ভগ্নহৃদয়/পঞ্চবিংশ সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চবিংশ সর্গ।

মুরলা।

ওই ধীরে সন্ধ্যা হয় হয়!
গ্রামের কানন হ’ল অন্ধকার ময়!
যতই ঘনায়ে আসে সন্ধ্যার আঁধার—
কাঁদিয়া ওঠে গো কেন হৃদয় আমার?
দুঃখ যেন অতিশয় ধীরে ধীরে আসে
পা টিপিয়া পা টিপিয়া বসে মোর পাশে!
মরমেতে আঁখি রাখে, এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে,
কি মন্ত্র পড়িতে থাকে বুকের উপরে!
কেন গো এমন হয় প্রাণের ভিতরে?
সন্ধ্যাদীপ ঘরে ঘরে উঠিল জ্বলিয়া—
বাহিরে যেদিকে চাই—কিছু না দেখিতে পাই—
আঁধার বিশাল-কায়া আছে ঘুমাইয়া!
ভিতরে কুঁড়ের বুকে নিভৃতে মনের সুখে
ছোট ছোট আলো গুলি রয়েছে জাগিয়া!
আমার আলয় নাই—ভাই নাই, বন্ধু নাই,
কেহ নাই এক তিল করিবারে স্নেহ,—
দিবস ফুরায়ে এলে মোর তরে কেহ
জ্বালায়ে রাখেনা কভু প্রদীপটি ঘরে—

পথ পানে চেয়ে কেহ নাই মোর তরে!
দিবসের শ্রমে ক্লান্ত—সন্ধ্যা যবে হয়
কোথায় যে যাব—নাই স্নেহের আলয়।
বিরাম বিশ্রাম নাই—আদর যতন নাই—
পথ প্রান্তে ধূলি পরে করিগো শয়ন,
চেয়ে দেখিবার লোক নাই এক জন।
অন্ধকার শাখা মেলি শুধু বৃক্ষ যত
কি কোরে যে চেয়ে থাকে অবাকের মত!
তারকার স্নেহ-শূন্য লক্ষ লক্ষ আঁখি
এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে দূরাকাশে থাকি।
স্নেহের অভাব মনে জেগে উঠে কেন?
আশ্রয়ের তরে মন হুহু করে যেন!
এত লক্ষ লক্ষ আছে সুখের কুটীর
একটিও নহে ওর এই অভাগীর!
সারাদিন নিরাশ্রয় ঘুরিয়া বেড়াই
সন্ধ্যায় যে কোথা যাব তারো নাই ঠাঁই!
কত শত দিন হল ছেড়েছি আলয়—
আজো কেন ফিরে যেতে তবু সাধ হয়?
ঘুরে ঘুরে পথ-শ্রান্ত নাই দিগ্বিদিক—
আকাশ মাথার পরে চেয়ে অনিমিখ!
লক্ষ্য নাই—আশা নাই—কিছু নাই চিতে
এমন ক’দিন এ ও পারব থাকিতে?

আহা সে মোর থাকিত সে কাছে।

হয়ত তাহার মনে ব্যথা লাগিয়াছে!
আমি কোথা হতে এক আসিয়া আঁধার
মলিন করিয়া দিনু হৃদয় তাহার।
সদাই সে থাকে আহা প্রমোদের ভরে
মুহূর্ত্ত সে মোর তবে কাঁদিবে কেনরে?
এতক্ষণে কবি মোর এসেছে ভবনে
কে র’য়েছে তাঁর তরে বসি বাতায়নে?
পদশব্দ শুনি তাঁর ত্বরায় অমনি
দিতেছে দুয়ার খুলি কেগো সে রমণী!
প্রতিদিন মালা গেঁথে দিতাম যেমন
আজো কি তেমন কেহ করে গো রচন?
হয়ত আলয় তাঁর রয়েছে আঁধার
হয়ত কেহই নাই বাতায়নে তার।
হয়ত গো কবি মোর ম্রিয়মান মন
কেহ নাই যার সাথে কথাটি ও কন!
হয়ত গো মুরলার তরে মাঝে মাঝে
করুণ হৃদয়ে তাঁর ব্যথা বড় বাজে!
হা নিষ্ঠুর মুরলারে—কেন ছেড়ে এলি তাঁরে
নিতান্ত একেলা ফেলি কবিরে আমার,
হয়ত রে তোর তরে প্রাণ কাঁদে তাঁর!
বড় স্বার্থপর তুই, নয় দুঃখে তোর
কঁদিয়া কাটিয়া হোত এ জীবন ভোর,
তাই কি ফেলিয়া আসে কবিরে একেলা!
ফিরে চল্ মুরলারে, চল্ এই বেলা।

হা অভাগী, সন্ন্যাসিনী, আবার, আবার?
কোথা কবি? কোন্ কবি? কেগো সে তোমার।
মাঝে মাঝে দেখিস্‌রে একি স্বপ্ন মিছে!
স্বপনের অশ্রুজল ত্বরা ফেল্ মুছে!
জীবনের স্বপ্ন তোর ভাঙ্গিবে ত্বরায়—
জীবনের দিন তোর ফুরায় ফুরায়!
ওই দেখ্ মৃত্যু তোর সমুখে বসিয়া
কঙ্কালের ক্রোড় তার আছে প্রসারিয়া!
সম্বন্ধ হোয়েছে তোর মরণের সাথে,—
দেরে তোর হাত তার অস্থিময় হাতে!
এ সংসারে কেহ যদি তোরে ভালবাসে
সে কেবল ওই মৃত্যু—ওইরে আকাশে!
গুরুভার রক্তহীন হিম-হস্তে তার
আলিঙ্গন কোরেছে সে হৃদয় তোমার!
হে মরণ! প্রিয়তম—স্বামীগো—জীবন মম,
কবে আমাদের সেই সম্মিলন হবে?
জীবনের মৃত্যু শয্যা তেয়াগিব কবে?