ময়ূখ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
“ঠাকুর, আমি ঢাকা হইতে ফিরিতেছি, বাঙ্গালার সুবাদার দরিদ্র প্রজাকে দস্যুর অত্যাচার হইতে রক্ষা করিতে অক্ষম।” “তবে বাদশাহের নিকটে আবেদন করুন।” “ঠাকুর, আমি বণিক্, ফিরিঙ্গির অত্যাচারে আমার সর্ব্বস্ব গিয়াছে। যাহা কিছু আছে দিল্লী গেলে তাহাও যাইবে।” “কেন, বাদশাহ কি তাহা কাড়িয়া লইবেন?” “না, তবে আমি বাদশাহের দরবারে পৌঁছবার পূর্ব্বে ফিরিঙ্গি বণিক্ এবং খৃষ্টান পাদরী আমার অবশিষ্ট সম্পত্তি এমন কি স্ত্রী, পুত্র, পর্য্যন্ত হরণ করিবে।”
ময়ূখ বিস্মিত হইয়া প্রৌঢ়ের মুখের দিকে চাহিয়া রছিলেন, —ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনি কে?” প্রৌঢ় ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি নিজ পরিচয় গোপন করিয়াছেন—কিন্তু আমি তাহা করিব না। আমি সপ্তগ্রামবাসী সুবর্ণবণিক্, বাণিজ্য আমার ব্যবসা, আমার নাম—গোকুলবিহারী সেন। সপ্তগ্রামে, গৌড়ে, সুবর্ণগ্রামে ও ঢাকায় আমার কুঠী আছে। পূর্ব্বে আমার দশখনি জাহাজ ছিল, সেগুলি একে একে বিসর্জ্জন দিয়াছি। গৌড়ে ও ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্য অচল এবং সপ্তগ্রামে অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।” ময়ূখ কহিলেন, “মহাশয়, আমার নাম ময়ূখ, আমার পিতা উত্তর রাঢ়ে একজন প্রসিদ্ধ ভূস্বামী ছিলেন। বাদশাহের আদেশে, আমার শৈশবে, পিতৃব্য সে অধিকার পাইয়াছেন, আমি একা সম্বলহীন ভিখারী। আপনার দশখানি জাহাজ ছিল, তাহা বিসর্জ্জন দিলেন কেমন করিয়া?” “পর্ত্তুগীজ বণিক্ তাহার কতকগুলি ডুবাইয়া দিয়াছে এবং অবশিষ্টগুলি কাড়িয়া লইয়াছে।” “ইহার কি প্রতিকার নাই?” “অনেক চেষ্টা করিয়া দেখিলাম—কিন্তু কোন ফল হইল না—” “এখন কি করিবেন?” “আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিব।” “সুবাদার ফৌজদার যাহাদিগের সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারেন না, আপনি একা তাহাদিগের সহিত কি করিয়া লড়াই করিবেন?” “আমার কিঞ্চিৎ সৈন্যবল আছে এবং অন্য ফিরিঙ্গিরা আমাকে সাহায্য করবে।” “ফিরিঙ্গী কি দুই তিন রকম আছে না কি?” “ঠাকুর কি তাহা জানেন না? এখন যাহাদিগের প্রভাব অধিক তাহার পর্ত্তুগীজ; ইহাদিগের এক সন্ন্যাসী জল ও স্থলের রাজত্ব ইহাদিগকে লিখিয়া পড়িয়া দান করিয়াছেন, সেইজন্য ইহারা পৃথিবীর সর্ব্বত্র অত্যাচার করিয়া বেড়ায়। অন্যান্য ফিরিঙ্গীরা ইহাদের ন্যায় উদ্ধত নহে, তাহাদিগের মধ্যে ওলন্দাজ জাতি সর্ব্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত। আংরেজ ও ফরাসী জাতি ক্রমে ক্রমে এদেশে বাণিজ্য বিস্তার করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে ফরাসী জাতি শুনিয়াছি বড়ই পরাক্রান্ত; কিন্তু এদেশে পরাক্রমের লক্ষণ কিছু দেখিতে পাই নাই। অন্য ফিরিঙ্গী বণিকের সহিত কারবার করি বলিয়া পর্ত্তুগীজ বণিক্ আমার উপর অসন্তুষ্ট। ইহারই জন্য আমার জাহাজ মারা গিয়াছে, আমার সপ্তগ্রামের কুঠিতে আগুন লাগিয়াছে এবং সকল বিষয়ে আমার সর্ব্বনাশের চেষ্টা হইতেছে।”
“অন্য ফিরিঙ্গীদের কোথাও কুঠী আছে?” “এদেশে নাই, কিছুদিন পূর্ব্বে দুইজন ইংরাজ পাটনায় একটি কুঠী খুলিয়াছিল, কিন্তু সে কুঠী বোধ হয় উঠিয়া গিয়াছে। সকলেই সপ্তগ্রামে অথবা নিকটে কুঠী খুলিবার চেষ্টায় আছে, সপ্তগ্রামের বাজারে সকল ফিরিঙ্গীর গোমস্তা খরিদ বিক্রয় করিতে আসে। এখন কেহই পর্ত্তুগীজ বণিকের সহিত পারিয়া উঠিতেছে না, তবে ওলন্দাজ ও আংরেজ একসঙ্গে মিশিলে বোধ হয় পর্ত্তুগীজের প্রভাব কমিয়া যাইবে।”
“সুবাদারের কাছে দরবার করিয়া কোন লাভ হইল না?” “না,—মোকরম খাঁ অত্যন্ত বিলাসী, পর্ত্তুগীজ বণিক্গণ নানা উপায়ে তাহাকে সন্তুষ্ট রাখিয়াছে, সেইজন্য তিনি বাদশাহের নিকট প্রজা বা অন্য জাতীয় ফিরিঙ্গীর আর্জি পেশ করিতে দেন না।”
“পর্ত্তুগীজদিগের সহিত লড়াই আরম্ভ করিলে সুবাদার কি অসন্তুষ্ট হইবেন না?” “হয়ত হইবেন। কিন্তু সুবাদারকে সন্তুষ্ট করিতে হইলে আমাকে সবংশে মরিতে হইবে।” “তবে কি করিবেন? স্বয়ং সুবাদার যদি ফিরিঙ্গীর সহিত যোগ দেন তাহা হইলে কতক্ষণ তিষ্ঠিতে পারিবেন?” “দেখি নারায়ণ কি করেন? ঠাকুর, আপনি কি করিবেন?” “মহামায়া আমাকে আপনার আশ্রয়ে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, আপনি আমাকে যাহা করিতে বলিবেন তাহাই করিব।” “দেখুন, পর্ত্তুগীজ বণিক্ অপেক্ষা পর্ত্তুগীজ পাদরী আরও ভয়ানক। আপনার আত্মীয়া পাদরীর হাতে পড়িলে তাহাকে উদ্ধার করা কঠিন হইবে।” “আমরা কি কল্য সপ্তগ্রামে পৌঁছিব?” “না, এখান হইতে সপ্তগ্রাম দুই দিনের পথ, সাধারণ নৌকা সপ্তাহের পূর্ব্বে পৌঁছিতে পরিবে না।” “ফিরিঙ্গীদের কোশা কয়দিনে পৌঁছিবে?” “দিবারাত্রি চলিলে কল্য সন্ধ্যাকালে বন্দরে পৌঁছিবে।” “আমরা একদিন পরে পৌঁছিব, তাহাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না ত?” “বোধ হয় না।” “সপ্তগ্রামে কে কে আপনার বন্ধু আছেন?”
“বন্দরের মুন্সী হাফিজ আহ্মদ্ খাঁ, নাওয়ারার মীর আতেশ এনায়েৎ উল্লা খাঁ, খালিশা মহলের নায়েব দেওয়ান চিন্তামণি মজুমদার এবং ফৌজদারের খাজাঞ্চি হরিনারায়ণ শীল।” “চিন্তামণি মজুমদার ও হরিনারায়ণ শীল এখনও সপ্তগ্রামে আছেন। দুই বৎসর পূর্বে হাফিজ আহমদ্ খাঁর মৃত্যু হইয়াছে এবং এনায়েত উল্লা খাঁ জহাঙ্গীর নগর গিয়াছেন। ফৌজদারের সহিত কি আপনার পরিচয় আছে?” “না, তবে সুলতান সাজাহানের সহিত যখন উড়িষ্যার নায়েব নাজিম আহমদ্ বেগখাঁর যুদ্ধ হইয়াছিল, তখন পিতা ও কলিমুল্লা খাঁ পিপলি হইতে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত এক সঙ্গে ছিলেন, আকবর নগর ও জহাঙ্গীর নগরের যুদ্ধে পিতা আহামদ্ বেগ খাঁর দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিলেন। নাওয়ারার কোন কর্ম্মচারী কি এখন সপ্তগ্রামে আছেন?” “আছেন; আমীরউলবহর আসদ খাঁ কিছুদিন পূর্ব্বে সপ্তগ্রামে আসিয়াছেন।”
“বড়ই সৌভাগ্যের কথা, আসদ্খাঁও আমার পিতৃবন্ধু, মহবৎখাঁ ও খানাজদ্খাঁ সুবাদারীর সময়ে পিতা বহুদিন আসদখাঁর সহিত একসঙ্গে বিদ্রোহদমন কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন।” “সুবাদারের কর্ম্মচারীদের মধ্যে কাহারও সহিত আলাপ আছে কি?” “নায়েব কানুনগো ভগবান্ রায় পিতার বন্ধু, আর কাহারও নাম স্মরণ নাই।” “অনেক রাত্রি হইয়াছে, বিশ্রাম করুন, সপ্তগ্রামে পৌঁছিয়া পরামর্শ করা যাইবে।”
গোকুল, গোষ্ঠ ও ময়ূখ কক্ষমধ্যে শয়ন করিলেন। রাত্রি শেষে নৌকা থামিল, কেনারাম আসিয়া গোকুলকে জাগাইল এবং কহিল, “হুজুর, সম্মুখে অনেক নৌকা দেখা যাইতেছে, সমস্তই গরার ও কোশা। একখানা পঞ্চাশ তোপের গরার ঠিক গঙ্গার মাঝখানে নোঙ্গর করিয়া আছে, নৌকা কি চালাইব?”
গোকুল, গোষ্ঠ ও ময়ূখ নৌকার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং দেখিলেন যে, নৌবাহিনীর আলোকমালায় অন্ধকার গঙ্গাবক্ষ দিনের ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা দেখিয়া গোকুলবিহারী কহিলেন, “বোধ হয়, বাদশাহী বহর; কেনারাম, তুমি ধীরে ধীরে ছিপ বাহিয়া গরারের নিকট চল।” ছিপ ধীরে ধীরে চলিল। গরারের শত হস্ত দূরে পৌঁছিলে গরারের উপর হইতে শান্ত্রীপাহারা হাঁকিল, “নৌকা তফাৎ, কাহার ছিপ্?” ছিপ্ হইতে গোকুলবিহারী কহিলেন, “সপ্তগ্রামের বণিক্ গোকুলবিহারী সেনের ছিপ্, সপ্তগ্রামে যাইব।” “কোথা হইতে আসিতেছ?” “জহাঙ্গীর নগর হইতে।” “ছাড় আছে?” “আছে।” “দাঁড়াও।”
গরার হইতে একখানি ছোট নৌকা আসিয়া ছিপে লাগিল, একজন নাখোদা আসিয়া জহাঙ্গীরনগর বন্দরের ছাড়পত্র দেখিয়া পুনরায় ফিরিয়া গেল। ক্ষণকাল পরে গরার হইতে শান্ত্রী হাঁকিয়া কহিল, “ছিপ চালাও, কিন্তু খবরদার ফিরিঙ্গিদের একখানি কোশা এই পথে গিয়াছে।” নৌকার উপরে দাঁড়াইয়া গোকুলবিহারী কহিলেন, “তাহার জন্য চিন্তা নাই।” ছিপ বহর পার হইয়া নবদ্বীপাভিমুখে চলিল।