মহাভারত (রাজশেখর বসু)/উদ্‌যোগপর্ব/প্রজাগর- ও সনৎসুজাত-পর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ প্রজাগর- ও সনৎসুজাত- পর্বাধ্যায়॥

৮। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে বিদুর — বিরোচন ও সুধন্বা

 সঞ্জয় চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে ডেকে আনিয়ে বললেন, পাণ্ডবদের কাছ থেকে ফিরে এসে সঞ্জয় আমাকে ভর্ৎসনা করেছে, কাল সে যুধিষ্ঠিরের কথা জানাবে। আমি উৎকণ্ঠায় দগ্ধ হচ্ছি, আমার নিদ্রা আসছে না, মনের শান্তি নেই, সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন বিকল হয়েছে। বিদুর, তুমি আমাকে সৎপরামর্শ দাও।

 বিদুর বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠির রাজোচিত লক্ষণযুক্ত এবং ত্রিলোকের অধিপতি হবার যোগ্য। তিনি আপনার আজ্ঞাবহ ছিলেন সেজন্যই নির্বাসনে গিয়েছিলেন। আপনি ধর্মজ্ঞ, কিন্তু অন্ধ, সেজন্য রাজ্যলাভের যোগ্য নন। দুর্যোধন শকুনি কর্ণ ও দুঃশাসনকে প্রভুত্ব দিয়ে আপনি কি ক’রে শ্রেয়োলাভ করতে পারেন? আপনি পাণ্ডবগণকে তাঁদের পিতৃরাজ্য দান করুন, তাতে আপনি সপুত্র সুখী হবেন, আপনার অখ্যাতি দূর হবে। যত কাল মানুষের কীর্তি ঘোষিত হয় তত কালই সে স্বর্গভোগ করে। আপনি পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে সরল ব্যবহার করুন, তাতে আপনি ইহলোকে কীর্তি এবং মরণান্তে স্বর্গ লাভ করবেন। একটি প্রাচীন কথা বলছি শুনুন।—

 কেশিনী নামে এক অতুলনীয়া রূপবতী কন্যা ছিলেন। তাঁর স্বয়ংবরে প্রহ্লাদের পুত্র বিরোচন উপস্থিত হ’লে কেশিনী তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না দৈত্য শ্রেষ্ঠ? বিরোচন বললেন, প্রজাপতি কশ্যপের বংশধর দৈত্যরাই শ্রেষ্ঠ, সর্বলোক আমাদেরই অধীন। কেশিনী বললেন, কাল সুধন্বা এখানে আসবেন, তখন তোমাদের দুজনকেই দেখব। পরদিন সুধন্বা এলে কেশিনী তাঁকে পাদ্য অর্ঘ্য ও আসন দিলেন। বিরোচন বললেন, সুধন্বা আমার এই হিরণ্ময় আসনে বসুন। সুধন্বা বললেন, তোমার আসন আমি স্পর্শ করলাম, কিন্তু তোমার সঙ্গে বসব না; তোমার পিতা আমার আসনের নিম্নে বসেন। বিরোচন বললেন, স্বর্ণ গো অশ্ব প্রভৃতি অসুরদের যে বিত্ত আছে সে সমস্তই আমি পণ রাখছি; যিনি অভিজ্ঞ তিনিই বলবেন আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। সুধন্বা বললেন, স্বর্ণ গো প্রভৃতি তোমারই থাকুক, জীবন পণ রাখা হ’ক।

 দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন, তোমরা পূর্বে কখনও একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের সখ্য হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা, সখ্য হয় নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধন্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পাদ্য জল, মধুপর্ক ও দুই স্থূল শ্বেত বৃষ আনতে বললেন। সুধন্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন—ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? প্রহ্লাদ বললেন, সুধন্বার পিতা অঙ্গিরা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সুধন্বার মাতা বিরোচনের মাতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বিরোচন, তুমি পরাজিত হয়েছ, তোমার প্রাণ এখন সুধন্বার অধীন। সুধন্বা, আমার প্রার্থনায় তুমি বিরোচনকে প্রাণদান কর। সুধন্বা বললেন, দৈত্যরাজ, আপনি ধর্মানুসারে সত্য কথা বলেছেন, পুত্রের প্রাণবক্ষার জন্য মিথ্যা বলেন নি, সেজন্য বিরোচনকে মুক্তি দিলাম। ইনি কুমারী কেশিনীর সমক্ষে আমার পাদপ্রক্ষালন করুন।[১]

 উপাখ্যান শেষ করে বিদুর বললেন, মহারাজ, পররাজ্যের জন্য মিথ্যা ব’লে আপনি পুত্র ও অমাত্য সহ বিনষ্ট হবেন না। পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন, পাণ্ডবরা যেমন সত্যপালন করেছেন দুর্যোধনকেও সেইরূপ সত্যরক্ষায় প্রবৃত্ত করুন, তিনি পূর্বে যে পাপ করেছেন আপনি তার অপনয়ন করুন। বিদুর আরও অনেক উপদেশ দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তুমি যা বললে সবই সত্য, পাণ্ডবদের সঙ্গে আমি ন্যায়সংগত ব্যবহার করতে চাই, কিন্তু দুর্যোধন কাছে এলেই আমার বুদ্ধির পরিবর্তন হয়। মানুষের ভাগ্যই প্রবল, পুরুষকার নিরর্থক। বিদুর, তোমার কথা অতি বিচিত্র, যদি আরও কিছু বলবার থাকে তো বল। বিদুর বললেন, আমি শূদ্রযোনিতে জন্মেছি, অধিক কিছু বলতে সাহস করি না। জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ সনৎসুজাত (সনৎকুমার) আপনার সকল সংশয় খণ্ডন করবেন।

 বিদুর স্মরণ করলে সনৎসুজাত তখনই আবির্ভূত হলেন। তাঁকে যথাবিধি অর্চনা ক’রে বিদুর বললেন, ভগবান, ধৃতরাষ্ট্র সংশয়াপন্ন হয়েছেন, আপনি এমন উপদেশ দিন যাতে এঁর সকল দুঃখ দূর হয়। বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের প্রার্থনায় সনৎসুজাত ধর্ম ও মোক্ষবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন।

  1. মূলে আছে—‘পাদপ্রক্ষালনং কুর্ষাৎ কুমার্যাঃ সন্নিধৌ মম।’ টীকাকার নীলকণ্ঠ ব্যাখ্যা করেছেন, আমার সন্নিধানে কুমারী কেশিনীর পাদপ্রক্ষালন করুন, অর্থাৎ তাঁকে বিবাহ করুন; বিবাহের পূর্বে বরকন্যা হরিদ্রা দিয়ে পরস্পরের পাদপ্রক্ষালন করে।