মহাভারত (রাজশেখর বসু)/ভীষ্মপর্ব/জম্বুখণ্ডবিনির্মাণ- ও ভূমি-পর্বাধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

ভীষ্মপর্ব

॥ জম্বুখণ্ডবিনির্মাণ- ও ভূমি-পর্বাধ্যায় ॥

১। যুদ্ধের নিয়মবন্ধন

 পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্রের পশ্চিম ভাগে সসৈন্যে পূর্বমুখ হয়ে অবস্থান করলেন। স্বপক্ষ যাতে চেনা যায় সেই উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন নিজ নিজ বিবিধ সৈন্যদলের বিভিন্ন নাম রাখলেন এবং পরিচয়সূচক আভরণ দিলেন।

 অনন্তর রথারূঢ় বাসুদেব ও ধনঞ্জয় তাঁদের পাঞ্চজন্য ও দেবদত্ত নামক দিব্য শঙ্খ বাজালেন। সেই নির্ঘোষ শুনে পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যরা হৃষ্ট হ’ল, বিপক্ষ সৈন্য ও তাদের বাহনগণ ভয়ে মলমূত্র ত্যাগ করলে। ভূমি থেকে ধূলি উঠে সর্ব দিকে ব্যাপ্ত হ’ল, কিছুই দেখা গেল না, সূর্য যেন অস্তমিত হলেন। বায়ুর সঙ্গে কাঁকর উড়ে সৈন্যগণকে আঘাত করতে লাগল। কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষের বিপুল সৈন্যসমাবেশের ফলে বোধ হ’ল যেন পৃথিবীর অন্যত্র বালক বৃদ্ধ ও স্ত্রী ভিন্ন অন্য মানুষ বা অশ্ব রথ হস্তী অবশিষ্ট নেই।

 যুদ্ধারম্ভের পূর্বে উভয় পক্ষের সম্মতিতে এইসকল নিয়ম অবধারিত হ’ল।— যুদ্ধ নিবৃত্ত হ’লে বিরোধী দলের মধ্যে যথাসম্ভব পূর্ববৎ প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপিত হবে, আর ছলনা থাকবে না। এক পক্ষ বাগ্‌যুদ্ধে প্রবৃত্ত হ’লে অপর পক্ষ বাক্য দ্বারাই প্রতিযুদ্ধ করবেন। যারা সৈন্যদল থেকে বেরিয়ে আসবে তাদের হত্যা করা হবে না। রথীর সঙ্গে রথী, গজারোহীর সঙ্গে গজারোহী, অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহী, এবং পদাতির সঙ্গে পদাতি যুদ্ধ করবে। বিপক্ষকে আগে জানাতে হবে, তার পর নিজের যোগ্যতা ইচ্ছা উৎসাহ ও শক্তি অনুসারে আক্রমণ করা যেতে পারবে, কিন্তু বিশ্বস্ত বা বিহ্বল লোককে প্রহার করা হবে না। অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত, শরণাগত, যুদ্ধে বিমুখ, অস্ত্রহীন বা বর্মহীন লোককে কখনও মারা হবে না। স্তুতিপাঠক সূত, ভারবাহক, অস্ত্র যোগানো যাদের কাজ, এবং ভেরী প্রভৃতির বাদ্যকারকে কখনও প্রহার করা হবে না।

২। ব্যাস ও ধৃতরাষ্ট্র

 ধৃতরাষ্ট্র শোকার্ত হয়ে নির্জন স্থানে পুত্রদের দুর্নীতির বিষয় ভাবছিলেন এমন সময় প্রত্যক্ষদর্শী ত্রিকালজ্ঞ ভগবান ব্যাস তাঁর কাছে এসে বললেন, রাজা, তোমার পুত্রদের এবং অন্য রাজাদের মৃত্যুকাল আসন্ন হয়েছে, তাঁরা যুদ্ধে পরস্পরকে বিনষ্ট করবেন। কালবশেই এমন হবে এই জেনে তুমি শোক দূর কর। পুত্র, যদি সংগ্রাম দেখতে ইচ্ছা কর তবে আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দেব।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ব্রহ্মর্ষিশ্রেষ্ঠ, জ্ঞাতিবধ দেখতে আমার রুচি নেই, কিন্তু আপনার প্রসাদে এই যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিবরণ শুনতে ইচ্ছা করি। ব্যাস বললেন, গবল্‌গনপুত্র এই সঞ্জয় আমার বরে দিব্যচক্ষু লাভ করবেন, যুদ্ধের সমস্ত ঘটনা এঁর প্রত্যক্ষ হবে, ইনি সর্বজ্ঞ হয়ে তোমাকে যুদ্ধের বিবরণ বলবেন[১]। ইনি অস্ত্রে আহত হবেন না, শ্রমে ক্লান্ত হবেন না, জীবিত থেকেই এই যুদ্ধ হ’তে নিষ্কৃতি পাবেন। আমিও কুরু-পাণ্ডবের কীর্তিকথা প্রচারিত করব। তুমি শোক ক’রো না, সমস্তই দৈবের বশে ঘটবে, যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে। এই যুদ্ধে মহান লোকক্ষয় হবে, আমি তার বিবিধ ভয়ংকর দুর্নিমিত্ত দেখতে পাচ্ছি। উদয় ও অস্ত কালে সূর্যমণ্ডল কবন্ধে বেষ্টিত হয়। রাত্রে বিড়াল ও শূকর যুদ্ধ করে, তাদের ভয়ংকর নিনাদ অন্তরীক্ষে শোনা যায়। দেবপ্রতিমা কম্পিত হয়, হাস্য করে, রুধির বমন করে, স্বেদাক্ত হয়, এবং ভূপতিত হয়। যিনি ত্রিলোকে সাধ্বী বলে খ্যাত সেই অরুন্ধতী (নক্ষত্র) বশিষ্ঠের দিকে পিঠ ফিরিয়েছেন। কোনও কোনও স্ত্রী চার পাঁচটি ক’রে কন্যা প্রসব করছে, সেই কন্যারা ভূমিষ্ঠ হয়েই নাচছে গাইছে আর হাসছে। বৃক্ষ ও চৈত্য প’ড়ে যাচ্ছে, আহুতির পর যজ্ঞাগ্নি থেকে দুর্গন্ধময় নীল লোহিত ও পীত বর্ণের শিখা বামাবর্তে উঠছে। স্পর্শ গন্ধ ও স্বাদ বিপরীত হচ্ছে। পক্ষীরা পক্কা পক্কা রব ক’রে ধ্বজাগ্রে ব’সে রাজাদের ক্ষয় সূচনা করছে। ধৃতরাষ্ট্র, তোমার আত্মীয় ও সুহৃদ্‌বর্গকে ধর্মসংগত পথ দেখাও, তুমি এই যুদ্ধ নিবারণে সমর্থ। জ্ঞাতিবধ অতি হীন কার্য এবং আমার অপ্রিয়, তুমি তা হতে দিও না। যাতে তুমি পাপগ্রস্ত হবে তেমন রাজ্যে তোমার কি প্রয়োজন? পাণ্ডবরা তাদের রাজ্য লাভ করুক, কৌরবরা শান্ত হ’ক।

 ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পিতা, মানুষ স্বার্থের জন্য মোহগ্রস্ত হয়, আমিও মানুষ মাত্র। আমার অধর্মে মতি নেই, কিন্তু পুত্রগণ আমার বশবর্তী নয়। আপনি আমার উপর প্রসন্ন হ’ন। ব্যাস বললেন, রাজা, সাম ও দান নীতিতে যে জয়লাভ হয় তাই শ্রেষ্ঠ, ভেদের দ্বারা যা হয় তা মধ্যম, এবং যুদ্ধ দ্বারা যা হয় তা অধম। সেনার বাহুল্য থাকলেই জয়লাভ হয় না, জয় অনিশ্চিত এবং দৈবের বশেই ঘটে। যাঁরা পূর্বে বিজয়ী হন তাঁরাই আবার পরে পরাজিত হন।

৩। সঞ্জয়ের জীববৃত্তান্ত ও ভূবৃত্তান্ত কথন

 ব্যাসদেব চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, রাজারা ভূমি অধিকারের জন্যই যুদ্ধ করেন, অতএব ভূমির বহু গুণ আছে। আমি তা শুনতে ইচ্ছা করি।

 সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আমার যা জানা আছে তা বলছি। জগতে দুই প্রকার ভূত (জীব) আছে, জঙ্গম ও স্থাবর। জঙ্গম ভূত ত্রিবিধ—অণ্ডজ স্বেদজ ও জরায়ুজ; এদের মধ্যে জরায়ুজই শ্রেষ্ঠ, আবার জরায়ুজের মধ্যে মানুষ ও পশু শ্রেষ্ঠ। সিংহ ব্যাঘ্র বরাহ মহিষ হস্তী ভল্লুক ও বানর—এই সপ্ত প্রকার বন্য জরায়ুজ। গো ছাগ মেষ মনুষ্য অশ্ব অশ্বতর ও গদর্ভ—এই সপ্ত প্রকার গ্রাম্য জরায়ুজ। গ্রাম্য জীবদের মধ্যে মানুষ এবং বন্য জীবদের মধ্যে সিংহ শ্রেষ্ঠ। সমস্ত জীবই পরস্পরের উপর নির্ভর করে। উদ্‌ভিজ্জ সকল স্থাবর, তাদের পঞ্চ জাতি—বৃক্ষ গুল্ম লতা বল্লী ও ত্বক্‌সার তৃণ। চতুর্দশ জঙ্গম ভূত, পঞ্চ স্থাবর ভূত, এবং পঞ্চ মহাভূত — এই চতুর্বিংশতি পদার্থ গায়ত্রীর তুল্য। যিনি এই গায়ত্রী যথার্থরূপে জানেন তিনি বিনষ্ট হন না। সমস্তই ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে ভূমিতেই বিনাশ পায়, ভূমিই সর্ব ভূতের পরম আশ্রয়। যার ভূমি আছে সে স্থাবরজঙ্গমের অধিকারী, এই কারণেই রাজারা ভূমির লোভে পরস্পরকে হত্যা করেন।

 তার পর সঞ্জয় ভূমি জল বায়ু অগ্নি ও আকাশ এই পঞ্চ মহাভূত এবং তাদের গুণাবলী বিবৃত ক’রে সুদর্শন দ্বীপ বা জম্বু দ্বীপের কথা বললেন। জম্বু দ্বীপে ছয় বর্ষপর্বত আছে, যথা—হিমালয় হেমকূট নিষধ নীল শ্বেত ও শৃঙ্গবান। এই সকল বর্ষপর্বত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এবং উভয় প্রান্তে সমুদ্রে অবগাহন ক’রে আছে। এদের মধ্যে মধ্যে বহু সহস্র যোজন বিস্তৃত পুণ্য জনপদসমূহ আছে, তাদের নাম বর্ষ। হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতবর্ষ, উত্তরে কিম্পুরুষগণের বাসভূমি হৈমবতবর্ষ। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। নিষধ পর্বতের উত্তরে এবং নীল পর্বতের দক্ষিণে মাল্যবান পর্বত। মাল্যবানের পর গন্ধমাদন, এবং এই দুই গিরির মধ্যে কনকময় মেরু পর্বত। মেরু পর্বতের চার পার্শ্বে চার দ্বীপ (মহাদেশ) আছে—ভদ্রাশ্ব কেতুমাল জম্বুদ্বীপ ও উত্তরকুরু। নীল পর্বতের উত্তরে শ্বেতবর্ষ, তার পর হৈরণ্যকবর্ষ, এবং তার পর ঐরাবতবর্ষ। দক্ষিণে ভারতবর্ষ এবং উত্তরে ঐরাবতবর্ষ—এই দুইএর মধ্যে ইলাবৃত সমেত পাঁচটি[২] বর্ষ।

 অন্যান্য বর্ষের বর্ণনা ক’রে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, ভারতবর্ষে সাতটি কুলপর্বত আছে, যথা—মহেন্দ্র মলয় সহ্য শক্তিমান ঋক্ষবান বিধ্য ও পারিপাত্র। গঙ্গা সিন্ধু সরস্বতী গোদাবরী নর্মদা শতদ্রু বিপাশা চন্দ্রভাগা ইরাবতী বিতস্তা যমুনা প্রভৃতি অনেক নদী আছে, এই সকল নদী মাতৃতুল্য ও মহাফলপ্রদ। ভারতে বহু দেশ আছে, যথা—কুরুপাঞ্চাল শাল্ব শূরসেন মৎস্য চেদি দশার্ণ পাঞ্চাল কোশল মদ্র কলিঙ্গ কাশী বিদেহ কাশ্মীর সিন্ধু সৌবীর গান্ধার প্রভৃতি, দক্ষিণে দ্রবিড় কেরল কর্ণাটক প্রভৃতি এবং উত্তরে যবন চীন কাম্বোজ হূণ পারসীক প্রভৃতি ম্লেচ্ছ জাতির দেশসমূহ। কুকুর যেমন মাংসখণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, রাজারাও তেমনি পরস্পরের ভূমি হরণ করেন, কিন্তু এ পর্যন্ত কারও কামনার তৃপ্তি হয় নি।

 তার পর সঞ্জয় চতুর্যুগ, শাক কুশ শাল্মলি ও ক্রৌঞ্চ দ্বীপের বৃত্তান্ত, এবং রাহু ও চন্দ্রসূর্যের পরিমাণ বিবৃত ক’রে বললেন, মহারাজ, আমরা যেখানে আছি এই দেশই ভারতবর্ষ, এখান থেকেই সর্বপ্রকার পুণ্যকর্ম প্রবর্তিত হয়েছে।

  1. সঞ্জয় বক্তা এবং ধৃতরাষ্ট্র শ্রোতা—এইভাবে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের সমগ্র ঘটনা মহাভারতে বিবৃত হয়েছে।
  2. হৈমবত হরি ইলাবৃত শ্বেত ও হৈরণ্যক।