বিষয়বস্তুতে চলুন

মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/আরণ্যকপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

বনপর্ব

॥আরণ্যকপর্বাধ্যায়॥

১। যুধিষ্ঠির ও অনুগামী বিপ্রগণ—সূর্যদত্ত তাম্রস্থালী

 পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হস্তিনাপুর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে উত্তরমুখে যাত্রা করলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি চোদ্দ জন ভৃত্য স্ত্রীদের নিয়ে রথে চ’ড়ে তাঁদের পশ্চাতে গেল। পুরবাসীরা কৃতাঞ্জলি হয়ে পাণ্ডবগণকে বললে, আমাদের ত্যাগ ক’রে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? নিষ্ঠুর শত্রুরা অধর্ম ক’রে আপনাদের জয় করেছে এই সংবাদ শুনে উদ্‌বিগ্ন হয়ে আমরা এসেছি। আমরা আপনাদের ভক্ত অনুরক্ত ও হিতকামী, কুরাজার অধিষ্ঠিত রাজ্যে আমরা বাস করব না। ধর্ম-অর্থ-কাম এই ত্রিবর্গের সাধক এবং লোকাচারসম্মত ও বেদোক্ত সকল গুণ আপনাদের আছে, আমরা আপনাদের সঙ্গেই থাকব।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা ধন্য, ব্রাহ্মণপ্রমুখ প্রজারা আমাদের স্নেহ করেন, তাই যে গুণ আমাদের নেই তাও আছে বলছেন। আমরা আপনাদের কাছে এই অনুরোধ করছি, স্নেহ ও অনুকম্পার বশবর্তী হয়ে অন্যথা করবেন না।—পিতামহ ভীষ্ম, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, আমাদের জননী, এবং বহু সুহৃৎ হস্তিনাপুরে রয়েছেন, তাঁরা শোকে বিহ্বল হয়ে আছেন, আপনারা তাঁদের সযত্নে পালন করুন, তাতেই আমাদের মঙ্গল হবে। আপনারা বহুদূরে এসে পড়েছেন, এখন ফিরে যান। আমাদের স্বজনবর্গের ভার আপনাদের উপর রইল, তাঁদের প্রতি স্নেহদৃষ্টি রাখবেন, তাতেই আমরা তুষ্ট হব।

 ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথায় প্রজাবর্গ ‘হা রাজা’ ব’লে আর্তনাদ ক’রে উঠল এবং অনিচ্ছায় বিদায় নিয়ে শোকাতুরচিত্তে ফিরে গেল। তারা চ’লে গেলে পাণ্ডবগণ রথারোহণে যাত্রা করলেন এবং দিনশেষে গঙ্গাতীরে প্রমাণ নামক মহাবটবৃক্ষের নিকট উপস্থিত হলেন। সেই রাত্রিতে তাঁরা কেবল জলপান ক’রে রইলেন। শিষ্য ও পরিজন সহ কয়েকজন ব্রাহ্মণ পাণ্ডবদের অনুগমন করেছিলেন, তাঁরা সেই রমণীয় ও ভয়সংকুল সন্ধ্যাকালে, হোমাগ্নি জ্বেলে বেদধ্বনি ও বিবিধ আলাপ করতে লাগলেন এবং মধুর বাক্যে যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দিয়ে সমস্ত রাত্রি যাপন করলেন।

 পরদিন প্রভাতকালে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের বললেন, আমরা হৃতসর্বস্ব হয়ে দুঃখিতমনে বনে যাচ্ছি, সেখানে ফলমূল আর মাংস খেয়ে থাকব। হিংস্রপ্রাণিসমাকুল বনে বহু কষ্ট, আপনারা এখন ফিরে যান। ব্রাহ্মণেরা বললেন, রাজা, আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হবে। আমাদের ভরণপোষণের জন্য ভাববেন না, নিজেরাই আহার সংগ্রহ ক’রে নেব। আমরা ধ্যান ও জপ ক’রে আপনার মঙ্গলবিধান করব, মনোহর কথায় চিত্তবিনোদন করব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনারা আহার সংগ্রহ ক’রে ভোজন করবেন তা আমি কি ক’রে দেখব? আপনারা ক্লেশভোগের যোগ্য নন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের ধিক, আমাদের প্রতি স্নেহবশেই আপনারা ক্লেশভোগ করতে চাচ্ছেন।

 যোগ ও সাংখ্য শাস্ত্রে বিশারদ শৌনক নামক এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, রাজা, সহস্র শোকস্থান[] আছে, শত ভয়স্থান[] আছে, মূর্খরাই প্রতিদিন তাতে অভিভূত হয়, পণ্ডিতজন হন না। শাস্ত্রসম্মত অমঙ্গলনাশিনী বুদ্ধি আপনার আছে, অর্থ কষ্ট, দুর্গমস্থানে বাস বা স্বজনবিচ্ছেদের জন্য শারীরিক বা মানসিক দুঃখে অবসন্ন হওয়া আপনার উচিত নয়। মহাত্মা জনক বলেছেন, রোগ, শ্রম, অপ্রিয় বিষয়ের প্রাপ্তি ও প্রিয় বিষয়ের বিরহ, এই চার কারণে শারীরিক দুঃখ উৎপন্ন হয়। শারীরিক দুঃখের প্রতিবিধান করা এবং মানসিক দুঃখ সম্বন্ধে চিন্তা না করাই দুঃখনিবৃত্তির উপায়। অগ্নি যেমন জলে নির্বাপিত হয় সেইরূপ জ্ঞান দ্বারা মানসিক দুঃখ দূরীকৃত হয়, মন প্রশান্ত হ’লে শারীরিক কষ্টেরও উপশম হয়। স্নেহ[]ই মানসিক দঃখের মূল, দুঃখ ভয় শোক হর্ষ আয়াস সবই স্নেহ থেকে উৎপন্ন। জ্ঞানী যোগী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি স্নেহে লিপ্ত হন না। আপনি কোনও বিষয় স্পৃহা করবেন না, যদি ধর্ম চান তবে স্পৃহা ত্যাগ করুন।

 যুধিষ্ঠির বললেন, ব্রাহ্মণদের ভরণের জন্যই আমি অর্থ কামনা করি, আমার নিজের লোভ নেই। অনুগত জনকে পালন না ক’রে আমার ন্যায় গৃহাশ্রমবাসী কি ক’রে থাকতে পারে? তৃণাসন ভূমি জল ও মধুর বাক্য, এই চারটির অভাব সজ্জনের গৃহে কখনও হয় না। আর্ত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্তকে আসন, তৃষিতকে জল এবং ক্ষুধিতকে আহার দিতে হবে। গৃহস্থের পক্ষে এইরূপ আচরণই পরম ধর্ম।

 শৌনক বললেন, মহারাজ এই বেদবচন আছে—কর্ম কর, ত্যাগও কর; অতএব কোনও ধর্মকার্য কামনাপূর্বক করা উচিত নয়। ব্রাহ্মণদের ভরণের জন্য আপনি তপ ও যোগ দ্বারা সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করুন, সিদ্ধ ব্যক্তি যা ইচ্ছা করেন তপস্যার প্রভাবে তাই করতে পারেন।

 যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের কাছে গিয়ে পুরোহিত ধৌম্যকে বললেন, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ আমার সঙ্গে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি দুঃখী, তাঁদের পালন করতে অক্ষম, পরিত্যাগ করতেও পারছি না। কি কর্তব্য বলুন! ক্ষণকাল চিন্তা ক’রে ধৌম্য বললেন, সূর্যই সর্বভূতের পিতা, প্রাণীদের প্রাণধারণের নিমিত্ত তিনিই অন্নস্বরূপ, তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও। ধৌম্য সূর্যের অষ্টোত্তর শত নাম শিখিয়ে দিলে যুধিষ্ঠির পুষ্প ও নৈবেদ্য দিয়ে সূর্যের পূজা করলেন এবং কঠোর তপস্যা ও স্তবপাঠে রত হলেন। সূর্যদেব প্রসন্ন হয়ে দীপ্যমান মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বললেন, রাজা, তোমার যা অভীষ্ট আছে সবই তুমি পাবে, বনবাসের স্বাদশ বৎসর আমি তোমাকে অন্ন দেব। এই তাম্রময় স্থালী নাও, পাঞ্চালী পাকশালায় গিয়ে এই পাত্রে ফল মূল আমিষ শাকাদি রন্ধন করে যতক্ষণ অনাহারে থাকবেন ততক্ষণ চতুর্বিধ অন্ন অক্ষয় হয়ে থাকবে। চতুর্দশ বৎসর পরে তুমি আবার রাজ্যলাভ করবে। এই ব’লে সূর্য অন্তর্হিত হলেন।

 বরলাভ ক’রে যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে প্রণাম এবং ভ্রাতাদের আলিঙ্গন করলেন, এবং তখনই দ্রৌপদীর সঙ্গে পাকশালায় গিয়ে রন্ধন করলেন। চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় এই চতুর্বিধ খাদ্য প্রস্তুত হ’ল, অল্প হলেও তা প্রয়োজনমত বাড়তে লাগল। ব্রাহ্মণভোজন শেষ হ’লে যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতারা খেলেন, তার পর বিঘস নামক অবশিষ্ট অন্ন যুধিষ্ঠির এবং সর্বশেষে দ্রৌপদী খেলেন। তখন অন্ন নিঃশেষ হয়ে গেল। সূর্যের বরপ্রভাবে এইরূপে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে অভিলষিত বস্তু দান করতে লাগলেন। কিছু কাল পরে পাণ্ডবগণ ধৌম্য ও অন্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কাম্যকবনে যাত্রা করলেন।

২। ধৃতরাষ্ট্রের অস্থির মতি

 পাণ্ডবদের বনযাত্রার পর প্রজ্ঞাচক্ষু[] ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, তোমার বুদ্ধি নির্মল, ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তুমি জান, কুরুবংশীয়গণকে তুমি সমদৃষ্টিতে দেখ; যাতে কুরুপাণ্ডবের হিত হয় এমন উপায় বল। বিদুর বললেন, মহারাজ, অর্থ কাম ও মোক্ষ এই ত্রিবর্গের মূল ধর্ম; রাজ্যেরও মূল ধর্ম। সেই ধর্মকে বঞ্চিত ক’রে শকুনি প্রভৃতি পাপাত্মারা যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেছে। আপনি পূর্বে যেমন পাণ্ডবদের সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এখন আবার সেইরূপ দিন। পাণ্ডবদের তোষণ এবং শকুনির অবমাননা—এই আপনার সর্বপ্রধান কার্য, এই যদি করেন তবেই আপনার পুত্রদের কিছু রাজ্য রক্ষা পাবে। দুর্যোধন যদি সন্তুষ্ট হয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে একযোগে রাজ্য ভোগ করে তবে আপনার দুঃখ থাকবে না। যদি তা না হয় তবে দুর্যোধনকে নিগৃহীত ক’রে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যের আধিপত্য দিন, দুর্যোধন শকুনি আর কর্ণ পাণ্ডবগণের অনুগত হ’ক, দুঃশাসন সভামধ্যে ভীমসেন আর দ্রৌপদীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুক। এ ছাড়া আর কি পরামর্শ আমি দিতে পারি?

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তুমি পূর্বে দ্যূতসভায় যা বলেছিলে এখন আবার তাই বলছ। তোমার কথা পাণ্ডবদের হিতকর, আমাদের অহিতকর। পাণ্ডবদের জন্য নিজের পুত্রকে কি ক’রে ত্যাগ করব? পাণ্ডবরাও আমার পুত্র বটে, কিন্তু দুর্যোধন আমার দেহ থেকে উৎপন্ন। বিদুর, আমি তোমার বহু সম্মান করে থাকি, কিন্তু তুমি যা বলছ সবই কুটিলতাময়। তুমি চ’লে যাও বা থাক, যা ইচ্ছা কর। অসতী স্ত্রীর সঙ্গে মিষ্ট ব্যবহার করলেও সে স্বামিত্যাগ করে। ধৃতরাষ্ট্র এই ব’লে সহসা অন্তঃপুরে চ’লে গেলেন। বিদুর হতাশ হয়ে পাণ্ডবদের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।


 পাণ্ডবগণ পশ্চিম দিকে যাত্রা ক’রে সরস্বতী নদীর তীরে সমতল মরুপ্রদেশের নিকটবর্তী কাম্যকবনে এলেন। পশুপক্ষিসমাকুল সেই বনে তাঁরা মুনিগণের সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। বিদুর রথারোহণে আসছেন দেখে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, ইনি কি আবার আমাদের দ্যূতক্রীড়ায় ডাকতে এসেছেন? শকুনি কি আমাদের অস্ত্রশস্ত্রও জয় করে নিতে চায়?

 যুধিষ্ঠিরাদি আসন থেকে উঠে বিদুরের সংবর্ধনা করলেন। বিশ্রামের পর বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্র আমার কাছে হিতকর মন্ত্রণা চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার কথা তাঁর রুচিকর হয় নি, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে বললেন, যেখানে ইচ্ছা চ’লে যাও, রাজ্যশাসনের জন্য তোমার সাহায্য আর আমি চাই না। যুধিষ্ঠির, ধৃতরাষ্ট্র আমাকে ত্যাগ করেছেন, এখন আমি তোমাকে সদুপদেশ দিতে এসেছি। পূর্বে তোমাকে যা বলেছিলাম এখনও তাই বলছি।—শত্রু কর্তৃক নির্যাতিত হয়েও যে সহিষ্ণু হয়ে কালপ্রতীক্ষা করে সে একাকীই সমস্ত পৃথিবী ভোগ করে। সহায়দের সঙ্গে যে সমভাবে বিষয় ভোগ করে, সহায়রা তার দুঃখেরও অংশভাগী হয়। সহায়সংগ্রহের এই উপায়, তাতেই রাজ্যলাভ হয়। পাণ্ডুপুত্র, অন্নাদি সমস্তই সমভাবে সহায়দের সঙ্গে ভোগ করবে, অনর্থক কথা বলবে না, আত্মশ্লাঘা করবে না, এইরূপ আচরণেই রাজারা সমৃদ্ধি লাভ করেন।


 বিদূর চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের অনুতাপ হ’ল। তিনি সঞ্জয়কে বললেন, বিদুর আমার ভ্রাতা সুহৃৎ এবং সাক্ষাৎ ধর্ম, তাঁর বিচ্ছেদে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, তুমি শীঘ্র তাঁকে নিয়ে এস। যাও সঞ্জয়, তিনি বেঁচে আছেন কিনা দেখ। আমি পাপী তাই ক্রোধবশে তাঁকে দূর ক’রে দিয়েছি, তিনি না এলে আমি প্রাণত্যাগ করব। সঞ্জয় অবিলম্বে কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর সঞ্জয় বললেন, ক্ষত্তা, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে স্মরণ করেছেন, পাণ্ডবদের অনুমতি নিয়ে সত্বর হস্তিনাপুরে চলুন, রাজার প্রাণরক্ষা করুন।

 বিদুর ফিরে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে ক্রোড়ে নিয়ে মস্তক আঘ্রাণ ক’রে বললেন, ধর্মজ্ঞ, আমার ভাগ্যক্রমে তুমি ফিরে এসেছ, তোমার জন্য আমি দিবারাত্র অনিদ্রায় আছি, অসুস্থ বোধ করছি। যা বলেছি তার জন্য ক্ষমা কর। বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনি আমার পরম গুরু, আপনাকে দেখবার জন্য আমি ব্যগ্র হয়ে সত্বর চ’লে এসেছি। আপনার আর পাণ্ডুর পুত্রেরা আমার কাছে সমান পাণ্ডবরা এখন দুর্দশাগ্রস্ত তাই আমার মন তাদের দিকে গেছে।

৩। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে ব্যাস ও মৈত্রেয়

 বিদুর আবার এসেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন শুনে দুর্যোধন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসনকে বললেন, পাণ্ডবদের যদি ফিরে আসতে দেখি তবে আমি বিষ খেয়ে, উদ্‌বন্ধনে, অস্ত্রাঘাতে বা অগ্নিপ্রবেশে প্রাণ বিসর্জন দেব। শকুনি বললেন, তুমি মূর্খের ন্যায় ভাবছ কেন? পাণ্ডবরা প্রতিজ্ঞা ক’রে গেছে, তারা সত্যনিষ্ঠ, তোমার পিতার অনুরোধে ফিরে আসবে না। কর্ণ বললেন, যদি ফিরে আসে তবে আবার দ্যূতক্রীড়ায় তাদের জয় করবেন। দুর্যোধন তুষ্ট হলেন না, মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন কর্ণ বললেন, আমরা দুর্যোধনের প্রিয়কামনায় কেবল কিংকরের ন্যায় কৃতাঞ্জলি হ’য়ে থাকব, অথচ স্বাধীনতার অভাবে প্রকৃত প্রিয়কার্য করতে পারব না, এ ঠিক নয়। আমরা সশস্ত্র হয়ে রথারোহণে গিয়ে পাণ্ডবদের বধ করব। সকলেই কর্ণের এই প্রস্তাবের প্রশংসা করলেন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পৃথক পৃথক রথে চ’ড়ে যাত্রার উপক্রম করলেন।

 কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিব্যদৃষ্টিতে সমস্ত জানতে পেরে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে বললেন, পাণ্ডবগণ কপটদ্যূতে পরাজিত হয়ে বনে গেছে—এই ঘটনা আমার প্রীতিকর নয়। তারা তের বৎসর পরে ফিরে এসে কৌরবদের উপর বিষ মোচন করবে। তোমার পাপাত্মা মূঢ় পুত্রকে বারণ কর, সে পাণ্ডবদের মারতে গিয়ে নিজেই প্রাণ হারাবে। রাজা, পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের এই বিদ্বেষ যদি তুমি উপেক্ষা কর তবে ঘোর বিপদ উৎপন্ন হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভগবান, দ্যূতক্রীড়ায় আমার এবং ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর গান্ধারীর মত ছিল না, দৈবের আকর্ষণেই আমি তা হ’তে দিয়েছিলাম। নির্বোধ দুর্যোধনের স্বভাব জেনেও পুত্রস্নেহবশে তাকে ত্যাগ করতে পারি না।

 ব্যাসদেব বললেন, তোমার কথা সত্য, পুত্রের চেয়ে প্রিয় কিছু নেই। আমি একটি আখ্যান বলছি শোন।—পুরাকালে একদা গোমাতা সুরভীকে কাঁদতে দেখে ইন্দ্র তাঁর শোকের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সুরভী বললেন, দেখুন আমার ওই দুর্বল ক্ষুদ্র পুত্র লাঙ্গলের ভারে পীড়িত হয়ে আছে, কৃষক তাকে কষাঘাত করছে। দুই বৃষের মধ্যে একটি বলবান, সে অধিক ভার বইছে: অন্যটি দুর্বল ও কৃশ, তার দেহের সর্বত্র শিরা দেখা যাচ্ছে, বার বার কশাহত হয়েও সে ভার বইতে পারছে না। তার জন্যই আমি শোকার্ত হয়েছি। ইন্দ্র বললেন, তোমার তো সহস্র সহস্র পুত্র নিপীড়িত হয়, একটির জন্য এত কৃপা কেন? সুরভী বললেন, সহস্র পুত্রকে আমি সমদৃষ্টিতে দেখি, কিন্তু যে দীন ও সৎ তারই উপর আমার অধিক কৃপা। তখন ইন্দ্র প্রবল জলবর্ষণ করে কৃষককে বাধা দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, সুরভীর ন্যায় তুমিও সকল পুত্রকে সমভাবে দেখো, কিন্তু দুর্বলকে অধিক কৃপা ক’রো। পুত্র, তুমি পাণ্ডু ও বিদুর সকলেই আমার কাছে সমান। তোমার একশত এক পুত্র; পাণ্ডুর কেবল পাঁচ পুত্র, তারা হীনদশাগ্রস্ত ও দুঃখার্ত। কি উপায়ে তারা জীবিত থাকবে এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে এই চিন্তায় আমি সন্তপ্ত আছি। যদি কৌরবগণের জীবনরক্ষা করতে চাও তবে দুর্যোধন যাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তভাবে থাকে সেই চেষ্টা কর।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ মুনি, আপনি যা বললেন তা সত্য। যদি আমরা আপনার অনুগ্রহের যোগ্য হই তবে আপনি নিজেই দুরাত্মা দুর্যোধনকে উপদেশ দিন। ব্যাস বললেন, ভগবান মৈত্রেয় ঋষি পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা ক’রে এখানে আসছেন, তিনিই দুর্যোধনকে উপদেশ দেবেন। এই ব’লে ব্যাস চ’লে গেলেন।

 মুনিশ্রেষ্ঠ মৈত্রেয় এলে ধৃতরাষ্ট্র অর্ঘ্যাদি দিয়ে তাঁর পূজা করলেন। মৈত্রেয় বললেন, মহারাজ, আমি তীর্থ পর্যটন করতে করতে কাম্যকবনে গিয়েছিলাম, সেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমি শুনলাম আপনার পুত্রদের বিভ্রান্তির ফলে দ্যূতরূপে মহাভয় উপস্থিত হয়েছে। আপনি আর ভীষ্ম জীবিত থাকতে আপনার পুত্রদের[] মধ্যে বিরোধ হওয়া উচিত নয়। দ্যূতসভায় দস্যুবৃত্তির ন্যায় যা ঘটেছে তাতে আপনি তপস্বীদের সমক্ষে আর মুখ দেখাতে পারেন না। তার পর মৈত্রেয় মিষ্টবাক্যে দুর্যোধনকে বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার হিতের জন্য বলছি শোন, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ ক’রো না। তাঁরা সকলেই বিক্রমশালী সত্যব্রত ও তেজস্বী এবং হিড়িম্ব বক প্রভৃতি রাক্ষসগণের হন্তা। ব্যাঘ্র যেমন ক্ষুদ্র মৃগকে বধ করে সেইরূপ বলিশ্রেষ্ঠ ভীম কির্মীর রাক্ষসকে বধ করেছেন। আরও দেখ, দিগ্‌বিজয়ের পূর্বে ভীম মহাধনুর্ধর জরাসন্ধকেও যুদ্ধে নিহত করেছেন। বাসুদেব যাঁদের আত্মীয়, ধৃষ্টদ্যুম্নাদি যাঁদের শ্যালক, তাঁদের সঙ্গে কে যুদ্ধ করতে পারে? রাজা দুর্যোধন, তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্ত আচরণ কর, আমার কথা শোন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ো না।

 দুর্যোধন তাঁর ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন এবং ঈষৎ হাস্য ক’রে অধোবদনে অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ভূমিতে রেখা কাটতে লাগলেন। দুর্যোধনের এই অবজ্ঞা দেখে মৈত্রেয় ক্রোধে রক্তলোচন হলেন এবং জলস্পর্শ করে অভিশাপ দিলেন, তুমি আমার কথা অগ্রাহ্য করছ, এই অহংকারের ফল শীঘ্রই পাবে, মহাযুদ্ধে গদাঘাতে ভীম তোমার ঊরু ভগ্ন করবেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রসন্ন করবার চেষ্টা করলে মৈত্রেয় বললেন, রাজা, দুর্যোধন যদি শান্তভাবে চলে তবে আমার শাপ ফলবে না, নতুবা ফলবে। ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, কির্মীরকে ভীম কি করে বধ করেছেন? মৈত্রেয় উত্তর দিলেন, আমি আর কিছু বলব না, আপনার পুত্র আমার কথা শুনতে চায় না। আমি চ’লে গেলে বিদুরের কাছে শুনবেন।

  1. ১.০ ১.১ শোক ও ভয়ের কারণ।
  2. অনুরাগ, আসক্তি।
  3. যাঁর চক্ষুর ক্রিয়া বুদ্ধি দ্বারা সম্পন্ন হয়।
  4. পাণ্ডবরাও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররূপে গণ্য।