বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/ত্রয়োবিংশ প্রবাহ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োবিংশ প্রবাহ

 স্বার্থপ্রসবিনী গর্ভবতী আশা যত দিন সন্তান প্রসব না করে, তত দিন আশাজীবী লোকের সংশিত মানসাকাশে ইষ্টচন্দ্রের উদয় হয় না। রাত্রির পর দিন, দিনের পর রাত্রি আসিতে লাগিল। এই রকমে দিবারজনীর যাতায়াত। জেয়াদের মানসকাশে ততদিন শান্তি-চন্দ্রের উদয় হয় নাই! সর্ব্বদাই তিনি অন্যমনস্ক! সর্ব্বদাই যেন দুশ্চিন্তাতে নিমগ্ন! ইহা এক প্রকার মোহ! জেয়াদ দিন দিন, দিন গণনা করিতেছেন,ক্রমে গণনার দিন পরিপুর্ণ হইল, মদিনা হইতে কাসেদ ফিরিয়া আসিল। কুফা আগমনে হোসেনের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এতদিন না আসিবার কারণ কি? দিনের পর দিন যাইতে লাগিল। সূর্য্যের পর চন্দ্র আসিতে লাগিল। বিনা চন্দ্রে নক্ষত্রের উদয় সম্ভব। সে দিনও ক্রমে ক্রমে উত্তীর্ণ হইল, নিশ্চয় যে দিন হোসেন আসিবেন সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, তাহাও গত হইয়া গেল। তাহার পর পরিজন লইয়া একত্র আসিতে যে বিলম্ব সম্ভব, তাহাও গণনা করিয়া দেখা হইল! কিন্তু হোসেন আসিলেন না। জেয়াদ এই বার বড়ই ভাবিত হইলেন, দিবারাত্রই চিন্তা করিতে লাগিলেন! কি কৌশলে হোসেনকে হস্তগত করিয়া বন্দীভাবে এজিদের হাতে অর্পণ করিবেন, সেই চিন্তাই মহাপ্রবল হইল। পুনরায় মদিনায় সংবাদ পাঠাইতে মনস্থ করিয়া ভাবিলেন, “হোসেন যে বংশের সন্তান, তাহাতে তাঁহার অন্তর্যামী হইতেই বা আশ্চর্য্য কি? আমার অব্যক্ত মনোগত ভাব বোধ হয় তিনি জানিতে পারিয়াছেন। আবার সংবাদ দিয়া কি নূতন বিপদে নিপতিত হইব?” পরামর্শ স্থির হইল না। তিনি নানা প্রকার ভাবিতেছেন, এমন সময় নূতন সংবাদ আসিল, মদিনা হইতে হোসেনের প্রেরিত সহস্র সৈন্যসহ মোস্‌লেম নগরে আসিয়া উপস্থিত; রাজদরবারে আসিতে ইচ্ছুক। পরম্পরায় এই সংবাদ শুনিয়া জেয়াদ আরও চিন্তিত হইলেন। “হোসেন স্বয়ং না আসিয়া দূত পাঠাইবার কারণ কি? হইতে পারে এটি আমার প্রথম পরীক্ষা। আমার মনোগত ভাব জানিবার জন্যই হয় ত তিনি দূত প্রেরণ করিয়াছেন।”—মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, সাদরে মোস্‌লেমকে অভ্যর্থনা করিয়া সভাগৃহে আনিতে তিনি প্রধান মন্ত্রীকে আদেশ করিলেন।

 মোস্‌লেম সভায় উপস্থিত হইলে জেয়াদ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “দূতবর! বোধ হয়, প্রভু হোসেনের আজ্ঞাক্রমেই আপনার আগমন হইয়াছে। প্রভুর না আসিবার কারণ কি? এ সিংহাসন তাঁহার জন্য শূন্য আছে; রাজকার্য্য বহুদিন হইতে বন্ধ রহিয়াছে। প্রজাগণ, সভাসদগণ প্রভুর আগমন প্রতীক্ষায় পথপানে চাহিয়া রহিয়াছে। আমি যে চিরকিঙ্কর, দাসানুদাসেরও অনুপযুক্ত, আমিও সেই পবিত্র পদসেবা করিবার আশায় এতদিন সমুদয় কার্য্য পরিত্যগ করিয়া বসিয়া আছি! কি দোষে প্রভু আমাদিগকে বঞ্চিত করিলেন, বুঝিতে পারিতেছি না।”

 মোস্‌লম বলিলেন, “এমাম হোসেন শীঘ্রই মদিনা পরিত্যাগ করিবেন। মদিনাবাসীরা অনেক প্রতিবন্ধকতা করায় তিনি শীঘ্র শীঘ্র আসিতে পারেন নাই। আপনাকে সান্ত্বনা করিয়া আশ্বস্ত করিবার জন্যই অগ্রে আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন, তিনি শীঘ্রই আসিবেন।”

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ পূর্ব্ববৎ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “আপনি প্রভুর পক্ষ হইতে আসিয়াছেন, আমরা আপনাকে প্রভুর ন্যায় গ্রহণ করিব।” এই বলিয়া মোস্‌লেমকে রাজসিংহাসনে বসাইয়া আবদুল্লাহ্ জেয়াদ ভৃত্যের ন্যায় সেবা করিতে লাগিলেন। অমাত্যগণ, সভাসদগণ, রাজকর্ম্মচারিগণ সকলেই রীত্যনুসারে উপটোকনের সহিত নতশিরে, ভক্তিসহকারে রাজদূতকে ‘রাজা’ বলিয়া মান্য করিলেন। ক্রমে অধীন রাজগণও মর্য্যাদা রক্ষা করিয়া নূন্যতা স্বীকারে নতশিরে প্রণিপাত করিলেন।

 মোস্‌লেম কিছু দিন নির্ব্বিঘ্নে রাজকার্য্য চালাইলেন, অধীন সর্ব্বসাধারণ তাঁহার নিরপেক্ষ বিচারে আশার অতিরিক্ত সুখী হইলেন, সকলেই তাঁহার আজ্ঞাকারী। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ সদাসর্ব্বদা আজ্ঞাবহ কিঙ্করের ন্যায় উপস্থিত থাকিয়া মোস্‌লেমের আদেশ প্রতিপালনে ভক্তির প্রাধান্য দেখাইলেন। মোস্‌লেমের মনে সন্দেহের নামমাত্রও রহিল না। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও কোন প্রকারের কপট ভাব, বা লক্ষণ, ষড়যন্ত্রের কুঅভিসন্ধি, এজিদের সহিত যোগাযোগ, কুমন্ত্রণা, এজিদের পক্ষ হইয়া বাহ্যিক প্রণয়াভাব এবং অন্তরে তদ্বিপরীত, ইহার কিছুই জানিতে পারিলেন না। জেয়াদের প্রাণের কথা দুই কর্ণ হইলে ত সন্ধানের অঙ্কুর পাইবেন? যাহা আছে তাহা জেয়াদের অন্তরেই রহিয়াছে। কুফা নগরে জেয়াদের অন্তর ভিন্ন হোসেন-সম্বন্ধীয় নিগূঢ় কথা কাহারও কর্ণে প্রবেশ করে নাই। এমন কি, জেয়াদ অন্তর হইতে সে কথা আপন মুখে আনিতেও এত সতর্কভাব অবলম্বন করিয়াছেন যে, তাহা অপরের কর্ণে যাইবার কোনই সম্ভাবনা নাই। মোস্‌লেম পরাস্ত হইলেন। তাঁহার সন্ধান ব্যর্থ হইল, চতুরতা ভাসিয়া গেল। বাধ্য হইয়া তিনি কুফার আনুপূর্ব্বিক সমস্ত বিবরণ মদিনায় লিখিয়া পাঠাইলেন,—

 “হজরত! নির্ব্বিঘ্নে আমি কুফায় আসিয়াছি। রাজা জেয়াদ সমাদরে আমাকে গ্রহণ করিয়াছেন। কোন কপটতা জানিতে পারি নাই। নগরবাসীরা এমামের নামে চিরবিশ্বস্ত এবং এমামের চিরভক্ত, লক্ষণে তাহাও বুঝিলাম! এখন আপনার যেরূপ অভিরুচি।

বশম্বদ—
মোস্‌লেম”

 হোসেন পত্র পাইয়া সন্তুষ্ট হইলেন। পুত্র, কন্যা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভ্রাতৃবধূদ্বয় প্রভৃতির সহিত ঈশ্বরের নাম করিয়া কুফায় যাত্রা করিলেন। ষষ্টি সহস্র লোক মদিনা পরিত্যাগ করিয়া হোসেনের অনুগামী হইল। এমাম হোসেন সকলের সহিত একত্র কুফাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন; কিন্তু এজিদের কথা মনে হইলেই তাহার মুখ সর্ব্বদা রক্তবর্ণে রঞ্জিত হইয়া উঠিত। হজরতের রওজা-আশ্রয়ে থাকার সময় কোন দিন কোন মুহূর্ত্তে অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হয় নাই। এক্ষণে প্রতি মুহূর্ত্তে এই আশঙ্কা যে, এজিদের সৈন্য পশ্চাদ্বর্ত্তী হইয়া আক্রমণ করিলে আর নিস্তার নাই। ক্রমে দিন অতীত হইল, এগার দিনের পর হোসেনের অন্তর হইতে এজিদের ভয় ক্রমে ক্রমে দূর হইতে লাগিল। মনে সাহস এই যে, কুফা অতি নিকট, সেখানে এজিদের ক্ষমতা কি? তিনি একেবারে নিশ্চিন্ত হইয়া যাইতে লাগিলেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদের গুপ্তচরগণ চতুর্দ্দিকে রহিয়াছে, হোসেন মদিনা পরিত্যাগ করিয়া এ পর্য্যন্ত যেদিন যে প্রকারে যে স্থানে অবস্থিতি করিতেছেন, যেখানে যাইতেছেন, সকল সংবাদ প্রতিদিন দামেস্ক এবং কুফায় যাইতেছে। কুফা নগরে মোস্‌লেমকে প্রকাশ্য রাজসিংহাসনে জেয়াদ বিশেষ ভক্তিসহকারেই বসাইয়াছেন। মোস্‌লেম প্রকাশ্যে রাজা, কিন্তু জেয়াদের মতে তিনি এক প্রকার বন্দী। সহস্র সৈন্যের সহিত মোস্‌লেম কুফায় বন্দী। জেয়াদ এমন কৌশলে তাঁহাকে রাখিয়াছেন এবং মোস্‌লেমের আদেশানুসারে কার্য্য করিতেছেন যে, মোস্‌লেম জেয়াদ-চক্রে বাস্তবিক সৈন্যসহ বন্দী, তাহা তিনি কিছুতেই জানিতে পারিতেছেন না, কেবল হোসেনের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন।

 ঈশ্বরের মহিমার অন্ত নাই! একটি সামান্য বৃক্ষপত্রেও তাঁহার শত সহস্র মহিমা প্রকাশ পাইতেছে! একটি পতঙ্গের ক্ষুদ্র পালকেও তাঁহার অনন্ত শিল্পকার্য্য বিভাসিত হইতেছে! অনন্ত বালুকারাশির একটি ক্ষুদ্র বালুকণাতেও তাঁহার অনন্ত করুণা আঁকা রহিয়াছে! তুমি আমি সে করুণা হয়ত জানিতে পারিতেছি না; কিন্তু তাঁহার লীলাখেলার মাধুর্য্য, কীর্ত্তিকলাপের বৈচিত্র্য, বিশ্বরঙ্গভূমির বিশ্বক্রীড়া একবার পর্য্যালোচনা করিলে ক্ষুদ্র মানব-বুদ্ধি বিচেতন হয়। তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়া অনুমাত্রও বুঝিবার ক্ষমতা মানব-বুদ্ধিতে সুদুর্ল্লভ। সেই অব্যর্থ কৌশলীর কৌশলচক্র ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করে কাহার সাধ্য? ভবিষ্যৎ-গর্ভে কি নিহিত আছে, কে বলিতে পারে? কোন বুদ্ধিমান বলিতে পারেন যে, মুহূর্ত্ত অন্তে তিনি কি ঘটাইবেন? কোন মহাজ্ঞানী পণ্ডিত তাঁহার কৌশলের কণামাত্র বুঝিয়া তদ্বিপরীত কার্য্যে সক্ষম হইতে পারেন? জগতে সকলেই বুদ্ধির অয়াত্তাধীন; কিন্তু ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্যে বুদ্ধি অচল, অক্ষম, অস্ফুট এবং অতি তুচ্ছ। ষষ্ঠি সহস্র লোক হোসেনের সঙ্গে কুফায় যাইতেছে,—সূর্য্যদেব পথ দেখাইতেছেন, —তরু, পর্ব্বত, নির্ঝরিণী পথের চিহ্ন দেখাইয়া যাইতেছে। কুফার পথ পরিচিত, কত লোক তন্মধ্যে রহিয়াছে, কত লোক সেই পথে যাইতেছে; চক্ষু বন্ধ করিয়া তাহারাও কুফা নগরে যাইতে অসমর্থ নহে। কিন্তু সেই সর্ব্বশক্তিমান পূর্ণ-কৌশলীর কৌশলে আজ সকলেই অন্ধ, চক্ষু থাকিতেও অন্ধ! তাঁহার যে আজ্ঞা, সেই কার্য্য; এক দিন তিনি যে আজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার আর বৈলক্ষণ্য নাই, বিপর্য্যয় নাই, ভ্রম নাই! একবার মনোনিবেশপূর্ব্বক অনন্ত আকাশে, অনন্ত জগতে, অনন্ত প্রকৃতিতে বাহ্যিক নয়ন একেবারে নিক্ষেপ করিয়া যথার্থ নয়নে দৃষ্টিপাত কর, সেই মহাশক্তির কিঞ্চিৎ শক্তি বুঝিতে পারিবে। যাহা আমরা ধারণা করিতে পারি না, তাহা দেখিয়া একেবারে বিহ্বল হইতে হয়। তাঁহার আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়, বাক্য অব্যর্থ। হোসেন মহানন্দে কুফায় যাইতেছেন,—ভাবিতেছেনঃ কুফায় যাইতেছি। কিন্তু ঈশ্বর যে, তাঁহাকে পথ ভুলাইয়া বিজন বন কারবালার পথে লইয়া যাইতেছেন, তাহা তিনি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছেন না। কেবল তিনি কেন, ষষ্টি সহস্র লোক চক্ষু থাকিতেও যেন অন্ধ!

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদের সন্ধানী অনুচর গোপনে তাঁহার নিকট যাইয়া সংবাদ দিল যে, এমাম হোসেন মদিনা হইতে ষষ্টি সহস্র সৈন্য সঙ্গে করিয়া কুফায় আসিতেছিলেন, পথ ভুলিয়া ঘোর প্রান্তর কারবালাভিমুখে যাইতেছেন। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ মহাসন্তুষ্ট হইয়া শুভসংবাদবাহী আগন্তুক চরকে যথোপযুক্ত পুরস্কৃত করিয়া বলিলেন, “তোমাকেই আজ কাসেদ-পদে বরণ করিয়া দামেস্কে পাঠাইতেছি।”

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ এজিদের নিকট পত্র লিখিলেন, “বাদশাহের অনুগ্রহে দাসের প্রাণদান হউক! আমি কৌশল করিয়া মোহাম্মদের রওজা হইতে এমাম হোসেনকে বাহির করিয়াছি। বিশ্বস্ত গুপ্ত সন্ধানী অনুচর-মুখে সন্ধান পাইলাম যে, এমাম হোসেন কুফা নগরের পথ ভুলিয়া ‘দাস্ত কারবালা’ অভিমুখে যাইতেছেন। তাঁহার পূর্ব্ব-প্রেরিত সাহসী মহাবীর মোস্‌লেমকে কৌশলে বন্দী করিয়া রাখিয়াছি। এই অবসরে হোসেনের পশ্চাৎ পশ্চাৎ কতকগুলি ভাল ভাল সৈন্য প্রেরণ করা নিতান্ত আবশ্যক। ওত্‌বে অলীদকে কুফার দিকে সৈন্যসহ পাঠাইলে, তাহারা প্রথমে মোস্‌লেমকে মারিয়া, পরে হোসেনের পশ্চাদ্‌বর্ত্তী হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিবে। প্রথমে মোস্‌লেমকে মারিতে পারিলে হোসেনের মস্তক দামেস্কে পাঠাইতে আর কোন বিঘ্ন হইবে না, ক্ষণকাল বিলম্বও হইবে না।”

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ স্বহস্তে পত্র লিখিয়া গুপ্তসন্ধানী অনুচরকে কাসেদপদে নিযুক্ত করিয়া দামেস্কে পাঠাইলেন; এদিকে মোস্‌লেমের নিকট দিন দিন আরও নূন্যতা স্বীকার করিয়া তাঁহার যথোচিত সেবা করিতে লাগিলেন এবং সময়ে সময়ে হোসেনের আগমনের বিলম্বজনিত বাহ্যিক দুঃখে নানাপ্রকার দুঃখ প্রকাশ করিয়া মোস্‌লেমকে নিশ্চিন্ত রাখিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ প্রেরিত কাসেদ পুরস্কার লোভে দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া দামেস্কে পৌঁছিলেন। দামেস্কাধিপতি এজিদ কাসেদের পরিচয় পাইয়া—সমুদয় বৃত্তান্ত নির্জ্জনে অবগত হইয়া, মহানন্দে কাসেদকে যথোচিত পুরস্কার দিয়া, প্রধান প্রধান সৈন্য ও সৈন্যাধ্যক্ষকে আহ্বান-পূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন, “এত দিনের পর আমার পরিশ্রমের ফল ফলিয়াছে। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কৌশল করিয়া হোসেনকে মদিনা হইতে বাহির করিয়াছেন, তোমরা এখনই প্রস্তুত হইয়া হোসেনের অনুসরণ কর। মরুস্থল কারবালার পথে যাইলে, পলাতক হোসেনের দেখা পাইবে। যদি পথের মধ্যে আক্রমণ করিবার সুযোগ না হয়, তবে একেবারে নির্দ্দিষ্ট স্থানে যাইয়া অগ্রে ফোরাত নদীর পূর্ব্বকূল বন্ধ করিবে। মদিনা হইতে কুফা পর্য্যন্ত গমনোপযোগী জল সর্ব্বদা সংগ্রহ করা সহজ মনে করিয়া হোসেন মদিনা পরিত্যাগ করিয়াছেন। সঙ্গেও ষষ্টি-সহস্র লোক। ইহাদের পানোপযোগী জল সর্ব্বদা সংগ্রহ করা সহজ কথা নহে। তোমাদের প্রথম কার্য্যই হইল, কারবালার ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়া রাখা। হোসেন পক্ষীয় একটা প্রাণীও যেন ফোরাতকূলে আসিতে না পারে, ইহার বিশেষ উপায় করিতে হইবে। দিবারাত্র সদাসর্ব্বদা সতর্কভাবে থাকিবে, যেন কোন সময়ে, কোন সুযোগে, এক পাত্র জলও হোসেনের, কি তৎসঙ্গীয় কোন লোকের, আশু প্রাপ্য না হয়। বারি-রোধ করিতে পারিলেই তোমাদের কার্য্য সিদ্ধ হইবে। হোসেনের মস্তক যে ব্যক্তি এই দামেস্কে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিবে, তৎক্ষণাৎ তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পুরস্কার দিব এবং বিজয়ী সৈন্যদিগের নিমিত্ত দামেস্কের রাজভাণ্ডার খুলিয়া রাখিব। যাহার যত ইচ্ছা, সে তাহা গ্রহণ করিতে পারিবে। কোন প্রতিবন্ধক থাকিবে না। প্রধান প্রধান সৈন্যগণ, ওমর, সীমার প্রভৃতি বলিয়া উঠিল, “মহারাজ এবারে হোসেনের মস্তক না লইয়া আর ফিরিব না।” সীমার অতি দর্পে বলিতে লাগিল—“আর কেহই পারিবে না, আমিই হোসেনের মাথা কাটিব, কাটিব—নিশ্চয় কাটিব, পুরস্কার আমিই লইব, আর কেহই পারিবে না। হোসেনের মাথা না লইয়া সীমার এ নগরে আর ফিরিবে ন। এই-ই সীমারের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।”

 এজিদ বলিলেন, “পুরস্কারও তোমার জন্য ধরা রহিল।”—এই বলিয়া আবদুল্লাহ্ ও সীমারকে প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করিয়া বিদায় করিলেন।

 পাঠকগণ! এত দিন আপনাদের সঙ্গে আসিতেছি, কোন দিন মনের কথা বলি নাই। বিষাদ-সিন্ধুতে হাস্য-রহস্যের কোন কথা নাই, তন্নিমিত্ত এ পর্য্যন্ত হাসি নাই। কাঁদিবার অনেক কথা আছে, তথাপি নিজে কাঁদিয়া আপনাদিগকে কাঁদাই নাই। আজ মন কাঁপিয়া উঠিল, সীমার হোসেনের মস্তক না লইয়া আর দামেস্কে ফিরিবে না—প্রতিজ্ঞা করিল। সীমার কে? পরিচয় এখনও প্রকাশ পায় নাই—কিন্তু ভবিষ্যতে ইহার পরিচয় অপ্রকাশ থাকিবে না। সীমারের নামে কেন যে হৃদয়ে আঘাত লাগিতেছে, জানি না। সীমারের রূপ কোন লেখকই বর্ণনা করেন নাই, আমিও করিব না। কল্পনাতুলি হস্তে তুলিয়া আজ আমি এখন সেই সীমারের রূপ-বর্ণনে অক্ষম হইলাম। কারণ, বিষাদ-সিন্ধুর সমুদয় অঙ্গই ধর্ম্মকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট। বর্ণনায় কোন প্রকার ন্যূনাধিক হইলে প্রথমতঃ পাপের ভয়, দ্বিতীয়তঃ মহাকবিদিগের মূল গ্রন্থের অবমাননা ভয়ে তাঁহাদেরই বর্ণনায় যোগ দিলাম। সীমারের বিশাল ধবল বক্ষে লোমের চিহ্নমাত্র নাই; মুখাকৃতি দেখিলেই নির্দ্দয় পাষাণহৃদয় বলিয়া বোধ হইত—দন্তরাজি দীর্ঘ ও বক্রভাবে জড়িত—প্রাচীন কবির এই মাত্র আভাষ এবং আমারও এইমাত্র বলিবার অধিকার,—নাম সীমার।

 এজিদ সৈন্যদিগকে নগরের বাহির করিয়া দিয়া ফিরিয়া আসিলেন। এবং আবদুল্লাহ জেয়াদের লিখন অনুসারে মারওয়ানকে সসৈন্যে মদিনা পরিত্যাগ করিয়া কুফা নগরে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিলেন। সংবাদবাহক সংবাদ লইয়া যাইবার পূর্ব্বেই ওত্‌বে অলীদ ও মারওয়ান সৈন্যসহ হোসেনকে অনুসরণ করিতে কুফার পথে যাত্রা করিয়াছিলেন। পথিমধ্যে দামেস্কের কাসেদ-মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া অলীদ এবং মারওয়ান অবিশ্রান্তভাবে কুফাভিমুখে সৈন্য-সমভিব্যাহারে যাইতে লাগিলেন। দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া বুদ্ধির অগম্য, চিন্তার বহির্ভূত—অল্প সময়ের মধ্যে কুফার নিকটবর্ত্তী হইলে জেয়াদের অনুচরেরা তাঁহার নিকট সংবাদ দিল, “মহারাজ এজিদের সৈন্যাধ্যক্ষ মারওয়ান ও ওত্‌বে অলীদ সৈন্যসহ নগরপ্রান্তে উপস্থিত হইয়াছেন,—কি কর্ত্তব্য?”

 জেয়াদ এতৎ সংবাদে মহাসন্তুষ্ট হইয়া মোস্‌লেম-সমীপে যাইয়া করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “বাদশাহ্-নামদার! এজিদের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ মহাবীর মারওয়ান এবং ওত বে অলীদ কুফার অতি নিকটবর্ত্তী হইয়াছে। বোধ হয়, অদ্যই নগর আক্রমণ করিবে। প্রভু হোসেনের আশায় এত দিন রহিলাম, তিনি ত আসিলেন না; শত্রুপক্ষ নগরর-সীমার নিকটবর্ত্তী, এক্ষণে কি আদেশ হয়?”

 মোস্‌লেম বলিলেন, “আমরা এমন কাপুরুষ নহি যে, শত্রুর অস্ত্রের আঘাত সহ্য করিয়া নগর রক্ষা করিব। আমি এখনই আমার সঙ্গী সৈন্য লইয়া মারওয়ানের গতিরোধ করিব এবং নগর আক্রমণে বাধা দিয়া তাহাদিগকেই আক্রমণ করিব। আপনি যত শীঘ্র পারেন, কুফার সৈন্য লইয়া আমার পশ্চাদ্বর্ত্তী হউন। সৈন্যসহ আপনি আমার পশ্চাদ্-রক্ষক থাকিলে ঈশ্বরের কৃপায় আমি সহস্র মারওয়ানকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করি।” এই কথা বলিয়াই মোস্‌লেম মদিনার সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে অনুমতি-সঙ্কেত করিলেন। মদিনাবাসীরা এজিদ ও এজিদের সৈন্য়-শোণিতে তরবারি রঞ্জিত করিতে সদাসর্ব্বদা প্রস্তুত। মোস্‌লেমের সাঙ্কেতিক অনুমতি, মারওয়ানের সহিত যুদ্ধের অনুমাত্র প্রসঙ্গ পাইয়াই সৈন্যগণ “মার মার” শব্দে শ্রেণীবদ্ধপূর্ব্বক মোস্‌লেমের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। সৈন্যদিগের উৎসাহ দেখিয়া মোস্‌লেম দ্বিগুণ উৎসাহে অশ্বে আরোহণ করিলেন এবং মুহূর্ত্তমধ্যে সৈন্যশ্রেণী শ্রেণীবদ্ধপূর্ব্বক নগরের বাহির হইলেন। কুফার সৈন্যগণও অত্যল্প সময়মধ্যে সুসজ্জিত হইয়া পূর্ব্বতন প্রভু জেয়াদের সহিত সমরে চলিলেন। মোস্‌লেম নগরের বাহির হইয়াই দেখিলেন যে, এজিদের চিহ্নিত পতাকাশ্রেণী বায়ুর সহিত ক্রীড়া করিতেছে, যুদ্ধবাদ্য মহাঘোর রবে বাদিত হইতেছে। মোস্‌লেম সৈন্যগণকে বলিলেন, “ভাই সকল! যে এজিদ, যে মারওয়ান, যে ওত্‌বে অলীদের ভয়ে হোসেন মদিনাবাসীদের জন্য, মদিনাবাসীদিগকে বিপদ-উপদ্রব হইতে রক্ষার জন্য কুফায় আসিতে মনস্থ করিয়া অগ্রে আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, সেই বিধর্ম্মী কাফের তাহারই উদ্দেশ্যে, কিংবা আমাদের প্রাণ লইতে, কিংবা আমাদিগকে যে এত সাহায্য করিতেছে, সেই জেয়াদের প্রাণ বিনাশ করিতে আসিয়াছে। কুফার সৈন্য আসিতে এখনও অনেক বিলম্ব। সময় পাইলেই শত্রুর বল চতুর্গুণ বৃদ্ধি পায়। আর অপেক্ষা নাই, কুফার সৈন্য আসিবে, একত্রে যাইব, ইহা বলিয়া আর সময় নষ্ট করিব না। এস, আমরাই অগ্রে গিয়া শত্রুপক্ষকে বাধা দিয়া আক্রমণ করি।” মোস্‌লেম সহস্র সৈন্য লইয়া একেবারে শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হইলেন; উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল।

 জেয়াদ কুফার সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মোস্‌লেমের পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন। নগরের অন্তসীমার শেষ তোরণ পর্য্যন্ত আসিয়া দেখিলেন, নগারের অন্ত-সীমায় যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে। সৈন্যগণ অবাক হইল। সকলেই, পূর্ব্ব প্রভুর আজ্ঞা হঠাৎ লঙ্ঘন করা বিবেচনাসিদ্ধ নহে, এই বলিয়া বিরতভাবে দণ্ডায়মান রহিল।

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ বলিতে লাগিলেন, “আমি এত দিন মনের কথা তোমাদিগকে কিছুই বলি নাই, আজ বলিবার সময় হইয়াছে বলিয়াই এক্ষণে বলিতেছি! হোসেনকে রাজ্যদান আমার চাতুরী মাত্র। আমি মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ, অনুগৃহীত, আশ্রিত এবং দামেস্কাধিপতি আমার একমাত্র পূজ্য। কারণ আমি তাঁহার অধীনস্থ প্রজা। তাঁহার দেশে হোসেনকে কৌশল করিয়া বন্দী করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘটনাক্রমে তাহা হইল না। মোস্‌লেমকে যে উদ্দেশ্যে সিংহাসনে বসাইয়াছিলাম, তাহা এক প্রকার সম্পূর্ণ হইল; কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হইল না। মহারাজ এজিদের সৈন্য আসিয়াছে, কৌশলে মোস্‌লেমকেও নগরের বাহির করিয়া মহারাজ এজিদের সৈন্যের সম্মুখীন করিয়া দিলাম, রাজাজ্ঞা প্রতিপালিত হইল। আমাদের নগরের বাহিরে কোন প্রয়োজন নাই। আমরা যুদ্ধে যাইব না, মোস্‌লেমের সহায়তাও করিব না। নগরতোরণ আবদ্ধ কর,—বলবান সাহসী সৈনিক পুরুষ নগরতোরণ রক্ষা করুক। মোস্‌লেমের বাঁচিবার সাধ্য নাই। ওত্‌বে অলীদের অস্ত্রের সম্মুখীন হইলেই মোস্‌লেমকে ইহজগৎ পরিত্যাগ করিতে হইবে। তথাপি যদি মোস্‌লেম যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া প্রাণরক্ষার জন্য নগরে আশ্রয় লইতে নগরদ্বারে উপস্থিত হয়, কিছুতেই নগরমধ্যে প্রবেশ করিতে দিবে না!” সৈন্যাধ্যক্ষ এবং সৈন্যগণ আবদুল্লাহ্ জেয়াদের বাক্যে একেবারে অবাক হইয়া রহিল! জেয়াদের মনে এত চাতুরী, এত ছলনা, এত প্রতারণা! ইহাতে তাহারা—আরও আশ্চর্যান্বিত হইল। কিন্তু কি করিবে, নগর-দ্বার রুদ্ধ করিয়া দ্বারের নিকটবর্ত্তী স্থানেই সৈন্যগণের সহিত সকলেই একত্র হইয়া রহিল।

 ওত্‌বে অলীদ মোস্‌লেমকে দেখাইয়া সৈন্যগণকে বেগে অগ্রসর হইতে আদেশ করিলেন। মোস্‌লেম ওত্‌বে অলীদের আক্রমণে বাধা দিয়া বিশেষ পারদর্শিতার সহিত ব্যূহ রচনা করিয়া শত্রুসম্মুখে সৈন্যদিগকে দণ্ডায়মান করাইলেন। কিন্তু আক্রমণ করিতে আর সাহসী হইলেন না, আত্মরক্ষাই আবশ্যক মনে করিলেন। কুফার সৈন্য কত নিকটবর্ত্তী হইয়াছে, তাহা দেখিতে পশ্চাতে ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে মোস্‌লেমের মস্তক ঘুরিয়া গেল। জনপ্রাণী মাত্র নাই, তথাপি নগরতোরণ বদ্ধ—মোস্‌লেম একেবারে হতবুদ্ধির ন্যায় হইয়া নগরের দিকে বার বার চাহিয়া দেখিলেন, পূর্ব্ব প্রকারেই নগরদ্বার বদ্ধ রহিয়াছে। তখন নিশ্চয়ই তিনি মনে মনে জানিলেন যে, এ সকল জেয়াদের চাতুরী! চতুরতা করিয়া সে তাঁহাকে নগরের বাহির করিয়াছে! এখন তিনি নিশ্চয়ই জানিলেন যে, জেয়াদের মনে নানাপ্রকার দুরভিসন্ধি ছিল; হোসেনবধের জন্যই এই মায়াজাল বিস্তার,—তাহাতে আর সন্দেহ নাই। ‘ভালই হইয়াছে, কুফায় আসিলে হজরত যে প্রকারে বিপদগ্রস্ত হইতেন, তাহা আমার ভাগ্যেই ঘটিল। মোস্‌লেমের প্রাণ যাইয়াও যদি হোসেনের প্রাণ রক্ষা হয় তাহাও মোস্‌লেমের পক্ষে সার্থক।’—মনে মনে তিনি এই কথা বলিলেন।

 মােস্‌লেম হতাশ হইলেন না; কিন্তু তাঁহাকে নূতন প্রকার চিন্তার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইল। নিজ সৈন্য এবং কুফার সৈন্যের সাহায্যে যে যে প্রকারে যুদ্ধের পরিকল্পনা করিয়াছিলেন এক্ষণে তিনি তাহা পরিবর্ত্তন করিয়া নূতনরূপ চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। ওদিকে ওত্‌বে অলীদ কি মনে করিয়া আর অগ্রসর হইলেন না। আপন আয়ত্তাধীনে সম্ভবমত দূরে থাকিয়া দ্বৈরথ যুদ্ধ আরম্ভ করিবার অভিপ্রায়ে মহাবীর ওত্‌বে অলীদ গম্ভীরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “মোস্‌লেম! যদি নিতান্তই যুদ্ধসাধ হইয়া থাকে, তবে আইস, আমরা উভয়ে যুদ্ধ করি; জয়-পরাজয় আমাদের উভয়ের উপরই নির্ভর। অনর্থক অন্য অন্য প্রাণ বিনষ্ট করিবার আবশ্যকতা কি?”

 মােস্‌লেম সে কথার উত্তর না দিয়া কতক সৈন্যসহ ওত্‌বে অলীদকে ঘিরিয়া ফেলিলেন। ওত্‌বে অলীদ আবার বলিলেন, “মােস্‌লেম! এই কি যুদ্ধের রীতি, না বীরপুরুষের কর্ত্তব্য কার্য্য? কে তােমাকে বীর-আখ্যা দিয়াছিল? কহ মহারথি! একি মহারথী-প্রথা?”

 মােস্‌লেম সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সৈন্যদিগকে বলিলেন— “ভ্রাতৃগণ! বিধর্ম্মীর হস্তে মৃত্যুতে বড়ই পুণ্য। প্রভু মােহাম্মদের দৌহিত্রগণকে যাহারা, যে পাপাত্মারা, যে নরপিশাচেরা শত্রু মনে করে— তাহাদের প্রাণবিনাশের চেষ্টা করিয়া তাহাদের হস্তে প্রাণিবিসর্জ্জন করিতে পারিলে, তাহা অপেক্ষা ইহজগতে আর কি অধিকতর সুখ আছে? এক দিন মরিব বলিয়াই জন্মিয়াছি। যে মরণে সুখ,—সহস্র সহস্র পাপ থাকিলেও স্বর্গসুখ ভােগের অধিকারী, এমন মরণে কে না সুখী হয়? আমরা যুদ্ধে জয়ী হইব না, ইহার আশাও করি না। তবে বিধর্ম্মীর হস্তস্থিত তরবারি ইস্‌লাম-শােণিতে রঞ্জিত হইয়া পরিণামে আমাদিগকে স্বর্গসুখের অধিকারী করিবে, এই-ই আমাদের আশা। জয়ের আশা আর মনে আনিও না, আজই যুদ্ধের শেষ, আজই আমাদের জীবনের শেয।” মোস্‌লেম এই বলিয়া ওত্‌বে অলীদের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মারওয়ান দেখিলেন যেন, অলীদের পরমায়ু শেষ হইল, সমুদয় সৈন্য একত্র করিয়া মােস্‌লেম আক্রমণ করিয়াছে; ক্ষণকাল বিলম্ব না করিয়া মারওয়ান সমুদয় সৈন্যসহ মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিলেন। ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মোস্‌লেমের জীবনের আশা নাই, তাঁহার সৈন্যগণ বিধর্ম্মীর হস্তে মরিবে—সেই আশায় তিনি কেবল মারিতেই লাগিলেন; ভবিষ্যৎ জ্ঞান, পশ্চাৎ লক্ষ্য, পার্শ্বে দৃষ্টি ইত্যাদির প্রতি কিছুই লক্ষ্য রাখিলেন না। মহাবীর মোস্‌লেম দুই হস্তে তরবারি ধরিলেন, অশ্ববল্গা দন্তে ধারণ করিলেন এবং শত্রুসৈন্য অকাতরে কাটিয়া চলিলেন। মধ্যে মধ্যে “আল্লাহো আকবর” নিনাদে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে সৈন্যদিগকে উৎসাহিত করিলেন। ওত বে অলীদ ও মারওয়ান বহু পরিশ্রম ও বহু চেষ্টা করিয়াও মোস্‌লেমের লঘুহস্তচালিত চপলবৎ তরবারির সম্মুখে আর তিষ্ঠিতে পারিলেন না। ক্ষণকাল মধ্যে সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া দিগ্বিদিক পলাইতে লাগিল। মোস্‌লেমের সৈন্যগণও ঐ পলায়িত শত্রুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইয়া দেহ হইতে বিধর্ম্মীর মস্তক মৃত্তিকাশায়ী করিতে লাগিল।

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ নগরতোরণের উপরিস্থ অতি উচ্চ মঞ্চে উঠিয়া উভয় দলের যুদ্ধ দেখিতেছিলেন; দেখিতেছিলেন, মোস্‌লেমের তরবারীর সম্মুখে কেহই অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। বহুতর সৈন্য মৃত্তিকাশায়ী হইয়াছে। যাহারা জীবিত আছে তাহারাও প্রাণভয়ে দিশাহারা হইয়া পলাইতেছে। জেয়াদ মঞ্চ হইতে নামিয়াই দ্বাররক্ষককে বলিলেন, “দ্বার খুলিয়া দাও"; সৈন্যগণকে আদেশ করিলেন, “আমার পশ্চাদ্‌বর্ত্তী হইয়া মোস্‌লেমকে আক্রমণ কর, আমরা সাহায্য না করিলে ওত্‌বে অলীদের প্রাণ কখনই রক্ষা হইবে না।”

 রাজাজ্ঞা প্রাপ্তি মাত্রই লক্ষাধিক সৈন্য জয়নাদে তুমুল শব্দ করিয়া পশ্চাদ্দিক হইতে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ স্বয়ং যুদ্ধে আসিয়াছেন, মোস্‌লেমের সেদিকে দৃষ্টিপাত নাই, কেবল অশ্ববল্গা দন্তে ধারণ করিয়া দুই হস্তে বিধর্ম্মী নিপাত করিতেছেন। তিনি যাহাকে যে অবস্থায় পাইতেছেন, সেই অবস্থায়ই তাহার দেহ হইতে মস্তক ছিন্ন করিতেছেন; কাহাকেও বা অশ্ব সহিত একচোটে দ্বিখণ্ডিত করিয়া জন্মশোধ তাহার যুদ্ধের সাধ মিটাইতেছেন।

 আবদুল্লাহ জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে মোস্‌লেমকে আক্রমণ করিবার উপক্রম করিতেই ওত্‌বে অলীদ উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “মোস্‌লেম! ঈশ্বরের নাম মনে কর; তোমার সাহায্যের জন্য আবদুল্লাহ্ জেয়াদ লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া আসিতেছেন।”

 মোস্‌লেম জেয়াদের নাম শুনিয়া চমকিতভাবে পশ্চাতে ফিরিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে আর কিছুই বলিলেন না; কেবলমাত্র বলিলেন “বিধর্ম্মীর কথায় যে বিশ্বাস করিবে, কাফেরের ভক্তিতে যে মুসলমান ভুলিবে, তাহার দশাই এইরূপ ঘটিবে?” মোস্‌লেম ভীত হইলেন না, যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়াও পরাজয় স্বীকার করিলেন না, পূর্ব্বমত বিধর্ম্মী-শোণিতে মৃত্তিকা রঞ্জিত করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতে কোনই ফল হইল না। চতুর্দ্দিক হইতে অবিশ্রান্তভাবে মোস্‌লেমের শরীরে শর বিদ্ধ হইতে লাগিল; সর্ব্বাঙ্গে শোর্ণিতধারা ছুটিল। অশ্বপদতলে বিধর্ম্মীর রক্তস্রোত বহিতেছে, যুদ্ধক্ষেত্র মনুষ্যদেহে পরিপূর্ণ হইয়াছে, শোণিতসিক্ত মৃত্তিকায় ক্ষিপ্রগামী মোস্‌লেম শত্রুক্ষয় করিতে নিবৃত্ত হইতেছেন না। শত্রুসৈন্য এত মারিতেছেন, কিন্তু কিছুতেই তাহার শেষ হইতেছে না। দিন মণিও সমস্ত দিনএই ঘোরতর যুদ্ধ দেঘিয়া লোহিতবর্ণে অস্তমিত হইলেন। তৎসঙ্গেই ইসলামগৌরব-রবি মহাবীর মোস্‌লেমও লোহিত বসনে আবৃত হইয়া জগৎ অন্ধকার করিয়া শত্রুহস্তে প্রাণবিসর্জ্জন দিয়া স্বর্গবাসী হইলেন। মদিনার একটি প্রাণীও আর বিধর্ম্মীর অস্ত্র হইতে রক্ষা পাইল না।

 যুদ্ধাবসনে নরপতি জেয়াদ দর্পের সহিত বলিতে লাগিলেন,—“মদিনার শত্রুকুল,—মহারাজ এজিদ-নামদারের নামের বলেই এরূপে নির্ম্মূল হইবে। যেরূপ চিন্তা করিয়া কৌশলজাল বিস্তার করিয়াছিলাম, তাহাতে বাদশাহ নামদারের মহাশত্রু আজ সবংশে বিনষ্ট হইত, দৈববিপাকে তাহা হইল না। মোস্‌লেমের যে দশা ঘটিল, প্রধান শত্রু হোসেনকেই সেই দশায় পতিত হইতে হইত। দামেস্ক ও কুফার সৈন্যের তরবারিধারে হোসেন-মস্তক নিশ্চয়ই দেহবিচ্ছিন্ন হইত। পরিবার, পরিজন, সঙ্গীরাও আজ কুফার সিংহদ্বায়ের সম্মুখস্থ প্রান্তরে রক্তমাখা হইয়া গড়াগড়ি যাইত। ভাগ্যক্রমে হোসেন ষষ্টি সহস্র লোকজনসহ কুফার পথ ভুলিয়া কারবালার পথে গিয়াছে; জেয়াদের হস্ত হইতে রক্ষা পাইয়াছে। সম্পূর্ণরূপে সর্ব্বাংশে যশঃ লাভ করিতে পারিলাম না; ইহাই আমার নিদারুণ আক্ষেপ, মদিনার একটি প্রাণীও আজ কুফার সৈন্যগণের হস্তে রক্ষা পায় নাই, সমুদয় শেষ হইয়া যমালয়ে গমন করিয়াছে। একটি প্রাণীও পলাইতে পারে নাই। ধন্য কুফার সৈন্য!”

 গুপ্তচর, গুপ্তসন্ধানীগণ মধ্য হইতে একজন বলিল,—“ধর্ম্মাবতার। মোস্‌লেমের দুই পুত্র মারা যায় নাই, ধরা পড়িয়া বন্দীও হয় নাই। তাহারা যুদ্ধাবসানে যুদ্ধক্ষেত্র হইতে অতি ত্রস্তপদে নগরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। কি কৌশলে যে তাহারা কুফার সৈন্যগণের চক্ষে ধূলি দিয়া প্রাণ বাঁচাইল, আর এ পর্য্যন্ত যে জীবিত আছে,—ইহই আশ্চর্য্য! মহারাজ!—তাহারা দুই ভ্রাতা এই নগরেই আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছে। আমরা বিশেষ সন্ধানে জানিতে পারিয়াছি, তাহারা নগরের বাহিরে যায় নাই;—যাইতে পারে নাই।”

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ অতি ব্যস্তভাবে বলিতে লাগিলেন,—“সে কি কথা? মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় জীবিত আছে?” অমাত্যগণকে সম্বোধন করিয়া তিনি কহিলেন, “ওহে! এ কি ভয়ানক কথা? ভুজঙ্গ হইতে ভুজঙ্গশিশুর বিষ যে অত্যধিক মারাত্মক তাহা কি তোমরা জান না? এখনই ডঙ্কা বাজাইয়া ঘোষণা প্রচার কর। নগরের প্রতি রাজপথে, ক্ষুদ্র পথে, প্রকাশ্য স্থানে, নগরবাসীর প্রতি দ্বারে ডঙ্কা, দুন্দুভি, ভেরী বাজাইয়া ঘোষণা করিয়া দাও,যে ব্যক্তি মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয়কে ধরিয়া আমার নিকট আনিতে পারিবে, সে সহস্র সুবর্ণ মুদ্রা তৎক্ষণাৎ পারিতোষিক পাইবে। আর যে ব্যক্তি মোস্‌লেমের পুত্রদয়কে আশ্রয় দিয়া গোপনে রাখিবে—প্রকাশমাত্র, বিচার নাই—কোন কথা জিজ্ঞাস্য নাই, দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই,—শূলদণ্ডই হইবে তাহার জীবনের সহচর। শূলদণ্ডকেই চির আলিঙ্গন করিয়া—প্রাণের সহিত আলিঙ্গন করিয়া মজ্জাভেদে তাহাকে মরিতে হইবে।”

 আদেশমত তখনই ঘোষণা প্রচার হইল—নগরময় ঘোষণা প্রচার হইল। কত লোক অর্থলোভে পিতৃহীন বালকদ্বয়ের অন্বেষণে ছুটিল, নানা স্থানে খুঁজিতে আরম্ভ করিল। তাহারা পাহাড়, পর্ব্বত, বন, জঙ্গল, মাঠ, ঘাট চারিদিকে সন্ধান করিয়া বাস্তভাবে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

 মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় ঘোযণা প্রচারের পূর্ব্বেই এক ভদ্রলোকের আশ্রয়বাটিতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। সে ভদ্রলোকটি কুফা নগরের বিচারপতি (কাজী); তিনি বালকদ্বয়ের দুঃখে দুঃখিত হইয়া তাহাদিগকে পরিতোষরূপে আহার করাইয়া শয়নের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। মহাবীর মোস্‌লেমের জন্য আক্ষেপ করিতেছেন। ইতিমধ্যে ঘোষণার বিবরণ শুনিয়া কাজী সাহেব নিতান্তই দুঃখিত হইলেন। কি করেন! কি উপায়ে পিতৃহীন বালক দুইটির প্রাণ রক্ষা হইতে পারে, তিনি তাহারই সুযোগ-সুবিধা খুঁজিতেছেন, চিন্তা করিতেছেন! বহু চিন্তার পর সঙ্কল্প স্থির করিয়া তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘আসাদ’কে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “প্রাণাধিক পুত্র! দেখ—এই পিতৃহীন বালক দুইটির প্রাণ রক্ষার উপায় করিতে হইবে। ঘোষণার বিষয় ত শুনিয়াছ। সাবধানে সতর্কে নিশীথ সময়ে বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া লইয়া নগরের প্রবেশদ্বার পার হইবে। কিছুক্ষণ মদিনার পথে দাঁড়াইলেই মদিনার যাত্রীদল অবশ্যই দেখিতে পাইবে। বহু যাত্রীদলই প্রতি রাত্রে গমন করে, অদ্যও করিবে, তাহাদের কোন এক দলের সহিত বালকদ্বয়কে সঙ্গী করিয়া দিলেই ‘কাফেলায়’ মিশিয়া নিরাপদে উহারা মদিনায় যাইতে পারিবে। বালক দুইটিরও প্রাণ রক্ষা হইবে, আমরাও নরপতি জেয়াদের ঘোষণা হইতে রক্ষা পাইব।” কাজী সাহেব এই কথা বলিয়াই প্রতি ভ্রাতার কোমরে পঞ্চাশটি করিয়া মোহর বাঁধিয়া দিলেন এবং খাদ্যসামগ্রী পরিমাণ মত যাহা তাহারা অনায়াসে লইয়া যাইতে পারে, উভয় ভ্রাতার সঙ্গে তাহাও দিয়া দিলেন।

 কাজী সাহেবের পুত্র আসাদ, পিতৃহীন বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া নিশীথ সময়ে গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। সাবধানে সতর্কে নগরের সিংহদ্বার পার হইয়া দেখিলেন, একদল যাত্রী মদিনাভিমুখে যাইতেছে, কিন্তু তাহারা কিঞ্চিৎ দূরে গিয়া পড়িয়াছে।

 আসাদ বলিলেন,—“ভ্রাতৃগণ! দেখিতেছ? ঐ মদিনার যাত্রীদল যাইতেছে, এমন সুযোগ-সুবিধা আর না-ও পাওয়া যাইতে পারে। ঐ যে যাত্রীদল যাইতেছে, তোমরা খোদার নাম করিয়া ঐ দলে মিশিয়া চলিয়া যাও। ঐ যাত্রীদলে মিশিতে পারিলে আর ভয়ের কোন কারণ থাকিবে না। তোমাদিগকে এলাহীর হস্তে সঁপিলাম। যাও ভাই! আর বিলম্ব করিও না। শীঘ্র যাও। ভাই সালাম!”—আসাদ বিদায় লইলেন। ভ্রাতৃদ্বয় ত্রস্তপদে মদিনার যাত্রীদলের পশ্চাৎ অনুসরণ করিয়া যাইতে লাগিলেন। রজনী ঘোর অন্ধকার। বালুকাময় পথ। তদুপরি প্রাণের ভয়, দুই ভাই একত্রে দৌড়াইতে লাগিলেন,—অগ্রগামী কাফেলার দিক লক্ষ্য করিয়া দৌড়াইতে লাগিলেন।

 জগৎকারণ জগদীশ্বরের মহিমার অন্ত নাই! ভ্রাতৃদ্বয় দৌড়াইতে দৌড়াইতে মদিনার পথ ভুলিয়া পুনরায় নগরের দিকে-কুফা নগরের দিকেই আসিতে লাগিলেন। তাঁহারা মনে মনে আশা করিয়াছিলেন, যাত্রীদল বেশী দূর যায় নাই, এখনই তাহাদের সঙ্গে যাইয়া দলে মিশিতে পারিবেন। কিন্তু আশা করিলে কি হয়? মানুষের সব আশা পূর্ণ হয় কি? অদৃষ্টফেরে পথ ভুলিয়া অন্য পথে কুফা নগরের দিকেই যে আসিতেছেন, দুই ভাই এ দৈব ঘটনার কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না। ত্রস্তপদে যাইতে যাইতে তাঁহারা সম্মুখে দেখিলেন,— মশালের আলো। তাঁহারা আলো লক্ষ্য করিয়া দৌড়াইলেন; সেখানে যাইয়া দেখেন—যাত্রীদল নহে, রাজকীয় প্রহরীদল অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত, প্রত্যেকের হস্তেই জ্বলন্ত মশাল। প্রহরীদিগের সম্মুখে পড়িতেই তাহারা বালকদ্বয়কে দেখিয়াই, আকার-প্রকারে তাহাদের রূপের ছটা দেখিয়াই, যাহা বুঝিবার বুঝিয়া লইল। আর কি যাইবার সাধ্য আছে? তাহারা তাহাদিগকে ধরিয়া ফেলিল এবং পুরস্কার-লোভে অগ্রে শহর-কোটালের নিকট লইয়া উপস্থিত করিল। নগরপাল কোটাল উভয় ভ্রাতার আকার-প্রকার দেখিয়াই বুঝিয়া লইলেন—এই বালকদ্বয়ই বীরবর মোস্‌লেমের হৃদয়ের সার, প্রিয় আত্মজ। নগরপাল ভ্রাতৃদ্বয়ের রূপলাবণ্য দেখিয়া যত্নপূর্ব্বক তাহাদিগকে আপন গৃহে রাখিলেন এবং অতি প্রত্যুষে তাহাদিগকে মহারাজ জেয়াদের দরবারে উপস্থিত করিলেন।

 কুফাধিপতি মোস্‌লেমের তনয়দ্বয়ের রূপলাবণ্য, মুখশ্রী, কিঞ্চিৎ কৃষ্ণ কেশের নয়নরঞ্জন দৃশ্য দেখিয়া “শিরচ্ছেদ কর”—এ কথাটি আর মুখে উচ্চারণ করিতে পারিলেন না; মায়াবশে বশীভূত হইয়া বলিলেন—“এই বালকদ্বয়কে দ্বিতীয় আদেশ না হওয়া পর্য্যন্ত বন্দীখানায় রাখিতে বল। কারাধ্যক্ষকে আদেশ জানাও যে, ইহারা রাজকীয় বন্দী; কোন প্রকারে যেন কষ্ট না পায়, বন্দীগৃহ হইতে যেন বহির্গত হইতে না পারে; কোন প্রকার অসম্মান, অবমাননা যেন না হয়।”

 দুই ভ্রাতা করজোড়ে সবিনয়ে তাঁহাদের মনের কথা মুখে প্রকাশ করিতে উদ্যোগী হইতেই এদিকে প্রহরীদল উভয়কে লইয়া কারাগৃহের প্রধান কার্য্য কারকের নিকটে চলিয়া গেল। তাহারা আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকট একটি কথা বলিতেও সুযোগ পাইলেন না। কারাগৃহে নীত হইলে কারাধ্যক্ষ—(নাম মাস্কুর), উভয় ভ্রাতার রূপমাধুরী দেখিয়া এবং ইহারাই বীরশ্রেষ্ঠ মোস্‌লেমের হৃদয়ের ধন ভাবিয়া সাদরে ও সযত্নে তাঁহাদিগকে স্থান দিলেন। বন্দীগৃহে না রাখিয়া স্বীয় ভবনে উভয় ভ্রাতাকে লইয়া আহারাদি করাইলেন। তাঁহাদের বিশ্রামের জন্য শয্যা রচনা করিয়া দিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “কি করি, রাত্রি প্রভাতেই হউক, দুইদিন পরেই হউক, নরপতি নিশ্চয়ই ইহাদের শিরশ্ছেদ আজ্ঞা প্রদান করিবেন। দুইটি ভাইকে রক্ষা করি কি প্রকারে?”—অনেক চিন্তার পর অর্দ্ধ নিশা অতীত হইলে দুই ভ্রাতাকে জাগাইয়া বলিলেন, “তোমরা আমার সঙ্গে সঙ্গে আইস। কোন চিন্তা নাই। আমি তোমাদিগকে রক্ষা করিব। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা থাকে, হইবে। আইস, আমার সঙ্গে আইস।” মোস্‌লেম-পুত্রদয় কারাধ্যক্ষের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। নগরের বাহির হইয়া কারাধ্যক্ষ কিঞ্চিৎ দূরে চলিয়া গিয়া দুই ভ্রাতাকে বলিলেন, “শুন, তোমরা মনোযোগ দিয়া শুন। এই যে পথের উপর দাঁড়াইয়া আছি—এই পথ ধরিয়া কুদ্‌সীয়া নগরে যাইবে। এই পথ ধরিয়া একটু দ্রুতপদে চলিয়া গেলে রাত্রি প্রভাতের পূর্ব্বেই কুদ্‌সীয়া নগরে যাইতে পারিবে। ঐ নগরে আমার ভাই আছেন,—তাঁহার নাম এই— নামটি মনে রাখিও। নাম করিলেই তাঁহার বাসস্থান লোকে দেখাইয়া দিবে। আমি যে তোমাকে পাঠাইতেছি, তাহার নিদর্শন-স্বরূপ আমার এই অঙ্গুরীয় দিতেছি। সাবধানে রাখিও। কিছু বলিতে হইবে না। এই অঙ্গুরী আমার ভ্রাতাকে দিলেই তিনি তোমাদিগকে তোমাদের গন্তব্যস্থানের কথা জিজ্ঞাসা করিবেন। তোমরা মদিনার নাম করিও। যে উপায়ে হউক—যে কোন কৌশলেই হউক, তিনি তোমাদিগকে মদিনায় পাঠাইয়া দিবেন। এই অঙ্গুরী লও, খোদার হাতে তোমাদিগকে সঁপিয়া দিলাম। শীঘ্রই এই পথ ধরিয়া চলিয়া যাও। কোন ভয়ের কারণ নাই।সর্ব্ববিপদহর জয় জগদীশ তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন।”

 ভ্রাতৃদ্বয় বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাইয়া অঙ্গুরী লইয়া বিদায় হইলেন। এবং কুদসীয়ার পথে যাইতে লাগিলেন।

 দয়াময় এলাহীর অভিপ্রেত কার্য্যে বাধা দিতে সাধ্য কার? কার ক্ষমতা তাঁহার বিধানের বিপর্য্যয় করে? ভ্রাতৃদ্বয় সারা নিশা ত্রস্তপদে হাঁটিয়া বড়ই ক্লান্ত হইলেন। জ্যেষ্ঠ বলিলেন “ভাই, বহু দূরে আসিয়াছি। কুফা হইতে বহু দূরে কুদ্‌সীয়া নগর—এই সেই কুদ্‌সীয়া।” রাত্রিও প্রভাত হইয়া আসিল। একটু স্থির হইয়া বসিতেই চতুর্দ্দিকে ঊষার আলোক নয়নফলকে প্রতিফলিত হইতে লাগিল। ভ্রাতৃদ্বয় এখনও নির্ভয়ে বসিয়া আছেন, প্রকৃতির কল্যাণে ঘটনাচক্রে কি সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটিয়াছে,— তাঁহারা কিছুই জানিতে পারেন নাই। অদৃষ্টলিপি খণ্ডাইতে মানুষের সাধ্য কি? ভাতৃদ্বয় সারাটি রাত্রি ত্রস্তপদে হাঁটিয়াছেন সত্য;—মনে মনে স্থির করিয়াছেন—বহু দূর আসিয়া পড়িয়াছেন; এস্থানে আর আবদুল্লাহ্ জেয়াদের ভয়ে ভাবিতে হইবে না। হা অদৃষ্ট! তাঁহাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কুদ্‌সীয়ার পথ ভুলিয়া তাঁহারা সারাটি রাত্রি কুফা নগরের মধ্যেই ঘুরিয়াছেন। এদিকে রাত্রিও প্রভাত হইল। চক্ষুর ধাঁধা ছুটিয়া গেল। প্রাণ চমকিয়া উঠিল!—জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলিলেন, “ভাই, আমাদের কপাল মন্দ! হায়! হায়! কি করিলাম! প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া সারা রাত হাঁটিলাম, কি কপাল! এই ত সেই স্থান, আমাদিগকে যে স্থানে রাখিয়া মাস্কুর কুদ্‌সীয়ার পথ দেখাইয়া গিয়াছেন, এই ত সেই স্থান।” কনিষ্ঠ ভ্রাতাও চমকিয়া উঠিয়া বলিলেন, “হাঁ। ভাই! ঠিক কথা! যে স্থান হইতে তিনি বিদায় লইয়াছিলেন, এই-ই সেই পথ—সেই পথিপার্শ্বের দৃশ্য!”

 ঘটিয়াছেও তাহাই। কারাধ্যক্ষ মাস্কুর যে স্থানে তাঁহাদিগকে রাখিয়া চলিয়া গিয়াছেন, সারা নিশা ঘুরিয়া প্রভাতে আবার তাঁহারা সেই স্থানেই আসিয়াছেন।

 ভ্রাতৃদ্বয় সে সময় আকুল প্রাণে কথা বলিতে লাগিলেন।—মোহাম্মদ জ্যেষ্ঠ, এব্রাহিম কনিষ্ঠ। জ্যেষ্ঠ বলিতেছেন,—“ভাই! এখন উপায়? প্রাণের ভাই এব্রাহিম! এবারে আর বাঁচিবার উপায় নাই। এখন উপায় কি? একবার নয়, দুইবার এইরূপ ভুল! আর আশা কি? ভ্রাতঃ! এইবারে রাজা জেয়াদ আমাদিগকে জীবন্তে ছাড়িবে না।”

 এব্রাহিম বলিলেন,—“নিরাশ হইয়া এই স্থানে বসিয়া থাকা কাজের কথাই নহে। সূর্য্যোদয় হইলেই আমরা প্রকাশ্য পথছাড়িয়া সম্মুখের ঐ খোর্‌মা প্রভৃতি ফলের বাগানমধ্যে লুকাইয়া থাকিব। কোন প্রকারে দিনটা কাটাইতে পারিলেই বোধ হয় বাঁচিতে পারি। সন্ধ্যা ঘোর হইলে আমরা মদিনার পথ ধরিব।”

 মোহাম্মদ বলিলেন,—“ভাই তবে উঠ, আর বিলম্ব নাই।”

 কনিষ্ঠের হস্ত ধরিয়া জোষ্ঠ ত্রস্ত পদে নিকটস্থ খোরমার বাগানে যাইয়া দেখিলেন,—ছোট বড় বহু বৃক্ষপূর্ণ বিস্তৃত ফলের বাগান, বাগানের মধ্যে জলের নহর বহিয়া যাইতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় এগাছ সে-গাছ সন্ধান করিয়া নহরের ধারে পুরাতন একটি বৃক্ষের কোটরে দুই দেহ জড়সড়ভাবে এক করিয়া সাধ্যানুসারে আত্মগোপন করিলেন; কিন্তু এক দিকে যে ফাঁক রহিল, সে দিকে তাঁহাদের দৃষ্টি রহিল না। সে সকল বৃক্ষের ছায়া নহরের জলে পড়িয়া ভাসিতেছে; মৃদুমন্দ বায়ুর আঘাতে সেই ছায়াসকল কখনও কাঁপিতেছে, কখনও বা ক্ষুদ্র বৃহৎ আকার ধারণ করিয়া জলের মধ্যে যেন ছুটিয়া যাইতেছে। জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গের সহিত বৃক্ষসকলের ছায়াও হেলিয়া দুলিয়া ছুটাছুটি করিতেছে। ভ্রাতৃদ্বয় যে বৃক্ষকোটরে গাত্রের সহিত গাত্র মিশাইয়া বসিয়া আছেন, কোটরে প্রবেশ-অংশের স্থান অনাবৃত থাকায় তাঁহাদের ছায়া জলে পতিত হইয়া বৃক্ষছায়ার সহিত কম্পিত ও সঙ্কুচিত হইতেছিল এবং প্রশস্ত, স্থূল, সুক্ষ্ম, দীর্ঘ প্রভৃতি নানা প্রকার আকার ধারণ করিতেছিল।

 বাগানের এক পার্শ্বে এক ভদ্রলোকের আবাসস্থান। সেই ভদ্রলোকের বাটীর পরিচারিকা নহরের জল লইতে আসিয়া জলে ঢেউ দিয়া কলসী পূর্ণ করিতে করিতে হঠাৎ বৃক্ষছায়ার প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল। বৃক্ষকোটরের ছায়ার মধ্যে অন্য এক প্রকার ছায়া দেখিয়া পরিচারিকা কলসী জলে ডুবাইয়া চিন্তা করিতে লাগিল ও বৃক্ষকোটরে এ কিসের ছায়া—ঠিক যেন দুইটি জোড়া-মানুষের মত বোধ হইতেছে। কান, ঘাড়, পিঠ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে,—কি ব্যাপার! ভাবিয়া সে কিছুই স্থির করিতে পারিল না। জলপূর্ণ কলসী ডাঙ্গায় রাখিয়া যে বৃক্ষের ছায়ামধ্যে ঐ অপরূপ ছায়া দেখিতেছিল, এক পা দুই পা করিয়া পরিচারিকা সেই বৃক্ষের নিকট যাইয়া দেখিল যে, দুইটি বালক উভয়ে উভয়কে জড়াইয়া ধরিয়া যেন এক-দেহ হইয়া রহিয়াছে। পরিচারিকা বালকদ্বয়ের অবস্থা দেখিয়া অন্তরে আঘাতপ্রাপ্ত হইল। তাহার হৃদয়ে ব্যথা লাগিল,—সে মুখে বলিল,—“আহা! আহা!! তোমরা কাহার কোলের ধন, বাছা রে! দুই জনে এরূপভাবে এই পুরাতন বৃক্ষের কোটরে লুকাইয়া রহিয়াছ কেন বাছা? আমাকে দেখিয়া এত ভয় করিতেছ কেন বাপ? আহা বাছা, তোমাদের কি প্রাণের মায়া নাই? ওরে বাপধন! ঐ কোটরে সাপ বিচ্ছুর অভাব নাই। কার ভয়ে তোরা এ ভাবে গলাগলি করিয়া নীরবে কাঁদিতেছিস? বল্, আমার নিকটে মনের কথা বল্, কোন ভয় নাই। বাপ্। তোরা পেটের সন্তান তুল্য। তোদের দুইখানি মুখ যেন দুইখানি চাঁদ। —বাবা! তোরা কি দুই ভাই? মুখের গড়ন, হাত পায়ের গঠন দেখিয়া তাহাই বোধ হইতেছে। তোরা দুটি ভাই, এক মায়ের পেটে জন্মিয়াছিস, বাপ? কোন্ দুঃখিনীর সন্তান তোরা? বল্, বাবা শীঘ্র বল্, কার ভয়ে, তোরা লুকাইয়া আছিস?”

 ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে কোন কথা নাই। দুই ভাই হাত আরও শক্ত করিয়া গলাগলি করিয়া মাথা নীচু করিয়া রহিলেন। পরিচারিকা নিকটে যাইয়া মৃদু মৃদু স্বরে সজল চক্ষে বলিতে লাগিল,—

 “হ্যাঁ বাবা! তোরা কি সেই মদিনার মহাবীর মোস্‌লেমের নয়নের পুত্তলী, হৃদয়ের ধন, জোড়-মাণিক? তাই বুঝি হবে! তাহা না হইলে এত রূপ ‘কুফায়’ কোন ছেলেরই নাই! আহা! আহা!—যেন দুইটি ননীর পুতুল, সোনার চাঁদ, জোড়া-মাণিক। বাবা! তোদের কোন ভয় নাই—আমি অতি সাবধানে রাখিব। রাজবাড়ীর ঢেঁড়রা শুনিয়াছি। সে জন্য কোন ভয় করি না। আমি তোদের কথা কাহারও নিকটে বলিব না। তোরা আমার পেটের সন্তান—আয় বাবা! আমার অঞ্চলের মধ্যে আয়, প্রাণের মাঝে রাখিব।”

 ভ্রাতৃদ্বয় কোটর হইতে সজলনয়নে বাহির হইয়া পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। দয়াবতী নারী বালকদ্বয়কে গাত্রবস্ত্রের আবরণে ঢাকিয়া আপন কর্ত্রীর নিকটে লইয়া গেলেন।

 বালকদ্বয়ের কথা কুফা নগরে গোপন নাই। দ্বারে দ্বারে ঢেঁড়রা দেওয়া হইয়াছে—ধরিয়া দিতে পারিলেই পাঁচ সহস্র মোহর পুরস্কার, আশ্রয় দিলে তখনই শুলের অগ্রভাগে আশ্রয়দাতার প্রাণের শেষ,—তাহাতে দ্বিতীয় আদেশের অপেক্ষা নাই। গৃহকর্ত্রী এসকল জানা সত্ত্বেও দুই ভাইয়ের মস্তকে চুমা দিয়া অঞ্চল দ্বারা তাহাদের চক্ষুজল মুছাইয়া বলিতে লাগিলেন,—“বাবা! তোরা ‘এতিম’। তোদের প্রতি যে দয়া করিবে, তাহার ভাল ভিন্ন কখনই মন্দ হইবে না। আয় বাবা, আয়! আমি তোদের মা, মায়ের কোল থেকে কেউ তোদের ছিনাইয়া লইতে পারিবে না। তোদের এই মায়ের প্রাণ দেহে থাকিতে তোদের দুইজনকে কেহ লইতে পারিবে না। আয়! তোদের খুব নির্জ্জন গৃহে লইয়া রাখি। খোদা তোদের রক্ষক।” গৃহিণী দুই ভ্রাতাকেই বিশেষ যত্নে এক নির্জ্জন গৃহে রাখিলেন, বিছানা পাতিয়া দিয়া তাহাদিগকে কিছু আহার করাইলেন। প্রাণের ভয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকিলেও খায় কে? গৃহকর্ত্রী আপন পেটের সন্তানের অনিচ্ছায় যেমন মুখে তুলিয়া দিয়া আহার করান, সেইরূপে খাদ্যসামগ্রী হাতে তুলিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের মুখে দিতে লাগিলেন। আহার শেষ হইলে বলিলেন, “বাবা! তোমরা কথাবার্ত্তা বলিও না। চুপ করিয়া এই বিছানায় শুইয়া ঘুমাও। পুনঃ আহারের সময় উপস্থিত হইলে আমি আসিয়া তোমাদিগকে জাগাইয়া খাওয়াইব। তোমরা ঘুমাও, সারা রাত জাগিয়াছ, আর কত হাঁটাই হাঁটিয়াছ—ঘুমাও, কোন চিন্তা করিও না।”

 যে বাড়ীর কর্ত্রী দয়াবতী, পরিচারিকাগণও প্রায় তাঁহারই অনুরূপ হইয়া থাকে। দেখা গেল-বালকদ্বয়ের কথা কর্ত্রী আর পরিচারিকা ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না।

 বাটীর কর্ত্তার নাম হারেস্। কর্ত্তা বাটীতে ছিলেন না; কার্য্যবশতঃ প্রত্যুষেই নগরমধ্যে গমন করিয়াছিলেন। দিন গত করিয়া রাত্রি এক প্রহর পরে, তিনি আধমরার মত হইয়া বাটীতে আসিলেন। গৃহিণী বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে কর্ত্তা বলিলেন, “সে কথা আর কি বলিব! আমার কপাল মন্দ, আমার চক্ষে পড়িবে কেন? সারাটি দিন আর এই রাত্রি এক প্রহর পর্য্যন্ত কত গলি-পথে, কত বড় বড় রাস্তায় দোধারী ঘরের কোণের আড়াল মধ্যে, কত ভাঙ্গা বাড়ীর বাহিরে ভিতরে, কত স্থানে খুঁজিলাম! আমার এ পোড়া অদৃষ্টে তাহা ঘটিবে কেন? আমি হতভাগ্য, চিরকাল দুঃখকষ্টের সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা, আত্মীয়তা,—আমার চক্ষে পড়িবে কেন? অনটন আমার অঙ্গের ভূষণ, অলক্ষী আমার সংসার ঘিরিয়া বসিয়াছে, শয়তান আমার হিতৈষী বন্ধু সাজিয়াছে, আমি দেখা পাইব কেন? আমার চক্ষে পড়িবে কেন? এত পরিশ্রম বৃথা হইল! সারাটি দিন উপবাস, না খাইয়া কত স্থানেই যে ঘুরিয়াছি, সে দুঃখের কথা আর কি বলিব? হায় হায়! আমার কপাল! এক জনের চক্ষে অবশ্যই পড়িবে, সে লালে লাল হইবে!”

 গৃহিণী বলিলেন, ‘আসল কথা ত কিছুই শুনিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এত বিলম্ব হইল কেন?’ তুমি সাত গ্রাম বেড় দিয়া ভাগ্যলিপি— অদৃষ্ট মন্দ, এই সকল খামখেয়ালী কথা তুলিয়া বসিলে! সারাটি দিন, আর রাত্রিও প্রায় দেড় প্রহর— এত সময় কোথায় ছিলে? কি করিলে? তাহাই শুনিতে চাই। আর একটি কথা, আজ তুমি যেমন দুঃখের সহিত আক্ষেপ করিতেছ,—অদৃষ্টের দোষ দিতেছ—এরূপ আক্ষেপ, এরূপ কপালদোষের কথা ত আর কখনও তোমার মুখে শুনি নাই?’

 হারেস দুঃখিতভাবে নাকীসুরে ক্ষীণস্বরে বলিতে লাগিলেন,—“তোমায় আর কি বলিব? আমাদের বাদশাহ্ জেয়াদ, মদিনার হজরত হোসেনকে প্রাণে মারিবার যোগাড় করিয়া, মিথ্যা স্বপ্ন, মিথ্যা রাজ্যদান ভাণ করিয়া হজরত হোসেনকে—”

 গৃহিণী বলিলেন, “সে সকল কথা আমরা জানি। হজরত হোসেনের অগ্রে মোস্‌লেম আসিলেন, মোস্‌লেমকে কৌশল করিয়া মারিবার কথাও জানি।”

 “তবে ত তুমি সকলই জান। সেই মোস্‌লেমের দুই পুত্র পলাইয়াছে। তাহাদের জন্য রাজসরকার হইতে যোষণা করা হইয়াছে—ধরিয়া দিতে পারিলেই এক হাজার মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে। প্রথম, তাহারা শহর-কোতোয়ালের হাতে ধরা পড়িয়াছিল। বাদশাহ্-নামদারের দরবারে হাজির করিলে আমাদের বাদশাহ্ ছেলে দুইটির মুখের ভাব, সুশ্রী সুন্দর মুখ দুখানি ও দেহের গঠন দেখিয়া ‘মাথা-কাটা’র আদেশ দিতে পারিলেন না; বন্দীখানায় কয়েদ করিতে অনুমতি করিলেন। বন্দীখানার প্রধান কর্ম্মচারী মস্কুর ছেলে দুইটির রূপে মোহিত হইয়া তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেন। বাদশাহ্-নামদার পর্য্যন্ত সেই সংবাদ পৌঁছিলে, মস্কুরের শিরশ্ছেদ হইল। আজ আবার নূতন ঘোষণা জারী হইয়াছে, যে সেই পলায়িত ছেলে দুইটিকে ধরিয়া দিবে, তাহাকে পাঁচ হাজার মোহর পুরস্কার দেওয়া হইবে। যে আশ্রয় দিয়া গোপনে রাখিবে, মস্কুরের ন্যায় সেই দণ্ডেই তাহার শিরশ্ছেদ হইবে। আমি মোস্‌লেমের ছেলে দুইটির জন্য আহার-নিদ্রা-বিশ্রাম ত্যাগ করিয়া কোথায় না সন্ধান করিয়াছি। ধরিয়া বাদশাহের দরবারে হাজির করিতে পারিলেই পাঁচ হাজার মোহর! যে পাইবে, সে কতকাল বসিয়া খাইতে পারিবে, বুঝিয়া চলিলে হয় ত মহাধনী হইয়া কত পুরুষ পর্য্যন্ত সুখে থাকিতে পারিবে! এত সন্ধান করিলাম, কিছুই করিতে পারিলাম না। আজ বেশী টাকার লোভে হাজার হাজার লোক পাহাড় জঙ্গল, যেখানে যাহার সন্দেহ হইতেছে সেখানেই খুঁজিতেছে। আমি বহুদূরে গিয়াছিলাম। কোথাও কিছু না পাইয়া শেষে খোর্‌মার বাগান খুঁজিয়া তন্ন তন্ন করিলাম, প্রতি বৃক্ষের গোড়ায়, কোটরে খুঁজিলাম, কোথাও কিছুই পাইলাম না। তাহাতেই বলিতেছিলাম আমার ভাগ্যে ঘটিবে কেন? হতভাগার চক্ষে তাহারা ধরা পড়িবে কেন?”

 গৃহিণী বলিলেন, “হায়! হায়! সেই পিতৃহীন অনাথ বালক দুইটিকে ধরিয়া দুরন্ত জালেম বাদশাহের নিকটে দিলে পাঁচ হাজার মোহর পাইবে তাহা সত্য, কিন্তু আর একটি হৃদয়বিদারক মর্ম্মান্তিক সাংঘাতিক কথা কি তোমার মনে উদয় হয় নাই? নিরপরাধ দুইটি এতিমকে বাদশাহের হাতে দিলে, সে নিষ্ঠুর পাষাণ-প্রাণ শাহ্ জেয়াদ কি তাহাদিগকে স্নেহ করিয়া যত্নে রাখিবে? না তাহাদের চির-দুঃখিনী জননীর নিকট মদিনায় পাঠাইয়া দিবে? হাতে পাইবামাত্র শিরশ্ছেদ—উহুঃ! বালক দুইটির শিরশ্ছেদের হুকুম প্রদান করিবে। তাহা হইলে হইল কি? তুমিই বালক দুইটির বধের উপস্থিত কারণ হইলে। তৎপরিবর্ত্তে কতকগুলি মোহর পাইবে সত্য—আচ্ছা বল ত, সে মোহর তোমার কত দিন থাকিবে? এখন যে অবস্থায় আছ, দয়াময় দাতা অনুগ্রহকারী ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হও। তোমার সমশ্রেণীর লোক কত স্থানে কত প্রকার কষ্টভোগ করিতেছে। তোমার অপেক্ষা কত উচ্চ শ্রেণীর লোক তোমার হইতেও মন্দ অবস্থায় দিন কাটাইতেছে। তুমি সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত—মহাসুখী। ইহার উপরেও তোমার লোভের অন্ত নাই। বিচারকর্ত্তা অদ্বিতীয় এলাহীর প্রতিও তোমার ভক্তি নাই, ভয়ও নাই। তিনি সর্ব্বদর্শী, তাহাও যেন তোমার মনে নাই। হায় হায়! তোমার মত পাষাণ প্রাণ পাথরের দেহ ত আমি কাহারও দেখি নাই। পিতৃহীন নিরপরাধ বালকদ্বয়ের দেহরক্তের মূল্যই নরপতি জেয়াদের চক্ষে পাঁচ হাজার মোহর! হইতে পারে—তাঁহার চক্ষে অন্য রূপ! হউক্ পাঁচ হাজার মোহর! তুমি সে রক্তমাখা মোহরের জন্য এত লালায়িত কেন? তুমি কি বোঝ নাই যে, ঐ দুই বালকের শরীরের রক্তের মূল্য পাঁচ হাজার মোহর? তুমি রক্তমাখা মোহরলোভে বালক দুইটির অমূল্য জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া নিজের বিষময় অস্থায়ী সুখের প্রতি দৃষ্টি করিতেছ! আর এক কথা, সেও দিবে, আর তুমিও পাইবে! পাঁচ হাজার মোহরই তোমার লক্ষ্য, অন্তরেও এই কথাই জাগিতেছে—‘বালক দুইটিকে যদি ধরিতে পারি, পাঁচটি হাজার খাঁটী সোণার মোহর! হা অদৃষ্ট!—আমার কপালে কি তাহা আছে?’ মনে মনে এই ভাবের কথাই ত ভাবিতেছ? বার বার সেই নররক্তমাখা কদর্য্য মোহরগুলির প্রতিই অন্তর-চক্ষুতেই কল্পনায় সাজান দেখিতেছ? মোহরের জন্য প্রকাশ্যে আক্ষেপও করিতেছ! বালক দুইটির জীবনের মূল্য হইতে মোহরের মুল্যই অধিক স্থির করিয়াছ! জানিলাম, তোমার মনে দয়ামায়ার একটি পরমাণুও নাই; এক ফেঁটা রক্তও নাই। তোমার হৃদয়ে সাধারণ রক্তও নাই,—পাথর চোয়াইয়া রস ঝরিতে পারে? তোমার হৃদয় পাষাণ, দেহটা পোড়া মাটির, অস্থিমজ্জাসমুদয় কঙ্করে পূর্ণ। ইহাতে আর আশা কি?”

 “তুমি বুঝিবে কি? যাহাদের শরীর কিছুতেই সমানভাবে ঢাকে না— হাজার ঢাক, হাজার বেড় দেও —অসমান থাকিবেই থাকিবে, তাহারা জগৎ সংসারের কি বুঝিবে? তুমি বােঝ—প্রথম, অলঙ্কার,—তাহার পর টাকা-পয়সা, তাহার পর স্বামীকে একহাতে রাখা। আর কি বােঝ? মােস্‌লেমের ছেলে দুইটির মাথা কাটিবে রাজা জেয়াদ! তাহাতে তােমার চক্ষে জল আসে কেন? পরের ছেলের মাথা পরে কাটিবে, আমাদের কি? রাজা জেয়াদ মােস্‌লেমকে প্রাণে মারিয়াছে, তাহার ছেলে দুইটিকেও মারিয়া ফেলুক, ছেলের মাকে ধরিয়া আনিয়া হয় প্রাণে মারুক—না হয় ভালবাসিয়া রাণী করিয়া অন্তঃপুরে রাখুক,—তােমার আমার কি? মাঝখানে আমার পাঁচটি হাজার মােহর লাভ হইবে। এ কার্য্যে চেষ্টা করিব না? তােমার অঞ্চল ধরিয়া—চেনা নাই, জানা নাই, মােস্‌লেমের জন্য-—তাহার দুইটি পুত্রের জন্য কাঁদিতে থাকিব? এরূপ বুদ্ধি আমার হইলে আর চাই কি?—সংসার টন্‌টনে— খাসা!—একেবারে কাবার! শুন কথা: ছেলে দুইটি যাহার চক্ষে পড়িবে, সেই-ই ধরিবে। ধরিলেও নিশ্চিন্ত নহে। বাধা বিঘ্ন অনেক। কত লােক ছুটাছুটি করিতেছে। কত গুণ্ডা ঐ খোঁজে বাহির হইতেছে। কাহার হাত হইতে কে কাড়িয়া লইয়া বাদশাহের দরবারে দাখিল করিবে—তাহা কে জানে? ধরিতে পারিলেও সাফল্যের আশা অতি কম! যাহা হউক, শুন আমার মনের কথা: যদি ছেলে দুইটিকে হাতে পাই—আর নিরাপদে জেয়াদ-দরবারে লইয়া যাইতে পারি— আর তােমার ভাল হউক— যদি পাঁচ হাজার মােহর পাই, তিন হাজার মােহর ভাঙ্গিয়া মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত, আবার পা হইতে মাথা পর্য্যন্ত ডবল পেঁচে সােণা দিয়া তােমার এই সুন্দর দেহখানি একেবারে মোড়াইয়া দিব। দেখ ত, এখন লাভ কত?”

 গৃহিণী অতিশয় বিষণ্ণভাবে স্বামীর মুখ-চোখপানে চাহিয়া বলিতে লাগিলেন,—“দেখ! আমি তােমার কথায় বাদ-প্রতিবাদ করিব না। বাধা দিতেও চাহি না তােমাকে উপদেশ দিবার ক্ষমতাও আমার নাই। আমি তােমার নিকট মিনতি করিয়া বলিতেছি, সবিনয়ে প্রার্থনা করিতেছি, তুমি মােস্‌লেমের সেই ছেলে দুইটির সন্ধানে আর যাইও না—ইহাই প্রার্থনা। আমি তোমার নিকট রতি-পরিমাণ সোণাও চাহি না এবং ও-রক্তমাখা মোহরের জন্য লালায়িত নই। পিতৃহীন বালকদ্বয়ের শোণিতরঞ্জিত মোহর চক্ষেও দেখিতে ইচ্ছা করি না। ছুঁইতেও পারিব না! জীবন কয় দিনের? ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর দিবে? আমি তোমার দুইখানি হাত ধরিয়া অনুরোধ করিতেছি, আমার মাথার দিব্বি দিয়া বলিতেছি, তুমি লোভের বশীভূত হইয়া এমন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইও না।”

 হারেস্ স্ত্রীরত্নের কথায় ক্রোধে আগুন হইয়া রক্তলোচনে আঁখি ঘুরাইয়া বলিলেন,—“চুপ! চুপ! নারীজাতির মুখে ধর্ম্মকথা আমি শুনি না। এখন খাইবার কি আছে, শীঘ্র শীঘ্র আন। একটু বিশ্রাম করিয়া এই রাত্রেই আবার সন্ধানে বাহির হইব। দেখি কপালে কি আছে! তোর ও-মিছরীমাখা কথা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি না।”

 হারেসের স্ত্রী আর কোন কথা কহিলেন না। স্বামীর আহারের আয়োজন করিয়া দিলেন। হারেস মনে মনে নানা চিন্তা করিতে করিতে অন্যমনস্ক আহার করিলেন এবং হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া তখনি শয়ন করিলেন। এত পরিশ্রমেও তাঁহার চক্ষে নিদ্রা নাই। কোথায় ছেলে দুইটিকে পাইবেন, কোন্ পথে, কোথায় কোন্ স্থানে গেলে তাহাদের দেখা পাইবেন, দেখা পাইয়া কি প্রকারে ধরিয়া রাজদরবারে লইয়া যাইবেন, এইসকল চিন্তাই তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিতে লাগিল। বালক দুইটির দেখা পাওয়া—পাঁচ হাজার সোণার টাকা, এই সকল ভাবিতে ভাবিতে বহুক্ষণ পরে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন।

 গৃহিণী দেখিলেন,— স্বামী ঘোর নিদ্রায় অচেতন। কি উপায়ে ছেলে দুইটিকে রক্ষা করিবেন, এই চিন্তা করিয়া পরামর্শে বসিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি ও পরিচারিকা ভিন্ন বাড়ীর অন্য কেহও বালকদ্বয়ের কথা জানেন নাই। এখন বাধ্য হইয়া স্বামীর ঐরূপ ভাব দেখিয়া, তাঁহার মুখের কথা শুনিয়া দয়াবতী স্নেহময়ী রমণী অস্থির হইয়াছেন। কি উপায়ে পিতৃহীন বালকদ্বয়কে রক্ষা করিবেন? স্বামীর অদ্যকার মনের ভাবে—ভয়ের কারণই অধিক, আর আশ্রয়ের স্থানই বা কোথা? সত্য প্রকাশ পাইলে ছেলে দুইটির মাথা যায়! এমন কি, নিজের প্রাণের আশাও অতি সঙ্কীর্ণ! স্বামী পুরস্কার-লোভে স্ত্রীর বিরোধী হইতে পারেন! আর একটি গোলের কথা, স্বামীর সঙ্গে বালক দুইটি লইয়া কথান্তর হইলে পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই জানিবে। ভাল করিতে কেহ আগে বাড়িতে চাহে না, কিন্তু মন্দ করিতে কোমর বাঁধিয়া দৌড়াইতে থাকে। রাজদরবারে যাইয়া বলিলেই হইল—অমুকের ঘরে ছিল—অমুক স্ত্রীলোকের আশ্রয়ে ছিল। আর প্রাণের আশা কি!—এই সকল কথা ভাবিয়া চিন্তিয়া তিনি আরও দুইটি লোকের সহিত পরামর্শ করিয়া কার্য্য করাই স্থির করিলেন।

 এক জন তাঁহার গর্ভজাত পুত্র;—বুদ্ধিমান বিচক্ষণ-দয়ার শরীর। শরীরে পিতার গুণ অল্প ছিল, মাতার গুণ অধিক। সেই এক জন, আর একজন, তাঁহার গর্ভজাত পুত্র নহে,—পালিত পুত্র। শৈশবকাল হইতে আপন স্ত্ন্য পান করাইয়া তিনি তাহাকে প্রতিপালন করিয়াছেন। সেই পালিত পুত্র তাঁহার সম্পূর্ণ গুণের অধিকারী হইয়াছে। সেই-ই তাঁহার সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। আপন গর্ভজাত পুত্র তাহার পিতা হারেসের কথা অমান্য করিতে পারে না। অন্যায় কার্য্য হইলেও প্রতিবাদ করে না,—চুপ করিয়া নীরব থাকে। পালিত পুত্রটি তাহা নহে। সে জননীর অনুগত—বাধ্য। হারেসের কথা সে শুনে না। হারেস কোন অন্যায় কথা বলিলে, সে অকপটে নির্ভয়ে তাহার প্রতিবাদ করে। তাহার মনের ধারণাই এই,‘যাঁহার শরীরের শোণিতে আমার জীবন রক্ষা হইয়াছে, দেহ বৃদ্ধি হইয়াছে, যাঁহার স্নেহ-মমতা, অনুগ্রহে আমি এত বড় হইয়াছি, তিনিই আমার সর্ব্বস্ব—তিনিই আমার পূজনীয়া। তিনিই আমার মুক্তিদাত্রী মাতা—মাতাই আমার সম্বল—মাতাই আমার বল।

 হারেস-জায়া নিশীথ সময়ে দুই পুত্রকেই চুপি চুপি ডাকিলেন; অন্য কক্ষে আনিয়া অতি নির্জ্জন স্থানে তাহাদিগকে সম্মুখে রাখিয়া বসিলেন।

 পালিত পুত্রকে বলিলেন, “বাবা। তুই আমার পেটে না জন্মিলেও আমি তোকে আমার বুকের দুধ দিয়া প্রতিপালন করিয়াছি। কত মল-মুত্র এই হাতে পরিষ্কার করিয়া তোকে বাঁচাইয়াছি। বাবা! তুই আমার শরীরের সার অংশ দ্বারা প্রতিপালিত হইয়াছিস। আমার শরীরের রক্ত-মাংসে তোর দেহপুষ্টি হইয়াছে।” পরে আপন গর্ভজাত সন্তানের হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “বাবা! তোতে আর এতে ভিন্ন কি? অতি সামান্য! সেই সামান্য অংশটুকু ছাড়িয়া দিলে—তুইও যেমন, (পালিত পুত্রের হস্ত ধরিয়া)—এও তেমনি। পরিচারিকাকে যে কথা বলিতে বলিয়াছিলাম তোমাদের দুইজনকে একত্রে বসাইয়া সে তাহা বলিয়াছে। তোমরা সকলই শুনিয়াছ। এখন সেই বালক দুইটির রক্ষার উপায় কি? আমি ভাবিয়াছিলাম—তোমাদের পিতা বাটী আসিলে ছেলে দুইটির কথা বলিব। তিনি কতই দুঃখ করিবেন, ছেলে দুইটির রক্ষার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিবেন। এখন দেখিতেছি, তিনিই তাহাদের সংহারক, তিনিই তাহাদের প্রাণনাশক প্রধান শত্রু। মোহরের লোভে তিনি ঐ বালক দুইটিকে পরিবার জন্য বহু চেষ্টা, বহু পরিশ্রম করিয়াছেন। নিদ্রা হইতে উঠিয়া এই রাত্রেই পুনরায় তাহাদের অন্বেষণে ছুটিবেন। তিনি যদি বালক দুইটির সন্ধান পান, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। কিছুতেই তাহারা দুরন্ত বাঘের মুখ হইতে রক্ষা পাইবে না—বাঁচিবে না। এক্ষণে তোমরাই আমার সহায়-সম্বল-বল, তোমরা দুই ভাই যদি আমার সহায়তা কর, তোমরা দুই ভাই যদি আমার পক্ষে থাকিয়া পিতৃহীন বালক দুইটির রক্ষার জন্য চেষ্টা কর, তবে তাহারা বাঁচিতে পারে। তোমাদের পিতার চক্ষে পড়িলে কিন্তু কিছুতেই রক্ষা পাইবে না।”

 দুই ভাই বলিল,—“মা! আপনি ব্যস্ত হইবেন না। আমরা সকলই শুনিয়াছি,—বালকদ্বয়ের অবস্থা সকলই জানিয়াছি; তাহার বাটীতেই আছে তাহাও জানি। আপনি অত উতলা হইবেন না। পিতা গুরুজন, তাঁহার নিন্দা করিব না। আমরা তাঁহার অর্থলালসার কথা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইয়াছি,—আক্ষেপ করিয়াছি। কি করি, পিতা গুরুজন,—তাঁহার কথায় প্রতিবাদ করা মহাপাপ। যাহাই হউক, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। রাত্রি দুইপ্রহর অতীত হইলেই আমরা দুই ভাই বালকদ্বয়কে সঙ্গে করিয়া মদিনার পথে যাইব। যদি সুবিধা করিতে পারি, ভালই; না করিতে পারি, আমরা সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া মদিনায় তাহাদিগকে রাখিয়া আসিব।”

 গৃহিণী সন্তুষ্টচিত্তে অথচ চক্ষুজলে ভাসিতে ভাসিতে দুই পুত্রের দুই হাত দুই করে ধরিয়া আপন মাথার উপর রাখিয়া বলিলেন, “বাবা! তোরা আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বল—‘আমরা সাধ্যানুসারে বালকদ্বয়কে রক্ষা করিব’।

 পুত্রদ্বয় অকপটচিত্তে অঙ্গীকার করিল, বলিল, “মা! আপনি নিশ্চয় জানিবেন, বালকদ্বয়ের অনিষ্ট সম্বন্ধে আমাদের পিতার কোন কথা আমরা শুনিব না! বরং তাঁহার বিরোধী হইব। আপনার আদেশ, আপনার আজ্ঞ। পালন করিতে যদি আমাদের প্রাণও যায়, তথাপি আপনার আদেশের অন্যথা করিব না, কি পশ্চাদপদ হইব না।”

 দুই পুত্র আর গৃহিণী এক কক্ষে পরামর্শ করিতেছেন। অন্য কক্ষে অতি নির্জ্জন স্থানে ভ্রাতৃদ্বয় শুইয়া আছেন। ভিন্ন আর এক কক্ষে হারেস শুইয়া আছে। ঈশ্বরের মহিমার অন্ত নাই! মোহাম্মদ ও এব্রাহিম নির্জ্জন কক্ষে নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, হঠাৎ মোহাম্মদ জাগিয়া ক্রন্দন করিতে করিতে এব্রাহিমকে জাগাইয়া বললেন,—“ভাই রে! আর ঘুমাইও না। শুন—স্বপ্ন-বিবরণ শুন। এখনই পিতাকে স্বপ্নে দেখিলাম। শুন, অতি আশ্চর্য্য স্বপ্ন। স্বপ্নে দেখিয়াছি, আকাশের দ্বার হঠাৎ খুলিয়া গেল। স্বর্গীয় সৌরভে জগৎ আমোদিত ও মোহিত হইল। দেখিলাম, স্বর্গীয় উদ্যানে হজরত মোহাম্মদ রসুল মকবুল (দঃ), হজরত আলী (কঃ), হজরত বিবি ফাতেমা জোহরা এবং হজরত হাসান উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছেন। পিতৃদেব তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বেড়াইতেছেন। আমরা দুই ভ্রাতা দূরে দাঁড়াইয়া আছি। ইতিমধ্যে হজরত রসুল মকবুল আমাদের পিতৃদেবকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—মোস্‌লেম! তুমি চলিয়া আসিলে, আর তোমার পুত্র দুইটিকে জালেমের হস্তে রাখিয়া আসিলে?”

 পিতৃদেব করজোড়ে নিবেদন করিলেন,—“হজরত! এলাহীর কৃপায় তাহারাও আগামী কল্য ইন্‌শা আল্লাহ্‌র পবিত্র পদ-চুম্বনের জন্য আসিবে।”

 এব্রাহিম বলিলেন,—“ভাই, আমিও ঐ স্বপ্ন দেখিয়াছি। আর চিন্তা কি? রাত্রি প্রভাতেই আমরা পিতৃদেবের নিকটে যাইব। এস ভাই, এইক্ষণে দুই ভাই গলাগলি করিয়া একবার শয়ন করি। জগতে আমাদের আজ নিদ্রাৱ শেষ, নিশারও শেষ। আমাদের পরমায়ুরও শেষ। এস ভাই, এস! গলাগলি করিয়া একবার শয়ন করি।” দুই ভাই এই বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিতেই পাপমতি হারেসের নিদ্রাভঙ্গ হইল। অতি ত্রস্তে শয্যাত্যাগ করিয়া তিনি স্ত্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার বাড়ীতে বালকের ক্রন্দন! কাহার ক্রন্দন? কোথায় তাহারা? কোথা হইতে তাহারা আসিয়াছে? কে তাহাদিগকে তোমার নিকটে আনিয়া দিল? শীঘ্র শীঘ্র প্রদীপ জ্বালিয়া আন; আর যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকেও আমার সম্মুখে শীঘ্র শীঘ্র লইয়া আইস।”

 হারেস্-জায়া নীরব। কারণ, দুর্দ্দান্ত স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ—প্রদীপ জ্বালিতে আদেশ, “যাহারা কাঁদিতেছে, তাহাদিগকে আমার সম্মুখে লইয়া আইস”—এই সকল কথায় সতী-সাধ্বী দয়াবতীর প্রাণপাখী যেন দেহ-পিঞ্জর হইতে ‘উড়ু উড়ূ’ করিতে লাগিল। কি করিবেন, কোথায় যাইবেন, কিছুই বোধ নাই—জ্ঞান নাই —তিনি নীরব রহিলেন। হারেস গৃহিণীর এইরূপ ভাব দেখিয়া অবাক হইলেন, মনে মনে বলিলেন: এ কি? হঠাৎ এরূপ হইল কেন? তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোমার এ কি ভাব হইল?” কোন উত্তর নাই। গৃহিণী নির্ব্বাকে, এক ধ্যানে স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। হারেস স্ত্রীর এইরূপ অন্যমনস্ক ভাব দেখিয়া নিজেই প্রদীপ জ্বালিয়া যে গৃহ হইতে ক্রন্দন-শব্দ বাহির হইতেছিল, সন্ধান করিয়া প্রদীপহস্তে সেই গৃহে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, —দুইটি বালক গলাগলি করিয়া শুইয়া কাঁদিতেছে। তিনি দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন; অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “এ কাহারা? আমার বাড়ীর নির্জ্জন স্থানে পরম রূপবান্ দুইটি বালক শয়নাবস্থায় কাঁদে কেন?” তখন তিনি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“তোরা কে? কাঁদিস্ কেন? শীঘ্র বল্, কে তোরা?”

 বালকদ্বয় সভয়ে উত্তর করিলেন, “আমরা হজরত মোস্‌লেমের পুত্র।” হারেস নিকটে যাইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিলেন, “মোস্‌লেমের পুত্র! তোমরাই মোস্‌লেমের পুত্র! আমি কি আহম্মক—কি পাগল! ঘরে শিকার রাখিয়া জঙ্গলে ঘুরিতেছি! কি পাগলামী। যাক্, যাহা হইবার হইয়াছে। আমার অদৃষ্টজোরেই শিকার ঘরে আসিয়াছে! পাঁচ হাজার মোহর পায়ে হাঁটিয়া আমার নির্জ্জন ঘরে আসিয়া ঢুকিয়াছে। এখন কি করি? রাত্রি প্রভাত হইতে অনেক বিলম্ব। কিন্তু আর যাইবে কোথা?”—এই বলিয়া দুই ভ্রাতার জোল্‌ফে জোল্‌ফে বন্ধন করিলেন। চুলে টান পড়ায় দুই ভাই কঁদিয়া উঠিতেই হারেস্— নির্দ্দয় হারেস্ উভয় ভ্রাতার সুললিত কোমল গণ্ডে সজোরে চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন,—“চুপ! চুপ! কাঁদ্‌বি ত এখনই মাখা কেটে ফেল্‌বো।”

 বলিতে বলিতে দুই ভ্রাতার হস্ত বন্ধন করিয়া, দ্বারে জিঞ্জির লাগাইয়া, দ্বার ঘেঁসিয়া শয্যা পাতিয়া তিনি তরবারি-হস্তে বসিয়া রহিলেন। স্বগত বলিতে লাগিলেন,—“আর ঘুমাইব না। আর কি—হোঃ হোঃ! আর কি!— প্রভাতেই মোহরের তোড়া, মোহরের ঝন্‌ঝনা, এইবার সুখের সীমা কত দূর—দেখিয়া লইব।”

 গৃহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে স্বামীর পা দুইখানি ধরিয়া বলিলেন,—“ছেলে দুইটির প্রতি দয়া কর।”

 হারেস বলিলেন,—“দয়া ত করিবই, রাত্রিটা আছে বলিয়া ‘দয়া’ দেখিতে পাইতেছ না, একটু পরেই দয়া-মায়া সকলই দেখিবে।”

 “দেখ তুমি আমার স্বামী! তোমার পায়ের উপর এই মাথা রাখিয়া বলিতেছি, ছেলে দুইটির প্রতি কোনরূপ অত্যাচার করিও না। এতিমের উপর কোনরূপ কর্কশ ব্যবহার করিতে নাই। ছেলে দুইটির প্রতি দয়া কর। টাকা কয় দিন থাকিবে?”

 হারেস স্ত্রীর মাথায় পদাঘাত করিয়া বলিলেন,—“দূর হ হতভাগিনী, দূর হ!—আমার সম্মুখ হ’তে দূর হ! তোকে কি বলিব—তুই চ’লে যা। তোর কথা শুন্‌বো কি না! পাঁচ হাজার মোহর লক্ষীর কথায়, বুড়ী রূপসীর মায়া-কান্নায় ছাড়িয়া দিব? এ ত আমার ঘরে তোলা টাকা। দেখ,!— ফের্ আমার এই বিছানার নিকটে আস্‌বি ত মাথা মাটিতে গড়াইয়া দিব?”

 “তোরা সকলে ভেবেছিস কি? আমার চক্ষেও ঘুম নাই! তোদের চক্ষেও ঘুম নাই! আর তোরা কখনই এ কথা মনে করিস না যে, মোস্‌লমের দুই পুত্র আমার হাতছাড়া হইবে,—তাহা হইবে না। আর তোরা যা ভাব্‌ছিস তাও হ’বে না। আমি নিশ্চয়ই বুঝিয়াছি, মোস্‌লেমের দুই পুত্রকে জীবন্তভাবে মহারাজ জেয়াদের দরবারে লইয়া যাইতে আমার মত লোকের সাধ্য নাই। পথে বাহির হইলেই চারিদিকে পুরস্কারলোভী গুণ্ডার দল বালক দুইটিকে জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়া যাইবে। কি অন্যায় কথা! ধরিলাম আমি—পুরস্কার পাইব আমি, তাহা না হইয়া যার বল বেশী, সেই-ই বলপূর্ব্বক লইয়া মহারাজ জেয়াদের দরবারে উপস্থিত করিয়া বিজ্ঞাপিত পুরস্কার লইবে। টাকার লোভ বড় শক্ত লোভ! আমি সে সকল ভবিষ্যৎ আশঙ্কার মধ্যেই যাইব না। রাত্রি প্রভাত হইলেই মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের শুধু মস্তক লইয়া রাজ-দরবারে উপস্থিত হইব। তাহাতেই আশা পূর্ণ, কার্য্যসিদ্ধি! তাহাতেই মহারাজ অধিক পরিমাণে সন্তুষ্ট হইবেন!”

 স্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া হারেস বলিলেন,—“তুই স্ত্রীলোক! ওরে তুই কি বুঝ্‌বি? এ সকল উপার্জ্জনের অঙ্গ তুই কি বুঝ্‌বি রে?—ছেলে দুটাও দেখ্‌ছি ওদের পাগলী মায়ের কথায় পাগল হইয়াছে! আমার চক্ষেও ঘুম নাই। তোদের চক্ষেও ঘুম নাই! যা যা, তোরা বিছানায় যা!” এদিকে রাত্রি প্রভাত হইল—কুক্কুটদল সপ্তস্বরে কুফা নগরকে জাগ্রত করিতে লাগিল।

 হারেস প্রত্যুষে উঠিয়াই মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয়কে বন্ধন করিলেন এবং ঘোড়ার পিঠে চাপাইয়া সু-ধার তরবারি ও ঘোড়ার বাগডোর হস্তে ধরিয়া ফোরাত নদীতীরে যাইতে লাগিলেন। হারেসের দুই পুত্রও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইল। গৃহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে মাথায় ঘা মারিতে মারিতে অশ্বপশ্চাতে ছুটিলেন। গৃহিণীও দুই পুত্রসহ গোপনে পরামর্শ করিয়াছেন, যে কোন উপায়েই হউক তাঁহারা তিনজনে একত্রে বালক দুইটিকে রক্ষা করিবেন,— উপস্থিত যমের হস্ত হইতে রক্ষা করিবেন! পুত্রদ্বয় মাতার পদস্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন,—‘দেহে প্রাণ থাকিতে, আমাদের দুই ভ্রাতার শির স্কন্ধে থাকিতে, মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের শির দেহবিচ্ছিন্ন হইতে দিব না।’ দৌড়াইতে দৌড়াইতে সকলেই ফোরাত নদীতীরে উপস্থিত হইলেন।

 হারেসের ক্ষণকাল বিলম্ব সহিতেছে না। শীঘ্র শীঘ্র কার্য্য শেষ করিয়া দুই ভ্রাতার দুইটি মাথা মহারাজ জেয়াদ-দরবারে উপস্থিত করিতে পারিলেই তাঁহার কার্য্যের প্রথম পালা শেষ হয়। দ্বিতীয় পালা মোহরগুলি গণিতে যা বিলম্ব! যে ঘোড়ার পৃষ্ঠে বালকদ্বয়ের মাথা চাপাইয়া রাজদরবারে যাইবেন, সেই ঘোড়ার পৃষ্ঠেই মোহরের ছালা তুলিয়া শীঘ্রই বাটীতে আসিতে পারিবেন—এইরূপ কার্য্যপ্রণালী মনে মনে স্থির করিয়া হারেস শীঘ্র শীঘ্র বালকদ্বয়ের মাথা কাটিতে আগ্রহ করিতেছেন। তিনি বালক দুইটিকে অশ্ব হইতে নামাইয়া সম্মুখে স্থাপন করিলেন। বালকদ্বয় স্বপ্নে যদিও পিতা মোস্‌লেমকে দেখিয়া শীঘ্রই পিতার নিকট যাইতে হইবে—ইহা স্বপ্নযোগে শুনিয়া আনন্দিত হইয়াছিলেন, কিন্তু সে কতক্ষণ? কুহকিনী দুনিয়ার এমনই মায়া যে, তাহাকে ছাড়িবার কথা কর্ণে প্রবেশ করিলেই প্রাণ কাঁদিয়া উঠে। মৃত্যুর কথা মনে পড়িলেই হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়। প্রাণের মায়া কাহার না আছে? মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় হারেসের সম্মুখে দণ্ডায়মান। উলঙ্গ খরধার অসিহস্তে কালান্তকের ন্যায় রক্তজবা সদৃশ আঁখিতে চাহিয়া হারেস বালক দুইটিকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন।

 দুই ভাই কাঁদিতে কাঁদিতে হারেসের পদতলে মাথা রাখিয়া বলিতে লাগিলেন,—“দোহাই তোমার! আমাদিগকে প্রাণে মারিও না। তোমার পদতলে মাথা রাখিয়া বলিতেছি, আমাদিগকে ছাড়িয়া দাও। আমাদের চিরদুঃখিনী মায়ের মুখখানি একবার দেখিতে ছাড়িয়া দাও-মদিনায় যাই। আর কখনও কুফায় আসিব না।”

 বালকদ্বয়ের কাতর ক্রন্দনে পাষাণ প্রাণ হারেসের কিছুই হইল না। দুরন্ত নরপিশাচের কর্ণে পিতৃহারা বালকদ্বয়ের করুণ ক্রন্দন প্রবেশই করিল না; একটি বর্ণও না। হারেস বালকদ্বয়ের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলন করেন, আবার কে যেন বাধা দেয়, থামিয়া যান। আবার ক্ষণকাল পরে মুখ চোখ লাল করিয়া, আঁখিদ্বয়ের তারা বাহির করিয়া, বালকদ্বয়ের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলন করেন, আবার থামিয়া যান। কি মর্ম্মঘাতী দৃশ্য। হারেসের এই অত্যাচার, অমানুষিক ব্যবহার ও হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত, মুক্ত আকাশে দিননাথ শতসহস্র কিরণজাল বিস্তার করিয়া দেখিতেছেন। ফোরাত নদীতীরে এই ঘটনা, ফোরাত-জলও দেখিয়া যাইতেছে, প্রবাহে প্রবাহে হারেসের এই কু-কীর্ত্তি দেখিয়া বহিয়া চলিয়া যাইতেছে। নদীতীরে পিতৃহারা অনাথ দুইটি বালক, কৃপাণধারী যমদুত-সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া কতরকণ্ঠে বলিতেছেন, “ওগো! আমাদিগকে প্রাণে মারিও না।” তাঁহারা প্রাণের দায়ে হন্তার পদতলে লুটাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছেন, “আমরা দুঃখিনীর সন্তান। জনমের মত পিতাকে এই দেশে হারাইয়াছি। মায়ের মুখখানি দেখিব। তোমার নিকটে প্রাণভিক্ষা চাহিতেছি— আমাদের প্রাণভিক্ষা দাও। আমরা জীবনে আর কুফায় আসিব না।”

 বালক দুইটি কতই অনুনয় বিনয় করিলেন—হারেসের মন গলিল না। হারেসের সম্মুখে বধ্যভূমে বালকদ্বয় দণ্ডায়মান। বাম পার্শ্বে হায়েসের দুই পুত্র,—বিষণ্ণবদনে দণ্ডায়মান। দয়াবতী হারেস-জায়াও পুত্রদ্বয়ের পশ্চাৎ—মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া স্বামী-ভয়ে নীরবে কাঁদিয়া চক্ষুজলে ভাসিতেছেন। হারেস এক একবার তরবারি উত্তোলন করেন, আবার থামিয়া যান। একবার বালকদ্বয়ের মুখের দিকে, তৎপরেই ফোরাতের জলস্রোতের দিকে চাহিয়া ঊর্দ্ধে দৃষ্টি করেন। এইরূপে ক্রমেই বিলম্ব হইতে লাগিল।

 হারেস যেন বিরক্ত হইয়া পালিত পুত্রকে বলিলেন,—“পুত্র! ধর ত আমার এই তরবারি। আজ দেখিব তোমার তরবারির হাত। এক আঘাতে দুইটি বালকের মাথা মাটিতে গড়াইয়া দাও দেখি।”

 পুত্র উত্তর করিল, “পিতঃ! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি উহা পারিব না। নিষ্পাপ, নিরপরাধ, দোষশূন্য দুইটি পিতৃহীন অনাথ বালককে, টাকার লোভে বধ করিতে পারিব না—কখনই পারিব না। বালকদ্বয়ের প্রাণ রক্ষা করিতে যাহা আবশ্যক তাহা করিব। আমার প্রাণ দিব, তথাপি ঐ বালকদ্বয়ের প্রতি কোনরূপ অত্যাচার হইতে দিব না। আপনার এ অবৈধ আদেশ কখনই প্রতিপালন করিব না। টাকার লোভে মানুষ খুন, এ মানুষের কার্য্য নহে—ডাকাত! ডাকাত!”

 হারেস রোষ-কষায়িত লোচনে রক্ত আঁখি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিতে লাগিলেন,—“কি রে পামর! আমার কার্য্য তোর চক্ষে হ’ল অবৈধ? তোর এত বিচারে কাজ কি? আর এত লম্বা-চওড়া কথা তুই কার কাছে শিখেছিস? তুই আমার হুকুম মান্‌বি কিনা তাহাই বল্? তুই বেটা ভারি অবাধ্য!”

 “আপনি যাহাই বলুন, আমি মানুষ খুন করিতে পারিব না! আর এই দুইটি বালককে আমি রক্ষা করিবই। আমি এতক্ষণ কিছুই বলি নাই। দেখি, আপনি পাপের কোন্ সীমায় গিয়া উপস্থিত হন! জানিবেন—পিতা বলিতে ঘৃণা বোধ হইতেছে—জানিবেন, দস্যু মহাশয়! জানিবেন, লোভীর লোভ পূর্ণ হয় না। ঈশ্বর তাহার মনের আশা পূর্ণ করেন না। এই দেখুন তাহার দৃষ্টান্ত।”

 পরে সে বালকদ্বয়ের প্রতি চাহিয়া বলিল,—“এস ভাই, তোমরা এস! আমি তোমাদিগকে এখনই মদিনায় লইয়া যাইতেছি।”

 বালকদ্বয় মদিনার নাম শুনিয়াই যেন প্রাণের ভয় ভুলিয়া গেলেন। হারেসের পালিত পুত্র হস্ত বাড়াইয়া বালকদ্বয়ের হস্ত ধরিয়া ক্রোড়ের দিকে টানিয়া আনিতেই হারেস ক্রোধে এক প্রকার জ্ঞানহারা হইয়া বিকম্পিত কণ্ঠে বলিলেন,—“ওরে নিমকহারাম! আমার হাত থেকে বালকদ্বয়কে তুই কাড়িয়া লইবি? তোর এত বড় ক্ষমতা? এত বড় মাথা? তোকেই আগে শিক্ষা দিই।” পালিত পুত্রের দক্ষিণ হস্ত মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের দিকে প্রসারিত। বালকদ্বয়েরও ঐ প্রসারিত হস্ত ধরিতে একটু মাথা নোওয়াইয়া অগ্রসর হইবার চেষ্টা! এই সময়ে হারেসের তরবারি পালিত পুত্রের গ্রীবা-লক্ষ্যে উত্তোলিত হইল। চক্ষের পলক পড়িতেও অবসর হইল না। হারেসের আঘাতে পালিত পুত্রের শির ফোরাতকুলে বালুকা-মিশ্রিত ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। হারেসের রক্তরঞ্জিত তরবারি ঝন্‌ ঝন্ শব্দে কাঁপিয়া উঠিল। গৃহিণী পালিত পুত্রের অবস্থা দেখিয়া আর ক্রন্দন করিলেন না; স্ত্রী-স্বভাব বশতঃ অস্থির হইয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকারও দেখিলেন না। তিনি আপন গর্ভজাত পুত্রের প্রতি আদেশ করিলেন,—“বাছা! এই ত সময়, তোমার প্রতিজ্ঞা পূরণ কর। বালক দুইটিকে রক্ষা কর!” মাতৃ-আজ্ঞা প্রাপ্তিমাত্র তিনি পিতৃহীন বালকদ্বয়কে রাক্ষস হারেসের হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক কাড়িয়া লইতে এক লক্ষে বালকদ্বয়ের নিকটে গিয়া পড়িলেন। হারেস পালিত পুত্রের শির দেহবিচ্ছিন্ন করিয়া বালকদ্বয়ের প্রতি অসি উত্তোলন করিতেই দয়াবতী গৃহিণী গর্ভজাত সন্তানের প্রতি সঙ্কেতে আদেশ করিলেন। আদেশমাত্র বীরপুত্র বালকদ্বয়কে বুকের মধ্যে করিয়া আঘাত ব্যর্থ করিলেন। হারেস ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন,—“ওরে! তুইও তোর মায়ের কথায় আমার বিরোধী হ’য়েছিস? আমার কাজে বাধা দিতে পার্‌বি না। মোস্‌লেম—পুত্রদ্বয়কে রক্ষা ক’র্‌তে পার্‌বি না—পার্‌বি না। ওরে মুর্খ! তোর জন্যও যমদূত দণ্ডায়মান। ছেড়ে দে ছোঁড়া দু’টোকে?”

 পুত্র বলিল—“কখনই ছাড়িব না। নরপিশাচ অর্থলোভীর অর্থলাভ জন্য জীবন্ত জীবকে নরব্যাঘ্রের হস্তে দিব না—দিব না।”

 “দিবি না? আচ্ছা যা, তুইও যা,—বিদ্রোহী পুত্রকে চাই না। যা বেটা জাহান্নামে যা।”

 তরবারি কম্পিত হইয়া বিজলীবৎ চমকাইল। তরবারি স্বীয় ঔরসজাত পুত্রের গ্রীবাদেশে বসিয়া আঘাতে তাহার শির ফোরাতকূলে দেহ-বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল। গৃহিণীর চক্ষের উপর এই সকল হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটিতেছে। পালিত পুত্র, গর্ভজাত পুত্র—দুই পুত্রের খণ্ডিত দেহ মাটিতে পড়িয়া আছে। দুইটি মস্তক যেন তাঁহারই মুখের দিকে চক্ষু মেলিয়া তাকাইয়া আছে। এখনও চক্ষুর পাতা বন্ধ হয় নাই, চারিটি চক্ষু এক দৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়াই আছে। এ দৃশ্য দেখিয়া গৃহিণী পুত্রদ্বয়ের কথা মনেই করিলেন না, স্বামীর ভয়ানক উগ্রমুর্ত্তি দেখিয়াও ভয় করিলেন না। বালকদ্বয়ের প্রতিই তাঁহার লক্ষ্য—কি উপায়ে তাহাদিগকে রক্ষা করিবেন, এই চিন্তাই তখন প্রবল। হারেস রক্তরঞ্জিত তরবারির দ্বারা বালকদিগের মস্তকে আঘাত করিবেন, এমন সময়ে গৃহিণী, “ও কি কর—ও কি কর” বলিয়া তরবারিসমেত স্বামীকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি স্বামী, আমি স্ত্রী, আমি এত অনুনয়বিনয় করিতেছি, মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের শিরে অস্ত্রাঘাত করিও না। দেখ। একবার ঐ দিকে চাহিয়া দেখ! তোমার কর্ম্মফল দেখ! টাকার লোভে পুত্রসম পালিতপুত্রের প্রাণ বিনাশ করিলে। তোমার হৃদয়ের সার, কলেজার অংশ— নয়নের মণি যুবক পুত্রকে টাকার লোভে দুই খণ্ড করিলে! ভালই করিলে! টাকার লোভে আজ তোমার নিকটে পিতৃস্নেহও পরাস্ত হইল। ভালই করিলে! তোমার এ কীর্ত্তিগান চিরকাল জগতের লোকে গাহিবে। দুঃখ নাই!—তোমার পুত্রের প্রাণ তুমি বিনাশ করিয়াছ, তাহাতে হতভাগিনীর দুঃখ নাই। তবে তোমার ঔরসজাত নয়, আমার গর্ভে জন্মে নাই, কিন্তু আমার বুকের দুধ দিয়া যাহাকে পালিয়া পুষিয়া এত বড় করিয়াছিলাম—সেই পালিত পুত্রের জন্য মনটা একটু দমিয়াছে। তাই বলিয়া তোমাকে কিছু বলিব না। এ কথা তুমি নিশ্চয় জানিও—আমি বঁচিয়া থাকিতে, আমার প্রাণ দেহে থাকিতে আমার সম্মুখে তোমকে মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের মাথা কাটিতে দিব না, কখনই দিব ন!। আগে আমাকে কাটিয়া খণ্ড খণ্ড কর, তাহার পর মোস লেম-পুত্রদ্বয়ের গায়ে হাত দিও—অস্ত্র বসাইও।”

 মানুষের কু-প্রবৃত্তি উত্তেজিত হইলে আর কি রক্ষা আছে? হারেস বলবান্, কৌশলী। তিনি কৌশলে স্ত্রীর হাত ছাড়াইয়া রক্ত—আঁখি ঘুরাইয়া বলিলেন,—তোকে তোর ছেলের নিকট পাঠাচ্ছি। যা তোর ছেলে কোলে ক’রে শুয়ে থাক্।” তাহার পর বিষম রোষে তিনি স্ত্রীর প্রতি আঘাত করিলেন।—“যা শুইয়া পড়্! শুইয়া শুইয়া তামাসা দেখ্!”

 হারেসের স্ত্রী মৃত্তিকায় পড়িতেই হারেস উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন,—“এই মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয় যায়! কে রক্ষা কর্‌বি আয়। মোহাম্মদের শিরে তরবারি তুলিতেই এব্রাহিম কাঁদিয়া বলিলেন, “দেখ হারেস! আগে আমার মাথা কাট।” তিনি মাথা নোয়াইয়া দিয়া বলিলেন, “আমি বড় ভাইয়ের মাথা-কাটা এই চক্ষে দেখিতে পারি না। হারেস! তোমার পায়ে ধরি, আগে আমার মাথা কাট।” হারেস মোহাম্মদকে ছাড়িয়া এব্রাহিমের মাথায় তরবারি তুলিতেই মোহাম্মদ কাঁদিয়া বলিলেন, “হারেস! অমন কার্য্য করিও না—কখনও করিও না। আমার প্রাণতুল্য কনিষ্ঠ ভাই! আমারই মাথা আগে কাট, বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথা-কাটা কোন প্রাণে দেখিবে? দোহাই তোমার— দোহাই তোমার ধর্ম্মের—আগে আমার মাথা কাট।”

 হারেস মোহাম্মদের কথায় থতমত খাইয়া ক্ষণকাল স্থিরভাবে থাকিয়াই মহা সাংঘাতিক মূর্ত্তি ধারণ করিয়া অসি ঘুরাইয়া বলিলেন,—“তোদের কাহারও কথা শুনিব না, আর শুনিব না, বিলম্বও করিব না। ভ্রাতৃ-মায়া মিটাইয়া দিতেছি।”—বলিয়াই অগ্রে মোহাম্মদের মাথা কাটিয়া ফেলিলেন। পরে কনিষ্ঠ ভ্রাতা এব্রাহিমের মাথা মাটিতে গড়াইয়া দিলেন। মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের মৃতদেহ ফোরাত জলে নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের মস্তক অতি সাবধানে লইয়া হারেস অশ্বে চাপিলেন। রক্তমাখা তরবারি-হস্তেই একেবারে মহারাজ জেয়াদের দরবারে উপস্থিত হইয়া তিনি বলিলেন,—

 “বাদশাহ্-নামদারের আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি। তবে আজ্ঞার কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত হইয়াছে। আপনি যাহা করিতেন, তাহাই করিয়াছি। জীবন্ত আনিতে পারি নাই, অপরে কাড়িয়া লইবে সন্দেহে জীবনান্ত করিয়া দুই ভাইয়ের এই ‘মাথা’দুটি আনিয়াছি—এই দেখুন! আমার পুরস্কার—আপনার আদিষ্ট পুরস্কার আমাকে দিন, আমি চলিয়া যাই। স্বীকৃত পঞ্চ সহস্র মোহর আনিতে আজ্ঞা করুন। মহারাজ! ছেলে দুইটিকে খুঁজিয়া বাহির করিতে যাহা হইবার হইয়াছে, তাহা আর বলিবার নহে!”

 নরপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, রাজদরবারের সভাসদগণ, অমাত্যগণ, দরবারের যাবতীয় লোক হারেসের এই অমানুষিক কার্য্য দেখিয়া ক্ষণকাল নিস্তব্ধভাবে রহিলেন। সকলেই মোস্‌লেমের পুত্রদ্বয়ের জন্য অন্তরে বিশেষ আঘাতপ্রাপ্ত হইলেন। কাহারও মুখে কোন কথা সরিল না।

 নরপতি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ হারেসের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দুঃখিতভাবে বলিলেন,—“ওহে! সুন্দর বালক দুইটিকে এরূপভাবে শিরশ্ছেদ করিলে কেন? যাও, শীঘ্র দরবারের বাহিরে যাও। উহাদের ধুলি-রক্তজমাটযুক্ত মস্তক ধৌত করিয়া একটি পরিস্কার পাত্রে করিয়া আমার সম্মুখে আনয়ন কর।”

 হারেস তখনই মস্তকদ্বয় ধৌত করিয়া মূল্যবান পাত্রোপরি রাখিয়া নরপতি জেয়াদের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন।

 জেয়াদ বলিলেন,—“ওহে যুগল-বালকহন্তা পাষাণপ্রাণ হারেস! তোমার মন কি উপকরণে গঠিত? বল শুনি। সত্যই কি মানব-রক্তমাংস তোমার দেহে নাই? অন্য কোন প্রকারে জীবনীশক্তি থাকিতে পারে? এই বালক দুইটির মুখের লাবণ্য, চক্ষের ভাব, গণ্ডস্থলের স্বাভাবিক ঈষৎ গোলাপী আভা দেখিয়াও কি তোমার মন কিছুই বলে নাই? হাতের তরবারি কি প্রকারে উর্দ্ধে উঠিল? ইহাদের বিষাদমাখা মুখের ভাব দেখিয়াও কি তরবারি নীচে নামিল না? মহারাজ এজিদ-নামদার যদি মোস্‌লেম-পুরদ্বয়কে দামেস্কে পাঠাইতে আদেশ করেন, তখন আমি কি করিব? উপায় কি? অল্পবয়স্ক বালক দুইটিই কি আমার বেশী ভারবোধ হইয়াছিল? তাহাদের জীবিত থাকাই কি আমার বিশেষ ভয়ের কারণ হইয়াছিল? ওহে বীর! বালকহন্তা মহাবীর! আমার ঘোষণায় কি বালকদের শিরশ্ছেদ করিয়া মাথা আনিবার কথা ছিল? না ডঙ্কা বাজাইয়া মাথা আনিবার ঘোষণা করা হইয়াছিল?”

 হারেস বলিল—“শিরশ্ছেদের কথা ছিল না, ধরিয়া আনিবার আদেশ ছিল। জীবিত অবস্থায় তাহাদিগকে দরবার পর্য্যন্ত আনা দুঃসাধ্য বলিয়াই মাথা দুইটি আনিয়াছি। শত শত জন এই বালকদ্বয়ের সন্ধানে ছিল—আমাকে দরবারে আনিতে দেখিলেই তাহাদের মধ্যে কেহ না কেহ বালকদ্বয়কে কাড়িয়া লইত; মাথা সমেত বালক দুইটিকে আনিয়া স্বচ্ছন্দে পুরস্কার লাভ করিয়া চলিয়া যাইত। পরিশ্রম আমার—লাভ করিত ডাকাতদল!”

 আমি বাদ্‌শাহ-নামদারের মঙ্গলকামী হিতৈষী। চিরশত্রুর বংশে কাহাকেও রাখিতে নাই। হয় ত সময়ে এই বালকদ্বয় বীরশ্রেষ্ঠ বীর শত্রুর ন্যায় দণ্ডায়মান হইত। আমি ইহাদিগকে একেবারে নির্ম্মূল করিয়া দিয়াছি, আমাকে স্বীকৃত পুরস্কারে পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করুন। আজ দুই তিন রাত্রি আমার আহার নাই—নিদ্রা নাই—বিশ্রামের সময়, অবসর কিছুই নাই। এই দুইটি বালকের মস্তক গ্রহণ করিতে আমার দুইটি পুত্র এবং স্ত্রীর মাথা কাটিয়াছি।”

 দরবারসমেত সকলে মহাদুঃখিত ও বিস্ময়াপন্ন হইলেন। নরপতি জেয়াদ বলিলেন,—“ওহে বীর! সে কি কথা?—”

 “কি কথা?—আপনার শত্রুকুল নির্ম্মূল করিতে আমার বংশ নিপাত করিলাম, তথাপি আপনার নিকট যশোলাভ করিতে পারিলাম না। যাহার জন্য এত কাণ্ড, তাহা—অর্থাৎ সে মোহরগুলি পাইব কি না, তাহাতেও এখন সন্দেহ হইতেছে!”

 মন্ত্রীদল মধ্য হইতে এক জন বলিলেন,—“আপনার পুরস্কার ধরা আছে, আর তিনটি খুন কোথায় কি প্রকারে করিলেন, বলুন শুনি।”

 “তিনটি খুনই বটে! কেন করিলাম, শুনুন। আমার দুই পুত্র, এক স্ত্রী—এই তিনটি। তাহারা কিছুতেই এই শত্রু বালকদের শির কাটিতে দিবে না। বাধা দিতে আরম্ভ করিল! একে একে বাধা দিল। একে একে লাল বসন পরাইয়া ফোরাত নদীর কূলে তাহাদিগকে শয়ন করাইয়া দিলাম। এক স্থানেই সকলের শিরশ্ছেদ-রক্তপাত—নড়াচড়া-পরে সকলের দেহই ফোরাতজলে ক্ষেপণ—অবগাহন—নিমজ্জন—বিসর্জ্জন!”

 আবদুল্লাহ্ জেয়াদ বলিলেন,—“এ দৃশ্য আমি দেখিতে পারি না! নিরপরাধ বালকদ্বয়ের শির যে আপন হাতে কাটিতে পারে, তাহাকে বাধা দিয়াছিল কাহারা? এই নরপিশাচের সন্তান দুই জন; আর সহধর্ম্মিণী স্বয়ং। তাহাদিগকেও সে বিনাশ করিয়াছে! এমন নর-রাক্ষসের শির কিছুতেই স্বস্থানে থাকিতে পারে না। হায়! হায়! একই সময়ে পাঁচটি মানবজীবন শেষ করিয়াছে। আমার আদেশ মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়-হন্তা হারেস্‌ এই দুই বালকের শির সম্মানের সহিত মাথায় করিয়া ফোরাত-কূলে লইয়া যাইবে। এই দুই বালকের মস্তক সে যে স্থানে দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে, সেই স্থানে সেই অস্ত্রে সেই মহাপাপীর মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া, শৃগাল-কুকুরের ভক্ষণের সুযোগ করিয়া দিও। ফোরাত-জলে নিক্ষেপ করিয়া—জল অপবিত্র করিও না। মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের দেহখণ্ড ফোরাত জলে ভাসাইয়া দিয়াছে, কি করিব কোন উপায় নাই। বিশেষ সন্ধান করিয়া দেখিও। যদি এই যুগলভ্রাতার মৃতদেহ প্রাপ্ত হওয়া যায়, তবে রীতিমত কাফন দাফন করিয়া, যথোচিতরূপে অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়াদি করিয়া আমার আদেশ সম্পূর্ণ করিও এবং কার্য্যশেষে আমাকে সংবাদ জ্ঞাপন করি।”

 ঘাতক, প্রহরী, কার্য্যকারক তখনই রাজাদেশ মত কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহারা মোস্‌লেম-পুত্রদ্বয়ের খণ্ডিত শির মহামুল্য বস্ত্রে আবরিত করিয়া হারেস শিরে চাপাইয়া ফোরাত-কূলে লইয়া চলিল। ফোরাত-কূলে যাইয়া তাহা দেখিল, রক্তে আর বালিতে জমাট বাঁধিয়া একটি স্থান চিহ্নিত হইয়া রহিয়াছে। আরও এক আশ্চর্য্য ঘটনা। তাহারা দেখিল যে, মোসলেম-পুত্রদ্বয়ের শিরশূন্য ঘুগল দেহ গলাগলি করিয়া জড়াইয়া জলে ভাসিতেছে। কি আশ্চর্য্য! স্রোতের জলে যে মৃতদেহ ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, স্রোতের বিপরীত দিকে তাহা টানিয়া আনিল কে? এই আশ্চর্য্য সংযোগ করিল কে?

 এই অত্যাশ্চর্য্য ঘটনা দেখিয়া রাজকীয় কার্য্যকারকের মনেও একটি কথা হঠাৎ উদয় হইল। তিনি পাত্রস্থ দুইটি মস্তক ফোরাত-জলের নিকটে ধরিতেই জড়িত যুগল দেহ ভাসিতে ভাসিতে আসিয়া আপন আপন মস্তকে সংলগ্ন হইল। রাজকর্ম্মচারী মৃতদেহ দুইটি উঠাইয়া পৃথক করিতে বহু চেষ্টা করিলেন, কিছুতেই পৃথক করিতে পারিলেন না; সে অপূর্ব্ব ভ্রাতৃস্নেহ-বন্ধন বহু যত্নেও ভিন্ন করিতে পারিলেন না, শবদেহের সে আশ্চর্য্য ভ্রাতৃমায়া-বন্ধন ছাড়াইয়া পৃথক করিতে সক্ষম হইলেন না। বাধ্য হইয়া তিনি দুই ভ্রাতার দেহ একত্রে স্নান করাইয়া একত্রে কাফন করিয়া একযোগে দাফন করিলেন।

 তাহার পর হারেসের প্রতি রাজাজ্ঞা যাহা ছিল, তাহা সম্পাদন করিতে যাইতেই হারেস বলিল, “আমার উচিত শাস্তি হইল। অতিরিক্ত লোভের অতিরিক্ত ফলও ভোগ করিলাম। হা-পুত্র—হা-স্ত্রী—হা-লোভ।”

 হারেসের খণ্ডিত দেহ বধ্যভূমিতে পড়িয়া রহিল।