মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/নিবাতকবচযুদ্ধপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ নিবাতকবচযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥

৩৬। অর্জুনের প্রত্যাবর্তন — নিবাতকবচ ও হিরণ্যপুরের বৃত্তান্ত

 একমাস পরে একদিন পাণ্ডবগণ দেখলেন, আকাশ আলোকিত ক’রে ইন্দ্রের বিমান আসছে, মাতলি তা চালাচ্ছেন, ভিতরে কিরীটমাল্যধারী অর্জুন নব-আভরণে ভূষিত হয়ে ব’সে আছেন। বিমান থেকে নেমে অর্জুন পুরোহিত ধৌম্য, যুধিষ্ঠির ও ভীমের চরণবন্দনা করলেন। পাণ্ডবগণ কর্তৃক সৎকৃত হয়ে মাতলি বিমান নিয়ে ইন্দ্রলোকে ফিরে গেলেন।

 প্রিয়া দ্রৌপদীকে ইন্দ্রদত্ত বিবিধ মহামূল্য অলংকার উপহার দিয়ে অর্জুন তাঁর ভ্রাতা ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে এসে বসলেন এবং সুরলোকে বাস ও অস্ত্রশিক্ষার বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বললেন। পরদিন প্রভাতকারে উজ্জ্বল বিমানে আরোহণ করে ইন্দ্র পাণ্ডবদের নিকট উপস্থিত হয়ে বুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি পৃথিবী শাসন করবে, এখন তোমরা কাম্যকবনে ফিরে যাও। অর্জুন সর্ববিধ অস্ত্র লাভ করেছেন, আমার প্রিয়কার্যও করেছেন। এখন ত্রিভুবনের লোকেও এঁকে জয় করতে পারবে না। ইন্দ্র চ’লে গেলে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন তাঁর যাত্রা ও সুরলোকবাসের ঘটনাবলী সবিস্তারে জানিয়ে নিবাতকবচবধের এই বৃত্তান্ত বললেন।—

  আমার অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে দেবরাজ বললেন, তোমার এখন গুরুদক্ষিণা দেবার সময় এসেছে। আমার শত্রু নিবাতকবচ নামক তিন কোটি দানব সমুদ্রমধ্যস্থ দুর্গে বাস করে, তারা রূপে ও বিক্রমে সমান। তুমি তাদের বধ কর, তা হ’লেই তোমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া হবে।

 কিরীট-কবচে ভূষিত হয়ে গাণ্ডীবধনু নিয়ে আমি ইন্দ্রের রথে যাত্রা করলাম। অবিলম্বে মাতলি আমাকে সমুদ্রস্থ দানবনগরে নিয়ে এলেন। সহস্র সহস্র নিবাতকবচ নামক দানব লৌহময় মহাশূল গদা মূষল খড়্‌গ প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে বিকৃত বাদ্যধ্বনি ক’রে আমাকে আক্রমণ করলে। তুমুল যুদ্ধে অনেক দানব আমার অস্ত্রাঘাতে নিহত হ’ল। তার পর তারা মায়াবলে শিলা জল অগ্নি ও বায়ু বর্ষণ করতে লাগল, চতুর্দিক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হ’ল। তখন আমি নিজের অস্ত্রমায়ায় দানবগণের মায়া নষ্ট করলাম। তারা অদৃশ্য হয়ে আকাশ থেকে শিলা বর্ষণ করতে লাগল, আমরা যেখানে ছিলাম সেই স্থান গুহার ন্যায় হয়ে গেল। তখন মাতলির উপদেশে আমি দেবরাজের প্রিয় ভীষণ বজ্র অস্ত্র নিক্ষেপ করলাম। পর্বতের ন্যায় বিশালকায় নিবাতকবচগণের মৃতদেহে যুদ্ধস্থান ব্যাপ্ত হ’ল, দানবরমণীগণ উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে তাদের গৃহমধ্যে আশ্রয় নিলে। আমি মাতলিকে জিজ্ঞাসা করলাম, দানবদের এই নগর ইন্দ্রালয়ের চেয়েও উৎকৃষ্ট, দেবতারা এখানে বাস করেন না কেন? মাতলি বললেন, এই নগর পূর্বে দেবরাজেরই ছিল, নিবাতকবচগণ ব্রহ্মার বরপ্রভাবে এই স্থান অধিকার ক’রে দেবতাদের তাড়িয়ে দেয়। ইন্দ্রের অনুযোগে ব্রহ্মা বলেছিলেন, বাসব, এই নিয়তি আছে যে তুমি অন্য দেহে এদের সংহার করবে। এই কারণেই ইন্দ্র তোমাকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন।

 নিবাতকবচগণকে বিনষ্ট ক’রে যখন আমি দেবলোকে ফিরছিলাম তখন আর একটি দীপ্তিময় আশ্চর্য নগর আমার দৃষ্টিগোচর হ’ল। মাতলি বললেন, পুলোমা নামে এক দৈত্যনারী এবং কালকা নামে এক মহাসুরী বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করে ব্রহ্মার নিকট এই বর পায় যে, তাদের পৌলোম ও কালকেয় নামক পুত্রগণ দেব রাক্ষস ও নাগের অবধ্য হবে এবং তারা এই প্রভাময় রমণীয় আকাশচারী নগরে বাস করবে। এই সেই ব্রহ্মার নির্মিত হিরণ্যপুর নামক দিব্য নগর। পার্থ, তুমি এই ইন্দ্রশত্রু অসুরগণকে বিনষ্ট কর।

 মাতলি আমাকে হিরণ্যপুরে নিয়ে গেলেন। দানবগণ আক্রমণ করলে আমি তাদের মোহগ্রস্ত করে শরাঘাতে বধ করতে লাগলাম। তাদের নগর কখনও ভূতলে নামল, কখনও আকাশে উঠল, কখনও জলমধ্যে নিমগ্ন হ’ল। তার পর দানবগণ ষাট হাজার রথে চড়ে আমার দিব্যাস্ত্রসমূহ প্রতিহত করে যুদ্ধ করতে লাগল। আমি ভীত হয়ে দেবদেব রুদ্রকে প্রণাম করে রৌদ্র নামে খ্যাত সর্বশত্রুনাশক দিব্য পাশুপত অস্ত্র প্রয়োগে উদ্যত হ’লাম। তখন এক আশ্চর্য পুরুষ আবির্ভূত হ’ল, তার তিন মস্তক, নয় চক্ষু, ছয় হস্ত। তার কেশ সূর্য ও অগ্নির ন্যায় প্রদীপ্ত, লেলিহান মহানাগগণ তা বেষ্টন ক’রে আছে। মহাদেবকে নমস্কার ক’রে আমি সেই ঘোর রৌদ্র অস্ত্র গাণ্ডীবে যোজনা ক’রে নিক্ষেপ করলাম। তৎক্ষণাৎ সহস্র সহস্র মৃগ সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক মহিষ সর্প হস্তী প্রভৃতি এবং দেব ঋষি গন্ধর্ব পিশাচ যক্ষ ও নানারূপ অস্ত্রধারী রাক্ষস ও অন্যান্য প্রাণীতে সর্বস্থান ব্যাপ্ত হ’ল। ত্রিমস্তক, চতুর্দন্ত, চতুর্ভুজ ও নানারূপধারী প্রাণিগণ নিরন্তর দানবগণকে বধ করতে লাগল, আমিও শরবর্ষণ করে মুহূর্তমধ্যে সমস্ত দানব সংহার করলাম।

 আমি দেবলোকে ফিরে গেলে মাতলির মুখে সমস্ত শুনে দেবরাজ আমার বহু প্রশংসা ক’রে বললেন, পুত্র, তুমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হ’লে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ শকুনি ও তাঁদের সহায়ক রাজারা সকলে মিলে তোমার ষোল ভাগের এক ভাগেরও সমান হবেন না। তার পর তিনি আমাকে এই দেহরক্ষক অভেদ্য দিব্যকবচ, হিরন্ময়ী মালা, দেবদত্ত নামক মহারব শঙ্খ, দিব্য কিরীট এবং এই সকল দিব্য বস্তু ও আভরণ দান করলেন। আমি পাঁচ বৎসর সুরলোকে বাস ক’রে ইন্দ্রের অনুমতিক্রমে এখন এই গন্ধমাদন পর্বতে আপনাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছি।

 অর্জুনের নিকট সকল বৃত্তান্ত শুনে যুধিষ্ঠির অতিশয় আনন্দিত হলেন। পরদিন তাঁর অনুরোধে অর্জুন দিব্যাস্ত্রসমূহের প্রয়োগ দেখাবার উপক্রম করলে নদী ও সমুদ্র বিক্ষুব্ধ, পর্বত বিদীর্ণ এবং বায়ুপ্রবাহ রুদ্ধ হ’ল; সূর্য উঠলেন না, অগ্নি জ্বললেন না, ব্রাহ্মণগণ বেদ স্মরণ করতে পারলেন না। তখন নারদ এসে বললেন, অর্জুন, দিব্যাস্ত্র বৃথা প্রয়োগ ক’রো না, তাতে মহাদোষ হয়। যুধিষ্ঠির, অর্জুন যখন শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তখন তুমি এইসব অস্ত্রের প্রয়োগ দেখবে।