মহাভারত (রাজশেখর বসু)/আদিপর্ব/হিড়িম্ববধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥হিড়িম্ববধপর্বাধ্যায়॥

২৭। হিড়িম্ব ও হিড়িম্বা—ঘটোৎকচের জন্ম

 কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদি যেখানে নিদ্রিত ছিলেন তার অনতিদূরে শালগাছেব উপর হিড়িম্ব নামে এক রাক্ষস ছিল। তার বর্ণ বর্ষার মেঘের ন্যায়, চক্ষু পিঙ্গল, বদন দংষ্ট্রাকরাল, কেশ ও শ্মশ্রু রক্তবর্ণ, আকার ভয়ংকর। পাণ্ডবদের দেখে এই রাক্ষসের মনুষ্যমাংস খাবার ইচ্ছা হ’ল, সে তার ভগিনী হিড়িম্বাকে বললে, বহু কাল পরে আমার প্রিয় খাদ্য উপস্থিত হয়েছে, তার গন্ধে আমার লালা পড়ছে, জিহ্বা বেরিয়ে আসছে। আজ নরম মাংসে আমার ধারাল আটটি দাঁত বসাব, মানুষের কণ্ঠ ছেদন ক’রে ফেনিল রক্ত পান করব। তুমি ওদের বধ ক’রে নিয়ে এস, আজ আমরা দুজনে প্রচুর নরমাংস খেয়ে হাততালি দিয়ে নাচব।

 ভ্রাতার কথা শুনে হিড়িম্বা গাছের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে পাণ্ডবদের কাছে এসে দেখলে সকলেই নিদ্রিত, কেবল একজন জেগে আছেন। ভীমকে দেখে সে ভাবলে, এই মহাবাহু সিংহস্কন্ধ উজ্জ্বলকান্তি পুরুষই আমার স্বামী হবার যোগ্য। আমি ভ্রাতার কথা শুনব না, ভ্রাতৃস্নেহের চেয়ে পতিপ্রেমই বড়। কামরূপিণী হিড়িম্বা সুন্দরী সালংকারা নারীর রূপ ধারণ করে যেন লজ্জায় ঈষৎ হেসে ভীমসেনকে বললে, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন? এই দেবতুল্য পুরুষরা এবং এই সকুমারী রমণী যাঁরা ঘুমিয়ে রয়েছেন এঁরা কে? এই বনে আমার ভ্রাতা হিড়িম্ব নামক রাক্ষস থাকে, সে আপনাদের মাংস খেতে চায় সেজন্য আমাকে পাঠিয়েছে। আপনাকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি, আপনি আমার পতি হ’ন। আমি আকাশচারিণী, আপনার সঙ্গে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করব। ভীম বললেন, রাক্ষসী, নিদ্রিত মাতা ও ভ্রাতাদের রাক্ষসের কবলে ফেলে কে চ’লে যেতে পারে? হিড়িম্বা বললে, এঁদের জাগান, আমি সকলকে রক্ষা করব। ভীম বললেন, এঁরা সুখে নিদ্রা যাচ্ছেন, আমি এখন জাগাতে পারব না। রাক্ষস বা যক্ষ গন্ধর্ব সকলকেই আমি পরাস্ত করতে পারি। তুমি যাও বা থাক বা তোমার ভ্রাতাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।

 ভগিনীর ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে হিড়িম্ব দ্রুতবেগে পাণ্ডবদের কাছে আসতে লাগল। হিড়িম্বা ভীমকে বললে, আপনারা সকলেই আমার নিতম্বে আরোহণ করুন, আমি আকাশপথে আপনাদের নিয়ে যাব। ভীম বললেন, তোমার ভয় নেই, মানুষ বলে আমাকে অবজ্ঞা ক’রো না। হিড়িম্ব এসে দেখলে, তার ভগিনী সন্দরী নারীর রূপ ধ’রে সূক্ষ্ম বসন, অলংকার এবং মাথায় ফুলের মালা পরেছে। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, তুই অসতী, এদের সঙ্গে তোকেও বধ করব। এই বলে সে পাণ্ডবদের দিকে ধাবিত হ’ল। ভীম বললেন, রাক্ষস, এঁদের জাগিয়ে কি হবে, আমার কাছে এস। তোমার ভগিনীর দোষ কি, ইনি নিজের বশে নেই, শরীরের ভিতরে যে অনঙ্গদেব আছেন তাঁরই প্রেরণায় ইনি আমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন। তার পর ভীম আর হিড়িম্বের ঘোর বাহুযুদ্ধ আরম্ভ হ’ল। পাছে দ্রাতাদের নিদ্রাভঙ্গ হয় সেজন্য ভীম রাক্ষসকে দূরে টেনে নিয়ে গেলেন, কিন্তু যুদ্ধের শব্দে সকলেই জেগে উঠলেন।

 কুন্তী হিড়িম্বাকে বললেন, বরবর্ণিনী, সুরকন্যাতুল্য তুমি কে? বনের দেবতা, না অপ্সরা? হিড়িম্বা নিজের পরিচয় দিয়ে জানালে যে ভীমের প্রতি তার অনুরাগ হয়েছে। অর্জুন ভীমকে বললেন, আপনি বিলম্ব করবেন না, আমাদের যেতে হবে। ঊষাকাল আসন্ন, সেই রৌদ্র মুহূর্তে রাক্ষসরা প্রবল হয়। ওই রাক্ষসটাকে নিয়ে খেলা করবেন না, ওকে শীঘ্র মেরে ফেলুন। তখন ভীম হিড়িম্বকে তুলে ধ’রে ঘোরাতে লাগলেন এবং তার পর ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট ক’রে বধ করলেন।

 অর্জুন বললেন, আমার মনে হয় এখান থেকে নগর বেশী দূরে নয়, আমরা শীঘ্র সেখানে যাই চলুন, দুর্যোধন আমাদের সন্ধান পাবে না। ভীম বললেন, রাক্ষসজাতি মোহিনী মায়ার বলে শত্রুতা করে, হিড়িম্বা, তুমিও তোমার দ্রাতার পথে যাও। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি স্ত্রীহত্যা ক’রো না, এ আমাদের অনিষ্ট করতে পারবে না। হিড়িম্বা কুন্তীকে প্রণাম ক’রে করজোড়ে বললে, আর্যা, আমি স্বজন ত্যাগ ক’রে আপনার এই বীর পুত্রকে পতিরূপে বরণ করেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি বাঁচব না, আমাকে মুগ্ধা ভক্তিমতী ও অনুগতা জেনে দয়া করুন। আপনার পুত্রের সঙ্গে আমাকে মিলিত করে দিন। আমি ওঁকে নিয়ে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করব, তার পর আবার এনে দেব, আমাকে বিশ্বাস করুন। আমাকে মনে মনে ভাবলেই আমি উপস্থিত হব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, হিড়িম্বা, তোমার কথা অসংগত নয়, কিন্তু তোমাকে এই নিয়ম পালন করতে হবে।—ভীম স্নান আহ্যিক ক’রে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন এবং সূর্যাস্ত হ’লেই আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। ভীম হিড়িম্বাকে বললেন, রাক্ষসী, শোন, যত দিন তোমার পুত্র না হয় তত দিনই আমি তোমার সঙ্গে থাকব। হিড়িম্বা সম্মত হয়ে ভীমকে নিয়ে আকাশপথে চ’লে গেল।

 কিছুকাল পরে হিড়িম্বার একটি ভীষণাকার বলবান পুত্র হ’ল, তার কর্ণ সূক্ষ্মাগ্র, দন্ত তীক্ষ্ণ, ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ, কণ্ঠস্বর ভয়ানক। রাক্ষসীরা গর্ভবতী হয়েই সদ্য প্রসব করে। হিড়িম্বার পুত্র জন্মাবার পরেই যৌবনলাভ ক’রে সর্বপ্রকার অস্ত্রপ্রয়োগে দক্ষ হ’ল। তার মাথা ঘটের মত এবং চুল খাড়া সেজন্য হিড়িম্বা পুত্রের নাম রাখলে ঘটোৎকচ। কুন্তী ও পাণ্ডবদের প্রণাম ক’রে সে বললে, আমাকে কি করতে হবে আজ্ঞা করুন। কুন্তী বললেন, বৎস, তুমি কুরুকুলে জন্মেছ, তুমি সাক্ষাৎ ভীমের তুল্য এবং পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তুমি আমাদের সাহায্য করো। ঘটোৎকচ বললে, প্রয়োজন হ’লেই আমি উপস্থিত হব। এই ব’লে সে বিদায় নিয়ে উত্তর দিকে চ’লে গেল।

 পাণ্ডবরা জটা বল্কল মৃগচর্ম ধারণ ক’রে তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে চললেন। যেতে যেতে পিতামহ ব্যাসের সঙ্গে তাঁদের দেখা হ’ল। ব্যাস বললেন, আমি তোমাদের সমস্ত বৃত্তান্ত জানি, বিষণ্ণ হয়ো না, তোমাদের মঙ্গল হবে। যত দিন আমার সঙ্গে আবার দেখা না হয় তত দিন তোমরা নিকটস্থ ওই নগরে ছদ্মবেশে বাস কর। এই কথা ব’লে ব্যাস পাণ্ডবগণকে একচক্রা নগরে এক ব্রাহ্মণের গৃহে রেখে এলেন।