ভগ্নহৃদয়/অষ্টম সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম সর্গ।

মুরলা ও চপলা।

চপলা।—দেখ্, সখি মাের, সত্য কহি তোরে, 
প্রাণে বড় ব্যথা বাজে,
চপলার কেহ সখী নাই হেথা
এত বালিকার মাঝে!
তোদের ও মুখ হেরিলে মলিন
হৃদয় কাঁদিয়া উঠে,
আকুল হইয়া শুধাবার তরে
তাড়াতাড়ি আমি ছুটে;
শতবার কোরে শুধাই তোদের
কথা না কহিস্ তবু,
ভাবিস্, চপলা অবোধ বালিকা
কিছু সে বুঝেনা কভু!
চোখের জলের কাহিনী বুঝেনা,
বুঝেনা সে ভালবাসা,
পড়িতে পারেনা প্রাণের লিখন
দুখের সুখের ভাষা!
ভাল, সখি, ভাল, নাইবা বুঝিল,
তাহাতে কি যায় আসে?

চপলা কি শুধু হাসিতেই জানে;
কাঁদিতে কি জানে না সে?
মুরলা আমার, তোরে আমি এত
ভাল বাসি প্রাণ ভোরে,
তবু একদিন তোর তরে, সখি,
কাঁদিতে দিবিনে মোরে?
মুরলা।—চপলাটি মাের, হাসি-রাশি মোর, 
আমার প্রাণের সখি!
নিজের হৃদয় নিজেই বুঝিনা
অপরে তা’ বুঝাব’ কি?
যাহাদের সুখে আমি সুখে র’ই
সকলেই সুখী তারা;
তবে কেন আমি একেলা বসিয়া
ফেলি এ নয়ন ধারা?
সকলেই যদি সুখে থাকে সখি,
আমি থাকিব না কেন?
প্রমোদ তেয়াগি বিজনে আসিয়া
কেনবা কাঁদিব হেন।
নিজের মনেরে বুঝানু কতই
কিছুই না পেনু সাড়া;
মুরলার কথা শুধাস্‌নে আর,
মুরলা জগত-ছাড়া!
চপলা।—এত দিনে দেখি কবির অধরে 
হরষ কিরণ জ্বলে,—

যেন আঁখি তার ডুবিয়া গিয়াছে
সুখের স্বপন তলে!
জোছনা উদিলে কুসুম-কাননে,
একেলা ভ্রমিয়া ফিরে,
ভাবে মাতোয়ারা, আপনার মনে
গান গাহে ধীরে ধীরে;
নয়নে অধরে মলয়-আকুল
বসন্ত বিরাজ করে,
মধুর অথচ উদাস হরষ
ঘুমায় মুখের পরে!
হেন ভাব কেন হেরিলো তাহার
শুধাইব তোর কাছে!
বড়ই সে সুখে আছে!
মুরলা।—চপলা, সখিলো, দেখেছিস্ তারে? 
বড় কি সে সুখে আছে?
কেমনে বুঝিলি, বল্ তাহা বল্,
বল্ সখি মোর কাছে!
বড় কি সে সুখে আছে?
চপলা।—হাঁলো সখি হাঁলাে;—শোন্ বলি তোরে, 
আয়, সখি, মোর পাশে,
কবি আমাদের, নলিনী বালারে
মনে মনে ভালবাসে।
সত্য কহি তোরে, নলিনীরে বড়
ভাল নাহি লাগে মোর,

শুনিয়াছি নাকি পাষাণ হ’তেও
মন তার সুকঠোর!
মুরলা।—সে কি কথা বালা! মুখ খানি তার 
নহে কি মধুর অতি?
নয়নে কি তার দিবস রজনী
খেলে না মধুর জ্যোতি?
চপলা।—শুনেছি সে জ্যোতি আলেয়ার চেয়ে 
কপট, চপল না কি,
পথিকের পথ ভূলাবারি তরে
জ্বলি উঠে থাকি থাকি!
শুনেছি সে বালা, সারাটি জীবন
চড়িয়া পাষাণ-রথে,
চাকায় দলিয়া চলিবারে চায়
হৃদয়-বিছানো পথে!
শুনেছি সে নাকি একটি একটি
হৃদয় গণিয়া রাখে,
কি কুখণে, কবি আমাদের
ভাল বাসিয়াছে তাকে!
মুরলা।—চপলা, চপলা, পায়ে ধরি তাের, 
ক’স্‌নে অমন কোরে।
তুই লো বালিকা, হৃদয় তাহার
চিনিবি কেমন কোরে?
চপলা।—কে জানে সজনি, বুঝিতে পারিনে 
কেন যে হইল হেন,

তাহারে হেরিলে মুখ ফিরাইতে
সাধ যায় মোর যেন?
সেদিন যখন দেখিনু নলিনী
বসিয়া কবির সাথে,
সরমের বেশে লাজহীন হাসি
খেলিছে আঁখির পাতে;
দেখিনু কপোল ঢাকিয়া তাহার
আলক প’ড়েছে ঝুলি,
আঁচলেতে গাঁঠ বাঁধি শতবার
শতবায় ফেলে খুলি;
কে জানে আমার ভাল না লাগিল
চোলে এনু ত্বরা কোরে,
কপট সরম দেখিলে সজনি
সরমেতে যাই মোরে!
মুরলা আমার, অমন করিয়া
কেন লো রহিলি বসি,
দেখিতে দেখিতে মলিন হইয়া
এসেছে ও মুখ-শশি!
ভাবিস্‌নে সখি, কমলা ক’য়েছে
কাল মোর কাছে এসে,
পাষাণ-হৃদয়া নলিনীও নাকি
ভালবাসে কবিরে সে।
শুনেছি নলিনী কবিরে দেখিতে
নদীতীরে যায় নাকি!

কবিরে দেখিলে ঢ’লে পড়ে তার
অনুরাগ-নত আঁখি!
মুরলা।—নলিনী-বালারে ভালবেসে যদি 
কবি মোর সুখে থাকে,
তাহা হ’লে, সখি, বল্ দেখি মোরে,
কেন না বাসিবে তাকে?
মোরা তাহা ল’য়ে ভাবি কেন এ?
চপলা লো আমরা কে?



চপলার গান।


যে ভাল বাসুক্—সে ভাল বাসুক্,
সজনি লো আমরা কে!
দীনহীন এই হৃদয় মোদের
কাছেও কি কেহ ডাকে?
তবে কেন বল ভেবে মরি মোরা
কে কাহারে ভাল বাসে,
আমাদের কি আসে যায় বল’
কেবা কাঁদে, কেবা হাসে!
আমাদের মন কেহই চাহে না,
তবে মন খানি লুকান’ থাক্,
প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্
যদি, সখি, কেহ ভূলে
মন খানি লয় তুলে,
উলটি পালটি দুদণ্ড ধরিয়া

পরখ করিয়া দেখিতে চায়,
তখনি ধুলিতে ছুঁড়িয়া ফেলিবে
নিদারুণ উপেখায়।
কাজ কি লো, মন লুকান’ থাক্,
প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্
হাসিয়া খেলিয়া ভাবনা ভুলিয়া
হরষে প্রমোদে মাতিয়া থাক্!