মহাভারত (রাজশেখর বসু)/দ্রোণপর্ব/অভিমন্যুবধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ অভিমন্যুবধপর্বাধ্যায় ॥

৬। অভিমন্যুবধ

(ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধ)

 অভিমানী দুর্যোধন ক্ষুণ্ণ হয়ে দ্রোণকে বললেন, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি নিশ্চয় মনে করেন যে আমরা বধের যোগ্য, তাই আজ যুধিষ্ঠিরকে পেয়েও ধরলেন না। আপনি প্রীত হয়ে আমাকে বর দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষে তার অন্যথা করলেন। সাধু লোকে কখনও ভক্তের আশাভঙ্গ করেন না। দ্রোণ লজ্জিত হয়ে উত্তর দিলেন, আমি সর্বদাই তোমার প্রিয়সাধনের চেষ্টা করি কিন্তু তুমি তা বুঝতে পার না। বিশ্বস্রষ্টা গোবিন্দ যে পক্ষে আছেন এবং অর্জুন যার সেনানী, সে পক্ষের বল ত্র্যম্বক মহাদেব ভিন্ন আর কে অতিক্রম করতে পারেন? সত্য বলছি, আজ আমি পাণ্ডবদের কোনও মহারথকে নিপাতিত করব। আমি এমন ব্যূহ রচনা করব যা দেবতারাও ভেদ করতে পারেন না। তুমি কোনও উপায়ে অর্জুনকে সরিয়ে রেখো।

 পরদিন সংশপ্তকগণ দক্ষিণ দিকে গিয়ে পুনর্বার অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন, অর্জুনও তাঁদের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধে নিরত হলেন। দ্রোণ চক্রব্যূহ নির্মাণ ক’রে তেজস্বী রাজপুত্রগণকে যথাস্থানে স্থাপিত করলেন। তাঁরা সকলেই রক্ত বসন, রক্ত ভূষণ ও রক্ত পতাকায় শোভিত হলেন এবং মাল্যধারণ ক’রে অগুরু-চন্দনে চর্চিত হয়ে অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চললেন। দুর্যোধনের পত্র লক্ষ্মণ এই দশ সহস্র যোদ্ধার অগ্রবর্তী হলেন। কৌরবসেনার মধ্যদেশে দুর্যোধন কর্ণ কৃপ ও দুঃশাসন, এবং সম্মুখভাগে সেনাপতি দ্রোণ, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, অশ্বত্থামা, ধৃতরাষ্ট্রের ত্রিশ জন পুত্র, শকুনি, শল্য ও ভূরিশ্রবা রইলেন।

 দ্রোণকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না এই স্থির করে যুধিষ্ঠির অভিমন্যুর উপর অত্যন্ত গুরুভার অর্পণ করলেন। তিনি তাঁকে বললেন, বৎস, অর্জুন ফিরে এসে যাতে আমাদের নিন্দা না করেন এমন কার্যকর। আমরা চক্রব্যূহ ভেদের প্রণালী কিছুই জানি না, কেবল অর্জুন কৃষ্ণ প্রদ্যুম্ন আর তুমি এই চার জন চক্রব্যূহ ভেদ করতে পার। তোমার পিতৃগণ মাতুলগণ এবং সমস্ত সৈন্য তোমার নিকট বর প্রার্থনা করছে, তুমি দ্রোণের চক্রব্যূহ ভেদ কর।

 অভিমন্যু বললেন, পিতৃগণের জয়কামনায় আমি অবিলম্বে দ্রোণের ব্যূহমধ্যে প্রবেশ করব। কিন্তু পিতা আমাকে প্রবেশের কৌশলই শিখিয়েছেন, যদি কোনও বিপদ হয় তবে ব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে আমি পারব না। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস তুমি ব্যূহ ভেদ করে আমাদের জন্য দ্বার ক’রে দাও, আমরা তোমার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ ক’রে তোমাকে রক্ষা করব। ভীম বললেন, বৎস, ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি ও আমি তোমার অনুসরণ করব, পাঞ্চাল কেকয় মৎস্য প্রভৃতি যোদ্ধারাও যাবেন, তুমি একবার ব্যূহ ভেদ করলে আমরা বিপক্ষের প্রধান প্রধান যোদ্ধাদের বধ ক’রে ব্যূহ বিধ্বস্ত করব। অভিমন্যু বললেন, পতঙ্গ যেমন জ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করে, আমি সেইরূপ দুর্ধর্ষ দ্রোণসৈন্যের মধ্যে প্রবেশ করব। সকলেই দেখতে পাবে, বালক হ’লেও আমি সংগ্রামে দলে দলে শত্রুসৈন্য ধ্বংস করব।

 যুধিষ্ঠির আশীর্বাদ করলেন। অভিমন্যু তাঁর সারথিকে বললেন, সুমিত্র, তুমি দ্রোণসৈন্যের দিকে শীঘ্র রথ নিয়ে চল। সারথি বললে, আয়ুষ্মান, পাণ্ডবগণ আপনার উপর গুরুভার দিয়েছেন, আপনি বিবেচনা করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন। দ্রোণাচার্য অস্ত্রবিশারদ পরিশ্রমী কৃতী যোদ্ধা, আর আপনি সুখে পালিত, যুদ্ধেও অনভিজ্ঞ। অভিমন্যু সহাস্যে বললেন, সারথি, দ্রোণ ও সমগ্র ক্ষত্রমণ্ডলকে আমি ভয় করি না, ঐরাবতে আরূঢ় ইন্দ্রের সঙ্গেও আমি যুদ্ধ করতে পারি। বিশ্বজয়ী মাতুল কৃষ্ণ বা পিতা অর্জুন যদি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেন তথাপি আমি ভয় পাব না। তুমি বিলম্ব ক’রো না, অগ্রসর হও। তখন সারথি সুমিত্র অপ্রসন্নমনে রথের অশ্বদের দ্রুতবেগে চালনা করলে, পাণ্ডবগণ পিছনে চললেন। সিংহশিশু যেমন হস্তিদলের প্রতি ধাবিত হয়, অভিমন্যু সেইরূপ দ্রোণ প্রভৃতি মহারথগণের প্রতি ধাবিত হলেন। তিনি অল্প দূরে গেলেই দুই পক্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হ’ল।

 দ্রোণের সমক্ষেই অভিমন্যু ব্যূহ ভেদ করে ভিতরে গেলেন এবং কুরুসৈন্য ধ্বংস করতে লাগলেন। দুর্যোধন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে অভিমন্যুকে বাধা দিতে এলেন। দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপ কর্ণ শল্য প্রভৃতি শরবর্ষণ ক’রে অভিমন্যুকে আচ্ছন্ন করলেন। অভিমন্যুর শরাঘাতে শল্য মূর্ছিত হয়ে রথের উপর ব’সে পড়লেন, কৌরবসৈন্য পালাতে লাগল। শল্যের ভ্রাতা অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে নিহত হলেন।

 দ্রোণ হৃষ্ট হয়ে উৎফুল্লনয়নে কৃপকে বললেন, এই সুভদ্রানন্দন অভিমন্যু আজ যুধিষ্ঠিরাদিকে আনন্দিত করবে। এর তুল্য ধনুর্ধর আর কেউ আছে এমন মনে হয় না, এ ইচ্ছা করলেই আমাদের সেনা সংহার করতে পারে, কিন্তু কোনও কারণে তা করছে না। দ্রোণের এই কথায় দুর্যোধন বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ দুঃশাসন শল্য প্রভৃতিকে বললেন, সকল ক্ষত্রিয়ের আচার্য শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞ দ্রোণ অর্জুনের ওই মূঢ় পুত্রকে বধ করতে ইচ্ছা করেন না, শিষ্যের পুত্র বলে ওকে রক্ষা করতে চান। বীরগণ, আপনারা ওকে বধ করুন, বিলম্ব করবেন না। দুঃশাসন বললেন, আমিই ওকে মারব।

 দুঃশাসনকে দেখে অভিমন্যু বললেন, ভাগ্যক্রমে আজ ধর্মত্যাগী নিষ্ঠুর কটুভাষী বীরকে যুদ্ধে দেখছি। মূর্খ, তুমি দ্যূতসভায় জয়লাভে উন্মত্ত হয়ে কটুবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে ক্রোধিত করেছিলে, তোমার পাপকর্মের ফলভোগের জন্য আমার কাছে এসে পড়েছ, আজ তোমাকে শাস্তি দিয়ে পাণ্ডবগণের ও দ্রৌপদীর নিকট ঋণমুক্ত হব। এই ব’লে অভিমন্যু দুঃশাসনকে শরাঘাত করলেন। দুঃশাসন মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন, তাঁর সারথি তাঁকে সত্বর রণস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা অভিমন্যুকে দেখে সিংহনাদ ক’রে দ্রোণের সৈন্যগণকে আক্রমণ করলেন।

 তার পর কর্ণের সঙ্গে অভিমন্যুর যুদ্ধ হ’তে লাগল। অভিমন্যু কর্ণের এক ভ্রাতার শিরশ্ছেদন করলেন এবং কর্ণকেও শরাঘাতে নিপীড়িত ক’রে রণভূমি থেকে দূর করলেন। অভিমন্যুর শরবর্ষণে বিশাল কৌরবসৈন্য ভগ্ন হ’ল, যোদ্ধারা পালাতে লাগলেন, অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধু রাজ জয়দ্রথ ভিন্ন আর কেউ রইলেন না। দ্রৌপদীহরণের পর ভীমের হস্তে নিগৃহীত হয়ে জয়দ্রথ মহাদেবের আরাধনা ক’রে এই বর পেয়েছিলেন যে অর্জুন ভিন্ন অন্য চার জন পাণ্ডবকে তিনি যুদ্ধে বাধা দিতে পারবেন।

 জয়দ্রথ শরবর্ষণ ক’রে সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাট দ্রুপদ শিখণ্ডী এবং যুধিষ্ঠির ভীম প্রভৃতিকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। অভিমন্যু ব্যূহপ্রবেশের যে পথ করেছিলেন জয়দ্রথ তা রুদ্ধ করে দিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধারা দ্রোণসৈন্য ভেদ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু জয়দ্রথ তাঁদের বাধা দিলেন। কুরসৈন্যে বেষ্টিত হয়ে অভিমন্যু একাকী দারুণ যুদ্ধ করতে লাগলেন। শল্যপুত্র রুক্মরথ ও দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ অভিমন্যুর হস্তে নিহত হলেন।

 প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে রুদ্ধ হয়ে দুর্যোধন স্বপক্ষের বীরগণকে উচ্চস্বরে বললেন, আপনারা অভিমন্যুকে বধ করুন। তখন দ্রোণ রূপ কর্ণ অশ্বত্থামা বৃহদ্‌বল ও কৃতবর্মা এই ছয় রথী অভিমন্যুকে বেষ্টন করলেন। কোশলরাজ বৃহদ্‌বল এবং আরও অনেক যোদ্ধা অভিমন্যুর বাণে নিহত হলেন। দ্রোণ বললেন, কুমার অভিমন্যু তার পিতার ন্যায় সর্ব দিকে দ্রুত বিচরণ ক’রে এত ক্ষিপ্রহস্তে শর সন্ধান ও মোচন করছে যে কেবল তার মণ্ডলাকার ধনুই দেখা যাচ্ছে। সুভদ্রানন্দনের শরক্ষেপণে আমার প্রাণসংশয় আর মোহ হ’লেও আমি অতিশয় আনন্দলাভ করছি, অর্জুনের সঙ্গে এর প্রভেদ দেখছি না।

 কর্ণ শরাহত হয়ে দ্রোণকে বললেন, রণস্থলে থাকা আমার কর্তব্য, শুধু এই কারণে অভিমন্যু কর্তৃক নিপীড়িত হয়েও আমি এখানে রয়েছি। মৃদু হাস্য করে দ্রোণ বললেন, অভিমন্যুর কবচ অভেদ্য, আমিই ওর পিতাকে কবচধারণের প্রণালী শিখিয়েছিলাম। মহাধনুর্ধর কর্ণ, যদি পার তো ওর ধনু ছিন্ন কর অশ্ব সারথি বিনষ্ট কর, তার পর পশ্চাৎ থেকে ওকে প্রহার কর। যদি বধ করতে চাও তবে ওকে রথহীন ও ধনুহীন কর।

 দ্রোণের উপদেশ অনুসারে কর্ণ পিছন থেকে অভিমন্যুর ধনু ছিন্ন করলেন এবং অশ্ব ও সারথি বধ করলেন। তার পর দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা দুর্যোধন ও শকুনি নিষ্করণ হয়ে রথচ্যুত বালক অভিমন্যুর উপর শরাঘাত করতে লাগলেন। অভিমন্যু খড়্‌গ ও চর্ম নিয়ে রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। দ্রোণ ক্ষুরপ্র অস্ত্রে অভিমন্যুর খড়্‌গের মুষ্টি কেটে ফেললেন। অভিমন্যু চক্র নিয়ে ধাবিত হলেন, বিপক্ষ বীরগণের শরাঘাতে তাও ছিন্ন হ’ল। তখন তিনি গদা নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এই সময়ে দুঃশাসনের পুত্র অভিমন্যুর মস্তকে গদাঘাত করলেন, অভিমন্যু অচেতন হয়ে প’ড়ে গেলেন।

 জগৎ তাপিত ক’রে সূর্য যেমন অস্তে যান সেইরূপ কৌরবসেনা নিপীড়িত ক’রে অভিমন্যু প্রাণশূন্যদেহে ভূপতিত হলেন। গগনচ্যুত চন্দ্রের ন্যায় তাঁকে নিপতিত দেখে গগনচারিগণ বিলাপ করতে লাগলেন। পলায়মান পাণ্ডবসৈন্যগণকে যুধিষ্ঠির বললেন, বীর অভিমন্যু যদ্ধে পরাঙ্‌মুখ হন নি, তিনি স্বর্গে গেছেন। তোমরা স্থির হও, ভয় দূর কর, আমরা যুদ্ধে শত্রুদের জয় করব। কৃষ্ণার্জুনের তুল্য যোদ্ধা অভিমন্যু দশ সহস্র শত্রুসৈন্য ও মহাবল বৃহদ্‌বলকে বধ ক’রে নিশ্চয় ইন্দ্রলোকে গেছেন, তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়। তার পর সায়াহ্নকাল উপস্থিত হ’লে শোকমগ্ন পাণ্ডবগণ এবং রুধিরাক্ত কৌরবগণ যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ শিবিরে প্রস্থান করলেন।


 ধৃতরাষ্ট্রকে অভিমন্যু বধের বৃত্তান্ত শুনিয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি ছ জন মহারথ একজনকে নিপাতিত করলেন—এ আমরা ধর্মসংগত মনে করি না।

৭। যুধিষ্ঠির সকাশে ব্যাস ― মৃত্যুর উপাখ্যান

 অভিমন্যুর শোকে যুধিষ্ঠির বিলাপ করতে লাগলেন—কেশরী যেমন গোমধ্যে প্রবেশ করে সেইরূপ অভিমন্যু আমার প্রিয়কার্য করবার জন্য দ্রোণব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। মহাধনুর্ধর দুর্ধর্ষ শত্রুগণকে পরাস্ত ক’রে দ্রোণসৈন্যসাগর উত্তীর্ণ হয়ে পরিশেষে সে দুঃশাসনপুত্রের হাতে নিহত হ’ল। হা, হৃষীকেশ আর ধনঞ্জয়কে আমি কি বলব? নিজের প্রিয়সাধন ও জয়লাভের জন্য আমি সুভদ্রা অর্জুন ও কেশবের অপ্রিয় কার্য করেছি। বালকের স্থান ভোজনে গমনে শয়নে ও ভূষণে সর্বাগ্রে, কিন্তু তাকে আমরা যুদ্ধেই অগ্রবর্তী করেছিলাম। অর্জুনপুত্রের এই মৃত্যুর পর জয়লাভ রাজ্যলাভ অমরত্ব বা দেবলোকে বাস কিছুই আমার প্রীতিকর হবে না।

 এই সময়ে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস যুধিষ্ঠিরের নিকটে এলেন। তিনি বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ, তোমার তুল্য লোকের বিপদে মোহগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। পুরুষশ্রেষ্ঠ অভিমন্যু যা করেছেন তা বালকে পারে না, তিনি বহু শত্রু বধ ক’রে স্বর্গে গেছেন। দেব দানব গন্ধর্ব সকলেই মৃত্যুর অধীন, এই বিধান অতিক্রম করা যায় না। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, মৃত্যু কেন হয় তা বলুন। ব্যাসদেব বললেন, পুরাকালে অকম্পন রাজাকে নারদ যে ইতিহাস বলেছিলেন তা শোন।

 সত্যযুগে অকম্পন নামে এক রাজা ছিলেন, হরি নামে তাঁর একটি অস্ত্রবিশারদ মেধাবী বলবান পুত্র ছিল। এই রাজপত্র যুদ্ধে নিহত হ’লে অকম্পন সর্বদা শোকাবিষ্ট হয়ে থাকতেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য দেবর্ষি নারদ এই পুত্রশোকনাশক আখ্যান বলেছিলেন।—

 প্রাণিসৃষ্টির পর ব্রহ্মা ভাবতে লাগলেন, এদের সংহার কোন্ উপায়ে হবে। তখন তাঁর ক্রোধপ্রভাবে আকাশে অগ্নি উৎপন্ন হয়ে চরাচর সর্ব জগৎ দগ্ধ করতে লাগল। প্রজাগণের হিতকামনায় মহাদেব ব্রহ্মার শরণ নিলেন। ব্রহ্মা বললেন, পুত্র, তুমি আমার সংকল্পজাত, কি চাও বল। মহাদেব বললেন, প্রভু, আপনার সৃষ্ট প্রজাবর্গ আপনার ক্রোধেই দগ্ধ হচ্ছে, আপনি প্রসন্ন হ’ন। ব্রহ্মা বললেন, আমি অকারণে ক্রুদ্ধ হই নি, দেবী পৃথিবী ভারে আর্ত হয়ে প্রাণিসংহারের নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, কোনও উপায় খুঁজে না পাওয়ায় আমার ক্রোধ জন্মেছিল। মহাদেবের প্রার্থনায় ব্রহ্মা তাঁর ক্রোধজাত অগ্নি স্বদেহে ধারণ করলেন। তখন তাঁর সকল ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে এক পিঙ্গলবর্ণা রক্তাননা রক্তনয়না স্বর্ণকুণ্ডলধারিণী নারী আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, মৃত্যু, তুমি আমার নিয়োগ অনুসারে সকল প্রাণী সংহার কর।

 সরোদনে কৃতাঞ্জলি হয়ে মৃত্যু বললেন, প্রভু, আমি নারী রূপে সৃষ্ট হয়ে কি ক’রে এই ক্রূর কর্ম করব? আমি যাকে মারব তার আত্মীয়রা আমার অনিষ্টচিন্তা করবে, আমি তা ভয় করি। লোকে যখন বিলাপ করবে তখন আমি তাদের প্রিয় প্রাণ হরণ করতে পারব না; আপনি অধর্ম থেকে আমাকে রক্ষা করুন। ব্রহ্মা বললেন, তুমি বিচার ক’রো না, আমার আদেশে সকল প্রাণী সংহার কর, তুমি জগতে অনিন্দিতা হবে।

 মৃত্যু সম্মত হলেন না, ধেনুক ঋষির আশ্রমে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে বর দিতে এলে মৃত্যু বললেন, প্রভু, সুস্থ প্রাণীকে আমি হত্যা করতে চাই না, আমি আর্ত ভীত ও নিরপরাধ, আমাকে অভয় দিন। ব্রহ্মা বললেন, কল্যাণী, তোমার অধর্ম হবে না, তুমি সকল প্রাণী সংহার করতে থাক। সনাতন ধর্ম তোমাকে সর্বপ্রকারে পবিত্র রাখবেন, লোকপাল যম তোমার সহায় হবেন, ব্যাধি সকলও তোমাকে সাহায্য করবে। আমার ও দেবগণের বরে তুমি নিষ্পাপ হয়ে খ্যাতিলাভ করবে। মৃত্যু বললেন, আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য, কিন্তু লোভ ক্রোধ অসূয়া দ্রোহ মোহ অলজ্জা ও পুরুষ আচরণ—এই সকল দোষে দেহ বিদ্ধ হ’লেই আমি সংহার করব। ব্রহ্মা বললেন, মৃত্যু, তাই হবে, তোমার অশ্রুবিন্দু আমার হাতে পড়েছিল, তাই ব্যাধি হয়ে প্রাণিদের বধ করবে, তোমার অধর্ম হবে না।

 তার পর নারদ অকম্পনকে বললেন, মহারাজ, ব্রহ্মার আজ্ঞায় মৃত্যুদেবী অনাসক্তভাবে অন্তকালে প্রাণীদের প্রাণ হরণ করেন, অতএব তুমি নিষ্ফল শোক ক’রো না। জীব পরলোকে গেলে ইন্দ্রিয়সকল সূক্ষ্মশরীরে অবস্থান করে, কর্মক্ষয় হ’লে আবার অন্য শরীর আশ্রয় ক’রে মর্ত্যে আসে। প্রাণবায়ু, দেহ ভেদ করে বহির্গত হ’লে আর ফিরে আসে না। তোমার পুত্র স্বর্গ লাভ করে বীরলোকে আনন্দে আছে, মর্ত্যের দুঃখ ত্যাগ ক’রে স্বর্গে পুণ্যবানদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

৮। সুবর্ণষ্ঠীবীর উপাখ্যান

 মৃত্যুর উপাখ্যান শোনার পর যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আপনি আমাকে পুণ্যকর্মা ইন্দ্রতুল্যবিক্রমশালী নিষ্পাপ সত্যবাদী রাজর্ষিদের কথা বলুন। ব্যাসদেব এই উপাখ্যান বললেন।—

 একদিন দেবর্ষি নারদ ও পর্বত তাঁদের সখা শ্বিত্যপুত্র রাজা সৃঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁরা সুখে উপবিষ্ট হ’লে একটি শুচিস্মিতা বরবর্ণিনী কন্যা তাঁদের কাছে এলেন। পর্বত ঋষি জিজ্ঞাসা করলেন, এই চঞ্চলনয়না সর্বলক্ষণযযুক্তা কন্যাটি কার? এ কি সূর্যের দীপ্তি, না অগ্নির শিখা, না শ্রী হ্রী কীর্তি ধৃতি পুষ্টি সিদ্ধি, কিংবা চন্দ্রমার প্রভা? সৃঞ্জয় বললেন, এ আমারই কন্যা। নারদ বললেন, রাজা, যদি সুমহৎ শ্রেয় লাভ করতে চাও তবে এই কন্যাটিকে ভার্যারূপে আমাকে দাও। তখন পর্বত ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে নারদকে বললেন, আমি পূর্বে যাকে মনে মনে বরণ করেছি তাকেই তুমি চাচ্ছ! ব্রাহ্মণ, তুমি আর নিজের ইচ্ছানুসারে স্বর্গে যেতে পারবে না। নারদ বললেন, মন্ত্রপাঠাদির দ্বারা বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না, সপ্তপদীগমনেই সম্পূর্ণ হয়। এই কন্যা আমার ভার্যা হবার পূর্বেই তুমি আমাকে শাপ দিলে, অতএব তুমিও আমার সঙ্গে ভিন্ন স্বর্গে যেতে পারবে না। পরস্পর অভিশাপের পর নারদ ও পর্বত সঞ্জয়ের নিকটেই বাস করতে লাগলেন।

 রাজা সৃঞ্জয় তপস্যাপরায়ণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণকে সেবা দ্বারা তুষ্ট ক’রে বর চাইলেন, যেন তাঁর গুণবান যশস্বী কীর্তিমান তেজস্বী ও শত্রুনাশন পুত্র হয়। বর পেয়ে যথাকালে তাঁর একটি পুত্র হ’ল। এই পুত্রের মূত্র পুরীষ ক্লেদ ও স্বেদ সুবর্ণনয়, সেজন্য তার নাম হ’ল সুবর্ণষ্ঠীবী। রাজা ইচ্ছামত সকল বস্তু স্বর্ণে রূপান্তরিত করতে লাগলেন, কালক্রমে তাঁর গৃহ প্রাকার দুর্গ ব্রাহ্মণাবাস শয্যা আসন যান স্থালী প্রভৃতি সবই স্বর্ণময় হল। এক দল দস্যু লুব্ধ হয়ে স্বর্ণের আকরস্বরূপ রাজপুত্রকে হরণ ক’রে বনে নিয়ে গেল। তারা সুবর্ণষ্ঠীবীকে কেটে খণ্ড খণ্ড করলে, কিন্তু তাদের কোনও অর্থলাভ হ’ল না। রাজপুত্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজার সমস্ত ধন লুপ্ত হ’ল, মূর্খ দস্যুরাও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পরস্পরকে বধ ক’রে নরকে গেল।

 সৃঞ্জয় রাজা পুত্রশোকে মৃতপ্রায় হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। নারদ তাঁকে বললেন, আমরা ব্রহ্মবাদী বিপ্রগণ তোমার গৃহে বাস করছি, আর তুমি কাম্য বিষয়ের ভোগে অতৃপ্ত থেকেই মরবে! যজ্ঞ বেদাধ্যয়ন দান আর তপস্যায় যাঁরা তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এমন বহু রাজার মৃত্যু হয়েছে, অতএব অযজ্ঞকারী অদাতা পুত্রের মৃত্যুর জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়। তার পর নারদ উদাহরণ স্বরূপ এই ষোল জন মহাত্মার কথা বললেন।—

 রাজর্ষি মরুত্ত, যাঁর ভবনে দেবতারা পরিবেশন করতেন। রাজা সুহোত্র, যাঁর জন্য পর্জন্যদেব হিরণ্য বর্ষণ করতেন। পুরুর পুত্র জনমেজয়, যিনি প্রতি বার যজ্ঞকালে দশ সহস্র স্বর্ণভূষিত হস্তী, বহু সহস্র সালংকারা কন্যা এবং কোটি বৃষ দক্ষিণা দিতেন। উশীনরপুত্র শিবি, যাঁর যজ্ঞে দধিদুগ্ধের মহাহ্রদ এবং শুভ্র অন্নের পর্বত থাকত। দশরথপুত্র রাম, যিনি সুরাসরের অবধ্য দেবব্রাহ্মণের কণ্টক রাবণকে বধ এবং এগার হাজার বৎসর রাজত্ব ক’রে প্রজাদের নিয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন। ভগীরথ, যাঁকে সমুদ্রগামিনী গঙ্গা পিতা ব’লে স্বীকার করেছিলেন। দিলীপ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে বসুধা দান করেছিলেন এবং যাঁর ভবনে বেদপাঠধ্বনি, জ্যানির্ঘোষ, এবং ‘পান-ভোজন কর’ এই শব্দ কখনও থামত না। যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতা, যিনি আসমুদ্র পৃথিবী ব্রাহ্মণগণকে দান ক’রে পূণ্যলোকে গিয়েছিলেন। নহুষের পুত্র যযাতি, যিনি বহুবিধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় ইচ্ছানুসারে স্বর্গোদ্যানে বিহার করতেন। নাভাগের পুত্র অম্বরীষ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণাস্বরূপ কোষ ও সৈন্য সহ শত সহস্র রাজ্য দান করেছিলেন। রাজা শশবিন্দু, যাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞে এক ক্রোশ উচ্চ তেরটা খাদ্যের পর্বত প্রস্তুত হয়েছিল। অমূর্তরয়ার পুত্র গয়, যিনি অশ্বমেধ যজ্ঞে মণিকঙ্করে খচিত স্বর্ণময় পৃথিবী নির্মাণ ক’রে ব্রাহ্মণগণকে দান করতেন এবং অক্ষয় বট ও পবিত্র ব্রহ্মসরোবরের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। সংস্কৃতের পুত্র রন্তিদেব, যাঁর দু লক্ষ পাচক ছিল, যাঁর কাছে পশুর দল স্বর্গলাভের জন্য নিজেরাই আসত, যাঁর গৃহে অতিথি এলে একুশ হাজার বৃষ হত্যা করা হ’ত, কিন্তু তাতেও পর্যাপ্ত হ’ত না, ভোজনের সময় পাচকরা বলত, আজ মাংস কম, আপনারা বেশী ক’রে সূপ (দাল) খান। দুষ্মন্তের পুত্র ভরত, যিনি অত্যন্ত বলবান ছিলেন এবং যমুনা সরস্বতী ও গঙ্গার তীরে বহু সহস্র যজ্ঞ করেছিলেন। বেণ রাজার পুত্র পৃথু যাঁর আজ্ঞায় পৃথিবীকে দোহন ক’রে বৃক্ষ পর্বত দেবাসুর মনুষ্য প্রভৃতি অভীষ্ট বিষয় লাভ করেছিলেন। এই মহাত্মারা সকলেই মরেছেন। জমদগ্নিপুত্র পরশুরামও মরবেন, যিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন এবং কশ্যপকে সপ্তদ্বীপা বসমতী দান ক’রে মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।

 নারদ সৃঞ্জয়কে বললেন, আমার কথা তুমি শুনলে কি? না শূদ্রার ব্রাহ্মণ পতি শ্রাদ্ধ করলে যেমন নিষ্ফল হয়, আমার বাক্যও সেইরূপ নিষ্ফল হ’ল? সঞ্জয় করজোড়ে বললেন, সূর্যের কিরণে যেমন অন্ধকার দূর হয় সেইরূপ আপনার আখ্যান শুনে আমার পুত্রশোক দূর হয়েছে। নারদ বললেন, তুমি অভীষ্ট বর চাও, আমাদের কথা মিথ্যা হবে না। সৃঞ্জয় বললেন, ভগবান, আপনি প্রসন্ন হয়েছেন তাতেই আমি হৃষ্ট হয়েছি। নারদ বললেন, তোমার পুত্র দস্যুহস্তে বৃথা নিহত হয়েছে, তাকে কষ্টময় নরক থেকে উদ্ধার ক’রে তোমাকে দান করছি। তখন নারদের বরে সুবর্ণষ্ঠীবী পুনর্জীবিত হ’ল।

 উপাখ্যান শেষ ক’রে ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন, সৃঞ্জয়ের পুত্র বালক, সে ভয়ার্ত ও যুদ্ধে অক্ষম ছিল, কৃতকর্মা না হয়ে যজ্ঞ না ক’রে নিঃসন্তান অবস্থায় মরেছিল, এজন্যই সে পুনর্জীবন পেয়েছিল। কিন্তু অভিমন্যু মহাবীর ও কৃতকর্মা, তিনি বহু সহস্র শত্রুকে সন্তপ্ত ক’রে সম্মুখ সমরে নিহত হয়ে অক্ষয় স্বর্গলোকে গেছেন, সেখান থেকে কেউ মর্ত্যে আসতে চায় না। অতএব অর্জুনের পুত্রকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তিনি অমৃতকিরণে উদ্ভাসিত হয়ে চন্দ্রের ন্যায় বিরাজ করছেন, তাঁর জন্য শোক করা উচিত নয়। মহারাজ, তুমি ধৈর্য ধারণ ক’রে শত্রু জয় কর। এই ব’লে ব্যাস চ’লে গেলেন।