মহাভারত (রাজশেখর বসু)/বিরাটপর্ব/পাণ্ডবপ্রবেশপর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

বিরাটপর্ব

॥ পাণ্ডবপ্রবেশপর্বাধ্যায় ॥

১। অজ্ঞাতবাসের মন্ত্রণা

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা রাজ্যত্যাগ ক’রে দ্বাদশ বৎসর প্রবাসে আছি, এখন ত্রয়োদশ বৎসর উপস্থিত হয়েছে। এই শেষ বৎসর কষ্টে কাটাতে হবে। অর্জুন, তুমি এমন দেশের নাম বল যেখানে আমরা অজ্ঞাতভাবে বাস করতে পারব। অর্জুন বললেন, যক্ষরূপী ধর্ম যে বর দিয়েছেন তার প্রভাবেই আমরা অজ্ঞাতভাবে বিচরণ করতে পারব, তথাপি কয়েকটি দেশের নাম বলছি।—কুরুদেশের চারিদিকে অনেক রমণীয় দেশ আছে, যেমন পাঞ্চাল চেদি মৎস্য শূরসেন পটচ্চর দশার্ণ মল্ল শাল্ব যুগন্ধর কুন্তিরাষ্ট্র সুরাষ্ট্র অবন্তী। এদের মধ্যে কোন্‌টি আপনার ভাল মনে হয়? যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যদেশের রাজা বিরাট বলবান ধর্মশীল বদান্য ও বৃদ্ধ, তিনি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন, আমরা এক বৎসর বিরাটনগরে তাঁর কর্মচারী হয়ে থাকব।

 অর্জুন বললেন, মহারাজ, আপনি মৃদুস্বভাব লজ্জাশীল ধার্মিক, সামান্য লোকের ন্যায় পরগৃহে কি কর্ম করবেন? যুধিষ্ঠির বললেন, বিরাট রাজা দ্যূতপ্রিয়, আমি কঙ্ক নাম নিয়ে ব্রাহ্মণরূপে তাঁর সভাসদ হব, বৈদূর্য স্বর্ণ বা হস্তিদন্ত নির্মিত পাশক, জ্যোতীরস[১] নির্মিত ফলক এবং কৃষ্ণ ও লোহিত গুটিকা নিয়ে অক্ষক্রীড়া ক’রে রাজা ও তাঁর অমাত্যবর্গের মনোরঞ্জন করব। তিনি জিজ্ঞাসা করলে বলব যে পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের প্রাণসম সখা ছিলাম। বৃকোদর, বিরাটনগরে তুমি কোন কর্ম করবে?

 ভীম বললেন, আমি বল্লব নাম নিয়ে রাজার পাকশালার অধ্যক্ষ হব, পাককার্যে নিপুণতা দেখিয়ে তাঁর সুশিক্ষিত পাচকদের হারিয়ে দেব। তা ছাড়া আমি রাশি রাশি কাঠ বয়ে আনব, প্রয়োজন হ’লে বলবান হস্তী বা বৃষকে দমন করব। যদি কেউ আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে চায় তবে তাদের প্রহার ক’রে ভূপাতিত করব, কিন্তু বধ করব না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি রাজা যুধিষ্ঠিরের হস্তী ও বৃষ দমন করতাম এবং তাঁর সূপকার ও মল্ল ছিলাম।

 যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন বললেন, আমি বৃহন্নলা নাম নিয়ে নপুংসক সেজে যাব, বাহুতে যে জ্যাঘর্ষণের চিহ্ন আছে তা বলয় দিয়ে ঢাকব, কানে উজ্জ্বল কুণ্ডল এবং হাতে শাঁখা পরব, চুলে বেণী বাঁধব, এবং রাজভবনের স্ত্রীদের নৃত্য-গীত-বাদ্য শেখাব। জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম।

 নকুল বললেন, আমি অশ্বের রক্ষা ও চিকিৎসায় নিপুণ, গ্রন্থিক নাম নিয়ে আমি বিরাটরাজার অশ্বরক্ষক হব। নিজের পরিচয় এই দেব যে পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের অশ্বরক্ষক ছিলাম।

 সহদেব বললেন, আমি তন্তিপাল নাম নিয়ে বিরাট রাজার গোসমূহের তত্ত্বাবধায়ক হব। আমি গরুর চিকিৎসা দোহনপদ্ধতি ও পরীক্ষা জানি; সুলক্ষণ বৃষও চিনতে পারি।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের এই ভার্যা প্রাণাপেক্ষা প্রিয়া, মাতার ন্যায় পালনীয়া, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় মাননীয়া। ইনি সেখানে কোন্ কর্ম করবেন? দ্রৌপদী সুকুমারী, অভিমানিনী, জন্মাবধি মাল্য গন্ধ ও বিবিধ বেশভূষায় অভ্যস্ত। দ্রৌপদী বললেন, যে নারী স্বাধীনভাবে পরগৃহে দাসীর কর্ম করে তাকে সৈরিন্ধ্রী বলা হয়। কেশসংস্কারে নিপুণ সৈরিন্ধ্রীর রূপে আমি যাব, বলব যে পূর্বে আমি দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম। রাজমহিষী সুদেষ্ণা আমাকে আশ্রয় দেবেন, তুমি ভেবো না। যুধিষ্ঠির বললেন, কল্যাণী, তোমার সংকল্প ভাল। মহৎ কুলে তোমার জন্ম, তুমি সাধ্বী, পাপকর্ম জান না। এমন ভাবে চ’লো যাতে পাপাত্মা শত্রুরা সুখী না হয়, তোমাকে কেউ যেন জানতে না পারে।

২। ধৌম্যের উপদেশ ― অজ্ঞাতবাসের উপক্রম

 পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী নিজ নিজ কর্ম স্থির করার পর যুধিষ্ঠির বললেন, পুরোহিত ধৌম্য দ্রুপদ রাজার ভবনে যান এবং সেখানে অগ্নিহোত্র রচনা করুন; তাঁর সঙ্গে সারথি, পাচক দ্রৌপদীর পরিচারিকারাও যাক। রথগুলি নিয়ে ইন্দ্রসেন প্রভৃতি দ্বারকায় চ’লে যাক। কেউ প্রশ্ন করলে সকলেই বলবে, পাণ্ডবরা কোথায় গেছেন তা আমরা জানি না।

 ধৌম্য বললেন, পাণ্ডবগণ, তোমরা ব্রাহ্মণ সুহৃদ্‌বর্গ যান অস্ত্রাদি এবং অগ্নিরক্ষা সম্বন্ধে ব্যবস্থা করলে। যুধিষ্ঠির ও অর্জুন সর্বদা দ্রৌপদীকে রক্ষা করবেন। এখন তোমাদের এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করতে হবে; তোমরা লোক ব্যবহার জান, তথাপি রাজভবনে কিরূপ আচরণ করতে হয় তা আমি বলছি।—আমি রাজার প্রিয় এই মনে ক’রে রাজার যান পর্যঙ্ক আসন হস্তী বা রথে আরোহণ করা অনুচিত। রাজা জিজ্ঞাসা না করলে তাঁকে উপদেশ দেবে না। রাজার পত্নী, যারা অন্তঃপুরে থাকে, এবং যারা রাজার অপ্রিয় তাদের সঙ্গে মিত্রতা করবে না। অতি সামান্য কার্যও রাজার জ্ঞাতসারে করবে। মতামত প্রকাশ করবার সময় রাজার যা হিতকর ও প্রিয় তাই বলবে, এবং প্রিয় অপেক্ষা হিতই বলবে। বাক্‌সংযম ক’রে রাজার দক্ষিণ বা বাম পার্শ্বে বসবে, পশ্চাদ্‌ভাগে অস্ত্রধারী রক্ষীদের স্থান। রাজার সম্মুখে বসা সর্বদাই নিষিদ্ধ। রাজা মিথ্যা কথা বললে তা প্রকাশ করবে না। আমি বীর বা বুদ্ধিমান এই ব’লে গর্ব করবে না, প্রিয়কার্য করলেই রাজার প্রিয় হওয়া যায়। রাজার সকাশে ওষ্ঠ হস্ত বা জানু সঞ্চালন করবে না, উচ্চবাক্য বলবে না, বায়ু ও নিষ্ঠীবন নিঃশব্দে ত্যাগ করবে। কৌতুকজনক কোনও আলোচনা হ’লে উন্মতের ন্যায় হাসবে না, মৃদুভাবে হাসবে। যিনি লাভে হর্ষ এবং অপমানে দুঃখ না দেখিয়ে অপ্রমত্ত থাকেন, রাজা কোনও লঘু বা গুরু কার্যের ভার দিলে যিনি বিচলিত হন না, তিনিই রাজভবনে বাস করতে পারেন। রাজা যে যান বস্ত্র ও অলংকারাদি দান করেন তা নিত্য ব্যবহার করলে রাজার প্রিয় হওয়া যায়। বৎস, যুধিষ্ঠির, তোমরা এইভাবে এক বৎসর যাপন ক’রো।

 যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি যে সদুপদেশ দিলেন তা মাতা কুন্তী ও মহামতি বিদুর ভিন্ন আর কেউ দিতে পারেন না। তার পর ধৌম্য পাণ্ডবগণের সমৃদ্ধিকামনায় মন্ত্রপাঠ ক’রে অগ্নিতে আহূতি দিলেন। হোমাগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ করে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করলেন।

 তাঁরা যমুনার দক্ষিণ তীর দিয়ে পদব্রজে চললেন। দুর্গম পর্বত ও বন অতিক্রম ক’রে দশার্ণ দেশের উত্তর, পাঞ্চালের দক্ষিণ, এবং যকৃল্লোম ও শূরসেন দেশের মধ্য দিয়ে পাণ্ডবগণ মৎস্য দেশে উপস্থিত হলেন। তাঁদের বর্ণ মলিন, মুখ শ্মশ্রুময়, হস্তে ধনু, কটিদেশে খড়্‌গ; কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, আমরা ব্যাধ। বিরাটরাজধানীর অদূরে এসে দ্রৌপদী অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লেন, যুধিষ্ঠিরের আদেশে অজুর্ন তাঁকে স্কন্ধে বহন ক’রে চলতে লাগলেন। রাজধানীতে উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা যদি সশস্ত্র হয়ে নগরে প্রবেশ করি তবে লোকে উদ্‌বিগ্ন হবে; অর্জুনের গাণ্ডীব, ধনু অনেকেই জানে, তা দেখে আমাদের চিনে ফেলবে। অর্জুন বললেন, শ্মশানের কাছে পর্বতশৃঙ্গে ওই যে বৃহৎ শমীবৃক্ষ রয়েছে তাতে আমাদের অস্ত্র রাখলে কেউ নিতে সাহস করবে না। তখন পাণ্ডবগণ তাঁদের ধনু থেকে জ্যা বিযুক্ত করলেন এবং দীর্ঘ উজ্জ্বল খড়্‌গ, তূণীর ও ক্ষুরধার বৃহৎ বাণ সকল ধনুর সঙ্গে বাঁধলেন। নকুল শমীবৃক্ষে উঠে একটি দৃঢ় শাখায় অস্ত্রগুলি এমনভাবে রজ্জুবদ্ধ করলেন যাতে বৃষ্টি না লাগে। তার পর তিনি একটি মৃতদেহ সেই বৃক্ষে বেঁধে দিলেন, যাতে পূতিগন্ধ পেয়ে লোকে কাছে না আসে। গোপাল মেষপাল প্রভৃতির প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, ইনি আমাদের মাতা, বয়স আশি বা একশ, মৃতদেহ গাছে বেঁধে রাখাই আমাদের কুলধর্ম।

 যুধিষ্ঠির নিজেদের এই পাঁচটি গুপ্ত নাম রাখলেন — জয় জয়ন্ত বিজয় জয়সেন জয়দ্‌বল। তার পর সকলে সেই বিশাল নগরে প্রবেশ করলেন।

৩। বিরাটভবনে যুধিষ্ঠিরাদির আগমন

 বিরাট রাজার সভায় প্রথমে ব্রাহ্মণবেশী যুধিষ্ঠির উপস্থিত হলেন। তাঁর রূপ মেঘাবৃত সূর্য ও ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায়, তিনি বৈদূর্যখচিত স্বর্ণময় পাশক বস্ত্রাঞ্চলে বেঁধে বাহুমূলে ধারণ ক’রে আছেন। তাঁকে দেখে বিরাট তাঁর সভাসদ্‌গণকে বললেন, ইনি কে? এঁকে ব্রাহ্মণ মনে হয় না, বোধ হয় ইনি কোনও রাজা; সঙ্গে গজ বাজি রথ না থাকলেও এঁকে ইন্দ্রের ন্যায় দেখাচ্ছে। যুধিষ্ঠির নিকটে এসে বললেন, মহারাজ, আমি বৈয়াঘ্রপদ্য-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, আমার সর্বস্ব বিনষ্ট হয়েছে, জীবিকার জন্য আপনার কাছে এসেছি। পূর্বে আমি যুধিষ্ঠিরের সখা ছিলাম। আমার নাম কঙ্ক, আমি দ্যূতক্রীড়ায় নিপুণ।

 বিরাট বললেন, যা চাও তাই তোমাকে দেব, তুমি রাজা হবার যোগ্য, এই মৎস্যদেশ শাসন কর। দ্যূতকারগণ আমার প্রিয়, আমি তোমার বশবর্তী হয়ে থাকব। যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যরাজ, এই বর দিন যেন দ্যূতক্রীড়ায় নীচ লোকের সঙ্গে আমার বিবাদ না হয়, এবং আমি যাকে পরাজিত করব সে তার ধন আটকে রাখতে পারবে না। বিরাট বললেন, কেউ যদি তোমার অপ্রিয় আচরণ করে তবে আমি তাকে নিশ্চয় বধ করব, যদি সে ব্রাহ্মণ হয় তবে নির্বাসিত করব। সমাগত প্রজাবৃন্দ শোন—যেমন আমি তেমনই কঙ্ক এই রাজ্যের প্রভু। কঙ্ক, তুমি আমার সখা এবং আমার সমান, তুমি প্রচুর পানভোজন ও বস্ত্র পাবে, আমার ভবনের সকল দ্বার তোমার জন্য উদ্‌ঘাটিত থাকবে, ভিতরে বাইরে সর্বত্র তুমি পরিদর্শন করতে পারবে। কেউ যদি অর্থাভাবের জন্য তোমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আমাকে জানিও, যা প্রয়োজন তাই আমি দান করব।

 তার পর সিংহবিক্রম ভীম এলেন, তাঁর পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র; হাতে খন্তি হাতা ও কোষমুক্ত কৃষ্ণবর্ণ অসি। বিরাট সভাস্থ লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, সিংহের ন্যায় উন্নতস্কন্ধ অতি রূপবান কে এই যুবা? ভীম কাছে এসে বিনীতবাক্যে বললেন, মহারাজ, আমি পাচক, আমার নাম বল্লব, আমি উত্তম ব্যঞ্জন রাঁধতে পারি, পূর্বে রাজা যুধিষ্ঠির আমার প্রস্তুত সূপ প্রভৃতি ভোজন করতেন। আমার তুল্য বলবানও কেউ নেই, আমি বাহুযুদ্ধে পটু, হস্তী ও সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি আপনাকে তুষ্ট করব। বিরাট বললেন, তোমাকে আমি পাকশালার কর্মে নিযুক্ত করলাম, সেখানে যেসব পাচক আছে তুমি তাদের অধ্যক্ষ হবে। কিন্তু এই কর্ম তোমার উপযুক্ত নয়, তুমি আসমুদ্র পৃথিবীর রাজা হবার যোগ্য।

 অসিতনয়না দ্রৌপদী তাঁর কুঞ্চিত কেশপাশ মস্তকের দক্ষিণ পার্শ্বে তুলে কৃষ্ণবর্ণ পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে আবৃত করে বিচরণ করছিলেন। বিরাট রাজার মহিষী কেকয়রাজকন্যা সুদেষ্ণা প্রাসাদের উপর থেকে দেখতে পেয়ে তাঁকে ডেকে আনালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ভদ্রে, তুমি কে, কি চাও? দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, রাজ্ঞী, আমি সৈরিন্ধ্রী, যিনি আমাকে পোষণ করবেন আমি তাঁর কর্ম করব। সুদেষ্ণা বললেন, ভাবিনী, তুমি নিজেই দাসদাসীকে আদেশ দেবার যোগ্য। তোমার পায়ের গ্রন্থি উচ্চ নয়, দুই উরু ঠেকে আছে, তোমার নাভি কণ্ঠস্বর ও স্বভাব নিম্ন, স্তন নিতম্ব ও নাসিকা উন্নত, পদতল করতল ও ওষ্ঠ রক্তবর্ণ, তুমি হংসগদ্‌গদভাষিণী, সুকেশী সুস্তনী। তুমি কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর ন্যায় সুদর্শনা। তুমি কে? যক্ষী দেবী গন্ধর্বী না অপ্সরা?

 দ্রৌপদী বললেন, সত্য বলছি আমি সৈরিন্ধ্রী। কেশসংস্কার, চন্দনাদি পেষণ, বিচিত্র মাল্যরচনা প্রভৃতি কর্ম জানি। আমি পূর্বে কৃষ্ণের প্রিয়া ভার্যা সত্যভামা এবং পাণ্ডবমহিষী কৃষ্ণার পরিচর্যা করতাম। তাঁদের কাছে আমি উত্তম খাদ্য ও প্রয়োজনীয় বসন পেতাম। দেবী সত্যভামা আমার নাম মালিনী রেখেছিলেন। সুদেষ্ণা বললেন, রাজা যদি তোমার প্রতি লুব্ধ না হন তবে আমি তোমাকে মাথায় ক’রে রাখব। এই রাজভবনে যেসকল নারী আছে তারা একদৃষ্টিতে তোমাকে দেখছে, পুরুষরা মোহিত হবে না কেন? এখানকার বৃক্ষগুলিও যেন তোমাকে নমস্কার করছে। সুন্দরী, তোমার অলৌকিক রূপ দেখলে বিরাট রাজা আমাকে ত্যাগ ক’রে সর্বান্তঃকরণে তোমাতেই আসক্ত হবেন। কর্কটকী (স্ত্রী-কাঁকড়া) যেমন নিজের মরণের নিমিত্তই গর্ভধারণ করে, তোমাকে আশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে সেইরূপ। দ্রৌপদী বললেন, বিরাট রাজা বা অন্য কেউ আমাকে পাবেন না, কারণ পাঁচজন মহাবলশালী গন্ধর্ব যুবা আমার স্বামী, তাঁরা সর্বদা আমাকে রক্ষা করেন। আমি এখন ব্রতপালনের জন্যই কষ্ট স্বীকার করছি। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দেন না এবং আমাকে দিয়ে পা ধোয়ান না তাঁর উপর আমার গন্ধর্ব পতিরা তুষ্ট হন। যে পুরুষ সামান্য স্ত্রীর ন্যায় আমাকে কামনা করে সে সেই রাত্রিতেই পরলোকে যায়। সুদেষ্ণা বললেন, আনন্দদায়িনী, তুমি যেমন চাও সেই ভাবেই তোমাকে রাখব, কারও চরণ বা উচ্ছিষ্ট তোমাকে স্পর্শ করতে হবে না।


 তার পর সহদেব গোপবেশ ধারণ করে বিরাটের সভায় এলেন। রাজা বললেন, বৎস, তুমি কে, কোথা থেকে আসছ, কি চাও? সহদেব গোপভাষায় গম্ভীরস্বরে উত্তর দিলেন, আমি অরিষ্টনেমি নামক বৈশ্য, পূর্বে পাণ্ডবদের গোপরীক্ষক ছিলাম। তাঁরা এখন কোথায় গেছেন জানি না, আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। যুধিষ্ঠিরের বহু লক্ষ গাভী ও বহু সহস্র বৃষ ছিল, আমি তাদের পরীক্ষা করতাম। লোকে আমাকে তন্তিপাল বলত। আমি দশযোজনব্যাপী গরুর দলও গণনা করতে এবং তাদের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলতে পারি, যে উপায়ে গোবংশের বৃদ্ধি হয় এবং রোগ না হয় তাও জানি। আমি সুলক্ষণ বৃষ চিনতে পারি যাদের মূত্র আঘ্রাণ করলে বন্ধ্যাও প্রসব করে। বিরাট বললেন, আমার বিভিন্ন জাতীয় এক এক লক্ষ পশু আছে। সেই সমস্ত পশুর ভার তোমার হাতে দিলাম, তাদের পালকগণও তোমার অধীন থাকবে।

 তার পর সভাস্থ সকলে দেখলেন, একজন রূপবান বিশালকায় পুরুষ আসছেন, তাঁর কর্ণে দীর্ঘ কুণ্ডল, হস্তে শঙ্খ ও সুবর্ণ নির্মিত বলয়, কেশরাশি উন্মুক্ত। নপুংসকবেশী অর্জুনকে বিরাট বললেন, তুমি হস্তিযূথপতির ন্যায় বলবান সুদর্শন যুবা, অথচ বাহুতে বলয় এবং কর্ণে কুণ্ডল প’রে বেণী উন্মুক্ত ক’রে এসেছ। যদি রথে চড়ে যোদ্ধার বেশে কবচ ও ধনুর্বাণ ধারণ করে আসতে তবেই তোমাকে মানাত। তোমার মত লোক ক্লীব হ’তে পারে না এই আমার বিশ্বাস। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, রাজ্যভার থেকে মুক্তি চাই, তুমিই এই মৎস্যদেশ শাসন কর।

 অর্জুন বললেন, মহারাজ, আমি নৃত্য-গীত-বাদ্যে নিপুণ, আপনার কন্যা উত্তরার শিক্ষার ভার আমাকে দিন। আমার এই ক্লীবরূপ কেন হয়েছে সেই দুঃখময় বৃত্তান্ত আপনাকে পরে বলব। আমার নাম বৃহন্নলা, আমি পিতৃমাতৃহীন, আমাকে আপনার পুত্র বা কন্যা জ্ঞান করবেন। রাজা বললেন, বৃহন্নলা, তোমার অভীষ্ট কর্মের ভার তোমাকে দিলাম, তুমি আমার কন্যা এবং অন্যান্য কুমারীদের নৃত্যাদি শেখাও। অনন্তর বিরাট রাজা অর্জুনের ক্লীবত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁকে অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিলেন। অর্জুন রাজকন্যা উত্তরা ও তাঁর সহচরীদের নৃত্য-গীতবাদ্য শিখিয়ে এবং প্রিয়কার্য ক’রে তাঁদের প্রীতিভাজন হলেন।

 তার পর আকাশচ্যুত সূর্যের ন্যায় নকুলকে আসতে দেখে মৎস্যরাজ বিরাট বললেন, এই দেবতুল্য পুরুষটি কে? এ সাগ্রহে আমার অশ্বসকল দেখছে, নিশ্চয় এই লোক অশ্বতত্ত্বজ্ঞ। রাজার কাছে এসে নকুল বললেন, মহারাজের জয় হ’ক, সভাস্থ সকলের শুভ হ’ক। আমি যুধিষ্ঠিরের অশ্বদলের তত্ত্বাবধান করতাম, আমার নাম গ্রন্থিক। অশ্বের স্বভাব, শিক্ষাপ্রণালী, চিকিৎসা এবং দুষ্ট অশ্বের সংশোধন আমার জানা আছে। বিরাট বললেন, আমার যত অশ্ব আছে সে সকলের তত্ত্বাবধানের ভার তোমাকে দিলাম, সারথি প্রভৃতিও তোমার অধীন হবে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুধিষ্ঠিরের দর্শন পেয়েছি। ভৃত্যের সাহায্য বিনা তিনি এখন কি ক’রে বনে বাস করছেন?

 সাগর পর্যন্ত পৃথিবীর যাঁরা অধিপতি ছিলেন সেই পাণ্ডবগণ এইরূপে কষ্ট স্বীকার ক’রে মৎস্যরাজ্যে অজ্ঞাতবাস করতে লাগলেন।

  1. মণিবিশেষ, bloodstone।