ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা/ভারতীয় ঐক্য সাধন সমস্যা

উইকিসংকলন থেকে

ভারতীয় ঐক্যসাধন সমস্যা

 পাশ্চাত্য সমালোচকগণ বলিয়া থাকেন, ভারতীয় মনীষা যদিও বা দার্শনিকতা, ধর্ম্ম, আর্ট ও সাহিত্যে বিশিষ্ট শক্তির পরিচয় দিয়া থাকে, উহা জীবনসংগঠন ব্যাপারে অপটু ছিল, ব্যবহারিক বুদ্ধির প্রয়োগে ন্যুন ছিল, উহার ইতিহাসে সুনিপুণ রাষ্ট্রনীতিক গঠন, গবেষণা ও কর্ম্মের স্থান শূন্য; কিন্তু প্রকৃত তথ্যসকল অবগত হইলে এবং ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ ও নীতি যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করিলে এইরূপ অভিযোগ একেবারেই দাঁড়াইতে পারে না। বরঞ্চ প্রকৃত সত্য এই যে, ভারতীয় সভ্যতা যে-চমৎকার রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ করিয়াছিল তাহার ছিল নিরেট গঠন ও স্থায়ী উৎকর্ষতা, রাষ্ট্রগঠন প্রচেষ্টায় মানুষের বুদ্ধি রাজতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র ও অন্যান্য যে-সব আদর্শ ও নীতির দিকে আকৃষ্ট হইয়াছে, ভারতীয় সভ্যতা অপূর্ব্ব কৌশলের সহিত সে-সবের সমন্বয় সাধন করিয়াছিল, অথচ বর্ত্তমান য়ুরোপীয় রাষ্ট্রের যে দোষ, সকল জিনিষকে যন্ত্রবৎ করিয়া তোলার দিকে অত্যধিক প্রবণতা, তাহা এড়াইতে সক্ষম হইয়াছিল। ক্রমবিকাশ ও প্রগতির পাশ্চত্য আদর্শ অনুসারে বিচার করিলে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে-সব আপত্তি তোলা যাইতে পারে, পরে আমি সে-সমুদয় আলোচনা করিব।

 কিন্তু রাষ্ট্রনীতির আর একটা দিক আছে যাহাতে একথা বলা যাইতে পারে যে, ভারতের রাষ্ট্রনীতিক মনীষা অকৃতকার্য্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখাইতে সমর্থ হয় নাই। উহা যে-ব্যবস্থার বিকাশ করিয়াছিল তাহা দৃঢ়তায় ও শাসনবিষয়ক কার্য্যপটুতায় এবং প্রাচীন অবস্থানুযায়ী সমষ্টিজীবনের শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতা বিধানে এবং জনসাধারণের কল্যানবিধানে প্রশংসনীয় হইতে পারে, কিন্তু যদিই বা ভারতের অন্তর্গত বহু জনসমাজ প্রত্যেকে পৃথকভাবে স্বায়ত্ত্বশাসনশীল ছিল, সুশাসিত ও সমৃদ্ধিসম্পন্নছিল, এবং সমগ্র দেশে এক উচ্চবিকশিত সভ্যতা ও কৃষ্টি নিশ্চিতভাবে ক্রিয়া করিতে পারিত, তথাপি উক্ত ব্যবস্থা ভারতের জাতীয় ও রাষ্ট্রনীতিক ঐক্যসাধন করিতে কৃতকার্য্য হয় নাই, এবং শেষ পর্য্যন্ত বিদেশীর আক্রমণ হইতে দেশকে রক্ষা করিতে, জাতীয় অনুষ্ঠানগুলির ধ্বংস নিবারণ করিতে এবং বহুকালব্যাপী পরাধীনতা নিবারণ করিতে কৃতকার্য্য হয় নাই। কোন সমাজের রাষ্ট্রনীতিক ব্যবস্থার বিচার করিতে হইলে সর্ব্বপ্রথমেই অবশ্য দেখিতে হয় যে, উহা জাতিকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি, অভ্যন্তরীন স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলা দিতে কতখানি সমর্থ হইয়াছে, কিন্তু আবার ইহাও দেখিতে হয় যে, অন্যান্য রাষ্ট্র হইতে নিরাপদ থাকিবার কিরূপ ব্যবস্থা সে করিয়াছে, বহিঃশত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণকে আক্রমণ করিতে এবং তাহাদের আক্রমণে আত্মরক্ষা করিতে প্রয়োজনীয় ঐক্য ও শক্তি কতদূর বিকাশ করিয়াছে। ইহা যে দেখিতে হয় সেটা হয় ত মানবসমাজের পক্ষে নিছক প্রশংসার কথা নহে, যে-জাতি বা দেশ এরূপ রাষ্ট্রনীতিক শক্তিতে হীন, তাহার বিজেতাদের অপেক্ষা কৃষ্টি ও সভ্যতাতে সে অনেক উন্নত হইতে পারে, এবং কৃতী সমরকুশল রাষ্ট্র, আক্রমণশীল জাতি, পরদেশশোষণকারী সাম্রাজ্য অপেক্ষা মানবজাতির প্রগতিতে অনেক বেশীই সাহায্য করিয়া থাকিতে পারে, প্রাচীন গ্রীক ও মধ্যযুগের ইতালীয়নেরা তাহার দৃষ্টান্ত। কিন্তু মানুষের জীবন এখনও প্রধানতঃ রহিয়াছে প্রাণশক্তির (vital) ক্ষেত্রে, এক্ষেত্রে আত্ম-বিস্তার, ভোগদখল, আক্রমণ, পরস্পরকে গ্রাস করিবার এবং অপরের উপর আধিপত্য করিবার জন্য দ্বন্দ, এই সবের প্রেরণাই সমধিক বলবান, কারণ এই সবই হইতেছে প্রাণশক্তির প্রাথমিক ধর্ম্ম; অতএব যে সমষ্টিগত মনীষা ও চৈতন্য আক্রমণ ও আত্মরক্ষায় সর্ব্বদা অসামর্থ্যের পরিচয় দেয়, এবং নিজের নিরাপদতার জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীভূত ও কার্য্যকরী ঐক্যের বিধান না করে, সে রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রথমশ্রেণীতে স্থান পাইবার যোগ্য নহে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ভারতের জাতীয় ও রাষ্ট্র নীতিক ঐক্য কখনই সাধিত হয় নাই। ভারত প্রায় এক সহস্র বৎসর ধরিয়া বাহির হইতে বর্ব্বর জাতিদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হইয়াছে, এবং প্রায় আর এক সহস্র বৎসর ক্রমান্বয়ে নানা বিদেশী শাসকের পদানত রহিয়াছে। অতএব বলিতেই হয় যে, ভারতবাসী রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারে অক্ষম।

 এখানেও প্রয়োজন হইতেছে সর্ব্বাগ্রে অত্যুক্তিসকলের খণ্ডন করা, প্রকৃত তথ্য এবং তাহাদের মর্ম্ম সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা, এবং ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বস্তুতঃ যে সমস্যাটির সমাধান মিলে নাই তাহার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করা। আর প্রথমতঃ যদি একটা জাতি ও সভ্যতার মহত্ত্ব বিচার করিতে হইলে তাহার সামরিক আক্রমণশীলতার হিসাব লইতে হয়, দেখিতে হয় কি পরিমাণে সে অপরের দেশ জয় করিয়া লইয়াছে, অপর জাতির সহিত সংগ্রামে কতদূর কৃতকার্য্য হইয়াছে, তাহার সুব্যবস্থিত পরস্বাপহরণ প্রবৃত্তি কতখানি জয়লাভ করিয়াছে, তাহার পরের দেশ শাসন ও শোষণ করিবার প্রেরণা কেমন অদম্য, তাহা হইলে অবশ্য স্বীকার করিতেই হইবে যে, জগতের মহাজাতিসকলের তালিকায় ভারতের স্থান বোধ হয় সর্ব্বনিম্নে। ভারত যে কখনও পরের দেশ আক্রমণ এবং নিজের সীমানার বাহিরে রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা করিয়াছে তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না জগতের উপর আধিপত্য স্থাপনের কোনও মহাকাব্য বা সুদূর দিগ্বিজয় ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের কোনও মহান কাহিনী ভারতের কৃতিত্ব বর্ণনা করিতে রচিত হয় নাই। ভারত আত্মবিস্তার, দিগ্বিজয়, আক্রমণের যে একমাত্র মহৎ প্রয়াস করিয়াছে তাহা হইতেছে তাহার শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার, বৌদ্ধধর্ম্মকর্ত্তৃক প্রাচ্য জগত আক্রমণ ও অধিকার, এবং তাহার আধ্যাত্মিকতা, আর্ট এবং চিন্তাশক্তির সঞ্চারণ। আর এই যে আক্রমণ, ইহাও ছিল শান্তিময়, ইহাতে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল না। কারণ বলপ্রয়োগ ও দেশজয়ের দ্বারা অধ্যাত্ম সভ্যতা বিস্তারের যে নীতি আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে গর্ব্ব করিবার বিষয় বা অজুহাত স্বরূপ তাহা ভারতের প্রচীন মনোভাব ও মতি গতির এবং তাহার ধর্ম্মের মূল আদর্শের বিরোধী ছিল। সত্য বটে পর্য্যায়ক্রমে কতকগুলি ঔপনিবেশিক অভিযান ভারতের রক্ত এবং ভারতের শিক্ষাদীক্ষাকে দ্বীপপুঞ্জে বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল, কিন্তু যে সকল জাহাজ ভারতের পূর্ব্ব ও পশ্চিম উপকূল হইতে যাত্রা করিয়াছিল সে-গুলি নিকটবর্ত্তী দেশসমূহকে জয় করিয়া ভারতসাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রেরিত রণতরী ছিল না, সেগুলিতে ভারত হইতে নির্ব্বাসিত ব্যক্তিগণ অথবা সাহসিক ভাগ্যান্বেষণকারিগণ ভারতের ধর্ম্ম, স্থাপত্য, শিল্প, কাব্য, চিন্তা, জীবনধারা, আচারব্যবহার সঙ্গে করিয়া লইয়া এমন সব দেশে গিয়াছিল যেখানে তখনও সভ্যতার আলোক পৌঁছায় নাই। সাম্রাজ্য স্থাপনের, এমনকি জগৎব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা যে ভারতবাসীর মনে স্থান পায় নাই তাহা নহে, কিন্তু তাহাদের কাছে ভারতই ছিল জগৎ এবং তাহাদের সাম্রাজ্যচেষ্টার লক্ষ্য ছিল ভারতের অন্তর্গত জাতিসমূহের মহান্ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

 এই আদর্শ, এই প্রয়োজনের অনুভূতি, ইহাকে কার্য্যে পরিণত করিবার নিয়ত প্রেরণা ভারতের ইতিহাসে বরাবর দেখিতে পাওয়া যায়—বৈদিক যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত যুগে, গুপ্ত ও মৌর্য্য সম্রাটগণের চেষ্টায়, মোগল ঐক্য সাধনে এবং শেষে পেশোয়াদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়,—যতক্ষন না শেষ পর্য্যন্ত সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছে, এবং সকল বিবদমান শক্তি এক বিদেশী শাসনের অধীনতায় সমতা লাভ করিয়াছে, স্বাধীন জাতির স্বাধীন ঐক্যের পরিবর্ত্তে পরাধীনতার সাম্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এখন প্রশ্ন হইতেছে, ঐক্যসাধনের এই যে মন্থর গতি, দুষ্করতা, অবস্থাবিপর্য্যয়, এবং সুদীর্ঘ প্রয়াসের শেষ পর্য্যন্ত ব্যর্থতায় পরিসমাপ্তি, ইহার কারণ কি ভারতীয় সভ্যতার, ভারতবাসীর রাষ্ট্রীয় চেতনা ও সামর্থ্যের, কোনও মূলগত অক্ষমতা, না, ইহার অন্য কোন কারণ আছে? ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হইতে অক্ষম, তাহাদের মধ্যে এক দেশপ্রেমের অভাব, তাহা কেবল বর্ত্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবেই সৃষ্ট হইতেছে, ধর্ম্ম ও জাতিভেদে তাহারা বহুধা বিভক্ত, এই সব লইয়া অনেকেই অনেক কথা বলিয়াছেন ও লিখিয়াছেন। এই সব সমালোচনার গুরুত্ব যদি সম্পূর্ণ ভাবেই স্বীকার করিয়া লওয়া যায়—এ গুলি সবই একেবারে সত্য নহে, বা ঠিক ভাবে কথিত হয় না, বা এ বিষয়ে যথার্থ প্রাসঙ্গিক নহে—তথাপি এ সব হইতেছে উপসর্গ মাত্র, ইহাদের গভীরতর কারণের সন্ধান আমাদিগকে করিতেই হইবে।

 এইরূপ সমালোচনার সাধারণতঃ যে উত্তর দেওয়া হয় তাহা এই যে, ভারত একটা মহাদেশ বলিলেই হয়, বহু সংখ্যক জণসমাজকে লইয়া ইহা আয়তনে প্রায় য়ুরোপেরই সমান, য়ুরোপের ঐক্যসাধনে যে সব বাধা এখানকার বাধাও তেমনিই গুরুতর। য়ুরোপের ঐক্যসাধন এখনও কেবল আদর্শের স্তরে নিষ্ফল কল্পনামাত্র হইয়া রহিয়াছে, আজও তাহা কার্য্যতঃ সিদ্ধ করা সম্ভব হয় নাই, ইহা যদি পাশ্চাত্য সভ্যতার অযোগ্যতার অথবা য়ুরোপীয়গণের রাষ্ট্রনীতিক অক্ষমতার পরিচায়ক না হয়, তাহা হইলে ভারতের ইতিহাসে যে দেখিতে পাওয়া যায় ভারতবাসী ঐক্যের আদর্শটিকে অনেক বেশী স্পষ্টতার সহিত গ্রহণ করিয়াছে, উহাকে কার্য্যে পরিণত করিতে অবিরত চেষ্টা করিয়াছে, এবং পুনঃ পুনঃ সফলতার নিকটবর্ত্তী হইয়াছে, ইহাকে অন্য মানদণ্ড লইয়া বিচার কর ঠিক হয় না। এরূপ যুক্তিতে কিছু জোর আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ সঙ্গত নহে, কারণ সাদৃশ্যটি মোটেই পূর্ণ নয়, এবং আনুষঙ্গিক অবস্থানিচয়ও ঠিক এক রকমের নহে। য়ুরোপের জাতিসকল তাহাদের সমষ্টিগত সত্তায় পরস্পর হইতে অতি সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত, এবং খৃষ্টধর্ম্মে তাহাদের যে আধ্যাত্মিক ঐক্য, এমন কি এক সাধারণ য়ুরোপীয় সভ্যতায় তাহাদের যে কৃষ্টিগত ঐক্য, তাহা ভারতের প্রাচীন আধ্যাত্মিক ও কুষ্টিগত ঐক্যের ন্যায় কখনই এত বাস্তব ও সম্পূর্ণ ছিল না, আর তাহা তাহাদের জীবনের একেবারে কেন্দ্রস্বরূপ ছিল না, ইহার ভিত্তি বা সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠানভূমি ছিল না, তাহা ছিল কেবল একটা সাধারণ আব্‌হাওয়া বা পারিপার্শ্বিক বেষ্টনীর মত। তাহাদের জীবনের ভিত্তি নিহিত ছিল রাষ্ট্রনীতিক ও অর্থনীতিক সংস্থানে, এবং ইহা প্রত্যেক দেশে বিশিষ্টভাবে পৃথক ছিল; আর পাশ্চাত্য মনে রাষ্ট্রনীতিক চেতনার যে প্রাবল্য তাহাই য়ুরোপকে বহু প্রতিদ্বন্দী ও সর্ব্বদা পরস্পরের সহিত কলহে নিরত জাতিতে বিভক্ত করিয়া রাখিয়াছে। রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারে ঐক্যবৃদ্ধি, এবং বর্ত্তমানে অর্থনীতিক ব্যাপারে পরস্পরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা, কেবল ইহাই শেষ পর্য্যন্ত যাহা সৃষ্টি করিয়াছে তাহা ঐক্য নহে, একটি League of Nations বা জাতিসঙ্ঘ, তাহাও এই সবেমাত্র গড়িয়া উঠিতেছে, এখনও বিশেষ কোন কাজের হয় নাই, তাহা যুগযুগান্তের দ্বন্দের ফলে যে মনোভাব সৃষ্ট হইয়াছে সেইটিকে য়ুরোপীয় জাতিসকলের সাধারণ স্বার্থে নিয়োজিত করিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু ভারতে অতি প্রাচীনকালেই আধ্যাত্মিকতা ও কৃষ্টিমূলক ঐক্য পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এবং তাহাই হইয়াছিল হিমালয় ও দুই সাগরের অন্তর্বর্ত্তী এই বিরাট জনসমূহের জীবনের মূল উপাদানস্বরূপ। প্রাচীন ভারতের লোকসকল কখনই রাষ্ট্রনীতিক ও অর্থনীতিক জীবনে পরস্পর হইতে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত পৃথক পৃথক জাতি ততটা ছিল না যতটা তাহারা ছিল এক মহান্ আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিসম্পন্ন জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন উপজাতি; সেই মহাজাতিটি ভৌগলিক সংস্থানে সমুদ্র ও পর্ব্বতমালার দ্বারা অন্যান্য দেশ হইতে যেমন সুদৃঢ়ভাবে পৃথক ছিল, তেমনিই তাহার বিশিষ্ট ধর্ম্ম ও কৃষ্টির দ্বারা অন্যান্য জাতি হইতেও পৃথক ছিল। অতএব দশটি যতই বিশাল হউক এবং কার্য্যতঃ যতই বাধা থাকুক তাহার রাষ্ট্রনীতিক ঐক্য য়ুরোপের ঐক্য অপেক্ষা সহজেই সম্পাদিত হওয়া উচিত ছিল। কেন তাহা হয় নাই সে কারণ অনুসন্ধান করিতে হইলে আমাদিগকে আরও গভীরে যাইতে হইবে; তাহা হইলে আমরা দেখিতে পাইব যে, সমস্যার সমাধানটিকে যে ভাবে অবধারণ করা হইয়াছিল বা করা উচিত ছিল বাস্তব চেষ্টা সে পথে চালিত হয় নাই এবং তাহা ভারতবাসীর বিশিষ্ট মনোভাবের বিরুদ্ধ হইয়াছিল।

 ভারতীয় মনের সমগ্র ভিত্তিটি হইতেছে উহার আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্ম্মুখীনতার দিকে ঝোঁক, সকলের আগে এবং প্রধানতঃ আত্মা ও অন্তরের জিনিষের সন্ধান করা এবং আর সব কিছুকেই গৌণ বলিয়া, নিম্নতন জিনিষ বলিয়া দেখিবার প্রবৃত্তি; এই সবকে মহত্তর জ্ঞানের আলোকে নির্ণয় করিতে হইবে, ব্যবহার করিতে হইবে, এই সব হইতেছে গভীরতর অধ্যাত্ম লক্ষ্যের একটা অভিব্যক্তি মাত্র, একটা প্রাথমিক ক্ষেত্র বা সহায়, অন্ততঃ একটা আনুষঙ্গিক কিছু। অতএব ভারতীয় মনের গতি হইতেছে—যাহা কিছু সৃষ্টি করিতে হইবে প্রথমে সেটিকে অন্তরের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা, এবং পরে তাহার অন্যান্যদিকের বিকাশ করা। এই মনোভাব এবং ইহার ফলস্বরূপ ভিতর হইতে আরম্ভ করিয়া বাহিরের দিকে সৃষ্টি করিবার প্রবৃত্তি থাকার দরুণ, ইহা অবশ্যম্ভাবীই ছিল যে, ভারত নিজের যে ঐক্য প্রথমে সৃষ্টি করিবে তাহা হইবে আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্য। রোমে অথবা প্রাচীন পারস্যদেশে বিজয়ী রাজ্য বা সমরতান্ত্রিক সংগঠনশীল জাতির প্রতিভাকর্ত্তৃক কেন্দ্রানুগত বাহ্যিক শাসনের দ্বারা যে রাষ্ট্রনীতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ভারতে প্রারম্ভেই সেরূপ ঐক্যসাধন সম্ভব হয় নাই। আমার মনে হয় না যে, এটা ভুল হইয়াছিল, এটা ভারতবাসীর ব্যবহারিক বুদ্ধির অভাবের প্রমাণ, বা এক রাষ্ট্র প্রথমেই গঠন করা উচিত ছিল, পরে এক স্বাধীন ভারতীয় সাম্রাজ্যের সুবিশাল শরীরের মধ্যে আধ্যাত্মিক ঐক্য নিশ্চিতভাবে বিকাশলাভ করিতে পারিত। প্রারম্ভেই যে-সমস্যাটি উঠিয়াছিল সেটি হইতেছে শতাধিক রাজ্য, কুল, জাতি (races), গোষ্ঠীর আবাস ভূমি এক অতি বিরাট দেশের সমস্যা, এ-বিষয়ে আর একটি গ্রীসেরই ন্যায়, কিন্তু বিশালভাবে বিস্তৃত গ্রীস্, আকারে প্রায় আধুনিক য়ুরোপেরই ন্যায় বৃহৎ। গ্রীসে যেমন মূলগত ঐক্যবোধের সৃষ্টি করিতে হেলেনিক্ (hellenic) কৃষ্টির ঐক্য প্রয়োজন হইয়াছিল, এখানেও এবং আরও অলঙ্ঘনীয়রূপে এই সকল লোকের মধ্যে একটা সচেতন আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্য প্রথম ও অপরিহার্য্য প্রয়োজন ছিল, ইহা ব্যতীত কোনও স্থায়ী ঐক্য সম্ভবপর ছিল না। এ বিষয়ে ভারতীয় মনীষার, এবং ভারতের শিক্ষাদীক্ষার প্রতিষ্ঠাতা মহানুভব ঋষিগণের সহজোপলব্ধিতে কোন ভুলই হয় নাই। আর যদিই ধরিয়া লওয়া যায় যে, প্রাচীন ভারতের লোকসকলের মধ্যে রোম্যান জগতের ন্যায় সামরিক ও রাষ্ট্রনীতিক উপায়ের দ্বারা একটা বাহ্য সাম্রাজিক ঐক্য স্থাপন করা যাইত, তাহা হইলেও আমাদের মনে রাখা কর্ত্তব্য যে, ঐ রোম্যান্ ঐক্যও স্থায়ী হয় নাই, এমন কি রোমের জয় ও সংগঠনের দ্বারা প্রাচীন ইতালীর যে ঐক্য সম্পাদিত হইয়াছিল তাহাও স্থায়ী হয় নাই; ভারতের বিশাল পরিধির মধ্যে পূর্ব্বেই আধ্যাত্মিকতা ও কৃষ্টির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা না করিয়া ঐরূপ ঐক্যসাধনের চেষ্টা করিলে তাহাও স্থায়ী হইত বলিয়া মনে হয় না। আর যদিই বা আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্যের দিকে একান্ত বা অত্যধিক ঝোঁক দেওয়া হইয়া থাকে, এবং রাষ্ট্রনীতিক ও বাহ্য ঐক্যের চেষ্টা যৎসামান্যই হইয়া থাকে, তাহা হইলেও বলা চলে না যে, ইহার ফল কেবলই অনর্থকর হইয়াছিল বা ইহাতে কোনও সুবিধা হয় নাই। এই যে-মূল বৈশিষ্ট্য, এই অমোচনীয় আধ্যাত্মিকতার ছাপ, সকল ভেদবিভাগের মধ্যে এই অন্তর্নিহিত ঐক্য, ইহারই ফলে ভারত যদিও এ-পর্য্যন্ত এক সঙ্ঘবদ্ধ রাষ্ট্রনীতিক জাতিতে পরিণত হইতে পারে নাই, তথাপি টিকিয়া আছে এবং আজও ভারতই রহিয়াছে।

 বস্তুতঃ কেবল আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্যই স্থায়ী ঐক্য। একটা জাতি টিকিয়া থাকে বেশীর ভাগ তাহার স্থিতিশীল মন ও আত্মার জন্য, তাহার স্থায়ী স্থূল শরীর ও বাহ্যিক সংগঠনের জন্য নহে। এই সত্যটি পাশ্চাত্যের বহির্মুখী মন বুঝিতে বা স্বীকার করিতে অনিচ্ছুক হইতে পারে, কিন্তু যুগযুগান্তের ইতিহাসে ইহার প্রমাণ লিখিত রহিয়াছে। ভারতের সমসাময়িক প্রাচীন জাতি সকল এবং তাহার পরে উদ্ভূত তাহা অপেক্ষা তরুণ অনেক জাতি লয়প্রাপ্ত হইয়াছে, কেবল তাহাদের স্মৃতিচিহ্নগুলি পড়িয়া আছে। গ্রীস্ ও মিশর রহিয়াছে কেবল নামে ও মানচিত্রে, কারণ হেলাসের আত্মা (the soul of Hellas) অথবা যে জাতীয় আত্মা মেম্‌ফিস্ (Memphis) নির্ম্মাণ করিয়াছিল তাহা আর আমরা এখন এথেন্স্ বা কাইরোতে দেখিতে পাইনা। রোম ভূমধ্যসাগরের তীরবর্ত্তী জাতিসকলের উপরে একটা রাষ্ট্রনীতিক এবং একটা শুধু বাহ্য কৃষ্টিমূলক ঐক্য চাপাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু তাহাদের জীবন্ত আধ্যাত্মিক, ও কৃষ্টিমূলক ঐক্য সৃষ্টি করিতে সক্ষম হয় নাই। সেই জন্য পূর্ব্ব পশ্চিম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল, আফ্রিকা সাময়িক রোমান অধিকারের চিহ্ন পর্য্যন্ত লুপ্ত করিয়া দিল। এমন কি পশ্চিমের জাতিসকল, যাহাদিগকে এখনও লাতিন (Latin) জাতি বলা হয়, তাহারাও বর্ব্বরদের আক্রমণে জীবন্তভাবে বাধা দিতে পারে নাই, বিজাতীয় জীবনীশক্তির সংমিশ্রণে নবজন্ম লাভ করিয়া তবেই তাহারা আধুনিক ইতালী, স্পেন ও ফ্রান্স হইতে পারিয়াছে। কিন্তু ভারত আজিও বাঁচিয়া আছে, এবং অভ্যন্তরীন মন, প্রাণ, আত্মায় যুগযুগান্তের ভারতের সহিত যোগসূত্র বজায় রাখিয়াছে। বিদেশীর আক্রমণ ও শাসন, গ্রীক্, পার্থিয়ান, হুণ, ইস্‌লামের দুর্দ্ধর্ষ তেজ, ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ তন্ত্রের সর্ব্বপেষণকারী ষ্টীম্-রোলার সদৃশ গুরুভার, পাশ্চাত্যের ভীষণ চাপ, কিছুই বৈদিক ঋষিগণ কর্ত্তৃক সৃষ্ট ভারতের দেহ হইতে তাহার প্রাচীন আত্মাকে বহিষ্কৃত করিতে বা ধ্বংস করিতে সক্ষম হয় নাই। প্রতি পদে, প্রত্যেক বিপদ, আক্রমণ ও পরাধীনতার মধ্যে সে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের দ্বারা আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। তাহার গৌরবের যুগে সে ইহা করিতে সমর্থ হইয়াছিল তাহার আধ্যাত্মিক সংহতির বলে এবং সাঙ্গীকরণ ও প্রতিক্রিয়া করিবার শক্তির বলে, যাহা গ্রহণসাধ্য নহে সে সমুদয়কে দূর করিয়া দিয়াছে, যাহা দূর করা যায় না সে সমুদকে অঙ্গীভূত করিয়া লইয়াছে, এমন কি যখন তাহার অধঃপতন আরম্ভ হইয়াছে তাহার পরেও ঐ শক্তির বলেই সে বাঁচিয়া থাকিতে সমর্থ হইয়াছে, নিস্তেজ হইলেও অবধ্য থাকিয়া গিয়াছে, পিছু হটিয়া দক্ষিণদেশে কিছুকাল তাহার প্রাচীন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বজায় রাখিয়াছে। ইস্‌লামের আক্রমণ হইতে তাহার প্রাচীন আত্মা ও আদর্শকে রক্ষা করিতে রাজপুত, শিখ ও মারাঠার অভ্যুত্থান করিয়াছে, যেখানে সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করিতে পারে নাই যেখানে নিষ্ক্রিয়ভাবেই আত্মরক্ষা করিয়াছে, যে সাম্রাজ্য তাহার সমস্যার সমাধান করিতে পারে নাই বা তাহার সহিত সন্ধি করিতে পারে নাই তাহাকেই সে ধ্বংসের মুখে পাঠাইয়াছে, এবং সর্ব্বদা নিজের পুনরভ্যুত্থানের সুদিন অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে। আর এখনও এইরূপই একটি ব্যাপার আমাদের চক্ষের সম্মুখে ঘটিতেছে দেখিতে পাইতেছি। তাহা হইলে যে সভ্যতা এই অসাধ্য সাধন করিতে সমর্থ হইয়াছে তাহার অসাধারণ জীবনী শক্তি সম্বন্ধে, এবং যাঁহারা ইহার ভিত্তি কোন বাহ্য জিনিষের উপর স্থাপন না করিয়া আত্মা ও অভ্যন্তরীণ মনের উপর স্থাপন করিয়াছিলেন এবং আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্যকে তাহার ক্ষণভঙ্গুর শোভামাত্র না করিয়া তাহার জীবণের মূল ও সারবস্তু করিয়া দিয়াছিলেন, ধ্বংসশীল ঊর্দ্ধস্তরমাত্র না করিয়া চিরস্থায়ী ভিত্তি করিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহাদের দূরদৃষ্টি ও জ্ঞান সম্বন্ধে আর বলিবার কি আছে?

 কিন্তু আধ্যাত্মিক ঐক্য, ব্যাপক ও নমনীয় জিনিষ, রাষ্ট্রনীতিক ও বাহ্যিক ঐক্যের ন্যায় ইহা কেন্দ্রীকরণ ও সমরূপতার উপর নির্ভর করে না, বরঞ্চ ইহা সর্ব্ব অঙ্গে ব্যাপ্ত হইয়া থাকে, এবং জীবনের বহু বৈচিত্র্য ও স্বাধীনতার অবাধ অবসর দেয়। প্রাচীন ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করিবার সমস্যা কেন এত কঠিন ছিল, এইখানেই আমরা সেই গূঢ় কারণের আভাস পাই। সাধারণতঃ যেভাবে ইহা সম্পন্ন করা হয়, এক কেন্দ্রানুগত সমাকার সাম্রাজিক ষ্টেটের দ্বারা সকল স্বচ্ছন্দ বৈচিত্র্য, স্থানীয় স্বাতন্ত্র্য, প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতা লুপ্ত করিয়া দেওয়া হয়, ভারতে তাহা সম্ভব হয় নাই, এবং যতবারই এইরূপ চেষ্টা করা হইয়াছে, ততবারই তাহা দীর্ঘকাল কৃতকার্য্যতার আভাস দিলেও শেষ পর্য্যন্ত ব্যর্থ হইয়াছে; এমন কি আমরা ইহাও বলিতে পারি যে, ভারতের ভাগ্যদেবতাগণ যে ঐরূপ চেষ্টাকে ব্যর্থ হইতে বাধ্য করিয়াছেন, যেন তাহার আভ্যন্তরীণ সত্তার বিনাশ না হয়, যেন সাময়িক নিরাপদতার ব্যবস্থা করিতে গিয়া তাহার আত্মা জীবনের গভীর উৎসগুলিকে নষ্ট করিয়া না ফেলে, এটা ঠিকই করা হইয়াছে। ভারতের পক্ষে প্রকৃত প্রয়োজন কি তাহা ভারতের প্রাচীন মনীষা সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধি করিয়াছিল; তাহার সাম্রাজ্যের আদর্শ ছিল এমন এক ঐক্যসাধক শাসনতন্ত্র যাহা স্থানীয় ও সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতা যেখানে যাহা আছে সব বজায় রাখিবে, কোন জীবন্ত স্বায়ত্ত্বশাসনমূলক অনুষ্ঠানকে বৃথা নষ্ট করিবে না, জীবনের সমন্বয় সাধন করিবে, যান্ত্রিক ঐক্য নহে। যে অবস্থাপরম্পরার মধ্যে এরূপ সমাধান নিশ্চিতভাবে বিকশিত হইতে পারিত, পরবর্ত্তীকালে সে সমুদয়ের অভাব হয়, এবং তাহার পরিবর্ত্তে শাসনমূলক একচ্ছত্র সাম্রাজ্যস্থাপনের প্রয়াস করা হয়। এক আসন্ন ও বাহ্য প্রয়োজন মিটাইতে এইরূপ চেষ্টা করা আবশ্যক হইয়াছিল, কিন্তু তাহার মহত্ত্ব ও চমৎকারিত্ব সত্ত্বেও তাহা সম্পূর্ণভাবে সফল হইতে পারে নাই। পারে নাই, কারণ উহা যে পথ ধরিয়াছিল ঘটনাক্রমে তাহা ভারতীয় আত্মার প্রকৃত গতির অনুযায়ী হয় নাই। আমরা দেখিয়াছি যে, ভারতীয় রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থার মূলগত নীতি ছিল কম্যুনাল বা সাম্প্রদায়িক স্ব-তন্ত্র অনুষ্ঠান সকলের সমন্বয় সাধন, গ্রামের স্বা-তন্ত্র্য, নগর ও রাজধানীর স্বাতন্ত্র্য, জাতির (caste) স্বাতন্ত্র্য, গিল্ড, গোষ্ঠী, কুল, ধর্ম্মসঙ্ঘ প্রভৃতির স্বাতন্ত্র্য, এই সবের সমন্বয় সাধন। ষ্টেট্ বা রাজতন্ত্র বা গণসঙ্ঘ ছিল এই সকল স্ব-তন্ত্র অনুষ্ঠানকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া রাখিবার এবং এক মুক্ত ও জীবন্ত রাষ্ট্রশরীরের মধ্যে লইয়া সকলকে সমঞ্জসীভূত করিবার যন্ত্র। সাম্রাজিক সমস্যা ছিল আবার এই সকল ষ্টেট্ জাতি, নেশন্‌কে তাহাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং এইভাবে এক বৃহত্তর মুক্ত ও জীবন্ত রাষ্ট্রশরীরের মধ্যে সকলের ঐক্য সাধন করা। এমন এক রাষ্ট্রসংগঠন আবিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল যাহা তাহার সকল অঙ্গের শান্তি ও ঐক্য রক্ষা করিবে, বাহ্য আক্রমণ হইতে নিরাপদতার সুব্যবস্থা করিবে, বা ভারতীয় সভ্যতা ও কৃষ্টির আত্মা ও শরীরের স্বচ্ছন্দ ক্রিয়া ও ক্রমবিকাশকে ঐক্যে ও বৈচিত্র্যে, অঙ্গীভূত সকল সাম্প্রদায়িক ও স্থানীয় অনুষ্ঠানের অপ্রতিহত ও কর্ম্মময় জীবনে, সম্পূর্ণতা প্রদান করিবে, ধর্ম্মকে বিরাট ও সমগ্র আয়তনে কার্য্য করিতে দিবে।

 ভারতের প্রাচীন মণীষা সমস্যাটিকে এই অর্থে ই বুঝিয়াছিল। পরবর্ত্তীকালের শাসনমূলক সাম্রাজ্য ইহাকে কেবল আংশিকভাবে গ্রহণ করে, কিন্তু তাহার ঝোঁক ছিল খুব ধীরে ধীরে এবং প্রায় অজ্ঞাতসারেই অধীনস্থ স্ব-তন্ত্র অনুষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করা না হউক, অন্ততঃ তাহাদের শক্তিকে ক্ষীণ ও দুর্ব্বল করিয়া দেওয়া,—সকল কেন্দ্রীকরণের চেষ্টাতেই এইরূপ ঝোঁক অবশ্যাম্ভাবী। ইহার পরিণাম হইয়াছিল এই যে, যখনই কেন্দ্রীর শক্তিটি দুর্ব্বল হইয়া পড়িত, তখনই ভারতের জাতীয় জীবনের মূলতঃ প্রয়োজনীয় প্রাদেশিক স্বা-তন্ত্র্যের চিরন্তণ নীতি পুনরায় মাথা তুলিয়া উঠিয়া কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যকে ক্ষুণ্ণ করিয়া দিত; কিন্তু তাহার দ্বারা যাহা হওয়া উচিত ছিল, সমগ্র জাতীর জীবনের গভীর সামঞ্জস্যসাধনে এবং অধিকতর মুক্ত অথচ ঐক্যবদ্ধ ক্রিয়ায় সহায় হওয়া, তাহা আর হইয়া উঠিত না। সাম্রাজিক রাজতন্ত্র স্বাধীন জাতীয় সভাগুলিরও শক্তি হ্রাস করিয়া দিয়াছিল, এবং তাহার ফলে মূল সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র অনুষ্ঠানগুলি এক ঐক্যবদ্ধ শক্তির অঙ্গ না হইয়া পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ভেদেরই সৃষ্টি করিয়াছিল। পল্লী সমাজ (Village Community) নিজের সজীব শক্তি কতকটা বজায় রাখিয়াছিল, কিন্তু ঊর্দ্ধতম কর্ত্তৃপক্ষের সহিত তাহার কোন জীবন্ত সম্বন্ধ ছিল না, এবং বৃহত্তর জাতীয়তা বোধ হারাইয়া যে-কোন দেশী বা বিদেশী শাসন তাহার নিজের স্ব-পর্য্যাপ্ত সঙ্কীর্ণ জীবনকে সম্মান করিত তাহাকেই স্বীকার করিয়া লইতে প্রস্তুত ছিল। ধর্ম্মসঙ্ঘগুলির মধ্যেও এই রূপ ভাব আসিয়া পড়িয়াছিল। জাতিভেদ কোনও প্রকৃত প্রয়োজন ব্যতীত অথবা দেশের আধ্যাত্মিক বা অর্থনীতিক প্রয়োজনের সহিত কোনও সম্বন্ধ ব্যতীত সংখ্যায় বাড়িয়া উঠিয়া কেবল অলঙ্ঘ্য আচারমূলক বিভাগে পরিণত হইল, এইভাবে সে-গুলি দেশের মধ্যে কেবল ভেদ বিরোধেরই সৃষ্টি করিল, পূর্ব্বের ন্যায় আর সমগ্র জাতীয় জীবনের সুসমঞ্জস ক্রিয়ার অঙ্গ স্বরূপ রহিল না। ইহা সত্য নহে যে, প্রাচীন ভারতে জাতিবিভাগ দেশের মিলিত জীবনের পরিপন্থী ছিল, কিম্বা পরবর্ত্তীকালেও তাহা সাক্ষাৎভাবে রাজনীতিক দ্বন্দ বা অনৈক্যের সৃষ্টি করিত (যদিও শেষকালে, চরম অধঃপতনের যুগে, বিশেষতঃ মহারাষ্ট্র সংগঠনের শেষভাগে এইরূপই ঘটিয়াছিল), কিন্তু বাস্তবিকই তাহা সমাজে ভেদবৈষম্য সৃষ্টি করিবার এবং মুক্ত ও জীবন্তভাবে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জীবনের পুনর্গঠনের পরিপন্থী অচলায়তন বিভাগ সৃষ্টি করিবার গৌণ শক্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

 ব্যবস্থাটির আনুসঙ্গিক দোষগুলি মুসলমান আক্রমণের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত বিশেষভাবে প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু সূত্রপাতরূপে সেগুলি পূর্ব্ব হইতেই বর্ত্তমান ছিল, এবং পাঠান ও মোগল সাম্রাজ্যের দ্বারা যে অবস্থানিচয়ের সৃষ্টি হয় তাহার মধ্যে সে-গুলি দ্রুত বৃদ্ধি পাইয়াছিল। এই-সব উত্তরকালীন সাম্রাজিক অনুষ্ঠান যতই জাঁকজমকপূর্ণ ও শক্তিশালী হউক তাহাদের স্বরূপ স্বৈরাচারমূলক (autocratic) ছিল বলিয়া তাহারা পূর্ব্ববর্ত্তী সাম্রাজ্য সকল অপেক্ষা আরও অধিক পরিমাণে কেন্দ্রানুবর্ত্তিতার দোষগুলি পাইয়াছিল, এবং কৃত্রিম ঐক্যসাধন ব্যবস্থার প্রতি ভারতের প্রাদেশিক জীবনের সেই একই বিরোধিতার ফলে সেগুলি পুনঃ পুনঃ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল, অথচ জাতির জীবনের সহিত তাহাদের কোনও সত্য, জীবন্ত যোগ না থাকায় তাহারা এমন সাধারণ দেশাত্মবোধের সৃষ্টি করিতে পারে নাই যাহা তাহাদিগকে বিদেশীর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে পারিত। অবশেষে আসিয়াছে এক যন্ত্রবৎ পাশ্চাত্য শাসন, তাহা অবশিষ্ট সাম্প্রদায়িক ও স্থানীয় স্ব-তন্ত্র অনুষ্ঠানগুলিকে বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছে এবং তৎপরিবর্ত্তে যন্ত্রবৎ প্রাণহীন ঐক্য স্থাপন করিয়াছে। কিন্তু আবার ইহারও বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখিতে পাইতেছি সেই প্রাচীন নীতিসকল পুনরায় জাগিয়া উঠিতেছে,—ভারতবাসীর স্থানীয় স্ব-তন্ত্র জীবন পুনর্গঠনের দিকে প্রবণতা, জাতি ও ভাষার সত্য বিভাগ অনুযায়ী প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি, রাষ্ট্রশরীরের স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবন্ত অনুষ্ঠানরূপে অধুনালুপ্ত পল্লী-সমাজের আদর্শের দিকে ভারতীর মনের পুনরার দৃষ্টি; এবং এখনও পুনরুজ্জীবিত না হইলেও, অপেক্ষাকৃত উন্নতব্যক্তিগণের মনে আভাসরূপে দেখা দিতে আরম্ভ করিতেছে, ভারতীয় জীবনের উপযোগী কম্যুনাল ভিত্তির, এবং আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠার উপর ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রকে নবীভূত ও পুনর্গঠিত করিবার আরও সত্য আদর্শ।

 অতএব ভারতীয় ঐক্যসাধনের চেষ্টা যে ব্যর্থ হইয়াছিল, এবং তাহার পরিণাম হইয়াছিল বিদেশীর আক্রমণ এবং শেষ পর্য্যন্ত পরাধীনতা, তাহার কারণ কাজটির বিশালতাও বটে আবার উহার বিশিষ্ট স্বরূপও বটে, কারণ কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্যের সহজ পন্থা ভারতে প্রকৃতপক্ষে কৃতকার্য্য হওয়া সম্ভব ছিল না, অথচ মনে হইয়াছিল যে এইটিই বুঝি একমাত্র পন্থা, এবং পুনঃ পুনঃ এই দিকেই চেষ্টা করা হইয়াছিল; সে চেষ্টার আংশিক সফলতা সাময়িকভাবে এবং বহুকাল পর্য্যন্ত তাহাকে সমর্থন করিলেও শেষ পর্য্যন্ত তাহা কখনই কৃতকার্য্য হয় নাই। আমি বলিয়াছি যে, ভারতের প্রাচীন মনীষা সমস্যাটির মূলস্বরূপ আরও ভালভাবে বুঝিয়াছিল। বৈদিক ঋষি ও তাঁহাদের উত্তরাধিকারিগণ ভারতীয় জীবনের আধ্যাত্মিক ভিত্তি স্থাপন করা এবং ভারতের অন্তর্গত বহু জাতি (Races) ও জনসমাজের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিমূলক ঐক্যস্থাপন করাকেই তাঁহাদের প্রধান কার্য্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা রাষ্ট্রনীতিক ঐক্যের প্রয়োজন সম্বন্ধেও অন্ধ ছিলেন না। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন, আর্য্যগণের কুলপ্রথামূলক জীবনের নিরন্তর প্রবৃত্তি হইতেছে, বিভিন্ন আকারের কুল, বংশ, রাজ্য পরস্পরের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইবে, এবং সকলে মিলিয়া কাহারও নেতৃত্ব স্বীকার করিয়া লইবে, এই ভাবে বৈরাজ্য ও সাম্রাজ্যের অধীনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হইবে; তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, এই প্রবৃত্তির পূর্ণ পরিণতির দিকে অগ্রসর হওয়াই ঠিক পন্থা, এবং সেইজন্য তাঁহারা চক্রবর্ত্তীর আদর্শ বিকাশ করিয়াছিলেন—এক ঐক্যসাধক সাম্রাজিক শাসন আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারতের অন্তর্গত বহু রাজ্য ও জাতিগুলিকে (Races) তাহাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট না করিয়া ঐক্যবদ্ধ করিবে। এই আদর্শটিকে তাঁহারা ভারতীয় জীবনের অন্যান্য সকল বিষয়ের ন্যায়ই ধর্ম্ম ও আধ্যাত্মিকতার দ্বারা সমর্থন করিয়াছিলেন, এবং এই আদর্শকে কার্য্যে পরিণত করা শক্তিশালী নরপতির পক্ষে ধর্ম্ম বলিয়া, রাজকীয় ও আধ্যাত্মিক কর্ত্তব্য বলিয়া নিরূপণ করিয়া দিয়াছিলেন। সে ধর্ম্ম তাহাকে তাহার অধীনতায় আগত জনসমূহের স্বাধীনতা নষ্ট করিতে দিত না, তাহাদের রাজবংশকে সিংহাসনচ্যুত বা ধ্বংস করিতে অথবা তাহাদের কর্ম্মচারিগণের পরিবর্ত্তে নিজের কর্ম্মচারী ও প্রতিনিধি নিয়োগ করিতে দিত না। তাহার কাজ ছিল এমন এক ঊর্দ্ধতন আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা করা যাহা সামরিক শক্তিতে দেশের মধ্যে শান্তিরক্ষা করিতে সমর্থ হইবে এবং প্রয়োজন হইলে দেশের সমস্ত শক্তিকে একত্র করিতে পারিবে। আর এই প্রাথমিক কর্ত্তব্যের সহিত আর এক আদর্শ যুক্ত হইয়াছিল,—এক প্রবল ঐক্যসাধক শক্তির অধীনে ভারতীয় ধর্ম্মের, ভারতের আধ্যাত্মিক, ধার্ম্মিক, নৈতিক ও সামাজিক কৃষ্টির যথাযথ ক্রিয়ার সংরক্ষণ ও পূর্ণবিকাশ।

 এই আদর্শের পূর্ণরূপটি আমরা দেখিতে পাই রামায়ণ ও মহাভারতে। মহাভারতে এইরূপই একটি সাম্রাজ্যস্থাপন চেষ্টার, ধর্ম্মরাজ্য স্থাপন চেষ্টার কাল্পনিক, অথবা হইতে পারে, ঐতিহাসিক কাহিনী। সেখানে আদর্শটিকে এমনই অবশ্যপালনীয় ও বহুজন-স্বীকৃত বলিয়া চিত্রিত করা হইয়াছে যে, শিশুপালের ন্যায় দুরন্ত রাজাও বশ্যতা স্বীকারপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে যোগদান করিয়াছিল এই বলিয়া যে, যুধিষ্ঠির যাহা করিতেছেন তাহা ধর্ম্মেরই অনুশাসন। আর রামায়ণে আমরা দেখিতে পাই এইরূপই ধর্ম্মরাজ্যের, এক সুপ্রতিষ্ঠিত সর্ব্বব্যাপী সাম্রাজ্যের আদর্শ চিত্র। এখানেও সেটি স্বেচ্ছাচারী স্বৈরশাসন নহে, পরন্তু রাজধানীর, প্রদেশ সমূহের এবং সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিস্বরূপ স্বাধীন জনসভা দ্বারা সমর্থিত সার্ব্বভৌম রাজতন্ত্র; তাহা ভারতীয় ব্যবস্থানুযায়ী সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র অনুষ্ঠানগুলির সমন্বয়সাধক এবং ধর্ম্মের নীতি ও বিধানরক্ষক রাজতন্ত্র ষ্টেটেরই পরিবর্দ্ধিত রূপ। যে বিজয়ের আদর্শ প্রদর্শিত হইয়াছে তাহা বিজিত জনসমূহের জীবন্ত স্বাধীনতা হরণকারী, তাহাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান সকলের বিলোপসাধনকারী এবং তাহাদের অর্থনীতিক সম্পদ শোষণকারী ধ্বংসপরায়ণ লুণ্ঠনাত্মক আক্রমণ নহে; পরন্তু তাহা এক যজ্ঞীয় যাত্রা (sacrificial progression), তাহাতে যে শক্তি-পরীক্ষা হইত তাহার ফলাফল সকলে সহজেই মানিয়া লইত, কারণ পরাজয়ের ফলে অবমাননা, দাসত্ব বা উৎপীড়নের সম্ভাবনা ছিল না; কেবল যে বিজয়ী শক্তির একমাত্র লক্ষ্য জাতির ও ধর্ম্মের প্রকাশ্য ঐক্য সাধন তাহার প্রতি আনুগত্যই দূরীভূত হইত। প্রাচীন ঋষিগণের আদর্শ এবং তাঁহাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট; বুঝা যায় যে, দেশের বিচ্ছিন্ন ও কলহনিরত জনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার সামরিক ও রাষ্ট্রনীতিক প্রয়োজন তাঁহারা দর্শন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারা আবার ইহাও দেখিয়াছিলেন যে, প্রদেশ সকলের স্ব-তন্ত্র জীবন বা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করিয়া ঐ ঐক্যসাধন উচিত নহে, অতএব কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র অথবা কড়াকড়িভাবে ঐক্যমূলক সাম্রাজিক ষ্টেটের দ্বারা উচিত নহে। তাঁহারা দেশবাসীর মনে যে-আদর্শ সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন, পাশ্চাত্য দেশে তাহার নিকটতম সাদৃশ্য হইতেছে এক সামাজিক আধিপত্যের অধীনে বিভিন্ন স্ব-তন্ত্র জাতি ও রাজ্যের সম্মেলন, “a hegemony or confederacy under an imperial head.”

 এই আদর্শকে কার্য্যে পরিণত করা যে কখনও সম্ভব হইয়াছিল তাহার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই, যদিও পৌরাণিক কিম্বদন্তী এই যে, যুধিষ্ঠিরের ধর্ম্মরাজ্যের পূর্ব্বেও এইরূপ রাজ্য কয়েকবারই স্থাপিত হইয়াছিল। বুদ্ধের সময়ে এবং পরে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য যখন ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য গঠন করিতেছিলেন, তখনও দেশ স্বাধীন রাজ্য ও গণতন্ত্রে পূর্ণ ছিল, এবং আলেক্‌জান্দারের আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার মত কোন ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য বর্ত্তমান ছিল না। পূর্ব্বে যদিই বা কখনও চক্রবর্ত্তীত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে, তাহাকে স্থায়ী করিবার ব্যবস্থা বা প্রণালী আবিষ্কৃত হয় নাই ইহা বুঝা যায়। যদি সময় দেওয়া হইত তাহা হইলে হয়ত তাহার বিকাশ হইতে পারিত, কিন্তু ইতিমধ্যে এক গুরুতর পরিবর্ত্তন ঘটে, তাহাতে অবিলম্বে একটা সমাধান করা একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়ে। ভারতের ইতিহাস প্রসিদ্ধ দুর্ব্বলতা হইতেছে তাহার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তদ্বার-সকলের ভেদ্যতা, আধুনিক কাল পর্য্যন্ত এইরূপই ছিল। যতদিন প্রাচীন ভারত সিন্ধুনদকে অতিক্রম করিয়া বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং শক্তিশালী গান্ধার ও বহ্লিক রাজ্যদ্বয় বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে অজেয় দুর্গস্বরূপ দণ্ডায়মান ছিল, ততদিন ঐ দুর্ব্বলতার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ পারস্যসাম্রাজ্যের আক্রমণে তাহারা ভাঙ্গিয়া পড়ে, এবং তখন হইতে বরাবর সিন্ধুনদের পরপারে অবস্থিত দেশসকল আর ভারতের অন্তর্গত থাকে না, এবং সেই জন্যই তাহারা আর ভারতের রক্ষক স্বরূপ না হইয়া বরং ক্রমান্বয়ে প্রত্যেক আক্রমণকারীর নিরাপদে দাঁড়াইবার স্থানে পরিণত হয়। আলেকজান্দারের আক্রমণ ভারতের রাষ্ট্রনীতিক মনকে বিপদটির গুরুত্ব সম্বন্ধে বিশেষভাবে সজাগ করিয়া দিল, এবং সেই সময় হইতেই আমরা দেখিতে পাই, কবি, লেখক, রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সাম্রাজ্যের আদর্শ সর্ব্বদা প্রচার করিয়াছেন, অথবা কি উপায়ে তাহাকে কার্য্যে পরিণত করা যাইতে পারে সে-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন। কার্য্যতঃ ইহার অব্যবহিত ফল হইল হইল চাণক্যের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা দ্বারা আশ্চর্য্য ক্ষিপ্রতার সহিত গঠিত সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়; মাঝে মাঝে দুর্ব্বলতা এবং অন্তর্নিহিত ধ্বংসের বীজ সত্ত্বেও সেই সাম্রাজ্য আট নয় বৎসর ধরিয়া ক্রমান্বয়ে মৌর্য্য, সুঙ্গ, কানোয়া, অন্ধ্র ও গুপ্তবংশের দ্বারা রক্ষিত বা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই সাম্রাজ্য, ইহার চমৎকার সংগঠন, কার্য্যনির্ব্বাহক পদ্ধতি, জনহিতকর অনুষ্ঠান, সমৃদ্ধি, আশ্চর্য্য কৃষ্টি এবং ইহার আশ্রয়াধীন দেশবাসীর তেজবিক্রম, ও অপূর্ব্ব সৃষ্টিশক্তিপূর্ণ জীবনের ইতিহাস কেবল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অসম্পূর্ণ নিদর্শন সকল হইতে পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু তাহা হইলেও ইহাকে পৃথিবীর মহান্ জাতিসকলের প্রতিভা দ্বারা গঠিত ও সংরক্ষিত মহত্ত্বম সাম্রাজ্য সকলের মধ্যেই স্থান দেওয়া যায়। সাম্রাজ্যগঠনে প্রাচীন কালে ভারত যাহা করিয়াছে তাহাতে এই দিক দিয়া তাহার গর্ব্ব না করিবার কোন কারণ নাই, অথবা যাহারা অজ্ঞতার বশে হঠাৎ মত প্রকাশ করিয়া বসে যে, ভারতের প্রাচীন সভ্যতায় সমর্থ ব্যবহারিক প্রতিভা বা উচ্চ রাষ্ট্রনীতিক দক্ষতা ছিল না, তাহাদের কথাও মাথা পাতিয়া লইবার কোনও প্রয়োজন নাই।

 তবে ইহাও ঠিক যে, একটি আসন্ন প্রয়োজন মিটাইতে এই সাম্রাজ্যটির প্রাথমিক গঠনে যে ব্যস্ততা, জোরজবরদস্তি ও কৃত্রিমতা অবলম্বন করা অপরিহার্য্য হইয়াছিল, তাহার ফলও তাহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল, কারণ সেজন্য সেটি প্রাচীন ভারতীয় প্রথা অনুসারে সুদৃঢ়ভাবে ভারতের গভীরতম আদর্শের সুচিন্তিত, স্বাভাবিক ও সুনিয়ন্ত্রিত বিকাশ হইতে পারে নাই। এক কেন্দ্রগত সাম্রাজিক রাজতন্ত্র স্থাপন চেষ্টার পরিণাম হইয়াছিল এই যে, স্থানীয় স্ব-তন্ত্র অনুষ্ঠানগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল, তাহাদের জীবন্ত সমন্বয় সাধিত হয় নাই। যদিও ভারতীয় নীতি অনুসারে তাহাদের আচার ও অনুষ্ঠান সকলকে সম্মান করা হইত, এবং প্রথম প্রথম তাহাদের রাষ্ট্রনীতিক অনুষ্ঠানগুলিকেও, অন্ততঃ অনেক ক্ষেত্রেই, সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করিয়া দেওয়া হয় নাই, পরন্তু সাম্রাজিক ব্যবস্থারই অন্তর্ভুক্ত করিয়া লওয়া হইয়াছিল, তথাপি সেগুলি সাম্রাজিক কেন্দ্রানুগতার ছায়ায় বস্তুতঃপক্ষে সজীব ও সতেজ থাকিতে পারে নাই। প্রাচীন ভারতের স্বাধীন জাতি সকল অদৃশ্য হইতে লাগিল, তাহাদের ভগ্নাবশেষ হইতেই পরে বর্ত্তমান ভারতীয় জাতি সকলের (Indian races) উদ্ভব হয়। আর আমার মনে হয় মোটের উপর এই সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে, যদিও প্রধান জাতীয় সভাগুলি বহুকাল পর্য্যন্ত সতেজ ছিল, শেষ পর্য্যন্ত তাহাদের ক্রিয়া অনেকটা যন্ত্রবৎ কৃত্রিম হইয়া পড়ে এবং তাহাদের জীবনীশক্তি হ্রাসপ্রাপ্ত ও ক্ষুণ্ণ হইতে আরম্ভ করে। নাগরিক রিপাবলিকগুলিও ক্রমশঃ সংহত রাজ্য বা সাম্রাজ্যের কেবল মিউনিসিপালিটিতে পরিণত হয়। সাম্রাজিক কেন্দ্রীকরণ এবং পূর্ব্বকালীন উচ্চতর স্বাধীন জাতীয় সভাগুলি দুর্ব্বল ও লুপ্ত হওয়ার ফলে যে মনোভাব ও সংস্কারের উদ্ভব হয়, তাহাতে একটা আধ্যাত্মিক ব্যবধানের মত সৃষ্টি হইল,—এদিকে প্রজাবর্গ যে-কোন গবর্ণমেণ্ট তাহাদের নিরাপদতার ব্যবস্থা করিত এবং তাহাদের ধর্ম্ম, জীবন, আচার ব্যবহারের উপর অত্যধিক হস্তক্ষেপ না করিত তাহাতেই সন্তুষ্ট হইয়া থাকিতে লাগিল, আর অন্যদিকে রহিল সাম্রাজিক শাসন, তাহা হিতকারী ও গৌরবান্বিত ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু ভারতের প্রাচীন ও সত্য রাষ্ট্রনীতিক মণীষা স্বাধীন ও প্রাণময় জাতি সকলের মস্তকস্বরূপ যে-জীবন্ত অনুষ্ঠানের কল্পনা করিয়াছিল তাহার আর অস্তিত্ব রহিল না। এই সকল পরিণাম সুস্পষ্ট হয় এবং চরমে উঠে অবনতির সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু বীজরূপে তাহারা সকল সময়েই বর্ত্তমান ছিল, এবং ঐক্যসাধনের জন্য যান্ত্রিক প্রণালী অবলম্বন করায় সেগুলি একরকম অবশ্যম্ভাবীই হইয়া পড়িয়াছিল। সুবিধার মধ্যে হইয়াছিল অধিকতর শক্তিমান ও ও সংহত সামরিক উদ্যোগ, এবং অধিকতর নিয়মিত ও সমভাবাপন্ন শাসনক্রিয়া, কিন্তু যে স্বাধীন প্রাণময় বৈচিত্রপূর্ণ জীবনে জাতির মন ও প্রকৃতির সত্য প্রকাশ, তাহা ক্ষুণ্ণ হওয়ায় এই সবের দ্বারা শেষ পর্য্যন্ত সে ক্ষতির আর পূরণ হয় নাই।

 আরও অশুভ এক পরিণাম হইয়াছিল ধর্ম্মের উচ্চ আদর্শ হইতে পতন। রাজ্যের সহিত রাজ্য প্রভুত্বের জন্য দ্বন্দে প্রবৃত্ত থাকায়, কূটরাজনীতির (Machiavellian Staecraft) অভ্যাস পূর্ব্বেকার মহত্তর নৈতিক আদর্শ সকলের স্থান গ্রহণ করিল, দুরন্ত বিজয়াকাঙ্খাকে দমন করিবার মত কোন আধ্যাত্মিক বা নৈতিক প্রতিবন্ধক রহিল না, এবং রাজনীতি ও শাসননীতিতে জাতির মন অনেকটা রুঢ় ও নীচ হইয়া পড়িল; মৌর্য্যযুগের কঠোর দণ্ডবিধি আইনে এবং অশোক কর্ত্তৃক উড়িষ্যাবিজয়ে নৃশংস রক্তপাতে ইতিমধ্যেই তাহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল। এই অবনতির গতি ধর্ম্মভাব ও উচ্চ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা নিরুদ্ধ থাকায় আরও প্রায় এক সহস্র বৎসরকাল চরম অবস্থার পৌঁছিতে পারে নাই; ইহার পূর্ণ বেগটি আমরা দেখিতে পাই কেবল চুড়ান্ত অধঃপতনের যুগে, তখন পরস্পরকে অবাধ আক্রমণ, রাজা ও নেতাগণের উচ্ছৃঙ্খল অহমিকা, রাষ্ট্রনীতিক বুদ্ধির এবং কার্য্যকরীভাবে ঐক্যবদ্ধ হইবার শক্তির একান্ত অভাব, এক সাধারণ দেশপ্রেমের অভাব, এবং কোন রাজা গিয়া কে রাজা হইল সে-বিষয়ে জনসাধারণের চির-উদাসীনতা, এই সমগ্র বিরাট দেশকে সমুদ্র পার হইতে আগত মুষ্টিমেয় বণিকের হস্তে তুলিয়া দিল। কিন্তু চরম উপসর্গগুলি যতই মন্থরগতিতে আসিয়া থাকুক, এবং প্রথম প্রথম সাম্রাজ্যটির রাষ্ট্রনীতিক মহত্ত্ব, দেশের সভ্যতায় অপূর্ব্ব শিক্ষাদীক্ষা ও শিল্পসম্পদ এবং পুনঃপুনঃ আধ্যাত্মিক অভ্যুত্থান, সেই সমুদয়কে যতই সংশোধিত ও নিবারিত করিয়া থাকুক, শেষ গুপ্ত রাজাগণের সময়ের মধ্যেই ভারত তাহার অধিবাসিবৃন্দের রাষ্ট্রনীতিক জীবনে তাহার সত্য মন ও অন্তরতম আত্মার স্বাভাবিক ও পূর্ণবিকাশ করিবার সম্ভাবনা হারাইয়া ফেলিয়াছিল।

 তবে যে প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার জন্য সাম্রাজ্যটি সৃষ্ট হইয়াছিল, ইতিমধ্যে তাহা সম্পূর্ণরূপে না হইলেও যথেষ্ট ভাবেই সিদ্ধ করিতে সে সমর্থ হইয়াছিল। সে প্রয়োজন ছিল ভারতের মাটি ও ভারতীয় সভ্যতাকে বববর জাতিগণের সেই বিরাট প্লাবনতুল্য উপদ্রব হইতে রক্ষা করা যাহা সকল প্রাচীন সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্যতারই পরম বিপদ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, এবং যাহার বিরুদ্ধে উচ্চ-বিকশিত গ্রীকো-রোমান সভ্যতা এবং বিশাল ও শক্তিশালী রোমক সাম্রাজ্যও শেষ পর্য্যন্ত দাঁড়াইতে সক্ষম হয় নাই। সেই উপদ্রব টিউটন্‌, স্লাভ্, হূন ও শকগণের বিপুল বাহিনী সকল পশ্চিমে, পূর্ব্বে, দক্ষিণে ছড়াইয়া দিয়াছিল, বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতের দ্বারে পুনঃ পুনঃ দারুণ আঘাত করিয়াছিল, কখনও কখনও ভিতরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াছিল, কিন্তু যখন তাহা অবসন্ন হইয়া পড়িল, তাহা ভারতীর সভ্যতার মহান্ সৌধকে দণ্ডায়মানই রাখিয়া গেল, তাহা তখনও রহিল সুদৃঢ়, মহান্ ও নিরাপদ। ভারতে তাহারা প্রবেশ করিতে সমর্থ হইত যখনই সাম্রাজ্যটি দুর্ব্বল হইয়া পড়িত, এবং মনে হয় দেশ কিছুদিন ধরিয়া নিরাপদ থাকিলেই ইহা ঘটিত। যে প্রয়োজন মিটাইবার জন্য সাম্রাজ্যটির উদ্ভব হইয়াছিল, তাহার অভাব হইলেই সেটি দুর্ব্বল হইয়া পড়িত, কারণ তখন প্রাদেশিক স্বা-তন্ত্র্য বোধ আবার জাগিয়া উঠিয়া পৃথক হইবার আন্দোলন আরম্ভ করিত, ফলে সাম্রাজ্যটির ভিতরের ঐক্য নষ্ট হইত, অথবা উত্তরদেশে উহার বিরাট বিস্তার ভাঙ্গিয়া পড়িত। কোনও নূতন বিপদ উপস্থিত হইলে, কোন এক নূতন বংশের অধীনে উহা আবার সবল হইয়া উঠিত, কিন্তু এইরূপ পুনঃ পুনঃ ঘটিয়াছিল যতদিন না বিপদটি বহুকালের জন্য অন্তর্হিত হওয়ায়, সেই বিপদ নিবারণের জন্য যে সাম্রাজ্যর সৃষ্টি হইয়াছিল তাহাও চিরতরে লুপ্ত হইয়া গেল। তখন তাহার অবশিষ্ট রহিল পূর্ব্বে, দক্ষিণে ও মধ্যদেশে কতকগুলি মহান্ শক্তিশালী রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিমে রহিল অপেক্ষাকৃত বিশৃঙ্খল জনপুঞ্জ; এই দুর্ব্বল ভাগই মুসলমানেরা আসিয়া ভেদ করে, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর দেশে সেই প্রাচীন সাম্রাজ্যটিকেই পুনর্গঠিত করে, তবে অন্য এক ধরণে, মধ্য এশিয়ার ধরণে।

 এই সব পূর্ব্বতন বিদেশী আক্রমণ এবং ইহাদের ফলাফল সকলের প্রকৃত গুরুত্ব কি তাহা হিসাব করিয়া দেখিতে হইবে, কারণ প্রাচ্যবিষয়ক গবেষকগণের অতিরঞ্জিত থিওরি বা মতবাদের দ্বারা অনেক সময়েই ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আলেক্‌জাণ্ডারের আক্রমণ ছিল বস্তুতঃ প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার (Hellenism) পূর্ব্বমুখীন বিস্তার, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় তাহার কিছু কাজ করিবার ছিল, কিন্তু ভারতে তাহার কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত কর্ত্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ায় তাহার আর কোন চিহ্ণ পর্য্যন্ত বর্ত্তমান রহিল না। পরবর্ত্তী মৌর্য্যগণের দুর্ব্বলতার সময়ে গ্রীকো ব্যাক্‌ট্টিয়নগণের (Graeco Bactrians) যে-অভিযান ভারতে প্রবেশ করে, এবং সাম্রাজ্যটির পুনরুত্থিত শক্তির দ্বারা পরাভূত হয়, তাহা ছিল এমন এক গ্রীক সভ্যতাপ্রাপ্ত জাতির অভিযান যাহা ইতিপূর্ব্বেই ভারতীয় কৃষ্টির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হইয়াছিল। পরে পার্থিয়ান, হূন ও শকগণের যে আক্রমণ আইসে তাহা ছিল আরও গুরুতর, এবং কিছুকালের জন্য আশঙ্কা হইয়াছিল উহা বুঝি ভারতের বিশিষ্ট সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক হইবে। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত তাহারা কেবল পঞ্জাবকেই প্রবলরূপে প্রভাবান্বিত করিতে সমর্থ হইয়া ছিল, যদিও তাহারা তাহাদের তরঙ্গ পশ্চিম উপকূল দিয়া আরও দক্ষিণে প্রেরণ করিয়াছিল, এবং বহুদূর দক্ষিণে কিছুকালের জন্য বিদেশী রাজবংশও প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু এই সকল স্থানে জনগণের জাতিগত প্রকৃতি কতখানি পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল, তাহা আদৌ নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। প্রাচ্য সম্বন্ধে গবেষণাকারী পণ্ডিতগণ এবং নৃবিজ্ঞানবিদ্‌গণ কল্পনা করিয়াছেন যে, পঞ্জাব শকজাতিতে পরিণত হয়, রাজপুতেরা শকেদেরই বংশধর, এমন কি আরও দক্ষিণে এই আক্রমণের দ্বারা জাতি পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছিল। এই সকল জল্পনাকল্পনা অতি অপর্য্যাপ্ত বা বিনা প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, ইহাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য থিওরি বা মতও আছে, এবং ইহা খুবই সন্দেহের বিষয় যে, আক্রমণকারীরা এত বেশী সংখ্যায় আসিয়াছিল যাহাতে এইরূপ গুরুতর পরিবর্ত্তন সংঘটিত হইতে পারে। আরও ইহা অসম্ভব বলিয়া প্রতিপন্ন হয় এই জন্য যে, দুই তিন পুরুষের মধ্যেই এই সকল আক্রমণকারীর দল সম্পূর্ণভাবেই ভারতীয় ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, সম্পূর্ণভাবেই ভারতের ধর্ম্ম, আচার ব্যবহার, কৃষ্টি গ্রহণ করিয়াছিল এবং ভারতীয় জনসাধারণের সহিত মিশিয়া গিয়াছিল। রোমক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত দেশ সমূহে যেরূপ হইয়াছিল সেরূপ ভারতে বর্ব্বরজাতি সকল এক মহত্তর সভ্যতার উপরে নিজেদের আইনকানুন, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বর্ব্বর আচার ব্যবহার চাপাইয়া দিতে সক্ষম হয় নাই। এই সব আক্রমণের এই সাধারণ তথ্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, এবং ইহার তিনটি কারণ নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। আক্রমণকারীরা ছিল সম্ভবতঃ সৈন্যদল মাত্র, জনসমূহ নহে; বিদেশীশাসনরূপে তাহাদের অধিকার একাদিক্রমে বহুদিন স্থায়ী হইতে না পাওয়ায় তাহার বিজাতীয় রূপটি দৃঢ় হইয়া উঠিতে পারে নাই, কারণ প্রত্যেক আক্রমণের পরই ভারতীয় সাম্রাজ্যটি আবার সবল হইয়া উঠিত, এবং বিজিত প্রদেশ সকলকে পুনরধিকার করিয়া লইত; এবং শেষতঃ, ভারতীয় কৃষ্টি এমনই সতেজভাবে প্রাণময় ও গ্রহণশীল যে আক্রমণকারিগণের দিক হইতে কোনরূপ মানসিক বাধাই সাঙ্গীকরণের প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করিতে পারে নাই। যাহাই হউক, যদি এই সব অভিযান খুবই গুরুতর হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহা স্বীকার করিতেই হইবে যে, ভারতীয় সভ্যতা অপেক্ষাকৃত তরুণ গ্রীকোরোমান্ সভ্যতা অপেক্ষা অধিকতর প্রাণশক্তি ও সুদৃঢ়তার পরিচয় দিয়াছিল; গ্রীকো-রোমান সভ্যতা টিউটন্ ও আরবদের আক্রমণে ভূলুণ্ঠিত হইয়াছিল, অথবা নীচে পড়িয়া কোনরকমে আত্মরক্ষা করিয়াছিল, বর্ব্বরতার দ্বারা ও অত্যন্ত প্রভাবিত ও নিষ্পেষিত হইয়া তাহা এমনই হীন দশা প্রাপ্ত হইয়াছিল যে তাহাকে আর চিনিবার উপায় ছিল না। আর ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, রোমক সামাজ্য যতই সুদৃঢ়তা ও মহত্ত্বের গর্ব্ব করুক, ভারতীয় সাম্রাজ্যটি কার্য্যতঃ তাহা অপেক্ষা অধিকতর দক্ষতার প্রমাণ দিয়াছিল, কারণ পশ্চিম প্রান্তে বিদ্ধ হইলেও ভারত উপদ্বীপের বিরাট ভাগকে সে নিরাপদ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 পরে যে অধঃপতন হয়, আরবদের দ্বারা মুসলমান আক্রমণ কৃতকার্য্য না হইয়া বহুকাল পরে পুনরায় সেই চেষ্টা হয় এবং কৃতকার্য্য হয় এবং ইহার যে-সব পরিণাম হয়, তাহাই ভারতবাসীর সক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ দেয়। কিন্তু এখানে কতকগুলি প্রচলিত ভুল ধারণা নিরসন করা প্রয়োজন। এই পরাজয় ঘটিয়াছিল এমন এক সময়ে যখন প্রাচীন ভারতীয় জীবন ও কৃষ্টির প্রাণশক্তি দুই সহস্রবৎসর অপূর্ব্ব কর্ম্মপরায়ণতা ও সৃষ্টিকুশলতার পরিচয় দিবার পর ইতিমধ্যেই সাময়িকভাবে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, অথবা অবসন্নতার খুব সমীপবর্ত্তী হইয়াছিল, এবং সংস্কৃত ভাষা হইতে জনসাধারণের ভাষায় এবং নবোত্থিত প্রাদেশিক জাতিগুলির মধ্যে আনিয়া তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করিবার জন্য কিছু নিঃশ্বাসফেলিবার সময় প্রয়োজন হইয়াছিল। উত্তরাঞ্চলে মুসলমানবিজয় খুবই দ্রুত সম্পাদিত হইয়াছিল, যদিও তাহা সম্পূর্ণ হইতে কয়েক শতাব্দী লাগিয়াছিল, কিন্তু দক্ষিণদেশ ইতিপূর্ব্বে যেমন দেশীয় সাম্রাজ্যটির বিরুদ্ধে নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখিয়াছিল, এই মুসলমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও বহুকাল তেমনিই করিতে সক্ষম হইয়াছিল; আর বিজয়নগর রাজ্য ধ্বংসের পর মহারাষ্ট্রের অভ্যুত্থান হইতেও বেশী সময় লাগে নাই। রাজপুতেরা আকবর ও তাহার উত্তরাধিকারীদের সময় পর্য্যন্ত নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিল, এবং শেষকালে মোগলেরা, কতকটা তাহাদের রাজপুত মন্ত্রী ও সেনাপতিগণের সাহায্যের জোরেই, পূর্ব্বে ও দক্ষিণে তাহাদের আধিপত্য পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছিল। আর ইহাও যে সম্ভব হইয়াছিল তাহার কারণ—এই কথাটা প্রায়ই ভুলিয়া যাওয়া হয়—মুসলমান শাসন অতি অল্পদিনই বিদেশী-শাসন ছিল। এদেশের অধিকাংশ মুসলমানই জাতিতে ভারতীয় ছিল এবং এখনও রহিয়াছে, কেবল পাঠান, তুর্কি ও মোগল রক্তের যৎসামান্য সংমিশ্রণ হইয়াছে; আর বিদেশ হইতে আগত রাজা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণও অবিলম্বেই মনে, প্রাণে ও স্বার্থে ভারতীয় হইয়া পড়িয়াছিল। ভারতবাসী যদি বাস্তবিক পক্ষে য়ুরোপের নানা দেশের ন্যায় বহু শতাব্দী ধরিয়া বিদেশী শাসনের অধীনে নিশ্চেষ্ট, সম্মত, নিরুপায় হইয়া পড়িয়া থাকিত, সেইটাই হইত জাতির অন্তর্নিহিত এক মহাদৌর্ব্বল্যের নিঃসন্দেহ প্রমাণ; কিন্তু বস্তুতঃ ব্রিটিশ-শাসনই প্রথম বিদেশী শাসন একাদিক্রমে ভারতে আধিপত্য করিতেছে। প্রাচীন সভ্যতাটি মধ্য এশিয়া হইতে আগত ধর্ম্ম ও কৃষ্টির সহিত সম্মিলিত হইতে না পারিয়া তাহার সঞ্চাপনে ম্লান ও ক্ষুন্ন হইয়াছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু সে চাপ সে কাটাইয়া উঠিতে সমর্থ হইয়াছিল, তাহার উপরে নানাদিক দিয়া নিজের প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, এবং আমাদের সময় পর্য্যন্ত অবনত অবস্থাতে হইলেও জীবিত রহিয়াছে, পুনরভ্যুত্থানে সক্ষম রহিয়াছে। এই ভাবে সে যে শক্তি ও উৎকর্ষতার পরিচয় দিয়াছে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাহা সুদুর্ল্লভ। আর রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে উচ্চশক্তিশালী রাজা, রাজনীতিবিদ্, যোদ্ধা ও শাসনকর্ত্তার অভ্যুত্থান করিতে সে কখনও বিরত হয় নাই। অবনতির যুগে তাহার রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা এমন পর্য্যাপ্ত ছিল না, এমন সংহত এবং দৃষ্টিতে ও কর্ম্মে তৎপর ছিল না, যাহাতে পাঠান, মোগল ও য়ুরোপীয়গণের আক্রমণকে নিবারিত করা যাইত, কিন্তু সে-সকল আঘাত কাটাইয়া উঠিতে এবং পুনরভ্যুত্থানের প্রত্যেক সুযোগ গ্রহণ করিতে উহা সমর্থ ছিল, রাণা সুঙ্গের নায়কতায় সাম্রাজ্যগঠনের প্রয়াস করিয়াছিল, মহান শক্তিশালী বিজয়নগর রাজ্যের সৃষ্টি করিয়াছিল, রাজপুতানার পর্ব্বতমালায় বহুশতাব্দী ধরিয়া মুসলমানের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিষ্ঠা বজায় রাখিয়াছিল, এবং অতি দুর্দ্দশার দিনেও দিনেও দক্ষতম মোগল সম্রাটের সমগ্র শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া শিবাজীর রাজ্য গঠন করিয়াছিল, রক্ষা করিয়াছিল, মহারাষ্ট্র সমবায় (Mahratta confederacy) ও শিখ্ খাল্‌সা (Sikh Khalsa) গঠন করিয়াছিল, বিরাট মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি ক্ষয় করিয়া দিয়াছিল এবং পুনরায় সাম্রাজ্য গঠনের এক শেষ চেষ্টা করিয়াছিল। যখন চরম ও প্রায় মারাত্মক অধঃপতন আরম্ভ হইয়াছে, চারিদিকে বর্ণনাতীত অন্ধকার, অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, তাহার মধ্যেও সে রণজিৎসিং ও নানা ফড়নবিশের অভ্যুত্থান করিয়া ইংলণ্ডের ভাগ্যলক্ষ্মীর অবশ্যম্ভাবী জয়যাত্রাকে বাধা দিতে সমর্থ হইয়াছিল। মূল সমস্যাটি ঠিকমত দেখিবার ও সমাধান করিবার অক্ষমতা, নিয়তি পুনঃ পুনঃ পুনঃ পুনঃ যে প্রশ্নটি তুলিয়াছে তাহার সদুত্তর দিবার অক্ষমতা সম্বন্ধে যে অভিযোগ আনা যাইতে পারে, এই সকল ঐতিহাসিক তথ্যের দ্বারা সে অভিযোগের গুরুত্ব কিছুমাত্র কম হয় না বটে, কিন্তু যদি বিবেচনা করিয়া দেখা যায় যে, এই সব হইতেছে অবনতির যুগের ঘটনা, তাহা হইলে তাহারা এমন এক বিস্ময়জনক ইতিহাস হয়, যাহার তুলনা সহজে অন্য কোথাও মিলিবে না, এবং লোকে যে অজ্ঞভাবে বলিয়া থাকে ভারত চিরকালই পরাধীন এবং রাষ্ট্রনীতিক ব্যাপারে অক্ষম, তাহার পরিবর্ত্তে সমগ্র প্রশ্নটি এক সম্পূর্ণ নূতন আলোকে দেখা যায়।

 মুসলমানবিজয়ের দ্বারা যে-সমস্যাটি উঠিয়াছিল, সেটি বস্তুতঃ বিদেশীর পরাধীনতা এবং তাহা হইতে মুক্ত হইবার সমস্যা ছিল না, সেটি ছিল দুই সভ্যতার দ্বন্দ, একটি প্রাচীন ও দেশীয়, অপরটি মধ্যযুগীয় এবং বাহির হইতে আনীত। সমস্যাটি অসমাধানীয় হইয়া উঠিয়াছিল এই জন্য যে, উভয়ের সহিতই জড়িত ছিল এক একটি শক্তিশালী ধর্ম্ম। একটি সংগ্রামপ্রিয় ও আক্রমণশীল, অপরটি আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়া সহনশীল ও নমণীয় হইলেও, নিজের বৈশিষ্টের প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠাসম্পন্ন এবং সামাজিক আচার-ব্যবহারের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের অন্তরালে আত্মরক্ষাপরায়ণ। সমস্যাটির সমাধান দুই প্রকার হইতে পারিত, এমন এক মহত্তর অধ্যাত্মতত্ত্বের অভ্যুত্থান যাহা উভয়ের মধ্যে সমন্বয় বিধান করিতে পারিত, অথবা এমন রাষ্ট্রনীতিক দেশপ্রেমের বিকাশ যাহা ধর্ম্মের দ্বন্দকে অতিক্রম করিয়া উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যসাধন করিতে পারিত। প্রথমটি সে যুগে অসম্ভব ছিল। মুসলমানদের দিক হইতে আকবর সে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার ধর্ম্ম ছিল বস্তুতঃ মানসিক বুদ্ধির সৃষ্টি, রাষ্ট্রনীতিপ্রসূত, তাহা আধ্যাত্মিক সৃষ্টি ছিল না, এবং সম্প্রদায় দুইটির প্রবল ধর্ম্মশীল মন যে সে ধর্ম্ম কখনও গ্রহণ করিবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। হিন্দুদের দিক হইতে নানক ঐ চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার ধর্ম্ম মূলনীতিতে সার্ব্বজনীন হইলেও, কার্য্যতঃ তাহা সাম্প্রদায়িক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। আকবর এক সাধারণ রাষ্ট্রনীতিক দেশপ্রেম সৃষ্টি করিবারও চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু সে চেষ্টারও ব্যর্থতা প্রথম হইতেই অবশ্যম্ভাবী ছিল। সেই বাঞ্ছনীয় মনোভাব সৃষ্টি করিতে হইলে, উভয় সম্প্রদায়ের শক্তিমান পুরুষ, রাজা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের ভিতর দিয়া উভয় সম্প্রদায়ের কার্য্যকরী শক্তিকে আকৃষ্ট করিয়া এক ঐক্যবদ্ধ ভারত সাম্রাজ্য গঠনের কার্য্যে লাগাইতে হইত; কিন্তু মধ্য এশিয়ার আদর্শে গঠিত স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যের পক্ষে এরূপ করা সম্ভব ছিল না; দেশবাসীর জাগ্রত সম্মতি প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাহাদিগকে উদ্বুদ্ধ করিবার মত রাষ্ট্রনীতিক আদর্শ ও অনুষ্ঠান সকলের অভাবে তাহা সক্রিয় হইয়া উঠিতে পারে নাই। মোগল সাম্রাজ্যটি ছিল এক মহান্ ও চমৎকার সৃষ্টি, তাহার গঠন ও সংরক্ষণে অপরিসীম রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা ও বুদ্ধি নিয়োজিত হইয়াছিল। তাহা ছিল কীর্ত্তিমণ্ডিত, শক্তিশালী, জনহিতসাধক, এবং আরও বলা যাইতে পারে যে, আউরঙ্গজেবের প্রবল গোঁড়ামি সত্ত্বেও সেটি ধর্ম্মের ব্যাপারে মধ্যযুগের ও সমসাময়িক সকল য়ুরোপীয় রাজ্য ও সাম্রাজ্যের তুলনায় যে কত বেশী উদার ও সহনশীল ছিল তাহার ইয়ত্তা করা যায় না। এবং তাহার অধীনে ভারত সামরিক ও রাষ্ট্রনীতিক শক্তিতে, আর্থিক ঐশ্বর্য্যে এবং আর্ট ও কৃষ্টির গৌরবে অনেক উচ্চে উঠিয়াছিল। কিন্তু পূর্ব্ব পূর্ব্ব সাম্রাজ্যের ন্যায় এইটিও, বরং আরও শোচনীয় ভাবেই, ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল, এবং সেই একই প্রণালীতে, বহিঃশত্রুর আক্রমণে নহে, অন্তর্বিপ্লবের ফলে। সামরিক ও শাসনমূলক কেন্দ্রগত সাম্রাজ্যের দ্বারা ভারতের জীবন্ত রাষ্ট্রনীতিক ঐক্যসাধন সম্ভব হয় নাই। আর যদিও প্রদেশ গুলিতে নবজীবনের অভ্যুত্থান দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু সেই সময়ে য়ুরোপীয় জাতিগণের অনাহূত আগমনে এবং দেশের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ গ্রহণে, সে সম্ভাবনা মুকুলেই বিনষ্ট হইয়াছিল; পেশোয়াগণের অকৃতকার্য্যতা এবং তাহার পরবর্ত্তী অরাজকতা ও অধঃপত্তনের বিষম বিশৃঙ্খলা তাহাদিগকে এই সুযোগ প্রদান করিয়াছিল।

 ভাঙ্গনের যুগে দুইটি বিশিষ্ট সৃষ্টির দ্বারা ভারতের রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা পুরাতন অবস্থা-পরম্পরার মধ্যে নবজীবনের ভিত্তি স্থাপন করিবার শেষ প্রয়াস করিয়াছিল, কিন্তু কোনটিই কার্য্যতঃ সমস্যাটির সমাধান করিবার মত উপযুক্ত হইয়া উঠিতে পারে নাই। রামদাসের মহারাষ্ট্র-ধর্ম্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং শিবাজী কর্ততৃক সংগঠিত মারাঠা অভ্যুত্থান ছিল প্রাচীন আদর্শ ও অনুষ্ঠানের যাহা কিছু জানা বা বুঝা যায় তাহাই পুনঃ সংস্থাপনের চেষ্টা; কিন্তু প্রারম্ভে অধ্যাত্ম প্রেরণা ও প্রজাতান্ত্রিক শক্তি সকলের সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও তাহা কৃতকার্য্য হয় নাই, বস্তুতঃ অতীতকে এইরূপে ফিরাইয়া আনিবার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইতে বাধ্য। পেশোয়াগণ তাঁহাদের সকল প্রতিভা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠাতার দৃষ্টিটি লাভ করিতে পারেন নাই। তাহারা কেবল এক সামরিক ও রাষ্ট্রনীতিক সমবায়েরই (Confederacy) সৃষ্টি করিতে পারিয়াছিলেন। আর তাহাদের সাম্রাজ্যস্থাপনের চেষ্টা কৃত্যকার্য্য হয় নাই কারণ তাহার মূলে ছিল প্রাদেশিকতা, তাহা নিজের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী ছাড়াইয়া উঠিতে পারে নাই, সমগ্র ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করিবার জীবন্ত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইতে পারে নাই। অপর পক্ষে শিখ্ খাল্‌সা ছিল এক আশ্চর্য্য রকমের মৌলিক ও নূতন সৃষ্টি, তাহার দৃষ্টি অতীতের দিকে নহে, ভবিষ্যতের দিকেই প্রসারিত ছিল। গভীর আধ্যাত্মিক সূচনা, ধর্ম্মগুরুর নেতৃত্ব, সাম্যতান্ত্রিক সংগঠন, ইস্‌লাম ও বেদান্তের গভীরতম সত্যগুলির সমন্বয় সাধন করিবার প্রথম চেষ্টা, এই সব লইয়া এই অপরূপ ও অভিনব অনুষ্ঠান ছিল মানব সমাজের তৃতীয় বা অধ্যাত্ম স্তরে প্রবেশ করিবার অকাল প্রয়াস; কিন্তু উহা আধ্যাত্মিকতা ও বাহ্য জীবনের মধ্যে যোগসাধক সমৃদ্ধ সৃষ্টিমূলক চিন্তা ও কৃষ্টির বিকাশ করিতে পারে নাই। এই ভাবে ক্ষুন্ন ও অসম্পূর্ণ হওয়ায়, সে চেষ্টা সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিক গণ্ডীর মধ্যেই আরম্ভ ও শেষ হইয়াছিল, প্রগাঢ়তা লাভ করিয়াছিল, কিন্তু প্রসারতার শক্তি লাভ করিতে পারে নাই। যে অবস্থাপরম্পরার মধ্যে ঐরূপ চেষ্টা কৃতকার্য্য হইতে পারিত তখন সে সবের অস্তিত্ব ছিল না।


 তাহার পর আসিল নিশার অন্ধকার, সকল রাষ্ট্রনীতিক উদ্যম ও সৃষ্টি সাময়িকভাবে বন্ধ হইয়া গেল। আমাদের এক পুরুষ পূর্ব্বে পাশ্চাত্য আদর্শ ও অনুষ্ঠানগুলি দাসসুলভ নিষ্ঠার সহিত অনুকরণ ও গ্রহণ করিবার যে প্রাণহীন প্রয়াস দেখা গিয়াছিল, তাহা হইতে ভারতবাসীর রাষ্ট্রনীতিক মনীষা ও প্রতিভার কোনও সত্য পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু আবার অনেক ভ্রান্তি-কুজ্‌ঝটিকার মধ্যেও এক নূতন সন্ধ্যার আলোক দেখা যাইতেছে, প্রদোষের প্রদোষের সন্ধ্যা নহে, প্রভাতেরই যুগ সন্ধ্যা। যুগযুগান্তের ভারত মরে নাই, তাহার সৃষ্টির শেষ কথাও এখনও বলা হয় নাই; সে জীবিত রহিয়াছে, নিজের জন্য, সমগ্র মানবজাতির জন্য এখনও তাহার কিছু করিবার রহিয়াছে। আর আর এখন যাহা জাগ্রত হইতে চাহিতেছে, তাহা একটা ইংরাজীভাবাপন্ন (Anglicised) প্রাচ্য জাতি নহে, পাশ্চাত্যের অনুগত শিষ্য হওয়া এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার ফলাফল গুলির পুনরভিনয় করাই তাহার নিয়তি নহে, পরন্তু তাহা এখনও সেই প্রাচীন স্মরণাতীত কালেরই শক্তি পুনরায় নিজের গভীরতর আত্মার সন্ধান পাইতেছে, সকল জ্যোতি ও শক্তির পরম উৎসের দিকে নিজের মাথা আরও উচ্চ করিয়া তুলিয়া ধরিতেছে, নিজের ধর্ম্মের পূর্ণ অর্থ ও বিশালতর রূপ আবিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইতেছে।


সম্পূর্ণ