বেতালপঞ্চবিংশতি/নবম উপাখ্যান

উইকিসংকলন থেকে

নবম উপাখ্যান

বেতাল কহিল মহারাজ

মগধপুর নামে এক নগর আছে। তথায় বীরবর নামে রাজা ছিলেন। হিরণ্যদত্ত নামে বণিক্‌ তাঁহার অধিকারে বাস করিত। ঐ বণিকের মদনসেনা নামে এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। ঋতুরাজ বসন্ত সমাগত হইলে মদনসেনা স্বীয় সহচরীবর্গ সমভিব্যাহারে করিয়া উপবনভ্রমণে গমন করিল। দৈবযোগে ধর্ম্মদত্ত বণিকের পুত্ত্র সোমদত্তও বনবিহারবাসনায় সেই উপবনে উপস্থিত হইল। সে কিয়ৎ ক্ষণ ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া দূর হইতে দর্শন করিল এক পরম সুন্দরী পূর্ণযৌবনা কামিনী সখীগণ সহিত ভ্রমণ করিতেছে। ক্রমে ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইয়া মদনসেনার অসামান্য রূপলাবণ্য নয়নগোচর করিয়া মোহিত হইল এবং নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া তাহার নিকটে গিয়া কহিল সুন্দরি তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও আমি নিতান্ত বিচেতন হইয়াছি। অধিক কি কহিব যদি তুমি অনুকুল না হও তোমার সমক্ষে আত্মঘাতী হইব। মদনসেনা শুনিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া সোমদত্তকে অশেষপ্রকার সদুপদেশ প্রদান করিল কিন্তু কোন প্রকারেই তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিল না। বরং সোমদত্ত পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক অধৈর্য্য ও ব্যাকুল হইয়া অঞ্জলি বদ্ধ করিয়া অশ্রুমুখে সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিল। তখন মদনসেনা উদারস্বভাবতা প্রযুক্ত পরের প্রাণ রক্ষা করা প্রধান ধর্ম্ম বোধ করিয়া কহিল আগামী পঞ্চম দিবসে আমার বিবাহ হইবেক তৎপরে শ্বশুরালয়ে যাইব। প্রতিজ্ঞা করিতেছি অগ্রে তোমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া স্বামিসেবায় প্রবৃত্ত হইব না। তুমি এক্ষণে ক্ষান্ত হও গৃহে গমন কর। সোমদত্ত মদনসেনার বাক্যে আশ্বাসিত হইয়া বিশ্বসিত মনে গৃহে গমন করিল।

তৎপরে পঞ্চম দিবসে পরিণীতা হইয়া মদনসেনা শ্বশুরালয়ে গমন করিল। রজনী উপস্থিত হইলে গৃহজনেরা তাহাকে শয়নাগারে প্রেরণ করিল। সে সর্ব্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত করিয়া মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক শয্যার এক পার্শ্বে উপবিষ্টা রহিল। তাহার স্বামী পরম সমাদরে কর গ্রহণপূর্ব্বক প্রিয়সম্ভাষণ করিতে লাগিল। কিন্তু মদনসেনা তৎকালোচিত নবোঢ়াচেষ্টিত সমুদায়ের বৈপরীত্যে সোমদত্তের বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া কহিল যদি তুমি আমাকে তাহার নিকটে যাইতে অনুমতি না দাও আমি আত্মহত্যা করিব। তাহার স্বামী প্রথমতঃ বিস্তর নিষেধ করিল কিন্তু তাহার আগ্রহাতিশয় দেখিয়া কহিল যদি তুমি নিতান্তই তাহার নিকটে যাইতে চাও যাও আমি নিষেধ করিতে পারি না। প্রতিজ্ঞাপরিপূর্ণ অবশ্যকর্ত্তব্য বটে।

মদনসেনা এই রূপে স্বামীর সম্মতি লাভ করিয়া অর্দ্ধরাত্র সময়ে একাকিনী সোমদত্তের উদ্দেশে চলিল। রাজপথে উপস্থিত হইলে এক তস্কর তাহার সম্মুখে আসিয়া জিজ্ঞাসিল সুন্দরি তুমি কে এবং সর্ব্বাঙ্গে সর্ব্বপ্রকার অলঙ্কার ধারণ করিয়া এ ঘোর রজনীতে কোথায় যাইতেছ। তোমাকে একাকিনী দেখিতেছি অথচ তোমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার লক্ষিত হইতেছে না। মদনসেনা কহিল আমি হিরণ্যদত্ত শ্রেষ্ঠীর কন্যা আমার নাম মদনসেনা প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালনার্থে সোমদত্তের নিকট যাইতেছি।

চোর শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া তাহার গাত্র হইতে অলঙ্কারগ্রহণের উদ্যম করিলে মদনসেনা শঙ্কিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে পূর্ব্বাপর বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া কহিল ভ্রাতঃ আমি অনেক যত্নে স্বামীকে সম্মত করিয়া তাঁহার অনুমতি লইয়া এই প্রতিজ্ঞাতার হইতে মুক্ত হইবার উপায় করিয়াছি। তুমি আমার বেশ ভঙ্গ করিয়া প্রতিবন্ধকতাচরণ করিও না। এই স্থানে অবস্থিতি কর প্রতিজ্ঞা করিতেছি প্রত্যাগমনসময়ে সমস্ত অলঙ্কার তোমার হস্তে সমর্পণ করিয়া যাইব। চোর মদনসেনার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিল এবং সেই স্থানে উপবিষ্ট হইয়া অলঙ্কারপ্রত্যাশায় প্রত্যাগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

মদনসেনা সোমদত্তের শয়নাগারে প্রবেশ করিয়া তাহাকে সুপ্ত দেখিয়া জাগরিত করিল। সোমদত্ত মদনসেনার অসম্ভাবিত সমাগমে বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল তুমি এই ঘোর রজনীতে একাকিনী কি প্রকারে কোথা হইতে উপস্থিত হইলে। মদনসেনা কহিল বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে গিয়াছি তথা হইতে আসিতেছি। কয়েক দিবস হইল উপবনবিহারকালে তোমার নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম তৎপ্রতিপালনার্থে উপস্থিত হইয়াছি, এক্ষণে তোমার ইচ্ছা বলবতী। সোমদত্ত জিজ্ঞাসিল তোমার পতির নিকটে এই বৃত্তান্ত ব্যক্ত করিয়াছ কি না। সে উত্তর দিল তাঁহার নিকটে সমস্ত অবিকল বর্ণন করিলাম তিনি শুনিয়া ও বিবেচনা করিয়া কিঞ্চিৎ কাল পরে অনুমতি করিলেন তৎপরে তোমার নিকটে আসিয়াছি।

সোমদত্ত কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল আমি পরকীয় মহিলার অঙ্গস্পর্শ করিব না শাস্ত্রে তদ্বিষয়ে অনেক অধর্ম্ম নির্দেশ আছে। যাহা হউক তোমার বাক্যনিষ্ঠায় ও তোমার পতির ভদ্রতায় অতিশয় প্রীত হইলাম। অকপট হৃদয়ে কহিতেছি তুমি প্রতিজ্ঞাতার হইতে মুক্ত হইলে এক্ষণে যাও নির্বিঘ্নে পতিশুশ্রূষার প্রবৃত্ত হও।

তদনন্তর মদনসেনা প্রত্যাবর্ত্তনকালে মলিম্লুচের নিকটে উপস্থিত হইল। সে তাহাকে ত্বরায় প্রত্যাগত দেখিয়া কারণ জিজ্ঞাসিলে মদনসেনা সবিশেষ সমস্ত বর্ণন করিল। চোর শুনিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া অকপট হৃদয়ে কহিল আমার অলঙ্কারের প্রয়োজন নাই। তুমি অতি সুশীলা ও সত্যবাদিনী। ধর্ম্মে ধর্ম্মে তোমার যে সতীত্ব রক্ষা হইল তাহাই আমার পরম লাভ। তুমি নির্বিঘ্নে আপন আলয়ে গমন কর। এই বলিয়া চোর চলিয়া গেল। অনন্তর মদনসেনা স্বামিসন্নিধানে উপস্থিত হইলে সে আর তাহার প্রতি পূর্ব্ববৎ প্রণয়সম্ভাষণ না করিয়া অপ্রসন্ন মনে শয়ান রহিল।

ইহা কহিয়া বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল মহারাজ এই চারি জনের মধ্যে কাহার ভদ্রতা অধিক। রাজা উত্তর দিলেন চোরের। বেতাল কহিল কি প্রকারে। রাজা কহিলেন মদনসেনার স্বামী তাহাকে অন্যসংক্রান্তহৃদয়া দেখিয়া পরিত্যাগ করিয়াছিল প্রশস্ত মনে সোমদত্তের নিকট গমনে অনুমতি করে নাই। তাহা হইলে উহার মন এক্ষণে অপ্রসন্ন হইত না। আর সোমদত্ত উপবনে তাদৃশ অধৈর্য্য প্রদর্শন করিয়া এক্ষণে কেবল রাজদণ্ডভয়েই পরাঙ্মুখ হইল আন্তরিক ধর্ম্মভীরুতা প্রযুক্ত নহে। আর মদনসেনা সোমদত্তের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল এবং প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করা উচিত কর্ম্ম বটে কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে সতীত্ব প্রতিপালন করাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান ধর্ম্ম। সুতরাং প্রতিজ্ঞাভঙ্গভয়ে সতীত্বভজে প্রবৃত্ত হওয়া অসতীর কর্ম্ম বলিতে হইবেক। অতএব তাহার এই সত্যনিষ্ঠা সাধুবাদযোগ্য নহে। কিন্তু চোর স্বভাবতঃ অর্থগৃধ্নু সে যে মহামূল্য অলঙ্কার সমস্ত হস্তে পাইয়া মদনসেনার কেবল সতীত্বরক্ষা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া লোভসংবরণপূর্ব্বক তাহাকে অক্ষত বেশে গমন করিতে দিল ইহাকে কেবল অকৃত্রিম ঔদার্য্যের কার্য্য বলিতে হইবেক।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।