বেতালপঞ্চবিংশতি/সপ্তদশ উপাখ্যান

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল মহারাজ

হেমকূট নগরে বিষ্ণুশর্ম্মা নামে পরম ধার্ম্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার গুণাকর নামে পুত্ত্র ছিল। ঐ পুত্ত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া দ্যূতক্রীড়ায় অত্যন্ত আসক্ত হইল এবং ক্রমে ক্রমে পিতার সর্ব্বস্ব দুরোদরমুখে আহুতি দিয়া পরিশেষে অর্থনিমিত্ত তস্করবৃত্তি অবলম্বন করিল। তখন বিষ্ণুশর্ম্মা তাহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।

গুণাকর নিতান্ত নিরুপায় হুইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে করিতে এক নগরের প্রান্তভাগে উপস্থিত হইল এবং দেখিল এক সন্ন্যাসী শ্মশানে উপবেশন করিয়া যোগাভ্যাস করিতেছেন। পরে সে যোগীর নিকটে গিয়া সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতপূর্ব্বক সমীপদেশে উপবিষ্ট হইল। যোগী গুণাকরের প্রতি দৃষ্টিপাত দ্বারা তাহাকে ক্ষুধার্ত্ত বোধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কিছু ভোজন করিবে। সে কহিল মহাশয় আপনি কৃপা করিয়া প্রসাদ দিলে অবশ্য ভোজন করিব। তখন তিনি এক নরকপালপূর্ণ অন্ন ব্যঞ্জন তাহার সম্মুখে রাখিয়া ভোজন করিতে কহিলেন। সে কহিল মহাশয় এ অন্ন ব্যঞ্জন ভোজন করিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না।

তখন যোগী যোগাসনে আসীন হইয়া নয়নদ্বয় মুদ্রিত করিবামাত্র এক যক্ষকন্যা অঞ্জলিবন্ধপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখবর্ত্তিনী হইয়া নিবেদন করিল মহাশয় দাসী উপস্থিত কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন এই ব্রাহ্মণ বুভুক্ষু হইয়া আমার আশ্রমে আসিয়াছেন ইঁহার যথোচিত অতিথিসৎকার কর। যক্ষকন্যা যোগীর আজ্ঞা প্রাপ্তিমাত্র মায়াবলে নিমিষমধ্যে এক রম্য হর্ম্ম্য নির্মাণপূর্ব্বক তাহাতে যথাযথ সুখসাধন বস্তুজাত সুসজ্জিত করিয়া পরিশেষে ব্রাহ্মণকে সমভিব্যাহারে লইয়া গেল এবং নানাবিধ অন্ন ব্যঞ্জন মৎস্য মাংস দধি দুগ্ধ মিষ্টান্ন প্রভৃতি দ্বারা ইচ্ছানুরূপ ভোজন করাইয়া তাহাকে মহার্হ বেশ ভূষা পরিধাপনপূর্ব্বক মণিময় পর্য্যঙ্কে শয়ন করাইল। পরে রজনী উপস্থিত হইলে স্বয়ং পরম রমণীয় বেশ ভূষী সমাধান করিয়া পল্যঙ্কের একদেশে উপবেশনপূর্ব্বক চরণসেবা করিতে লাগিল। ফলতঃ গুণাকরের পরম সুখে রজনীযাপন হইল।

প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গ হইলে যক্ষকন্যা ও তৎকৃত যাবতীয় ব্যাপারের চিহ্নমাত্র দেখিতে না পাইয়া গুণাকর অত্যন্ত দুঃখিত মনে সন্ন্যাসীর নিকটে গিয়া নিবেদন করিল মহাশয়ের প্রসাদে কল্য রাজভোগে রজনী যাপন করিয়াছি। কিন্তু নিশাবসানে সেই কামিনী প্রস্থান করিয়াছে এবং তৎকৃত সেই সমস্ত হর্ম্ম্যাদিও লয় পাইয়াছে। যোগী কহিলেন যক্ষকন্যা বিদ্যাপ্রভাবে আসিয়াছিল। যে ব্যক্তি বিদ্যায় সিদ্ধ হয় তাহার নিকটে দীর্ঘ কাল অবস্থিতি করে। গুণাকর কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল মহাশয় যদি কৃপা করিয়া উপদেশ দেন তাহা হইলে আমিও সেই বিদ্যার সাধনা করি। যোগী তদীয় বিনয়ের বশীভূত হইয়া এক মন্ত্র উপদেশ দিয়া কহিলেন তুমি এই মন্ত্র লইয়া চত্বারিংশৎ দিবস অর্দ্ধরাত্র সময়ে জলাবগাহনপূর্ব্বক একাগ্র চিত্তে জপ কর।

গুণাকর সন্ন্যাসীর আদেশানুরূপ জপ করিয়া তাঁহার নিকটে আসিয়া কহিল মহাশয় আপনকার আদেশানুসারে যথানিয়মে চল্লিশ দিন জপ করিয়াছি এক্ষণে কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন আর চল্লিশ দিন অগ্নিপ্রবেশ করিয়া জপ কর তাহা হইলেই তুমি কৃতকার্য্য হইবে। তখন সে কহিল মহাশয় বহু দিবস হইল গৃহ পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। পিতা মাতা প্রভৃতিকে দেখিবার নিমিত্ত চিত্ত অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছে। অতএব অগ্রে এক বার পরিবার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসি পশ্চাৎ আপনকার নির্দেশানুরূপ মন্ত্র সাধন করিব। এই বলিয়া সন্ন্যাসীর নিকট বিদায় লইয়া গুণাকর আপন আলয়ে প্রস্থান করিল। গৃহে উপস্থিত হইবামাত্র তাহার পিতা মাতা বহু কালের পর পুত্ত্রকে গৃহাগত দেখিয়া অত্যন্ত রোদন করিতে লাগিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন বৎস এত দিন তুমি কোথায় ছিলে। আমরা তোমার অদর্শনে মৃতপ্রায় হইয়া আছি। গুণাকর কহিল হে তাত হে মাতঃ আমি ইতস্ততঃ নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে সৌভাগ্যক্রমে এক পরম দরালু সন্ন্যাসীর দর্শন পাইয়াছি এবং তাঁহার শরণ লইয়াছি। এক্ষণে তাঁহার উপদেশানুসারে মন্ত্র সাধন করিতেছি। তোমাদিগকে বহু কাল না দেখিয়া অতিশয় উৎকণ্ঠিত ও চলচিত্ত হইয়াছিলাম তাহাতেই এক বার কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত দর্শন করিতে আসিয়াছি। সম্প্রতি জন্মের মত বিদায় লইয়া যোগসাধনার্থে প্রস্থান করিব।

গুণাকর এই বলিয়া পলায়নের উদ্যম করিলে তাহার জননী বাষ্পাকুল লোচনে গদ্গদ বচনে কহিতে লাগিলেন বৎস এ তোমার যোগাভ্যাসের সময় নয়। গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া গৃহস্থধর্ম্ম প্রতিপালন কর তাহা হইলেই তুমি যোগাভ্যাসের সম্পূর্ণ ফল পাইবে। গৃহস্থাশ্রম সমস্ত আশ্রমের মূল এবং সমস্ত আশ্রম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বিশেষতঃ পরম গুরু পিতা মাতার শুশ্রূষা করাই গৃহীর প্রধান ধর্ম্ম। অতএব যাবৎ আমরা জীবিত আছি তাবৎ তোমার তীর্থযাত্রা বা যোগানুষ্ঠানের প্রয়োজন নাই। কেবল আমাদের শুশ্রূষা কর তাহাতেই তোমার পরম ধর্ম্ম লাভ হইবেক। আর বিবেচনা কর তুমি আমাদের একমাত্র পুত্ত্র মা বলিয়া সম্বোধন করিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই। অন্ধের যষ্টির ন্যায় তুমি আমাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন আছ। আমরা তোমাকে বিদায় দিয়া কোন ক্রমেই প্রাণধারণ করিতে পারিব না। অতএব এ দুর্বুদ্ধি পরিত্যাগ কর। যদি নিতান্তই যোগাভ্যাসের অতিলাষ হইয়া থাকে অন্ততঃ আমাদের মৃত্যু পর্য্যন্ত অপেক্ষা কর পরে ইচ্ছানুসারে ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিবে।

গুণাকর শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিল এবং কহিল এই মায়াময় সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর। ইহাতে লিপ্ত থাকিয়া কেবল জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য কঠিন শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিতে হয়। প্রত্যক্ষপরিদৃশ্যমান পদার্থমাত্রই মায়াপ্রপঞ্চ বাস্তবিক কিছুই নহে। কে কাহার পিতা কে কাহার মাতা কে কাহার পুত্ত্র। সকলই ভ্রান্তিমূলক। অতএব আর আমি বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইব না এবং শ্রেয়ঃসাধন বোধ করিয়া যে পথ অবলম্বন করিয়াছি তাহাও পরিত্যাগ করিব না। এই বলিয়া পিতা মাতার নিকট বিদায় হইল এবং সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া অগ্নিপ্রবেশপূর্ব্বক মন্ত্রসাধনে যত্ন করিতে লাগিল কিন্তু সিদ্ধ হইতে পারিল না। ইহা কহিয়া বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল মহারাজ কি কারণে ব্রাহ্মণ সাধনা করিয়া সিদ্ধ হইতে পারিল না বল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন একাগ্রচিত্ত না হইলে মন্ত্রসিদ্ধি হয় না। ব্রাহ্মণের মনে একান্ত নিষ্ঠা ছিল না সেই বৈগুণ্য প্রযুক্তই তাহার সাধনা বিফল হইল। ইহা শুনিয়া বেতাল কহিল যে সাধক মন্ত্র সিদ্ধ করিবার উদ্দেশে এতাদৃশ-দুঃসহ ক্লেশ স্বীকার করিলেক সে একাগ্রচিত্ত হয় নাই তাহার প্রমাণ কি। বিক্রমাদিত্য কহিলেন সে একাগ্রচিত্ত হইলে পরিবারের নিমিত্ত চঞ্চলচিত্ত হইত না এবং মধ্যে যোগভঙ্গ করিয়া তাহাদের দর্শনে যাইত না। ফলতঃ সকলই অদৃষ্টমূলক। নতুবা যোগাভ্যাস দ্বারা সর্ব্ব প্রকারে নির্মম ও জ্ঞানসম্পন্ন হইয়াও কি নিমিত্তে সিদ্ধপ্রায় সাধনফলে বঞ্চিত হইল বল।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।