ভগ্নহৃদয়/নবম সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

নবম সর্গ।

নলিনী ও সখিগণ।

নলিনী।—(গাহিতে গাহিতে) 
কি হোল আমার? বুঝিবা সজনি
হৃদয় হারিয়েছি!
প্রভাত-কিরণে সকাল বেলাতে
মন লোয়ে সখি গেছিনু খেলাতে,
মন কুড়াইতে, মন ছড়াইতে,
মনের মাঝারে খেলি বেড়াইতে,
মন-ফুল দলি চলি বেড়াইতে,
সহসা সজনি, চেতনা পাইয়া
সহসা সজনি দেখনু চাহিয়া,
রাশি রাশি ভাঙ্গা হৃদয় মাঝারে
হৃদয় হারিয়েছি!
পথের মাঝেতে খেলাতে খেলাতে
হৃদয় হারিয়েছি!
যদি কেহ, সখি দলিয়া যায়!
তার পর দিয়া চলিয়া যায়!
শুকায়ে পড়িবে, ছিঁড়িয়া পড়িবে,

দলগুলি তার ঝরিয়া পড়িবে,
যদি কেহ সখি দলিয়া যায়!
আমার কুসুম-কোমল হৃদয়
কখনো সহেনি রবির কর,
আমার মনের কামিনী-পাপড়ি
সহেনি ভ্রমর চরণ-ভর!
চিরদিন সখি বাতাসে খেলিত,
জোছনা আলোকে নয়ন মেলিত,
হাসি পরিমলে অধর ভরিয়া,
লোহিত রেণুর সিঁদুর পরিয়া,
ভ্রমরে ডাকিত হাসিতে হাসিতে
কাছে এলে তারে দিতনা বসিতে,
সহসা আজ সে হৃদয় আমার
কোথায় হারিয়েছি!
এখনো যদি গো খুঁজিয়া পাই
এখনো তাহারে কুড়ায়ে আনি।
এখনো তাহারে দলে নাই কেহ,
আমার সাধের কুসুম খানি;
এখনো, সজনি, একটি পাপড়ি
ঝরেনি তাহার, জানিলো জানি।
শুধু হারায়েছে,—খুঁজিয়া পাইলে
এখনি তাহারে কুড়ায়ে আনি।
ত্বরা কর্ তবে, ত্বরা কর্ তোরা,
হৃদয় খুঁজিতে যাই;

ওড়াবার আগে—ছিঁড়িবার আগে
হৃদয় আমার চাই!



(সখীদের প্রতি) বিপাশা-তীরের পথে সখি আয় 
আয় ত্বরা কোরে আয়!
জানিস্ কি সখি, নদীতীরে কবি
কখন বেড়াতে যায়?
জানিস্‌ত সখি, পথের ধারেতে
একটি অশোক আছে,
বনলতা কত ফুলে ফুলে ভরা
উঠিয়াছে সেই গাছে—
সেই খানে সখি—সেই গাছ তলে
বসিয়া থাকিতে হবে;
সেই পথ দিয়া যাইবে ত কবি?
আয় ত্বরা কোরে তবে।
বল্ দিকি তোরা, হোল কি আমার?
যখন কবির সুমুখে থাকি—
একটি কথাও পারিনে বলিতে
পারিনে তুলিতে আনত আঁখি!
কতবার, সখি, করিয়াছি মনে
পরিহাস করি কহিব কথা—
নিদারুণ হাসি হাসিয়া হাসিয়া
হৃদয়ে তাহারে দিব গো ব্যথা;—
কৃষ্ণ-হীরা সম কৃষ্ণ আঁখি-তারা

আঁধার আগার হোতে আলো—ধারা
হানিবে হেথায়, হানিবে হোথায়
আকুলিয়া দশ দিশ;
মূরছিয়া তার পড়িবেক মন,
মুদিয়া আসিবে অবশ নয়ন,
যতই ঢালিব এ অধর হোতে
মিষ্ট সুধাময় বিষ!
কিন্তু কি কোরে সে চেয়ে থাকে, সখি,
না জানি নয়নে কি আছে জ্যোতি!
এমন সে গান গায় ধীরে ধীরে,
কথা কয় সখি মৃদুল অতি;
মুখেতে আমার কথা নাহি ফুটে,
চাহিতে পারিনে আঁখির পানে,
হাসির লহরী খেলেনা অধরে
নয়নে তড়িৎ নাহিক হানে!
আয় ত্বরা কোরে—বেলা হোয়ে এল
অস্তাচলে যায় রবি,
পথের ধারেতে বসি রব’ মোরা
সেই পথে যাবে কবি!