মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বনপর্ব/মার্কণ্ডেয় সমাস্যাপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

॥ মার্কণ্ডেয়সমাস্যা[১]পর্বাধ্যায় ॥

৩৮। কৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়র আগমন ― অরিষ্টনেমা ও অত্রির কথা

 বিশাখযূপ বনে বর্ষা ও শরৎ ঋতু কাটিয়ে পাণ্ডবগণ আবার কাম্যকবনে এসে বাস করতে লাগলেন। একদিন সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণ তাঁদের দেখতে এলেন। অর্জুনকে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর কুশলসংবাদ দিয়ে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন, যাজ্ঞসেনী, ভাগ্যক্রমে অর্জুন ফিরে এসেছেন, তোমার স্বজনবর্গ এখন পূর্ণ হ’ল। তোমার বালক পুত্রগণ ধনুর্বেদে অনুরক্ত ও সুশীল হয়েছে। তোমার পিতা ও ভ্রাতা নিমন্ত্রণ করলেও তারা মাতুলালয়ের ঐশ্বর্য ভোগ করতে চায় না, তারা দ্বারকাতেই সুখে আছে। আর্যা কুন্তী আর তুমি যেমন পার সেইরূপ সুভদ্রাও সর্বদা তাদের সদাচার শিক্ষা দিচ্ছেন। রুক্মিণীতনয় প্রদ্যুম্ন ও কুমার অভিমন্যু তাদের রথ ও অশ্বচালনা এবং বিবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ শেখাচ্ছেন। তার পর কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, যাদবসেনা আপনার আদেশের অপেক্ষা করছে, আপনি পাপী দুর্যোধনকে সবান্ধবে বিনষ্ট করুন। অথবা আপনি দ্যূতসভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাই পালন করুন, যাদবসেনাই আপনার শত্রু সংহার করবে, আপনি যথাকালে হস্তিনাপুর অধিকার করবেন।

 যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কেশব, তুমিই আমাদের গতি, উপযুক্ত কালে তুমি আমাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে তাতে সংশয় নেই। আমরা প্রায় দ্বাদশ বৎসর বনবাসে কাটিয়েছি, অজ্ঞাতবাস শেষ ক’রেই তোমার শরণ নেব।

 এমন সময়ে মহাতপা মার্কণ্ডেয় মুনি সেখানে এলেন। তাঁর বয়স বহু সহস্র বৎসর কিন্তু তিনি দেখতে পঁচিশ বৎসরের যুবার ন্যায়। তিনি পূজা গ্রহণ ক’রে উপবিষ্ট হ’লে কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, আমরা সকলে আপনার কাছে পুণ্যকথা শুনতে ইচ্ছা করি। এই সময়ে দেবর্ষি নারদও পাণ্ডবদের দেখতে এলেন, তিনিও মার্কণ্ডেয়কে অনুরোধ করলেন।

 মার্কণ্ডেয় ধর্ম অধর্ম কর্মফল ইহলোক পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক ব্যাখ্যান করলেন। পাণ্ডবগণ বললেন, আমরা ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য শুনতে ইচ্ছা করি, অপনি বলুন। মার্কণ্ডেয় এই আখ্যান বললেন।—হৈহয় বংশের এক রাজকুমার মৃগয়া করতে গিয়ে কৃষ্ণমৃগচর্মধারী এক ব্রাহ্মণকে দেখে তাঁকে মৃগ মনে ক’রে বধ করেন। তিনি ব্যাকুল হয়ে রাজধানীতে ফিরে এসে তাঁর পাপকর্মের কথা জানালেন। তখন হৈহয়রাজগণ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত মুনিকে দেখলেন এবং তাঁর সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে করতে মহর্ষি অরিষ্টনেমার আশ্রমে এলেন। মহর্ষি তাঁদের পাদ্য-অর্ঘাদি দিতে গেলে তাঁরা বললেন, আমরা ব্রহ্মহত্যা করেছি, সংস্কৃত হবার যোগ্য নই। তার পর সকলে পুনর্বার ঘটনাস্থলে গেলেন কিন্তু মৃতদেহ তখন দেখতে পেলেন না। তখন অরিষ্টনেমা বললেন, দেখুন তো, আমার এই পুত্রই সেই নিহত ব্রাহ্মণ কিনা। রাজারা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই মৃত মুনিকুমার কি ক’রে জীবিত হলেন? অরিষ্টনেমা বললেন, আমরা স্বধর্মের অনুষ্ঠান করি, ব্রাহ্মণদের যাতে মঙ্গল হয় তাই বলি, যাতে দোষ হয় এমন কথা বলি না। অতিথি ও পরিচারকদের ভোজনের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাই আমরা খাই। আমরা শান্ত, সংযতেন্দ্রিয়, ক্ষমাশীল, তীর্থপর্যাটক ও দানপরায়ণ, পুণ্যদেশে তেজস্বী ঋষিগণের সংসর্গে বাস করি। যেসকল কারণে আমাদের মৃত্যুভয় নেই তার অল্পমাত্র আপনাদের বললাম। আপনারা এখন ফিরে যান, পাপের ভয় করবেন না। রাজারা হৃষ্ট হয়ে অরিষ্টনেমাকে প্রণাম করে চ’লে গেলেন।

 তার পর মার্কণ্ডেয় এই উপাখ্যান বললেন।—মহর্ষি অত্রি বনগমনের ইচ্ছা করলে তাঁর ভার্যা বললেন, রাজর্ষি বৈণ্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন, তুমি তাঁর কাছে প্রার্থনা ক’রে প্রচুর ধন নিয়ে এস, এবং সেই ধন পুত্র ও ভৃত্যদের ভাগ করে দিয়ে যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। অত্রি সম্মত হয়ে বৈণ্য রাজার কাছে গিয়ে তাঁর এই স্তুতি করলেন— রাজা, আপনি ধন্য, প্রজাগণের নিয়ন্তা ও পৃথিবীর প্রথম নরপতি; মুনিরা বলেন, আপনি ভিন্ন আর কেউ ধর্মজ্ঞ নেই। এই স্তুতি শনে গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অত্রি, এমন কথা আর বলো না, ইন্দ্রই রাজাদের মধ্যে প্রথম। তুমি মূঢ় অপরিণতবুদ্ধি, রাজাকে তুষ্ট করবার জন্য স্তুতি করছ। অত্রি ও গৌতম কলহ করছেন দেখে সভাস্থ ব্রাহ্মণগণ দুজনকে ধর্মজ্ঞ সনৎকুমারের কাছে নিয়ে গেলেন। সনৎকুমার বললেন, রাজাকে ধর্ম ও প্রজাপতি বলা হয়, তিনিই ইন্দ্র ধাতা প্রজাপতি বিরাট প্রভৃতি নামে স্তুত হন, সকলেই তাঁর অর্চনা করে। অত্রি রাজাকে যে প্রথম বা প্রধান বলেছেন তা শাস্ত্রসম্মত। বিচারে অত্রিকে জয়ী দেখে বৈণ্য রাজা প্রীত হয়ে তাঁকে বহু ধন দান করলেন।

৩৯। বৈবস্বত মনু ও মৎস্য ― বালকরূপী নারায়ণ

 যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় বৈবস্বত মনুর এই বৃত্তান্ত বললেন।― বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র মনু রাজ্যলাভের পর বদরিকাশ্রমে গিয়ে দশ হাজার বৎসর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। একদিন একটি ক্ষুদ্র মৎস্য চারিণী নদীর তীরে এসে মনুকে বললে, বলবান মৎস্যদের আক্রমণ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। মনু সেই মৎস্যটিকে একটি জালার মধ্যে রাখলেন। ক্রমশ সে বড় হ’ল, তখন মনু তাকে একটি বিশাল পুষ্করিণীতে রাখলেন। কালক্রমে মৎস্য এত বড় হ’ল যে সেখানেও তার স্থান হ’ল না, তখন মনু তাকে গঙ্গায় ছেড়ে দিলেন। কিছুকাল পরে মৎস্য বললে, প্রভু, আমি অতি বৃহৎ হয়েছি, গঙ্গায় নড়তে পারছি না, আমাকে সমুদ্রে ছেড়ে দিন। মনু যখন তাকে সমুদ্রে ফেললেন তখন সে সহাস্যে বললে, ভগবান, আপনি আমাকে সর্বত্র রক্ষা করেছেন, এখন আপনার যা কর্তব্য তা শুনুন।― প্রলয়কাল আসন্ন, স্থাবর জঙ্গম সমস্তই জলমগ্ন হবে। আপনি রজ্জুযুক্ত একটি দৃঢ় নৌকা প্রস্তুত করিয়ে সপ্তর্ষিদের সঙ্গে তাতে উঠবেন, এবং পূর্বে ব্রাহ্মণগণ যেসকল বীজের কথা বলেছেন তাও তাতে রাখবেন। আপনি সেই নৌকায় থেকে আমার প্রতীক্ষা করবেন, আমি শৃঙ্গ ধারণ ক’রে আপনার কাছে আসব। মৎস্যের উপদেশ অনুসারে মনু মহাসমুদ্রে নৌকায় উঠলেন। তিনি স্মরণ করলে মৎস্য উপস্থিত হ’ল। মনু তার শৃঙ্গে রজ্জু বাঁধলেন, মৎস্য গর্জমান ঊর্মিময় লবণাম্বুর উপর দিয়ে মহাবেগে নৌকা টেনে নিয়ে চলল। তখন পৃথিবী আকাশ ও সর্বদিক সমস্তই জলময়, কেবল সাতজন ঋষি, মনু আর মৎস্যকে দেখা যাচ্ছিল। বহু বর্ষ পরে হিমালয়ের নিকটে এসে মনু মৎস্যের উপদেশ অনুসারে পর্বতের মহাশৃঙ্গে নৌকা বাঁধলেন। সেই শৃঙ্গ এখনও ‘নৌবন্ধন’ নামে খ্যাত। তার পর মৎস্য ঋষিগণকে বললে, আমি প্রজাপতি ব্রহ্মা, আমার উপরে কেউ নেই, আমি মৎস্যরূপে তোমাদের ভয়মক্ত করেছি। এই মনু দেবাসুর মানুষ প্রভৃতি সকল প্রজা ও স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করবেন। এই ব’লে মৎস্য অন্তর্হিত হ’ল। তার পর মনু কঠোর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে সকল প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন।


 যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি পুরাকালের সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সম্বন্ধে কিছু শুনতে ইচ্ছা করি। মার্কণ্ডেয় বললেন, সত্যযযুগের পরিমাণ চার হাজার বৎসর[২], তার সন্ধ্যা[৩] চার শ, এবং সন্ধ্যাংশ[৪]ও চার শ বৎসর। ত্রেতাযুগ তিন হাজার বৎসর, তার সন্ধ্যা তিন শ বৎসর, সন্ধ্যাংশও তাই। দ্বাপরযুগে দু হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ দুইই দু শ বৎসর। কলিযুগ এক হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ এক-এক শ বৎসর। চার যুগে বার হাজার বৎসর; এক হাজার যুগে (এক হাজার চতুর্যুগে) ব্রহ্মার এক দিন। তার পর ব্রহ্মার রাত্রি প্রলয়কাল। একদা প্রলয়কালে আমি নিরাশ্রয় হয়ে সমুদ্রজলে ভাসছিলাম এমন সময়ে দেখলাম, এক বিশাল বটবৃক্ষের শাখার তলে দিব্য-আস্তরণযুক্ত পর্যঙ্কে একটি চন্দ্রবদন পদ্মলোচন বালক শুয়ে আছে, তার বর্ণ অতসী[৫] পুষ্পের ন্যায়, বক্ষে শ্রীবৎসচিহ্ণবিষ্ণুর বক্ষের রোমাবর্ত॥ সেই বালক বললেন, বৎস মার্কণ্ডেয়, তুমি পরিশ্রান্ত হয়েছ, আমার শরীরের ভিতরে বাস কর। এই বলে তিনি মুখব্যাদান করলেন। আমি তাঁর উদরে প্রবেশ করে দেখলাম, নগর রাষ্ট্র পর্বত নদী সাগর আকাশ চন্দ্রসূর্য দেবগণ অসুরগণ প্রভৃতি সমেত সমগ্র জগৎ সেখানে রয়েছে। এক শত বৎসরের অধিক কাল তাঁহার দেহের মধ্যে বিচরণ ক’রে কোথাও অন্ত পেলাম না, তখন আমি সেই বরেণ্য দেবের শরণ নিলাম এবং সহসা তাঁর বিবৃত মুখ থেকে বায়ুবেগে নির্গত হলাম। বাইরে এসে দেখলাম, সেই পীতবাস দ্যুতিমান বালক বটবৃক্ষের শাখায় ব’সে আছেন। তিনি সহাস্যে বললেন, মার্কণ্ডেয়, তুমি আমার শরীরে সুখে বাস করেছ তো? আমি নবদৃষ্টি লাভ ক’রে মোহমুক্ত হয়ে তাঁর সুন্দর কোমল আরক্ত চরণদ্বয় মস্তকে ধারণ করলাম। তার পর কৃতাঞ্জলি হয়ে বললাম, দেব, তোমাকে আর তোমার মায়াকে জানতে ইচ্ছা করি। সেই দেব বললেন, পুরাকালে আমি জলের নাম ‘নারা’ দিয়েছিলাম, প্রলয়কালে সেই জলই আমার অয়ন বা আশ্রয় সেজন্য আমি নারায়ণ। আমি তোমার উপর পরিতুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার রূপ ধারণ করে অনেক বার তোমাকে বর দিয়েছি। লোকপিতামহ ব্রহ্মা আমার শরীরের অর্ধাংশ। যত কাল তিনি জাগরিত না হন তত কাল আমি শিশুরূপে এইখানে থাকি। প্রলয়ান্তে ব্রহ্মা জাগরিত হ’লে আমি তাঁর সঙ্গে একীভূত হয়ে আকাশ পৃথিবী স্থাবর জঙ্গম প্রভৃতি সৃষ্টি করব। তত কাল তুমি সুখে এখানে বাস কর। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন।

 এই ইতিহাস শেষ ক’রে মার্কণ্ডেয় যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, সেই প্রলয়কালে আমি যে পদ্মলোচন আশ্চর্য দেবকে দেখেছিলাম তিনিই তোমার এই আত্মীয় জনার্দন। এঁর বরে আমার স্মৃতি নষ্ট হয় না, আমি দীর্ঘায়ু, ইচ্ছামৃত্যু হয়েছি। এই অচিন্ত্যস্বভাব মহাবাহু কৃষ্ণ যেন ক্রীড়ায় নিরত আছেন। তোমরা এঁর শরণ নাও। মার্কণ্ডেয় এইরূপ বললে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী জনার্দন কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন।

৪০। পরীক্ষিৎ ও মণ্ডূকরাজকন্যা ― শল, দল ও বামদেব

 যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য-বিষয়ক আরও উপাখ্যান বললেন।—অযোধ্যায় পরীক্ষিৎ নামে ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি অশ্বারোহণে মৃগয়ায় গিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে নিবিড় বনে এক সরোবর দেখতে পেলেন। রাজা স্নান ক’রে অশ্বকে মৃণাল খেতে দিয়ে সরোবরের তীরে বসলেন। তিনি দেখলেন, এক পরমসুন্দরী কন্যা ফুল তুলতে তুলতে গান করছে। রাজা বললেন, ভদ্রে, তুমি কে? আমি তোমার পাণিপ্রার্থী। কন্যা বললে, আমি কন্যা; যদি প্রতিজ্ঞা কর যে আমাকে কখনও জল দেখাবে না তবেই বিবাহ হ’তে পারে। রাজা সম্মত হলেন এবং কন্যাকে বিবাহ ক’রে রাজধানীতে নিয়ে গেলেন। তিনি পত্নীর সঙ্গে নির্জন স্থানে বাস করতে লাগলেন।

 পরিচারিকাদের কাছে কন্যার বৃত্তান্ত শুনে রাজমন্ত্রী বহুবৃক্ষশোভিত এক উদ্যান রচনা করলেন। সেই উদ্যানের এক পার্শ্বে একটি পুষ্করিণী ছিল, তার জল মুক্তাজাল দিয়ে এবং পাড় চুনের লেপে ঢাকা। মন্ত্রী রাজাকে বললেন, এই মনোরম উদ্যানে জল নেই, আপনি এখানে বিহার করুন। রাজা তাঁর মহিষীর সঙ্গে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তাঁরা বেড়াতে বেড়াতে শ্রান্ত হয়ে সেই পুষ্করিণীর তীরে এলেন। রাজা রানীকে বললেন, তুমি জলে নাম। রানী জলে নিমগ্ন হলেন, আর উঠলেন না। রাজা তখন সেই পুষ্করিণী জলশূন্য করালেন এবং তার মধ্যে একটা ব্যাং দেখে আজ্ঞা দিলেন, সমস্ত মণ্ডূক বধ কর। মণ্ডূকরাজ তপস্বীর বেশে রাজার কাছে এসে বললেন, মহারাজ, বিনা দোষে ভেক বধ করবেন না। রাজা বললেন, এই দুরাত্মারা আমার প্রিয়াকে খেয়ে ফেলেছে। মণ্ডূকরাজ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম আয়ু, আপনার ভার্যা আমার কন্যা সুশোভনা। তার এই দুষ্ট স্বভাব— সে অনেক রাজাকে প্রতারণা করেছে। রাজার প্রার্থনায় আয়ু তাঁর কন্যাকে এনে দিলেন এবং তাকে অভিশাপ দিলেন, তোমার অপরাধের ফলে তোমার সন্তান ব্রাহ্মণের অনিষ্টকারী হবে।

 সুশোভনার গর্ভে পরীক্ষিতের তিন পুত্র হ’ল — শল, দল, বল। যথাকালে শলকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে পরীক্ষিৎ বনে চ’লে গেলেন। একদিন শল রথে চ’ড়ে মৃগয়ায় গিয়ে একটি দ্রুতগামী হরিণকে ধরতে পারলেন না। সারথি বললে, এই রথে যদি বামী নামক দুই অশ্ব জোতা হয় তবেই মৃগকে ধরতে পারবেন। মহর্ষি বামদেবের সেই অশ্ব আছে জেনে রাজা তাঁর আশ্রমে গিয়ে অশ্ব প্রার্থনা করলেন। বামদেব বললেন, নিয়ে যাও, কিন্তু কৃতকার্য হ’লেই শীঘ্র ফিরিয়ে দিও। রাজা সেই দুই অশ্ব রথে যোজনা ক’রে হরিণ ধরলেন, কিন্তু রাজধানীতে গিয়ে অশ্ব ফেরত পাঠালেন না। বামদেব তাঁর শিষ্য আত্রেয়কে রাজার কাছে পাঠালে রাজা বললেন, এই দুই অশ্ব রাজারই যোগ্য, ব্রাহ্মণের অশ্বে কি প্রয়োজন? তার পর বামদেব স্বয়ং এসে অশ্ব চাইলেন। রাজা বললেন মহর্ষি, সুশিক্ষিত বৃষই ব্রাহ্মণের উপযুক্ত বাহন; আর, বেদও তো আপনাদের বহন করে। শল রাজা যখন কিছুতেই দুই অশ্ব ফেরত দিলেন না তখন বামদেবের আদেশে চারজন ঘোররূপ রাক্ষস আবির্ভূত হয়ে শূলহস্তে রাজাকে মারতে গেল। রাজা উচ্চস্বরে বললেন, ইক্ষ্বাকুবংশীয়গণ, আমার ভ্রাতা দল এবং সভাস্থ বৈশ্যগণ যদি আমার অনুবর্তী হন তবে এই রাক্ষসদের নিবারণ করুন; বামদেব ধর্মশীল নন, তাঁর বামী আমি দেব না। এইরূপ বলতে বলতে শল রাক্ষসদের হাতে নিহত হলেন।

 ইক্ষ্বাকুবংশীয়গণ দলকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। বামদেব তাঁর কাছে অশ্ব চাইলে দল ব্রুদ্ধ হয়ে তাঁর সারথিকে বললেন, আমার যে বিষলিপ্ত বিচিত্র বাণ আছে তারই একটা নিয়ে এস, বামদেবকে মারব, তার মাংস কুকুররা খাবে। বামদেব বললেন, রাজা, সেনজিৎ নামে তোমার যে দশবৎসরবয়স্ক পুত্র আছে তাকেই তোমার বাণ বধ করুক। দলের বাণ অন্তঃপুরে গিয়ে রাজপুত্রকে বধ করলে। রাজা আর একটা বাণ আনতে বললেন, কিন্তু তাঁর হাত বামদেবের শাপে অবশ হয়ে গেল। রাজা বললেন, সকলে দেখুন, বামদেব আমাকে স্তম্ভিত করেছেন, আমি তাঁকে শরাঘাতে মারতে পারছি না, অতএব তিনি দীর্ঘায়ু হয়ে জীবিত থাকুন। বামদেব বললেন, রাজা, তোমার মহিষীকে বাণ দিয়ে স্পর্শ কর, তা হ’লে পাপমুক্ত হবে। রাজা দল তা করলে মহিষী বললেন, এই নৃশংস রাজাকে আমি প্রতিদিন সদুপদেশ দিই, ব্রাহ্মণগণকেও সত্য ও প্রিয় বাক্য বলি, তার ফলে আমি পুণ্যলোক লাভ করব। মহিষীর উপর তুষ্ট হয়ে বামদেব বর দিলেন, তার ফলে দল পাপমুক্ত হয়ে শুভাশীর্বাদ লাভ করলেন এবং অশ্ব ফিরিয়ে দিলেন।

৪১। দীর্ঘায়ু বক ঋষি — শিবি ও সুহোত্র — যযাতির দান

 তার পর মার্কণ্ডেয় ইন্দ্রসখা দীর্ঘায়ু, বক ঋষির এই উপাখ্যান বললেন।— দেবাসুরযুদ্ধের পর ইন্দ্র ত্রিলোকের অধিপতি হয়ে নানাস্থানে বিচরণ করতে করতে পূর্বসমুদ্রের নিকটে বক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বক পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি নিবেদন করলে ইন্দ্র বললেন, আপনার লক্ষ বৎসর বয়স হয়েছে; চিরজীবীদের কি দুঃখ তা আমাকে বলুন। বক বললেন, অপ্রিয় লোকের সঙ্গে বাস, প্রিয় লোকের বিরহ, অসাধু লোকের সঙ্গে মিলন, পত্র-দারাদির বিনাশ, পরাধীনতার কষ্ট ধনহীনতার জন্য অবমাননা, অকুলীনের কুলমর্যাদা, কুলীনের কুলক্ষয়— চিরজীবীদের এইসব দেখতে হয়, এর চেয়ে অধিক দুঃখ আর কি আছে? ইন্দ্র আবার প্রশ্ন করলেন, চিরজীবীদের সুখ কি তা বলুন। বক উত্তর দিলেন, কুমিত্রকে আশ্রয় না ক’রে দিবসের অষ্টম বা দ্বাদশ ভাগে শাক ভক্ষণ — এর চেয়ে সুখতর কি আছে? অতিভোজী না হয়ে নিজ গৃহে নিজ শক্তিতে আহৃত ফল বা শাক ভোজনই শ্রেয়, পরগৃহে অপমানিত হয়ে সুস্বাদু খাদ্য ভোজনও শ্রেয় নয়। অতিথি ভৃত্য ও পিতৃগণকে অন্নদান ক’রে যে অবশিষ্ট অন্ন খায় তার চেয়ে সুখী কে আছে? মহর্ষি বকের সঙ্গে নানাপ্রকার সদালাপ করে দেবরাজ সুরলোকে চ’লে গেলেন।


 পাণ্ডবগণ ক্ষত্রিয়মাহাত্ম্য শুনতে চাইলে মার্কণ্ডেয় বললেন।— একদা কুরুবংশীয় সুহোত্র রাজা পথিমধ্যে উশীনরপুত্র রথারূঢ় শিবি রাজাকে দেখতে পেলেন। তাঁরা বয়স অনুসারে পরস্পরকে সম্মান দেখালেন, কিন্তু গুণে দুজনেই সমান এই ভেবে কেউ কাকেও পথ ছেড়ে দিলেন না। সেই সময়ে নারদ সেখানে এসে বললেন, তোমরা পরস্পরের পথরোধ করে রয়েছ কেন? রাজারা উত্তর দিলেন, ভগবান, যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁকেই পথ ছেড়ে দেবার বিধি আছে। আমরা তুল্যগুণশালী সখা, সেজন্য কে শ্রেষ্ঠ তা স্থির করতে পারছি না। নারদ বললেন, ক্রুর লোক মৃদুস্বভাব লোকের প্রতিও ক্রুরতা করে, সাধুজন অসাধুর প্রতিও সাধুতা করেন, তবে সাধুর সহিত সাধু সদাচরণ করবেন না কেন? শিবি রাজা সুহোত্রের চেয়ে সাধুস্বভাব।―

জয়েৎ কদর্যং দানেন সত্যেনানৃতবাদিনম্।
ক্ষমযা ক্রূরকর্মণিমসাধুং সাধুনা জয়েৎ॥

—দান ক’রে কৃপণকে, সত্য বলে মিথ্যাবাদীকে, ক্ষমা করে কূর-কর্মাকে, এবং সাধুতার দ্বারা অসাধুকে জয় করবে।

 নারদ তার পর বললেন, তোমরা দুজনেই উদার; যিনি অধিকতর উদার তিনিই স’রে গিয়ে পথ দিন, উদারতার তাই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হবে। তখন সুহোত্র শিবিকে প্রদক্ষিণ করে পথ ছেড়ে দিলেন এবং তাঁর বহু সৎকর্মের প্রশংসা করে চ’লে গেলেন। এইরূপে রাজা সুহোত্র তাঁর মাহাত্ম্য দেখিয়েছিলেন।


 তার পর মার্কণ্ডেয় এই উপাখ্যান বললেন।—একদিন রাজা যযাতির কাছে এক ব্রাহ্মণ এসে বললেন, মহারাজ, গুরুর জন্য আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছি। দেখা যায় লোকে যাচকের উপর অসন্তুষ্ট হয়; আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আমার প্রার্থিত বস্তু আপনি তুষ্ট হয়ে দেবেন কিনা? রাজা বললেন, আমি দান ক’রে তা প্রচার করি না, যা দান করা অসম্ভব তার জন্য প্রতিশ্রুতি দিই না। যা দানের যোগ্য তা দিয়ে আমি অতিশয় সুখী হই, দান ক’রে কখনও অনুতাপ করি না। এই ব’লে রাজা যযাতি ব্রাহ্মণকে তাঁর প্রার্থিত সহস্র ধেনু দান করলেন।

৪২। অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবি — ইন্দ্রদ্যুম্ন

 মার্কণ্ডেয় ক্ষত্রিয়মাহাত্ম্য-বিষয়ক আরও উপাখ্যান বললেন।—বিশ্বামিত্রের পুত্র অষ্টক রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপ্ত ক’রে তাঁর ভ্রাতা[৬] প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবির সঙ্গে রথারোহণে যাচ্ছিলেন এমন সময়ে দেবর্ষি নারদের সঙ্গে দেখা হল। অষ্টক অভিবাদন ক’রে নারদকে রথে তুলে নিলেন। যেতে যেতে এক ভ্রাতা নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা চারজনেই স্বর্গে যাব, কিন্তু নরলোকে কে আগে ফিরে আসবেন? নারদ বললেন, অষ্টক। যখন আমি তাঁর গৃহে বাস করছিলাম তখন একদিন তাঁর সঙ্গে রথে যেতে যেতে নানা বর্ণের বহু সহস্র গরু দেখতে পাই। আমি জিজ্ঞাসা করলে অষ্টক বললেন, আমিই এই সব গরু দান করেছি। এই আত্মশ্লাঘার জন্যই অষ্টকের আগে পতন হবে।

 আর এক ভ্রাতা প্রশ্ন করলেন, অষ্টকের পর কে অবতরণ করবেন? নারদ বললেন, প্রতর্দন। একদিন তাঁর সঙ্গে আমি রথে যাচ্ছিলাম এমন সময়ে এক ব্রাহ্মণ এসে একটি অশ্ব চাইলেন। প্রতর্দন বললেন, আমি ফিরে এসে দেব। ব্রাহ্মণ বললেন, এখনই দিন। প্রতর্দন রথের দক্ষিণ পার্শ্বের একটি অশ্ব খুলে দান করলেন। তার পর আর এক ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় তাঁকে বাম পার্শ্বের একটি অশ্ব দিলেন। তার পর আরও দুইজন ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় অবশিষ্ট দুই অশ্ব দিয়ে স্বয়ং রথ টানতে টানতে বললেন, এখন আর ব্রাহ্মণদের চাইবার কিছু নেই। প্রতর্দন দান ক’রে অসুয়াগ্রস্ত হয়েছিলেন সেজন্যই তাঁর পতন হবে।

 তার পর একজন প্রশ্ন করলেন, দুজনের পর কে স্বর্গচ্যুত হবেন? নারদ বললেন, বসুমনা। একদিন আমি তাঁর গৃহে গিয়ে আশীর্বাদ করি— তোমার পুষ্পক রথ লাভ হ’ক। বসুমনা পুষ্পক রথ পেলে আমি তার প্রশংসা করলাম। তিনি বললেন, ভগবান, এ রথ আপনারই। তার পর দ্বিতীয়বার আমি তাঁর কাছে গিয়ে রথের প্রশংসা করলাম, তিনি আবার বললেন, রথ আপনারই। আমার রথের প্রয়োজন ছিল, তৃতীয় বার তাঁর কাছে গেলাম কিন্তু রথ না দিয়ে তিনি বললেন, আপনার আশীর্বাদ সত্য হয়েছে। এই কপট বাক্যের জন্যই বসুমনার পতন হবে।

 তার পর একজন প্রশ্ন করলেন, বসুমনার পর কে অবতরণ করবেন? নারদ বললেন, শিবি স্বর্গে থাকবেন, আমারই পতন হবে। আমি শিবির সমান নই। একদিন এক ব্রাহ্মণ শিবির কাছে এসে বলেছিলেন, আমি অন্নপ্রার্থী, তোমার পুত্র বৃহদ্‌গর্ভকে বধ কর, তার মাংস আর অন্ন পাক ক’রে আমার প্রতীক্ষায় থাক। শিবি তাঁর পুত্রের পক্ক মাংস একটি পাত্রে রেখে তা মাথায় নিয়ে ব্রাহ্মণের খোঁজ করতে লাগলেন। একজন তাঁকে বললে, ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার গৃহ কোষাগার আয়ুধাগার অন্তঃপুর অশ্বশালা হস্তিশালা দগ্ধ করছেন। শিবি অবিকৃতমুখে ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, ভগবান, আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়েছে, ভোজন করুন। ব্রাহ্মণ বিস্ময়ে অধোমুখ হয়ে রইলেন। শিবি আবার অনুরোধ করলে ব্রাহ্মণ বললেন, তুমিই খাও। শিবি অব্যাকুলচিত্তে ব্রাহণের আজ্ঞা পালন করতে উদ্যত হলেন। ব্রাহ্মণ তখন তাঁর হাত ধ’রে বললেন, তুমি জিতক্রোধ, ব্রাহ্মণের জন্য তুমি সবই ত্যাগ করতে পার। শিবি দেখলেন, দেবকুমারতুল্য পুণ্যগন্ধান্বিত অলংকারধারী তাঁর পুত্র সম্মুখে রয়েছে। ব্রাহ্মণ অন্তর্হিত হলেন। তিনি স্বয়ং বিধাতা, রাজর্ষি শিবিকে পরীক্ষা করবার জন্য এসেছিলেন। অমাত্যগণ শিবিকে প্রশ্ন করলেন, কোন ফল লাভের জন্য আপনি এই কর্ম করলেন? শিবি উত্তর দিলেন, যশোলাভ বা ধনভোগের উদ্দেশ্যে করি নি, সজ্জনের যা প্রশস্ত আচরণ তাই আমি করেছি।

 পাণ্ডবগণ মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করলেন, আপনার চেয়ে প্রাচীন কেউ আছেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, পুণ্যক্ষয় হ’লে রাজর্ষি ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বর্গ থেকে চ্যুত হয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে চেনেন কি? আমি বললাম, আমি নিজ কার্যে ব্যস্ত থাকি সেজন্য সকলকে মনে রাখতে পারি না। হিমালয়ে প্রাবারকর্ণ নামে এক পেচক বাস করে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, হয়তো আপনাকে চেনে। ইন্দ্রদ্যুম্ন অশ্ব হয়ে আমাকে পেচকের কাছে বহন ক’রে নিয়ে গেলেন। পেচক তাঁকে বললে, তোমাকে চিনি না; ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে নাড়ীজঙ্ঘ নামে এক বক আছে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, তাকে প্রশ্ন কর। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আমাকে আর পেচককে নাড়ীজঙ্ঘের কাছে নিয়ে গেলেন। সে বললে, আমি এই রাজাকে চিনি না; এই সরোবরে আমার চেয়ে প্রাচীন অকূপার নামে এক কচ্ছপ আছে, তাকে প্রশ্ন কর। বকের আহ্বানে কচ্ছপ সরোবর থেকে উঠে এল। আমাদের প্রশ্ন শুনে সে মুহূর্তকাল চিন্তা ক’রে অশ্রুপূর্ণ নয়নে কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, এঁকে জানব না কেন? ইনি এখানে সহস্র যজ্ঞ ক’রে যূপকাষ্ঠ প্রোথিত করেছিলেন; ইনি দক্ষিণ৷স্বরূপ যে সকল ধেনু দান করেছিলেন তাদেরই বিচরণের ফলে এই সরোবর উৎপন্ন হয়েছে।

 তখন স্বর্গ থেকে দেবরথ এল এবং ইন্দ্রদ্যুম্ন এই দৈববাণী শুনলেন— তোমার জন্য স্বর্গ প্রস্তুত, তুমি কীর্তিমান, তোমার যোগ্য স্থানে এস।

দিবং স্পৃশতি ভূমিঞ্চ শব্দঃ পুণ্যস্য কর্মণঃ।
যাবৎ স শব্দো ভবতি তাবৎ পুরুষ উচ্যতে॥
অকীর্তিঃ কীর্ত্যতে লোকে যস্য ভূতস্য কস্যচিৎ।
স পতত্যধমাল্লোঁকান্ যাবচ্ছব্দঃ প্রকীর্ত্যতে॥

—পুণ্যকর্মের শব্দ (প্রশংসাবাদ) স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে; যত কাল সেই শব্দ থাকে তত কালই লোকে পুরুষরূপে গণ্য হয়[৭]। যত কাল কোনও লোকের অকীর্তি প্রচারিত হয় তত কাল সে নরকে পতিত থাকে।

 তার পর ইন্দ্রদ্যুম্ন[৮] আমাদের সকলকে নিজ নিজ স্থানে রেখে দেবরথে স্বর্গে প্রস্থান করলেন।

৪৩। ধুন্ধুমার

 যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা কুবলাশ্ব কি কারণে ধুন্ধুমার নাম পান? মার্কণ্ডেয় বললেন, উতঙ্ক[৯] নামে খ্যাত এক মহর্ষি ছিলেন, তিনি মরুভূমির নিকটবর্তী রমণীয় প্রদেশে বাস করতেন। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাঁকে বর দিতে চাইলে তিনি বললেন, জগতের প্রভু হরিকে দেখলাম, এই আমার পর্যাপ্ত বর। বিষ্ণু তথাপি অনুরোধ করলে উতঙ্ক বললেন, আমার যেন ধর্মে সত্যে ও ইন্দ্রিয়সংযমে মতি এবং আপনার সান্নিধ্য লাভ হয়। বিষ্ণু বললেন, এ সমস্তই তোমার হবে, তা ভিন্ন তুমি যোগসিদ্ধ হয়ে মহৎ কার্য করবে। তোমার যোগবল অবলম্বন ক’রে রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধু নামক মহাসুরকে বধ করবেন।

 ইক্ষ্বাকুর পর যথাক্রমে শশাদ কুকুৎস্থ অনেশ পৃথু বিষ্বগশ্ব অদ্রি যুবনাশ্ব শ্রাব শ্রাবস্তক (যিনি শ্রাবস্তী নগরী নির্মাণ করেছিলেন) ও বৃহদশ্ব অযোধ্যার রাজা হন। তাঁর পত্র কুবলাশ্ব। বৃহদশ্ব বনে যেতে চাইলে মহর্ষি উতঙ্ক তাঁকে বারণ ক’রে বললেন, আপনি রাজ্যরক্ষা ও প্রজাপালন করুন, তার তুল্য ধর্মকার্য অরণ্যে হতে পারে না। আমার আশ্রমের নিকটে মরুপ্রদেশে উজ্জ্বালক নামে এক বালুকাপপূর্ণ সমুদ্র আছে, সেখানে মধু-কৈটভের পুত্র ধুন্ধু নামে এক মহাবল দানব ভূমির ভিতরে বাস করে। আপনি তাকে বধ ক’রে অক্ষয় কীর্তি লাভ করুন, তার পর বনে যাবেন। বালুকার মধ্যে নিদ্রিত এই দানব যখন বৎসরান্তে নিঃশ্বাস ফেলে তখন সপ্তাহকাল ভূকম্প হয়, সূর্যের মার্গ পর্যন্ত ধূলি ওড়ে, স্ফুলিঙ্গ অগ্নিশিখা ও ধূম নির্গত হয়। রাজর্ষি বৃহদশ্ব কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমার পুত্র কুবলাশ্ব তার বীর পুত্রদের সঙ্গে আপনার প্রিয়কার্য করবে, আমাকে বনে যেতে দিন। উতঙ্ক তথাস্তু বলে তপোবনে চ’লে গেলেন।

 প্রলয়সমুদ্রে বিষ্ণু যখন অনন্ত নাগের দেহের উপর যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন তখন তাঁর নাভি হতে নির্গত পদ্মে ব্রহ্মা উৎপন্ন হয়েছিলেন। মধু ও কৈটভ নামে দুই দানব ব্রহ্মাকে সন্ত্রস্ত করলে। তখন ব্রহ্মা পদ্মনাল কম্পিত ক’রে বিষ্ণুকে জাগরিত করলেন। বিষ্ণুউ দুই দানবকে স্বাগত জানালেন। তারা হাস্য ক’রে বললে, তুমি আমাদের নিকট বর চাও। বিষ্ণু বললেন, লোকহিতের জন্য আমি এই বর চাচ্ছি—তোমরা আমার বধ্য হও। মধু-কৈটভ বললে, আমরা কখনও মিথ্যা বলি না, রূপ শৌর্য ধর্ম তপস্যা দান সদাচার প্রভৃতিতে আমাদের তুল্য কেউ নেই। তুমি অনাবৃত স্থানে আমাদের বধ কর এবং এই বর দাও যেন আমরা তোমার পুত্র হই। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। পৃথিবী ও স্বর্গে কোথাও অনাবৃত স্থান না দেখে বিষ্ণু তাঁর অনাবৃত ঊরুর উপরে মধু ও কৈটভের মস্তক সুদর্শন চক্রে কেটে ফেললেন।

 মধু-কৈটভের পুত্র ধন্ধু তপস্যা ক’রে ব্রহ্মার বরে দেব দানব যক্ষ গন্ধর্ব নাগ ও রাক্ষসের অবধ্য হয়েছিল। সে বালুকার মধ্যে লুকিয়ে থেকে উতঙ্কের আশ্রমে উপদ্রব করত। উতঙ্কের অনুরোধে বিষ্ণু কুবলাশ্ব রাজার দেহে প্রবেশ করলেন। কুবলাশ্ব তাঁর একুশ হাজার পুত্র ও সৈন্য নিয়ে ধুন্ধুবধের জন্য যাত্রা করলেন। সপ্তাহকাল বালকাসমুদ্রের সর্বদিক খনন করার পর নিদ্রিত ধুন্ধুকে দেখা গেল। সে গাত্রোত্থান করে তার মুখনির্গত অগ্নিতে কুবলাশ্বের পুউত্রদের দগ্ধ ক’রে ফেললে। কুবলাশ্ব যোগশক্তির প্রভাবে ধুন্ধুর মুখাগ্নি নির্বাপিত করলেন এবং ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ ক’রে তাকে দগ্ধ ক’রে বধ করলেন। সেই অবধি তিনি ধুন্ধুমার নামে খ্যাত হলেন।

৪৪। কৌশিক, পতিব্রতা ও ধর্মব্যাধ

 যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আপনি নারীর শ্রেষ্ঠ মাহাত্ম্য এবং সূক্ষ্ম ধর্ম সম্বন্ধে বলুন। মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি পতিব্রতার ধর্ম বলছি শোন।— কৌশিক নামে এক তপস্বী ব্রাহ্মণ ছিলেন। একদিন তিনি বৃক্ষমূলে ব’সে বেদপাঠ করছিলেন এমন সময়ে এক বলাকা (স্ত্রী-বক) তাঁর মাথার উপরে মলত্যাগ করলে। কৌশিক ক্রুদ্ধ হয়ে তার দিকে চাইলেন, বলাকা তখনই ম’রে পড়ে গেল। তাকে ভূপতিত দেখে ব্রাহ্মণ অনুতপ্ত হয়ে ভাবলেন, আমি ক্রোধের বশে অকার্য ক’রে ফেলেছি।

 তার পর কৌশিক ভিক্ষার জন্য গ্রামে গিয়ে একটি পূর্বপরিচিত গৃহে প্রবেশ ক’রে বললেন, ভিক্ষা দাও। তাঁকে অপেক্ষা করতে ব’লে গৃহিণী ভিক্ষাপাত্র পরিষ্কার করতে গেলেন। এমন সময়ে গৃহস্বামী ক্ষুধার্ত হয়ে গৃহে এলেন, সাধ্বী গৃহিণী তখন ব্রাহ্মণকে ছেড়ে পা আর মুখ ধোবার জল, আসন ও খাদ্যপানীয় দিয়ে স্বামীর সেবা করতে লাগলেন। তার পর তিনি ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণকে স্মরণ করে লজ্জিত হয়ে তাঁকে ভিক্ষা দিতে গেলেন। কৌশিক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এর অর্থ কি? তুমি আমাকে অপেক্ষা করতে ব’লে আটকে রাখলে কেন? সাধ্বী গৃহিণী বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার স্বামী পরমদেবতা, তিনি শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এসেছেন সেজন্য তাঁর সেবা আগে করেছি। কৌশিক বললেন, তুমি স্বামীকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ক’রে ব্রাহ্মণকে অপমান করলে। ইন্দ্রও ব্রাহ্মণের নিকট প্রণত থাকেন। তুমি কি জান না যে, ব্রাহ্মণ পৃথিবী দগ্ধ করতে পারেন?

 গৃহিণী বললেন, ক্রোধ ত্যাগ করুন, আমি বলাকা নই, ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আপনি আমার কি করবেন? আমি আপনাকে অবজ্ঞা করি নি, ব্রাহ্মণদের তেজ ও মাহাত্ম্য আমার জানা আছে, তাঁদের ক্রোধ যেমন বিপুল, অনুগ্রহও সেইরূপ। আপনি আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন। পতিসেবাই আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করি, তার ফল আমি কি পেয়েছি দেখুন— আপনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলাকাকে দগ্ধ করেছেন তা আমি জানতে পেরেছি। দ্বিজোত্তম, ক্রোধ মানুষের শরীরস্থ শত্রু, যিনি ক্রোধ ও মোহ ত্যাগ করেছেন দেবতারা তাঁকেই ব্রাহ্মণ মনে করেন। আপনি ধর্মজ্ঞ, কিন্তু ধর্মের যথার্থ তত্ত্ব জানেন না। মিথিলায় এক ব্যাধ আছেন, তিনি পিতা-মাতার সেবক, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। আপনি সেই ধর্মব্যাধের কাছে যান, তিনি আপনাকে ধর্মশিক্ষা দেবেন। আমার বাচালতা ক্ষমা করুন, স্ত্রী সকলেরই অবধ্য।

 কৌশিক বললেন, শোভনা, আমি প্রীত হয়েছি, আমার ক্রোধ দূর হয়েছে, তোমার ভর্ৎসনায় আমার মঙ্গল হবে। তার পর কৌশিক জনকরাজার পুরী মিথিলায় গেলেন এবং ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা ক’রে ধর্মব্যাধের নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মব্যাধ তখন তাঁর বিপণিতে ব’সে মৃগ ও মহিষের মাংস বিক্রয় করছেন, বহু ক্রেতা সেখানে এসেছে। কৌশিককে দেখে ধর্মব্যাধ সসম্ভ্রমে অভিবাদন ক’রে বললেন, এক পতিব্রতা নারী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন তা আমি জানি। এই স্থান আপনার যোগ্য নয়, আমার গৃহে চলুন। ধর্মব্যাধের গৃহে গিয়ে কৌশিক বললেন, বৎস, তুমি যে ঘোর কর্ম কর তা তোমার যোগ্য নয়। ধর্মব্যাধ বললেন, আমি আমার কুলোচিত কর্মই করি। আমি বিধাতার বিহিত ধর্ম পালন করি, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করি, সত্য বলি, অসূয়া করি না, যথাশক্তি দান করি, দেবতা অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন খাই। আমি নিজে প্রাণিবধ করি না, অন্যে যে বরাহ-মহিষ মারে আমি তাই বেচি। আমি মাংস খাই না, কেবল ঋতুকালে ভার্যার সহবাস করি, দিনে উপবাসী থেকে রাত্রে ভোজন করি। আমার বৃত্তি অতি দারুণ, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য, আমি পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ করছি। মাংসে দেবতা পিতৃগণ অতিথি ও পরিজনের সেবা হয়, সেজন্য নিহত পশুরও ধর্ম হয়। শ্রুতিতে আছে, অম্লের ন্যায় ওষধি লতা পশু পক্ষীও মানুষের খাদ্য। রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রত্যহ দু হাজার গরু পাক হ’ত। যথাবিধানে মাংস খেলে পাপ হয় না। ধান্যাদি শস্যবীজও জীব, প্রাণী পরস্পরকে ভক্ষণ ক’রেই জীবিত থাকে, মানুষ চলবার সময় ভূমিস্থিত বহু প্রাণী বধ করে। জগতে অহিংসক কেউ নেই।

 তার পর ধর্ম, দর্শন ও মোক্ষ সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিয়ে ধর্মব্যাধ বললেন, যে ধর্ম দ্বারা আমি সিদ্ধিলাভ করেছি তা আপনি প্রত্যক্ষ করুন। এই ব’লে তিনি কৌশিককে এক মনোরম সৌধে নিয়ে গেলেন, সেখানে ধর্মব্যাধের মাতা-পিতা আহারের পর শুক্ল বসন ধারণ করে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তম আসনে ব’সে আছেন। ধর্মব্যাধ মাতা-পিতার চরণে মস্তক রাখলে তাঁরা বললেন, পুত্র, ওঠ ওঠ, ধর্ম তোমাকে রক্ষা করুন। ধর্মব্যাধ কৌশিককে বললেন, এঁরাই আমার পরমদেবতা, ইন্দ্রাদি তেত্রিশ দেবতার সমান। আপনি নিজের মাতা-পিতাকে অবজ্ঞা করে তাঁদের অনুমতি না নিয়ে বেদাধ্যয়নের জন্য গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন। আপনার শোকে তাঁরা অন্ধ হয়ে গেছেন, আপনি শীঘ্র গিয়ে তাঁদের প্রসন্ন করুন।

 কৌশিক বললেন, আমি নরকে পতিত হচ্ছিলাম, তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। তোমার উপদেশ অনুসারে আমি মাতা-পিতার সেবা করব। তোমাকে আমি শূদ্র মনে করি না, কোন্ কর্মের ফলে তোমার এই দশা হয়েছে? ধর্মব্যাধ বললেন, পূর্বজন্মে আমি বেদাধ্যয়ী ব্রাহ্মণ ও এক রাজার সখা ছিলাম। তাঁর সঙ্গে মৃগয়ায় গিয়ে আমি মৃগ মনে ক’রে এক ঋষিকে বাণবিদ্ধ করি। তাঁর অভিশাপে আমি ব্যাধ হয়ে জন্মেছি। আমার প্রার্থনায় তিনি বললেন, তুমি শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ ক’রেও ধর্মজ্ঞ জাতিস্মর ও মাতা-পিতার সেবাপরায়ণ হবে, শাপক্ষয় হ’লে আবার ব্রাহ্মণ হবে। তার পর আমি সেই ঋষির দেহ থেকে শর তুলে ফেলে তাঁকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে গেলাম। তিনি মরেন নি।

 ধর্মব্যাধকে প্রদক্ষিণ করে কৌশিক তাঁর আশ্রমে ফিরে গেলেন এবং মাতাপিতার সেবায় নিরত হলেন।

৪৫। দেবসেনা ও কার্তিকেয়

 মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি এখন অগ্নিপুত্র কার্তিকেয়র কথা বলছি তোমরা শোন।— দেবগণের সহিত যুদ্ধে দানবগণ সর্বদাই জয়ী হয় দেখে দেবরাজ ইন্দ্র একজন সেনাপতির অনুসন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মানস পর্বতে স্ত্রীকণ্ঠের আর্তনাদ শুনে কাছে গিয়ে দেখলেন, কেশী দানব একটি কন্যার হাত ধ’রে আছে। ইন্দ্রকে দানব বললে, এই কন্যাকে আমি বিবাহ করব, তুমি বাধা দিও না, চ’লে যাও। তখন কেশীর সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধ হ’ল, কেশী পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেল। কন্যা ইন্দ্রকে বললেন, আমি প্রজাপতির কন্যা দেবসেনা, আমার ভগিনী দৈত্যসেনাকে কেশী হরণ করেছে। আপনার নির্দেশে আমি অজেয় পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি। ইন্দ্র বললেন, তুমি আমার মাতৃষ্বসার কন্যা। এই ব’লে ইন্দ্র দেবসেনাকে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, এক মহাবিক্রমশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে এই কন্যার পতি হবেন, তিনি তোমার সেনাপতিও হবেন।

 ইন্দ্র দেবসেনাকে বশিষ্ঠাদি সপ্তর্ষির যজ্ঞস্থানে নিয়ে গেলেন। সেখানে অগ্নিদেব হোমকুণ্ড থেকে উঠে দেখলেন, অপূর্বসুন্দরী ঋষিপত্নীগণ কেউ আসনে ব’সে আছেন, কেউ শুয়ে আছেন। তাঁদের দেখে অগ্নি কামাবিষ্ট হলেন, কিন্তু তাঁদের পাওয়া অসম্ভব জেনে দেহত্যাগের সংকল্প ক’রে বনে চ’লে গেলেন।

 দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন। তিনি মহর্ষি অঙ্গিরার ভার্যা শিবার রূপ ধ’রে অগ্নির কাছে এসে সংগম লাভ করলেন এবং অগ্নির শুক্র নিয়ে গরুড়-পক্ষিণী হয়ে কৈলাস পর্বতের এক কাঞ্চনকুণ্ডে তা নিক্ষেপ করলেন। তার পর তিনি সপ্তর্ষিগণের অন্যান্য ঋষির পত্নীরূপে পূর্ববৎ অগ্নির সঙ্গে মিলিত হলেন, কেবল বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীর তপস্যার প্রভাবে তাঁর রূপ ধারণ করতে পারলেন না। এই প্রকারে স্বাহা ছ বার কাঞ্চনকুণ্ডে অগ্নির শুক্র নিক্ষেপ করলেন। সেই স্কন্ন অর্থাৎ স্খলিত শুক্র থেকে স্কন্দ[১০] উৎপন্ন হলেন; তাঁর ছয় মস্তক, এক গ্রীবা, এক উদর। ত্রিপুরাসুরকে বধ ক’রে মহাদেব তাঁর ধনু রেখে দিয়েছিলেন, বালক স্কন্দ সেই ধনু নিয়ে গর্জন করতে লাগলেন। বহু লোক ভীত হয়ে তাঁর শরণাপন্ন হ’ল, ব্রাহ্মণরা তাঁদের ‘পারিষদ’ ব’লে থাকেন।

 সপ্তর্ষিদের ছ জন নিজ পত্নীদের ত্যাগ করলেন, তাঁরা ভাবলেন তাঁদের পত্নীরাই স্কন্দের জননী। স্বাহা তাঁদের বার বার বললেন, আপনাদের ধারণা ঠিক নয়, এটি আমারই পুত্র। মহামুনি বিশ্বামিত্র কামার্ত অগ্নির পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন সেজন্য তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন। তিনি স্কন্দের জাতকর্মাদি ত্রয়োদশ মঙ্গলকার্য সম্পন্ন ক’রে সপ্তর্ষিদের বললেন, আপনাদের পত্নীদের অপরাধ নেই; কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করলেন না।

 স্কন্দের বৃত্তান্ত শুনে দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, এর বল অসহ্য হবে, শীঘ্র একে বধ করুন; কিন্তু ইন্দ্র সাহস করলেন না। তখন দেবতারা স্কন্দকে মারবার জন্য লোকমাতা[১১]দের পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা গিয়ে বালককে বললেন, তুমি আমাদের পুত্র হও। স্কন্দ তাঁদের স্তন্য পান করলেন। সেই সময়ে অগ্নিও এলেন এবং মাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্কন্দকে রক্ষা করতে লাগলেন।

 স্কন্দকে জয় করা দুঃসাধ্য জেনেও বজ্রধর ইন্দ্র সদলবলে তাঁর কাছে গিয়ে সিংহনাদ করলেন। অগ্নিপুত্র কার্তিক সাগরের ন্যায় গর্জন ক’রে মুখনির্গত অগ্নিশিখায় দেবসৈন্য দগ্ধ করতে লাগলেন। ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলেন, কার্তিকের দক্ষিণ পার্শ্ব বিদীর্ণ হ’ল, তা থেকে বিশাখ[১২] নামে এক যুবা উৎপন্ন হলেন, তাঁর দেহ কাঞ্চনবর্ণ, কর্ণে দিব্য কুণ্ডল, হস্তে শক্তি অস্ত্র। তখন দেবরাজ ভয় পেয়ে পার্বতীর সঙ্গে কার্তিকের শরণাপন্ন হলেন এবং তাঁকে দেবসেনাপতি করলেন। মহাদেব এসে কার্তিকের গলায় দিব্য সুবর্ণমালা পরিয়ে দিলেন। দ্বিজগণ রুদ্রকে অগ্নি ব’লে থাকেন, সেজন্য কার্তিক মহাদেবেরও পুত্র, মহাদেব অগ্নির শরীরে প্রবেশ করে এই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।

 দেবগণ কর্তৃক অভিষিক্ত হয়ে কার্তিক রক্ত বস্ত্র প’রে রথারোহণ করলেন, তাঁর ধ্বজে অগ্নিদত্ত কুক্কুটচিহিতে লোহিত পতাকা কালাগ্নির ন্যায় সমুত্থিত হ’ল। ইন্দ্র দেবসেনাকে কার্তিকের হস্তে সম্প্রদান করলেন। সেই সময়ে ছয় ঋষিপত্নী এসে কার্তিককে বললেন, পুত্র, আমরা তোমার জননী এই মনে ক’রে আমাদের স্বামীরা অকারণে আমাদের ত্যাগ করেছেন এবং পুণ্যস্থান থেকে পরিচ্যুত করেছেন, তুমি আমাদের রক্ষা কর। কার্তিক বললেন, আপনারা আমার মাতা, আমি আপনাদের পুত্র, আপনারা যা চান তাই হবে।

 স্কন্দের পালিকা মাতৃগণকে এবং স্কন্দ থেকে উৎপন্ন কতকগুলি কুমার-কুমারীকে স্কন্দগ্রহ[১৩] বলা হয়, তাঁরা ষোড়শ বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নানাপ্রকার অমঙ্গল ঘটান। এইসকল গ্রহের শান্তি এবং কার্তিকের পূজা করলে মঙ্গল আয়ু ও বীর্য লাভ হয়।

 স্বাহা কার্তিকের কাছে এসে বললেন, আমি দক্ষকন্যা স্বাহা, তুমি আমার আপন পুত্র। অগ্নি জানেন না যে আমি বাল্যকাল থেকে তাঁর অনুরাগিণী। আমি তাঁর সঙ্গেই বাস করতে ইচ্ছা করি। কার্তিক বললেন দেবী, দ্বিজগণ হোমাগ্নিতে হব্য-কব্য অর্পণ করবার সময় ’স্বাহা’ বলবেন, তার ফলেই অগ্নির সঙ্গে আপনার সর্বদা বাস হবে।

 তার পর হরপার্বতী সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান রথে চ’ড়ে দেবাসুরের বিবাদস্থল ভদ্রবটে যাত্রা করলেন। দেবসেনায় পরিবৃত হয়ে কার্তিকও তাঁদের সঙ্গে গেলেন। সহসা নানাপ্রহরণধারী ঘোরাকৃতি অসুরসৈন্য মহাদেব ও দেবগণকে আক্রমণ করলে। মহিষ নামক এক মহাবল দানব এক বিপুল পর্বত নিক্ষেপ করলে, তার আঘাতে দশ সহস্র দেবসৈন্য নিহত হ’ল। ইন্দ্রাদি দেবগণ ভয়ে পলায়ন করলেন। মহিষ দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে রুদ্রের রথ ধরলে। তখন কার্তিক রথারোহণে এসে প্রজ্বলিত শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ ক’রে মহিষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। প্রায় সমস্ত দানব তাঁর শরাঘাতে বিনষ্ট হ’ল; যারা অবশিষ্ট রইল, কার্তিকের পারিষদগণ তাদের খেয়ে ফেললে। যুদ্ধস্থান দানবশূন্য হ’লে ইন্দ্র কার্তিককে আলিঙ্গন করে বললেন, মহাবাহু, এই মহিষদানব ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে দেবগণকে তৃণতুল্য জ্ঞান করত, তুমি এই দেবশত্রু ও তার তুল্য শত শত দানবকে সংহার করেছ। তুমি উমাপতি শিবের ন্যায় প্রভাবশালী, ত্রিভুবনে তোমার কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে।

  1. সমাস্যা—ধর্মতত্ত্ব, আখ্যান ইত্যাদি কথন ও শ্রবণের জন্য একত্র উপবেশন।
  2. অনেকে বৎসরের অর্থ করেন দৈব বৎসর, অর্থাৎ মানুষের ৩৬০ বৎসর।
  3. যে কালে যুগলক্ষণ ক্ষীণ হয়।
  4. যে কালে পরবর্তী যুগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
  5. অতসী বা তিসির ফুল নীলবর্ণ।
  6. বৈপিত্র ভ্রাতা। উদ্‌যোগপর্ব ১৫-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  7. এই শ্লোক ৫৭-পরিচ্ছেদও আছে।
  8. ইনিই পুরীধামের জগন্নাথ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা এই খ্যাতি আছে।
  9. এঁর কথা আশ্রমবাসিকপর্ব ৫-৬-পরিচ্ছেদে আছে।
  10. স্কন্দ, কার্তিকেয় বা কার্তিকের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিভিন্ন উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
  11. মাতৃকা, এঁরা শিবের অনুচরী।
  12. কার্তিকের এক নাম।
  13. গ্রহ—অপদেবতা।