ্ছবি লক্ষ্য করিলে বুঝিতে পারিবে, মৃত্যুই চরম অভিশাপ, কোনও কীর্ত্তি কোনও গৌরব সে ক্ষতিপূরণ করিতে পারে না—যাইবার সময়ে তাহাকেও ভিখারীর মত যাইতে হইবে!

 মৃত্যুকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করিতে হইলে হৃদয় দিয়া উপলব্ধি করিতে হয়—মস্তিষ্কের সাহায্যে, তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা নয়। যাহার প্রেম যত বড়, যাহার হৃদয়-বৃত্তি যত গভীর—সেই মৃত্যুকে তত সুস্পষ্ট দেখিতে পায়; সে সহজেই আত্মসংস্কার বিসর্জ্জন দিতে পারে বলিয়াই মৃত্যু তাহাকে ফাঁকি দিতে পারে না। মহাপ্রেমিক নহিলে নাস্তিক হইতে পারে না। মৃত্যু যে কত বড় পরিসমাপ্তি, কত বড় শূন্য, তাহা আত্মাভিমানী জ্ঞানী বুঝিবে কেমন করিয়া? যে আপনাকে ত্যাগ করিতে পারে না, যে নিজে মরিতে ভয় পায়, সে আপনার জন্য একটা অবিনশ্বরতার স্বপ্ন দেখে—যেমন অর্থেই হোক, একটা অস্তিত্বের অভিমান সে শেষ পর্য্যন্ত ধরিয়া থাকিবে। তাই, যে গেল সে যে একেবারেই গেল, এমন বিশ্বাস সে প্রাণ থাকিতে করিবে না। কিন্তু যে পরের মৃত্যুতে আপনার ভাবনা না ভাবিয়া পরের ভাবনাই ভাবে; যে মরিল তাহার আত্যন্তিক অভাব অনুভর করার পক্ষে যাহার নিজ পরিণাম-ভাবনা বাধা হইতে পারে না, সে-ই অন্তরের অন্তরে বুঝিতে পারে—মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না; কারণ, সে যে মৃত প্রিয়জনের সম্পর্কে সত্যকেই চায়, মিথ্যা দিয়া সেই অভাব পূরণ করিতে তাহার হৃদয় একাস্ত বিমুখ। এজন্য প্রেমই মানুষকে মৃত্যুর স্বরূপ দেখায়, প্রেমিক ভিন্ন আর কেহ নাস্তিক হইতে পারে না। জগতের আদি মহাপ্রেমিক বুদ্ধ-ভগবান এই জন্যই নাস্তিক ছিলেন; তিনি আত্মার গল্পে বিশ্বাস করিতে পারেন নাই—তিনি মৃত্যুকে দেখিয়াছিলেন বলিয়াই জন্মস্রোত রুদ্ধ করিবার জন্য নির্ব্বাণ-মন্ত্র প্রচার করিয়াছিলেন।

 মৃত্যু-দর্শন সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি, তাহা তত্ত্বালোচনা বা চিন্তাবিলাস নয়। মৃত্যুর তত্ত্বালোচনা করিতে হইলে সমগ্র মানব-চিন্তার ইতিহাস উদ্ঘাটন করিতে হয়, তাহাতেও মৃত্যু সম্বন্ধে কোনও সংশয়রহিত জ্ঞান লাভ হইবে না; তাহার প্রমাণ, মৃত্যুর স্বরূপ সম্বন্ধে মানুষের অজ্ঞতা এ পর্য্যন্ত সমান রহিয়াছে। যত যুক্তি, যত পাণ্ডিত্য, যত সূক্ষ্ম দার্শনিক তর্করীতিই এ বিষয়ে নিয়োজিত কর, কিছুতেই কিছু হইবে না। এই মহা রহস্য-নিকেতনের দ্বারে স্বয়ং মহাকাল ওষ্ঠে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া দাঁড়াইয়া আছে—কোনও জিজ্ঞাসার অবসর সেখানে নাই। সে উপায় নাই বলিয়া মানুষ দর্শন-শাস্ত্র রচনা করিয়াছে, অর্থাৎ এক-তরফা আপন মনে বকিয়া চলিয়াছে—কিন্তু মহাকাল তেমনই নীরব। যে কলস শূন্য তাহাকে উল্টাইয়া নিঃশেষ করা যেমন অসম্ভব, তেমনই যে তত্ত্ব মূলেই নাস্তি, তাহার সন্ধান শেষ হইতে পারে না। তাই, সন্ধানের বস্তুটার চেয়ে সন্ধানের নেশাটাই বড় হইয়া উঠিয়াছে; তাহার কারণ, সত্য মানেই ধ্বংস, প্রলয়, শেষ,—নেশাই জীবন। এ নেশা ভাঙিতে চাহিবে কে? অর্থোপার্জ্জন যেমন নেশা, ধর্ম্মোপার্জ্জন যেমন নেশা—বিদ্যা-উপার্জ্জন বা তত্ত্ব-চর্চ্চাও সেইরূপ নেশা। যে সত্যের পিছনে মানুষ যুগ যুগ ধরিয়া ছুটিতেছে তাহাকে পাইতে হইলে সকল নেশা ত্যাগ করিতে হয়; চক্ষুর দৃষ্টি—দূরে নয়—নিকটে সংলগ্ন করিতে হয়; জ্ঞানের অভিমান নয়—প্রাণের ঐকান্তিকতা অর্জ্জন করিতে হয়। যাহাকে শিকার করিয়া ধরিতে চাও সে শিকারের বস্তু নয়, জ্ঞান-বুদ্ধির নিশিত শরও তাহাকে বিদ্ধ করিতে পারে না; সে ধরা দেয় স্বেচ্ছায়— সে বাস করে হৃদয়ের অতি সন্নিকটে। সমস্যার সে গ্রন্থি অতি সরল; তাহাকে খুলিতে হইলে অতি লঘুস্পর্শ অঙ্গুলির চকিত প্রয়োগই যথেষ্ট, বল প্রয়োগ করিলেই সে বন্ধন বজ্রকঠিন হইয়া উঠে। মৃত্যু আমাদের প্রাণের অতি সন্নিকটে বাস করিতেছে, তাহাকে আমরা অহরহ দেখিতেছি তথাপি তাহাকে চিনি না কেন? চিনিলে যে আমাদের নেশা ছুটিয়া যায়! আমরা গ্রন্থির উপর গ্রন্থি বাঁধিয়া নেশা বজায় রাখিয়াছি, পাছে সকল রহস্যের মূল এই মৃত্যু অতি সবল হইয়া আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎ সকল আশা সকল সংশয় ছুটিয়া যায়। যাহা চরম সত্য তাহাই পরম সরল—যাহা যত জটিল তাহা ততই মিথ্যা। জগতে যেখানে যে সত্যকে লাভ করিয়াছে সে এইরূপ সরল অকুতোভয় দৃষ্টির সাহায্যেই তাহাকে লাভ করিয়াছে—তাহাতে তর্ক নাই, চিন্তা-বিলাস বা যুক্তি-তর্কের আস্ফালন নাই। মৃত্যু সম্বন্ধে যে সত্য, তাহাকেও তেমনই ভাবে লাভ করা যায়—অন্য উপায় নাই। সে সত্য প্রবেশ করে হৃদয়ে, অথচ হৃদয়কেই বিদীর্ণ করে। যখন সেই মহাসত্য হৃদয়ঙ্গম হয়, তখন শোক করিতে গিয়া হৃদয় স্তম্ভিত হয়—কোনও অজুহাত কোনও আশ্রয় পায় না; উচ্ছ্বসিত রোদন যখন সেই মহাশূন্যের অট্টহাস্যে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে, তখন মনে হয়, এ সত্যের সাক্ষাৎকারে কতখানি শক্তির প্রয়োজন। যে নিমেষে মিথ্যার মোহপাশ মোচন করিয়াছে তাহার শাস্তি কি ভীষণ! তাই মৃত্যু-দর্শনের কথা যাহা লিখিয়াছি, তাহা মুছিয়া ফেলিতে ইচ্ছা হয়; মৃত্যু যত বড় অভিশাপ, মৃত্যু-দর্শন তাহার চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ ধর্ম্মবিশ্বাস অথবা দার্শনিক চিন্তাবিলাস লইয়াই থাকুক—মৃত্যুর সত্যকে উপলব্ধি করার মত দুর্ভাগ্য যেন কাহারও না হয়।

শ্রাবণ, ১৩৩৯